1 of 2

অলৌকিক জলযান – ২৪

।। চব্বিশ।।

জ্যাক যেন নেকড়ের মুখ থেকে পালিয়ে ছুটছে। সে এলোপাথাড়ি ছুটছে। সব কেমন গণ্ডগোল হয়ে গেছিল—ছোটবাবুকে এলি-ওয়েতে ঢুকতে দেখেই শয়তানটা হাত ছেড়ে দিয়েছে। কেন যে মরতে সে নিচে নেমে এসেছিল। এবং সে যখন ওপরে উঠে প্রায় দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে গেল তখন এত ঘামছে, যে মনে হয় বৃষ্টিপাতে সে ডেকের ওপর দাঁড়িয়ে ভিজেছে। সে কিছু এখন আর ভাবতে পারছে না। দরজা লক করে সে চুপচাপ বসে থাকল কিছুক্ষণ। একবার পোর্ট-হোল খুলে দেখল, ও-পাশে ছোটবাবু দাঁড়িয়ে আছে কিনা। সতর্ক থাকল, যদি ছোটবাবু ভেবে অবাক হয়ে যায় এবং সংশয় দেখা দেয় মনে, তবে ওপরে ছুটে আসতে পারে। –কি ব্যাপার! তুমি এমনভাবে কেন ছুটে এলে। ভয়ংকর কিছু ঘটেছে ভেবে ছোটবাবু স্বাভাবিক কারণেই আসতে পারে। এলেও সে দরজা খুলবে না। কারণ সে এখন জানে তার মাথা ঠিক নেই। সে হয়তো ছোটবাবুর মুখের ওপর থুথু ছিটিয়ে দিতে পারে। আর্চির মুখের ওপর থুথু ছিটিয়ে দেবার মতো মনে হবে তবে।

এসব কারণে জ্যাক এতটুকু স্থির হয়ে বসতে পারছে না। মাথা সমান উঁচু আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখছে নিজেকে। সে যে মেয়ে এবং মেয়ের মতো। সে বলল, ছোটবাবু তুমি কেন বোঝ না জান না আমি বনি। শয়তানটা আমার সব টের পেয়ে গেছে। –আচ্ছা, ছোটবাবু আজ তোমরা এলে না কেন! কেমন কাতর গলায় সে নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে দেখতে বলল। আমি সেই আটটা থেকে পোর্ট-হোলে দাঁড়িয়ে আছি, আসছ না তোমরা। নটা বেজে গেল। কতক্ষণ একা-একা থাকা যায়। রোজ আটটার পর বোট-ডেকে এসে বসো তোমরা অথচ আজ…!

বনি এবার এক এক করে পুরুষের পোশাক শরীর থেকে খুলতে থাকল। আর্চি আমাকে ঘাটাবে না। বাবাকে বলে জাহাজ থেকে নামিয়ে দেব! তুমি ভাল করছ না। তুমি খারাপ। তুমি বদমাস। পোশাক খুলতে খুলতে, এমন অজস্র কথা। সে প্যান্ট খুলে ছুড়ে দিল, যেন পারলে আগুন ধরিয়ে দেয়। সে যে কি করছে এখন! সে মেয়ে, এবং এই পুরুষের পোশাক তাকে কিছুতেই আর পুরুষ করে রাখতে পারছে না।—শয়তান অধার্মিক—আর ছোটবাবু তুমি তুমি…ভাঙ্গা রেকর্ডের মতো পুনরাবৃত্তি…তুমি….তুমি এবং তখনই কি যে হয়ে যায়, সে তার প্যান্ট তুলে একটা ব্লেডে ফালা ফালা করে কেটে ফেলে। জাঙ্গিয়া খুলে দাঁতে ছিন্ন-ভিন্ন করে দেয়। লম্বা ঢোলা জামা খুলে দু-হাতে ছিঁড়ে উড়িয়ে দেয় সমুদ্রে। মোটা গেঞ্জি খুলে পোর্ট-হোলে ঝুলিয়ে দিল। তারপর দেশলাই কাঠি জ্বেলে আগুন ধরিয়ে ছুড়ে মারল আকাশের গায়ে। তারপর ব্রেসিয়ার। একটা একটা করে ভাঁজকরা তিনটে ছোট রুমাল খুলে ফেলতেই সে দেখল, দুটো স্তন রাবারের বলের মতো ফুলে উঠেছে। যেন পিন ফুটিয়ে দিলে স্তন থেকে রক্ত পিচকিরির মতো ছুটবে। সে দুহাতে দু-স্তন ধরে ব্যথায় গুমরে উঠল। টনটন করছে স্তনের চারপাশ। ক্রমে স্তনের চারপাশ থেকে শিরা-উপশিরা জেগে উঠলে সে দেখল, বেশ সুপুষ্টু স্তন, এবং চারপাশে মাখনের রং জেগে উঠছে আর শিরা-উপশিরাতে আশ্চর্য চঞ্চলতা সে টের পাচ্ছে। বিকেল থেকে সে এভাবে একই পোশাকে। আর ব্রেসিয়ারে আঁটা শক্ত স্তন এতক্ষণ খুবই মিইয়ে ছিল। সব খুলে ফেলতেই আবার সব সহজ স্বাভাবিক হয়ে গেল। ব্রেসিয়ারের দাগ শরীরের চারপাশে বসে গেছে। সে এখন ভীষণ হাল্কা বোধ করছে।

এবং তখনই মনে হল, পোর্ট-হোলের কাচ সে বন্ধ করেনি। তাড়াতাড়ি রাতের পোশাকে স্তন এবং নাভিমুখ ঢেকে পোর্ট-হোলের কাচ বন্ধ করে দিল। ছোটবাবু এলেও সে দরজা খুলবে না। দরজা খুলতে হলে আবার সব তাকে পরে নিতে হবে। এবং সে কেমন অধীর হয়ে উঠল আয়নায়। সে বুঝতে পারছে তার শরীরে ভারী সুন্দর গঠন, যা সে মাঝে মাঝে হাত তুলে এবং নুয়ে নিচু অংশ দেখার সময় কাউকে ভেবে থাকে। ভাবতে ভাল লাগে।

এই প্রতিবিম্ব তাকে কিছুক্ষণ মুহ্যমান করে রাখল। ছোটবাবু আসতে পারে, ডাকতে পারে মনে থাকল না। কাল সকালে সে ভেবেছে আর্চিকে সাবধান করে দেবে। আর্চি ওর দিকে এখন হিংস্র লোভী জন্তুর মতো তাকিয়ে থাকে। তখন আর্চির মুখে কিছু ছুড়ে মারার প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে স্থির থাকতে পারে না।

বনি এমন সাত-পাঁচ ভেবে যাচ্ছিল। আলতো করে বেগুনি রঙের একটা নাইটি পরে নিল। সাদা চাদরে ঢাকা মখমলের মতো বিছানা। দুটো বালিশের একটাকে সে সব সময় পাশবালিশ করে নেয়। সবুজ রঙের আলো জ্বেলে শুয়ে পড়বে ভাবল। কিন্তু তেষ্টা গলায়। সে জল খেল এক গ্লাস। শুয়ে পড়বে ভেবে বাংকের কাছে গেল—কিন্তু কেন জানি ভেতরে এক অসহ্য জ্বালা। ছোটবাবুর ওপর আবার মন বিরূপ হয়ে উঠছে। আটটার পর ছোটবাবু এখানে এসে বসলে তাকে নিচে নেমে যেতে হত না। আটটার পর ছোটবাবু কি আজ শুয়ে পড়েছে! ওর শরীর ভাল নাও থাকতে পারে। পাখি দুটো না থাকায় ছোটবাবুর মন ভাল নাও থাকতে পারে। কখন কি যে হয়, মনের এই বিরূপতা কাটতে ওর সময় লাগেনি। সে আবার ছোটবাবুর জন্য কেমন এক কষ্টে ডুবে যাবার সময়, দরজা খুলে ফেলল। অন্ধকার রাত বলে উইংসের আলো দুলে দুলে জাহাজটাকে এক অলৌকিক জাহাজ বানিয়ে ফেলছে। এবং ভাবতে ভাল লাগল জাহাজে কেউ নেই। কেবল সে আর ছোটবাবু। নিরবধি কাল যেন জাহাজটা এভাবেই চলবে। থামবে না। সে বেগুনি রঙের নাইটি পরে ডেকচেয়ারে বসে থাকবে। পাশে ছোটবাবু, পৃথিবীর সব প্রাচীন ইতিহাস ছোটবাবুর মুখ থেকে শুনতে শুনতে সে ঘুমিয়ে পড়বে।

বনি আশা করেছিল ছোটবাবু ওপরে উঠে আসবে। এমন একটা ঘটনার পর চুপচাপ থাকতে পারে না ছোটবাবু। এবং সে এত অধীর যে ছোটবাবু এলে সে তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়বে। তাকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে দিতে বলবে, দ্যাখো আমি কে? আমার ঊরুমূল দ্যাখো, বাহু দ্যাখো, আমার সুন্দর স্তনের রূপলাবণ্যে তুমি ভালো হয়ে যাও।

বনি দরজা ফাঁক করে রেখেছে। চুপিচুপি দেখছে কেউ নিচ থেকে উঠে আসছে কিনা। জুতোর শব্দ উঠছে কিনা। কান সজাগ। যদি ছোটবাবু আসে তবে সিঁড়ি ভাঙ্গার শব্দে সে ঠিক টের পাবে—সে উঠে আসছে। ছোটবাবু ওঠার সময় যেন কি ভাবতে ভাবতে উঠে আসে। ওর পায়ের শব্দে সব টের পাওয়া যায়। অথচ ছোটবাবু আসছে না। সিঁড়িতে কোনও শব্দ নেই। নিঝুম সমুদ্রে অনেক নিচ থেকে সেই এনজিনের এক শব্দ, ক্রমান্বয়ে চারপাশে পরিব্যাপ্ত হয়ে যাচ্ছে। অন্ধকার সমুদ্র তখন আরও ভয়াবহ এবং গভীর মনে হয়। সমুদ্রের অতলে হাজার সেই প্রাগৈতিহাসিক জীবেরা সত্যি ঘোরাফেরা করছে মনে হয়। তারা এখনও তেমনি রয়েছে। তাদের স্বভাব পাল্টায় নি।

বনি দরজা বন্ধ করে দিল। ওর জন্য ছোটবাবুর এতটুকু কষ্ট নেই। ছোটবাবুর ওপর চাপা অভিমান এবং মাঝে মাঝে মনে হয় সে ছোটবাবুর সঙ্গে আর কিছুতেই কথা বলবে না। সে এভাবে কতবার ভেবেছে, এই শেষ, এবং ছোটবাবু যেমন আছে তেমনি থাক, কিন্তু মনের ভেতরে কি যে থাকে, যেন সে শিশুবয়স থেকে ছোটবাবুকে দেখে এসেছে, একসঙ্গে বড় হয়ে উঠেছে, বড় মাঠে বিকেলে তুষারপাতের সময় একসঙ্গে স্কি খেলেছে, একসঙ্গে কোথাও দুজন কেবল নাচ ঘরে নেচে যাচ্ছে অথবা হৈ-হৈ করে কতকাল একজন সমুদ্রগামী মানুষের হাত ধরে সে হেঁটে যাচ্ছে। ছোটবাবু তার কেউ নয়, সে কিছুতেই আর এটা ভাবতে পারে না।

বনি সত্যি শুয়ে পড়ল। সবুজ আলো জ্বেলে দু-পা ছড়িয়ে দিল। দু-হাতে মুখ ঢেকে রাখল। শরীরের সব পবিত্রতা আর্চি হরণ করে নিতে চাইছে। ছোটবাবু তুমি জান না, এ পবিত্রতা আমার সব। সহজে সে ঘুমোতে পারল না। পাশ ফিরে শুল। ঘুম আসছে না, কেবল হিজবিজি ভাবনা তার, যেন সেই আশৈশব ক্যাসেলের পাশে ভ্রমণ—বাবার হাত ধরে ভ্রমণ। এখন বাবার হাত ধরে কোথাও আর যেতে ভাল লাগে না তার। মনে মনে কার্ডিফ-ক্যাসেলের পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে কেবল ছোটবাবুর মুখ সে দেখতে পায়। বাবার মুখ আর কিছুতেই মনে করতে পারে না।

বনি আরও ভেবে অবাক হয়ে যায়, সে কত সহজে যে এই জাহাজে বড় হয়ে যাচ্ছে। তার চিন্তা ভাবনা কেমন পরিণত মানুষের মতো। সে আর ছেলেমানুষের মতো অকারণ ছোটবাবুর কেবিনে ছুটে যেতে পারছে না। পারলে যেন ভাল হত। অভিমানে সে এমন ভেঙ্গে পড়ত না। শুয়ে শুয়ে ফুলে ফুলে কাঁদতে হত না।

ছোটবাবু তখনও জেগে আছে নিচে। সে চুপচাপ একাকী বসে রয়েছে। আর্চির মুখ অতিকায় হয়ে যাচ্ছে। কখনও মনে হচ্ছে সে নিজে সমুদ্রের নিচে ছোট রুপোলী মাছ, বেশ নেচে নেচে বেড়াচ্ছে। জলের ভেতরে কি আছে জানত না। কিন্তু সেই জলে এক ভয়ঙ্কর ক্রুদ্ধ মুখ, হাঙ্গরের মতো লেজ নেড়ে নেড়ে ক্রমাগত তাকে অন্ধকারে লক্ষ্য করে যাচ্ছে যেন। আর্চিকে খুশী করার জন্য সে যা নয় প্রমাণ করতে চাইছে। সে নিজে বার বার মনে মনে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে, কিন্তু ব্যবহারে ভালমানুষ, মুখ বুজে কাজ করে যাওয়া স্বভাব। যখন আর পারে না, তখন কাপ্তানের কথা মনে হয়। মনে হয়, তাকে এভাবেই জীবনে বড় হতে হবে। সে তার ক্ষোভ অথবা উত্তেজনা ভুলে থাকার চেষ্টা করছে।

জ্যাকের কথা ভেবে আরও অবাক। এত রাতে জ্যাক নিচে নামে না। জ্যাক রাত হলে নিজের কেবিনে বসে থাকে। কখনও জ্যাক এবং সে আর ডেবিড বোট-ডেকে বসে থাকে। একটু রাত হলেই জ্যাক কেবিনে চলে যায়। দুটো-একটা কথা পোর্ট-হোলে দাঁড়িয়ে জ্যাক বলতে ভালবাসে। সে ভেবেছিল, জ্যাক ওর দিকেই ছুটে আসবে। কিন্তু জ্যাক গঙ্গাবাজুর দিকে ছুটে গেল কেন বুঝতে পারল না। কেবিনেই বা জ্যাক ঢুকে গেল কেন—তাও বুঝছে না। কাল দেখা হলে আর্চির কাছে ক্ষমা চেয়ে নেবে। এবারে সে ঘুম যাবে ভাবল।

কাপ্তান তখন নিজের কেবিনে বসে আছেন। সাদা জিন কাপড়ের ফুল প্যান্ট, সাদা হাফ-সার্ট এবং পায়ে সাদা জুতো। যতক্ষণ ডিউটি থাকবে, ততক্ষণ একেবারে পুরো ইউনিফরমে বসে থাকবেন। পোর্ট-হোল দিয়ে সামনের সমুদ্র দেখার স্বভাব। সালফার বোঝাই বলে জাহাজের ড্রাফট আটাশ। এর চেয়ে বেশি জাহাজে মাল তোলা যায় না। সামান্য ঢেউ উঠলেই জল উঠে আসে। খুব সতর্ক তিনি। এমন কি এখন যে মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিলেন তাও যেন ঠিক না। জাহাজ আবার সেই একই রাস্তা ধরে যাচ্ছে। সেই মাস্তুলে লম্ফ জ্বালিয়ে জাহাজ আবার যাচ্ছে সেই দ্বীপগুলিতে—কোম্পানী থেকে যে-যে ভাবে জাহাজের কার্গো দেওয়া হচ্ছে তাতে করে কতমাস এই সব দ্বীপপুঞ্জে ঘুরে বেড়াতে হবে তিনি বুঝতে পারছেন না।

অথচ তিনি এই প্রশান্ত মহাসাগরে পড়ার পরই হঠাৎ অনুভব করলেন, বনি আর আগের মতো নেই। সে লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি ভাঙ্গে না। সে রেলিঙ থেকে রেলিঙ-এ ঝুলে চলে যায় না। অথবা সে যে একটা দোল খাবার মতো ব্যবস্থা করে নিয়েছিল চিমনির পাশে সেখানে সে বসে না। বসলেও চুপচাপ, নিজের ভেতরে সে নেই, চোখে-মুখে কেমন এক আশ্চর্য উদাসীনতা। লাজুক, নম্র স্বভাবের হয়ে যাচ্ছে। বনির কথা ভেবেই তিনি অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন। এবং তখনই মনে হল, তাকে দরজার বাইরে কেউ ডাকছে। বনির মতো গলা। দরজা খুলে বের হয়ে দেখলেন কেউ নেই। অবাক। তিনি স্পষ্ট শুনতে পেয়েছেন বনির মতো কেউ ডেকে বলছে, দরজা খোল। ভিতরে ঢুকতে পারছি না।

হিগিনস সামান্য সময় দরজায় দাঁড়ালেন। বনি, না অন্য কেউ। অন্ধকার রাত বলে চারপাশে স্পষ্ট কিছু দেখা যায় না। চিমনির নিচে মনে হল গাউন পরে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। কুয়াশার মতো, ছায়া ছায়া! কি আশ্চর্য বনি এ-পোশাকে বের হয়েছে! কি সাহস মেয়ের! রাত গভীর। কেউ বোট- ডেকে এ সময়ে থাকবে না বলে, বনির এমন সাহস তিনি একেবারেই পছন্দ করছেন না। তিনি প্রায় দ্রুত নেমে যাচ্ছিলেন সিঁড়ি ভেঙ্গে। জোরে ডাকতেও পারছেন না বনি বলে। জ্যাক বলে ডাকলে, ব্রীজে যাদের ডিউটি তারা সতর্ক হয়ে যেতে পারে। অসময়ে কাপ্তান নিচে নেমে যাচ্ছেন কেন! আর যদি চিমনির ও-পাশে ছায়া ছায়া অন্ধকারে বনিকে আবিষ্কার করে ফেলেন, তবে কেলেঙ্কারি। তিনি যেন মরিয়া হয়ে ছুটছেন, এবং নেমে যাবার সময় পাইপে হোঁচট খেয়ে পড়তে পড়তে উঠে দাঁড়ালেন। আর দাঁড়াতেই অবাক, রেলিঙ ফাঁকা। অস্পষ্ট ছায়া ছায়া অন্ধকারে বনি কিংবা গাউনপরা কেউ নেই। যত দ্রুত নেমে যাচ্ছিলেন, ঠিক তত দ্রুত তিনি বনির কেবিনে গিয়ে জোরে ডাকলেন, জ্যাক জ্যাক।

বনি বাবার গলা শুনে ধড়ফড় করে উঠে বসল। সে ঘুমোয়নি। তার কিছুতেই ঘুম আসছিল না। সে লাফিয়ে নিজের পোশাক পরে দরজা খুলে বলল, বাবা তুমি!

—বনি তুমি আমাকে ডেকেছিলে?

—নাতো বাবা।

—এই এক্ষুনি—মানে মিনিট চার-পাঁচ আগে।

—নাতো বাবা। কেন কি হয়েছে!

—কিছু না। তুমি ঘুমোও। সাবধানে ঘুমোবে। বনি তুমি ভয় পাও না তো?

—না বাবা। ভয় পাব কেন!

—ছেলেমানুষ তুমি।

বনি বলল, ভিতরে এস! তুমি এত ঘামছ কেন বাবা? বোস।

—ঘামছি! তিনি বসতে বসতে বললেন।

—হ্যাঁ। বলে বনি তোয়ালে দিয়ে বাবার কপাল মুখ মুছিয়ে দিতে থাকল। তারপর হেসে ফেলল, তুমি না বাবা যত বয়স বাড়ছে তত ছেলেমানুষ হয়ে যাচ্ছ। আমার কথা ভেবে তোমার ঘুম আসে না।

কাপ্তান কিছু বললেন না। বসে থাকলেন। দেখলেন, মেয়ের কিছু পোশাক ছেঁড়া। প্যান্ট, ঢোলা জামা, ব্রেসিয়ার একপাশে পড়ে আছে।

কাপ্তান দেখলেন সব। কিছু বলতে পারলেন না। এই বোট-ডেকে এলিস এইমাত্র তবে এসেছিল, তার গলা। এলিসই বনির গলা নকল করে ডেকেছে। তারপর ভাবলেন, হয়তো তিনি বনির কথা ভাবতে ভাবতে খুব বেশি অন্যমনস্ক হয়ে গেছিলেন। এবং মনে হয়েছিল, বনি তাঁকে ডাকছে। কিন্তু পরক্ষণেই আর একটা চিন্তায় তিনি ভীত হয়ে পড়লেন। দীর্ঘ বিশ বছর আগে এলিসকে নিয়ে এ জাহাজে উঠেছিলেন। ঠিক সেই এলিসের গাউন অন্ধকার রাতেও রেলিঙে ঝলমল করছিল! তিনি এবার ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন। মেয়ের দিকে তাকাতে পর্যন্ত সাহস পেলেন না। কেবল বললেন, দরজাটা বন্ধ করে দাও। ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকলেন।

তারপর তিনি ঠিক সেই রেলিঙের কাছে গিয়ে বললেন, এলিস, আমি ক্যাপ্টেন স্যালি হিগিনস. বলছি।

শুধু ওপরে অজস্র নক্ষত্রমালা, অন্ধকার সমুদ্রে একটা গুমগুম আওয়াজ, প্রপেলারের একটানা জল- ভাঙ্গার শব্দ, আর কিছু না। না, মনে হল, সেই এ্যালবাট্রস পাখি দুটো এখনও উড়ছে। দূরে কোথাও তিনি তাদের কক্ কক্ শব্দ শুনতে পেলেন।

এ-সব কিছুই তিনি এখন শুনতে চান না! তিনি ফের বললেন, আমি স্যালি হিগিনিস ক্যাপ্টেন এস-এস সিউল-ব্যাঙ্ক, বলছি। তুমি শুনতে পাচ্ছ।

না কোন জবাব নেই। পাখি দুটো জাহাজের মাথায়, বোধ হয় মাস্তুলের ডগায় বসার জন্য আবার এসেছে। তাদের অতিকায় ছায়া, তাঁকে মুহূর্তের জন্য ঢেকে দিয়ে চলে গেল।

তিনি বললেন, এলিস, আমি সব সহ্য করব। যে কোন শাস্তি। দোহাই তুমি বনির ছদ্মবেশে এসো না। বনির গলায় আমাকে ডেকো না। বনির কোন দোষ নেই। তারপর তিনি নিজেই অবাক হয়ে ভাবলেন, অদৃশ্য আত্মার সঙ্গে তিনি কথা বলে চলেছেন। ভয়ে তাঁর শরীর ফুলে উঠছে। একাকী নিশীথ অন্ধকারে দেখলেন, দূরে একটা নক্ষত্র এইমাত্র খসে পড়ল। তিনি ফিরে এসে কেবিনে ঢুকতে সাহস পেলেন না। ব্রীজে একটা ডেক-চেয়ারে চুপচাপ অন্ধকারে বসে থাকলেন। সামনে থার্ড-মেট, হুইলের সামনে কোয়ার্টার-মাস্টার। ওদের দুজনেরই চোখ সামনের দিকে। পেছনে কেউ বসে আছে তারা টের পেল না।

আবার কোন নক্ষত্র যদি সমুদ্রের অতল থেকে ভেসে ওঠে এবং ভাসতে ভাসতে আকাশের গায়ে টুপ করে লেগে যায় বুঝতে পারবেন, এই নক্ষত্র বেয়ে কেউ কখনও এ-জাহাজে নেমে আসে। বোধহয় এলিসও তাই করছে। জাহাজ থেকে আকাশে, আকাশ থেকে সমুদ্রের গভীরে ডুবে যায়। এভাবে জাহাজের পিছু পিছু অথবা যেখানে তিনি থাকছেন, এলিস সঙ্গে সঙ্গে রয়েছে। এমন মনে হতেই ফের স্বাভাবিক হয়ে গেলেন। উঠে থার্ড-মেটের কাঁধে হাত রাখলেন। সেদিন থার্ড-মেটকে গালাগালি করেছেন। আজ কেন জানি মনে হল থার্ড-মেট সত্যি খুব কর্তব্যপরায়ণ অফিসার। তিনি বললেন, থার্ড-মেট, তোমার কি মনে হয়?

—কী স্যার?

—ওই ভূতটুতের ব্যাপার সম্পর্কে!

—আমার এতে বিশ্বাস নেই স্যার!

—অথচ দ্যাখো রিচার্ড নেমে গেল। চোখ-মুখের কি অবস্থা হয়েছিল!

—আমি তো জাহাজে কিছু কখনও দেখি না।

—আমিও না। বলেই তিনি লগ-বুকের পাতা উল্টাতে থাকলেন। তারপর বললেন, কম্পাস রিডিং ঠিক দিচ্ছে তো।

—সামান্য গণ্ডগোল করছে।

সামান্য বলতে কতটুকু তিনি তাড়াতাড়ি অঙ্ক কষে সেই হিসেবটা বের করলেন। জাইরো কম্পাসের সঙ্গে হিসেব মিলিয়ে দেখলেন, ঠিকই আছে। একটু এদিক-ওদিক সব জাহাজেই হয়। তিনি এবার যেন তার পুরানো সাহস ফিরে পেয়েছেন। বললেন, তবু কখনও কখনও এমন হয়। কি হয়, কিছু বললেন না। থার্ড-মেট প্রশ্ন করে, কি হয় জানতে পারল না। কাপ্তান তাঁর কেবিনের দিকে চলে যাচ্ছেন। কাপ্তান যে ঘুমোন না, জেগে থাকেন এটা বোধহয় দেখিয়ে গেলেন। কাপ্তানের দরজা বন্ধ হলেও থার্ড-মেট তেমনি সামনে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে থাকল। দুরের দুটো একটা আলো দেখে মনে হল অন্ধকারে একটা দ্বীপটিপ এগিয়ে আসছে সামনে। র‍্যাডারে সে দেখতে পেল—ওটা দ্বীপই। সঙ্গে সঙ্গে টেলিগ্রাম পাঠাল নিচে, স্লো। জাহাজের গতি কমিয়ে দিন। সামনে একটা দ্বীপ দেখা যাচ্ছে। এবং দ্বীপের পাশ কাটিয়ে জাহাজ ফের নেমে গেলে সে টেলিগ্রাম পাঠাল ফের—ফুল। পুরোদমে চালান। নিচে ডিউটি এনজিনিয়ার চার নম্বর, টেলিগ্রামে ঘণ্টা বাজতেই জাহাজের গতি বাড়িয়ে দিল। তারপর টুলের ওপর একটা পা রেখে সামান্য ঝুঁকে থাকল নিচে। কখনও পায়চারি করল। কখনও ব্যালেস্ট পাম্প চালিয়ে ময়লা জল বের করে দিতে থাকল। বয়লারের ওপাশে তিনজন ফায়ারম্যান, টিণ্ডাল। ওরা উইণ্ডসেলের নিচে দাঁড়িয়ে গেজে স্টিম দেখছে। এবং নানারকমের সব বালব, কক, গেজ। কক থেকে ফ্যাচ ফ্যাচ শব্দে স্টিম এবং জল একসঙ্গে বের হয়ে আসছে। আবার কোথাও হিসহিস শব্দ এবং নিচে ওরা প্রায় সমুদ্রের সারফেস থেকে আটাশ ফুট নিচে। ওরা কয়লা মেরে যাচ্ছে, ফার্নেস-ডোর খুলে আগুন ঘেঁটে দিচ্ছে। বড় বড় স্লাইশ, র‍্যাগ টানছে তুলছে এবং ভেতরে প্রায় সমস্ত শক্তি দিয়ে ঠেলে দিচ্ছে—এবং এভাবে শরীরে ওদের আগুনের হলকা এসে প্রায় সারা শরীর ঝলসে দেবার মতো। তখনই এয়ার বালব না টেনে পারা যায় না। না হলে আগুন লেগে পুড়ে মরার কথা।

আর এই হচ্ছে নিশীথের জাহাজ। সমুদ্রে নিশীথে জাহাজ এভাবেই চলে। আফট্-পিকে যে জাহাজি ডিউটিতে থাকে এখন সে কেন বেল বাজাল না! থার্ড-মেট ভেবে পেল না এটা। সবাই যখন সতর্ক, সজাগ প্রায় শরীরের শিরা-উপশিরার মতো সিউল-ব্যাংককে সচল রাখছে, তখন আফট্-পিকে দ্বীপ দেখে ঘণ্টা বাজল না, ভারি বিস্ময়ের। জাহাজে একটা বড় রকমের দুর্ঘটনা ঘটতে পারত, চড়ায় উঠে পড়তে পারত জাহাজ—তাছাড়া এত কাছাকাছি কোনও দ্বীপ তো থাকার কথা না। সহসা এমন মনে হতেই চার্টের ওপর ঝুঁকে বুঝতে পারল, অন্তত দুশো মাইলের ভেতর কোনও দ্বীপ নেই। তবে এটা সে কি দেখল! সে যে টেলিগ্রাম পাঠাল, এবং মনে হল সামনেই একটা দ্বীপ, এমন কি র‍্যাডারে মনে হল দ্বীপ। এত সব হবার পর সে কেমন ঘাবড়ে গেল। ঘণ্টাখানেকও হয়নি কাপ্তান এসে নিজে কম্পাস রিডিং-এর ডিভিয়েসান দেখে গেছেন—জাহাজ দ্রাঘিমা অক্ষাংশ ঠিক রেখে এগিয়ে যাচ্ছে, অথচ সে একটা দ্বীপের পাশ কাটিয়ে জাহাজ নামিয়ে আনল।

সে বলল, কোয়ার্টার-মাস্টার, তুমি কি স্টার-বোর্ডে একটা দ্বীপ দেখতে পাও নি?

–না তো স্যার।

—না তো স্যার! তবে আমি টেলিগ্রাম পাঠালাম কেন নিচে!

—সে তো জানি না স্যার!

—তুমি ঘুমোচ্ছিলে?

—না স্যার।

থার্ড-মেট ভাবল, এ দুনম্বর ঠিক নেশাভাঙ করে। সে হয়তো কিছুই খেয়াল করেনি। কেবল হুইল ঘুরিয়ে যাচ্ছে কম্পাস দেখে। আর কাকে সে সাক্ষী রাখতে পারে। লগ-বুকে লিখতে হবে সব। এনজিন- রুমের লগ-বুকে এতক্ষণে লেখা হয়ে গেছে। কতটা সময় জাহাজ স্লো চলেছে—কার ডিউটি, ফোর্থ এনজিনিয়ারের! না ওকে ফের নতুন করে কিছু লেখানো যাবে না। সে তাড়াতাড়ি কাপ্তানের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, থার্ড-মেট স্যার।

—কাম-ইন।

থার্ড-মেট দেখল কাপ্তান টেবিলে বড় একটা চার্ট ফেলে কি মাপ-জোক করছেন। এবং ভীষণ নিবিষ্ট। বললেন, বোস।

—স্যার!

—তুমি ভুল করেছ ভাবছ!

—হ্যাঁ স্যার।

—না। ঠিকই দেখেছ।

—কিন্তু স্যার কোর্সে কোন দ্বীপের উল্লেখ নেই। দুশো মাইলের ভেতর নেই।

তিনি বললেন, চার্ট সেকেণ্ড-মেট ভুল করেছে। চার্ট অনুযায়ী জাহাজ চললে আমাদের ভীষণ ভুগতে হত।

থার্ড-মেট মাথা চুলকে বলল, তবে চার্ট অনুযায়ী জাহাজ চলছে না!

—না।

—কিন্তু স্যার, আমরা তো সাধ্যমতো করে যাচ্ছি। চার্ট অনুযায়ী জাহাজ চালাচ্ছি।

কাপ্তান বুঝতে পারলেন, থার্ড-মেট কিছু ভুল করেছে ভেবে ভীত। তিনি বললেন, ভয় পাবার কিছু নেই। ঠিকই যাচ্ছে জাহাজ। যেন বলতে চাইলেন, আমরা ভুল করলেও সিউল-ব্যাঙ্ক ভুল করে না। আর হবেই বা না কেন, কতবার সিউল-ব্যাঙ্ক পানামা ক্রশ করে ঠিক এই পথে তাহিতি হয়ে নিউ-জিল্যাণ্ড এবং শেষে সে এই সব দক্ষিণ সমুদ্রের দ্বীপে ঘুরতে ঘুরতে প্রত্যেকটা দ্বীপকে চিনে ফেলেছে। ভুল কোর্সে চালিয়ে তাকে নিয়ে যাওয়া কঠিন। অবশ্য কেউ এ-সব বিশ্বাস করবে না, থার্ড-মেটও না, তিনি শুধু থার্ড-মেটকে বলে দিলেন, জাহাজ ঠিক যাচ্ছে। ভয় পাবার কিছু নেই। সেকেণ্ড-মেট এলে দেখা করতে বলবে।

সেকেণ্ড-মেট বারোটায় এলে কাপ্তান দেয়ালে একটা স্টিক তুলে ধরলেন। বললেন, কত দ্রাঘিমা অক্ষাংশ?

ডেবিড বলল, হানড্রেড এ্যাণ্ড ফাইভ ওয়েস্ট, ফিফটিন সাউথ।

কাপ্তান বললেন, ঠিক আছে?

ডেবিড দেখল, সে যে চার্ট করেছে, ওটা সোজা নিউ-প্লাইমাউথে যাবার কোর্স-লে। তাহিতিতে যেতে হলে আরও কয়েক ডিগ্রি সাউথ-সাউথ-ওয়েস্টে বেড়ে যাবার কথা। এবং আশ্চর্য জাহাজের এত বড় ভুলটা কারো নজরে আসেনি। আর ডেবিড অবাক, জাহাজ ঠিক পথেই চলেছে। চার্ট অনুযায়ী না চলে—কোথায় কম্পাস রিডিং-এ ভুল থেকে গেছে কেউ ধরতে পারেনি। তাহিতিতে যাবার পথে ওরা যে পরিচিত একটা ছোট্ট দ্বীপ দেখে থাকে সিউল-ব্যাঙ্ক তাও ভুল করেনি। এবং এমন সব হলেই ওরা কেমন বিমূঢ় হয়ে যায়। তখন কাপ্তান হিগিনস সহ গোটা জাহাজটা একটা শয়তানের আস্ত নিবাস তারা ভেবে থাকে। কাজেই ডেবিড আর কিছু বলতে পারল না। সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল। এত বড় একটা ভুলের জন্য সে দায়ী, যদিও জাহাজ ছাড়ার আগে সব অফিসাররাই চার্ট দেখে থাকে, অথচ দেখেও এমন একটা সহজ ভুল কেউ ধরতে পারল না—সুতরাং কাপ্তান ওকে অদায়িত্বশীল ভেবে তিরস্কার করবেন। এসব মনে হওয়ার দরুন সে যেতে পারছিল না।

হিগিনস খুব খুশি। যেন এটা তিনি আরও দেখেছেন। ভীষণ একটা প্লেজার, আনন্দে আর তিনি স্থির থাকতে পারছেন না। বলছেন, বুঝলে ডেবিড, জাহাজ আমাদের খুব বিশ্বস্ত। আমরা ভুল করলেও সে করে না। কেমন দেখলে তো! নিজের চোখে দেখলে।

ডেবিড কি বলবে? সে বলল, হ্যাঁ স্যার। এবার আমি তাহলে যেতে পারি?

—যাবে? যাও।

ডেবিড তাড়াতাড়ি বের হয়ে পড়ল। জাহাজটা সামান্য দুলছে। সমুদ্রে ঠাণ্ডা হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। শেষ রাতের দিকে সামান্য শীতও বেড়েছে। ডেবিড সেজন্য একটা মোটা গেঞ্জি গায়ে দিয়ে এসেছে। জাহাজি পোশাক। মাথায় এংকোরের টুপি। সে প্রায় গটগট করে ব্রীজে ঢুকে গেলে থার্ড-মেট বলল, কি আশ্চর্য কাণ্ড!

ডেবিড বলল, বাজে। বাজে কথা।

—তার মানে!

—মানে কাপ্তান ভুলটা ঠিকই ধরতে পেরেছিলেন। প্রথমেই ধরতে পেরেছিলেন। তিনি তলে তলে কোথায় কিভাবে কি করেছেন কে জানে!

থার্ড-মেট বুঝল, ডেবিড এসবে পাত্তা দিতে চায় না। না দেওয়া স্বাভাবিক। একটা জাহাজ নিজের খুশিমতো চলে ভাবতে গেলেই শরীর শিউরে ওঠে। আর সত্যি সে যখন চোখের ওপর দেখতে পায়, একটা জাহাজ নিজের খুশিমতো পথ ঠিকঠাক করে নির্দিষ্ট বন্দরে ঢুকে যাচ্ছে তখন মাথা ঠিক রাখা যায় না। জাহাজটা তাদের নিয়ে তবে যা খুশি তাই করতে পারে। জাহাজটাকে তারা নিয়ে যাচ্ছে না, জাহাজটা তাদের নিয়ে যাচ্ছে। এ-সব মনে হলেই মাথায় প্রায় বাজ পড়ার মতো। মুখে ডেবিড বাজে বলে উড়িয়ে দিলেও মনে মনে ভীষণ ভয় পেয়ে গেছে। এবং এ-জাহাজটা যে খুশিমতো আর স্ক্র্যাপ করা যাবে না জাহাজের মর্জি না হলে স্ক্র্যাপ করার হুকুম যে দেবে সেই ভোগে যাবে এ-সব যখন ভাবছিল, তখ, চোখ ওর গোল গোল হয়ে যাচ্ছে। কখন থার্ড-মেট চলে গেছে, কখন আর একজন কোয়ার্টার-মাস্টার এসে হুইলের দায়িত্ব নিয়েছে সে যেন টের পায় নি। ওর কেন জানি মনে হল, জাহাজ থেকে নেমে যেতে না পারলে কারো রক্ষা থাকবে না। খুশিমতো চড়ায় উঠে বসে থাকবে, খুশিমতো সমুদ্রের অতলে ডুবে নিরুদ্দিষ্ট করে দেবে তাদের। কোন বেতার সংকেত কোথাও ওরা পৌঁছে দিতে পারবে না। সমস্ত এস-ও-এস ইথারে ভেসে ভেসে মহাকাশে বিলীন হয়ে যাবে। পৃথিবীর কোনো ট্রেনসমিটারে সিউল-ব্যাংকের এস-ও-এস ধরা পড়বে না। সে চিৎকার করে বলতে চাইল, নো নো। নেভার। কিন্তু পারল না। কোয়ার্টার-মাস্টার একটা মোমের পুতুলের মতো হয়ে গেছে। স্থির। চোখ এবং হাত-পা কোনো এক অদৃশ্য আত্মার প্রভাবে যেন চলছে।

সে কাছে গিয়ে নাড়া দিল—এই

কোয়ার্টার-মাস্টার ডেবিডের দিকে তাকাল।

—চোখ এমন করে রেখেছ কেন?

-–কি করে রেখেছি সাব?

–একেবারে স্থির। চোখের পলক পড়ছে না।

—না সাব।

এমন নিশীথে, অর্থাৎ এত রাতে, কারণ এখন রাতদুপুর, সমুদ্রে কেউ জেগে নেই, পাখি দুটোও না, দ্বীপে হয়তো থেকে গেছে—তখন মোমের পুতুলের মতো কোয়ার্টার-মাস্টারের মুখ তাকে সীমাহীন অসহায়তার ভেতর টেনে নিয়ে যাচ্ছে। বার বার নাড়তে থাকে, না, না—তুমি ঠিক নেই তিন নম্বর। তুমি কারো প্রভাবে চোখ এমন করে রেখেছ। তুমি নিজের ভেতরে নিজে নেই।

কোয়ার্টার-মাস্টার বলল, সাব ঠিক থাকা যায় না।

–কেন কেন?

—শরীরে কেমন রোমাঞ্চ হয়। কি যে হয় বুঝি না। কম্পাসের কাঁটা, হুইল যেন সব নিজের ইচ্ছায় চলে। আমার কিছু করার থাকে না।

ডেবিড হয়তো এবার সত্যি চিৎকার করে উঠতে পারলে বাঁচত—সব গাঁজাখোরি। সব মিথ্যা। সিউল-ব্যাংক সম্পর্কে সব শুনে শুনে এমন হয়েছে। তোমরা ভীরু, কাপুরুষ। বলে সে নিজে হুইল ধরলে থরথর করে কাঁপতে থাকল। হুইলের সঙ্গে সে কেমন বিদ্যুৎপৃষ্ঠের মতো সেঁটে গেল। হাত দুটো শক্ত হয়ে যাচ্ছে। আর হুইলটা যখন যেমন দরকার নড়ছে। কম্পাসের কাঁটার সঙ্গে ঠিক মিল রেখে একবার ডাইনে বাঁয়ে ঘুরছে।

সে প্রায় ছিটকে বের হয়ে এসে বলল, কি ব্যাপার। কখনও তোমরা বলনি তো!

—কোন ক্ষতি করে না সাব।

তারপরই কেমন তাকে এক অহংকারে পেয়ে বসে। সে, সব মিথ্যা অহমিকা জাহাজ-এর ভেবে জাহাজের মুখ উল্টোমুখে ঘুরিয়ে দিতে যায়। ঠিক ঘুরে যায়, কিন্তু পরে আবার নিজের মতো জাহাজ পথ করে নেয়। ডেবিড যা করতে চায় করে। সে যেভাবে চালাতে চায় চলে, কিন্তু পরক্ষণে কেমন সেই এক গতি, জাহাজ যাচ্ছে তাহিতিতে।

কোয়ার্টার-মাস্টার বলল, আপনি সাব ভয় পেয়েছেন।

ডেবিড বলল, না। তবু এটা কি যে হল!

—কী সাব?

—এই যে হুইল ধরলে হাত শক্ত হয়ে গেল।

—ভয় পেয়েছেন বলে।

—তুমি?

—আমরা জাহাজকে মান্য করি। লেখা-পড়া জানি না, সারেং-সাব যা বলেন তাই করে থাকি। এত বড় জাহাজটা যাবে, তার খুশি মোতাবেক যাবে। ভয়ের কি আছে। সে তো আমাদের ঠিক ঠিক নিয়ে যায়। হিগিনস থাকলে আমাদের কোন ভয় থাকে না সাব।

ডেবিড আর এ-নিয়ে ভাবল না। ভাবলে মাথা খারাপ হয়ে যাবে। জাহাজে উঠে সে অজস্রবার হুইল ঠিক ঠিক বেঁধে দিয়েছে, আজকের মতো অবস্থা তার হয়নি। মনে মনে সে ভীত হয়ে পড়ছে। সকাল হলে সব কেটে যাবে। এ-সব অনুভূতি থাকবে না। সে যতটা পারল হুইল থেকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকল। ব্রিজের ভেতর থেকে আকাশ এবং সমুদ্রকে আশ্চর্য রহস্যময় মনে হয়। সে নক্ষত্র এবং অন্ধকার সমুদ্র দেখতে দেখতে বুঝল চারটে বাজতে দেরি নেই। একটু বাদেই সূর্য উঠবে। ঠিক পেরুর পর্বতমালার এপাশে সূর্য সে দেখতে পাবে। সমুদ্র থেকে সহসা ভেসে ওঠার মতো, এবং সূর্য ওঠার আগে সেই সব রং-বেরংয়ের আভা পরিবর্তনশীল আকাশ এবং সমুদ্রের রং, আর যদি কোনও ছোট ফ্লাইং ফিস সে-সময় উড়ে উড়ে আসে, তখন তার এই জাহাজের অস্থিরতার কথা মনে থাকবে না। মনে হবে, জাহাজ তারা ঠিকই চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কোথাও কোন ভুল নেই। কাপ্তান জাহাজের নাম করে একটু বেশি বাহবা নিতে চাইছে। আর কিছু না।

সকালে সমুদ্রে সূর্য উঠছিল। সূর্য ওঠার সময় মনে হয় এই সামনে একেবারে সামনে সূর্য সমুদ্রের অতল থেকে ভেসে উঠল। ডেবিড বোট-ডেকে দাঁড়িয়ে দাঁত ব্রাস করছিল। কোর্স এতটা কি করে ভুল হল সে কিছুতেই বুঝতে পারল না। জাহাজের আজগুবি বিশ্বাস অবিশ্বাসে সে কেমন মনমরা হয়ে আছে। এবং এভাবেই সে এখন ভেবে থাকে সমুদ্রে সূর্য উঠলেই এখন পেরুর পর্বতমালার নিচে উঠবে। যদিও তারা হাজার মাইলের ওপর দূরে রয়েছে। এবং কাছাকাছি কোথাও স্থলভাগ নেই বলে সূর্য পেরুর পর্বতমালার নিচে উঠছে ভাবতে ভাল লাগে তার। এও তেমনি মনে হয়, কাপ্তান হয়তো জানেন হিসেবে কোথাও ভুল করে জাহাজ ঠিক কোর্স-লে পেয়ে গেছে। ঠিক কোর্স-লে পেয়ে গেছে কথাটা কাপ্তান বেমালুম অস্বীকার করতে চাইছেন।

এ-নিয়ে সকালে কথাবার্তা হতে পারে, সবাই জানবে, ডেবিড মারাত্মক ভুল করেছে। কোর্স লে ঠিক করতে পারেনি। সে এজন্যও কিছুটা মনমরা ছিল। তখনই সে দেখলো এ্যালবাট্রস দুটো মাস্তুলে বসে রয়েছে। মাস্তুলের ডগায় এত বড় পাখি দুটো কেউ খেয়ালই করেনি। এবং সঙ্গে সঙ্গে সে আর স্থির থাকতে পারল না। মনমরা ভাবটা একেবারে কেটে গেল। দু-লাফে কেবিনে ঢুকে বন্দুক হাতে নিয়ে হামাগুড়ি দিতে থাকল। তারপর সেই বড় পাখিটাকে, বড়-পাখিটাই ওর মাংস খুবলে নিয়েছে। এমন সুযোগ আর সে পাবে না। পাখি দুটোর বোধ হয় চোখে এখনও ঘুম জড়িয়ে আছে। ওদের ঠোট ডানার ভেতরে। সে সন্তর্পণে এগিয়ে যাচ্ছে। বুঝতেই দিচ্ছে না বোটের নিচে হামাগুড়ি দিয়ে কেউ এগিয়ে যাচ্ছে।

সকালে তখন ছোটবাবু মাত্র বাথরুম থেকে বের হয়েছে। এক কাপ চা রেখে গেছে মেস-রুম- বয়। একটু ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছিল। শীত শীত করছে। একটা চাদর গায়ে চড়িয়ে চা খেল। পোর্ট-হোলের কাচ খুলে দিল। আর্চির কাছে প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে। তার এখন কিছু আর করণীয় নেই। নতুবা কাপ্তানের কাছে কি আবার মিথ্যা রিপোর্ট করবে, ভাবতেই সে বিষণ্ণ হয়ে গেল।

আর জ্যাক সারারাত অসহ্য জ্বালায় একেবারে ঘুমোতে পারেনি! আর্চি ওকে ভয় দেখিয়েছে। আর্চি সব জেনে এখন ওকে নানাভাবে খেলাবে। সে যে ছোটবাবুকে চুমু খেয়েছিল, আর্টি তাও দেখেছে। আর্চি ভয় দেখাচ্ছে, কাপ্তানের কানে কথাটা তুলবে। জ্যাক সহজভাবে সব মেনে না নিলে আর্চি তাকে সহজে রেহাই দিচ্ছে না। সারারাত ভেবেছে কি করবে! ছোটবাবুকে সব খুলে বলবে কিনা, না চুপচাপ সব হজম করে যাবে। বাবাকে বললে, সে যে বনি, বাবার একমাত্র আশ্রয় এবং বাবার আশা-ভরসা —এমন শুনলে বাবা আরও ভেঙ্গে পড়বেন। ওর বয়েস কম হলে কি হয়, গত রাতে বাবার মুখ দেখে টের পেয়েছিল, তিনি মাঝে মাঝে ভীষণ ভয় পেয়ে যান। এবং ছেলেমানুষের মতো মুখ করে বনির দিকে তাকিয়ে থাকেন। বাবাকে তখন ওর ছোট্ট শিশুসন্তানের মতো লাগে। সে, সব এখন থেকে সহ্য করতে পারবে, কিন্তু বাবাকে কষ্টের ভেতর কিছুতেই ফেলে দিতে পারবে না। এ-সব ভাবতে ভাবতে ওর চোখ ভোররাতের দিকে জড়িয়ে এসেছিল, তখনই এক ভয়ঙ্কর শব্দে সে চমকে উঠল। জাহাজে ফায়ারিং হচ্ছে। সে ছুটে বের হবার আগে পোশাক তাড়াতাড়ি পাল্টে নিল। বোট-ডেকে নেমে যা দেখল, তাতে সে হিম হয়ে গেছে। বড় পাখিটা অতিকায় ডানা মেলে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। পাখা ঝাপটাচ্ছে। গল গল করে রক্তে ডেক ভেসে যাচ্ছে। আর লেডি এ্যালবট্রস জাহাজটার চারপাশে উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। জাহাজটাকে ছেড়ে সে কিছুতেই দূরে চলে যাচ্ছে না। কেমন কান্নার মতো এক আর্ত বেদনা পাখিটার গলায়।

পাখিটা রক্ত ওগলাতে ওগলাতে মরে যাচ্ছে এবং এক ভীষণ অমঙ্গলের আশঙ্কায় বনি স্তব্ধ হয়ে গেল। পাখিটা মরে গেলে সে এতটা ভেঙ্গে পড়বে কখনও বুঝতে পারে নি। মনে হল মৃত্যুর আগে পাখিটার অসহায় চোখ তার ভারি চেনা। যখন মনে হল তখন আর স্থির থাকতে পারল না। ছোটবাবুর কেবিনে দৌড়ে গেল। –ছোটবাবু, ম্যান এ্যালবাট্রস ডেড।

ছোটবাবু ভারি খুশি। বলল, সত্যি! সে দরজা খুলে বলল, সত্যি। আর সঙ্গে সঙ্গে সেই বাচ্চা ছেলের মতো মরা-পাখি জাহাজ ডেকে দেখার জন্য ছুটতে থাকল। এলি-ওয়েতে জ্যাক দাঁড়িয়ে আছে। অমঙ্গল ভেবে মুখ ক্লিষ্ট। এবং ছোটবাবুকে অপলক দেখতে দেখতে চোখ ভারি হয়ে আসছে জ্যাকের। তখন কেমন নিজের আনন্দে আছে ছোটবাবু। রাতের ঘটনা বেমালুম ভুলে গেছে। ভুলে না গেলে সে এভাবে দৌড়াতে পারে না।

আর তখনই একটা ভয়ঙ্কর অহংকারী স্বর এদিকে ভেসে আসছিল।-–ম্যান, ম্যান এদিকে এস।

ছোটবাবু একেবারে ফ্রিজ হয়ে গেছে। মুখোমুখি সেকেণ্ড-এনজিনিয়ার আর্চি। সে ছুটে যেতে পারল না। আর্চি তাকে এনজিনরুমে নেমে যেতে বলছে।

তখনও দূরে ঠিক ছোটবাবুর কেবিনের পাশে দাঁড়িয়ে আছে জ্যাক। সে দেখছে, আর্চি ছোটবাবুকে নিয়ে নেমে যাচ্ছে। কোথায় নিয়ে যাবে সে জানে। কত নিচে নামিয়ে তাকে টর্চার করবে তাও জানে। সে এখন কি করবে বুঝতে পারছে না। নিচে নামবে, না পাখিটার কাছে যাবে বুঝতে পারছে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *