1 of 2

অলৌকিক জলযান – ১৮

।। আঠার।।

অমিয় চুপচাপ বাংকে শুয়ে আছে। খুব হৈ-চৈ চলছে ডেকে এবং সবাই বড়-মিস্ত্রির ভূত দেখার ব্যাপারে নানারকম মন্তব্য করছে। তখনও নির্বিকার অমিয়। সে শুয়ে শুয়ে কোত্থেকে একটা প্যান- আমেরিকান গাইড-বুক পেয়েছে তাই পড়ছে। পৃথিবীর কোন বন্দরে, অথবা কোন শহরে ভাল খাবার, ভাল দৃশ্যাবলী আছে, এখন এটা জানা যেন তার বেশি জরুরী। ছোটবাবু নিচে বসে রয়েছে, সেও বের হয়নি। মৈত্র মুখ গোমড়া করে রেখেছে। যেন এখুনি অমিয়র ওপর ফেটে পড়বে।

মৈত্র নিচে বসে রয়েছে বলে অমিয়র মুখ দেখতে পাচ্ছে না। সকাল সাতটায় সবার চা চপাটি খেয়ে পরীর জন্য ঠিকঠাক থাকার কথা, তখন অমিয় বই পড়ছে মনোযোগ দিয়ে। এবং ছুটির দিনের মতো অমিয় কখন উঠবে, কখন চা চপাটি খাবে ওরা যেন ঠিক বলতে পারে না। এই যে এমন একটা ঘটনা ঘটে গেল, যে কোন সময় অমিয় ধরা পড়তে পারে, তার জন্য তার যেন কিছু আসে যায় না। মৈত্র এতে আরো ক্ষেপে যাচ্ছে। এখন তো ওর উচিত বসে কিছু একটা পরামর্শ করা। দুটো ডিম, একটা আপেল যদি অমিয় একা খেত, ওরা যদি সমান ভাগে ভাগ করে না খেত, তবে মৈত্রের কিছু আসত না। অমিয় একা হ্যাপা সামলাতো। এখন যে চুরির দায়ে ওরাও ধরা পড়েছে। আর কি সাহস পোর্ট-হোল দিয়ে হাত বাড়িয়ে বড়-মিস্ত্রির টেবিল থেকে ডিম আপেল চুরি করে আনা- না ভাবা যায় না। রাগও হচ্ছে আবার কোথায় যেন একটা মায়াও গড়ে উঠছে। অমিয়র সাহস আছে।

কিন্তু তারপরই যখন মৈত্রের মনে হয়, সেও আছে সঙ্গে, ধরা পড়লে ছোটবাবুও রেহাই পাবে না তখনই চিৎকার করে চুল ধরে টেনে নামাতে ইচ্ছে হয়। নামিয়ে দু লাথি, এবং চড়-থাপ্পড়। অথচ সে জানে, কোন গণ্ডগোলই করা যাবে না। চুপচাপ এখন হজম করে যাওয়া বাদে তাদের উপায় নেই। ব্যাপারটা কত দূরে গড়াবে কেউ বলতে পারে না। শুধু লক্ষ্য করে যাওয়া। অমিয়কে কতবার বলেছে, কিভাবে ম্যানেজ করছিস অমিয়, সে কিছু বলত না। কেবল বলত, খা শালা। হারামে পেয়েছিস খেয়ে নে।

জাহাজে বাসী গোস্ত আর ডাল, বাসী বাঁধাকপি ভাজা এবং খেতে খেতে মুখে এমন অরুচি যে এই দুটো ডিম এবং আপেল মধ্যরাত্রিতে ওদের কাছে ভীষণ লোভের। ছোটবাবু মাঝে মাঝে পরিজ অথবা কেক নিয়ে আসে, মৈত্র জানে, জ্যাক ছোটবাবুকে খুব পছন্দ করে। ওদের ভাল কিছু হলে জ্যাক ছোটবাবুর জন্য রেখে দেয়। কখনও কমলা, কলা আবার ফ্রাইড এগ যখন সে আনতে পারে, সবাই বসে ভাগ করে খায়। ডেকে যে দুজন আছে অর্থাৎ বন্ধু আর অনিমেষ মজুমদার ওরাও তখন বাদ যায় না। মনু অথবা মান্নানকে একদিন ডেকেছিল খেতে, ওরা খায়নি। সাহেবদের গ্যালিতে শুয়োর রান্না হয় বলে, কিছুই ওরা খেতে চায় না। যত ভাল খাবার হোক ওরা খাবে না। সুতরাং জ্যাক আলাদা করে ভাল কিছু দিলে এক সঙ্গে পাঁচজন, এবং তখন অনিমেষ গ্যালিতে নেচে টব বাজাবে, দু-এক দানা খাবে, আর জাহাজ এবং জাহাজিদের জীবন সম্পর্কে ইতর রসিকতা। এভাবেই যখন দিন যাচ্ছিল, তখন অমিয়টা ওদের কি যে ফ্যাসাদে ফেলে দিল।

অমিয় এখনো উঠছে না। মৈত্র নিচে বসে রয়েছে। অমিয় ওপরের বাঙ্কে, রেলিঙে কম্বল বিছানো, কেবল অমিয়র দুটো হাত, এবং বইটা দেখা যাচ্ছে। ডান পাটা সে বাঁ পায়ের ওপর রেখে নাচাচ্ছে সেটা সে দেখতে পাচ্ছে। যত অমিয় পা নাচাচ্ছিল, তত মৈত্রের রক্ত টগবগ করে ফুটছিল। হারামজাদা কি বুঝতে পারছে না, তারা কতটা বিপাকে পড়ে গেছে। অমিয় কি ওদের বিপদের মুখে ফেলে দিয়ে মজা দেখছে। সে আর তখন কি করে। সে ডাকল, অমিয়।

ছোটবাবুর মুখ দেখলেই বোঝা যায় সে খুব উদ্বিগ্ন। এবং যা খবর তাতে বোঝাই যায় সব এই অমিয় করেছে। বড়-মিস্ত্রিকে উলঙ্গ করে ছেড়েছে।

কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে যেন একান্ত সোহাগে ডাকা—অমিয় তোকে ডাকছি আমি।

—আমাকে দাদা তুমি ডাকছ! বলে একেবারে সুবোধ বালকের মতো নেমে পড়ল।—বল।

—এখন কি হবে!

—কিছু হবে না।

—ওরা কি বুঝতে পারবে না বলছিস?

—বুঝতে পারলে কি হল!

—মাসতার দিতে বলবে। দ্যাখো এদের কেউ তোমার ডিম, আপেল চুরি করেছে কিনা!

—তা দিলে কি করা! বলেই সে আবার কিসব দৃশ্যাবলী দেখা যেন তার বাকি। সে এসব না দেখে ফালতু কথাবার্তা শুনতে রাজী না, সে ফের মনোযোগের সঙ্গে পাতা ওল্টাতে থাকলে মৈত্র আর ধৈর্য ধরতে পারল না। চিৎকার করে উঠল, রাসকেল তোমার জন্য আমরা ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ি! সে উঠে গিয়ে হয়ত একটা ঘুঁসিই মেরে দিত। ছোটবাবু একটা কথাও এতক্ষণ বলেনি, এবার সে বলল, কি হচ্ছে মৈত্রদা! পাগলের মতো কি করতে যাচ্ছ!

মৈত্রের সত্যি খেয়াল হল, এটা করা ঠিক না। যা অমিয়র গোঁয়ার্তুমি, সে হয়তো মারামারি লাগিয়ে দেবে। এবং চিৎকার চেঁচামেচিতে সবাই ছুটে এলে, কিছু একটা বলতে হবে। সব কথা বলে দিতে পারে অমিয়। ও কেমন মরিয়া। জাহাজে ওঠার পরই মৈত্র এটা লক্ষ্য করেছে। কেবল কি ভাবে, আর বড় বড় কথা। এবং স্বপ্ন দেখতে ভালবাসে অমিয়। সে যে জাহাজে খালাসির কাজ নিয়ে এসেছে এটা একটা অজুহাত মাত্র। অমিয় জীবনে বড় কিছু করতে চায়। এমন একটা কিছু করে দেশে ফিরবে, যা দেখে ওর বাবা এবং ভাইয়েরা ভেবে ফেলবে, বাড়ির জাহান্নামে যাওয়া ছেলেটা রাজপুত্র হয়ে ফিরেছে।

সুতরাং মৈত্র বাড়াবাড়ি কিছু করল না। চুপচাপ আবার নিজের জায়গায় গিয়ে বসে পড়ল।

অমিয় বলল, কি দাদা চা ফা খাবে না। খিদে পায় না?

মৈত্র কোন কথা বলল না। ছোটবাবু বলল, চাবি দাও।

মৈত্র চাবি ছুঁড়ে ফেলে দিল।

অমিয় সুড়সুড় করে উঠে গেল। লকার খুলে চা চিনি কনডেনস্ড মিল্ক বের করে সোজা ওপরে উঠে যেতে থাকলে, মৈত্র বলল, চা আমি খাব না।

অমিয় সিঁড়ির মুখে থামল। সামান্য হাসল। তারপর ঠোঁট বাঁকিয়ে বিড়বিড় করে বলল, কি আমার জাহাজিরে! ভয়ে টেসে গেছে! বড় বড় কথা যত!

আসলে মৈত্র নৌ-বিদ্রোহের সময় কি কি করেছিল, এবং কি কি কারণে সে দুবার জাহাজে ব্ল্যাক- লিস্টেড হয়েছিল তার ফিরিস্তি দেবার সময় দেখাতে চায় সে কতবড় জাহাজি, আর এখন!

চা, অমিয় তিনটে মগে আলাদা আলাদা করে এনেছে। মৈত্রের জন্য একটা বেশি চপাটি। মৈত্র চপাটি বেশি খেতে ভালবাসে। এখন তাকে যে করেই হোক মৈত্রের সঙ্গে সমঝোতা করতে হবে। সে এসেই পায়ের কাছে বসল, এবং কিছুটা নিবেদনের ভঙ্গীতে চা-এর মগ আর চপাটি তুলে দিল হাতের কাছে।

—খাব না বললাম!

—খাও গুরু। তুমি শালা গুরু রাগ করলে আমাদের কি হবে! আর এমন করব না। এই দ্যাখো কানমলা নাকমলা খাচ্ছি। আচ্ছা তবু রাগ যাচ্ছে না, সে মৈত্রের পা টেনে একটা কল্পিত রেখা টেনে বলল, এই দ্যাখো নাকে খত দিচ্ছি, আর কি চাই বল!

মৈত্র আর কি করে! তবু বুকটা ধুক্‌ধুক্ করতে থাকে, সিঁড়িতে কোনও পায়ের শব্দ দ্রুত নেমে এলে মনে হয়, এই বুঝি ফোকসালে ঢুকে সারেঙ বলবে, তোমরা বাপুরা বোট-ডেকে যাও। মাসতার দিতে হবে। অথবা ওপরে কেউ চিৎকার করে কথা বললেই বুকটা ধড়াস করে উঠছে। কেউ বুঝি এতক্ষণে টের পেয়ে গেছে, ডিম এবং আপেল, বড়-টিণ্ডালের ফোকসালে মাঝে মাঝে দেখা গেছে—সব কিছুর দায় বড়-টিণ্ডালের। আমাদের সারেঙ ঝুটঝামেলায় টানবেন না। এসব ভেবে মৈত্র খুব মুষড়ে পড়েছিল আর কিনা অমিয় এখন ঠাট্টা তামাসা করছে। তবু কেন যে মৈত্র অমিয়র ওপর রাগ করে থাকতে পারে না। ছোটবাবুও চা হাতে নিয়ে বসে রয়েছে, সে না খেলে কেউ খাচ্ছে না, তখন মৈত্র মাথা নিচু করে চা চপাটি খেতে থাকলে, অমিয় বলল, কেবল তুমি আমার দোষই দেখছ!

ছোটবাবু বলল, এখন আর কথা না। যা বলার বাংকারে গিয়ে বলবি। জামাপ্যান্ট পাল্টে ওরা ওদের ওয়াচের পোশাকে তাড়াতাড়ি ওপরে উঠে গেল। সোজা বোট-ডেকে উঠে, আবার ফানেলের গুঁড়ি ধরে নিচে নেমে গেল। পেছনে ছোট। ছোটকে দেখেই জ্যাক দৌড়ে এসেছিল। রাতের এমন মজার ঘটনা, ছোটবাবুকে গোপনে বলতে না পারলে যেন ওর খাবার হজম হচ্ছে না। এতক্ষণ বোধহয় চিপিং হাতে কখন ছোটবাবু ওয়াচে নামবে তার জন্য অপেক্ষা করছিল জ্যাক। আর জ্যাকের যে কি করে ধারণা জন্মেছে, যত গোপন খবর, সব একমাত্র ছোটবাবুকে সে দিতে পারে। ছোটবাবু তার কোন ক্ষতি করতে পারে না।

যদিও জাহাজে এ-খবর গোপন থাক কাপ্তান চেয়েছিলেন, কিন্তু পৃথিবীতে কেন যে কোন খবরই নানা কারণে শেষপর্যন্ত গোপন থাকে না। স্টুয়ার্ড প্রথমে বলেছিল চিফ-কুককে, আর কাউকে কিন্তু বলবে না, বড় সাব উলঙ্গ হয়ে ভূতের ভয়ে ছুটেছে এটা ক্রুদের ভিতর জানাজানি হোক তিনি চান না। সাহেব মানুষ ভূতের ভয়ে উলঙ্গ হয়ে ছুটবে, ছিঃ কি যে প্রেস্টিজের ব্যাপার—এই প্রেস্টিজ কথাটা শেষ পর্যন্ত সবার কানে উঠে গেছে। সেকেণ্ড-কুক ধর্মভীরু মানুষ গোয়ানিজ, অল্প অল্প বাংলা জানে, সে সত্যিকথা গোপন রাখতে পারে না, এবং খবরটা যেহেতু ভারি মজার, সকাল হতে না হতেই সমস্ত ফোকসালে গুজবের মতো ছড়িয়ে পড়ল। ওরা ঘুম থেকে উঠেই তারপর শুনছিল, জাহাজে ভীষণ কাণ্ড, আবার ভূত। ছোটবাবু, আর বড় সাব দুজনেই তবে ভূত দেখেছে। ছোটকে কেউ কেউ প্রশ্ন করেছিল, তোর ভূত দেখতে কেমন।

সে বলেছিল, কি জানি মনে নেই। একটা লম্বা ছায়ার মতো দেখেছিলাম। কেমন ভয় পেয়ে গেলাম। আসলে মহসীন চাচা এজন্য দায়ী। এমন সব ভূতের গল্প জাহাজের করেছেন যে গভীর রাতে অন্ধকারে জাহাজের কোন গলিঘুঁজিতে দাঁড়ালেই মনে হয়, এই বুঝি একটা লম্বা হাত এগিয়ে আসছে। গা কেমন ছমছম করতে থাকে। আসলে বুঝতে পারি, কিছু না। মনের ভুল সব। কিন্তু অন্ধকার রাতে কিছুতেই সেটা বিশ্বাস করতে পারি না।

এবং দিনের বেলায় ছোটবাবু সব বুঝতে পারে। রাতের বেলা কত সব আলো চারপাশে। মাস্তুলে, ডেরিকে, সর্বত্র এ-ভাবে আলোর মালা দুলে দুলে জাহাজের সব ছায়া কখনও ছোট কখনও বড় করে দেয়। এবং নিজের ছায়াই সে কতবার দেখেছে, কখনও লম্বা হয়ে যায়, খাটো হয়ে যায়। কে কোথা দিয়ে হেঁটে বেড়ালে তার ছায়া নিচে সহজেই এসে পড়তে পারে, এবং অস্বাভাবিক কিছু ভেবে, ভূত ভূত বলে চিৎকার করে ওঠা অসম্ভবের কিছু না। জ্যাক তখন নামতে নামতে অজস্র কথা বলছে। ছোট আগে, জ্যাক পেছনে, সিঁড়ি ভেঙ্গে নামছে। জ্যাক সব ঘটনা কানে কানে বলছে, আর বলেই হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে। কি যে উচ্ছ্বল! আর সহসা সে কেন যে বলে ফেলল, আর্চি আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে, আমার ভয় করে ছোট।

ছোটবাবুর এ সব শোনার সময় নেই। সে জ্যাককে নিয়ে বাংকারে ঢুকে যেতে পারলে বাঁচে। জ্যাক আসল খবর দিতে পারবে। কাপ্তান এ ব্যাপারে কিছু ভাবছেন কিনা, অর্থাৎ কোনও ইনভেস্টিগেশনে যাবেন কিনা, যদি যান তবে সেটা কখন, অথবা সে কি গোটা ব্যাপারটা জ্যাককে বলবে, জ্যাক এ- ব্যাপারে যদি ওদের সহায় হয়, এভাবে নানা ভাবনা তাকে পেয়ে বসলে দেখল, অমিয়কে নিয়ে মৈত্র নিচে নেমে গেছে। ওরও নামার দরকার। অন্য সব আগওয়ালারা এসে গেছে। সে ইচ্ছে করলে এখন নাও নামতে পারে। বাংকারে ঢুকে কথাবার্তা বলতে পারে জ্যাকের সঙ্গে। সে গাড়ি গাড়ি কয়লা ফেলবে, জ্যাক পাশে দাঁড়িয়ে কত অজস্র কথা বলবে তখন, আসলে সে আজ চায় শুধু একটা কথা জানতে, তারপর কাপ্তান কি করছেন?

সে বলল, জ্যাক, বড়সাব আসলে সত্যি ভূত দেখেছেন তো!

—কি যে বল না! সারাক্ষণ…বলেই মুখের কাছে দুহাতে এমন অঙ্গভঙ্গী করল যে, বেহুঁস, মাতাল, কি দেখতে কি দেখে থাকে, বাবার খেয়েদেয়ে কাজ নেই, ঐ নিয়ে পড়ে থাকবে। পাজি নচ্ছার মেস- রুম-বয়ের কাজ সব। বাবা নাকি খুব ধমকে দিয়েছেন, এসব ডিম-আপেল যেন আর কেউ চুরি না করে। আবার হলে কেলেঙ্কারি হবে।

কিছুটা ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ার মতো যেন সে এখন অজস্র কথা বলে যেতে পারে, জ্যাক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলতে ভালোবাসে। কখনও একটা বড় কয়লার চাঙের ওপর বসে কথা বলতে ভালোবাসে। আজ কথায় কথায় বার বার আর্চির কথা বলছে। আর্চিকে কি করে একটা বড় রকমের শিক্ষা দেওয়া যায়, সে তো এসব তার বাবাকে বলতে পারে না, বলতে গেলেই কাপ্তান ওর দিকে সংশয়ের দৃষ্টিতে তাকাবেন। তাহলে মেজ-মিস্ত্রি আর্চি কি টের পেয়েছে, বেঁটে-খাটো চৌকো মুখের লোকটা, কি টের পেয়েছে, জ্যাক আসলে মেয়ে। বনি, জ্যাক সেজে এ-জাহাজে ডঠে এসেছে। সুতরাং যা কিছু গোপন শলাপরামর্শ সে ছোটবাবুর সঙ্গে করতে পারে।

ছোটবাবু বলল, হাঁ করে দেখছে তো কি হয়েছে!

—না, এটা ভাল না ছোটবাব্!

—কেন ভাল না।

—সে তুমি বুঝবে না।

সত্যি ছোটবাবু এসব বুঝবে কি করে! সাহেবদের ব্যাপার-স্যাপার আলাদা। সে এই প্রথম এদের ‘ দেখছে। মফস্বল শহরে সে একজন সাহেবকে দেখেছিল, তিনি পাদ্রী, গীর্জায় থাকেন। কলকাতা শহরে এসে সে দূর থেকে এদের চৌরঙ্গীপাড়ায় দেখেছে। কিন্তু এভাবে দৈনন্দিন জীবনে, কাজের সঙ্গে যুক্ত থেকে দেখা এই প্রথম। ওদের সব কিছুই সে সেজন্য ভীষণ সমীহ চোখে দেখে থাকে। সে বলল, তুমি খুব সুন্দর জ্যাক। তোমাকে সবাই দেখতে ভালবাসে।

—তুমি ভালোবাসো না!

সে বলল, হ্যাঁ। তোমাকে দেখতে আমার ভীষণ ভাল লাগে।

—সত্যি!

–সত্যি।

জ্যাকের চোখ যে চকচক করছে ছোট টের পেল না। বাংকারে অন্ধকার। কয়লার ধূলো উড়ছে। এভাবে জ্যাকের এখানে বেশি সময় দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক না। তাছাড়া এখন মৈত্রদা এবং অমিয় আসবে। জ্যাক থাকলে, খোলাখুলি কথা বলতে পারবে না। সে বলল, জ্যাক খুব ধুলো উড়ছে। তুমি যাও। আমি এখন কয়লা ফেলব। অনেক কাজ।

যদিও ছোটবাবু জানে, জ্যাকের মর্জি হলে যাবে, মর্জি না হলে যাবে না। আবার এও দেখেছে, সেই দুর্ঘটনার পর থেকে জ্যাক আর ওর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে না। বরং জ্যাক আজকাল অতীব সুবোধ বালক যেন। ছোটবাবু যা পছন্দ করে না, জ্যাক তেমন কিছু করে না। জ্যাক এখন এ-বাংকারে থাকুক ছোটবাবু যখন চাইছে না, তখন জ্যাক কেমন মুখ ভার করে ওপরে উঠে যাবে ভাবল। দরজার মুখে এসে আবার ফিরে গেল। বলল, এই

–কী! ছোটবাবু বেলচার ওপর ভর করে দাঁড়াল।

—তোমার লিটল ডার্লিং তোমাকে চিঠি দেয় না?

—না।

—কেন?

—সে অনেক কথা।

—আমাকে বলবে না?

—বলব না কেন?

–কবে বলবে?

—যে কোনো দিন।

—তোমার লিট্ল ডার্লিংকে আমার ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করে।

—দেখাব। আমার কাছে ওর ছবি আছে।

—তোমার কাছে ওর ছবি আছে।

—আছে।

জ্যাকের ভেতরটা গুড় গুড় করছে। ছোটবাবুর লিট্ল ডার্লিং দেখতে কেমন, নিশ্চয়ই বিশ্রী হবে। ওর মতো সুন্দরী হবে না, হে ঈশ্বর, সে যেন আমার চেয়ে দেখতে খারাপ হয়। ওর আরও কাতর প্রার্থনা, পৃথিবীতে ছোটবাবুর লিট্ল ডার্লিং না থাকলে কি হত! জ্যাক ইচ্ছে করলে ছোটবাবুকে ফোকসালে পাঠিয়ে এখনই সেই ছবি দেখতে পারত, কিন্তু সে কথাবার্তা বলে বুঝেছে, ছোটবাবু ভীষণ ব্যস্ত। তবু কেন যে ওর যেতে ইচ্ছে করছে না। সে বলল, এই।

–কী! আবার দাঁড়াল ছোটবাবু। সে কয়লার গাড়ি ঠেলে নিয়ে যাচ্ছিল। জ্যাক যাচ্ছে না। আবার কি বলবে। গাড়ি রেখে সে পাশে এসে দাঁড়াল। জ্যাক দেখছে, ছোটবাবুর চোখ লাল, কয়লার ধূলো পড়লে চোখ লাল হয়ে যায়, এবং চোখের ভিতর কালো মণি দুটোতে তার কোন প্রতিবিম্ব পড়ছে না। একেবারে নিস্পৃহ চোখ। এবং তখন ইচ্ছে করে জ্যাকের, ছোটবাবুর বুকের জামা রাগে দুঃখে ফালা ফালা করে দেয়। এমন নিস্পৃহ চোখ দেখলে, জ্যাকের মনে হয়, ছোটবাবু ভাল না। ছোটবাবু আর দশজনের মতো তার কাছে।

এবং এভাবে জ্যাক বাংকারে এলে আর সহজে যেতে চায় না। কেবল কথা বলতে ভালবাসে। কত রকমের কথা, মাঝে মাঝে ছোটবাবু না বলে পারে না, জ্যাক তুমি ওপরে যাও। কাপ্তান দেখতে পেলে রাগ করবেন। জ্যাক তার কথায় কর্ণপাত করে না। সে তার মতো অনর্গল কথা বলে যায়, এবং বাড়িটা ওদের কোথায়, আর কি গাছ আছে, কতসব গাছ, এই যেমন ইউকন গাছের কথা প্রায়ই জ্যাক বলে থাকে। কত লম্বা, আর কত বড় এবং কি গভীর নীলবর্ণের পাতা, তুষারপাতের সময় কখনও কখনও পাইনের জঙ্গল মনে হয় বাড়িতে গজিয়ে গেছে। নীলবর্ণের পাতার ওপর সাদা তুষারদানা, এবং তুলোর মতো পেঁজা পেঁজা ভাব গাছপালার চারপাশে, অথবা রিনরিন করে যখন তুষারপাতের শব্দ হয় জানালার কাঁচে, এবং যখন, নির্মল আকাশ থাকে ওদের বাড়ির মাথায়, দূরে লাইট-হাউসের আলো, সমুদ্রে নানা বর্ণের জাহাজ এবং সি-গালদের কোলাহল সমস্ত বন্দর জুড়ে তখন যদি কোন জ্যোৎস্না রাতে ছোটবাবু তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকত, তবে পৃথিবীর কোথাও বুঝি কোনও কষ্ট থাকত না। কেবলমাত্র ছোটবাবুর লিটল ডার্লিং তার সবকিছু কেমন বিষণ্ণ এবং দুঃখময় করে দিচ্ছে।

তাছাড়া সে তো আর পারে না—সেইদিন থেকে সে ছোটবাবুর কাছে কেমন ছোট হয়ে গেছে। ছোটবাবুর কাছে সে খুব নিষ্ঠুর, অন্ততঃ সে আর একবার প্রমাণ করে দিতে চায় ছোট, আমি মেয়ে, তুমি বিশ্বাস কর আমি মেয়ে। আমাকে বাবা বনি বলে ডাকে। রাতে আমি সুন্দর পোশাকে শুয়ে থাকি। আমার মাথার ওপরে থাকে অল্প সবুজ আলোর ডুম। সিল্কের চাদরে আমার শরীর ঢাকা থাকে। তখন যদি তুমি আমাকে দেখতে ছোট, আমার ওপর তোমার কিছুতেই রাগ থাকত না।

ছোট কখনও কখনও দেখত, জ্যাক নিরিবিলি চুপচাপ অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে। কথা বলছে না। কেবল দেখে যাচ্ছে ছোটবাবুর কাজ। এবং ছোটবাবুর তখনই খারাপ লাগে, ওর সঙ্গে ওর মতো কথা বলার জাহাজে কেউ নেই। সে তখন আবার কাছে এসে বলে, জ্যাক, আমার লিট্ল ডার্লিংকে দেখলে তুমিও ভালবেসে ফেলবে। আমি যেখানে যাই, ওর ছবি আমার সঙ্গে থাকে।

জ্যাক তখন বলত, আমি যাই ছোট।

ছোটবাবু এভাবে বুঝতে পারত না, জ্যাক তখন আর দাঁড়াত না কেন, সোজা চলে যেত। দুদিন তিনদিন কোন কথা বলত না। ছোট তখন আবার ভয় পেতে শুরু করত জ্যাককে। জ্যাক কথা না বললে, জ্যাক ইচ্ছে করে বাংকারে নেমে না এলে, কখনও জ্যাকের সঙ্গে তার কথাবার্তা হত না। এবং এমনকি সে দেখেছে তখন কথাবার্তা হলেও, জ্যাক তার সেই ছোট্ট ছবির কথা একবারও বলত না। জ্যাক এমন ভাবে কথা বলত, যেন কখনও সে লিট্ল ডার্লিং-এর নামই শোনে নি। ছোটবাবু ও তখন একেবারে সব ভুলে অন্য কথা, জাহাজ নিউ-অরলিনসে যাচ্ছে, মিসিসিপি নদীর ভেতরে জাহাজ ঢুকে যাবে কি মজা! এবং আলাদা রোমাঞ্চ, সে ভূগোল বইয়ে পড়েছে, মিসিসিপি পৃথিবীর দ্বিতীয় বড় নদী। মিসোরি ধরলে, এটাই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নদী। আর মিসিসিপি সম্পর্কে ওরা সবাই এখন থেকেই দুটো একটা কিংবদন্তী শুনতে শুরু করেছে, জাহাজ যত এগুবে, মিসিসিপি সম্পর্কে সবাই তত কৌতূহলী হয়ে উঠবে। নদীর মোহনাতে জাহাজ ঢুকলেই বোঝা যাবে এসে গেছে, মিসিসিপি এসে গেছে! তখন সমুদ্রের জল আর নীল থাকবে না। একেবারে হলুদ রঙ, অথবা গৈরিক রঙ বলা চলে। ঘোলা জল, যেদিকে তখন তাকানো যায়, কেবল অজস্র পাখি, দলে দলে ওরা আকাশের ওপর হাজার হাজার, তারও বেশি, কত যে পাখি—সি-গাল, মিউল হগস্‌, সি-পিজিয়নস এবং এ্যালবাট্রসও আছে মাঝে মাঝে কেবল অনবরত ঘুরে ঘুরে মোহনার ওপর যেন চক্রকারে সেই কবে থেকে ওরা উড়ছে। এবং নতুন জাহাজ দেখলেই ঘুরে ঘুরে ওড়া, অথবা নদী তার মোহনায় কত সব খাবার ভাসিয়ে নিয়ে আসছে তাদের জন্য। আর নিচে বোধহয় অজস্র মাছ, যেন এক বিস্তীর্ণ জলাশয়ে পাখি মাছ মানুষ মিলে এক আশ্চর্য মিউজিক তৈরী করে ফেলে! মাছেরা নিচে সব ছোট ছোট দ্বীপের চারপাশে সাদা পাখনা মেলে ঘুরে বেড়াচ্ছে, ওপরে পাখিরা নীল নির্জনতার ভেতর, আর তার ভিতর এক সাদা জাহাজ যাচ্ছে, সাদা পোশাকে দাঁড়িয়ে আছে জ্যাক, পাশে নীল রঙের পোশাকে দাঁড়িয়ে আছে ছোটবাবু। এভাবে একদিন সত্যি ওরা নদীর মোহনায় দূরের ছায়া ছায়া মেঘের মতো ভেসে থাকা কিনারার ছবি দেখতে দেখতে মুগ্ধ হয়ে গেল।

ছোটবাবু বলল, জ্যাক আমরা কাল বন্দর পাচ্ছি?

জ্যাক বলল, হ্যাঁ।

—আমরা ক’দিন থাকব?

জ্যাক বলল, জানি না।

—মাস্টার তোমাকে কিছু বলেন নি?

—না।

—তুমি বেড়াতে যাবে না?

—কোথায়?

—কিনারায়।

—জ্যাক বলল, বাবার সঙ্গে আমার কিনারায় যেতে ভাল লাগে না ছোট।

ছোট বুঝতে পারে, জ্যাকের দুঃখটা কোথায়। কাপ্তান বুড়ো মানুষ, বন্ধু-বান্ধব অথবা এজেন্ট অফিসের যারাই আসেন সবাই যেন প্রায় তার বাবার সমবয়সী, ওরা ওর বাবার সঙ্গেই বেশি কথা বলতে ভালবাসে! সে চুপচাপ তার বাবার পাশে বসে থাকে মাত্র। হয়তো তখন রাস্তায় শীতের বিকেলে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা হৈ-চৈ করছে, কোনও বড় মাঠে, দেবদারু গাছের মতো দাঁড়িয়ে আছে অজস্র পাইন, অজস্র পাইনের জঙ্গল ভেদ করে একটা সরু রাস্তা অনেক দূরে সীমাহীন গভীরতায় ঢুকে গেছে, তখন সেই গাড়ি তার ড্রাইভার অথবা রিনরিন বাজনার মতো সেইসব পাহাড়ি রাস্তায় বোধহয় জ্যাকের ঘুরে বেড়াতে ভাল লাগে। অথবা কোনও বড় কার্নিভালে হৈ-চৈ করা, মুখোশ মুখে লাগিয়ে ঘুরে বেড়ানো ভারি মজার—জ্যাক এসবই পছন্দ করে কিন্তু বুড়ো কাপ্তানের সঙ্গে গেলে জ্যাক বোধহয় সেসব পায় না। কেবল সব ভারি ভারি কথা। মজার কথা কেউ তার সঙ্গে বলে না। জ্যাকের তো ভীষণ একঘেয়ে লাগারই কথা তখন।

সে বলল, জ্যাক, তুমি তবে আমাদের সঙ্গে যাবে?

—কোথায়?

—তুমি আমি আর ডেবিড একসঙ্গে বের হবো। বেশ মজা হবে।

—কোথায় যাব আমরা?

—ডেবিড আমাদের যেখানে নিয়ে যাবে।

—সে কোথায় যাবে ছোট?

—তা তো জানি না। বলেছে, নিউ-অরলিনসে আমরা বেশ ক’দিন থাকব। ইচ্ছে করলে নাকি আমরা গাড়িতে বেটন-রুজ পর্যন্ত ঘুরে আসতে পারি।

—বাবাকে বলব।

তখনই মিঃ স্প্যারো বয়-কেবিনের মাথায় বসে ওদের দেখছে। আর মিসেস স্প্যারো বেশ হাওয়ায় দুলে দুলে উড়ছে। কোথা থেকে তখন উড়ে আসছে বড় একটা সি-গাল। সঙ্গে সঙ্গে পাখিদুটো ভয় পেয়ে একেবারে জালির ভেতর দিয়ে উড়ে গেল। এবং সাঁ-সাঁ করে বের হয়ে যাচ্ছে বড় সি-গালটা। জ্যাক পাখিটাকে তাড়িয়ে দেবার জন্য হাতে একটা ভাঙা লোহার টুকরো নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। বোধহয় জ্যাক অথবা ছোটবাবুর মারমুখো চেহারায় ভয় পেয়েছে পাখিটা। ওটা আর উড়ে এল না। এবং ছোটবাবু বুঝতে পারল, এই মোহনায় পাখি দুটো নিরাপদ নয়। ওরা এখন জালির ভেতর ঢুকে গেছে। নিরাপদে রয়েছে, ওরা বোধহয় মোহনা পার না হলে আর বের হবে না। এবং তখনই ছোটবাবু ফের বলল, আমরা ক্যারলটনে যেতে পারি, একটু দূরে গেলে বনেটকারে আরও দূরে গেলে কলেজ- পয়েন্ট। শেষ পর্যন্ত ডেবিড বলেছে, আর খুব দূরে গেলে বেটনরুজে। একদিন না হোক দুদিনে ফিরে আসা যেতে পারে। নদীর পারে আশ্চর্য সব জায়গা। মিসিসিপিকে যতটা পারি ভেতরে ঢুকে দেখে আসব।

আর তখনই হৈ-চৈ-প্রিয় ডেবিড ছুটে আসছে। সেই দূরবীন গলায় ঝুলছে। যত জাহাজ এগুবে, এই দূরবীনে ডেবিডের চোখ তত বড় হয়ে যাবে। আর যত রাগ জ্যাকের এই দূরবীনটাকে নিয়ে। ছোটবাবুকে ডেবিড নষ্ট করে দিচ্ছে এবং সঙ্গে সঙ্গে সে বলল, আমি তোমাদের সঙ্গে কোথাও যাব না ছোটবাবু। তারপর এক মুহূর্ত দাঁড়াল না। সে সিঁড়ি ধরে ওপরে উঠে গেল।

এবং এখন বিকেল। চারটা বেজে গেছে বলেই ডেবিডের ছুটি। তার এখন শুধু আবার আগের মতো বসে থাকা। পশ্চিমে পাহাড়ের ওপাশে অথবা সানফ্রান্সিসকো কিংবা লস এঞ্জেলসের সমুদ্রে সূর্য অস্ত যাচ্ছে, কারণ যখনই সূর্য অস্ত যায় সে ভেবে থাকে, সমুদ্রে সূর্য ডুবে যায়। পৃথিবীর আহ্নিক গতি বার্ষিক গতির কথা তার ভাবতে ভাল লাগে না। সমুদ্রে সূর্য ডুবে গেছে না ভাবতে পারলে এমন একটা জাহাজের বোট-ডেকে দূরবীন চোখে বসে থাকার মানে হয় না। কারণ ওর কাছে পৃথিবীর সব যুবতীরাই তখন ভীষণ দামী। একবার দূরবীনে দেখে ফেলতে পারলে, তাদের সব কিছু যেন দেখে ফেলে, এবং তখন জিভ লালায় ওর মোটা হয়ে যায়। ঠোঁট সে জিভের লালায় ভিজিয়ে রাখতে ভালবাসে। স্ত্রী এবির কথা মনে থাকে না। ছোট্ট মেয়েটি ফোলা ফোলা মুখে জানালায় দাঁড়িয়ে হাত যে নেড়েছিল, এবং রাস্তাটা যেখানে বাঁক নিল, গাড়িটা যেখানে অদৃশ্য হয়ে গেল, দূরবর্তী বাড়ির জানালায় কেউ তখনও দাঁড়িয়ে আছে, চোখে জল, এসব মনে থাকে না। সে কেমন গাউন আর তার ভেতরে এক অহমিকাময় যুবতীর শরীরের সুন্দর সুদৃশ্য জায়গাগুলো ভেবে ভেবে স্ত্রীর মুখ একেবারে ভুলে থাকে। এবিকে পেলে সে বোধ হয় তখন বুকে মুখ লুকিয়ে বলত, জাহাজে গেলে আমি ভাল থাকি না। তুমি কেমন থাকো আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে। কিন্তু এবি চিঠিতে তাকে কখনও এ-সম্পর্কে কিছু লেখে না। ওর ভীষণ রাগ হয়, অভিমান হয়। কেবল চিঠিতে, ওর শরীর, ওর নাওয়া-খাওয়ার কথা থাকে। ছেলে-মেয়েদের কথা থাকে। কে কি দুষ্টুমি করেছে, অথবা স্কুল ক্রিকেটে বড় ছেলে ক্যাপ্টেন হয়েছে বলে বাড়িতে কে কে নিমন্ত্রিত হয়েছিল এসব লেখা থাকে। জমিতে এবার ক্যাবেজ কেমন হয়েছে লেখা থাকে। মটরশুঁটির চাষ মনে হয় ভালই হবে। টমেটো খুব হয়েছে। গরুগুলোর খবর থাকে। গম চাষ বোধহয় ভাল হবে না খুব, এসব লিখে জানায়। ওর যে একটা শরীর আছে, এবিও যে একটা শরীর বয়ে বেড়ায় চিঠিতে তা কিছুতেই বোঝা যায় না। ছোট দাঁড়িয়েছিল। ওর রাতে ওয়াচ। সে এখানে এখন অনায়াসে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। ডেবিড একটু দূরে বসেছে। জ্যাককে দেখেই ডেবিড বোধহয় খুব আনন্দ প্রকাশ করেছিল, পোর্ট, আবার পোর্ট, কিন্তু জ্যাক চলে যাওয়ায় ডেবিড বোধহয় একটু আহত হয়েছে। সে চুপচাপ বসেছিল, পাশে ছোটবাবু রয়েছে এটা যেন সে দেখতেই পাচ্ছে না। সে নিজের মতো দূরবীনে নদীর মোহনায় পাখিদের ওড়া দেখছে। এবং পাখিগুলো যে খুব বড় আকারের হয়ে যায়, উড়তে উড়তে একেবারে মুখের ওপর মনে হয় হাওয়া কাটিয়ে ওপাশে চলে যায়, ছোটবাবু দূরবীন চোখে না দিয়েও এটা বুঝতে পারে।

ছোট ডাকল, এনি ওম্যান?

উত্তর এল, নো।

ছোট ভাবল, এ সময় হয়তো কিছু বলা ঠিক হচ্ছে না। এই মোহনায় মেয়ে পাবে কোথায়। কেবল দূরে দু-তিনটে জাহাজ দাঁড়িয়ে আছে। ওদেরও এবার দাঁড়িয়ে পড়তে হবে। পাইলট-বোট আসবে। পাইলট এবার ভার নেমে জাহাজের এবং জাহাজ নদীতে ঢুকে গেলে, দু’পাড়ে হয়তো গাছপালার ফাঁকে ওম্যান দেখে ফেললেও ফেলতে পারে। এখানে শুধু পাখি, ঘোলা জল, এটা হয়তো সেকেণ্ড রসিকতা ভেবে থাকতে পারে। ছোটবাবুর ভয়ে বুকটা গুড়-গুড় করে ওঠে। ওর মুখটা ভীষণ ফ্যাকাশে হয়ে গেল ফের।

আর তখনই ওরা দেখল দূর থেকে পাইলট-সিপ বেগে চলে আসছে। কিনারার বার্তা বয়ে আনবে। চিঠি আনবে। সেকেণ্ড লাফিয়ে উঠে পড়ল। চিৎকার করে বলল, আসছে আসছে। ছোটবাবুকে দেখিয়ে বলল, ঐ দ্যাখো আসছে। ওটা আমাদের নিয়ে যাবে মিসিসিপির ভেতর। এখানে এলেই আমার মনে হয় ছোট, আমরা যেন মার্ক টোয়েনের জগতে এসে গেছি। তুমি পড়েছ লাইফ অন দি মিসিসিপি, পড়েছ?

ছোট খুব সহজ গলায় বলল, নো স্যার।

সেকেণ্ড পিটপিট করে তাকাল। বুঝতে চেষ্টা করল ছোটবাবু এত সম্মান দিয়ে কথা বলছে কেন। তারপরই কি বুঝতে পেরে হা হা করে হেসে ওর কাঁধে জোরে চাপড় দিল, কি জান ছোট, মনটা ভাল নেই। ভেবেছিলাম দেশে ফিরব। কিন্তু সব বাতিল। বাড়ির জন্য মনটা মাঝে মাঝে খারাপ হয়ে যায়। তারপর একটু থেমে সেই পাইলট-বোটের দিকে তাকিয়ে বলল, আমাদের মিসিসিপিতে নিয়ে যাবার জন্য সে আসছে। তুমি পড়বে। সেলরদের কাছে এটা ভীষণ পবিত্র গ্রন্থ। আমি যে কতবার পড়েছি বইটা। আমি কোথাও কোথাও মুখস্থ পর্যন্ত বলে যেতে পারি।

তারপরই একটু থেমে দেখে নিল, পাইলট-সিপ আর কতদূর। যতক্ষণ জাহাজের কিনারায় এসে না ভিড়ছে ততক্ষণ বোধহয় কথা বলা যাবে—আর সব কথাই একমাত্র এখন এই মহামহিম নদী, তার প্রাচীনতা এবং তার নাব্যতা কতটুকু, প্রাচীন কালে, কে প্রথম এই নদী আবিষ্কার করেছিল, তার নাম, হ্যাঁ মনে পড়ছে ডি-সোটা।

—ওহে ছোটবাবু, তুমি ভাবলে সেই লোকটি কিনা একটা মহৎ কাজ করে ফেলেছে। কিছুই না। প্রথম ডি-সোটা মিসিসিপি দেখতে পান। এবং সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। নদীর পাড়ে পুরোহিত ও সৈনিকেরা তাঁকে সমাধি দেয়। এবং বুঝতেই পারছ তারপরই আশা করা যায় সৈনিক এবং পুরোহিতরা ফিরে এসে বিশাল মহাকায় নদীর কথা সাধারণ মানুষকে বলবে। তারা বলেওছিল। কেউ আর এ- নিয়ে মাথা ঘামায়নি। শোনা যায় ঐ লোকটির মৃত্যুর পঁচিশ বছর পর শেকসপিয়ারের জন্ম। এবং প্রায় পঞ্চাশ বছর বেঁচে রইলেন, তারপর তাঁর ও মৃত্যু হল। আরও পঞ্চাশ বছর যখন তিনি কবরে থাকলেন আরামে তখন দ্বিতীয় শ্বেতাঙ্গ ব্যক্তির মিসিসিপির পাড়ে আবির্ভাব ঘটল। অর্থাৎ তুমি বুঝতেই পারছ ডি-সোটার মৃত্যুর প্রায় একশ ত্রিশ বছর পর আর একজন, তার নাম বোধহয় লা-সালে এবং এমনই একটা নাম মনে হচ্ছে, তিনি আবার জাতিতে ফরাসী, প্রথম মিসিসিপি সম্পর্কে তাঁর অনুসন্ধান করবার একটা স্পৃহা জাগল।

পাইলট-সিপটা বেশ ছুটে আসছে—সে আবার সেদিকে তাকাল। আরও কিছুক্ষণ ছোটবাবুর সঙ্গে এই নদী এবং তার প্রাচীনতা সম্পর্কে কথাবার্তা বলা চলে। এখন কোনও কাজ নেই, যে ভাবেই হোক এই সব চারপাশের নদী-নালার গুণকীর্তন করে সময়টা কেটে যাবে। সে বলল, যা বলছিলাম, আমাদের যুগে এমন একটা আশ্চর্য নদী দেখার পর দেড়শো বছর চুপচাপ কাটিয়ে দিতে পারি—ভাবা যায় না। কোথাও কোনও সমুদ্র উপকূলে এক খণ্ড ভাঙ্গা প্রাচীন শিলাস্তর খুঁজে পেলে অন্তত পনেরটি অভিযাত্রী দল ছুটে আসবে। একদল যাবে শিলাস্তরের রহস্যসন্ধানে। বাকি চোদ্দটি দল যাবে পরস্পরের সন্ধানে।

ছোটবাবুর মনে হল, সেকেণ্ড এই নদী সম্পর্কে অনেক খবর রাখে। এবং প্রথম প্রথম কথা বুঝতে ছোটবাবুর অসুবিধা হত। এখন একেবারেই তা হয় না। এবং ছোটবাবুও প্রায় ওদের মতোই একসেন্টে কথাবার্তা বলতে পারে। আর এটাই বোধহয় ওর আশ্চর্য ক্ষমতা, কত সহজে, সেও সাবলীল। ইংরেজিতে কথাবার্তা চালিয়ে যেতে পারে। সে বলল, সব নদীর মোহনাই কিন্তু এক রকমের।

—মানে!

—সেই পাইলট-সিপ, কিছু জাহাজের প্রতীক্ষা, আর অজস্র পাখি এবং দূরে এই ছায়া ছায়া পাহাড় অথবা বনাঞ্চলের ছায়া। ওর ইংরেজিতে এমন শব্দেরই বেশি সমাবেশ ছিল বলে, সেকেণ্ড মনোযোগ দিয়ে শুনছিল, এবং পরে মনে হল, ঠিকই বলেছে ছোট—টেমস, গঙ্গা অথবা এই মিসিসপি, যদি আমাজনে যাওয়া যায়, সেখানেও হয়তো কিংবা ইউফ্রেটিস নদীর তীরে নীল নদের অববাহিকায়।

সেকেণ্ড বলল, যা বলছিলাম বুঝলে ছোট দেড়শো বছরের ওপর তখন এখানে সব সাদা মানুষেরা পাল তুলে তীরে বসতি গড়েছে। এদের সঙ্গে স্থানীয় আদিবাসীদের যোগাযোগ হয়েছে, দক্ষিণ দেশগুলোতে স্পানিয়ার্ডরা নির্বিচারে লুঠতরাজ চালাচ্ছে। নরহত্যা নারীধর্ষণ রোজকার ঘটনা। ওদের যেনতেন প্রকারেণ ধর্মান্তরিত করা হচ্ছে। একটু ওপরের দিকে ইংরেজরা তাদের কাছে মালা কম্বল বিক্রি আরম্ভ করে দিয়েছে, হুইস্কি ধরিয়ে ওদের মগজে ফূর্তির বান ডাকিয়েছে, কানাডায় ফরাসীরা আর এক ধাপ এগিয়ে, ইস্কুল খুলে হাতেখড়ি দিচ্ছে, বিদ্যাদানের নামে সব আত্মসাত করার নয়া ফরমূলা। মনট্রিল এবং কুইবেকে পশম কেনাবেচার ভেতর দিয়েও বেশ যখন জানাজানি ভালভাবেই হয়ে গেছে তখনও কেউ জানে না, এই দেশের ভেতরে রয়েছে এত বড় একটা নদী। একেবারে জানে না বললে ভুল হবে, তারা ভাসাভাসা খবর শুনেছিল। নদীর আয়তন এবং অবস্থান সম্পর্কে কোন সঠিক ধারণা ছিল না। অথচ দ্যাখো, ওদের মগজে কোন দুঃসাহসিক ইচ্ছে ছিল না, কোথায় সেই নদী, তার উৎপত্তি কোথায়, কোনদিক থেকে নেমে কোথায় যাচ্ছে, একেবারে সোজাসুজি না ডাইনে বাঁয়ে ঘুরে ঘুরে অশ্বখুর তৈরি করে চলেছে—কিছুই জানার ইচ্ছে ছিল না তাদের। আসলে কি জানো ছোট, নদীটা যে ওদের কোন কাজে লাগবে ভাবতেই পারেনি। নদী তারা চায়নি। তাদের জীবনে নদীর কোন প্রয়োজন ছিল না। অথচ প্রায় দেড়শ বছর পর যখন লা-সালে এই নদী আবিষ্কার করলেন, তখন পড়িমরি করে কে আগে যাবে, কার আগে প্রাণ কে করিবে দান, আসলে কি জানো, তখন সবার মনে জেগেছিল, নদীটাকে কিভাবে যে কাজে লাগানো যায়! তখনকার দিনে কেউ কেউ বিশ্বাস করত, ওটা গিয়ে পড়েছে ক্যালিফোর্ণিয়া উপসাগরে, এবং এখান থেকেই চীনে যাবার একটা সংক্ষিপ্ত পথ খুঁজে পাওয়া যাবে। অথবা কেউ কেউ ভাবত, ওটা গিয়ে পড়েছে ভার্জিনিয়ার সমুদ্রে। যাই হোক সে অনেক ইতিহাস বুঝলে ছোট, ঐ দ্যাখো পাইলট উঠে আসছে। তোমার চিঠি এলে দিয়ে দেব। তুমি এস। তখন ছোটবাবু হাসল। ওর চিঠি কখনও আসে না হেসে যেন বলতে চাইল। মেজ-মালোম ডেবিড ওর দিকে তাকিয়ে থাকল। ভারি কোমল স্বভাবের ছেলেটা। একটা চিঠি না এলে কী যে খারাপ লাগে! এখানে ছোটবাবুকে একা রেখে যেন যাওয়া ঠিক না। সে ফের বলল, এস আমার সঙ্গে।

সে বলল, সেকেণ্ড, আমার চিঠি আসে না, আমাকে কেউ চিঠি দেয় না। আমারও আর কাউকে চিঠি লিখতে ইচ্ছে হয় না। কাকে লিখব! যাঁকে লিখলে খুশি হতেন, তাঁকে জানাতেই পারছি না, জাহাজ মিসিসিপিতে ঢুকে যাচ্ছে। অবশ্য আমার মা জানেনও না পৃথিবীতে মিসিসিপি বলে একটা নদী আছে। তারপর বলার ইচ্ছে হল—তাঁর পৃথিবী ভীষণ ছোট। সেই ছোট পৃথিবীতে শুধু তাঁর আমরাই আছি। আর কি আছে না আছে তার জন্য তাঁর কিছু আসে যায় না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *