1 of 2

অলৌকিক জলযান – ১৪

।। চৌদ্দ।।

সকালে উঠেই মৈত্র দেখল, চব্বিশ ঘণ্টার ফ্ল্যাগ মাস্তুলে টানিয়ে দেওয়া হয়েছে। জাহাজের মাল নামানো শেষ। ড্রিফটিঙ লাইন অনেক ওপরে উঠে গেছে জাহাজের। গ্যাঙওয়েতে সিঁড়ি খাড়া। খাড়া সিঁড়িতে উঠতে ভয়। ক্রমে জাহাজ জলের ওপর ভেসে উঠলে যা হয়। মেরামতের কাজ মোটামুটি শেষ। তবু মনে হয় বয়লার চক মেরামত করে নিলে হত। জাহাজ সরফাই-এর সময় এমন একটা রিপোর্ট যেন ছিল। তারপর কি করে যে কি হয়ে যায়। মৈত্র ঠিক বোঝে না, এ-ভাবে একটা ভাঙ্গা জাহাজ নিয়ে কাপ্তান দরিয়াতে ভেসে চলেছে কি করে! এবং চারপাশে এত নিয়মকানুন থাকা সত্ত্বেও এটা হয়। বুড়ো কাপ্তানের চোখ মুখ লাল। অথচ তিনি কিছু করতে পারেন না। কোম্পানী এজেণ্ট-অফিসের মারফত এ-সব করে থাকে। কিভাবে কোথায় কি পরিমাণ টাকা দিলে, বেশি পরিমাণ টাকা বেঁচে যায়, এবং রিপোর্টে লেখা থাকে তখন, দি সিপ মে সেইল, কাপ্তান যেন ঠিক জানেন না।

সকালের দিকে ঘন কুয়াশা। কাজের ভেতর শুধু এখন এনজিন রুমে ঘুরে বেড়ানো। কোলবয়দের দিয়ে রেলিঙ, অথবা এনজিনরুমের পাটাতন ঝকঝকে করা। ঘন কুয়াশার ভেতর দিয়ে শীতের পোশাকে এখন সব জাহাজিরা যে যার কাজে চলে যাচ্ছে। মৈত্র, জানে তার টাকা পাঠানো হল না। সে সব শেষ করে ফেলেছে। সামনের বন্দরে কিছু একটা করা যায় কিনা, শেফালীকে যে সে মাসোহারা দিয়ে এসেছে, ওতে ওর চলার কথা। তবু সে যেমন মুদিখানা, ডাক্তার এবং অন্য সব মানুষদের বলে আসে, আমি যাচ্ছি, ওর যা লাগে দিয়ে যাবেন। সবাই ঠিক ঠিক দিয়ে যায়। সফর শেষে বাড়ি ফিরে এলে সে কারো এক পয়সা বাকি রাখে না। শেফালীর স্বভাব বেশি খরচ করে আরামে বেঁচে থাকা। টাকার প্রতি ওর ভীষণ মায়া কম। এবং তখন এমন একটা সময়, যে সারা সফর ঘুরে শরীরে জমে থাকে এক ভয়ঙ্কর ক্ষুধা, শেফালী যতই আরামে থাকুক, পয়সা খোলামকুচির মতো খরচ করে থাকুক, তার রাগ থাকে না। শেফালী একেবারে সবকিছু এমন ভাবে খরচ করেছে বলেই খুশি। এতটুকু অসুবিধে করে বেঁচে থাকলে মৈত্র ভীষণ কষ্ট পেত যেন। কিন্তু জাহাজে ওঠার সময় মনে মনে সে ভীষণ ক্ষেপে যায়। শেফালী এভাবে খরচ না করলে আরও কিছুদিন কিনারায় থেকে যেতে পারত।

গত রাতে সে ফেরেনি। কেন ফেরেনি, কোথায় ছিল কিছু বলছে না। সে এখন পুরোপুরি টিণ্ডাল। ছোটবাবু অমিয়কে কয়লায়ালা বাদে আর কিছু ভাবছে না।

অমিয়, ছোটবাবু জানে অথবা বুঝতে পারে বাবু কোথায় রাত কাটিয়েছে। ওরাও এ-নিয়ে কোনও কথাবার্তা বলছে না। বললেই যেন টিণ্ডাল গরম দেখাবে।

বিকেলের দিকে মৈত্র কোথাও বের হয়নি। কেবল একটু নিচে নেমে সে পায়চারি করছিল। কেউ কেউ কিনারায় আগুন জ্বেলে গরম পোহাচ্ছে। ওরা সবাই জাহাজে মেরামতের কাজ শেষ করে ফিরে যাচ্ছিল। ওদের বোসান হয়তো এখনও ফিরে আসেনি। ওরা আগুন পোহাচ্ছে। ডালপালা, গাছপাতা জড় করে আগুন জ্বেলে নিচ্ছে। মৈত্রের ভেতর কি যেন অস্থিরতা। সে বুঝতে পারে না। সে আর যেতে পারে না দূরে, সে জেটিতেই ঘুরে বেড়ায়। তার মনে হয় চারপাশে কি যেন ঘণ্টাধ্বনি, সেই যে কবে থেকে শুনে শুনে একেবারে পাগল হয়ে যাচ্ছে। সে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে, যেন সমুদ্রের নিচে কেউ ঘণ্টাধ্বনি বাজাচ্ছে। সে তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেল। সামনে আগুন জ্বলছে। ভীষণ কুয়াশার ভেতর দিয়ে সে হাঁটছে। পৃথিবীর সব কিছু এখন অন্যরকমের মনে হয়। কাছের মানুষ ছায়া ছায়া, দূরের কিছু দেখা যায় না। পর্দায় ভেসে আসা একটা মানুষ যেন তার কাছাকাছি ভেসে এল। সে বলল,

ছাঁইয়া। সে তার পাশে এসে বলল, এটা দ্যাখো। আমরা একজন মানুষকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। সে নিষ্ঠুরতার প্রতীক। সেদিন ধরা পড়েও কি করে যে পালিয়ে গেল। এটা ওর ছবি। কেমন ছায়া ছায়া হয়ে ভেসে এল মানুষটা, কুয়াশার মতো ভেসে এল, তারপর আবার মিলিয়ে গেল। মৈত্র দেখতে পেল, হাতে একটা ছবি। কুয়াশায় একেবারে স্পষ্ট নয়। সে ওপরে ওঠে ফোকসালে আলো জ্বেলে দেখল, ছবিটা যেন চেনা, খুব চেনা। নিচে একটা বড় টাকার ঘোষণা। খুব লোভের। সে ইচ্ছা করলেই ধরিয়ে দিতে পারে। হাতের কাছে এমন সুযোগ!

অথচ তার ভাল লাগছে না কিছু। ক্যাপ্টেন ফ্রক, আইখম্যান হতে পারে, আইখম্যান মৈত্র নিজে ও হতে পারে, অথবা সেই সিফিলিস আক্রান্ত মানুষটি। কেউ যেন কম যায় না। বরং ক্যাপ্টেন ফ্রক এখন একটা কুকুরের প্রাণরক্ষার্থে বনবাসে চলে গেছে। সে যেই হোক, তার আর এ নিয়ে ইচ্ছা নেই কিছু করার। সে জানে, একটু রাত হলে অথবা গভীর রাতে জাহাজে মানুষটা উঠে আসতে পারে। কিংবা কাল, কাল ওরা থাকছে না। চলে যাচ্ছে। ওর ঘুম পাচ্ছিল। সে ওপরে উঠে ফোকসালে ঢুকে গেল। বাংকে শুয়ে পড়ল। অমিয়, ছোটবাবুর সঙ্গে একটা কথাও বলল না।

রাত না পোহাতেই জাহাজ আবার চালু হয়ে গেল। এনজিনরুমে তিনটি বয়লারেই লক্ লক্ করে জ্বলে উঠল আগুন। ফায়ারম্যানদের মুখ লাল হয়ে গেল। ওপরে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা বলে এই স্টোক-হোলডে বেশ গরম এবং এক অনিবার্য সুখ। তখন ওপরে জাহাজের সামনে পেছনে বড় মালোম, মেজ মালোম। জাহাজের দড়ি দড়া সব খুলে দেওয়া হচ্ছে। নোঙর উঠে যাচ্ছে জাহাজের। মাস্তুল থেকে ফ্ল্যাগ নামানো হচ্ছে। কোয়ার্টার মাস্টার জাহাজের পেছনে ইউনিয়ান জ্যাক তুলে দিয়ে গেছে এবং এ-ভাবে ক্রমে জাহাজ জেটি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, ক্রমে প্রপেলার বেশ জোরে ঘুরছে। বন্দর পেছনে ফেলে জাহাজ আবার দূর সমুদ্রগামী হয়ে যাচ্ছে।

তখন সব জাহাজিদের ভীড় উপরে। কেউ নিচে নেই। যারা ওয়াচে নামার তারা নিচে এবং এনজিনরুমে এখন ঘড়ির কাঁটায় মাঝে মাঝে এ্যাস্টার্ণ-এ-হেড অথবা স্লো কখনও ফুল। বন্দর এলাকায় জাহাজটা এ-ভাবে পথ করে ক্রমে সমুদ্রে, গভীর সমুদ্রে নেমে গেলে মনে হয় এক রহস্যময় বন্দর ফেলে ওরা চলে যাচ্ছে। যত বাড়িঘর এবং জাহাজের মাস্তুল দূরবর্তী হয়ে যায় তত এই জাহাজিদের আপ্রাণ চুপচাপ ডেকে দাঁড়িয়ে থাকা। আসলে এই হচ্ছে জাহাজ, জাহাজের মানুষ। তারা নিরন্তর বন্দর ফেলে চলে যায়। নিরন্তর এক বন্দর ফেলে গেলেই প্রত্যাশা আবার কবে বন্দর পাবে। এবং এই বুঝি নিয়ম জাহাজি মানুষের যা চলে যায়, তার জন্য মায়াও শেষ হয়ে যায়। আবার নতুন মায়া গড়ে ওঠে, এবং স্বপ্ন নানাভাবে, বন্দর এলে কিভাবে যে তাদের দিনগুলো কেটে যায়।

ওরা আবার বন্দরের জন্য দিন গুনতে থাকে।

যেমন ছোটবাবু কয়লায় একটা একটা করে দাগ কেটে রাখে কাঠের পাটাতনে। একটা দিন গেলেই সে দাগ কেটে রাখে—এভাবে তার হিসেব ঠিক থাকে। আবার কখনও ক্যালেণ্ডারের পাতায় কেউ দাগ কাটছে। জ্যাক এভাবে তার দিনের হিসেব রাখে। এবং সে বুঝতে পারে এই জাহাজে প্রায় চার মাসের ওপর তার সময় পার হয়ে গেল। সে যে বয়সে ছিল এখন যেন ঠিক সেই বয়সে নেই এবং স্নান করার সময় সে কি সব টের পায়, আশ্চর্য নরম এক রঙের বৃত্তের মতো বুকের দু’পাশে তার বয়স ক্রমে সজীব হয়ে উঠছে। সে নানাভাবে এইসব সজীবতা থেকে আত্মরক্ষা করতে চেষ্টা করছে। তখনই কেন যে শৈশবের স্বপ্নের মতো এক সুন্দর মুখ তার চারপাশে খেলা করে বেড়ায়। নিজের হাতে তৈরি সে ব্র্যাসিয়ারের ভেতর রুমাল গুঁজে দেয়। এক দুই তিন। এখন ঠিক সে তিনটে রুমাল পর পর ভাঁজ না করে দিলে বুক অসমান থেকে যায়। সে ধরা পড়ে যাবে। অথচ তার মুখে কষ্টের ছাপ। এই ভাঁজ করা রুমাল মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় ছুঁড়ে ফেলে দিতে। সে যেন পারলে ডেক ধরে ছুটে যেতে চায়। এবং বলার আকাঙ্ক্ষা, হে মানুষেরা, আমি মেয়ে। মি গার্ল এবং তখন সত্যি গভীর সমুদ্রে শুধু নক্ষত্রেরা জেগে থাকে এবং দূরে হয়তো কোথাও তিমি মাছের ঝাঁক, জ্যোৎস্না ওদের পিঠে পিছলে যাচ্ছে—কি যে মনোহারিণী এই সমুদ্র! জ্যাক একা ডেকে দাঁড়িয়ে থাকলে এটা টের পায়।

সে এই বিষণ্নতায় বেশি সময় ডুবে থাকতে পারে না। ছোটবাবুর বোধ হয় পরি শেষ। সে ঘড়ি দেখলেই বুঝতে পারে এই ঠিক সময়, এখন ছোটবাবু সিঁড়ি ধরে ওপরে বোট-ডেকে উঠে আসবে। তখন তাঁর ইচ্ছে হয়, লুকোচুরি খেলা, মহামহিম এই ঈশ্বরের জগতে তার, নীরবে কোথাও আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে হয়। ছোটবাবুকে সে ভয় পাইয়ে দিতে পারলে মজা পায়। হয়তো ছোটবাবু ফানেলের গুঁড়ি ধরে ওঠে আসছে তখনও। বনির কি যে কৌতূহল! সে জালিতে মুখ রেখে দেখতে থাকে, উঠে আসছে, উঠে আসছে ছোটবাবু, ছোটবাবু মাথা নিচু করে রেখেছে। ওকে দেখতে পাচ্ছে না। ঠিক ফানেলের পাশ কাটিয়ে যেই না যাওয়া হঠাৎ চিৎকার, হেই। ছোটবাবু বুঝতে পারে জ্যাক। সে ভয় না পেলে জ্যাক আনন্দ পায় না। তখন ছোটবাবু আর কি করে। কেমন ভয়ের অভিনয় করে বলতে থাকে, জ্যাক তুমি! ওঃ কি না ভয় পেয়েছিলাম।

আবার সমুদ্রে সূর্য অস্ত যায়। পিছিল আর আগিল থেকে ফ্ল্যাগ জড় করে ব্রীজে উঠে যায় কোয়ার্টার মাস্টার। রেডিও অফিসার মাংকি-আয়ল্যাণ্ডে দূরবর্তী স্টেশনের খবরের আশায় থাকে। সাদা ফুলশার্ট কালো প্যান্ট পরে জ্যাক একাকী রেলিঙে। চড়ুই পাখি দুটো ওর মাথার ওপর। সমুদ্রে এতটুকু ঢেউ নেই। জলে একটা ফুটকিরি উঠলে পর্যন্ত টের পাওয়া যাচ্ছে। ফ্লাইং ফিসেরা উড়ে উড়ে অদৃশ্য হচ্ছে যখন, অথবা জলে প্রপেলারের ভাঙ্গা শব্দ, অতিকায় জলে ভাঙ্গা ভাঙ্গা শব্দ শুনলে মাছেরা ভয় পেয়ে যেতে পারে। জ্যাক তখনও দাঁড়িয়ে থাকে, ছোটবাবু হয়তো পাখি দুটোর টানে চলে আসবে। কারণ সে তো ইচ্ছে করলেই ছোটবাবুরা যে-দিকটায় থাকে যেতে পারে না। এদের জন্য জাহাজের পেছনটা। তাও ছোটবাবুরা থাকে ডেকের নিচে সিঁড়ি ধরে নেমে গেলে, বেশ অনেক নিচে, অর্থাৎ জাহাজ যখন ত্রিশ-বত্রিশ ড্রাফটে চলে তখন ছোটবাবুদের কেবিন প্রায় জলের নিচে থাকে। ছোটবাবুর কি যে মজা! তার পোর্ট-হোলে কেবল নীল জল চলে যাচ্ছে, চলে যাচ্ছে নীল জল, সমুদ্রের নীল জল ক্রমাগত ওর পোর্ট-হোলের কাচের ওপরে ভেসে যাচ্ছে। জ্যাক শরীরে আশ্চর্য ঘ্রাণ মেখে এভাবে কখনও কখনও ছোটবাবুর জন্য বোট-ডেকে অপেক্ষা করতে ভালবাসে তখন বড়-মিস্ত্রি কেবিনের দরজা বন্ধ করে পৃথিবীর সব বই যেমন যাবতীয় ঘোস্টস্টোরির ভেতর ডুবে থাকে। সে দরজা খোলে না। ডিনারে খেতে যায় না। তার খাবার তার ঘরে দিয়ে যেতে হয়।

কি যে একটা ভয় বড়-মিস্ত্রির। আগে তবু কখনও কখনও কেবিনের বাইরে বের হতেন। আফ্রিকার বন্দর পার হবার পর থেকে তাও নেই। একদিন কেবল ছোটবাবু দেখেছে, বড়-মিস্ত্রি প্রায় ছুটে এক পায়ে, রেলিঙে দু-হাতে ঝুলে অনেকটা গ্লাইড করে দ্রুত নেমে যাবার মতো, তখন মেজ-মিস্ত্রি ভীষণ হতবাক, চিফ নেমে আসছে। মেজ-মিস্ত্রি দ্রুত ছুটে তাঁর সামনে দাঁড়ালে একটা কথা না। চুপচাপ পকেট থেকে টর্চ বের করে হেঁটে গেছিলেন তারপর টর্চ মেরে ব্যালেস্ট পাম্পের গোড়ায় যে একটা নাট লুজ হয়ে গেছে, এবং এত শব্দের ভেতরও সেই লুজনাটের শব্দ কিভাবে যে তাঁর কানে পৌঁছেছিল তা ভেবে ছোটবাবু একেবারে মনমরা। এতদিনের একটা আপশোস, লোকটার কাজকর্ম নেই, কেবল কেবিনের দরজা বন্ধ করে সারাদিন আহার মদ্যপান বই পড়া, দাবা খেলা, পৃথিবীতে আর কিছু আছে তিনি যেন জানেন না এবং এনজিনের শব্দ ছন্দের মতো বোধ হয় তাঁর কানে বাজে। একটু বেসুরো হলেই টের পান, কোথায় কি গণ্ডগোল! এবং খবরটা মৈত্রকে দিলে বলেছিল, শালা সঙ্গীতজ্ঞ। সেই থেকে কেন জানি ছোটবাবু বড়-মিস্ত্রিকে বড় সঙ্গীতজ্ঞ বাদে কিছু ভাবতে পারে না।

সঙ্গীতজ্ঞ সায়েবটিকে এক রাতে সে দেখেছে বুয়েন-এয়ার্স বন্দরে, চুপি চুপি বের হয়ে যাচ্ছেন। মাথার টাক এত বড় যে পূর্ণিমার চাঁদের মতো বিশাল মনে হয়েছিল, ক্রাচের চেয়ে দু-হাতের ওপর যেন বেশি উনি নির্ভরশীল। বেঁটেখাটো মানুষ, গোল মতো অথচ হাঁটা দেখলে মনে হবে ভীষণ ফিট- বড়ি। সারাদিন বসে বসে এমন ফিট বডি রাখে কি করে! কতবার ভেবেছে, এনজিনরুম থেকে উঠে যাবার সময় একবার পোর্ট-হোলে যা আছে কপালে, দেখবে—কি করছেন তিনি। এবং একবার সে যা দেখেছিল বিশ্বাসই হয় নি, সাহেব মানুষের এ-সব কি আবার। এবং সে দেখেছিল বড়-মিস্ত্রি চোখ বুজে যোগাসন করছেন।

এ-সব কথা অবশ্য দু-কান করা চলে না। সে কেবল তার মৈত্রদাকে বলেছিল। তখন মৈত্ৰদা আবার মৈত্রদা হয়ে গেছে। আর গরম নেই। সে বলেছিল, ছোটবাবু, তুমি শেষ পর্যন্ত জাহাজে একটা কেলেঙ্কারি করবে।

সে ভেবে পাচ্ছিল না, কি কেলেঙ্কারি সে করতে যাচ্ছে!

মৈত্র বলেছিল, তোমার ওদিকে যাবার কথা না।

ছোটবাবু বলেছিল, কেন

—কোনদিন ধমক খাবে। সারেঙকে ডেকে বলবে, তোমারা আদমি ইধার কিউ ঘুমতা। অবশ্য ছোটবাবু পোর্ট-হালে উঁকি দিয়ে দেখেনি। আসলে দেখতে সাহস পায় নি। হলে কি হবে কৌতূহল মানুষকে ভীষণ বিপদে ফেলে দেয় কখনও কখনও। ছোটবাবুর বেলায়ও তাই। তখন সকালবেলা। রেডিও অফিসার এরিয়া স্টেশনকে বলে যাচ্ছে—জাহাজের নাম, যেমন প্রতিদিন সকালে করতে হয়, রেডিও-অফিসার সকালের ডিউটিতে যা যা করে থাকে, প্রতিদিন, ইয়েস এস এস সিউল ব্যাঙ্ক অথবা এক কথায় ডেনসিঙ গার্ল অর্থাৎ কি নাম জাহাজের, কোন কোম্পানীর জাহাজ, এসব বলতে হয় না। ডেনসিঙ গার্ল বললেই যেন বলে দেওয়া হয় এটা ব্যাঙ্ক লাইন কোম্পানী, ২১, বারি স্ট্রীট, লণ্ডনের একটি ভাঙ্গা জাহাজ—আর কিছু বলার দরকার হয় না। তারপর কোর্স-লে, নেকস্ট পোর্ট অফ কল, জাহাজের এন আর টি, জি আর টি, এরিয়া স্টেশনকে জানিয়ে দেওয়া এবং বোধ হয় জায়গাটা ছিল চোয়াল্লিশ পয়েণ্ট তিন ওয়েস্ট লঙ্গিচুড এবং বত্রিশ পয়েন্ট আট সাউথ ল্যাটিচুড।

সমুদ্র শান্ত ছিল। জাহাজ খালি বলে তবু সামান্য পিচিঙ ছিল জাহাজে। শীত ছিল না। বরং কিছুটা গরমকালের মতো ব্যাপার! তবে সকালের সমুদ্র এমনিতেই ঠাণ্ডা থাকে। সামান্য ঠাণ্ডা হাওয়া সে-জন্য জাহাজের দড়িদড়া কাঁপিয়ে আমাজন নদীর মোহনায় অথবা গভীর বনাঞ্চলে চলে যাচ্ছে। জাহাজের গতি কিছুটা উত্তর পূর্বমুখী ছিল।

ঘোস্ট-স্টোরি যাদের পড়ার বাতিক, তাদের একটা বিশ্বাস জন্মে যায়, ভূতেরা সর্বত্রই থাকে। এমন কি এই যে এখন জাহাজ গভীর সমুদ্রে, এখানেও ভূত অনায়াসে চলে আসতে পারে! অথবা এইসব জাহাজে, এত দীর্ঘদিনের জাহাজ যখন, যদি ধরা যায় এটা এক সময়ে যুদ্ধজাহাজই ছিল, তবে অসংখ্য মৃত্যু এই জাহাজে ঘটেছে। যাত্রীজাহাজ হলেও রেহাই নেই। ক্রুদের সমুদ্রে আত্মাহুতি তো লেগেই থাকে। সুতরাং যেমন মাছ বাদে জলাশয় হয় না, ভূত বাদে জাহাজ হয় না। আর এই যেন জাহাজ, জাহাজে কতদিন ধরে সব মরা গরু, ছাগল, শুয়োর বরফ ঘরে ঝুলে থাকে। এদেরও প্রাণ থাকে। একবার নর্দানসায়ারে তো একটা গাধা নিয়ে হৈ চৈ। গাধাটা থাকত চার্চের মাঠে। নানারকম পপলার গাছের ছায়ায় গাধাটা ঘুরে বেড়াতো। বে-ওয়ারিশ গাধা—কার গাধা কেউ জানে না। সবাই কখনও না কখনও ওটাকে দেখেছে গীর্জার মাঠে। জ্যোৎস্নায় বেশি দেখা গেছে। এটা যে কেবল ছেলেপুলেরাই দেখে থাকে তাই শুধু নয়, এটা আবাল-বৃদ্ধ-বনিতারা দেখেছে। এটা যে শুধু এ-সময়কার লোকেরাই দেখেছে তা নয়, গত শতাব্দীর লোকেরাও দেখেছে। গাধাটা সেণ্ট জনের গাধা। না দেখে উপায় নেই। কেলেঙ্কারি সেদিনই ঘটে গেল, কার আলু খেত খেয়ে শেষ করে দিচ্ছিল, মালিক তো তেড়ে মারতে যায়—ওমা গাধা হাওয়ায় বিলীন। এবং লোকজন সব চেঁচামেচিতে বের হয়ে এলে ক্ষেতের মালিক অবাক তার একবিন্দু শস্য নষ্ট হয় নি। এসব ঘটনা বড়-মিস্ত্রি হামেশাই শুনে আসছে। অথবা এ্যাশ-ট্রির সেই উইচ মাদারস্টোলের হত্যার হুকুম এবং এ-সব কারণে ভূতেরা অনেক সময় প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে থাকে।

বড়-মিস্ত্রির কি হয়েছে কে জানে আর কেবিন থেকে বের হন না। দরজা বন্ধ করে বসে থাকেন সারাদিন। পোর্ট-হোল খোলা থাকে কেবল! এনজিনের গণ্ডগোল হলে কেবল এনজিনরুমে হপ্তাহে দু হপ্তাহে মুহূর্তের জন্য দেখা যায়। ছোটবাবু এ-হেন বড়-মিস্ত্রির কেবিনের পাশ দিয়ে যাবার সময় একটা কেলেঙ্কারি করে ফেলেছিল আর কি!

ছোটবাবু ভেবেছিল কিছুতেই সে ওদিকে যাবে না। তবু কি যে আকর্ষণ থাকে। রাত্রে আজকাল অমিয় আপেল ডিম কোথা থেকে নিয়ে আসে। আপেল এবং ডিম ঠিক তিনজন মিলে সমানভাগে খায়। ধারণা ছিল ছোটবাবুর যে, এটা অমিয় স্টুয়ার্ডের কাছ থেকে চেয়ে নিচ্ছে। সুতরাং রহস্য তার জানার কথা না। দুপুররাতে সে যখন ওয়াচ শেষ করে উঠে আসছে তখন কি কপাল, কে বলবে, সোজা স্টোক-হোলডের সিঁড়ি ধরে না উঠে সে এনজিন-রুমের সিঁড়ি ভেঙ্গে ওপরে উঠে যাচ্ছে। এ-পথ ধরে সাধারণত ক্রুদের ওঠার নিয়ম নেই। সে, পথ সংক্ষেপ করার জন্য আগে মাঝে মাঝে উঠে যেত। সে-রাতে ওঠার মুখে দেখল, সামনের রাস্তা ব্লক করা। দরজা লক করে দেওয়া হয়েছে। আবার এনজিনরুমে নেমে বয়লাররুম পার হয়ে সিঁড়ি ধরতে হবে। অনেকটা পথ। ডাইনিঙ হলের পাশ দিয়ে একটা গুপ্তপথ আছে। সে ভাবল ওটা দিয়ে স্টাবোর্ডসাইডে নেমে যাবে। অন্ধকারে পথটা অস্পষ্ট। অমিয় সবসময়ই আজকাল একটু দেরি করে উঠে আসে বাঙ্কার থেকে। বোধহয় স্টুয়ার্ডের কাছ থেকে ডিম এবং আপেল চেয়ে নিতে দেরি হয়, অথবা কি অমিয়, গোপনে স্টোররুম থেকে চুরি করে থাকে। ও যা মানুষ সব পারে। জাহাজের একঘেয়েমী খাওয়া সহ্য হয় না। এ-জন্য অমিয়র এমন একটা দুর্ধর্ষ কাজ ওরা মনে মনে তারিফ করে থাকে। ওরা প্রশ্ন করলে, অমিয় ক্ষেপে যায়।

তবে মুসকিল হচ্ছে ডাইনিং হলের ও-পাশের গুপ্তপথের লাগোয়া কেবিনে থাকে সেই বড় মিস্ত্রি। যাকে সে একদিন দেখেছিল শীর্ষাসনে আপেল খাচ্ছে। এখন হয়ত গেলে দেখতে পাবে বই পড়ছে। ওর ধারণা এসব লোকেরা কখনও ঘুমায় না। সারাক্ষণ জেগে থাকে। নাহলে সব এনজিনিয়াররা বড়-মিস্ত্রিকে দেখে ভয় পায় কেন। এনজিনের কোথায় কি গণ্ডগোল মানুষটা যা জানে, আর কেউ তেমন জানে না। অথবা ও বোধহয় জানে, কত তারিখে, কোন সময়ে এনজিনের কোন অংশে ব্রেক- ডাউন হবে। না হলে সঙ্গে সঙ্গে টের পায় কি করে! কি সকালে, কি বিকেলে, কি মধ্যযামিনীতে এ-পর্যন্ত যতবার ছোটবাবু দেখেছে, অবশ্য খুব কমই দেখেছে, কিন্তু সময়ের কোন ঠিক নেই। ওর কেবিনটা ঠিক এনজিনরুমের পাশে। এমন গোলযোগে থেকে থেকে, সারাক্ষণ থেকে থেকে—এই তো জাহাজ যতদিন চলবে, বিশ বাইশ মাস নাগাড়ে, চব্বিশ ঘণ্টা কেবল অতিকায় ঝ্যাকোর ঝ্যাকোর শব্দ। এভাবে একজন সারাক্ষণ শব্দ শুনতে শুনতে—কারণ সে তো দেখেছে এনজিনে এমন শব্দ যে, চিৎকার করে কথা না বললে শোনা যায় না। বেশির ভাগ সময় হাতের ইশারায় কথা বলতে হয়। চার ঘণ্টা ওয়াচ শেষ করে যখন উঠে যায় এনজিনিয়াররা তখন ওদের মানুষ বলে মনে হয় না। শব্দেই হয়তো মাথা ধরে যায়। অথবা মাথার ভেতরে শিরা-উপশিরা যা কিছু থাকে তার নাটবল্টু আম্মা হতে কতক্ষণ।

ছোটবাবু এতসব ভাববার সময় পায় নি। সে এতরাতে এই জায়গায় এসে ফিরেও যেতে পারছে না! কারণ এতক্ষণে হয়তো মেজ-মিস্ত্রি নিচে নেমে গেছে। যে-করেই হোক তাকে এলিওয়ে ধরে আরও কিছুটা এগিয়ে যেতে হবে এবং গুপ্তপথটা আবিষ্কার করতে হবে। খুব একটা পরিচিত নয় পথটা। কেবল একদিন এদিকটায় সে জ্যাকের সঙ্গে এসেছিল। এখানে কেবিনের পাশে পাশে ঘুরে ঘুরে নিচে ওপরে পথ নেমে গেছে। কেবিনগুলো দেখতে সব একরকমের। বোট-ডেকে উঠে যেতে পারলে হত। পাশেই কোথাও একটা সিঁড়ি আছে। কিন্তু সে একটু এগিয়ে অন্ধকারের ভেতর পড়ে গেল। কেউ এখন এদিকটায় জেগে নেই। কেবল একটা ছায়ার মতো দেয়ালের পাশে কেউ অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে যেন! বোধহয় এগুলো কাপ্তান-বয়, মেসরুম-বয়ের কেবিন। যাই হোক খুব তাড়াতাড়ি সে আবছা আলো অন্ধকারে দেখতে পেল অস্পষ্ট এক ছায়ার মতো, কেউ দাঁড়িয়ে আছে। এবং এমন একটা অন্ধকার এলিওয়ো তো কোন বাতি না থাকলে যা হয় কেবল এনজিনের ভৌতিক একটা শব্দে, ওর মাথা কেমন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে অথচ সে সামনের সরুপথটা ধরে না গেলে জাহাজের স্টাবোর্ড-সাইডে পড়তে পারবে না। সেই ছায়াটা ক্রমে লম্বা হয়ে যেতে থাকল। আর ওর চোখ- মুখ শুকনো, ভৌতিক ব্যাপারটা একেবারে মিথ্যা নয়, সে দেখল সেই ছায়া ক্রমে লম্বা হতে হতে ওর পায়ের কাছে নেমে এসেছে এবং সে তখনই চিৎকার করে উঠবে ভাবল, আর মুখে কেউ তখন হাত চাপা দিয়ে প্রায় টানতে টানতে যখন স্টাবোর্ড-সাইডে নিয়ে গেল, তখন সে একেবারে অবাক, অমিয়। অমিয় সামনে দাঁড়িয়ে।

অমিয় বলল, ওদিকে কেন গেছিলি!

ছোটবাবু কিছু বলতে পারল না।

—ও-রাস্তাাটা ভাল না। শালা সঙ্গীতজ্ঞ ভূতটুতের ব্যবসা করে।

ছোটবাবু বলল, সত্যি!

—সত্যি! কেউ যায় না।

—কেন যায় না!

—মাঝে মাঝে একটা লম্বা ছায়া দাঁড়িয়ে থাকে।

ছোটবাবুর গা ছম ছম করতে থাকল। দুপুর রাতে এমনিতে জাহাজ ভীষণ ভয়াবহ। অনেকে একা তখন ওপরে উঠতে ভয় পায়। চারপাশে সমুদ্র। কিছু দেখা যাচ্ছে না। অন্ধকারে শুধু কিছু নক্ষত্র। এবং কোনো কেবিনে অথবা ফোকসালে আলো জ্বালা নেই। কেবল ডেকের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে বড় বড় দুটো মাস্তুল। মাস্তুলের দু’পাশে দুটো আলো আর উইংসে আলো। এমন একটা ভয়াবহ ঘটনার সম্মুখীন হয়ে ছোটবাবু জাহাজটা যে সত্যি ভূতুড়ে বিশ্বাস না করে পারল না। এবং সে দেখল অমিয়র হাতে একটা আপেল দুটো ডিম। ছোটবাবু বলল, কোথায় পাস তুই এ-সব। এত রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন কোথা থেকে সব সংগ্রহ করিস!

অমিয় বলল, এত সব জানবার তোমার কথা না! ভাগের ভাগ খাবে। কোন প্রশ্ন নয়।

তারপর ছোটবাবু দেখল অমিয় জামার নিচ থেকে এক টুকরো চকচকে কি বের করছে। ওরা তখন ডেকের ওপর দিয়ে হাঁটছিল। অমিয়র কি যে বাতিক দিন দিন হচ্ছে, লকারটা সে কিছুতেই খুলছে না। যখন সাফাই দেখতে বের হন কাপ্তান তখন তিনি দু-একবার এই লকার বন্ধ করে রাখার রহস্য জানতে চেয়েছেন। অমিয় বলছে, সে চাবি হারিয়েছে। তা তিন-চার মাস হয়ে গেলে সন্দেহের কারণ দেখা দিতে পারে। এভাবে যে অমিয় কি গোপন করছে ছোটবাবু বুঝতে পারছে না। অবশ্য লকার খুলে মাঝে মাঝে অমিয় যে না দেখেছে তাও নয়। অমিয় বয়লার রুমে কয়লা পুড়ে গেলে তার ভেতর থেকে উজ্জ্বল সব ভারি ধাতুপিণ্ড সংগ্রহ করছে। ওর ধারণা যে কি! দেখতে মূল্যবান, কিন্তু এ-সব এত সহজে যদি মিলে যায় তবে, কোলবয় হয়ে পৃথিবীর সবাই গোল্ড-রাশে নেমে যেত। ছোটবাবু এবং মৈত্র এ-নিয়ে রসিকতা করেছে, কিন্তু মনে মনে কষ্ট পাবে ভেবে, চাবিটা পাওয়া যে ঠিকই যাচ্ছে না এমন সমর্থন জানিয়ে এসেছে। আসলে গোটা লকারটাতে সে রেখেছে সব পোড়া কয়লা থেকে কাল্পনিক অমূল্য সব ধাতু। সে এ-ভাবে একদিন ঠিক বড়লোক হয়ে যাবে। স্বপ্নে প্রায় রাজা হবার মতো। এবং ছোটবাবু দেখল আজও অমিয় কিছু সংগ্রহ করে এনেছে। দেখলে সত্যি অমিয়র জন্যে মায়া হয়। অমিয় যেন এ-জন্যই ছোটকে এত তোষামোদ করে থাকে। আপেল খাওয়ায়, ডিম এনে খাওয়ায়। এদের রেশনে যা নেই তা জীবন বাজী রেখে সংগ্রহ করে আনছে।

ছোটবাবু আর কোন প্রশ্ন করল না। কেবল বলল, ঠিক আছে, আর ওদিকটাতে যাব না। সকালে ঘুম থেকে উঠলে ছোটবাবুর মনে হল ওপরে কেউ নাচছে। এবং ঢোল বাজাবার মতো টব বাজাচ্ছে কেউ। সুর ধরে কেউ গাইছে। সারেঙ দুবার খোঁজ নিয়ে গেছে ছোটবাবুর! ছোট তখনও ঘুমোচ্ছিল বলে ডাকে নি। ওপরে উঠে সে তাজ্জব। অনিমেষ মজুমদার একটা স্লিপিঙ-গাউন পরে মেয়ে সেজেছে। চুলে খোঁপা বেঁধেছে গামছা দিয়ে। আজ রবিবার। ছোটবাবুদের সমুদ্রে রবিবার শনিবার বলে কিছু নেই। ডেক-জাহাজিদের আছে।

ডেক-ক্রুরা আয়াসে চলাফেরা করছে। তাড়াহুড়ো নেই। মেসরুমে ভীড়। বাথরুম থেকে ছোটবাবু বুঝতে পারল অমিয় টপ্পা গাইছে। এ-সব টপ্পা শোনা যায় না। অফিসারের নামে অশ্লীল পদ্য এবং সমে অমিয়, ছোটবাবু ভূত দেখেছে বলে শেষ করছে।

অমিয় বেশ মিলিয়ে টপ্পা তৈরি করতে পারে। ছোটবাবু উঁকি দিলে দেখল, অমিয় বসে রয়েছে, পায়ের নিচে রঙের টব। জানালা দরজায় সব ক্রুদের মুখ। যারা বয়সে বুড়ো এদিকটায় আসছে না। গনি, ছোট টিণ্ডাল, বাদশা মিঞা নামাজ পড়তে এসে ফিরে গেছে। বেশ ময়ফেল জমেছে এবং রঙের টবে ঢোলের শব্দ আর পায়ের ঘুঙুর বেঁধে পুরানো এক স্লিপিং-গাউন মেমসাবের পরে ঘুরে ঘুরে মাথায় হাত তুলে পেছনে হাত রেখে অনিমেষ মজুমদার নাচছে। কেউ ওকে জড়িয়ে ধরে কামড়ে দিতে চাইছে। কেউ ওর হাত ধরে চুমু খাচ্ছে এবং পয়সা দিচ্ছে। সে তারপর ঘুরে ঘুরে ডেকে নেচে বেড়াল। এবং চারপাশে এই যে সমুদ্র, জাহাজ দিনরাত ভেসে চলেছে, তার ওপর অনিমেষ এ-ভাবে একটা মেয়ে সেজে তামাসা দেখাল, কে কত দেবে ঠিক হল। তার বিনিময়ে কেউ ঠেলে ঠেলে নিয়ে গেল ফোকসালে, নাও, এবারে লিখে নাও, বন্দরে এলে অনিমেষকে এ-টাকাটা দিতে হবে। একসঙ্গে যা টাকা জমবে, তা দিয়ে উৎসবের মতো জাহাজে, একেবারে কিনার থেকে তাজা মুরগি কিনে আনবে সারেঙ, তারপর পিকনিকের মতো ব্যাপার। অনিমেষ সং সেজে টাকা তুলে দিচ্ছে ডেক-সারেঙকে।

আসলে এই সং সাজার ভেতর অনিমেষ কেমন আনন্দ পায়। সে আবিষ্কার করেছিল, ডেক- টিণ্ডাল বুনোসাইরিসের পুরানো বাজার থেকে বিবির জন্য একটা সেকেণ্ড-হ্যাণ্ড স্লিপিং-গাউন কিনে এনেছে। সবাই যা আনে বাজার থেকে, পাশাপাশি সবাইকে খুলে দেখায়। কিন্তু ডেক-টিণ্ডাল অন্য রকমের। সে গোপনে তুলে রাখার সময় ধরা পড়েছিল। অনিমেষ তারপর বেশ সং সেজে ফেলল রাতে। রাত নটায় সে ঘুরেছে মেয়ে সেজে। সকালেও মেসরুমে মেয়ে সেজে বেশ পয়সা কামিয়ে বেড়িয়েছে। কিন্তু ছোটবাবু ভূত দেখেছে এটাই ছিল বার বার এক কথা। ছোটবাবুকে সারেঙ ডেকে সাবধান করে দিয়েছেন, তোকে ছোট কত করে বলব, তুই যে কেন একা উঠে আসিস! এবং সারেঙ যেন ছোটকে কি বলতে গিয়েও বলতে পারেন না। কেবল একসময় না বললেও যেন নয়, এমন ভেবে মুখ কাছে এনে বললেন, জাহাজে কত সব অদ্ভূত ঘটনা ঘটে। তুই সবচেয়ে কম বয়সের জাহাজি। কখন কি ঘটবে বলা যায় না। রাত বারোটায় কে তোকে একা একা এনজিন রুম থেকে উঠে আসতে বলেছে। মৈত্র মশাই কোথায় থাকে! জব্বার, অমিয়? তুই একা একা আসবি না। দুপুররাতে কেউ জাহাজে একা ঘুরে বেড়ায় না।

ছোটবাবুর খুবই বিশ্বাস সারেঙকে। তিনি তাকে হাতে ধরে জাহাজে নিয়ে এসেছেন। ওদের এখন ওয়াচের সময় হয়ে যাচ্ছে। জাহাজ কেমন নিরিবিলি যাচ্ছে। রোদ গ্যালিতে এসে পড়েছে। যত বেলা বাড়বে রোদ গ্যালি থেকে সরে যাবে। এবং কেউ কেউ রেলিঙের ধারে বেঞ্চিতে বসে সমুদ্র দেখছে, চর্বিভাজা রুটি খাচ্ছে। এবং ভূত নিয়ে ক্রুদের ভেতর কথাবার্তা। কোন কোন জাহাজে ভূতের উপদ্রব সত্যি ছিল ক্রমে তাও কথায় কথায় চলে আসছে। এবং একবার যে একটা জাহাজ-ভূত ছিল সাউথ-সিতে তার গল্প। এখন তো শোনা যাচ্ছে সে রাস্তায় আর কেউ জাহাজ চার্টার করে না। কোর্স- লে পাল্টে দিয়েছে। ছোটবাবু সারেঙের কথাবার্তা শুনে বুঝেছে, মধ্যরাতে একা ওর সত্যি ঘুরে বেড়ানো ঠিক না। গতকালের ঘটনার পেছনে সে কোনো কার্য-কারণ খুঁজে পাচ্ছে না। অথচ চোখের ওপর ঘটনাটা দেখেছে। এবং হতবাক হয়ে গেছে।

তখন কাপ্তান ফল আর এক-কাপ কফি খাচ্ছিলেন। তখন জ্যাক নিজের কেবিনে ফল, দু স্লাইস স্যাণ্ড-উইচ এবং কফি খাচ্ছে। জ্যাকের পায়ের কাছে পাখি দুটো। জ্যাক আজ কাজে বের হয় নি। দেরি করে ঘুম থেকে উঠেছে। রাত হলে, যখন সত্যি গভীর রাত হয়, এবং ডগ-ওয়াচের ঘণ্টায় ওর ঘুম ভেঙ্গে যায়, তখন নিভৃতে খুব দামী দামী স্কার্ট এবং সুন্দর সব গাউন পরে নিভৃতে বসে থাকে। আয়নায় প্রতিবিম্ব ভাসে। চুল আরও বড় হলে ওর মুখ আরও সুন্দর দেখাত। যা আছে তাই দিয়ে চুলটাকে পেছনের দিকে সামান্য ফাঁপিয়ে রাখে। এবং হাত দিয়ে, দু-হাত দিয়ে চুলের চারপাশটা চেপে চেপে সে তার মায়ের মতো দু-পাশে দুটো ক্লিপ এঁটে দেয়। তারপর দু-হাত দু-দিকে ডানার মতো মেলে দেয়, উঠে দাঁড়ায়। রেকর্ডপ্লেয়ারে সুন্দর রিন-রিন্ করে বাজনা বাজে, কখনও স্লোভাক লোকসঙ্গীত অথবা এক অবিরাম সঙ্গীতের মতো যেন কোন গীর্জায় কেউ ঝম্ ঝম্ করে পিয়ানোর রিডে হাত চালাচ্ছে। সে নিজের মতো কোনও ব্যালেগার্লের ছবি শরীরে ফুটিয়ে ধীরে ধীরে একা একা নাচে। একা একা সে টো-এর ওপর ঘুরতে ঘুরতে কোনও দূরবর্তী সরোবরের নীলপদ্ম হয়ে যায়। ওর শরীরে থাকে তখন আশ্চর্য ঘ্রাণ। রাত বারোটায়, জাহাজে সবাই যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন সারা জাহাজে এক মূল্যবান সুগন্ধি ছড়িয়ে যায়। কেবিনে কেবিনে, ফোকসালে ফোকসালে গন্ধটা ভেসে বেড়ালে শরীরে আকাঙ্ক্ষা জন্মে। সমুদ্র আর ভাল লাগে না। কবে যে জাহাজ আবার বন্দর ধরবে!

সকালে ঘুম ভাঙলেই জ্যাকের কাজ, সব পোশাক শরীর থেকে খুলে ফেলা। সে তার পোশাক খুলে বড় একটা ট্রাঙ্কে রেখে দেয়। সুন্দরভাবে রেখে দেয়। ভাঁজ করে, যেন ভাঁজ নষ্ট না হয়, কারণ বাবা তার পোশাক কিনে আনার সময় খুব গোপনীয়তা রক্ষা করেন। বনি রাতে নিজের পোশাকে সাদা চাদরের নিচে শুয়ে থাকতে ভালবাসে। তিনি তা বোঝেন। তবু খুব সতর্ক থাকতে হয়। বনিকে তিনি সব বলে দেন। তখন বনির কান্না পায়। সে আর এ ভাবে পুরুষ সেজে থাকতে পারছে না। ছোটবাবু কি যে, বোকা! কিছুতেই বোঝেনা সে মেয়ে। সে তো ছোটবাবুর পিঠে পিঠ লাগিয়ে এক দুপুরে বাংকারে বসে গল্প করেছিল। কি যে সুন্দর আর তরুণ সন্ন্যাসীর মতো অথবা মনে হয় মহান বৃক্ষের ছায়ায় সে তখন দাঁড়িয়ে। ওর ইচ্ছে, যেমন বাবা জানে সে মেয়ে, ছোটবাবুও জানুক সে মেয়ে। পৃথিবীতে আর কারো কাছে ধরা না দিলেও ক্ষতি নেই। যত জাহাজের দিন যাচ্ছে বনি তত পাগল হয়ে যাচ্ছে এবং যখন কিছু ভাল লাগে না, সাহসে কুলায় না, কিছু একটা করে ফেলতে, তখন রাতে মধ্যরাতে সে রেকর্ড-প্লেয়ারে সব মহান সঙ্গীতজ্ঞদের মিউজিক বাজিয়ে চলে। পৃথিবীর সবচেয়ে দামী পোশাকে সে একা একা নাচে। তার সঙ্গে থাকে তখন ছোটবাবু। কল্পনায় সেই ছোটবাবুকে ← তার পাশে রাখে কোন যুবক ব্যালে-ড্যানসারের মতো। ছোটবাবুর চওড়া কাঁধ, সোনালী অথবা নীলরঙের দাড়ি গোঁফ এবং শক্ত হাতের ভাঁজে এক পা তুলে নিজের সব কিছু অর্পণ করে দেবার ভিতর কি যে আকুলতা! বনির এই অস্থিরতা ওর চোখ মুখে ভাসে। সে কখনও শুয়ে থাকে নরম বিছানায়। সাদা মোমের মতো পা, হাতে নীল শিরা উপশিরা, গোলাপী রঙের স্তনে হুল ফোটালে রোমকূপে বিন্দু বিন্দু ঘাম। সে এ-ভাবে আর পারে না।

পারে না বলেই সকালে সে বার বার দরজা খুলে উঁকি দিয়েছে, কখন ছোটবাবু আসবে। সে তার বয়লার সুট পরে দাঁড়িয়ে আছে দরজায়। তাকে সে আজ একটা কথা বলবে। বলবে, আমি মেয়ে, ছোট, মি গার্ল। এবং সে প্রতিদিন এটা ভেবেছে বলবে, তুমি কাউকে বল না, বললে, বাবা আমাকে জাহাজ থেকে নামিয়ে দেবে, দেশে পাঠিয়ে দেবে। পরিচারকদের হাতে আমায় নির্বাসন দেবে। তুমি কিন্তু বল না। কেবল তুমি জানবে, আমি মেয়ে। আর কেউ না। হ্যাঁ আর জানে চিফ অফিসার। তিনি আমার আংকল। তিনি এবং বাবা আমার কাছে সমান।

ছোট যখন বোট-ডেকে উঠে এল, তখন জ্যাক ফানেলের গুঁড়িতে কিছু একটা করছে। আসলে এটা অজুহাত, ফানেলের গুঁড়ি ধরে ছোট সবার পরে এনজিন রুমে নেমে যাবে। এখনই ঠিক সময় এবং কি ভেবে জ্যাক ডাকল, ছোট!

তখন জাহাজের চিমনির ছায়া বেশ লম্বা হয়ে সমুদ্রে ভেসে গেছে। ধোঁয়া ব্রীজের ওপর দিয়ে সামনে কিছুটা এগিয়ে আবার উত্তর-পূব মুখি ভেসে যাচ্ছে। নীল সমুদ্রে এই ধোঁয়া কিছুটা ছায়া ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে, এবং তাজা রোদ বলে সমুদ্রের নীল রঙ কেবল সোনালী বর্ণমালায় সেজে চারপাশের অসীমতায় ডুবে যাচ্ছে। এমন যখন জাহাজের চারপাশের বর্ণমালা তখন ছোট দেখল, চিমনির পাশে উইণ্ডসেলের নিচে জ্যাক দু-হাঁটুর ভেতর থেকে মুখ তুলে ওকে দেখছে! উইণ্ডসেলের ছায়ায় জ্যাকের মুখ ভীষণ দুঃখী অথবা ভীতু দেখাচ্ছে। সে ছোটকে কী বলতে গিয়ে বলতে পারল না। ছোট তখন ডাকল, জ্যাক।

জ্যাক বলল, কাজে যাচ্ছ?

ছোট মাথা হেলাল। এটা জ্যাক জানে, এখন ছোটবাবু বয়লার রুমে নেমে যাচ্ছে। জ্যাক যে কি করে বলবে, আমার কেবিনে তুমি এস! তার খুবই সংকোচ বলতে পারে না। সে বলল, বারোটার পর কি করছ?

—স্নান করব। খাব। তারপর ঘুমোব

—কখন উঠবে?

—চারটে বাজতে পারে, পাঁচটাও বাজতে পারে।

—পাঁচটায় আমার কেবিনে আসবে। তখন কেউ ওপরে থাকবে না।

ছোট কেমন ঘাবড়ে গেল। জ্যাকের কেবিনে ও আর যেতে পারে না। ওদিকে ক্রুদের যাবার নিয়ম নেই। গেলে কথা উঠতে পারে। সে সহজেই বলে ফেলতে পারল না, যাব। একবার গিয়ে সে যা ফ্যাসাদে পড়ে গেছিল!

জ্যাক বলল, কাউকে বলবে না তুমি আসছ। দরজার পাশে আমি দাঁড়িয়ে থাকব। তুমি এলেই দরজা বন্ধ করে দেব। কেউ টের পাবে না।

ছোট বলল, কেউ দেখে ফেললে!

—কে দেখবে! এদিকে তখন কেউ আসে না।

এটা সত্যি, তখন এ-দিকটা খুবই ফাঁকা থাকে। ক্যাপ্টেন তখন ব্রীজে উঠে যান। কাপ্তান-বয়কে ডেকে না পাঠালে সে যেতে পারে না তখন। ডিউটিতে যে কোয়ার্টার মাস্টার থাকে সেও নামে না। কাপ্তান ব্রীজে থাকলে সবাই খুব মনোযোগী হয়ে যায় কাজে। ছোটবাবু টুপ করে নিচে ডুবে যাবার আগে কি ভেবে যে বলে ফেলল, যাব। তারপর আর দেখা গেল না। জ্যাক আবার উইণ্ডসেলে হেলান দিয়ে বসে থাকল। তার এখন আর উঠতে ইচ্ছে করছে না। বসে বসে কেবল সমুদ্র, দূরের কোথাও কোন সবুজ দ্বীপ ভেসে উঠবে এক্ষুনি, এ সব ভেবে বসে বসে অনেকটা সময় কাটিয়ে দিল। ওর চোখ আনন্দে এবং উত্তেজনায় চিকচিক করছে। ছোটবাবু তার কেবিনে আবার আসছে, আনন্দে ওর চোখে জল এসে গেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *