1 of 2

অলৌকিক জলযান – ২৫

।। পঁচিশ।।

—ম্যান, দৌড়ে কোথায় যাচ্ছিলে?

—টুইন ডেকে স্যার।

–ডেবিড পাখিটাকে একেবারে মেরে ফেলেছে?

—হ্যাঁ স্যার।

—ভাল করে নি।

—না স্যার, ডেবিড ভাল করে নি।

—ম্যান, জ্যাক তোমাকে কিছু বলেছে?

—না স্যার।

—ম্যান, তুমি জ্যাকের সঙ্গে মিশবে না।

ছোটবাবু কিছু বলল না। সে নামছে। সিঁড়ি ধরে নিচে নামছে। ক্রমে নিচে নেমে যাচ্ছে। সিলেণ্ডারের কাছে এসে নিচে নেমে আর্চি হিপ-পকেট থেকে দু-ব্যাটারীর একটা টর্চ বের করছে। ওয়াচের সময় আর্চির হিপ-পকেটে টর্চটা থাকে। ওয়াচের এনজিনিয়াররা টর্চটা না থাকলে কাজ করতে পারে না। আর্চিও পারে না।

টর্চ বের করতেই বুঝল, আর্চি তাকে ট্যাঙ্ক টপের নিচে ফের নামাবে। ওর কথাবার্তা শুনে মনে হয়েছিল, আর্চি ওর সঙ্গে বেশ ভাল ব্যবহার করছে। আর্চি আজ পর্যন্ত তার সঙ্গে এতগুলো কথা একসঙ্গে কখনও বলে নি। যদিও আর্চি ওকে নাম ধরে ডাকে না, অথবা ছ’ নম্বর বলতেও তার বাধে—এক ধরনের অবজ্ঞা ওর কথাবার্তায়, এবং এই যে ম্যান বলে ওকে সম্বোধন করছে, এটা ভীষণ অপমানের। এ-সব অবজ্ঞা ছোটবাবু গায়ে মাখে না। সে জানে, সেকেণ্ড এনজিনিয়ার এ-জাহাজে না থাকলে কাপ্তান অসহায় বোধ করবেন। কেউ এ-জাহাজে আসতে চায় না। ইচ্ছে থাকলেও কাপ্তান, একজন চিফ-এনজিনিয়ার জাহাজে এখন আর তুলে আনতে পারবেন না। টুয়েন্টি-ওয়ান বারি স্ট্রীট লণ্ডনে খবর গেলেও কিছু করা যাবে না। জাহাজের নাম শুনলেই সবাই সিক-লিভ নিয়ে বসে থাকবে। নামতে নামতে ছোটবাবুর এ-সব মনে হচ্ছিল। যত নিচে নেমে যাচ্ছিল তত দেখতে পাচ্ছে আর্চি টর্চটা হাতে দোলাচ্ছে। জ্যাকের সঙ্গে মিশতে বারণ করছে আর্চি। সে উত্তর দেয় নি। ওর হাতের টর্চ দুলছে তেমনি। সেই ঘণ্টা বাজানোর মতো। যেন ঘণ্টা দুলছে। আর্চিকে সেই জলদস্যুর মতো দেখাচ্ছে। ঘণ্টার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে তরবারী। ঠিক ঠিক জবাব না দিলেই ঘণ্টা তরবারির আঘাতে নামিয়ে দেবে। পাহাড় থেকে ঘণ্টাটা ছিটকে সমুদ্রের জলে পড়ে যাবে।

ছোটবাবু শুধু অনুসরণ করছে। আর্চির পেছনে পেছনে যাচ্ছে। ওর নাকের কাছে আর্চির মাথা। গায়ে আর্চির সাদা বয়লার স্যুট, গলা থেকে পা পর্যন্ত একটাই পোশাক। ঢোলা। গত রাত্রে জ্যাকের সঙ্গে কিছু একটা মনোমালিন্য হতে পারে। আর্চি হয়তো ওকে পক্ষে টানতে চায়। আর্চিকে বলতে পারত, জ্যাক বুঝি এবার আপনার পেছনে লেগেছে! সে বলতে পারল না কারণ এত বড় কথা সে আর্চির মুখের ওপর বলতে সাহস পায় না। আর এত লম্বা কথা সে বলতে গেলে তোতলাতে থাকবে। সেজন্য সে কিছু না বলে চুপচাপ নেমে যেতে থাকল।

আর্চি নিচে নেমে লগ-বুক খুলে কি দেখল। বোধ হয় ওকে সময় দিচ্ছে। ম্যান তুমি ভেবে দ্যাখো কার পক্ষ নেবে। ছোটবাবুর এমন মনে হতেই বলল, আমাকে ক্ষমা করবেন স্যার। কাল রাতে আমি ঠিক না বুঝে ছুটে গেছিলাম।

আর্চি বুঝতে পারল না, এই নেটিভ-ইণ্ডিয়ানটি তাকে যথার্থ কি বলতে চায়। ছুটে গিয়ে তুমি ঠিক কর নি, সে বলতে পারত। কিন্তু এখন আর্চি বুঝতে পারছে, এ-সবের কোন দাম নেই। ম্যানের প্রতি জ্যাকের অনুরাগ—তাকে পাগলা করে দিচ্ছে। আর্চি আয়নায় দেখেছিল—তার যৌবন অটুট। সে এ-বয়সের মেয়েদের খেতে বেশী পছন্দ করে। এবং জ্যাকের বয়সের কিছু মেয়ে, যেমন জেনি, যেমন ওয়ালা মাত্র ফুটে ওঠা ফুলের কিছু মুখ পরপর চোখের ওপর ভেসে উঠতেই বুঝতে পারল, জ্যাককে তার ভীষণ দরকার। সমুদ্রে এখন জাহাজ ডুবি হলেও কিছু আসে যায় না। কাল হাতাহাতি করতে গিয়ে জ্যাকের আধ ফোটা স্তনে হাত লেগে গেছে। যতই শক্ত করে বেঁধে রাখুক, সে একেবারে নিশ্চিত হয়ে গেছে—জ্যাক মেয়ে। কাপ্তান এতগুলো ক্ষুধার্ত বাঘের মুখ থেকে তাঁর মেয়েকে রক্ষা করার একমাত্র এটাই উপায় ভেবেছেন।

ছোটবাবু দেখল, ঠিক স্টাবোর্ড-সাইডের বয়লারের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে আর্চি। সে তার পেছনে দাঁড়িয়ে। যা বলবে, এখন তাকে তাই করতে হবে। কি করবে, সে বুঝতে পারছে না। ওপর থেকে ঝুরঝুর করে ছাই মাথায় মুখে পড়ছে। আর্চির মাথায় একটা গোলমতো টুপি। সে সাধারণত এ- ধরনের টুপি পরে না। কোথাও কোনো গোলমেলে কাজ থাকলে এটা পরে নেয় সে। সুতরাং ছোটবাবু বুঝতে পারছে, তাকে একেবারে খোলের নিচে নামিয়ে কিছু করাবে। নিচে নামতে সবার ভয়। জাহাজের জং-ধরা পাইপ, জং-ধরা স্কাম বকস জলের নিচে হয়তো বুক-সমান জলের নিচে রয়েছে। খুঁজে বের করতে হবে স্কাম-বকস। জলের নিচে ডুবে নাট-বোল্ট খুলে আনতে হবে। নতুবা এখানে আর্চির দাঁড়িয়ে থাকার কোন মানে হয় না।

আর্চি টর্চ মেরে চারপাশটা দেখছে। ছোটবাবু এতদিন জাহাজে কাজ করেছে জানেই না, জাহাজের এমন একটা জায়গা স্টাবোর্ড-সাইডের বয়লারটা তার পেটের নিচে লুকিয়ে রেখেছে। সে দেখল, অনেক উঁচুতে বয়লারের পেট, গড়িয়ে ওপরে উঠে গেছে। ছাই জমে জমে বয়লারের প্লেটে একটা পলেস্তারা পড়ে গেছে। একটু নড়লেই কুয়াশার মতো ছাই—চারপাশে শুধু ছাই, কিছু ভাঙ্গা র‍্যাগ স্লাইস, ব্যালচে ডাঁই মারা এবং মনে হয় এখন এটা একটা বিরাট উই-এর ঢিবি।

আর্চি তখন টর্চের আলো ঘুরিয়ে এনে ঢিবিটার ওপরে ফেলল। গলার স্বর ভীষণ ঠাণ্ডা। সে বলল, এগুলো স্টোক-হোলডে নিয়ে যাবে।

ছোটবাবু হাত ঢুকিয়ে দিতেই ফুল-ঝুরির মত ছাই চারপাশে ফুর ফুর করে উড়তে থাকল। অর্থাৎ ছোটবাবু আর্চিকে যাবার পর্যন্ত সময় দেয় নি। সে হামলে প্রায় ফুটখানেক নিচ থেকে একটা ভাঙা ব্যালচে তুলে আনল। সঙ্গে সঙ্গে চারপাশের ছাই উড়ে উড়ে একেবারে জায়গাটা অন্ধকার হয়ে গেল। পেছনের দিকে দরজা ঠেলে দিতেই সে দেখল সারেঙ স্টোক-হোলডে দাঁড়িয়ে আছেন।

সারেঙ সাব বুঝতে পারলেন ছেলেকে তার আর্চি অনর্থক অত্যাচার করছে। স্টিমের খুব একটা মারামারি নেই। দুজন ফায়ারম্যান নিয়ে সারেঙ নিজে এগিয়ে গেলেন—বললেন, তুই বেরিয়ে আয়। আমরা করে দিচ্ছি।

ছোটবাবু বলল, না চাচা। এটা ঠিক হবে না। সে এসে যদি দেখে তোমরা আমার সঙ্গে হাত লাগিয়েছ তবে আরও ক্ষেপে যাবে। বলে সে নাকে মুখে রুমাল বেঁধে নিল। কেউ কিছু দেখতে পাচ্ছে না। সেই কুয়াশার মতো অন্ধকার কারো কথা কানেও যাচ্ছে না। কারণ এনজিনের অতিকায় ঝমঝম শব্দের সঙ্গে সে চিৎকার করে কথা বলছিল, আর ফুরফুর করে ছাই অনবরত শ্বাস প্রশ্বাসের সঙ্গে ফুসফুসে ঢুকছে বের হয়ে আসছে—সারেঙ বুঝতে পারলেন—এভাবে আর কিছুক্ষণ ভেতরে থাকলে শ্বাস বন্ধ হয়ে মরে যাবে ছেলেটা। তিনি তাড়াতাড়ি বালতি বালতি জল সেখানে ঢেলে দিলেন। দেখলেন, গুঁড়ো গুঁড়ো বৃষ্টির মতো ছাই ক্রমে হাওয়ায় থিতিয়ে আসছে। তখন এনজিনের দিক থেকে মাইজলা মিস্ত্রি এগিয়ে আসছে। রাগী চোখ। সারেঙ নিজেও এ-চোখকে সমীহ করেন। কারণ নলিতে মাইজলা মিস্ত্রি ভাল-মন্দ লিখবে—তারপর কেন জানি মনে হয় বয়েস হয়ে গেছে। সিউল-ব্যাঙ্ক জাহাজ থাকলে তিনি থাকবেন, না থাকলে তাঁকেও আর দশজন সারেঙের মতো মাথা নিচু করে রাখতে হবে—তিনি একেবারে পরোয়া না করে ছোটবাবুর সঙ্গে হাত লাগিয়ে কাজটা করে ফেললেন। এ-কাজগুলো সাধারণ কোলবয়দের কাজ। জল মেরে সারেঙ ঠিকঠাক করে দিলে তবে এ-সব টেনে বের করা যায়।

আর্চির চোখ দুটো শয়তানের মতো ঘুরছে। ছোটবাবুকে জব্দ করার জন্য যেন পাষাণ ভার চাপিয়ে দেখা, কতটা সহ্য করার ক্ষমতা। ছোটবাবু কাজ সেরে যখন বের হতে যাবে, তখন ওকে আর চেনা যায় না। মুখে শরীরে শুধু ছাই আর ছাই, এরই ভেতরে চোখ দুটো লাল রক্তবর্ণ, তখনই ফের সেই ঠাণ্ডা গলা, ম্যান তুমি ভীষণ সাহসী। তুমি পারবে।

তারপর ছোটবাবু দেখল সেই টর্চ ফের দুলছে। ঝড় উঠলে যেমন ঘণ্টাটা পাহাড়ের ওপর দুলে দুলে সতর্ক করে দিত, সামনে মৃত্যুর বিভীষিকা, এখনও সময় আছে কোর্স পাল্টে দাও, তেমনি টর্চ দোলাচ্ছে আর্চি।

ছোটবাবু দাঁড়িয়ে থাকল। এই অকারণ টর্চার কেন যে করছে আৰ্চি!

আর্চি কাছে এসে মুখ উঁচু করে দেখল ছোটবাবুকে। তারপর দু’ পাটির দাঁত শক্ত করে বলল, জ্যাক কিছু বলে নি!

—না, বলে নি।

আর্চি বিশ্বাস করতে পারল না। ম্যানের মুখে চুমো খেয়েছে জ্যাক। সে পোর্ট-হোলে দাঁড়িয়ে দেখেছে। না, ঠিক পোর্ট-হোল থেকে বললে ঠিক হবে না, আসলে সেও নেশার ঘোরে চুপি চুপি ডেকে বের হয়ে গেছিল এবং উইণ্ড-সেলের আড়াল থেকে দেখেছে, জ্যাক পাগলের মতো চুমো খাচ্ছে।

সুতরাং ছোটবাবুর মুখ দেখেও আর্চি বিশ্বাস করতে পারল না, জ্যাক গত রাতের ঘটনা না বলে থাকবে। জ্যাক তার বাবাকে বলতে সাহস পাবে না, কারণ সে তাকে ভয় দেখিয়ে রেখেছে—কিন্তু ছোটবাবু। এবং যখন সে জ্যাককে টেনে নেবার চেষ্টা করেছিল কেবিনের ভেতরে তখন একমাত্র জ্যাক আর্ত গলায় ছোটবাবু, ছোটবাবু বলে চেঁচাচ্ছিল। এ-সব কারণে আর্চির ভেতরে রক্ত টগবগ করে ফুটছে। ক্রমশ এক বিদ্বেষ, ঈর্ষা ছোটবাবুর প্রতি। ছোটবাবুর চোখ রক্তবর্ণ, এবং এটা আর্চির কাছে শয়তানের চোখের মতো। সে না পেরে আবার টর্চ দোলাতে দোলাতে এক জায়গায় থামিয়ে দিল।—ওখানে। ওখানে নেমে যাও। হেল!

ছোটবাবু ঠিক টর্চের আলোতে পায়ে পায়ে যেখানে গিয়ে দাঁড়াল সেটা সেই ঢিবির নিচে ভাঙ্গা লোহার একটা পাটাতন। একটা রোগা মানুষ ঢোকার মত ফাঁক রয়েছে। আর্চি আলো দুলিয়ে নিচে নামতে বলছে ছোটবাবুকে।

ছোটবাবু প্রথম দুটো পা নামিয়ে দিল। সে ধীরে ধীরে দু’পা, তারপর ভাঙ্গা প্লেট বলে, ধারালো অংশে পা লেগে সামান্য কেটে যাচ্ছে—খুব সাবধানে সে জানে গোটা শরীরটা এই হোলের ভেতর দিয়ে নামিয়ে দিতে হবে। নিচে কি অন্ধকার! ঠিক হাতের কাছে একটা রবারের তারে মোড়া ল্যাম্প। সেটা নিয়ে ঠিক খাদের অতলে নেমে যাবার মতো। এবং কাপ্তানের কথা মনে হচ্ছে তার। উত্তেজিত হলে চলবে না। মাথা ঠাণ্ডা রেখে কাজ করে যেতে হবে—কারণ এ-দিকটায় আর বাতিল ব্যালেস্ট পাম্প জল তুলে ফেলতে পারছে না—ব্যালেস্ট-পাম্পের সমস্ত শক্তি নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। তবু স্কাম- বকস যেন কত পুরাকালে এখানে কেউ এটা ফিট করে রেখে গেছে, তারপর আর মেরামত হয় নি। জাহাজের সব তেলকালি জল, পচা দুর্গন্ধ সব একাকার হয়ে জায়গাটা কৃমির বাসস্থানের মতো হয়ে আছে। ছোটবাবু কিছুটা নেমেই গলার কাছে আটকে গেল। প্রায় বঁড়শিতে ঝোলার মতো—ওর পা হাটু কোমর জলে ডুবে আছে। মুখটা কিছুতেই টেনে নামাতে পারছে না। গলার কাছে প্লেটে আটকে গেছে। আর্চির পায়ের ডগা ওর নাকের কাছে। মনে হচ্ছে ছোটবাবুর মাথা ভেতরে না ঢুকলে, মাথায় দু পা জড়ো করে উঠে দাঁড়াবে আর্চি। এবং তা হলেই হড়হড় করে নিচে ঢুকে যাবে মাথাটা।

আবার নাকের ডগায় টর্চ দোলাতে থাকল। সেই এ্যাবট অফ এ্যাবটব্রথকের ঘণ্টা এবারে একেবারেই কেটে দেবে। তরবারীর মতো টর্চটা চোখের সামনে দুলছে। দুলতে দুলতে থেমে যাচ্ছে। তারপর চিৎকার, স্কাউন্ডেল।

ছোটবাবু বুঝতে পারছে না, অকারণ ওকে স্কাউড্রেল বলছে কেন! সে তো অনেক চেষ্টা করেও মাথাটা গলাতে পারছে না। সে তো ইচ্ছে করে মাথা বের করে রাখেনি। মাথাটা ঢুকিয়ে নিতে পারলেই সে ডুবে ডুবে সেই স্কাম বকসটা খুঁজে বের করতে পারবে। তারপর ডুবে ডুবে নাট-বোল্ট খুলে স্কাম বকস খুলে ফেলবে। ভেতরটা পরিষ্কার করে ফেললেই ব্যালেস্ট পাম্প এদিকে এই বুকসমান উঁচু জলটা সমুদ্রে ফেলে দিতে পারবে। বন্দরের জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। কিন্তু আর্চি যেভাবে গোয়ার্তুমি করছে সে যে এখন কি করে!

তখনই আর্চি প্রায় নাকের ডগায় পা রেখে বলল, কি বলছি শুনতে পাচ্ছ?

—না স্যার! আসলে তো ওকে কিছুই বলেনি এখনও।

—জ্যাকের সঙ্গে মিশবে না।

—মিশব না স্যার।

—কথা বলবে না।

—বলব না স্যার।

—যা বলব ঠিক ঠিক তাই করবে।

—করব স্যার।

আর তখনই মাথাটা ঠিক কি করে যে হড়কে গেল। কানের নিচে সামান্য কেটে গেছে। জ্বলছে। পায়ের খানিকটা অংশ ছুলে গেছে। নোনা জল থাকায় ভীষণ জ্বলছে। সে এবার হাত বাড়িয়ে বলল, স্প্যানার হাতুড়ি দিন।

আর্চি বলল, উঠে এস।

কিন্তু স্যার? ছোটবাবু বাকিটা বলতে পারছে না। ঠিক আলাদিনের দৈত্যের মতো ওপরে বসে রয়েছে আর্চি। সে নিচে। তারের বাতিটা আর্চির হাতে। ওটা ধরে রাখলে, আর স্প্যানার দিলে সে ঠিক স্কামবকসটা খুঁজে বের করতে পারবে। যখন তখন নামা যাবে না। যখন নামা গেছে তখন কাজটা করে ফেলা দরকার। সে হাত দিয়ে জলে ঢেউ দিল। অন্ধকারে খোলের গায়ে জলের ঢেউ আছড়ে পড়ছে। সে উঠে দাঁড়ালে ঝুপ ঝুপ জলের শব্দ এবং জলে সাঁতার কাটলে যেমন জলের তরঙ্গ চারপাশে ঘুরে ঘুরে ছড়িয়ে যায়, এও ঠিক তেমনি। ছোটবাবু বুঝতেই পারছে না,, স্প্যানার হাতুড়ি আর্চি দিচ্ছে না। কেন। ওকে উঠে আসতে বলছে। ছোটবাবু ভাবল আর্চি আসলে মাথা খারাপ লোক। সিউলি-ব্যাংক জাহাজে যখন সে ছ’ নম্বর তখন সেকেণ্ড এনজিনিয়ারের নাট-বোল্ট একটু লুজ থাকবে সে আর বেশী কি। কথামতো সে না উঠলে আবার হয়তো মা-মাসী তুলে খিস্তি জুড়ে দেবে। সুতরাং সে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে মাথাটা কোন রকমে ওপরে গড়িয়ে দিল। তারপর একটা হাত, তারপর কাত হয়ে আর একটা হাত, এবং বুকসমান ওপরে উঠে এল প্রায়। সে তার শরীর এবার নিচে থেকে ওপরে তুলে অনতে পারল। জামা-প্যান্ট জবজবে ভিজে, নোংরা তেলকালি এবং জলে দুর্গন্ধময় শরীর। এখন সে ইচ্ছে করলেই ওপরে উঠে যেতে পারে না। আর্চি তারপর ফের কি বলবে, কে জানে!

আর্চি বলল, ম্যান তোমার ছুটি!

ছুটি! তাকে কি বলছে আর্চি! আর্চি সামান্য হাসল পর্যন্ত। আর্চির চোয়াল চৌকো এবং হাসলে দাবার ছকের মতো মুখটা মনে হয়—কোন ঘরে কি চাল আছে পাকা দাবাড় না হলে বোঝা মুশকিল। ছোটবাবু তো কিছুই বুঝছে না। সে দাঁড়িয়ে আছে। কারণ ছুটি বললেই ছুটি হয়ে যায় না, আসলে সে আবার একটা র‍্যাগিং-এর ভেতরে পড়ে গেছে। সেই টি এস ভদ্রা জাহাজে যেমন সিনিয়ার ট্রেনিজরা জুনিয়রদের ওপর অকারণ টরচার করত—এখানেও এই মেজ-মিস্ত্রি আর্চি তাকে নিয়ে যা খুশী করছে। সে জানত, কোনো নালিশ চলবে না।

এবং সে এজন্যই ছুটি কথাটা বুঝতে পারেনি। ছুটি কথাটার যথার্থ মানে কি সে যেন ভুলে গেছে! এবং ওর মনে হচ্ছিল ছুটি বললেই সে দৌড়ে উঠে যাবে, আর তখন ধাঁই করে পাছায় লাথি মারবে আর্চি। সে উপুড়ে হয়ে পড়তে পারে ভয়ে, ছুটি বলা সত্ত্বেও দাঁড়িয়ে থাকল। মেজ-মিস্ত্রি ওর সামনে থেকে সরে না যাওয়া পর্যন্ত সে যাচ্ছে না। অথবা সে যখন দেখল মেজ-মিস্ত্রি কিছুতেই নড়ছে না, তখন পাশ কাটিয়ে, একেবারে এক দৌড়। এবং ঠিক ওপরে সিলেণ্ডারের সিঁড়িতে এসে থামল। একটু তেলজুট চেয়ে নিতে হবে। মুখে হাতে পিঠে সব কাদার মতো তেল-কালি। সে এই শরীরে এখন কারপেটের ওপর হেঁটে গেলে সব নোংরা হয়ে যাবে। সে কশপের কাছ থেকে বেশি করে তেলজুট নিয়ে নিল।

তারপর যা হয়, সিলেণ্ডারে পাশে লম্বা লোহার জালি, জালিতে বসে ঘসে পা হাত মুখ সাফ করে ফেলল। নিচে বোধহয় আর্চির ওয়াচ শেষ। ফোর্থ নেমে আসছে। ফোর্থ নেমে এলেই আৰ্চি উঠে যাবে। আর্চির সঙ্গে আবার দেখা হবে ভাবতেই সে আর সেখানেও বসল না। একেবারে দু- লাফে ওপরে উঠে গেল। ওপরে উঠেই অবাক! পোর্ট-সাইডে ঠিক তিন নম্বর ফল্কার পাশে বড় বড় কাঠ এনে ফেলছে ডেক জাহাজিরা। লম্বা কাঠ চিরে ফেলা হচ্ছে। কেন এসব হচ্ছে ছোটবাবু বুঝতে পারছে না। মৈত্রদা অমিয় নেই। ওদের হয়তো এখন ওয়াচ। সে একটু এগিয়ে গেল। সে তাড়াতাড়ি মরা পাখিটাকে দেখবে বলে দু-লাফে ফল্কায় উঠে গেল। এবং পাখিটার পাশে দেখল, জ্যাক দাঁড়িয়ে। সে আর জ্যাকের সঙ্গে কথা বলতে পারে না। জ্যাক তবু ছোটবাবুকে দেখছে। আর্চি ছোটবাবুকে খোলের ভেতর ফের ঢুকিয়ে দিয়েছিল। কষ্টে জ্যাক তাকাতে আর সাহস পাচ্ছিল না। সে মাথা নিচু করে রেখেছে। পাখিটার পাশে দাঁড়িয়ে। সব কাজের যেন তদারক করার ভার তার ওপর – ছোটবাবুর দিকে তাকালেই সে নড়তে পারবে না। আর্চির কথা মনে হলে চোখে আগুন জ্বলতে থাকে—এখন সে সেজন্য হাই করে ডাকল, কার্পেন্টার

কার্পেন্টার ছুটে আসছে।

সে আবার ডাকছে, কশপ।

ডেক-কশপ ছুটে আসছে।

সে ডাকছে, সারেঙ।

ডেক সারেঙ ছুটে এসে সালাম জানাচ্ছে।

সে এমন কি তার বাবাকে টানতে টানতে নিয়ে এল। ডেবিড এবং রেডিও-অফিসার আরও যারা আছে তাদেরও ডেকে নিলে হয়—কারণ এখন একটা কফিন তৈরি হচ্ছে জাহাজে। বড় বড় ফালা কাঠে হাতুড়ি ঠুকছে, পেরেক মারছে কার্পেন্টার। আর সেই লেডি এ্যালবাট্রস উড়ছে। উড়ে উড়ে আসছে। জ্যাক সবাইকে ডাকছে। সে এই পাখির মায়ায় এবং এটা তো ঠিক, সবাই যদিও এখন আর প্রাচীন নাবিকের মতো সংস্কারে ভোগে না তবু কেন যে এটা ওদের বিশ্বাস করতে ভাল লাগে পৃথিবীতে সব নাবিকেরা মরে গিয়ে এ্যালবাট্রস পাখি হয়ে যায়। মরার পরেও সমুদ্রকে ওরা ভুলতে পারে না। সমুদ্রের জন্য তাদের ভীষণ মায়া। তখন তারা পৃথিবীতে আবার এ্যালবাট্রস হয়ে ফিরে আসে। সমুদ্রে উড়ে উড়ে বেড়ায়। তাদের কোন অনিষ্ট করা জাহাজি মানুষের পক্ষে ঠিক না।

কেউ কেউ সামনে না হলেও গোপনে মেজ-মালোম ডেবিডকে যে ধিক্কার না দিচ্ছে তা নয়। আর এটা হয়তো কাপ্তানের ছেলেটা বুঝতে পেরে ঠিক সুমদ্রে একজন মৃত নাবিকের প্রতি যেমন সম্মান দেখানো হয়,—তেমনি সম্মান—আর কত বড় পাখি—প্রায় দশ বারো ফুটের ডানা মেলে সে চিৎ হয়ে পড়ে আছে। জ্যাক ঠোঁট দিয়ে রক্ত ওগলাতে দেখেছে। তারপর চোখ দুটো অসহায়, কি যে অসহায়, পাখিটা জ্যাকের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিল মরে যাবার আগে। জ্যাকের মনে হয়েছিল তেষ্টা পেয়েছে। যেমন মানুষ মৃত্যুর আগে ভীষণ তৃষ্ণার্ত বোধ করে। পাখিটাও হয়তো ওর দিকে করুণ চোখে একটু জলপানের নিমিত্ত তাকিয়ে আছে—সে ছুটে গিয়ে জল এনেছিল। জল খেতে দিয়েছিল। আশ্চর্য পাখিটা প্রায় বুক ভরে জল তেষ্টা নিবারণ করতে করতে চোখ বুজে ফেলেছিল।

জ্যাক শুধু ছোটবাবুকে বলেছিল, তুমি স্নান করে এস ছোটবাবু। ভাল প্যান্ট-জামা পরবে। ছোটবাবু কিছু বলল না। সে কথা না বললেই হ’ল। জ্যাক যা বলেছে এখন তাকে তাই করতে হবে। সে কেবিনে চলে গেল স্নান করবে বলে। তারপর সারাদিন ছুটি। অন্য সময় হলে সে জ্যাককে বলত, আমার সারাদিন ছুটি। আর্চি ভীষণ খুশি আমার কাজে। আমাকে সে ছুটি দিয়েছে জ্যাক। কিন্তু সে যখন কথা দিয়েছে আর্চিকে, তখন আর কিছু বলা যায় না। না হলে যেন বলা যেত, তোমার দুটো একটা বই জ্যাক আমাকে দেবে। সারাদিন বাংকে শুয়ে আজ শুধু বই পড়ব।

পাখিটার মৃত্যুর পর ডেবিডেরও খারাপ লাগছিল। যত না এই পাখিটার জন্য তার চেয়ে বেশি লেডি এ্যালবাট্রসের জন্য। কারণ লেডি এ্যালবাট্রস এখন সমুদ্রে একা। এবির মতো নিঃসঙ্গ। এবির কাতর চোখমুখ এখন যেন তাড়া করছে। সে একেবারে পাটভাঙ্গা ইউনিফরম পরে এসেছে।

এবং এভাবে প্রায় সব নাবিকেরা এখন গোল হয়ে দাঁড়িয়েছে পাখিটার চারপাশে। কাপ্তান কি ভেবে বাইবেল এনেছেন সঙ্গে। এনজিন-সারেঙ কোরাণশরিফ। বাইবেল থেকে কাপ্তান বেশ সুর করে দুটো একটা স্তবক—অর্থাৎ মৃত্যু জীব মাত্রেই শেষ কথা নয়, ঈশ্বরের দুটো একটা বাণী এমনভাবে পড়ে শুনিয়ে গেলেন। কোরাণশরিফ থেকে দুটো সুরা পড়ে গেলেন সারেঙ এবং সবই মৃত্যু সম্পর্কিত কথাবার্তা। দেখলে মনে হবে এই বিশাল সমুদ্রে তারা সত্যি সত্যি একজন মৃত নাবিককে সুমদ্রে সমাধিস্থ করছে। আর্চি দু-বার এদিকটায় এসেছিল, সে এসব দেখে ভীষণ ছেলেমানুষী ভেবেছে। জ্যাকের শরীরের প্রতি তার লোভ ভীষণ। সেও বেশ সেজে-গুজে মাথায় তার জাহাজি টুপি, পায়ে সাদা জুতো, সাদা মোজা একেবারে সব সাদা ইউনিফরমে জ্যাকের পাশে দাঁড়িয়ে গেল।

জ্যাক এত নিবিষ্ট যে কে তার পাশে কিভাবে দাঁড়িয়েছে খেয়াল নেই। সবার সঙ্গে সে পাখির ডানা ধরে কাঠের বাকসোতে শুইয়ে দিল। পেরেক মেরে সে নিজেই ঢাকনা বন্ধ করে দিল। কাপ্তান ঘুরে-ফিরে তদারক করার মতো কাজটা দেখছেন। কাঠ একটু বেশি বের হয়ে থাকলে কার্পেন্টারকে ডেকে কাঠ কেটে দিতে বলছেন।

এনজিন-সারেঙ কেমন মুহ্যমান পাখিটার মৃত্যুতে। তিনি পর পর সব বেছে বেছে সুরা আবৃত্তি করে যাচ্ছেন। যেমন বলছেন—যদি আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করেন, তবে এমন কেউ নেই যে তোমাদের পরাভূত করতে পারে; আর তিনি যদি তোমাদের পরিত্যাগ করেন তবে কে আছে যে তোমাদের সাহায্য করতে পারে। আর আল্লার ওপরেই বিশ্বাসীদের নির্ভর করা উচিত।

এনজিন-সারেঙ নিবিষ্ট মনে সুর ধরে পড়ে যাচ্ছেন। জাহাজ চলছে না এখন। জাহাজ সমুদ্রে থেমে আছে। সবকিছু কেমন স্থির অবিচল, কেবল পাখিটা বাদে। ঘুরে ঘুরে কখনও একেবারে মাথার ওপর উড়ে আসছে সে। সে দেখছে তার সঙ্গী পুরুষ পাখিটা আর ডেকে নেই। নাবিকেরা তাকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছে। তবু সে মাথার ওপর এই ত্রিশ চল্লিশ ফুট ওপরে উড়ছে। উড়ে উড়ে অনেক নিচে নেমে আসছে। এবং পাখিটাই এখন শোকার্ত মানুষের মতো মৃত্যুর আবাহাওয়া তৈরি করছে। তখন সারেঙ বলে যাচ্ছেন। সবাই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি বলছেন, প্রত্যেক প্রাণ মৃত্যু আস্বাদন করবে। আর তোমাদের প্রাপ্য যা তাই তোমাদের দেওয়া হবে পুনরুত্থানের দিনে। তখন বহুদূর যে অবস্থান করবে আগুন থেকে আর প্রবিষ্ট হবে উদ্যানে নিঃসন্দেহে সে সফলকাম।

তারপর তিনি বললেন, হে আমাদের পালনকর্তা সন্দেহ নেই যাকে তুমি আগুনে প্রবিষ্ট করাও তাকে তুমি প্রকৃতই লাঞ্ছিত করেছ। আর যারা অন্যায়কারী তাদের সহায় কেউ থাকে না।

আর্চি আড়চোখে দেখছে জ্যাকেেক। এখন বুঝতে অসুবিধা হয় না জ্যাকের স্তন উঁচু বলেই বুকের কাছটা বেমানান। শরীর জ্যাকের ঠিক রোগা বলা যায় না, যা আছে সবই ঠিক ঠিক মতো! সে এসবের ভেতরও জ্যাকের শরীর দেখতে দেখতে কেমন লোভী চতুর হয়ে যাচ্ছে। সারেঙ-এর শেষ কথা, সে যেন শুনতে পাচ্ছে না–আর যারা অন্যায়কারী তাদের সহায় কেউ থাকে না—সারেঙ এত সব কি বিড় বিড় করে কথা বলছেন বলে আর্চি কিছুটা বিরক্ত। সে এ-সময় একটা চুরুট ধরাতে পারলে বেঁচে যেত।

চিফ-অফিসার, রেডিও-অফিসার পাঁচ নম্বর এনজিনিয়ার মাথার দিকটায়। নিচের দিকে কাপ্তান, জ্যাক। আর্চি এনজিন-সারেঙ দু’পাশে আর সব জাহাজিরা। ছোটবাবু একপাশে সবার ভেতরে। সে একটু সবার আড়ালে পড়ে গেছে।

এবার কাপ্তান পড়ে শোনালেন—যীশুখৃষ্টের জন্ম এইভাবে হইয়াছিল। তাঁহার মতা মরিয়ম যোসেফের প্রতি বাগদত্তা হইলে তাঁহাদের সহবাসের পূর্বে জানা গেল তাঁহার গর্ভ হইয়াছে—পবিত্র আত্মা হইতে। আর তাঁহার স্বামী যোসেফ ধার্মিক হওয়াতে ও তাঁহাকে সাধারণের কাছে নিন্দার পাত্র করিতে ইচ্ছা না করাতে, গোপনে ত্যাগ করিবার মানস করিলেন। তিনি এই সকল ভাবিতেছেন, এমন সময় দেখ, প্রভুর এক দূত স্বপ্নে তাঁহাকে দর্শন দিয়া কহিলেন, তোমার স্ত্রী মরিয়মকে গ্রহণ করিতে ভয় করিও না। কেননা তাহার গর্ভে যাহা জন্মিয়াছে, তাহা পবিত্র আত্মা হইতে আসিয়াছে। আর তিনি পুত্র প্রসব করিবেন, কারণ তিনিই আপন প্রজাদিগকে তাহাদের পাপ হইতে ত্রাণ করিবেন। আর তাঁহার না রাখা যাইবে ইম্মানুয়েল। অনুবাদ করিলে ইহার অর্থ দাঁড়াল আমাদের সহিত ঈশ্বর।

জ্যাক তখনই কেন জানি ছোটবাবুর জন্য মনে মনে অধীর হয়ে উঠল। ছোটবাবু এখনও আসছে না। আসলে ছোটবাবু জাহাজিদের পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। জ্যাক বুঝতে পারেনি। সে বলল, সবাই এসেছে বাবা?

কাপ্তান বের হয়ে এলেন ভিড়ের ভেতর থেকে। সঙ্গে এনজিন-সারেঙ। চিফ-অফিসার ঘুরে ঘুরে দেখলেন। সবাই এসেছে। জ্যাক নিজে বের হয়ে যখন দেখল ছোটবাবু আছে, তখন আর কে এল না এল যেন আসে যায় না। এবারে ওরা একজন নাবিকের সলিলসমাধির মতো কফিনটাকে সবাই ধরে জলে ফেলে দিল। সঙ্গে সঙ্গে জাহাজের প্রপেলার ঘুরে গেল। তিনবার সমুদ্রের বুকে চিমনি থেকে সাইরেনের আওয়াজ—ক্রমে সেই কফিন বড় বড় পাথর সহ সমুদ্রের অতলে ডুবে গেল।

জ্যাক রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকল।

যতদূর দেখা যায় জ্যাক রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে দেখল।

এখন বোঝাই যায় না কোথায় সেই পাখির মৃতদেহ ফেলে দেওয়া হয়েছে। সমুদ্র আবার আগের মতো নিরিবিলি। একটা অতীব পাপের কথা মনে হল জ্যাকের। চারপাশের কত কিছু ঘটনা জাহাজটাকে যে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে! সে চোখ তুলে ছোটবাবুকে খোঁজার সময় দেখল, বোট-ডেক খালি। আর্চি এখন বোট-ডেকে দাঁড়িয়ে। যেখানে ছোটবাবু দাঁড়াত, ডেবিড ছোটবাবুর সঙ্গে বসে গল্প করত, আর্চি সেখানে দাঁড়িয়ে দূরবীনে লেডি-এ্যালবাট্রসকে দেখছে। ডেকে কজন জাহাজি। ওরা কাজ করছে। দড়িদড়া গোছাচ্ছে। আর কেউ নেই। বোট-ডেকে আর্চিকে দেখে সে সিঁড়ি ধরে উঠে গেল না। নিচে এলি- ওয়ে ধরে ছোটবাবুর কেবিনের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ। সে ডাকল, ছোটবাবু।

কোন জবাব নেই।

সে সন্তর্পণে ডাকল, ছোটবাবু, আমি জ্যাক

ছোটবাবু ভেতরে পোর্ট-হোলে দাঁড়িয়ে আছে।

জ্যাক ডাকল, ছোটবাবু তুমি ঘুমোচ্ছ?

ছোটবাবু দরজা খুলে দিচ্ছে না। ছোটবাবু বোধহয় অসময়ে ঘুমোচ্ছে। কিন্তু আর্চি ওকে ঘুমোতে দেখলে ভীষণ একটা কেলেঙ্কারী করবে। সে দৌড়ে বাইরে বের হয়ে পোর্টহোলে উঁকি মারল। ছোটবাবু ঘুমোয়নি। পোর্ট-হোলে দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ

জ্যাক বলল, তুমি সাড়া দিচ্ছ না কেন?

ছোটবাবু বলল, আর্চি বারণ করেছে।

—বারণ করেছে মানে!

—তোমার সঙ্গে কথা বলতে বারণ করেছে। কথা বললেই খোলের ভেতর টেনে নিয়ে যাবে বলেছে।

জ্যাক মাথা নিচু করে চলে যাচ্ছিল।

ছোটবাবু জ্যাককে এভাবে চলে যেতে দেখে কেমন ঘাবড়ে গেল। জ্যাক রেগে গেলেও সে মুশকিলে পড়ে যাবে। এমন একটা অসহায় অবস্থা কি করে বোঝাবে জ্যাককে! সে ডাকল, জ্যাক শোন!

জ্যাক ফিরে এসে বলল, আমাকে কিছু বলবে?

ছোটবাবু বলল, জ্যাক চুল বড় রাখলে তোমাকে দেখতে ভাল লাগে।

জ্যাক বলল, তাই বুঝি

—তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে।

জ্যাক পরেছে খয়েরী রঙের ট্রাউজার। নানাবর্ণের কারুকার্যময় মীনাকরা সাদা জ্যাকেট। ওর চুল ঘাড়ের কাছে বেশ লম্বা হয়ে গেছে। বোধহয় আবার জাহাজে কাপ্তানকে দেখা যাবে খুঁজে বেড়াচ্ছেন জ্যাককে। হাতে কাঁচি। জ্যাকের চুল এভাবে ক্রমে গভীর নীল রঙের হয়ে গেলেই বুড়ো কাপ্তান কেন যে চিন্তায় পড়ে যান! এমন সুন্দর চুল কেটে ফেললে, জ্যাককে ভীষণ বাজে লাগে দেখতে। এবং এই যে জ্যাক দাঁড়িয়ে আছে ওর সামনে, কেমন মেয়েলি ধরনের চোখ-মুখ, দুবার চোখ তুলে ছোটবাবুকে দেখেই আবার বলছে, আমি যাই ছোটবাবু। চোখ নামিয়ে নিতে পারলে যেন বাঁচে।

ছোটবাবু ভাবল, রাগ পড়েনি হয়তো। সে দেখেছে, জ্যাককে সুন্দর বললে ভীষণ খুশি হয়! এখন সে জ্যাককে খোসামোদ করছে। আর কিভাবে কি করা যায় সে বুঝতে পারছে না। সে বলল, আমরা পালিয়ে কথা বলব জ্যাক। আর্চিকে দেখলেই আমরা কেউ কাউকে চিনতে পারব না, কেমন

জ্যাক হেসে দিল। বড় কাতর হাসি। দু’গালে সেই হাসি একটা হাল্কা করুণ বিষণ্ণতা ছড়িয়ে দিয়ে গেল! সে বলল, তাই হবে ছোটবাবু। হয়তো জ্যাক আরও কিছু বলতে পারত, কি বলতে পারত অবশ্য জানে না। তবু জ্যাক নিজেকে ছোটবাবুর চেয়ে বেশি চালাক ভেবে থাকে। সে বলল, ছোটবাবু জাহাজে কাউকে বল না আর্চি কথা বলতে বারণ করেছে।

—কি দরকার বলার!

—তুমি যদি ডেবিডকে বলে দাও আবার…।

—আরে না! তারপর একটু থেমে বলল, আচ্ছা জ্যাক, আর্চি কি টের পেয়েছে তুমি ওকে ফেলে দিয়েছিলে!

—নাতো।

—গত রাতে আর্চির পেছনে লাগতে গেছিলে কেন?

—আর্চির পেছনে! বলে জ্যাক দু-হাতে এমন ভঙ্গী করল যে ছোটবাবুর মনে হল, আর্চিকে দেখলে এক্ষুনি কপালে ঢিল ছুঁড়ে মারবে জ্যাক। সে শেষে বলল, আমার ইচ্ছে। পোর্ট-হোলে সে আর এক দণ্ড দেরি করল না।

তখনই আবার জ্যাকের কি যেন হয়ে যায়!

আসলে জ্যাক, পুরুষ পাখিটার মৃত্যুতে ভারি কষ্টের ভেতর পড়ে গিয়েছে। ছোটবাবুর অসহায় মুখ দেখলে কষ্টটা আরও বাড়ে।

সে ঘড়িতে দেখল দশটা বাজে। কেবিনে ঢুকে চুপচাপ বসে থাকবে ভাবল। জাহাজে সে ভীষণ বিপদের মুখে পড়ে গেছে। আর্চি তাকে ক্ষিপ্ত নেকড়ের মতো চোখে চোখে রাখছে। এবং তাকে কখনও কাছে সুযোগ মতো পেলেই হল! শিকার নিয়ে খেলার মতো বাঘটা তাকে নিয়ে খেলতে চাইবে।

এবং এভাবেই সে সব বুঝতে পারে। অভিজ্ঞতা ক্রমে তাকে অনেক বেশি পরিণত করে দিয়েছে। বাবার কাছে বসে থাকলে সে নিরাপদ ভাবে। বাবার কাছে না থাকলে মনে হয় ফিকির খুঁজছে আর্চি আর এভাবে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী। সে কেবিনে না ঢুকে সিঁড়ি ধরে ওপরে উঠতে থাকল। চার্টরুমের পাশ দিয়ে যাবার সময় নিচে দেখল না, কে আছে। আর্চি যে আছে সে না দেখেও বুঝতে পারে। লেডি এ্যালবাট্রসের ডানা ভেঙ্গে দেবার জন্য ওঁৎ পেতে বসে আছে।

তখন ডেবিড কিছু ভেবে পাচ্ছিল না। চোখে ঘুম ঘুম ভাব। সকাল থেকে সে দু-চোখ এক করতে পারেনি। কোর্স-লে ভুল হওয়ায় মনটা ভাল ছিল না। এ্যালবাট্রসের মৃত্যুর পর মনটা আরও খারাপ ছিল। এবং যখন বাইবেল থেকে তিনি পড়ে শোনাচ্ছিলেন, তখন ডেবিড ভেবে পেল না, কাপ্তান মৃত্যু সম্পর্কিত দুটো একটা কথা বলেই খৃষ্টের জন্ম সম্পর্কে এতটা বিস্তারিত বক্তৃতা ঝাড়লেন কেন! আর বার বার বলছিলেন, ইম্মানুয়েল, আমাদের সহিত ঈশ্বর। আমাদের সহিত ঈশ্বর আছেন। তিনি আছেন বেশ, তাকে ফলাও করে এত বলার কি দরকার! অহেতুক এমন একটা শোকার্ত সময়ে আমাদের সহিত ঈশ্বর, বার বার বলার কি যে দরকার। কাপ্তান হিগিনস কি ঈশ্বরের ভরসায় এবার সমুদ্র সফরে বের হয়েছেন! ওরা জাহাজ ঠিকঠাক চালাতে না পারলেও তার ঈশ্বর অর্থাৎ আমাদের সহিত ঈশ্বর চালিয়ে নেবেন!

যত এমন হচ্ছে তত ডেবিড সংশয়ের ভেতর পড়ে যাচ্ছিল। কাপ্তানের নিজের সাহসও ক্রমে কমে আসছে। অথচ জাহাজে তিনিই সবার ঈশ্বরের মতো। এবং এই প্রথম জাহাজে বোট-ড্রিল শুরু হয়েছে। প্রতি পনেরো দিন অন্তর নিজেদের সেফটির জন্য একবার অন্ততঃ বোট-ড্রিল যেখানে করার দরকার, সেখানে কাপ্তান মাসে দু’মাসে একবার করাতেন। আবার ছ’মাসও বন্ধ থাকত একনাগাড়ে। জাহাজ প্রশান্ত মহাসাগরে নেমে আসার পর কাপ্তান থার্ড-মেটকে ডেকে পাঠিয়েছেন। বলে দিয়েছেন, নিয়মিত বোট-ড্রিল হবে জাহাজে। সেফটির জন্য সব বোট তিনি নিজে দেখা-শোনা করেছেন। মাত্ৰ চারটা লাইফ-বোট। লাইফ-বয়া প্রতি তিনজনের জন্য একটা। আর প্রত্যেকের আছে একটা করে লাইফ- জ্যাকেট। জাহাজ ডুবি হলে এ-চারটা বোটই তাদের একমাত্র সম্বল।

কাপ্তান বিশ্বাসই করতেন না, জাহাজ সিউল-ব্যাংক সমুদ্রে কখনও ডুবে যেতে পারে! না হলে ডেবিড যতবার জাহাজে এসেছে এই জাহাজে ততবার সে দেখেছে স্যালি হিগিনস এসব বোট-ফোটের পরোয়া করতেন না। রাজার মতো জাহাজ বন্দরে চালিয়ে নিতেন। সিউল-ব্যাংকের কিছু হতে পারে তিনি স্বপ্নেও ভাবতে পারতেন না।

তাই স্যালি হিগিনসের এসব নির্দেশ ডেবিডকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিল। গত রাতে যা সব ঘটল। এবং কোর্স-লে রহস্য নিয়ে কেউ ভাববার সময় পায়নি। এ্যালবাট্রসের মৃত্যু এবং জাহাজের ওপর একটা বিষণ্ণতা ঝুলেছিল বলে কেউ কিছু বলাবলি করেনি। আর জ্যাককে তো মোটামুটি সবাই সমীহ করে থাকে। সে যখন চায় এ্যালবাট্রস পাখিটার সমাধি হোক, তখন তারা এ-নিয়ে আর কথা বলতে পারে না। এ্যালবাট্রস হত্যার সময় কিছুই মনে হয়নি। কিন্তু সেই গোল হয়ে দাঁড়ানো, কফিনের ভেতর পুরে দেওয়া, ঠুকঠুক করে পেরেক মেরে দেওয়া, এ-সবের ভেতর প্রত্যেকের বোধহয় কোন প্রিয় স্মৃতি জড়িয়ে থাকে। এ্যালবাট্রসের সমুদ্রে সমাধি প্রকৃত একজন জাহাজির সমুদ্রে সমাধি হচ্ছে এমন মনে হয়েছিল সবার। তারা একটা মৃত পাখির চারপাশে দাঁড়িয়ে আছে মনেই হয়নি। যেন কোন প্রিয়জনের কফিনের পাশে দাঁড়িয়ে তারা ঈশ্বরের কাছে মৃত আত্মার শান্তি কামনা করছিল।

ডেবিড এসব ভেবে পাশ ফিরে শুল। বারোটায় লাঞ্চ। সে এখন একটু গড়িয়ে নিতে চায়। বিকেলে বারোটা-চারটায় তার ফের ওয়াচ। জাহাজ বন্দরে না যাওয়া পর্যন্ত এভাবে চলবে। সামান্য গড়িয়ে নিতে পারলেই সব ফের ঠিক হয়ে যাবে ভেবেছিল। কিন্তু ঘুম কিছুতেই আসছে না। কাপ্তানের কাজ- কর্ম সবই কেমন ক্রমে সংশয়ের ভেতর ফেলে দিচ্ছে তাকে।

আর তখন চুপি চুপি অমিয় পা টিপে টিপে ছোটবাবুর কেবিনের পাশে এসে সন্তর্পণে ডাকল, ছোট দরজা খোল।

ছোটবাবু তড়াক করে লাফিয়ে উঠে পড়ল ব্যাংক থেকে। দরজা খুলে তাড়াতাড়ি ওকে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। কে কোথায় দেখে ফেলবে! সে বলল, কি ব্যাপার!

—বলছি। বলে অমিয় ছোটর কেবিনটা দেখল। ভারি মনোরম লাগছে। কি ঝকঝকে সব কিছু। নিচে কার্পেট পাতা। দুটো দু’পাশে বড় বড় কাঠের বাংক। সে রং করে যাবার পর আর আসেনি। ছোটবাবুর বিছানা ধবধবে সাদা। একটু গড়িয়ে নিতে ইচ্ছে করছে। দেয়ালে ওর মায়ের ছবি। একটা ক্যালেণ্ডার। তার পাতায় তারিখের ওপর ক্রস টানা। একটা করে দিন যাচ্ছে, ছোটবাবু দিনটার ওপর ক্রস টেনে দিচ্ছে। সে সব দেখতে দেখতে বলল, তোকে একবার ফোকসালে যেতে হবে ছোটবাবু।

ছোটবাবু বলল, কেন কি হয়েছে?

অমিয় বলল, মৈত্রকে নিয়ে আর পারা যাচ্ছে না।

—ঝগড়া বাঁধিয়েছিস ফের?

—ধুস, ঝগড়া করতে যাব কেন। ও বেটা মরবে।

—কি বলছিস যা তা!

অমিয় ফিসফিস করে বলল, সত্যি বলছি। এভাবে থাকলে ও ঠিক মরবে। বললাম মেজ-মালোমের কাছে যেতে। কিছুতেই যাচ্ছে না। দিনরাত যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছে। জ্বর ভীষণ। এই নিয়েই ওয়াচ করছে। চোখ মুখ লাল! কেবল পালিয়ে থাকছে। আলোতে বের হচ্ছে না। নিচে স্টক-হোলডে জবুথবু হয়ে বসে থাকে। কথা বলে না।

—কি হয়েছে বলবি তো!

—আর কি হবে? বললাম ছোটকে অন্তত বলি। তেড়ে এল। ছোটকে বলে কি হবে! ও হারামজাদা মানুষ নাকি। ওতো নিজেই অমানুষ। ওকে মেজ-মিস্ত্রি যা না তা করাচ্ছে। মুখ বুজে সহ্য করে যাচ্ছে। বোধ বাস্যি থাকলে কেউ এভাবে সহ্য করতে পারে না!

ছোটবাবু হাসল। বলল, আমার জন্য মৈত্রদাকে মাথা গরম করতে বারণ করবি। কিন্তু কি হয়েছে বলবি তো!

অমিয়, পৃথিবীর কেউ যেন আর শুনতে না পায়, এত আস্তে কি যে সব বলল। তারপর বলল, আমাকে শাসিয়েছে। বলেছে, যদি দু-কান হয় তবে সে আমাকে খুন করবে।

ছোটবাবুর মুখ ভীষণ চিন্তিত দেখাল। সে বুঝতে পারল, এসব দু-কান হলে মৈত্রদাকে জাহাজ থেকে নামিয়ে দেবে। নামিয়ে দিলেই খুব অর্থাভাবে পড়ে যাবে। শেফালী বৌদির জন্য ওর অনেক টাকার দরকার। কফিনটাকে যখন সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয় তখন মৈত্রদা ছিল না। সে বোধহয় আসেনি। এলে ভাল করে দেখা যেত। ছোটবাবু কি ভেবে বলল, গিয়ে কিছু বললেই তো খেপে যাবে।

—তুই ওর কপালে হাত দিয়ে দেখবি। তুই ওর চোখ মুখ দেখেই টের পেয়েছিস এমনভাবে বলবি—ওর গোঁয়ার্তুমি ভাল লাগছে না। এক ফোকসালে থাকি, আমার ভয় করছে।

ছোটবাবু বলল, মেয়েটা ওকে কতভাবে বারণ করেছে। শুনল না।

—নে, এখন মর। বলছে, তাহিতিতে নেমে ডাক্তার দেখাবে। পেনিসিলিন নেবে। নিলেই ঠিক হয়ে যাবে। আর কটা দিন তো।

ছোটবাবু বলল, লাঞ্চের পর যাব। আর্চি তখন খেয়ে ঘুমোয়।

অমিয় দরজা খুলে মুখ বার করল সামান্য! কোনো অফিসার এনজিনিয়ার এদিকে আসছে কিনা দেখল। না কেউ আসছে না। সে বের হয়েই পোর্ট-সাইডের গ্যাংওয়ের দিকে চলে গেল। দেখলে মনে হবে, সে এনজিন-রুম থেকে উঠে ডেকে হেঁটে যাচ্ছে। ছোটবাবুর কেবিন থেকে বের হয়ে আসছে সে কাউকে বুঝতেই দিল না।

বিকেলে ছোটবাবুও এভাবে গোপনে মৈত্রদার ফোকসাল থেকে বের হয়ে এসেছিল। যেন সে স্টিয়ারিং এনজিনের পেনিয়ান মেরামত করে উঠে আসছে। সে ভাণ্ডারিজ্যাঠাকে বলল, জ্যাঠা তোমাদের ছেড়ে থাকতে ভাল লাগছে না। আর তখনই এনজিন-সারেঙ ডেক-সারেঙ ডেকের ওপর চিৎকার চেঁচামেচি লাগিয়েছে। সবাই যে যার ফোকসাল থেকে বের হয়ে আসছে। অনেক দূরে দিগন্তে কি দেখে সবাই আঁৎকে উঠছে। কি যে আসছে সব মেঘের মতো! কুণ্ডলি পাকিয়ে ক্রমে কখনও সারা আকাশ জুড়ে পঙ্গপালের মতো অজস্র কালো বিন্দু বিন্দু। আবার এক হয়ে যেন ঝড় অথবা বনের হরিৎবর্ণ পাতারা উড়ে উড়ে এদিকে চলে আসছে। ব্রীজে সব অফিসাররা দূরবীন চোখে দেখছে। লেডি এ্যালবাট্রসকে জাহাজের চারপাশে অথবা দিগন্তের কাছাকাছি কোথাও দেখা যাচ্ছে না! এখন যা দেখা যাচ্ছে নির্মল আকাশের নিচে সেই অদ্ভুত এক চিরহরিৎবর্ণের গাছের শাখা-প্রশাখা একত্র ডাই মেরে যেন উড়ে আসছে। অথবা কখনও ভয়ংকর ক্রুব্ধ। মেঘের মতো তাদের ধাবমান শব্দ এবং ডেকের, ব্রীজে যে যেখানে ছিল স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। সূর্য তখন আকাশের নিচে হেলে পড়েছে। সূর্যকে ঢেকে দিয়ে জাহাজের পেছনে পেছনে কালো ক্রুব্ধ অতিকায় কিছু এগিয়ে আসছে।

এ-সবের ভেতর কেউ লক্ষ্য করছে না ফোর-মাস্টের নিচে জ্যাক দাঁড়িয়ে আছে। ওর পকেটে ছোট ছোট পাথর, লোহার টুকরো। সে দূর থেকে পাগলের মতো একের পর এক পাথর ছুঁড়ে যাচ্ছে! কোনোটা মাস্তুলের ডগায় লাগছে। কোনোটা লাগছে না। লাগলে ঠুং করে আওয়াজ হচ্ছে! এমন একটা ভয়ংকর বিপদের সামনে জাহাজ অথচ সে এতটুকু বিচলিত হচ্ছে না। সে ক্রমাগত পাথর ছুঁড়ে যাচ্ছে।

আর ছোটবাবুর যেন এসবে আসে যায় না কিছু। সে কেবিনে ঢুকে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *