1 of 2

অলৌকিক জলযান – ১০

।। দশ।।

সাগরের জল নীল, সব সাগরের জল নীল। যেখানে যখন সমুদ্র আলাদা নামে ভাগ হয়ে গেছে, ঠিক সেখানে তারা এমন কিছু দেখতে পায় না, যা দেখে সমুদ্রকে আলাদা নামে চেনা যায়। সেই নীল রঙ, সেই শান্ত নিরিবিলি আকাশ, সেই উড়ুক্কু মাছেদের উড়ে উড়ে জলের ওপর খেলা। তীরের মতো ওরা হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে আবার জলে ডুবে যায়। এবং সমুদ্র-পাখীরা কখনও কখনও দেখা যায় পেছনে উড়ে আসছে। ঝড়ের সময়ও ঠিক তেমনি। যেন এক ভয়ঙ্কর সমুদ্রের ভেতরে, ভয়ঙ্কর সব ঢেউ আর মেঘলা আকাশের নিচে জাহাজ ছোট কাগজের নৌকার মতো। জাহাজের ওপর দিয়ে ঝড়ের দাপট, অথবা ঢেউগুলো কি আশ্চর্যভাবে যে ডেকের ওপর দিয়ে কখনও বোট ডেকের ওপর দিয়ে ভেসে চলে যায়। যেন সমুদ্র আর জাহাজের এক খেলা, মায়ার খেলা, অথবা লুকোচুরি খেলা। জাহাজ কখনও কখনও ঢেউয়ের ভেতর হারিয়ে গিয়ে বিশাল সমুদ্রের সঙ্গে তামাসা করে। আবার ভেসে উঠলে, প্রচন্ড রোষ সমুদ্রের, সে প্রবল বেগে আছড়ে পড়তে চায়। আর সামান্য জাহাজিরা তখন স্টোক-হোলডে বয়লারের সঙ্গে, আগুনের সঙ্গে লড়াই করতে করতে কত সহজে এইসব রোষ থেকে জাহাজকে যে রক্ষা করে থাকে। মানুষ এ-ভাবে সমুদ্রের সমস্ত অহঙ্কার ভেঙে দেয়। সে তার ঢেউ ফালা ফালা করে একদিন ঠিক শান্ত আকাশের নিচে চলে যায়। মনেই হয় না সমুদ্র সেদিনও জাহাজটাকে কি যে দুর্গতির ভেতর ফেলে দিয়েছিল। সমুদ্র ভালমানুষের মতো একেবারে সরল সহজ হয়ে গেলে, জাহাজিরা কাজের শেষে রেলিঙে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে থাকে। অবসর সময়ে ছোটবাবুর সমুদ্র দেখা বাদে যেন আর কাজ থাকে না তখন। অথবা বর্ণময় দ্বীপের অসংখ্য গাছপালা।

এবং এভাবে ছোটবাবু কখনও ডেকে, কখনও ফল্কায় অথবা মধ্যরাতে ঘুম না হলে সে একাকী উঠে আসে। সবাই ঘুমোচ্ছে। কেবল ডগ-ওয়াচে ওয়াসিন কিংবা অন্য কোনও ডেক-জাহাজি পাহারায় আছে। আর ব্রীজে ছোট-মালোম। স্টোক-হোলডে ফায়ারম্যান, টিন্ডাল। ফানেলের গুঁড়িতে উঠে গেলেই দেখা যাবে যেন পাতালে ক’জন ক্ষুদ্রাকৃতি মানুষ, ফার্নেসের দরজা ঠেলে র‍্যাগ মেরে ওল্টে পাল্টে দিচ্ছে আগুন। ওদের মুখগুলো আগুনে ঝলসে উঠলে বোঝা যায় মধ্যরাত্রিতে কেউ জেগে থাকে না, শুধু ওরা জেগে আছে। এনজিনে জেগে আছেন তিন নম্বর মিস্ত্রি। সে চুরুট খাচ্ছে আর মাঝে মাঝে স্টিম ঠিক আছে কিনা দেখছে। জেনারেটর ঠিকমত কাজ করছে কিনা লক্ষ্য রাখছে। ব্লিজ পাম্প চালিয়ে দিচ্ছে মাঝে মাঝে। চারপাশটায় লক্ষ্য রেখে, যেমন সে মাঝে মাঝে সার্কুলেটিঙ পাম্পে হাত দিয়ে দেখছে খুব বেশী গরম হয়ে গেল কিনা জলটা—এভাবে শুধু জেগে থাকা। অনেক উপরে ঠিক স্কাই-লাইটের ফাঁকে দেখা যায় আকাশটা ক্রমে সরে যাচ্ছে। কখনও মনে হয় আকাশটা ভীষণ দুলছে। এ-ভাবে জাহাজ ক্রমাগত চলছে।

ক্রমাগত দিনের পর দিন এ-ভাবে শুধু চলা। জাহাজের চেহারা ওয়াচে ওয়াচে পাল্টে যায়! সমুদ্রে মধ্য রাতের চেহারা যেন সবচেয়ে নিঝুম। এবং এ-সময় কাপ্তানের ঘরে কোন আলো জ্বালা থাকে না। পোর্টহোল দিয়ে উঁকি দিলে দেখা যায় বড়-মিস্ত্রি একজন অসহায় বালকের মতো কম্বলের নিচে পা মুড়ে শুয়ে আছে। এনজিনের শব্দ কেবল উঠে আসে ভেতর থেকে, আর সব আলো জ্বালা ডেকে, উইংসের আলোগুলো মায়াবী এক জগত তৈরী করে দেয়। গভীর নীল সমুদ্রে সাদা জ্যোৎস্নায়, সাদা জাহাজ গভীর রাতে যখন যায়, তখন এক ছোট্ট সচল নগরী অথবা যেন জাহাজের সুন্দর সুচারু গতি দেখলে ঈশ্বরের পৃথিবীকে ভীষণ ভালবাসতে ইচ্ছে করে।

মধ্যরাতে ছোটবাবুর কখনও কখনও ডেকের ওপর দিয়ে হেঁটে বেড়াতে ভাল লাগে। সহসা কেউ দেখলে ভূত টুত বলে চিৎকার পর্যন্ত করতে পারে। কারণ কোয়ার্টার মাস্টার মহসীনের বিশ্বাস জাহাজে যেমন সবাই আছে, তেমনি ভূতও আছে। জাহাজে মানুষ থাকবে, ভূত থাকবে না, সে বিশ্বাস করতে পারে না। সে তার সফরের কত এমন সব ভূতের যে গল্প করেছে। এবং এ-সব গল্প শুনলে, ডেকে একা ঘুরে বেড়াতে সত্যি ভয় লাগে। যেমন একটা ভূত ছিল, সিটি অফ পানামাতে। সে ডেকে মধ্য রাতে কোন জাহাজি পেলেই একেবারে ঠেলে সমুদ্রে হারিয়া করে দিত। যেমন একবার একটা ভূত একজন জাহাজির গলায় দড়ি লাগিয়ে একেবারে মাস্তুলের ডগায় ঝুলিয়ে দিয়েছিল। কাপ্তান নানাভাবে ভূতটাকে খুঁজে বেড়ালেন। তারপর দেখা গেল কাপ্তান নিজেই একেবারে চিৎপাত হয়ে পড়ে আছেন ইনজিন ঘরে। জ্ঞান ফিরে এলে তিনি বলেছিলেন, কেউ তাকে যেন, একটা বাতাস টাতাস হবে, ঠেলে নিচে ফেলে দিয়েছে।

এবং ছোটবাবু ঠিক দুপুর রাতে একা একা ঘুরে বেড়ালে—সেই সব ভূতের নানারকম কীর্তিকাহিনীর কথা মনে করতে পারে। ওর ভয় যে না হয়, তা নয়, তবু এই নিঃসঙ্গতায়, এবং সমুদ্রের গভীরে, অর্থাৎ হাজার হাজার মাইল এ ভাবে সমুদ্রের ভিতর দিয়ে যাওয়া এবং মধ্যযামিনীতে কখনও কখনও একা দাঁড়িয়ে থাকা এক ভীষণ রোমাঞ্চ সে বুঝতে পারে। এইসব মধ্যযামিনীতে সে কি যে প্রলোভনে পড়ে যায়! তার মনে হয় সে এ ভাবে একদিন ঠিক এই পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে ঘরে ফিরে যাবে। মানুষের কাছে এর চেয়ে বড় কি আছে! কারণ সে জানে ঘরে ফিরে গেলে, কত সব গল্প, মা চুপচাপ কুপি জ্বেলে বলবে, তারপর! ভাইবোনগুলো বলবে, তারপর

তারপর কি, সে নিজেও জানে না। কারণ, কোনও চিঠি কোথাও থেকে না এলে সে বুঝতে পারবে না ওরা কোথায় আছে। তখন ডেকে দাঁড়িয়ে তার কেমন গলা ধরে আসে। তার এত অহংকারের উপার্জন কোনও কাজে এল না। মানি অর্ডারের টাকা কোম্পানীর ঘরে ফিরে গেছে।

.

ঠান্ডায় জাহাজিরা কাঁপছে, সমুদ্র থেকে ঠান্ডা বাতাস উঠে আসছে। গ্যালি থেকে কেউ যেতে চাইছে না। বুড়ো মানুষ ভান্ডারী, সবাই এসে গ্যালিতে ভিড় করলে ভীষণ বিরক্ত হয়। একে ছোট্ট জায়গা, সবাই হাত সেঁকলে, সে দাঁড়ায় কোথায়। তার যে কত কাজ! সে উনুনে বড় তামার ডেকচিতে ডাল, আর ভাত বসিয়েছে। একটা বড় কড়াইয়ে সে চর্বি দিয়ে রুটি ভাজছে। যে যার মতো তুলে নিচ্ছে, এবং রোদে দাঁড়িয়ে খাচ্ছে।

এবং চড়ুই পাখি দুটো বসে আছে রেলিঙে। ওরাও শীতে কাঁপছে। এদের জন্য ছোটবাবু ভেবেছে একটা বাসা বানাবে। বাসাটাতে খড়কুটো দিয়ে এমন গরম জায়গা বানাবে, যাতে ওদের থাকতে কোন অসুবিধা না হয়। ছোটবাবু বুঝতে পারল না বোট-ডেকের রেলিঙে ওদের কি দরকার বসে থাকা। এখন এনজিন-ঘরে বেশ গরম। বয়লারের ওপর কোনও রেলিঙে-টেলিঙে বসে থাকলেই হয়ে যায়। না, তা না। সে ভেবেছিল, ওয়াচে নামার আগে ওদের তাড়িয়ে এনজিন ঘরে নিয়ে যাবে। অবসর সময়ে সে ওদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে থাকে। ওর সঙ্গে যখন কথাবার্তা হয়, তখন জ্যাক আসে, মেজ-মালোমও আসে। কখনও কখনও জ্যাক পাখি দুটোকে, বিশেষ করে মেয়ে-পাখিটাকে জাহাজ ছাড়া করতে চায়। কি দরকার, মেয়ে পাখি থাকার। যেন হেগে-মুতে জাহাজ নোংরা করছে। জ্যাকের ভীষণ রাগ এই মেয়ে পাখিটাকে নিয়ে। আর মেজ-মালোম এবং সে শুধু, সে কেন, এখন তো জাহাজে এত একঘেয়েমী, যে এ-দুটো পাখি জাহাজে ভীষণ বৈচিত্র্য বয়ে এনেছে।

সবাই ভেবে ফেলেছে তাদের মতো, পাখি দুটোও জাহাজের যাত্রি। এদের জন্য কখনও কখনও জাহাজিরা খাবার রেখে দিতে ভালবাসে। খেতে খেতে মনে পড়ে গেল, আরে মিঃ স্পেরো, মিসেস স্পেরো! কোন দরকার নেই। কারণ ওরা খুঁটে খুঁটে খায়, ওতেই চলে যায়। গ্যালিতে আসতে ভয় পায়, এত লোক দেখলে ভয়, তবু বেঁচে থাকার মতো খাবারের ভাবনা ওদের নেই। তবু জাহাজিদের যে কি হয়, খেতে খেতে মনে পড়ে গেলে, কখনও আপেলের টুকরো, কখনও কুচি মাংস, কখনও রুটির ভগ্নাংশ রেখে দিয়ে যেন মনে করে থাকে, এটা ঠিক জাহাজ চালিয়ে নেওয়ার মতো আর একটা কাজ। ওরা যেতে যেতে পাখি দুটোকে খুঁজে বেড়ায়। চারপাশে খুঁজে বেড়াতে বেড়াতে না দেখতে পেলে, ভাবে, কি হল, কোথায় গেল! যেন তখন তোলপাড় পড়ে যায়, কোথায় কোথায়! পাখি দুটোকে তো আর দেখা যাচ্ছে না।

তখন হয়তো কাপ্তানের ছেলে পাখি দুটোকে নিয়ে ঠিক ব্রীজের নিচে বসে আছে। সে বসে রয়েছে একটা টিনের চেয়ারে। সে বোধ হয় পরে আছে লম্বা সাদা ট্রাউজার। সে পরে আছে লম্বা সার্টের ওপর ঢোলা পুল-ওভার, সে পরে আছে একটা ষোড়শ শতাব্দীর জলদস্যুসের টুপি, ওর পায়ে নীল রঙের জুতো, এবং কালো মোজা। ওর হাতে দস্তানা সাদা রঙের। চুল আরও বড় হয়ে গেছে। সে পা দুটো সামনের দিকে ছড়িয়ে দিয়েছে। তার পায়ের চারপাশে পাখি দুটো উড়ে বেড়াচ্ছে। পাখি দুটোকে ওর আপেলের কিছু অংশ কখনও রুটির অংশ সে ছুড়ে দিচ্ছে। পাখিগুলো খেয়ে যাচ্ছে। এটা একটা এখন জ্যাকের খেলা হয়ে গেছে। সে যেন জাহাজে বেশ একটা কাজ পেয়ে গেছে। পুরুষ পাখিটাকে সে বেশি খাওয়াতে ভালবাসে।

পাখিদের খাওয়ানোর সময় হাতের দস্তানা খুলে ফেলে। দস্তানা সে কোমরে বেল্টে গুঁজে রাখে। সে কেমন এক অতীব সুন্দর ছবি তৈরি করে ফেলে ডেকে। জাহাজে থাকলে চুল চোখ কি মানুষের ক্রমে’ নীল হয়ে যায়! ছোটবাবু পাশে গিয়ে দাঁড়ালে বুঝতে পারে না, চুলে এমন সুন্দর গন্ধ কি করে হয়। সে তো কিছু মাখে না। জ্যাকের শরীরে এই যে ঘ্রাণ, যেন সব জাহাজিদের চেয়ে আলাদা। কাছে গেলে নড়তে ইচ্ছে হয় না। জ্যাকের পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে তার ভীষণ ভাল লাগে। পাখি দুটো চারপাশে তখন উড়ে বেড়ায়, আর কিচ কিচ করে ডাকে।

জ্যাক একদিন দেখল, ছোটবাবু চুপচাপ গ্যালির পাশে কি করছে। ছোটবাবু ঠুক ঠুক করে কাঠে পেরেক মেরে যাচ্ছে। কি হবে, এই বাকসো দিয়ে সে বুঝতে পারছে না। ছোটবাবুও কিছু বলছে না। তারপর ডাকল, জ্যাক!

এ-ডাক জ্যাক কেন যে অবহেলায় মাড়িয়ে যেতে পারে না। কেমন সরল অনাড়ম্বর ডাক। সে এলেই ছোটবাবু বলল, তুমি একটা কাজ করবে জ্যাক?

জ্যাক বুঝতে পারে না কি কাজ!

সে বলল, হাতুড়িটা বড়। একটা ছোট হাতুড়ি কশপের আছে। আমি চাইলাম, দিল না। তুমি যাবে? আমাকে এনে দেবে?

জ্যাক লাফিয়ে চলে যাচ্ছিল, তখন আবার ছোটবাবু ডাকল, আর শোন তুমি কটা কাঠ, কিছু পেরেক আরও আনতে পার কিনা দেখবে। আমাকে দিল না। বলল, মেজ-মিস্ত্রি বকবে। তুমি যদি পারো।

জ্যাক যখন ফিরে এল, ছোটবাবু অবাক। কশপের কাঁধে কোমরে, প্রায় কশপকে চেনা যায় না, কাঠ বোঝাই হয়ে কশপ চলে এসেছে। এক গাদা কাঠ জ্যাকের হাতে, এত দিয়ে কি হবে, সে বুঝতে পারছে না।

ছোটবাবু বলল, আরে এটা করেছ কি!

জ্যাক পাশে কাঠ রেখে বসল। বলল, বেশ বড় করে বানাবে।

কশপ দাঁড়িয়ে আছে। সে জ্যাক না বললে নামাতে পারছে না। দাঁড়িয়েই আছে।

ছোটবাবু বলল, চাচা ওগুলো নিয়ে যাও। লাগবে না। জ্যাক যা এনেছে ওতেই হয়ে যাবে।

—তোমার পেরেক লাগবে না?

—জ্যাক আনে নি!

এনেছে। আমার কাছে ভাল পেরেক আছে। তিনটে হাতুড়ি এনেছি, কোনটা লাগবে বল।

—লাগবে না। জ্যাকের হাতুড়ি হলেই হবে। তুমি বরং এটা নিয়ে যাও। বলে সে হাতের হাতুড়িটা দিতে গেলে দেখল, নেবার মতো ক্ষমতা ওর নেই। এই কাঠগুলো ফের বয়ে নিতেই কষ্ট হবে। সে উঠে দাঁড়াল। কাঠগুলো সব নামাল। বলল, তুমি হাতুড়িটা নিয়ে চলে যাও। কাঠগুলো যা লাগে নেব, বাকিটা আমি রেখে আসব।

এখানেই কেন জানি ছোটবাবুর জন্য সবার মায়া। এটা সে জানে, মানুষের কোথায় সব নরম জায়গা থাকে, সে নিজেও একটা দুঃখের ভিতর পড়ে গেছে, সে জন্য কারু সঙ্গে ছোটবাবু খারাপ ব্যবহার করতে পারে না। শৈশব থেকেই সে এমন একটা স্বভাবের ভেতর মানুষ হয়েছে।

এবং এ-ভাবে ছোটবাবু এক জাহাজি। আর কেউ জানে না, জ্যাক একটা মেয়ে, ছেলে সেজে বেশ চালিয়ে যাচ্ছে। কাপ্তান একদিন আবার জোর করে বনির চুল ছেঁটে দেবে বলে বনিকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। চুল ছেঁটে দেবার সময় জাহাজে এক দৃশ্য তৈরি হয়। বনিকে খুঁজে পাওয়া যায় না। কাপ্তান, সারেঙ, বড়মালোম সবাই মিলে তখন কেবল খোঁজে। বনি কোথায় যে লুকিয়ে থাকে তখন!

ছোটবাবু তখন বাংকারে কাজ করছিল। একটা লম্বা রাবারে মোড়া তারের মাথায় বাল্ব জ্বলছে। মাঝে মাঝেই টানাটানিতে নষ্ট হয়ে যায়। তখন থাকে একটা লম্ফ। লম্ফের আলোতে বাংকারটাকে কয়লার খাদ বাদে আর কিছু ভাবা যায় না। সে অন্ধকারে একা গাড়িতে কয়লা ভরে যাচ্ছে। শীতকাল, প্রচন্ড ঠান্ডায় সে ঘামছে। ওর মুখ কয়লায় কালো হয়ে গেছে। সে মাঝে মাঝে বেলচায় কয়লা ওপর থেকে টেনে নামাচ্ছে। বড় বড় পাথরের মতো কয়লার চাঙ এখন নেই। কয়লা কিছুটা ইংলিশ কোলের কাছাকাছি। খুব পরিশ্রম হবার কথা না। তবু সে তাড়াতাড়ি সুট ভরে ফেলতে পারলেই ছুটি পেয়ে যাবে। সে তাই এক নাগাড়ে কাজ করে যাচ্ছে। আর তখনই ফিস ফিস গলায় কে ডাকলে, ছোটবাবু আমি।

মইসীন মিঞার ভূতের গল্প সারা জাহাজে একটা ভয় ছড়িয়ে রাখে। ছোটবাবু মাঝে মাঝে একা বাংকারে ঢুকতে ভয় পায়। জাহাজের ভেতর এটাই সবচেয়ে বোধহয় অন্ধকার জায়গা। মাল গুদাম ছাড়া এত অন্ধকার আর কোথাও নেই। সে ভয়ে সহসা সোজা হয়ে গেলে দেখল, জ্যাক ওর পাশে দাঁড়িয়ে বলছে, প্লিজ ছোট।

ছোটবাবু কিছুই বুঝতে পারে না। সে বলল, কি!

—আমি এখানে লুকিয়ে থাকব।

—কেন?

—বাবা চুল কেটে দেবার জন্য খুঁজছে।

—আমাকে তবে জাহাজ থেকে নামিয়ে দেবে না!

—না। আমি বলছি তোমাকে কিছু বলবে না।

এ-ছাড়া সেই অস্পষ্ট অন্ধকারে বনির মুখে ভীষণ কষ্টের ছাপ, ছোটবাবুকে কেমন কাতর করে ফেলে। সে বলল, ঠিক আছে। ওদিকে চলে যাও। আমি এলে বলব, এখানে কেউ নেই।

—ওরা তবে খুঁজে বের করে ফেলবে!

—তবে কি করতে চাও?

—তুমি আমাকে বেলচাটা দাও। আমি কয়লা ফেলতে থাকি।

—আমি কি করব?

—তুমি স্টোক-হোলডে নেমে যাও।

—কিন্তু……..।

—কিন্তু না। তুমি শোন, একটা কাজ করবে, এই মানে…….। মনে হয় বনি কিছু বলতে লজ্জা পাচ্ছে। সে নিজের পোশাকের দিকে তাকাচ্ছে। খুব সাদা পোশাক। এমন সুন্দর পোশাকে কেউ বাংকারে ঢোকে না। ওরা দরজায় কেউ উঁকি দিলেই, বুঝতে পারবে এমন সাদা ধবধবে পোশাকে কেউ বাংকারে কয়লা ফেলতে আসে না। সে ঠিক ধরা পড়ে যাবে। তবু কি যে সংকোচ, কি যে সে বলতে চায় ছোটবাবু ঠিক বুঝতে পারে না। সে বলল, ছোট, তোমার পোশাকটা দেবে। আমি পরে নেব।

—আমার……মানে আমার নোংরা পোশাক। কী বলছ! তোমার ভীষণ ঢোলা হবে।

—তা হোক! তুমি দাও।

—আরে না না, সে কি করে হয়। খুব নোংরা।

—কিছু হবে না। এখানেই বোঝা যায় জ্যাক জেদি। সে বলল, তুমি দাও। আমারটা তুমি পরে নাও।

—তুমি কি বলছ জ্যাক! তোমারটা আমার গায়ে কখনও লাগে! খাটো হবে না!

—হোক খাটো। তুমি নাও। দেরী কর না। দেরী করলে ধরা পড়ে যাব।

ছোটবাবু আর কিছু ভাবতে পারে না। ঘামে গেঞ্জি ভিজে গেছে। প্যান্টালুন তেমন ভেজে নি। সে বনির সামনেই জামা খুলে ফেলল প্যান্ট খুলে ফেলল। আর কী শীত! সে তো এখন কাজ করছে না, শীতটা আবার জাঁকিয়ে বসেছে। সে বলল, এই তাড়াতাড়ি খুলে দাও। আমার ভীষণ শীত করছে জ্যাক। ও-তুমি আবার ওদিকে কোথায় চললে! জ্যাক!

—এদিকে এস না ছোট। প্লিজ।

—আরে তাড়াতাড়ি করে ফেল। আমার ভীষণ শীত করছে।

—প্লিজ, এদিকে এস না। আমার হয়ে গেছে। অস্পষ্ট অন্ধকার থেকে জ্যাকের গলা পাওয়া গেল।

—জ্যাক তোমাকে দেখা যাচ্ছে না। খালি গায়ে আমি কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকব। জ্যাক, আমি শীতে মরে যাব। জ্যাক, তোমার এত লজ্জা কেন?

মনে হয় অন্ধকারে জ্যাকও শীতে ভীষণ কাঁপছে। সে ছোটবাবুর কাছে যেতে ভয় পাচ্ছে। সে কেমন অধীর হয়ে পড়ছে। যেন সে ছোটর কাছে গেলেই নিজেকে ঠিক রাখতে পারবে না। কি সুন্দর, পবিত্র যীশুর মতো। সে যে কি করে ফেলতে পারে তখন! আশ্চর্য সুন্দর শরীর ছোটবাবুর। বাহুল্য নেই। সোজা সরল বৃক্ষের মতো ছোট দাঁড়িয়ে শীতে কাঁপছে। বনি কেমন আবিষ্ট হয়ে যাচ্ছে দেখতে দেখতে।

ছোটবাবু চিৎকার করে বলছে, কি হচ্ছে জ্যাক? বলে সে লম্বা বাংকারের মাথায় ছুটে গেলে বনি বলল,—এই যে আসছি। আমার হয়ে গেছে ছোট।

গলা এত কাঁপছে কেন? ছোটবাবু বুঝতে পারছে না, জ্যাকের গলা কেমন ধরে আসছে।

—আমি শীতে মরে যাচ্ছি ছোট। বলে, মাথার টুপি টেনে এগিয়ে আসছে জ্যাক। তারপর জ্যাক কাছে এসে বলল,—আর দাঁড়াবে না। একেবারে নিচে নেমে যাও। কোথাও গিয়ে লুকিয়ে বসে থাক।

ছোটাবাবু বলল, জ্যাক, তুমি আশ্চর্যভাবে ছোটবাবু হয়ে গেলে। আর একটু লম্বা হলে কেউ এমনিতেও ধরতে পারত না!

বনি কোন কথা না বলে গাড়ি টেনে নিয়ে যাচ্ছে। ছোটবাবু সিঁড়ি ধরে নিচে নেমে গেল। আসলে এখন বনি ছোটবাবু বাদে আর কিছু জানে না। সে যে কি সুন্দর! যেন জীবনের এক আশ্চর্য মোহ অথবা ঘ্রাণ বলা যেতে পারে, অথবা রাজার রাজা ছোটবাবু, এবং শরীরের সর্বত্র মহিমময় ঈশ্বর কোন কৃপণতা রাখেন নি। নাভির নিচে সে এক আশ্চর্য বনরাজিলীলা। এক আশ্চর্য মোমের শরীর, অথবা পাথরের মূর্তি। ছোটবাবুর হাতের পেশী কোমরের ভাঁজ, উরুর দৃঢ়তা তাকে পাগল করে দিচ্ছে। সে যে কতক্ষণ এভাবে ছোটর সুন্দর শরীরের ভিতর ডুবে ছিল, জানে না। ঠিক বারোটা, বারোটা কেন, ঠিক এগারোটা পার করে দিতে পারলেই বাবা আর তাকে চুল ফেলতে জোরজার করবে না। বারোটা ত্রিশে ডাইনিং হলে লাঞ্চ। লাঞ্চ টাইম হয়ে গেলে বাবা চুল কাটার কথা ভুলে যাবেন।

কাপ্তান-বয় সারা ডেক খুঁজে বেড়াচ্ছে। ছোট সাবকে কেউ দেখেছে কিনা বলতে পারছে না। ক্যাপ্টেন ব্রীজে কাঁচি নিয়ে অপেক্ষা করছেন। কাপ্তান-বয় একবার খবর দিয়ে গেছে, ডেকের ওপরে নেই ছোট সাব।

ফোকসালে খুঁজলে হয়। তখন কাপ্তান-বয় ছুটেছে, ফোসকালে। না, সেখানেও কেউ দেখেনি। এই মেয়েটার মাঝে মাঝে কি যে হয়—কাপ্তান হিগিনস ভেবে পান না। নিচে নামতে হবে, সে কাপ্তান বয়কে এক কড়া ধমক লাগাল, কোথায় যাবে, ভাল করে খুঁজে দ্যাখো। এনজিন রুমে পালিয়ে থাকতে পারে। সে এবার থার্ডকে ডাকল। দ্যাখ তো জ্যাক কোথায় পালাল।

—আবার!

—চুল ফেলতে গেলেই পালিয়ে যায় কোথায়।

সুতরাং থার্ড অফিসার আর কাপ্তান-বয় তন্ন তন্ন করে খুজে বেড়াল। এসে বলল—না নেই। কাপ্তানের রক্ত মাথায় উঠে গেল। সে বলল ওর কেবিনে দেখেছ? তারপরই মনে হল বনির কেবিনে ওদের ঢোকা ঠিক না। সে এবার বলল, দাঁড়াও দেখছি। কিন্তু আশ্চর্য বনি কেবিনেও নেই। কেবিনে থাকার কথা না। বনি এ-সময় ডেকে পাখি দুটোকে খাওয়ায়। সেখানে যদি থেকে যায়। কাপ্তান এবার বললেন, এনজিন রুমে দ্যাখো।

—স্যার, সব জায়গা খুঁজেছি। কোথাও নেই।

—বয়লারের ওপরে, স্মোক-বকসের পাশে?

—সব দেখে এসেছি।

—স্টুয়ার্ডের ঘরে, ওর বরফ-ঘরে?

—দেখে এসেছি, নেই।

তিনি এবার ডাকতে থাকলেন জ্যাক, ভালো হবে না। আমি তোমার চুল ফেলব না! কোথায় পালিয়ে আছ বল।

দলবল নিয়ে এবার নিচে নেমে গেলেন কাপ্তান। বাংকারে উঁকি দিলে, কোলবয়েরা কয়লা ফেলে যাচ্ছে। কি যে হবে! কোথাও দেখা যাচ্ছে না। এবং জাহাজে ভীষণ উত্তেজনা। খবর রটে যেতে থাকল, জ্যাককে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ছোটর বুক ভীষণ ঢিপ ঢিপ করছে। সে তার সাদা পোশাক পরে অমিয়র বাংকারে ঢুকে গল্প করছে। অমিয় এটা খেয়ালই করে নি ছোটবাবু বেশ ছিমছাম পোশাকে আছে। মুখে কালি। এও হতে পারে এ-ঘরে লম্ফ জ্বলছে। লম্ফের আলোতে সব স্পষ্ট নয় বলে সে খেয়াল করে নি। অমিয় বলল, শুনেছিস?

—কি

—জ্যাককে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, ক্যাপ্টেন, বড়-মালোম সবাই ওকে খুঁজছে।

—অঃ। এবং তারপর ছোটবাবু এক লাফে নিজের বাংকারে ঢুকে বলল, জ্যাক ভীষণ কান্ড। শিগগির উঠে যাও। ডেকের ওপর এবার কিন্তু কাপ্তান মাস্তার দিতে বলবে সবাইকে। সাইরেন বেজে উঠল বলে।

এবং সে দেখল ঘড়িতে এগারোটা বেজে গেছে। সে বলল, তাড়াতাড়ি প্যান্ট জামা খুলে দাও ছোটবাবু। তারপর কি ভেবে বলল, ঠিক আছে। সে তাড়াতাড়ি কি যে করতে যাচ্ছে। তোমার প্যান্ট জামা পাঠিয়ে দেব।

—আমার কি হবে?

—কেন তুমি ওপরে চলে যাবে!

—আরে বাংকারের অন্ধকারে কেউ টের পাবে না। ওপরে উঠলে সবাই টের পাবে।

—অঃ।

এবার যে যার পোশাক পাল্টে নিল। আগের মতোই জ্যাক চলে গেল অন্ধকারে। ছোটবাবুর এ-ব্যাপারে কোন লজ্জা নেই। সে আর অমিয় একসঙ্গে বাথরুমে স্নান করে থাকে। তাড়াতাড়ির সময় একটা বাথরুম বলে একই সঙ্গে স্নান করে নেয়। জাহাজে উঠে ছোটর লাজলজ্জা কিছুটা কমে গেছে। অথবা জাহাজে উঠলে বুঝি মানুষের ভিতর অনেক কৃত্রিমতা মুছে যায়। সব কেমন খোলামেলা। জামা প্যান্ট পাল্টে সে জ্যাককে দিয়ে দিল। যখন উঠে যাচ্ছে জ্যাক, তখন জ্যাক আবার যেন শীতে কাঁপছে! জ্যাকের মুখটা কেমন নীল হয়ে গেছে।

আর ঠিক তখনই জাহাজে সেই ভয়ঙ্কর কঠিন শব্দ। দুবার লম্বা সাইরেনের মতো শব্দ।

এবং যখন জাহাজে সবাই মাস্তার দিচ্ছে, কাপ্তানের চোখ মুখ সেই দুষ্টু মেয়েটির জন্য অধীর হয়ে আছে, কিছু বলতে পারছেন না, যেন তিনি ভেতরের সব দুঃখটা জোর করে চেপে রেখেছেন এবং হেঁটে যাচ্ছেন, বলতে সাহস পাচ্ছেন না, কোন রকমে যেন বড়-মালোম কাপ্তানের হয়ে বলছে তখন, জ্যাককে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কেউ তোমরা দেখেছ?

ছোটবাবু মাস্তার থেকে বের হয়ে বলল, হ্যাঁ স্যার, এইতো দেখলাম। এনজিন রুম থেমে যখন উঠে আসছিলাম, দেখলাম।

—কোথায়? কাপ্তান ছুটে কাছে চলে গেলেন।

—একোমডেসান ল্যাডারের নিচ দিয়ে চলে গেল।

—ঠিক তুমি দেখেছ? জ্যাককে!

—হ্যাঁ স্যার।

সঙ্গে সঙ্গে কাপ্তান ছুটে গেলেন। একোমডেসান ল্যাডারের নিচেই বনির কেবিন। কাপ্তান হিগিন্‌স্‌ ছুটে যেতে থাকলেন। তিনি নীল রঙের সুট পরেছেন। হাতে চারটা সোনালি স্ট্রাইপ, কাঁধেও চারটা। স্ট্রাইপগুলো ভীষণ চক্‌চক্‌ করছে। মাথায় এংকোরের ছবি আঁকা জাহাজি টুপি। তিনি ভেতরে ঢুকেই অবাক। একটা সাদা কম্বলের ভেতর বনি শুয়ে আছে।

তিনি ধীরে ধীরে ডাকলেন, বনি!

—বাবা!

—তুমি কোথায় ছিলে!

—এখানে বাবা।

—আমি তোমাকে খুঁজে গেলাম যে!

—আমি তখন বোধহয় চড়ুইদের বাসাটা তৈরী করছিলাম।

—শুয়ে আছ কেন?

তখন পেছন থেকে কে ডাকল স্যার, পেলেন!

তিনি ভুলে গেছিলেন, সবাই বোট-ডেকে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি এবার দরজায় মুখ বার করে বললেন, যেতে বল। জ্যাককে পাওয়া গেছে।

ওরা আর কিছু জানতে পারে না। এর চেয়ে বেশি জানার অধিকার তাদের নেই। ওরা বোট- ডেক থেকে নেমে গেল। জাহাজের ব্রাস্ট আবার বাজছে। এটা বোধহয় ক্লিয়ারিং সিগনাল। হিগিনস বনির কেবিনে বসেই শুনতে পেলেন সব। বড় উদ্বিগ্ন চোখে মুখে বললেন, তুমি অসময়ে শুয়ে আছ!

—আমার খুব শীত করছে বাবা।

—জ্বর আসবে মনে হয়? বলে তিনি বনির কপালে হাত রাখলেন।

—আমার ভীষণ শীত করছে।

—ডেবিডকে ডাকি। তোমাকে দেখুক। ওষুধপত্র যদি দিতে হয়!

বনি বাবাকে কিছু বলল না। কেবল তাকিয়ে থাকল। হিগিনসের মনে হল, বনির বয়স বাড়ছে। বয়স বাড়লে কখনও কখনও ভীষণ শীত পায়। তিনি ডেবিডকে ডাকতে পাঠালেন না। শীতটা কিছুক্ষণ পর হয়তো কেটে যাবে। তবু মেয়েটার জন্য কি যে কষ্ট থাকে ভেতরে। তিনি পাশে কিছুক্ষণ বসে থাকলেন চুপচাপ। কেউ কোনও কথা বললেন না। ডেবিডকে ডেকে পাঠালে হয়তো বনির বয়স ধরা পড়ে যাবে। ওর ভেতরে কষ্টটাও ধরা পড়বে। কার জন্য বনি ভেতরে এমন কষ্ট পায়। তিনি বুঝতে পারলেন না।

হিগিনস মেয়েটাকে কিছুতেই আর কিছু বলতে পারেন না। উঠে দাঁড়ান! ব্রীজে উঠে গেলে সমুদ্র চারপাশে। ব্রীজের উইংসে তিনি দাঁড়ান। অনবরত জাহাজটা জল কেটে যাচ্ছে। দু’পাশে সাদা ফেনা, অনেকদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ছে। নীল পোশাক পরে কোয়ার্টার মাস্টার হুইলের হাতল ধরে রেখেছে।

সন্ধ্যার সময় বনি ওপরে উঠে গেল। বনি বেশ কালো রঙের সুট পরেছে, নীল রঙের টাই, সে টুপি পরেনি। কাজের সময় সে কখনও কখনও সাদা দস্তানা হাতে পরে নেয়, এখন আর তাও নেই। শীতটা বেশ ক্রমে বাড়ছে। ঠান্ডা বাতাস সকালের দিকে ছিল, এখন নেই। জাহাজ ক্রমে আরও নিচে নেমে যাচ্ছে। জাহাজ ক্রমে গড়িয়ে গড়িয়ে একটা অতিকায় সাদা তিমি মাছের মতো জল কেটে ভেসে যাচ্ছে। এ-সময়ে তাকে বাবা ডাকেন না। সে এ-সময় আজকাল পাখি দুটোর পেছনে ঘুরে বেড়ায়। সে একা ঠিক না। মেজ-মালোম, ছোটবাবু আর সে। আরও কেউ কেউ আসে। তবে ওরা কেউ ঠিক এদের মতো পাখি দুটোকে নিয়ে মজা পায় না। যেন ওরা তিনজন তখন সমবয়সী বন্ধু। শীতের জন্য পাখি দুটিকে ওরা খড়কুটো বিছিয়ে দিয়েছে বাকসোটাতে। বাবা এ-সময়টাতে অন্যদিন একা একা চুপচাপ বসে আকাশের গ্রহ নক্ষত্র দেখেন, তাকে ডাকেন না, আজ কেন যে ডাকছেন!

সে পাশে গিয়ে দাঁড়ালে হিগিনস বললেন, বোস।

বাবার গলা খুব নরম। বাবার এমন গলা শুনলে ওর ভেতরটা গুড়গুড় করে ওঠে। কেমন বাবা ক্রমে ভীতু স্বভাবের হয়ে যাচ্ছেন। সে ভেবেছিল, বাবা তাকে আজ ভীষণ বকবে। বাবা ওকে একা পেতে চান। কিন্তু ব্রীজে, বাবা একা থাকতে পারেন না, সেখানে এখন কোয়ার্টার মাস্টার এবং থার্ড অফিসার আছে। ওদের ওয়াচ। বাবা সেখানে তাকে কোনা মন্দ কথা বলতে ডাকতে পারেন না। সে বসে পড়ল। চুলগুলো সে হাত দিয়ে দেখল, বেশ বড়, চুল বড় না থাকলে সে একেবারে ষোলআনা পুরুষের মতো হয়ে যায়। ছোটবাবু তখন ওর পাশে একেবারে ঘেসতে চায় না।

বাবা অনেকক্ষণ চুপচাপ থাকলেন। এনজিনের শব্দটা এখানে তেমন প্রবল নয়। আস্তে কথাবার্তা বললেও স্পষ্ট শোনা যায়। ওর ভাল লাগছে না। কেমন সে বসে উসখুস করছে। বাবা হয়তো টের পেয়েছেন। তিনি বললেন, বনি শান্ত হয়ে বোস।

বনি চুপচাপ বসে থাকল।

হিগিনস বললেন, তুমি নোয়ার নাম নিশ্চয়ই জানো?

—হ্যাঁ বাবা।

—নোয়ার আর্কই হচ্ছে পৃথিবীর প্রথম জাহাজ। এর আগে পৃথিবীর ইতিহাসে জাহাজ টাহাজের খবর আর পাওয়া যায় না। তখন সবে সভ্যতার উন্মেষ। এ-সব খবরও হয়তো রাখো।

—হ্যাঁ বাবা।

—কিন্তু তুমি কি জানো তোমার পূর্বপুরুষেরা কি ভাবে আগে সমুদ্র সফরে বের হত?

—কারা বাবা?

—এই আমাদের আগে যারা সমুদ্রে এসেছিলেন।

—তোমাদের আগে, মানে ডাবলিউ ফোর্ডের কথা বলছ?

—আরে না না। এই যেমন হোমারের বীর নায়কেরা সমুদ্র ঘুরে এসে কি সব বলত? —না বাবা।

—তারা সব নানারকমের গল্প বলত। তখন যারাই সমুদ্রে গেছে, ফিরে এসে নানারকম গল্প বলতো। সে-সব গল্প বলে ঠাকুমারা পর্যন্ত ভয় দেখিয়ে আমাদের ঘুম পাড়াতো। তখন সমুদ্র আমাদের কাছে একেবারে অজানা। আমাদের কথাই ধর না, যারা ভূমধ্যসাগর এবং বে অফ বিসকের কাছাকাছি ছিল, অর্থাৎ যারা এ-সব অঞ্চলে বসবাস করত ওরা আটলান্টিক বলে যে একটা সাগর আছে জানতই না। ওদের কতরকমের বিশ্বাস ছিল। যেমন হোমারের বীর নায়কেরা ইথাকাতে ফিরে কত বিচিত্র গল্প যে বলেছিল! ওরা নাকি সমুদ্রে এক আশ্চর্য ধ্বনি শুনতে পেত—প্ৰায় সেটা অবিকল সাইরেন বাজানোর মতো। শুনতে পেতো সমুদ্রে কারা ক্রমান্বয়ে সুন্দর মিউজিক বাজিয়ে যাচ্ছে। আবার তারা নানারকম দৈত্য দানবের গল্প বলত, মায়াবিনীদের গল্প বলত। কুহকিনীরা, সমুদ্রের ওপর নৃত্য করে বেড়াচ্ছে। বড় বড় পাথর সমুদ্রের জলে ভেসে বেড়াচ্ছে। কুহকিনীরা তার ওপর নেচে বেড়াচ্ছে। নাবিকেরা জাহাজ নিয়ে কিছুতেই আর তখন এগুতে পারত না।

—অথবা কিংবদন্তি ছিল, দক্ষিণ অঞ্চলে, অর্থাৎ সূর্যের দেশে, বিষুবরেখার দক্ষিণে জাহাজ যাবার নিয়মই নেই। সেখানে সমুদ্র বলে কিছু নেই। একরকম মানুষ সেখানে বাস করে-যারা কেবল পোকা মাকড়ের মতো লাফায়। ওদের আহার নিদ্রা বলে কিছু নেই। অথবা কেউ কেউ বলত, সেখানে বড় বড় ষাঁড় ঘুরে বেড়ায়। ওদের নিঃশ্বাসে আগুন লক লক করত।

বনি বুঝতে পারছে না, বাবা হঠাৎ এমন সব প্রাচীনকালের গল্প বলে যাচ্ছেন কেন। বাবা অবশ্য যখন যেখানে গেছেন বনিকে নিয়ে, সমুদ্রের অভিজ্ঞতার কথা দ্বীপের কথা কখনও বলতেন। কখনও সমুদ্রের প্রাচীন ইতিহাস নিয়ে বাবার মাথাব্যথা ছিল না।

তখনও হিগনিস বলে যাচ্ছেন, সমুদ্রে কিছুদূর গেলেই এক শয়তানের কালো হাত দেখা যেত। সেই হাত ওপরে ভেসে সাপের মতো দুলত। বলত, আর না। ফিরে যাও। অথবা একরকমের শামুকের খোল ভেসে বেড়াতো হাওয়ায়, তাদের ভিতর সব বিষাক্ত ধোঁয়া। জাহাজ আর এগুতে পারত না। সেখানে ঢুকলে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসত জাহাজিদের। অবশ্য আমাদের প্রাচীন অভিজ্ঞতা সমুদ্র সম্পর্কে ক্রমে ভেঙে যায়। আমরা জানতে পারি সমুদ্র বিশাল, জানতে পারি আটলান্টিক বলে এক মহাসাগর আছে, আমাদের সব নাবিকেরা ক্রমে বের হয়ে যায়, পৃথিবীর কোন কোন জায়গায় সমুদ্র কি-ভাবে আত্মগোপন করে আছে দেখতে।

কাপ্তান-বয় কফি রেখে গেল। দু কাপ। সামান্য ফল। কাপ্তান সামনের সমুদ্র দেখছেন। মাস্তুল পার হয়ে জাহাজের মাথা কেমন সোজা একটা টর্পেডো বোটের মতো, আর পেছনে আফটার-পিক পার হয়ে প্রপেলারের ক্রমাগত সাদা ফেনা এ-জ্যোৎস্নায়ও দেখা যায়। তখনই মনে হয়, সমুদ্র মনোহারিণী। তিনি বোধ হয় সমুদ্র-মনোহারিণী বলার জন্য, এতসব পুরানো কথা বনিকে বলে যাচ্ছেন। অথবা তিনি কি বলতে চান, বনি, জীবন হচ্ছে মনোহারিণী। তাকে অবহেলায় নষ্ট করে দিও না। তোমার ইচ্ছেটা যখন ভেতরে পাগলা ঘোড়ার মতো দামাল হয়ে যায়, তখন সমুদ্র দ্যাখো। সমুদ্র দেখলে ভেতরের কষ্ট একেবারে মুছে যাবে। কেননা, সমুদ্র সেই কবে থেকে, কেউ বলতে পারে না, পৃথিবীতে .অথবা সৌরজগতে বড় সে একা! একাকী সে, আছে তার মতো, সে কখনও উত্তাল তরঙ্গমালার ভেতর আকাশের নক্ষত্রদের ছুঁয়ে দিতে চায়, তার কি যে প্রলোভন তখন। সে কখনও চুপচাপ। নিরীহ শান্ত। আকাশের নক্ষত্রেরা তার বুকে প্রতিবিম্ব ফেলে সারারাত জেগে থাকে। অথবা দর্পণে নিজের মুখ দেখতে পায় বোধহয়! অথবা ভেবে দ্যাখো, কত গাছপালা পাখি, সমুদ্রের উপকূলে কত দীর্ঘকাল ধরে নির্জনে তাদের ছায়া ফেলে যাচ্ছে। একটা ফড়িঙ অথবা প্রজাপতির ছায়া পর্যন্ত বাদ পড়ে না। কত রঙীন দ্বীপমালা নিশীথে উত্তাল তরঙ্গের ভেতর ডুবে থাকে। পৃথিবীর সব সুন্দরীদের গলায় যে মহামূল্য মণিমাণিক্য ঝলমল করছে, সমুদ্রের কোন গহন অন্ধকারে তাদের জন্ম হচ্ছে, লক্ষ লক্ষ বছর ধরে এরা জন্মাচ্ছে, নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, সমুদ্রের কিছু আসে যায় না। অথবা সেইসব মনস্টার, যারা এখনও সমুদ্রের ওপরে ভেসে ওঠেনি, যারা সূর্যের আলো সহ্য করতে পারে না—কে জানে, কত অতিকায় তারা। সীমিত অভিজ্ঞতায় তার কতটুকু খবর আমরা রাখি। সমুদ্রের শান্ত গভীর অন্ধকারে কি মহিমায় যে ওরা ঘুরে বেড়াচ্ছে কে জানে। অথবা বনি চারপাশে দ্যাখো, সমুদ্র তার বিশাল অস্তিত্ব নিয়ে জেগে আছে। সে পৃথিবীর এতটুকু ক্ষতি করে না। সে তো ইচ্ছে করলেই যা ডাঙা আছে নিমেষে গ্রাস করে ফেলতে পারে। কিন্তু কি মায়া দ্যাখো বনি, সে ডাঙার চারপাশে নিয়ত ফুঁসে বেড়াচ্ছে, কখনও অতীব শান্ত প্রায় করজোড়ে যেন বলছে, আমাকে নাও, চঞ্চলা হয়ে বলছে, আমার কি আছে, কেবল তুমি আছো।

—অথবা বনি, আরো আশ্চর্য দ্যাখো, সমুদ্র তার নিজের অসীমতা নিয়ে জেগে আছে। তার অস্তিত্ব কখনও কমে না, বাড়ে না। জল বাষ্প হয়ে উড়ে যায়, মেঘেরা ভেসে বেড়ায়, যেন বাদাম তুলে চঞ্চলা তরণীর মতো সে তখন নিজের বুকে নিজেই ভাসতে ভাসতে চলে যায়। চারপাশে যা কিছু ডাঙা আছে, সেখানে তার বৃষ্টিপাত ফসল ফলায়, যত আবর্জনা রয়েছে, সে-নদী উপনদী ধরে তাকে বুকে. বহন করে আনে। এর জন্য তার কোন দুঃখ নেই বনি। পৃথিবীর জন্য তার কি যে মায়া। সব কিছু সে দিয়ে পৃথিবীর হয়ে বেঁচে আছে। বলেই তিনি সহসা মুখ ফেরালেন। তোমার কোন কষ্ট আছে?

—না বাবা।

—কষ্ট থাকলে, এই সমুদ্র দেখবে। পৃথিবীতে এর চেয়ে উদার, মহৎ এবং নিরিবিলি স্বভাবের আর কিছু নেই। আর সমুদ্র যে-ভাবে পৃথিবীকে ভালবাসতে জানে, আর কে আছে তেমন। তোমার যদি কিছু ভাল লেগে থাকে, তুমি যদি মনে করে থাক, ঠিক করছ, আমার কোন অমত থাকবে না। তবে যাই করবে, ভেবে করবে, বুঝতে না পারলে, অনেকক্ষণ, যত বেশি সময় হয় ততই ভাল, দাঁড়িয়ে থাকবে রেলিঙে। দেখবে, কেমন সূর্যাস্তের সঙ্গে তোমার ছায়া লম্বা হয়ে সমুদ্রের অনেক দূরে চলে যাচ্ছে। তখন একবার সমুদ্রকে জিজ্ঞাসা করতে পার, ঠিক করছ কিনা, সে কাউকে বনি, মিথ্যা বলে না।

বনি বুঝতে পারল, সে বাবাকে মিথ্যা কথা বলেছে। বাবা টের পেয়েছেন। বাবা মনে মনে ওর ব্যবহারে হয়ত রুষ্ট হয়েছেন। সমুদ্রের কথা বলে, বাবা তাকে শাসন করছেন। বাবাকে সে কখনও ওর প্রতি কঠোর হতে দেখেনি। এ-জন্য বাবা তাকে ডেকে এনেছিলেন। সে কফি খেয়ে উঠে পড়ল। বেশ রাত হয়েছে। ডাইনিং হলে ডিনার সাজানো হচ্ছে। সাদা জ্যোৎস্না বাবার পায়ের কাছে পড়েছে। বাবাকে তখন খুব একা এবং নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছে। বাবাকে ফেলে কেন জানি তার যেতে ইচ্ছা হল না। সে বাবার পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল। সমুদ্র দেখতে দেখতে বলল, আমি কখনও কষ্ট দেব না বাবা। কাল আমার চুল কেটে দিও। আমি আর পালিয়ে বেড়াব না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *