1 of 2

অলৌকিক জলযান – ১৬

সারেঙসাব জ্যাককে দেখে অন্য দিকে চোখ ফেরালেন। বড়লোকের ছেলে যা হয়, যা খুশি মনে আসে করে বেড়ায়। এখন জ্যাককে দেখলে কে বলবে, সেই ছোটবাবুকে এ-ভাবে জব্দ করেছে। আসলে, দুর্ঘটনার জন্য জ্যাক দায়ী ছিল না। সেই অতিকায় ব্রেকার, যার কার্যকারণ কেউ ব্যাখ্যা করতে পারে না কারণ কখন সমুদ্রে কি হয়, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণি এবং এমন সব ভূকম্পন, অগ্নুৎপাত হতে থাকে যে তার কার্যকারণের ব্যাখ্যা একমাত্র সেই মহামহিমের কাছেই থেকে যায়। কাপ্তান তখন বুকে ক্রস টেনে শুধু বলতে পারেন, হে মহামহিম আপনি মঙ্গলময়। কারণ কোনও বেতার সংকেত ছিল না। অটোএলার্ম ঠিক ছিল। ব্রীজে ডিউটি-অফিসার অটো-এলার্ম বাজলে ঠিক শুনতে পেতেন। যাই হোক, সারেঙ যেন ছোটর এই দুর্ঘটনায় জ্যাককে বাদে আর কাউকে দায়ি ভাবতে পারেন না। সেই জ্যাক যখন আনন্দে শিস্ দিতে দিতে হাঁটছে তখন কেন জানি তাঁর ভাল লাগল না। জ্যাক কাল যাবে, গেলেই যেন তার ছেলের আবার মন্দ কিছু হয়ে যাবে। সে ডেবিডকে ডেকে বলল, আপনি যান। আমি পরে যাচ্ছি। জ্যাক সঙ্গে গেলে যেন মাথা ঠিক রাখতে পারবেন না।

তখন চুপি চুপি জ্যাক বলল, ছোট কি বলে?

—বলে না কিছু।

—কেন!

—কথা বলতে দিচ্ছে না।

—কাল গেলে আমরা কথা বলতে পারব না?

—না।

তারপর ডেবিড পাইপে ধোঁয়া উঠছে না দেখে বুড়ো আঙ্গুলে টিপে কি দেখল। তখন লম্বা ব্ৰীজ পার হয়ে সারেঙ অন্যদিকে চলে যাচ্ছেন। জ্যাকের ভারি ইচ্ছে হল, ব্রীজ পার হয়ে বড় পাহাড়ের মাথায় উঠে যায়। এবং ডেবিডকে বলার ইচ্ছে, আচ্ছা এখান থেকে কতদূর!

—বেশি দূর না।

—পাহাড়টার মাথায় উঠে গেলে ছোটবাবুর হাসপাতাল চোখে পড়বে?

—পড়তে পারে।

—উঠবে ওপরে?

—পড়ে যাবে।

—তুমি এস না। বলে সেই যেন ডেবিডকে নিয়ে সেই নিকটবর্তী পাহাড়ের গাছপালার ভেতর দিয়ে ওপরে উঠে গেল। তখন সূর্য অস্ত যাবার মুখে। লেগুনের জলে নানাবর্ণের শালতি। লম্বা কোনোটা সাদা রঙের, কোনোটা নীল রঙের। আর কোনোটার মাথায় পাল, ছোট ছোট এই সব শালতির পাটাতনে বসে রয়েছে যুবক যুবতীরা। ওরা নৌকা-বাইচ দিচ্ছে। এবং পাশাপাশি সব জাহাজ। পাহাড়ের ছায়া লেগুনের জলে। আলো জ্বলছে বড় গম্বুজের মাথায়। অনেক দূরে সেই হাসপাতালের মাঠে লাল গীর্জা। ডেভিড গীর্জার মাথায় ক্রস দেখিয়ে বলল, ওখানে ছোটবাবু থাকে।

পরদিন জ্যাক, কাপ্তান, মেজ মালোম, সারেঙ, মৈত্র সবাই—এক দঙ্গল যেন। এ-সব জাহাজে একজন কোলবয়ের জন্য এটা বাড়াবাড়ি। কথা থাকে অসুস্থ হলে জাহাজ বন্দরে লাগলে নামিয়ে দেওয়া, কিন্তু বোধ হয় ছোটবাবুর জন্য বনির যেমন মায়া, তেমনি কাপ্তান থেকে সবাই। ছোট, বিনীত ভদ্র। অসহায় চোখ। কম বয়সে সবারই চোখ এমন থাকে, তাঁর নিজেরও এমন ছিল। আর তা ছাড়া কি যেন আছে ছোটর ভেতর। যখন সাদা এম্বুলেন্সে নিয়ে যাওয়া হয় কাপ্তান নিজের ভেতর কেমন অস্থির হয়ে পড়েছিলেন। ছোটবাবুর মুখে নীল দাড়ি। শরীরের লাবণ্য কোনো দূরবর্তী এক বনভূমির কথা অথবা কোন মরুভূমিতে একজন মুসাফিরের নিত্য হেঁটে যাওয়ার কথা মনে করিয়ে দেয়। ছোটবাবুর মুখের ছবির সঙ্গে দূরবর্তী কোন মরুভূমির মহামহিমের কথা কেবল মনে পড়ে যায়। তখন কিছুতেই তাকে ফেলে তিনি জাহাজ সমুদ্রে ভাসিয়ে দিতে সাহস পান না।

এবং এ জন্য কাপ্তান এখানে নানারকম মেরামতের কাজ বের করে যেমন, চক্ মেরামত, এনজিন রুমের বালকেড পাল্টে ফেলা, এবং ব্রীজে কিছু কাজকর্ম তাছাড়া স্মোক-পাইপ বসানের কাজ আছে এবং এসব কাজের ভিতর বন্দরে পড়ে থাকার প্রয়োজনীয়তা—যেন তিনি ছোটবাবুর জন্য অপেক্ষা করছেন না, অপেক্ষা করছেন, জাহাজের এইসব মেরামতের জন্য। মেরামত শেষ হলেই জাহাজ ছাড়া হবে।

ওরা যখন নেমে যাচ্ছিল, মেজ-মিস্ত্রি অর্থাৎ সেকেন্ড-এনজিনিয়ার তখন দু-পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে আছে ডেকে। সাদা বয়লার স্যুট পরেছে সে। ওর পাতলা চুল মাথায় এবং চোখে-মুখে কঠিন এক তাচ্ছিল্য, কোথাকার কে এক নেটিভ ইন্ডিয়ান তার জন্য এত সব। মুখে খুবই দাম্ভিকতার ছাপ। জ্যাকের জন্য সে মাঝে মাঝে আকুলতা বোধ করে থাকে। এমন নাবালকের মুখ এবং জাহাজে যা সব হয়ে থাকে, কখনও অধিক পানীয় পেটে পড়লে সে ঠিক থাকতে পারে না। জ্যাকের কেবিনের চারপাশে ঘুরে বেড়ায়। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় নরম পাখির মতো রোস্ট—জ্যাকের শরীর যেন সুস্বাদু খাদ্য—সেই জ্যাক পর্যন্ত এমন বিশ্রী একটা লোককে দেখতে যাচ্ছে। জ্যাক এ-জাহাজে ওকে মাঝে মাঝে পাগল করে দেয়। জ্যাকের যতদিন দাড়িগোঁফ না উঠবে ততদিন একটা মেয়ের শরীর বাদে তার কাছে আর কিছু না। সে কেবল ফাঁক খুঁজেছে। জ্যাককে দেখলেই গলে পড়ছে। কথা বলছে গদগদ গলায়। ওর কেবিনে কতদিন আসতে বলেছে চুপি চুপি। সে বন্দর থেকে যা কিছু দুর্লভ জ্যাকের জন্য নিয়ে আসতে চায়। বন্ধুত্ব অসীম বন্ধুত্ব, তারপর কখনও সবাই যখন কেবিনে ঘুম যাবে জ্যাকের শরীরে জোরজার করে একটা কিছু করে ফেলবে। জ্যাক সাহসই পাবে না। বাপকে এমন নোংরা ঘটনার কথা বলতে সাহস পাবে না। ও তারপর যে কি মজা হবে! জ্যাক যদি অভ্যস্ত হয়ে যায়, এ-জাহাজ নিরবধিকাল চললেও ভাববে না, দেশে ফেরা দরকার। সে জিভ্ দিয়ে ঠোঁট চাটছিল আর ভেতরে ভেতরে ফুঁসছিল।

জ্যাক সবার পেছনে। হাসপাতালের ভেতর বড় রাস্তা এবং সুন্দর ফুলের বাগান, গোলাপ ফুলই বেশি। ওর ইচ্ছে হল একটা ফুল তুলে নেয় ছোটবাবুর জন্য। এবং সে সবার অলক্ষ্যে একটা গোলাপ ফুল তুলে ফেলল। তারপর রুমালে ঢেকে সে যখন ঢুকে গেল ভেতরে, দেখল সারি সারি বেড। এবং শেষ দিকে বাবা এবং সেই ওল্ড-ম্যান অর্থাৎ সারেঙ। সে দেখতে পেল ছোটবাবু শুয়ে আছে পাশ ফিরে। ওর মাথায় ব্যান্ডেজ এবং ও-পাশে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে আছে। জ্যাক কিছুতেই সাহস পেল না সামনে গিয়ে একবার দেখে। সে তার বাবার পেছনে প্রায় যেন লুকিয়ে দাঁড়িয়েছিল। যেন ছোটবাবু দেখতে না পায়। সে দেখছিল ছোটবাবু বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। বাবাকে ছোটবাবু ভীষণ ভয় পায়। বাবা থাকলে ছোটবাবু ভীষণ অস্বস্তিতে পড়ে যায়। সারেঙ শিয়রের দিকে। এনজিন টিন্ডাল সামনে—ও পাশের বেডে ঠোঁট পুরু চুল কোঁকড়ানো বাদামী মানুষ। পা টানা দেওয়া। চেহারা দেখলে ড্রাইভার মনে হয়। এবং এ-ভাবে এখানে কত বিচিত্র ব্যান্ডেজে পড়ে থাকা মানুষ! ওষুধের গন্ধ ছোটবাবু এখানে এভাবে একা পড়ে রয়েছে। সে কিছু বলতে পারছে না। রিপোর্ট ঝুলছে। বাবা ডাক্তারের সঙ্গে একটু কথা বলতে চাইছেন, কবেতক তুলে নেয়া যাবে এবং এ-ভাবে জ্যাক দেখল বাবা করিডোর দিয়ে যখন হেঁটে যাচ্ছেন ছোটবাবুর মুখে সুন্দর হাসি। সে ডেভিডকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকছে। ছোটবাবু ওকে চোখ তুলে একবার দেখেছে, কিন্তু যেন একেবারেই চিনতে পারেনি। জ্যাকের ভীষণ অভিমান। সে তেমনি পায়ের দিকে দাঁড়িয়ে আছে। ছোটবাবু জানে না, সে ছোটবাবুর জন্য চুরি করে একটা গোলাপ ফুল নিয়ে এসেছে।

ছোটবাবুর কথা শুনে সেকেন্ড হেসে ফেলল। বলল, ওরা ভাল আছে।

জ্যাক আর থাকতে পারল না। বলল, কারা ভাল আছে সেকেন্ড?

—মিস্টার য়্যান্ড মিসেস স্প্যারো।

—ওর ঘুম হচ্ছিল না বুঝি!

জ্যাকের কথা ছোটবাবু শুনতে পায়নি। মেজ-মালোম স্পষ্ট করে বললেন, ওদের জন্য তোমার ঘুম নেই চোখে?

ছোটবাবু আস্তে আস্তে বলল, না। সে সারেঙের দিকে হাত তুলে বলল, ভাল আছি। ভাববেন না। মৈত্রকে বলল, মৈত্রদা বসো। দাঁড়িয়ে থাকলে কেন? আমাকে তোমরা কবে নিয়ে যাবে। আমার ভাল লাগছে না।

মৈত্র বলল, ঠিক নিয়ে যাব।

—আমাকে ফেলে কিন্তু চলে যেও না তোমরা। তবে একেবারে একা পড়ে যাব। জাহাজ ছাড়ছে কবে?

জ্যাক কাছে এসে দাঁড়ালো। জ্যাক কাছে এলে মৈত্র এবং সারেঙ বেশ দূরে সরে দাঁড়াল। জ্যাক পাশে বসল। বলল, তোমাকে না নিয়ে আমরা যাব না ছোটবাবু।

ছোটবাবুর সব রাগ দুঃখ কেমন নিমেষে উবে গেল। —সত্যি যাবে না।

—না।

ছোটবাবু বলল, তুমি ভাল হয়ে যাও জ্যাক। সবাই তোমাকে খারাপ বলে। আমার ভাল লাগে না।

—আমি ভাল হয়ে যাব ছোটবাবু।

—ঠিক!

–ঠিক।

জ্যাক এবার ওকে ফুলটা দিল। বলল, তোমার জন্য এনেছি। জ্যাককে তখন কি যে ভাল লাগে। ছোটবাবু বলল, কত বড় ফুল! এবং জ্যাক ইচ্ছে করলে আরও কত ফুল এনে দিতে পারে। কিন্তু সে যে একটা দুঃসাহসিক কাজের ভেতর ফুলটা ওর হাতে দিতে পেরেছে তার জন্য খুশী। সে বাজার থেকে অনেক ফুল এনে দিতে পারে। ইচ্ছে করলে ওর চারপাশে ফুলের সমারোহ গড়ে তুলতে পারে। কিন্তু সে তো সে-সব কিছু আসার সময় একেবারেই ভাবেনি। সে এই হাসপাতালে ঢুকে আবিষ্কার করেছে হাসপাতালে সময়ে অসময়ে দুর্লভ সব ফুলেরা ফুটে থাকে। একটা ফুল ছোটবাবুকে দিতে পারলে কি যে ভাল লাগবে। এবং এমন মনে হতেই সে কাপ্তান স্যালি হিগিনসের মেয়ে একেবারে মনে থাকল না। মান-সম্ভ্রমের কথা মনে থাকল না। একটা ফুল চুরি করে ফেলল ছোটবাবুর জন্য ফুলটা ছোটবাবুকে দিতে পেরে শেষ পর্যন্ত একটা মহৎ কিছু করে ফেলেছে ভাবল।

এবং এ-ভাবেই জীবন কখনও মধুময়, কখনও এক কঠিন বাস্তবতা অথবা জ্যাক হয়তো জানে না, জাহাজে একজন হিংস্র মানুষ ওর শরীরে মেয়েমানুষের ঘ্রাণ পাচ্ছে। ওর অভিসন্ধির শেষ নেই। অন্ধকার গুহার মতো কেবিনে একজন মানুষ স্থির দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখেও ভাল ঘুম নেই।

স্যালি হিগিনস ফিরে এসে সেকেন্ড অফিসারকে ডাকলেন। এবং পরামর্শ—অবশ্য জ্যাক, মৈত্র অথবা সারেঙ কিছুই শুনতে পেল না। তারপর দু-দিন যেতে না যেতেই আবার বন্দরে সেই সাদা এম্বুলেন্স। ছোটবাবু বসে রয়েছে। জ্যাক সাহায্য করছে তুলে আনতে। গ্যাঙ-ওয়ে ধরে ছোটবাবু উঠে আসছে। ব্রীজে দাঁড়িয়ে আছে সেই লোকটা। একজন নেটিভের সঙ্গে জ্যাকের মেলামেশা তার আদৌ পছন্দ না। সে দু-পা নিজের অজান্তেই ঠক ঠক করে নাচাচ্ছিল। বুড়ো বয়সে কাপ্তানের ভীমরতি ধরেছে।

তবু উঠে এলে, জ্যাককে মেজ-মিস্ত্রি আর্চি বলল, কেমন আছে?

জ্যাক বলল, ভাল।

এবং জ্যাকের যেন এখন কাজের শেষ নেই। বোধ হয় জ্যাক নিজের একগুঁয়েমির কথা ভেবে বিনয়ী হয়ে গেছে। এভাবে ছোটকে পাখি দুটোর পেছনে লেলিয়ে সে ঠিক কাজ করেনি। এখন সে ছোটবাবুকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। ওর ফোকসালে নিয়ে যাচ্ছে। জাহাজিরা ছোটবাবুকে ভীষণ ভাগ্যবান ভাবল। ছোটবাবুর সঙ্গে এমন যখন আচরণ তখন তারাও আর ছোটবাবুকে অবহেলা করতে পারে না। কেউ কেউ উদ্বিগ্ন চোখে মুখে কথাবর্তা বলল। শেষে এল অনিমেষ, বন্ধু। ওরা ফলঞ্চা ঝুলিয়ে জাহাজের বাইরে রঙ করছিল। শরীরে নীল পোশাক। মজুমদার এসেই হাত ঘুরিয়ে মেয়েদের মতো নাচতে থাকল আর গাইতে থাকল, ছোটবাবু ফিরে এসেছে, ছোটবাবু ভূত দেখেছে, আহা আমার কি যে মজা হয়েছে, রেতের বেলা বউ আমারে বাবা বলেছে। এবং এভাবে সবাই হো হো করে হেসে উঠল। জ্যাক এ সবের কিছু বোঝে না। তবু সে বুঝতে পারে ছোটবাবুকে ফিরে পেয়ে সবাই আনন্দ করছে। তারও ওদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আনন্দ করতে ইচ্ছে হল।

আর এভাবে জাহাজ ভিকটোরিয়া পোর্টে মাসাধিকাল থেকে গেল। মাসাধিকাল এ-জাহাজের বর্ণনা দিতে গেলে দেখা যাবে প্রতিদিন একই ছবি—বড় বড় গ্যাস সিলেন্ডার অথবা অক্সিজেন-সিলেন্ডার ডেরিকে উঠেছে নেমেছে। বড় বড় লোহার পাত জড় হয়েছিল এবং জোড়া তালি দেবার জন্য ওয়েলডিঙের কঠিন ধাতব শব্দ, কানে তালা লেগে যাবার মতো। আর ঝুলে ঝুলে রং করা ডেক- জাহাজিদের। চারপাশে বোল্ট লোহায় মুড়ে নেওয়া হচ্ছে। যতটা পারা যায় পুরানো জং-ধরা ঝরঝরে বালকেড মেরামত করে নেওয়া। আর পাশে সরু লেগুনের নীল জল। দু’পাশে শহরের ইট কাঠ সেতু। বিকেলে নৌকা বাইচ। এবং লম্বা লম্বা সালতিগুলো যেন শয়ে শয়ে লেগুনের জলে ভেসে যাচ্ছে—তখন ছোটবাবুর জন্য আর কিছুদিন অপেক্ষা করলে কি ক্ষতি ছিল। বনি, বাবার কথা শুনে সত্যি ভয় পেয়ে গেছে। বেশি কথা বললে, ছোট হয়তো কখনও আর নিরাময় হবে না। সে যে এখন কি করে!

তারপর আবার যা হয়ে থাকে, জাহাজ নোঙর তুলে ফেলছে। পাশের জেটিতে তেমনি জাহাজে আকরিক লোহা বোঝাই হচ্ছে। বোধ হয় কার্ডিফ অথবা হামবুর্গ যাবে জাহাজ। ওদের জাহাজ বাউন্ড ফর পোর্ট অফ সালফার। এখন আরও উত্তরে উঠে যাওয়া। জাহাজ সমুদ্রে পড়লে কার্সি ফ্ল্যাগ নামিয়ে ফেলা হল। জাহাজের সামনে শুধু কোম্পানীর ফ্ল্যাগ। পেছনে ইউনিয়ান জ্যাক। আবার সেই অসীম যাত্রা, নীল আলোময় অন্তহীন যাত্রা যেন। ঝ্যাক ঝ্যাক অবিরাম শব্দ এনজিনের। কেউ হয়তো অবসর সময়ে লম্বা তারের বঁড়শি ফেলে রেখেছে সমুদ্রে। তাজা মাছ উঠলে বেশ হয়। সুরমাই মাছ। বাসি খাবার খেয়ে মুখে রুচি নেই। একটু তাজা মাছের স্বাদ এবং যেদিন সত্যি বড় একটা মাছ, প্রায় ত্ৰিশ বত্রিশ সের ওজনের একটা মাছ উঠে আসে, তখন সবার কি যে হৈ-চৈ। তাজা মাছ। ডেক আর এনজিন ক্রু মিলে উৎসবের মতো দিনটা কাটিয়ে দেয়।

এবং জাহাজ বলতে গেলে বেশ যাচ্ছে। দু-এক দিনের ভেতর ওরা ক্যারেবিয়ান-সি পাবে। তারপর মিসিসিপি নদী। নদীর মোহনা এবং নদীর ভেতর দিয়ে বোধ হয় যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে ঢুকে যাওয়া। সেখানে সালফার বোঝাই হবে। যখন এমন সব ঘটনা, তখন জ্যাকের মনে হল বাবার দিন রাত কি যেন দুশ্চিন্তা মাথায়। ঠিক সেই দুঃস্বপ্ন দেখার পরে যেমন বাবা বলতেন, চিৎকার করে পরিচারকদের ডেকে বলতেন, দ্যাখো দ্যাখো ঘরের ভেতরে কে ঢুকে গেল। আমার সব কিছু তছনছ করে দিচ্ছে। আমার কিছু ঠিক রাখছে না। ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে অথবা যখন তিনি শান্ত হয়ে আসেন তখন তাঁর কন্ঠস্বরে দুঃখী মানুষের আভাস। তিনি ধীরে ধীরে বলেন, বনি দ্যাখতো কে গেল! ঘরের ভেতর কে ঢুকে গেল। চোখে মুখে বাবার কি যে ভীতির ছাপ থাকত।

—কৈ কাউকে তো দেখছি না! কে ঢুকল! ভেতরে কেউ নেই বাবা

—মনে হল যেন কেউ ঢুকে গেল।

আসলে বনি জানে বাবা মাঝে মাঝেই এমন করেন। বয়স যত বাড়ছে বাবার এটা বেশি হচ্ছে। যতক্ষণ সমুদ্রে ভেসে পড়তে না পারছেন, ততক্ষণ এটা থাকছে। কিন্তু এ সফরে বনি দেখছে, বাবা জাহাজেও মাঝে মাঝে সহসা বলে ওঠেন, দ্যাখতো চার্টরুমে কে ঢুকে গেল! বাকিটুকু বলতে যেন তিনি সাহস পান না। বনি মুখ দেখে বুঝতে পারে বাবা কথা সম্পূর্ণ শেষ না করেই ওর দিকে তাকিয়ে আছেন। বনি আবার সব বুঝে ফেলছে নাতো এমন চোখ মুখ তখন তাঁর। বনি জবাব দিত, কেউ না। এই এস না, দ্যাখো কেউ না। কেবল বড় বড় চার্ট, ম্যাপ এবং সেকসটান, নানা রকমের বই। সব বইগুলো যেন বনি লকার থেকে নামিয়ে দেখাতে চায়, দ্যাখো কেউ কোথাও নেই। এমনকি জ্যোতির্বিজ্ঞানের সব বই, যার ভিতর বনি পর্যন্ত এই সৌরজগতের এক অসীমতার রহস্য খুঁজে পায়।

বাড়ির পুরানো পরিচারকের কাছে বনি শুনেছে, বাবার প্রথম পক্ষের মায়ের মৃত্যুর পর এটা হয়েছে। বাবা এবং প্রথম পক্ষের মার সুন্দর একটা ছবি সে বাড়ির একটা অব্যবহৃত সিন্দুকে খুঁজে পেয়েছিল। আশ্চর্য, ছবিটা এত অযত্ন সত্ত্বেও এতটুকু মলিন হয়নি। বাবার প্রথম বয়সের ছবি। কি যে রূপবান ছিলেন এবং মা আরও। সে ওটা সুন্দর করে ঝেড়ে মুছে দেয়ালে ঝুলিয়ে রেখেছিল। বাবা ছবিটা দেখে বেশি উৎসাহ পেতেন না। যেন, আর ও বয়সের মুখ দেয়ালে টানিয়ে কি হবে! তিনি স্মিত হাসতেন। মানুষ তার অহঙ্কার নিয়ে বেশি দিন বাঁচতে পারে না। এবং এ-ভাবে যখন পুরানো স্মৃতির ভেতর ডুবে যান তখনই এমন হয় অথবা কখনও অন্যমনস্ক হয়ে গেলে মনে হয় পাশ কাটিয়ে কেউ চলে গেল। কে? কে?

পরে বুঝতে পারেন, কেউ না। বুঝতে পারলেই লজ্জা পান। বিষণ্ণ হয়ে যান তারপর ভীষণ সতর্ক নজর চারপাশে। আবার কি ভাবেন। এটা কি কোন ভৌতিক ব্যাপার, ভাবেন আর পায়চারি করেন। না না এটা তা হবে কেন। তিনি যে তখন এলিসের চুলের গন্ধ পান। চুলের গন্ধটা পাশ থেকে তখনও যেন ভেসে আসছে। তাড়াতাড়ি চুপি চুপি বড় সেই হলঘরে ঢুকে চারপাশে, যেমন লকার, সিন্দুক ওয়াড্রোব খাট বাতিদান সব টেনে টেনে হাঁটু মুড়ে কখনও হামাগুড়ি দিয়ে একেবারে ছেলেমানুষের মতো হারানো খেলনা খুঁজে বেড়াবার মতো অথবা দুষ্টু বালকের ঘুড়ি কেটে গেলে যে দুঃখ, ঘুড়িটা উড়ে চলে যাচ্ছে, ধরতে না পারলে যে দুঃখ, বাবার মুখে তেমনি দুঃখ ভেসে থাকত! মুখে হাতে ধুলো ময়লা লেগে বাবাকে শিশুর মতো লাগত। বনি তখন সহ্য করতে পারত না। কি এত খুঁজছ। আমাকে বলতে পার না।

তিনি বলতে পারেন না আমি খুঁজছি, আমার হারানো স্মৃতিকে। চুপচাপ হাত পা ঝেড়ে উঠে দাঁড়ান। মার কাছে শিশুর দুষ্টুমীর কথা লুকিয়ে যাবার মতো যেন বলা, লাঠিটা যে কোথায় রাখলাম বনি!

—এই তো লাঠি।

—দ্যাখো কি আশ্চর্য, সারা ঘর খুঁজছি। অথচ একেবারে সামনে লাঠিটা। ঠিক এই লুকোচুরি যেন ছোটবাবুকে নিয়ে। যেমন বাবা সময় পেলেই বলবে, বনি, ছোট কেমন আছে?

—ভাল।

—লাগে না আর?

—না।

—কথা ঠিক ঠিক বলে?

—হ্যাঁ।

—ঠিক ঠিক যে বলে বুঝতে পার?

—বুঝতে পারি।

সিঁড়ি ধরে ওপরে উঠতে উঠতে কথা বলেন। পেছনে তাকান না তখন। নিচে দাঁড়িয়ে থাকে বনি। তিনি বলতে বলতে অদৃশ্য হয়ে যান।—ওকে বেশি কথা বলতে দেবে না। ওর মাথার আঘাত গুরুতর। ভাল হতে সময় লাগবে।

বনি আরও প্রশ্ন করতে পারে ভেবে তিনি চার্টরুমে ঢুকে গেলেন। বনি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। বাবার ওপর রাগে দুঃখে ভীষণ কান্না পাচ্ছিল। কি দরকার ছিল তবে ওকে নিয়ে আসার। সে তো এখন পাখিদের খাবার দিতে ভালবাসে, সে তো এখন আবার কাজে নেমে যেতে চায়। সবাই কাজ করছে। ওর বসে থাকতে ভাল লাগবে কেন। অথচ বাবা এমন জেনেও ওকে পুরোপুরি নিরাময় করে তুললেন না কেন। কোম্পানীর টাকা বাঁচিয়েছেন। তাড়াতাড়ি জাহাজে তুলে এনে কোম্পানীর বিষয় বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ তিনি এমন হয়তো প্রমাণ করেছেন।

বন্ধু এখন রং করছে। জাহাজের খোলে রঙ লাগাচ্ছে। খালি বলে খুব ওপরে ভেসে উঠেছে জাহাজ। বন্দরে খোলের রং করা শেষ করে উঠতে পারে নি। বাকি যেটুকু আছে ফলঞ্চা বেঁধে বন্ধু রং করছে। সে ঝুলে আছে সমুদ্রের ওপর। ওর প্রতিবিম্ব জলে ভেসে চলে যাচ্ছে। দিন বড় বলে বেশ রোদ। ঘামে সে ভিজে গেছে। ক্রমে ইকুয়েডরে চলে আসছে জাহাজ। এবং রঙ্গিন ছবির মতো চারপাশের দৃশ্য। এসময়ে ছোটবাবু বন্ধুর একটা ছবি তুলে রাখছে। জ্যাকের ক্যামেরা দিয়ে সে পরপর ছবি তুলে যেতে ভালবাসে। এবং এভাবে একটা জাহাজ অসীম সমুদ্রে জল কেটে যাচ্ছে, শুধু যখন চারপাশে থাকে নির্জনতা আর এনজিনের একটানা যাই যাই শব্দ এবং দূরে দিগন্ত রেখায় মেঘের ছায়া। তখন হয়তো একটা শুশুকের অবিরাম জলে ভেসে থাকা ভীষণ বিস্ময়ের। ছোটবাবু খুব সন্তর্পণে তাও ক্যামেরায় ধরে রাখে।

জ্যাকও এভাবে ছবি তুলতে ভালবাসে। যখন ছোটবাবু বসে থাকে চুপচাপ, যখন পাখি দুটো ওর পায়ের কাছে বসে থাকে অথবা মাথার ওপর উড়ে বেড়ায় তখন সে বোট-ডেক থেকে হাঁটু মুড়ে, জাহাজ, সমুদ্র ছোটবাবু পাখি দুটো মিলে একটা ছবি; আবার ছোটবাবু যখন বিকেলে ডেকে হেঁটে বেড়ায় তখনও ছবি এবং এভাবে অজস্র ছবি। জ্যাক যখন ফানেলের গুঁড়িতে চিপিং করতে বসে তখন ছোটবাবু ছবি তুলে রাখে জ্যাকের। জ্যাক যখন দূরবীণে সমুদ্র দেখে তখনও। ডেবিডের এভাবে অনেক ছবি উঠেছে। এভাবে ওরা কখনও বোট-ডেক থেকে, কখনও মাংকি আয়ল্যাণ্ড থেকে সমুদ্রের কখনও সমুদ্রে জেগে-ওঠা কোরাল আয়ল্যাণ্ডের যখন যেখানে ধরে রাখার মতো দৃশ্য থাকছে ক্যামেরায় ধরে রাখছে।

এখন ওদের জাহাজ উইণ্ডওয়ার্ড দ্বীপের কাছাকাছি। কিছু কিছু বর্ণময় দ্বীপের পাশ দিয়ে জাহাজ যাচ্ছে। বোধহয় এভাবে ক্যারেবিয়ান সমুদ্রে ছড়িয়ে রয়েছে অজস্র দ্বীপপুঞ্জ। কোনটার রং সোনালী, কোনটা রুপোলী, কোনটা আবার সবুজ। নানা বর্ণের ফার্ণ গাছ চারপাশে। এমন কি ওরা কোথাও সমুদ্রের বালিয়াড়িতে বড় বড় শঙ্খ, কচ্ছপের খোল দেখতে পেল। নির্জন দ্বীপে সমুদ্রের বালিয়াড়িতে কতকাল অথবা আবহমানকাল ধরে এভাবে মরা কচ্ছপের খোল শামুকের হাড় শঙ্খ মাছের কঙ্কাল পড়ে আছে। রোদে শুকুচ্ছে, বৃষ্টিতে ভিজছে। কেবল ডেবিড সময় পেলেই বসে থাকছে দূরবীণ নিয়ে। কোনো মেয়েমানুষের প্রতিবিম্ব যদি সমুদ্রের জলে ভেসে বেড়ায়।

জাহাজ পোর্ট অফ জামাইকাতে একদিনের জন্য থামবে। জল ও রসদ নিতে হবে। জ্যাক যখন এমন একটা খবর দিল তখন আবার সবার মাটিতে নেমে যাবার আকাঙ্ক্ষা।

ডেবিড তেমনি বসেছিল বোট-ডেকে। ছোটবাবু পাশে বসে আছে। ডেবিড খুব নিবিষ্ট মনে দ্বীপের ভেতর চোখ চালিয়ে দিয়েছে। এবং ওর দূরবীণে গাছপালা ক্রমে সরে যাচ্ছে। ছোট বলল, এনি ওম্যান।

—নো। সেকেণ্ড হতাশ গলায় বলল।

—আমাকে দিন, আমি দেখছি।

সেকেণ্ড বলল, তুমি খুঁজে পাবে না।

ছোট বলল, কেন?

—এত গাছপালা দেখতে দেখতে একসময় তন্ময় হয়ে যাবে। মেয়েমানুষের কথা তোমার মগজে থাকবে না।

—কাল তো সকালে বন্দর ধরছে।

—কেউ নামতে পারছে না।

কেউ নামতে পারছে না যখন, তখন আর কি করা। ভোর রাতে জাহাজ বাঁদাছাঁদা হয়েছে। আসলে এটা যেন ঠিক বন্দর নয়। কারণ ওরা আর কোন জাহাজ দেখতে পেল না। সমুদ্র পাশে ছড়িয়ে আছে। খুব দূরে শহর। একটা ফিতের মতো কাঠের সাঁকো সমুদ্রের ওপর দিয়ে জাহাজের কাছাকাছি চলে এসেছে। একটা সাদা রঙের মোটরকার সকালের দিকে কেউ কেউ দেখতে পেল সেই কাঠের সাঁকোর ওপর দিয়ে আসছে। আর কিছু নেই চারাশে। কেবল কিছু সি-গাল এবং তাদের কলরব। দূরে বালিয়াড়ি দিগন্ত-বিস্তৃত। মাঝে মাঝে লাল নীল কাঠের ঘর ইতস্তত দেখা যাচ্ছে। সামান্য হাওয়া উঠলে সেই সব লাল নীল কাঠের ঘরের চারপাশে জলের ঢেউ চলে যাচ্ছে। ছড়িয়ে পড়ছে। টাগ-বোটে রসদ আসছে। রসদ ওঠানো হচ্ছে। বাটলার হিসাব মিলিয়ে সব নিচ্ছে

তখনই এনজিন সারেঙ এসে ছোটর ফোকসালে উঁকি দিলেন। দেখলেন, ছোট নেই। কোথায় ছোট! ওপরে উঠে দেখলেন, ছোট মনু জব্বার বন্ধু সমুদ্রের জলে ছিপ ফেলে মাছ ধরছে।

—তুই এখানে! শিগগির নিচে যা।

ছোট বলল, আমি যাব না চাচা, মাছ ধরছি। নিচে যেতে ভাল লাগছে না।

সারেঙ বললেন, তোকে বাড়িয়ালা ডেকেছে। জামাকাপড় পরে বের হতে হবে।

ছোটর মুখটা সহসা সাদা হয়ে গেল। সে কিছু বলতে পারল না! ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। তাকে এ অসময়ে বাড়িয়ালা কেন ডাকবে! সে জাহাজের কাজে উপযুক্ত নয় তাকে নামিয়ে দিতে পারে এখানে। সে বলল, আমাকে কেন ডাকছে চাচা?

—জানি না।

—আমি আপনাকে বলেছি না পরিতে ঠিক কাজ করতে পারব। আপনি কিছুতেই দিলেন না, যেন সারেঙসাবই এজন্য দায়ী। সে বলল কাল থেকে কাজ করতে পারব। কাল থেকে কাজ করতে পারব বললে, নিশ্চয়ই বাড়িয়ালা এবারের মতো ক্ষমা করে দেবেন।

সারেঙ বললেন, আমি কিছু জানি না, তোকে যেতে বলেছে, যা। ভাল জামা প্যান্ট পরে যাবি। বাড়িয়ালার সঙ্গে কিনারায় যেতে হবে তোকে।

ছোট বোকার মতো তাকিয়ে থাকলে ফের সারেঙসাব বললেন, দেরি করিস না, বুড়ো মানুষ ক্ষেপে যাবে আবার। ওর কত কাজ।

ছোট কেমন এবার বেয়াড়া হয়ে গেল। সে বলল, আমি যাব না। মৈত্রদা কোথায়। আঃ আমাকে কাজ দেবে না! বললাম, সব ঠিক, আমি ভাল আছি, ঠিক পরি করতে পারব, কিন্তু বাবুদের মাথাব্যথা। না, এখন না পরে। আমাকে ঠিক নামিয়ে দেবে এবার। আপনারা, সবাই এজন্য দায়ী হবেন।

সারেঙসাব বললেন, মাথা গরম করিস না। তাড়াতাড়ি যা। কেন ডেকেছে, কেন তোকে কিনারায় নিয়ে যাচ্ছে আমি জানি না।

—সঙ্গে কিছু নিতে বলেনি!

—নারে না।

কিছুটা ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ার মতো, কারণ তাকে নেমে যেতে হলে সব নিয়ে এই যেমন, তার টিনের সুটকেস, বেডিং, পুরানো বুট জুতো এসব নিয়ে নেমে যাবার অর্ডার হত। সে বলল, আপনি যাবেন না?

—না।

—আমি ওর সঙ্গে একা যাব! ছোটর মুখ দেখে মনে হয় সে একা গেলে ভয়েই মরে যাবে। এত বড় মানুষের সঙ্গে যাবে কি করে!

সারেঙসাব বললেন, ঠিক জানি না। তুই একা যাবি, না আর কেউ সঙ্গে যাবে বুঝতে পারছি না। আমাকে কিছু কিন্তু বলেনি। সারেঙসাব আর দাঁড়ালেন না। ওঁর নামাজের সময় হয়ে গেছে। তিনি এখন সামান্য জলখাবার খেয়ে নামাজ পড়তে বসবেন। তারপর নানা রকমের কাজ। লোক এমনিতেই কম। একজন মাত্র ফালতু ছিল, সেও দুর্ঘটনার পর থেকে কিছু করতে পারছে না। ওকে কাজের সব দিক নানাভাবে সামলাতে হচ্ছে।

ছোটবাবু বের হবার মুখে দেখল, সবাই ভিড় করেছে ওর ফোকসালে। কাপ্তান ডেকে পাঠালে একটা সাংঘাতিক কিছু ঘটনা। ওরা যেন ছোটকে দেখে খুব বিষণ্ন হয়ে গেছে। কেন ডাকছে, কি ব্যাপার, নানারকম প্রশ্ন। ছোট কেবল বলছে, জানি না। সারেঙসাবও বলতে পারলেন না। সে একটা সাদা হাফ সার্ট, কালো রঙের প্যান্ট পরেছে। পায়ে সাদা কেডস্ জুতো! সে খুব সাফসোফ, এবং নীল রঙের সামান্য নরম অল্প অল্প দাঁড়ি এখন যেন আরও বেশি লাবণ্যময়। সবাই ছোটকে দেখতে দেখতে ভাবল ভারি বিড়ম্বনা ছেলেটার। ছোট রাগে এবং ক্ষোভে ভেতরে ভেতরে ফেটে পড়ছে। চোখ মুখ ভারি থমথম করছে। সে কিনারায় কেন যাচ্ছে জ্যাক বিন্দু বিসর্গ জানায় নি। সে কারো সঙ্গে একটা কথা বলল না। মৈত্রদা, অমিয়, বাদসা মিঞা, ছোটকে চিফ-কুকের গ্যালি পর্যন্ত এগিয়ে দিল। আর ভিতরে যাওয়ার সাহস তাদের নেই।

ছোট একা একা হেঁটে গেল। এলিওয়ে দিয়ে হেঁটে গেল। পাশের কেবিন বাঙালী সাহেবের। জাহাজে উঠে সে সবার চেয়ে বেশি সাহেব। যখন ছোটবাবু সবার সঙ্গে বেশ জমিয়ে নিয়েছে, তখন বাঙালী সাহেব ফিফথ-এনজিনিয়ার ওদের সবাইকে বেশি নেটিভ ভেবে নিয়েছে। তারপর ফোর্থ এবং শেষেরটায় থাকে বড়-মিস্ত্রি। সেই রাস্তাটা, যেখানে সে এক রাতে লম্বাছায়া নড়ে উঠতে দেখেছিল। এখন সবই কেমন ফাঁকা। দু’পাশে কাঠের কারুকার্য করা দেয়াল। সে ডাইনিং হলের সামনে এসেই দেখল, সিঁড়ি ধরে দু’পাটি শাদা জুতো, তারপর ক্রমে হাঁটু পর্যন্ত এবং শেষে সে বুঝতে পারল, বাড়িয়ালা নেমে আসছেন। পুরো জাহাজী পোশাকে তিনি নেমে এলেন। চারটা লম্বা সোনালী স্ট্রাইপ এবং উজ্জ্বল এত বেশি সব যে, সে কেমন বিস্ময়ে মানুষটির দিকে তাকিয়ে শুধু বলল, গুড মর্নিং স্যার।

স্যালি হিগিনস বললেন, গুড মর্নিং। তারপর তিনি আরও কাছে এগিয়ে এলে ছোটবাবু যেন কি এক আশ্চর্য আকর্ষণে হাত বাড়িয়ে দিল। ভীষণ ভয় মনে মনে, এত বড় মানুষটা তার সঙ্গে হ্যাণ্ডসেক করবেন কিনা, সে নিজের মনুষ্যত্বের কাছে কেমন যেন তা না হলে অপমানিত হবে, যেই না ভেবে সে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, কি এক সাধারণ মানুষ তিনি, স্যালি হিগিনস সত্যি হাত বাড়িয়ে ওর সঙ্গে হ্যাণ্ডসেক করলেন। আর সঙ্গে সঙ্গে ছোটর যত ভয়, যা কিছু আতঙ্ক নিমেষে উবে গেল। মানুষটা তাকে নামিয়ে দিতে চাইলে সব খুলে বলতে পারবে। বলবে, আমি ঠিক পারব। আমার কোন অসুখ নেই। আমাকে জাহাজ থেকে দয়া করে নামিয়ে দেবেন না।

স্যালি হিগিনস বললেন, এস।

সে বাড়িয়ালার পেছনে পেছনে হাঁটতে থাকল। মেজ-মালোমের কেবিনের দরজায় হিগিনস স্টিকে দুবার ধীরে ধীরে টোকা মারলেন। বললেন সেকেণ্ড জলদি।

ডেবিড ভাবতেই পারেনি এত তাড়াতাড়ি তিনি নেমে আসবেন। সে তাড়াতাড়ি মাথায় টুপি গলিয়ে বের হয়ে এল। সাদা জুতো ডেবিডের সাদা হাফ-প্যান্ট, সোনালী ব্রেড কাঁধে কলারে। ওরা দু’জন আগে আগে, সে পেছনে। গ্যাঙ-ওয়েতে ছোটবাবু আরও অবাক হয়ে গেল। জ্যাক দাঁড়িয়ে আছে। জ্যাক হাতে সোনার ব্যাণ্ড দেওয়া খুব বড় মাপের ঘড়ি পরেছে। গায়ে লতাপাতা ফুল-ফল আঁকা ঢোলা জামা, ঢোলা তসরের প্যান্ট সে পরেছে।

তিনি নামতে নামতে কেমন নিজের মানুষের মতো বললেন, দেশে কে কে আছে তোমার ছোটবাবু?

–সে সবার কথা বলল।

—তুমি কি কিছু জানিয়েছ তাদের?

ছোট ঠিক বুঝতে পারল না। সে দেখল সেই কাঠের সেতুর ওপর সাদা রঙের মোটরকার। বাড়িয়ালা তাকে প্রশ্ন করে গাড়ির ভেতরে গিয়ে বসলেন।

ডেবিড বলল, বাড়িতে জানিয়েছ, ক্রোজনেস্ট থেকে লাফাতে গিয়ে যে পড়ে গিয়েছিলে?

ছোটবাবু বলল, না।

—এতদিন হাসপাতালে ছিলে, জানাও নি?

সে বলল, না।

আশ্চর্য! তিনি আর কোন প্রশ্ন করলেন না। তিনি কি ভাবলেন, তারপর বললেন, একজন বড় ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করতে যাচ্ছি। দরকার হলে এখানে একরে নেওয়া হবে। এবার তিনি আরও ধীরে ধীরে যেন বলে যেতে থাকলেন, প্রায় গীর্জার ফাদারের মতো, ছোটবাবু তোমার মাথার খুলি সামান্য ড্যামেজ হয়েছিল। বয়স কম বলে বোধহয় তেমন ভয়ের নেই। সেরে যাবে। মাঝে মাঝে এক্সরে নিলে ঘাবড়ে যাবে না।

ছোট খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছে। মাস্টার তার মতো সামান্য মানুষের সঙ্গে সোজাসুজি কথা বলছেন! ওর মাথায় কোন জটিলতা থাকতে পারে সে বিশ্বাস করতে পারল না। এমন একজন বড় মানুষের এমন কথার পর সে মরে পর্যন্ত যেতে পারে। একটা সাদারঙের গাড়িতে তারা বসে রয়েছে। সবাই চুপচাপ, চারপাশে সমুদ্র, বালিয়াড়ি, লাল নীল কাঠের ঘর। এবং বহু দূরে শহরের সবকিছু কুয়াশার মতো অস্পষ্ট। সে কিছুই যেন দেখছিল না। বাড়িয়ালার সাদা চুল ঘাড়ের পেছনে এবং কোঁচকানো চামড়া সে শুধু দেখতে পাচ্ছে। এক পাশে জ্যাক একপাশে ডেবিড, এর চেয়ে জীবনে কি আর বেশি সৌভাগ্য থাকতে পারে সে বুঝতে পারছে না। ডেকের ওপর সবাই দাঁড়িয়ে দেখছে ওদের। সামান্য একজন কোলবয়ের এই গৌরবময় যাত্রা বোধহয় নানা কারণেই জাহাজি জীবনে বড় আনন্দের। সে হাত নাড়ল ওদের।

কাঠের সেতু পার হয়ে গেলে, সামনে পিচের রাস্তা। সমুদ্রে ঢেউ এসে মাঝে মাঝে টায়ার ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। যেন জলের সঙ্গে গাড়িটার ছলাৎ ছলাৎ খেলা চলছে। জলকণা উড়ে এসে গাড়ির ভেতর ওদের মুখ ভিজিয়ে দিচ্ছে। জ্যাক ছোটবাবুকে আড়চোখে দেখছে। ছোটবাবু পাখি দেখছে আকাশের। জলকণার জন্য মাঝে মাঝে কাচ ভীষণ ঝাপসা হয়ে উঠছে। ছোটবাবু আকাশ দেখতে পাচ্ছে না, অস্পষ্ট সমুদ্রে ছোট ছোট ঢেউ দেখতে পাচ্ছে শুধু। জ্যাক কেবল তখন দেখতে পায় তার পাশে, ছোট, ছোটবাবু। কি যে তার সুষমামণ্ডিত মুখ! সমুদ্রের মতো গভীর চোখ। দু’পাশে ঝাপসা কাচে চোখ রেখে কেবল কি যেন খুঁজে বেড়ায়। তাকে দেখে না। ছোটবাবু কি তার মতো বয়সের কাউকে ফেলে এসেছে দেশে! জ্যাক তখন ভিতরে ঝড়ের খড়কুটোর মতো ছটফট করতে থাকে। তার কিছুই ভাল লাগে না।

.

আবার পাল তুলে দেবার মতো সমুদ্রে সন্ধ্যায় জাহাজ ভেসে গেল। গভীর সমুদ্রে জাহাজ। কিনার আর দেখা যাচ্ছে না। কেবল সেই ছলাৎ ছলাৎ শব্দ জলের। এবং যেসব পাখিরা উড়ে এসেছিল পেছনে, তারা আবার ডাঙ্গায় ফিরে গেছে। ছোটবাবু আর জ্যাক দাঁড়িয়েছিল রেলিঙে। সূর্য ক্যারেবিয়ান সিতে অস্ত যাচ্ছে। চারপাশে এক নীলাভ সোনালী আভা এবং একটা পাখি পর্যন্ত আকাশে নেই। শুধু সমুদ্রে দুজনের প্রতিবিম্ব ভাসছে। কেউ কোনও কথা বলছে না।

জ্যাক একসময় আর থাকতে না পেরে বলল, ছোট তুমি কাউকে ভালোবাসো না?

ছোট বলল, হ্যাঁ।

—কে সে?

—সে আমার লিটল গার্ল। মাই লিটল্‌ ডার্লিং। মাই প্রিন্সেস।

জ্যাক কেমন গম্ভীর হয়ে গেল! সে যেন এক্ষুনি আবার পায়ে হান্টার সু পরে বের হয়ে আসবে। এবং বলবে, কিল দ্যাট বার্ড। কিন্তু জ্যাক ভীষণ দুঃখী গলায় বলল, ওর জন্য তুমি কিছু নিয়ে যাবে না। এমন কিছু আশ্চর্য জিনিস……

ছোট বলল, হ্যাঁ, নিয়েছি তো।

—কি নিলে?

—একটা কম্বল নিয়েছি। শীতে বড় কষ্ট পেত। আর পাবে না। আমি বড় হয়ে গেছি। বলেই কেমন চোখ বুজে তার সেই ছোট রাজপুত্রীর কথা ভাবতে ভাবতে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। শীতের রাতে কুপি জ্বেলে সে হয়তো গোপনে এখনও জেগে থাকে। কখন দরজায় ডাকবে, মা আমি এসেছি। দরজা খোল।

জ্যাক আর দাঁড়াল না। অভিমানে ওর চোখ ফেটে জল আসছে। সে তার কেবিনে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।

এবং রাতে, যখন জ্যোৎস্না উঠেছে সমুদ্রে তখন সবাই শুনল, খুব জোরে জোরে জ্যাক রেকর্ড বাজাচ্ছে। যেন কোন দূরবর্তী গীর্জায় কেউ ধর্মীয় সঙ্গীত পিয়ানোতে বাজিয়ে যাচ্ছে। কখনও উঁচু লয়ে, কখনও খুব নিচু লয়ে, একেবারে বৃষ্টিপাতের মতো। যেন কখনও সেই বৃষ্টিপাত, সমুদ্রে ধীরে ধীরে আবার ঝম্ ঝম্ শব্দ, আবার মিলিয়ে যাচ্ছে অনেক দূরে। বৃষ্টিপাতের অস্পষ্ট নীরবতার মতো চুপচাপ সব কিছু আবার। ছোটবাবু জানে না, জ্যাক এখন গানের সঙ্গে সুন্দর এক মিউজিক বাজিয়ে যাচ্ছে। যেন বলছে, আমি ফুটে উঠছি দ্যাখো। সে তার দু’হাত গোপনে, পৃথিবীর কেউ দেখতে পাচ্ছে না, তবু গোপনে কি যে ইচ্ছে থেকে যায়, সে দু-হাত ছড়িয়ে নিজের ছোট্ট ঘরটিতে আপনমনে নেচে যেতে থাকল। যেন নাচের মুদ্রায় শুধু এক আকাঙ্ক্ষা। লেট মি ন্যুম। আমাকে ফুটতে দাও। লেট মি ব্ল্যুম, ব্ল্যুম…… ব্ল্যুম………

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *