1 of 2

অলৌকিক জলযান – ১৯

।। উনিশ।।

হেই হেই আর গুম গুম একটা শব্দ। ওরা নদীর ভেতরে ঢুকে গেলে এমন সব শব্দের ভিতর পড়ে গেল। দু’পাড় দেখা যাচ্ছে। প্রায় মাইলের ওপর চওড়া নদী, প্রায় সাত-আট ফেদম জল আছে। এবং গভীর নদীর ওপরে রয়েছে বড় বড় স্টিম-বোট। ওরা কেউ উজানে যাচ্ছে, কেউ নেমে আসছে। মাছ ধরার ছোট ছোট জাহাজ—ওরা কেউ মাছ ধরতে যাচ্ছে, কেউ মাছ ধরে ফিরছে। আর কখনও নদীর পাড় ভীষণ খাড়া। পঞ্চাশ ষাট ফুট খাড়া পাড়। নদী যেন অবলীলায় গর্জন করতে করতে লাফিয়ে নামছে। জাহাজটা তার ভেতর দিয়ে একটা ছবির মতো উঠে যাচ্ছে। দূর থেকে কখনও মনে হচ্ছে নিশ্চল জাহাজ, কাছে এলেই বোঝা যায়, না, বেশ যাচ্ছে জাহাজ। পাইলট চোঙ মুখে মাঝে মাঝে নদীর টেক সম্পর্কে বোধ হয় ব্যাখ্যা করে যাচ্ছে। এবং এভাবে জাহাজ চললেই মনে হয় সেই যেন কোনো অভিযাত্রী দল নদীর ভেতর দিয়ে ঢুকে যাচ্ছে। তখন দেখা যায় কেবল জাহাজিদের অহংকারী মুখ। ওরা ডেক ধরে হেঁটে গেলেই টের পায় নদী ভীষণ গর্জাচ্ছে, ফুঁসছে। তার সব কিছু অহংকার অবলীলায় ভেঙেচুরে জাহাজ ক্রমে দামাল হয়ে উঠছে। আর কি যেন তখন ভাল লাগে, নদীর পাড়ে কখনও বন, কখনও ছোট শহর, কখনও শুধু বার্চ আর দিওদর জাতীয় গাছ, অথবা বিরাট বাওবাব বৃক্ষের অন্তরালে দেখা যায় এক ফালি আকাশ, সেখানে চাঁদ উঠছে।

এমন সব দৃশ্য দেখলে মনে হয়, পৃথিবীতে এভাবে জাহাজে জাহাজে ঘোরা ভারী রোমাঞ্চকর। তখন হয়তো যাদের ওয়াচ নেই তারা ফল্কার ওপর বসে তাস খেলছে। কেউ হয়তো রেলিঙে চুপচাপ দাঁড়িয়ে অনেক দূরে দেখতে পায় একটা দেশ, তার ছোট্ট একটা নদী, নদীর পাড়ে তার গ্রাম এবং মসজিদে যে লোকটা আজান দিতে যায় তার মুখ। গভীর রাতে বিবির অপেক্ষা, মানুষটার জাহাজ থেকে চিঠি আসার কথা, ঘুম নেই তার চোখে। আর সেই মানুষ এখন একাকী রেলিংয়ে দাঁড়িয়ে পৃথিবীর অপর প্রান্তে নদীর মোহনায় এক ফালি চাঁদ দেখতে দেখতে অবাক হয়ে ভাবছে মসজিদের মাথায় চাঁপা ফুল গাছের ডালের ফাঁকে যখন চাঁদ ওঠে, ঠিক একরকম দেখতে। সব তেমনি ঠিক আছে, গাছপালা, বন, মাঠ, নদীর জল এবং জ্যোৎস্না। কেবল নেই সরল নোলক-পরা মেয়েটি যে পাশে থাকলে তার মনে হত, এটাও তার দেশ। আলাদা করে কিছু আর ভাবা যায় না।

তখন ভাণ্ডারি খাবার এগিয়ে দিচ্ছে! তাজা মাছ। মাছের ঝোল। ম্যাকরল মাছ তুলে নিয়েছে কিনার থেকে। তাজা মাছ, মাছের ঝাল, ঝাল গন্ধ সারা ডেকময়। আর ভাত এবং কেউ কেউ আগে থেকেই বলেছে ভাত বেশি খাবে। মাছের বেশ বড় টুকরো, প্রায় ইলিশ মাছের মতো খেতে স্বাদ, দেখতেও কিছুটা কাছাকাছি, ওগুলো হেরিংও হতে পারে। তবে জাহাজিদের কাছে নামে কিছু আসে যায় না। এবং গুম গুম শব্দের ভেতর জাহাজের ক্রমে এগিয়ে যাওয়া বেশ আরামদায়ক। ছোটবাবু, মৈত্র আর অমিয় অথবা অন্য যারা এখন ওয়াচে রয়েছে—ওপরে উঠতে পারছে না। তবু ছোটবাবু এক ফাঁকে উঠে তীরের গাছপালা, এবং কখনও আলোর বিন্দু দেখে দূরে, কেমন মুগ্ধ হয়ে গেছিল। সে ভুলেই গেছিল নিচে তার কাজ, সুট খালি হয়ে যাচ্ছে। কাপ্তান নিজেও ঠিক নেই, কারণ তিনি লাফিয়ে লাফিয়ে বোট-ডেক পার হয়ে যাচ্ছেন। কোথাও ঠিকমত দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেন না। চীফ- অফিসারের সারাদিন বেশ খাটুনি গেছে। সারেঙ সারা দিনমান ডেক-জাহাজিদের দিয়ে সব কটা ফল্কা সাফসোফ করছে। এখন কাপ্তান নিজে নিচে যাচ্ছেন। আলো ফেলে দেখছেন, কোথাও কোনও ফুটাফাটা রয়েছে কিনা।

সকাল থেকেই জাহাজে মাল উঠতে শুরু করবে। ওয়াচ ভেঙ্গে দেওয়া হবে। এবং সবাই যে যার মতো বিকেলে নেমে যাবে বন্দরে। বন্দর এলেই এই এক উত্তেজনা। ঠিক তখনই খবরটা সবাই শুনেছিল। সারেঙ বলে যাচ্ছে, প্রায় ফুঁকে ফুঁকে বলে যাবার মতো, আমরা ভারতীয় নাবিকরা বন্দরে নামতে পারছি না। দাঙ্গা, কালো-সাদাতে দাঙ্গা। কোথাও লঙ-মার্চে কার বের হবার কথা, সারেঙ সে-সবও বলে গেল। এমন একটা সুন্দর রাতে, এ-ধরনের দাঙ্গার খবর! কেউ আর তখন মন দিতে পারছে না কাজে! যারা তাস খেলছিল, ওরা তাসফাস ছুঁড়ে দিল হাওয়ায়। যারা খেতে বসেছিল, তারা বিষম খেল খেতে খেতে। যাঁরা নামাজ পড়ছিল ডেকে, তারা কিছুক্ষণ আরও বেশি আল্লার কাছে প্রার্থনা করবে বলে চুপচাপ বসে থাকল যেন। জাহাজের সব কিছু তখন কেমন একেবারে চুপ মেরে গেল। যেন একটা মরা জাহাজ নিয়ে কিছু অদৃশ্য আত্মা নদীর জলে ভেসে যাচ্ছে। কেউ কোনও কথা বলতে পারছে না।

বন্দরে নামতে না পারলে জাহাজিদের কি যে ব্যাজার মুখ—এখন এ-জাহাজটাকে না দেখলে বোঝা যাবে না।

তখন ডেবিড দেখল মুখ ভার করে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন জাহাজি। অস্পষ্ট অন্ধকারে সে তাদের ঠিক চিনতে পারল না। জায়গাটা আফটার-পিকের চার নম্বর ফল্কার কাছে। ওরা যেন কি গুজ-গুজ- ফুস-ফুস করছিল। এদের ভিতর ছোটবাবু নেই। অবশ্য এখন আর ওয়াচ নেই তার। জাহাজ বন্দরে পৌঁছে দেওয়ার দায়দায়িত্ব পাইলটের। কেবল তার একটা বড় কাজ রয়েছে, জাহাজ বাঁদা-ছাঁদার। সে তো ভোর রাতের দিকে। তবু যেন কিছু একটা অছিলায় চলে আসা। ছোটবাবুকে সে খুঁজছে এটা কাউকে বুঝতেই দিচ্ছে না। উইচের নিচে ঝুঁকে কি দেখছে! আসলে কিছুই দেখছে না। সে অহেতুক আফটার-পিকে আসতে পারে না, একটা কাজ চাই হাতে। জাহাজ বাঁধার আগে সব কিছু পরীক্ষা করে দেখা যেন। হাসিল ঠিক আছে কিনা, উইনচ কাজ করছে কিনা, হারিয়া হাপিজ ঠিক মতো বললে দড়িদড়া ঠিকমতো নেমে যাবে, উঠে আসবে কিনা, এ-সব দেখেই যেন চলে যেত। তবু একবার নিচে নেমে বাঁ পাশে ঢুকে গেল। দরজায় ঝুঁকে বল, হেই!

কিন্তু কেউ নেই। ফোকসাল ফাঁকা। থাকা উচিত ছিল। ডেকে, মেসরুমে, গ্যালিতে কোথাও ছোটবাবু নেই। এবং মনে হল, সেই গুজগুজ যারা করছিল তাদের ভিতর যদি থাকে। সেখানেও নেই। ওরা বন্ধু, অনিমেষ, মান্নান, মনু এবং ডেক-টিণ্ডাল হাসান। যদিও ওদের একটা করে প্রত্যেকের নম্বর আছে, কিন্তু ডেবিডের স্বভাব অন্যরকম। সে নম্বরে চেনে না, সে নামে চেনে। অন্য সবাই জাহাজিদের নম্বরে চেনে,

কি নাম, যদিও নাম মনে রাখা ভারী কষ্ট, তবু ওর মনে হয় মানুষের সম্মানের জন্য নামে চেনা ভাল। ওরা তো জেল-কয়েদী নয়, জেল-কয়েদী হলেই বা মানুষ মানুষকে নামে চিনবে না কেন সে বুঝতে পারে না। অবশ্য এ নিয়ে তার এখন দায় নেই। ছোটকে না পেলে চলছে না। একটা মজার ট্রিপ, আহা দিনের বেলা হলে কি যে ভারি মজা হত, তবু রাত জেগে দূরবীন নিয়ে বসে থাকা। একা ভাল লাগবে না বলে একমাত্র সে ছোটবাবুকে সঙ্গে নিতে পারে।

লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি ভেঙ্গে ওপরে ওঠার মুখে দেখা মৈত্রের সঙ্গে। সে বলল, টিণ্ডাল, ছোটবাবু কোথায়?

–সে তো ঘুমোচ্ছে।

—ঘুমোচ্ছে?

—হ্যাঁ। বলেই সে নেমে যেমন দেখে থাকে, ঠিক ছোটবাবু অমিয়র বাংকে শুয়ে আছে। ওপরের বাংকে বলে মেজ-মালোম ছোটকে দেখতে পায় নি। সে ডেকে বলল, এই ছোট তোকে মেজ-মালোম ডাকছে।

ছোটবাবুর ঘুম ভীষণ। জাহাজের দুলকি চালে বেশ শরীরে আমেজ এসে যায়। খুব এখন নাক ডাকিয়ে ঘুমোতে পারে। মৈত্র দু-তিন বার ডেকেও সাড়া পেল না। সেকেণ্ড এসে দেখল খুব জোরে জোরে নাড়ছে মৈত্র। কিন্তু ওঠবার নাম নেই।

সেকেণ্ড বলল, থাক।

—থাক মানে। আপনি দাঁড়ান। বলে সে ওপরে উঠে দু-হাতে টেনে তুলল, এই ছোট! ছোট শুনতে পাচ্ছিস! ছোট তখন চোখ মেলে তাকাবার চেষ্টা করল।—মেজ মালোম তোকে ডাকছে!

–মেজ-মালোম কে?

—কি হারামজাদা! মেজ-মালোমকে চেন না! সে বলল, মেজ-মালোম ডেবিড।

–ডেবিড এখানে কেন?

—আরে তুমি মেজাজ দেখাচ্ছ!

সেকেণ্ড তখন বলল, ছোট কি বলছে!

মৈত্র বলল, বলছে একটু বসতে। মেজ-মালোমকে একটু বসতে বল। তারপর আর কি করে—সেকেণ্ড কাছে এসে বলল, ওম্যান।

ছোট বলল, ওম্যান! কোথায় সেকেণ্ড?

—তাড়াতাড়ি এস।

দু-লাফে নেমে গেল ছোট। ওর ঘুম একেবারে ভেঙ্গে গেল। মৈত্র এবং অন্য সবাই, পারলে যেন এই জাহাজের যত জাহাজি রয়েছে সবাই এখন এই ডেবিডের পেছনে পেছনে বোট-ডেকে উঠে যাবে।

ডেবিড ঠিক সিঁড়ির মুখেই বলল, নো ওম্যান।

ছোট বলল, তবে!

—এস কথা আছে।

—এত রাতে কি কথা!

—অনেক কথা।

—মানে!

—মানে, দু’পাড়ের শহর ঘরবাড়ি তেলের পিপে, স্টিম-বোট, মোটর-বোট, লাল নীল রঙের আলো, কোথাও ব্যাণ্ড বাজবে, এস দেখবে। আমরা এক ফাঁকে ঠিক ওম্যান দেখে ফেলব কোথাও।

সুতরাং আর কি করা। সকালে ওয়াচ থাকছে না। হাল্কা কাজ থাকবে। সুতরাং এমন একটা জাহাজে যখন ক্রমে উজানে উঠে যাচ্ছে, দু-পাড়ের গাছপালা ছায়া অন্তহীন ক্রমশ সরে সরে যাচ্ছে, অথবা এক ফালি চাঁদ জাহাজটার সঙ্গে সঙ্গে উজানে ভেসে চলেছে, তখন রাত জেগে অন্তহীন দৃশ্যমালায় ডুবে যেতে ভালই লাগবে।

পাশেই জ্যাকের কেবিন। পোর্ট-হোলে এখনও আলো আছে। জ্যাক তবে ঘুমোয় নি? সেকেণ্ড আগেই ঠোটে আঙ্গুল ছুঁয়ে বলেছে, কিছু দেখে ফেললে খুব যেন হৈ-চৈ না করে ছোট। ওতে জ্যাকের জেগে যাবার সম্ভাবনা। চুপচাপ বসে থাকা ডেক চেয়ারে, আর ডেক খুব সাফ বলে ছোটবাবু ডেকে কাত হয়ে হাতে মাথা রেখে শুয়ে থাকতে পারে পর্যন্ত। এবং ছোট দেখল, মেজ চকোলেট কালারের বড় একটা বোতল এনেছে, দুটো গ্লাস। কেবিন-বয় ইলতুতমিস টিপয়ে কাঁচের প্লেটে রঙিন মাংস রেখেছে। ছোট ছোট টুকরো প্রায় স্যালাডের মতো করে রাখা।

সেকেণ্ড বলল, চলুক।

ছোটর ভীষণ ইচ্ছে হল। বেশ ঝাঁঝ। সে ঠিক সহ্য করতে পারে না। তবু বলল, কেউ দেখে ফেলবে নাতো!

—দেখে ফেললে কি হবে!

—খারাপ ভাববে।

—যা, খারাপের কি! ওম্যান-ওয়াইন-ওরসিপ ভারি পবিত্র ব্যাপার মানুষের। খাও খাও। পবিত্র যা কিছু তার থেকে দূরে থাকার কোনো মানে হয় না। বলেই ছোটকে দূরবীনটা দিয়ে সে উঠে গেল। দূরবীনে সে কিছুই দেখতে পেল না। পাগল। রাতে, এই সামান্য চাঁদের আলোতে পাড়ের কিছুই স্পষ্ট নয়। বরং ভোঁ ভোঁ শব্দ করতে করতে যে সব স্টিম-বোট নেমে যাচ্ছে উঠে আসছে, অথবা যদি কোন জাহাজ উঠে যায়, পাশাপাশি এলে তাদের রঙীন ছবির মতো দেখায়। জাহাজে সে কোনো মেয়ে দেখতে পাচ্ছে না। তবু জেগে থাকা, এভাবে একটা রাত মিসিসিপি নদীর বুকে জেগে থাকা ভারি আনন্দের। সে তো আর কখনও আসছে না, আবার যদি আসেও, সে কবে আসবে বলতে পারবে না। তখন আজকের মতো সব কিছু তার ঠিকঠাক নাও থাকতে পারে।

সে দু’টুকরো মাংস মুখে ফেলে দিল। ভাজা ভাজা মাংস। সেকেণ্ড এসে সামান্য মদ ওর গ্লাসে ঢেলে দিল, তারপর সোডা দিয়ে হাল্কা করে দিল, নিজে রাখল একেবারে নির্জলা, সে একেবারে সবটা গলায় ঢেলে দেবার মতো ঢেলে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলল, হাই—বলে সে দু’হাত ওপরে তুলে, কি মজা, এমন একটা ভঙ্গী করলে ছোট বলল, এই জ্যাক জেগে যাবে।

সেকেণ্ড বলল, জ্যাককে ‘ডাকো না! সেও এসে বসুক।

—তুমি পাগল। জ্যাক আমাদের সন্ন্যাসী বালক। তোমার দূরবীণ দেখলেই চটে যাবে।

—তা অবশ্য ঠিক। আচ্ছা কেমন ভাল লাগছে না! এত বড় নদীতে ভেসে যেতে ভাল লাগছে না!

—খুব।

—এখন তোমার নাচতে ইচ্ছে করছে না! ছোট বলল, নাতো।

—বারে ভেতরে তোমার ডিং ডিং করে বাজনা বাজছে না!

—নাতো।

—বলছ কি, এ-সময়ে ডিং ডিং করে বাজনা বাজছে না!

—নাতো।

—বলছ কি, এ-সময়ে ডিং ডিং করে ভেতরে বাজনা না বাজলে আবার কবে বাজবে, নদীতে এলেই আমার বাজনা বাজতে থাকে। নদীতে ডিং ডিং বাজনা না বাজলে লা-সালে প্রাণ হাতে করে মিসিসিপিতে আসত না।

—ডিং ডিং করে বাজনা বাজলেই প্রাণ হাতে করে আসা যায় না।

—আরে সে খুব সেয়ানা মানুষ ছিল। তখন ফ্রান্সের সম্রাট চতুর্দশ লুই। তার ইলিয়ানের কেল্লা থেকে মনট্রিলে যেতে ভীষণ কষ্ট। ডাঙ্গায় প্রায়ই লুঠতরাজ হত। রাস্তা বলতে কিছু ছিল না। কেবল জঙ্গল, মাঠ, অকারণ বনানী পাহাড় আর সব রেড় ইণ্ডিয়ানদের ভয়াবহ আক্রমণ, কিন্তু নদী দেখেই বুকের ভিতর বাজনা বাজতে থাকল। চতুর্দশ লুইকে লিখে পাঠাল কিছু সুযোগ-সুবিধার জন্যে। এবং সেটা আদায় হলে বেশ নদীপথে সে মনট্রিলে পৌঁছে গেল। পয়সা কম, লাভ বেশী।

—তুমি যে বললে ডিং ডিং করে বাজনা না বাজলে…..

সেকেণ্ড কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকল। ভুলে গেছে মতো, তারপর বলল, আমার কখনও কখনও এটা মনে হয়। মানুষ যতই স্বার্থপর হোক ছোট, কিন্তু কিছু ভাল কাজ করে থাকে কি না বল! মোষের চামড়ার ব্যবসাটা লা-সালে আদায় করে নিলেন বটে, বিনিময়ে তিনি কেল্লা নির্মাণ, কেল্লা দখল, জায়গা জমি যা কিছু দখল করলেন, সব চতুর্দশ লুইয়ের নামে। কেবল তাঁর ব্যবসা নদীর পাড়ে অথবা বনভূমির ভেতর হাজার হাজার মোষের। মোষের চামড়ার। ইজারা নেওয়া দেওয়ার কারবার।—তুমি ঠিক দেখছ তো!

ছোট বলল, দেখছি, ডান দিকে একটা স্টিম-বোট উঠে আসছে।

—তোমাকে আর একটু দেব! ছোট তখন ওর দিকে তাকালে, সে ছোটর গ্লাস তুলে দেখল। ছোট এক সিপও খায় নি। এই খাচ্ছ না কেন!

ছোট বলল, দেখি, সে প্রায় হাত বাড়িয়ে নিল, এবং ঠোঁটের কাছে নিয়ে খুব কষ্টে এক সিপ খেল, তারপর আর এক সিপ। এবং কিছুক্ষণ পর আরও এক সিপ। বেশ ঝিম-ঝিম্ করছে। সেকেণ্ড বলে চলেছে তখন। আর একটা দলে এসেছিলেন, জোলিয়েত এবং পুরোহিত মার্কুয়েট। তারা সারা দেশ পার হয়ে ঠিক এক সময় মিসিসিপির তীরে এসে পৌঁছাল। তারা ঠিক লা-সালের মতো যায় নি। ওরা বড় বড় হ্রদ পার হয়ে গিয়েছিল। ওরা হরিৎ উপসাগর থেকে ডিঙ্গি নৌকায় রওনা হয়েছিল। সঙ্গে ছিল মাত্র পাঁচজন লোক। ওরা উইসকনসিন এবং মিসিসিপি যেখানে মিশেছে ঠিক সেখানে পৌঁছে দেখল, সামনে শুধু অরণ্য—গভীর, যেন হাজার হাজার তিমি মাছ আকাশ থেকে অদৃশ্য সুতোয় কেউ ঝুলিয়ে রেখেছে। নদী পাশ দিয়ে বয়ে গেছে বোঝাই যাচ্ছে না, আরও কত সব কিংবদন্তী রয়েছে, ওরা শুনতে পেয়েছিল, নদীতে একটা বিরাট দানব রয়েছে। মাঝে মাঝে তার গর্জন আরম্ভ, হয়। চারপাশের গাছ-পালা থেকে সব পাখিরা পালিয়ে যেত। বুনো মোষেরা লেজ তুলে দিক-বিদিক ছুটতে থাকত। সমস্ত চরাচর একেবারে কাঁপিয়ে দিত।

সেকেণ্ড-এর মনে হল, ছোট ঝিমুচ্ছে। সেকেণ্ড কেমন ক্ষেপে গেল। সে ধাক্কা মরল ছোটকে। বলল, তুমি সেলর!

—ইয়েস স্যার।

—নো।

—কেন নো স্যার?

—তুমি ঝিমুচ্ছ আমি কি বলছি, শুনেছ?

—ধুস! আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে সেকেণ্ড। আমি উঠব। তোমার বক্ বক্ আমার ভাল লাগছে না।

—আরে শোন শোন, এই ছোট ঐ দ্যাখো। সত্যি ছোটর চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। একটা স্টীম- বোট যাত্রী বোঝাই—নিচে নেমে যাচ্ছে। আলোতে সাজানো। মার্দিগ্রাস উৎসব কি এখানে আরম্ভ হয়ে গেছে! সে বলল, দ্যাখো দ্যাখো কেমন নাচছে জোড়ায় জোড়ায়।

দূরবীন না হলেও দেখা যায়। খুব কাছে এবং দ্রুত নেমে যাচ্ছে স্টিম-বোটটা। –আচ্ছা ছোট, ডেবিড ছোটকে ঠেলা দিয়ে বলল, ওরা আমাদের সঙ্গে ওপরে উঠে যায় না কেন! নিচে নেমে যাচ্ছে কেন!

ছোট বলল, আমি আর খাব?

সেকেণ্ড বলল, খাবে। একশবার খাবে। রাত এখনও অনেক জাগতে হবে।

—কটা বাজে?

—এগারোটা।

—জ্যাক জেগে যাবে না তো!

—জাগলে আমাদের কি! ডেবিড খুব উত্তেজনার মাথায় কথা বলছে। আহারে! এমন একটা সময়ে সুন্দর স্টিম-বোটে আমরা কেন থাকলাম না।

ডেবিড কি এখন বসে বসে মরাকান্না জুড়ে দেবে! সে বলল, ডেবিড, তুমি মরাকান্না জুড়ে দিলে আমি এখানে থাকব না। আমি চলে যাব। বলেই ছোট হুড়মুড় করে উঠে বসল। জাহাজ যে যাচ্ছে বোঝা যাচ্ছে, কারণ তীরের গাছাপালা যদিও এখন আর কিছুই তেমন স্পষ্ট নয়, ছায়া-ছায়া এবং নদী ক্রমে প্রশস্ত হয়ে যাচ্ছে, কেবল কলকল জলের শব্দ। ওর তখন দূরের কোথাও আর একটা নদী পাড়ের কথা মনে পড়ে যায়, ঠিক যেন সেখানে ড্যাং ড্যাং করে দুর্গাপুজোর বাজনা বাজছে, কবুতর উড়ছে আকাশে এবং অজস্র কাশফুল নদীর পাড়ে তুষারপাতের মতো বাতাসে উড়ছে। সে উঠেই যেতে পারল না। মাথাটা কেমন ঝিম্‌ঝিম্ করছে। সেকেণ্ড পুরোহিতের মতো নদী সম্পর্কে যা মাথায় আসছে বলে যাচ্ছে।

সেকেণ্ড বলল, মার্কুয়েট ভীষণ চালাক লোক ছিল হে। রাতদিন নদীর জলে ডিঙ্গা ভাসিয়ে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই, নদী কখনও বাঁক নিয়েছে। দ্বীপের মতো মাঝখানে ডাঙ্গা। এতদিন চালিয়েও ওরা একটা মানুষের পায়ের দাগ দেখতে পেল না, কেবল যেখানে মাঠ, মাঠে বড় বড় ঘাস সেখানে হাজার হাজার বুনো মোষ কি যে আনন্দে ঘোরাফেরা করছে!

তারপর সেকেণ্ড কেমন মোহভঙ্গের মতো বলে ফেলল, প্রায় দু’হপ্তা চলার পর ওরা মানুষের পায়ের দাগ দেখতে পেয়েছিল, যেন সেই এক রবিনসন ক্রুশোর ব্যাপার। ওরা নদীর দু’পাড়ে কোথাও বড় বড় পাহাড় পর্যন্ত দেখেছিল। রবিনসন ক্রুশোর ব্যাপারটা ভয়াবহ, কেউ তখন আক্রমণ করে বসবে, ভয়ে বুক গলা শুকিয়ে তাদের কাঠ। কারণ তাদের নানাভাবে হুঁশিয়ারি ছিল, নদীর দু-পাড়ের আদিবাসীরা নদীর মতোই হিংস্র, নির্মম। তারা সব আগন্তুকদের মেরেই ফেলে। এক মুহূর্ত তারা অপেক্ষা করে না। মার্কুয়েট তাদের সহজেই খুঁজে পেয়েছিল। তাদের সৌজন্যপূর্ণ ব্যবহারে মার্কুয়েট অবাক। সর্দার রেড ইণ্ডিয়ান ওর শেষ কম্বলখানি খুলে দিয়েছিলে মার্কুয়েটকে। পরম সমাদরে আদর অভ্যর্থনা, এবং কুকুর নিয়ে ঘাসের ওপর বড় বড় গাছের ছায়ায় খেলা পর্যন্ত দেখিয়েছিল। উপহার দিয়েছিল পর্যাপ্ত মাছ, জই-এর পায়েস। সকাল বেলায় নদীর পাড়ে সর্দার তার ছশো অনুচরসহ ওদের বিদায় জানিয়েছিল।

সেকেণ্ড বলল, তুমি ঘুমোচ্ছ!

—না।

—তবে এভাবে চিৎপাত হয়ে শুয়ে পড়েছ কেন?

—মাথাটা ঝিমঝিম করছে।

সেকেণ্ড প্রায় কানের কাছে মুখ এনে চিৎকার করে বলল, এখন যেখানে আলটন শহর আছে না, সেখানে মেয়েদের কিছু নগ্ন মূর্তি তারা খুঁজে পেয়েছিল। তার নিচেই ওরা দেখেছিল নদীর জল ঘোলাটে কেমন হলুদ রঙ জলের। মিসিসিপির শান্ত নীল জলস্রোতকে কোথা থেকে প্রচণ্ড গতিতে জলের ঘূর্ণি এসে একেবারে হলদেটে করে দিচ্ছে। ওরা জানত না, ওটা মিসৌরি। মিসৌরি এসে এখানটায় মিলে নদীকে করেছে দুর্বার অশান্ত। পাগলা হাওয়ায় যেন নদীর জল অনেক ওপরে উঠে লাফিয়ে লাফিয়ে নেমে যাচ্ছে। পাগলাচণ্ডীর মতো অশান্ত গর্জনে নদী ক্ষিপ্ত হয়ে গেছে।

হঠাৎ তখন মনে হল পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। সেকেণ্ড দেখল, জ্যাক। জ্যাক এসে গেছে ছোটবাবু।

ছোটবাবু উঠে বসল না, এমন কি তাকিয়েও দেখল না। বলল, আঃ

জ্যাক বলল, কি করছ তোমরা?

সেকেণ্ড ওর দূরবীন বগল থেকে একেবারে নামিয়ে নিচে লুকিয়ে ফেলল। বলল, নদী দেখছি। ছোটবাবুকে নদীর কথা বলছি।

–ছোট তো ঘুমোচ্ছে।

–না ঘুমোচ্ছে না।

জ্যাক উপুড় হয়ে বসল মাথার কাছে। দেখল চোখ বুজে আসছে। খেয়েছে! আজ আবার খেয়েছে! চোখ দুটো টেনে ফাঁক করলে আবার খুঁজে যাচ্ছে। জ্যাক বলল, কাকে বলছ।

—কেন ছোটকে।

—কিছু শুনতে পাচ্ছে না।

—মানে!

—দ্যাখো না।

—এই ছোট তুমি কিছু শুনতে পাচ্ছ না?

—আমি বাড়ি যাব ডেবিড।

—এই তো কথা বলছে।

—ঠিক বলছে? ওতো এখন স্বপ্ন দেখছে।

—স্বপ্ন!

—তা ছাড়া কি!

সেকেণ্ড এবার উপুড় হয়ে পড়ল, এই ছোট তুমি স্বপ্ন দেখছ?

জ্যাক বুঝল দুজনেই বেশ টেনেছে। ছোটর খাবার অভ্যাস নেই এটা সে জানে। এ-ব্যাপারে ছোটর ভয়ও আছে। ছোট খায় না! অথচ ডেবিড ওকে খাওয়া শেখাচ্ছে। সে এবার দু-হাতে জামা ধরে তুলে বলল, ছোটবাবু তুমি কোথায় যাবে?

—বাড়ি যাব।

সেকেণ্ড তখন চোখ বুজে বলছে, ছোট কি বলছে জ্যাক?

—বাড়ি যাবে বলছে।

—কাল সকালেই তো বাড়ি পৌঁছে যাব।

জ্যাক আর সহ্য করতে পারল না। বলল, তুমি ওকে আর দেবে না।

—পাগল! ক্ষেপেছ ওকে আর দি। আমার একটা ইজ্জত নেই।

ছোট এবার কাউকে যেন গ্রাহ্য করছে না—আমারও ইজ্জত আছে সেকেণ্ড। আমাকে তোমরা যখন-তখন অপমান করতে চাও। আমি কিছু সহ্য করব না। আমি বাড়ি যাব। তুমি আমাকে বাড়ি পৌঁছে দেবে। ভীষণ জড়ানো কথা এবং অস্পষ্ট।

—দেব। ওঠো।

—কিন্তু —

—না আর কিন্তু না।

—আমি উঠতে পারছি না।

জ্যাক বলল, নাও ধরো। ডেবিড বলল, ধর। দুজনেই টলছে। জ্যাক দেখল, সিঁড়ি ধরে নামার সময় দুজনেই হুড়মুড় করে পড়বে। সে এবার বলল, তুমি বস ডেবিড। ওকে আমি রেখে আসি।

জ্যাক জানে এখন বাবা ঘুমোচ্ছে। রাত অনেক। ওর ঘুম আসছিল না। সেই কখন থেকে সে পোর্ট-হোল খুলে চুপচাপ গোপনে দেখে যাচ্ছিল। ওরা কিছু খাচ্ছে সে সেটা টের পাচ্ছিল। গোপনে ওরা চুরি করে মদ খাচ্ছে বুঝতে পারে নি। ওদের কথাবার্তা সেই কখন থেকে শুনছে। অস্পষ্ট বলে বুঝতে পারছিল না। সে কিছুতেই কেবিনে শুয়ে থাকতে পারে নি।

সে ক্রমে বুঝতে পারল, ছোটর ভীষণ নেশা হয়েছে। আর কেউ নেই এখন জেগে। জেগে থাকলেও ঐ যেমন এরা আছে তেমনি, পোর্টের কাছাকাছি দায়-দায়িত্ব সব পাইলটের। একটু বেচাল হলে তেমন ক্ষতির কিছু নেই। তবু সকালে জাহাজ বাঁধাছাঁদা আছে। ডেবিডের অনেক কাজ। কেবিনে একটু চোখ বুজতে পারলেই ডেবিড একেবারে ঠিকঠাক। আর এখন এই ছোটবাবু—সে ছোটবাবুকে নিভৃতে দাঁড় করিয়ে বলল, আমার কাঁধে হাত রাখো, ছোট। আস্তে আস্তে পা ফেল। ভয় নেই। পড়বে না।

ছোটবাবু বলল, তুমি খুব ভালো ডেবিড

জ্যাক বলল, আমি ভাল না। আমি ভীষণ খারাপ। আস্তে। লম্বা পা ফেলবে না।

—আমাকে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছ ডেবিড?

—হ্যাঁ বাড়ি। একবার বলার ইচ্ছে হল, আমি জ্যাক, ডেবিট বোট-ডেকে শুয়ে আছে। কিন্তু কিছু বলল না।

—জানো, আমার দুটো ভাই আছে। একটা বোন আছে।

—জানি।

—তুমি জানো আমরা এত গরীব ছিলাম না।

—জানি।

—আমরা দুর্গাপুজোতে মোষ বলি দেখতাম।

মোষ বলি ব্যাপারটা জ্যাকের জানা নেই। সে বুঝতে পারল না। ছোটবাবু যাই বলুক সে হুঁ- হাঁ করে যাচ্ছে। খুব সন্তর্পণে সিঁড়ি ধরে নামানোর সময় কেমন হড়কে গিয়ে জ্যাককে ছোটবাবু পুরোপুরি জড়িয়ে ধরল। আহা ছোটবাবুর শরীর কী নরম! জ্যাক চোখ বুজে রয়েছে। মাতাল ছোটবাবু তার শরীরের ওপর ভর করে সোজা দাঁড়াবার চেষ্টা করছে। জ্যাকও ছোটবাবুর কাঁধে মুখ লুকিয়ে একেবারে একটা লতার মতো জড়িয়ে থাকতে চাইল। যেন বলতে চাইল, ছোট তুমি কি টের পাচ্ছ না! তুমি কিছু বুঝতে পারছ না?

আর তখনই ছোটবাবু বলল, আমাকে এভাবে দাঁড় করিয়ে রাখলে কেন? আমি বাড়ি যাব না? জ্যাক বোধহয় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদত। ছোটবাবু তুমি কি! তুমি কি ছোটবাবু? তুমি আমাকে একটু লতার মতো জড়িয়ে থাকতে দাও। কেউ নেই। ছোট, আমি বড় হয়ে গেছি। সত্যি বড় হয়ে গেছি।

ছোটবাবু বলল, আমার দাঁড়াতে ভাল লাগে না।

জ্যাক বলল, তুমি তো হাঁটতে পারছ না।

—খুব পারছি।

জ্যাকের ইচ্ছে, সে যতটা পারে দেরি করে নিয়ে যাবে। এই নীল দাড়ি এবং চুল বড় মহিমময়। আশ্চর্য ঘ্রাণের মতো এক সৌরভময় জগতে সে আছে। সে যেন এক সুন্দর পৃথিবীর বাসিন্দা হয়ে যায় তখন। কেউ জানে না, এই যে যুবক অথবা কাজ করে করে ছোটবাবুর ঋজু চেহারা, আর শরীরে কি উজ্জ্বল রঙ আর ঘাসের মতো নরম বাহুর ভেতরে হারিয়ে যাবার কি যে অশ্চর্য প্রলোভন কেউ তা বুঝতে পারবে না। জ্যাক যেন নিরবধিকাল এভাবে জড়িয়ে থাকবে ছোটবাবুর শরীরে। সে বারবার মিশে যেতে চাইছে অথবা ছোটবাবুর শরীরে সে হাত দিয়ে দেখার এমন সুযোগ আর পাবে কিনা জানে না। যেন জ্যাক এক পাথরের মূর্তির পাশে দাঁড়িয়ে আছে। অকারণ চারপাশে ওর নরম আঙুলগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে শরীর এবং কি ভেবে হাঁটু গেড়ে বসে ওর দু পায়ের ফাঁকে মুখ রেখে ফিস ফিস করে বলছে, ছোটবাবু আমি মেয়ে। তুমি বিশ্বাস কর আমি মেয়ে। আমি জ্যাক নই ছোটবাবু। আমি বনি।

ছোটবাবু বুঝতে পারল না, ডেবিড তাকে এভাবে কেন দাঁড় করিয়ে রেখেছে। সে তো কিছুই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে না। সব কিছু সামনের ঝাপসা। ডেবিডের মুখ ঝাপসা। কখনও কুয়াশার ভেতরে মানুষের মুখ দেখলে যেমন লাগে তেমনি। সে বুঝতে পারছে না হাঁটুর ভেতর মাথা রেখে ডেবিড কি করছে? ওকে কী জুতো পরিয়ে দিচ্ছে? ঠোটে কি একটা পোকা উড়ে এসে বসেছে? সে কোনরকমে পোকাটা মুখ থেকে তাড়িয়ে দেবার জন্য হাত-পা ছুঁড়ে বলল, আমি বাড়ি যাব না? আর যা হবার, হাত-পা ছুঁড়তে গিয়ে প্রায় পড়তে পড়তে বেঁচে গেল। কারণ জ্যাক বুঝল এভাবে দাঁড় করিয়ে রাখা খুব রিস্কি। সে আবার হাঁটতে থাকল। একটা কথাও বলল না। একেবারে হুঁস নেই ছোটবাবুর। চুরি করে সে ছোটবাবুর ঠোটে চুমো খেয়েছে। ছোটবাবুর গালে গাল লাগিয়ে রাখছে। কেউ চলে আসতে পারে! এবং সে চারপাশে যখন দেখছে কেউ নেই সামনের ডেকে দু-একজন জাহাজি মাদুর পেতে ঘুমুচ্ছে, এবং পাশে সেই ছোটবাবুর দুটো পাখি, ওরাও বাকসের ভেতর ছোটবাবুর তৈরি ঘরে বেশ আছে, তখন সে বলতে চাইল, আহা ছোটবাবু তুমি কি মিষ্টি আহা তুমি কি সুইট। তোমার ঠোঁট দুটো ভীষণ ভারী। ভীষণ আদুরে। আমাকে তুমি কেন বুঝতে পার না।

ছোটবাবু বিড় বিড় করে বকছে, আমার মুখে তুমি থুথু মাখিয়ে দিচ্ছ কেন? একটা পোকা!

—কৈ, পোকা কোথায় দেখছি না তো?

—ভিজে ভিজে কেন? জোঁকের মতো কেন?

জ্যাক বলল, আস্তে ছোট। তুমি নেশা করে জাহান্নামে গেছ। কি যে হচ্ছে না! যেমন ডেভিড! আমার কেবিনের পাশে এমন হলে কি করে ঘুমোই? বোধ হয় ছোট টিণ্ডাল বাদশা মিঞা, ওয়াচের ফাঁকে উঠে এসেছে। ওকে দেখেই একেবারে বিরক্তিকর মুখ জ্যাকের। এই দ্যাখো তোমাদের ছোটবাবুর কাণ্ড। নিয়ে যাও তো।

টিণ্ডাল বলল, ছোটবাবু তুমি সোরাব খেয়েছ? তোবা তোবা!

জ্যাক বলল, আচ্ছা তুমি যাও টিণ্ডাল। আমিই দিয়ে আসছি।

—না সাব। আপনি যান। আমি নিয়ে যাচ্ছি। সে দু-হাত জোড় করে বলল, কাউকে বলবেন না। ছোটবাবুর কি যে হয় মাঝে মাঝে।

—আরে না না, আমি বলব না।

জ্যাক বলল, মদ খেতে বারণ করবে। আমি যে এখানে দিয়ে গেছি, কাউকে বলবে না।

—জী সাব। কেউ জানবে না। জানলে ছোটবাবুর ক্ষতি হবে।

জ্যাক তারপর লাফিয়ে লাফিয়ে ডেক পার হয়ে গেল। সে ঘুরে ঘুরে বোট-ডেকের ওপর দিয়ে হাঁটতে থাকল। সে চুলে হাত রেখে নক্ষত্রের ভেতর, অথবা এই নদীর জলে যে আবহমান কাল ধরে কলকল শব্দ সারা মাস কাল ধরে ক্রমান্বয়ে নেমে যাচ্ছে সমুদ্রে, তাদের কাছে সে যেন ছুঁড়ে দিচ্ছে তার আশ্চর্য অনুভূতির খবর। তার কিছুতেই ঘুমোতে ইচ্ছে হল না। সারা রাত সে জেগে থাকবে। যেন ঘুমিয়ে পড়লেই সকালের বাসি ফুল হয়ে যাবে সব। আহা! তাজা কি টাটকা আর কি মনোরম এই বেঁচে থাকা। সে কেবিনে ঢুকে তার প্রিয় গান, ইয়েস সেলর গো অন, মুভ অন, পা ফেলে পা তুলে, গো অন, মুভ অন। ইউ সি দি.সি, দি মুন, এ্যাণ্ড দি লিটল স্টার। তাজা টাটকা রক্তের ভেতরে সে নাচতে থাকল। গমগম করে বাজছে। তার রেকর্ডের বাজনা সমস্ত মিসিসিপির জলে তরঙ্গ তুলে ক্রমে কুয়াশার ভেতর হারিয়ে যাচ্ছে।

আর তখনই মনে হল দুটো চোখ পোর্ট-হোলে। সঙ্গে সঙ্গে ওর শরীরের রক্ত হিম হয়ে গেল। গোপনে ওকে কেউ এতক্ষণ দেখছিল। পোর্ট-হোলের কাঁচ বন্ধ করতে কখন ভুলে গেছে। উত্তেজনায় সে যখন অধীর, তখন গোপনে কেউ পোর্ট-হোলে দাঁড়িয়ে দেখতে পারে তার মনেই ছিল না। চোখ দুটো ভীষণ জ্বলছিল লোকটার। অস্পষ্ট আলোতে সে বুঝতে পারেনি, কে, তবু যখন মনে করতে পারল, তখন তার শরীরে আর বিন্দুমাত্র সাহস থাকল না। আর এই নাচ দেখে কেউ ভেবে ফেলতে পারে সে মেয়ে, বুঝে ফেলবে, সে বনি। লোকটা আর্চি বাদে কেউ নয়। শয়তানের মতো জাহাজে উঠেই তাকে অনুসরণ করে চলেছে।

সে পোর্ট-হোলের কাঁচ বন্ধ করে দিল। পর্দা ফেলে দিল। তারপর দাঁড়িয়ে থাকল—কি করবে বুঝতে পারল না।

জাহাজটা তখনও যাচ্ছে। নদীতে নানারকম বয়ার লাল নীল বাতি জ্বলছে নিভছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *