অলৌকিক ইস্টিমার
হুমায়ুন আজাদ
যাও রিকশা, যাও
যাও রিকশা, যাও, হুমায়ুন আজাদের মন্দির
হুমায়ুন আজাদ, কবি, কবিদের ঠিকানা হৃদয়স্থ রাখতে হয়
সকলের, শুধু কবিদেরই স্থায়ী নিজস্ব ঠিকানা রয়েছে।
এ-মাটিতে এই জলে এ-আগুনে কবি ছাড়া সবাই উদ্বাস্তু ঠিকানাবিহীন,
কবি ছাড়া কে আর নিজের ঘরের মতো দেখে সব ঘর,
এমন সহজে কে আর পাতার সবুজ ছেঁকে গ’ড়ে তোলে মরমী মন্দির!
যাও রিকশা নীল রিকশা সবুজ রিকশা অচিন রিকশা যাও
যে-কোনো গলিতে রাজপথে গৃহহীনতায় নামিয়ে দিলেই
দেখবে আমি স্মিত হেসে ঢুকছি নিজের মন্দিরে
নামাতে পারো তুমি জীর্ণ বস্তিতে ঝলসানো বারান্দার সামনে
আবাসিক এলাকায় পতিতা পল্লীতে দেখবে ঢুকছি স্বমন্দিরে
ধাবমান যানবাহনের মুখোমুখি দিতে পারো আমাকে নামিয়ে
দেখবে গাড়ির টায়ার হেডলাইট দীপাবলি হয়ে গেছে
আমাকে নামাতে পারো হরতালে উদ্যানে মরুভূমিতে
রিকশা নগর আলোকমালা চলচ্চিত্র উড়োজাহাজের সীমানা পেরিয়ে
একটি গাছের সামনে এসে বলতে পারো, ‘আপনার মন্দির, নামুন।’
দেখবে গাছ তার খুলছে দরোজা ঝুলছে জানালায় সবুজ কার্টন
আমার স্থায়ী শয্যা দেখা যাচ্ছে ভেতরে,
যাও, রিকশা, যাও। কবিদেরই শুধু স্থায়ী নিজস্ব ঠিকানা রয়েছে।
*
হুমায়ুন আজাদ
আব্বার খোলায় ধান মায়ের কোলেতে আমি একই দিনে
একই সঙ্গে এসেছিলাম। আড়িয়ল বিল থেকে সোনার গুঁড়োর মতো
বোরোধান এলো, ঘোড়ার পিঠের থেকে ছালার ভেতর থেকে
গড়িয়ে পড়লো লেপানো উঠোনে, তখনি আতুড় ঘরের থেকে দাদি চিৎকার
ক’রে উঠলেন, ‘রাশু, রাশু, তোর ঘরে এইবার সোনার চানই আইছে।’
কিছু দিন পর
বাড়ির উত্তর ধারে আকাশ ফেড়ে ওঠা কদম গাছটার উচ্চতম ডালে
একটি চানতারা আঁকা নিশান উড়িয়ে আমার আব্বা ব’লে উঠলেন, ‘এতো দিনে
স্বাধীন হইলাম।’ মায়ের বাহুতে আমি গাছের মাথায় চানতারা
আব্বার গলায় মেঘের মতোন শব্দ–‘পাকিস্থান জিন্দাবাদ’।
আব্বা, লাল তাজা রক্তের মতোই কোলাহলময়। তাঁর প্রেমে ধান
জমি গৃহ স্ত্রী দেশ একাকার। আঠারো বছর বয়সে আব্বা যে
ত্রয়োদশী কিশোরীর প্রেমে পাগল হয়ে ইস্কুল ছাড়লেন,
সে-কিশোরী আমার জননী। আব্বা, আরো এক প্রেমে, কিশোরীর
প্রেমের মতোই তীব্র প্রেমে ‘লড়কে লেংগে’ ব’লে পাড়া গ্রাম থানা মাতাতেন।
জিন্নাকে দেখেন নি কোনো দিন, জিন্নার জবান বোঝেন নি কখনো,
তবু বুঝেছিলেন দেশ চাই, কিশোরীর দেহের মতোন একান্ত স্বদেশ।
যে-কিশোরী আমার জননী তার অভাবে আঠারো বছর বয়সে
আব্বা হাসিমুখে বিষ ঢেলে দিতে পারতেন গলায়,
পারতেন প্রতিদ্বন্দ্বীর মাথা ভেঙে দিতে,
তেমনি পারতেন তাঁর সাধের দেশের জন্যে বুকে নিতে ছুরির আঘাত।
আব্বা, যিনি কোনো দিন রাড়িখাল ছেড়ে উনিশ মাইল
দূরে ঢাকায় আসেন নি।
ঢাকা এসে কী লাভ, রাড়িখালই সব।
আমি পাকিস্তানের সমান বয়সী। স্বাধীনতায় আমার কোনো
দরকার ছিলো না ১৯৫৭ পর্যন্ত। ১৯৫৮-তে যখন সপ্তম শ্রেণীতে পড়ি,
হাফপ্যান্ট ছাড়িছাড়ি করি, হঠাৎ একলা দুপুরে আমার
স্বাধীনতা দরকার হয়। চিৎকার করে বলি, স্বাধীনতা চাই।
ঘাটে মাঠে সারা বঙ্গে খুঁজে দেখি স্বাধীনতা নাই।
একরত্তি বাচ্চা আমি মায়ের স্তনের ফাঁকে নিশ্চিন্তে ঘুমোই।
ঘুম ভাঙে হামাগুড়ি দিয়ে, হাত রাখি আব্বার পকেটে, তাঁর কান টানি
দুলি মায়ের দীর্ঘ চুলের দোলনায়, ঘুম ভাঙলে জেগে দেখি
আমি হুমায়ুন, বয়স সাড়ে পাঁচ/ছয়।
পুকুরে ভাসছে হাঁস শাপলার থরোথরো ফুলের মতোই
আমার ইজার ভরে কাটাতৃণে, প্রতিদিন
শরীরের কোনো অংশ না কাটলে ঘুমোতে দেরি হয়ে যায়
কোন দিকে বয় নদী খরাক্রান্ত নির্জল বাঙলায়?
তারা কই? বাল্যকালের আমার সাথীরা কই?
এক দুপুরে ইস্কুল থেকে ফেরার পথে বিবির পুকুর পারে
জল দেখে লোভে পড়ি, বইশ্লেট রেখে শার্ট ইজার খুলে নেমে যাই জলে
আমার ক্লাশের সাথী রাজিয়া, যে আমার ইজার হরণ ক’রে খলখল
ক’রে দৌড়ে পালিয়েছিলো, আমি জল থেকে উঠতে পারি নি;
সে কই? কে আজ তার বস্ত্র হরণ করে মাঝরাতে, বৃষ্টির দুপুরে?
শেফালিরা দেশ ছেড়ে গেলো।
শেফালি অন্নদা স্যারের মেয়ে শেফালি নীলাদির ছোটো বোন
শেফালি যার সঙ্গে আমি কমপক্ষে এক হাজার দিন ন্যাংটো নেয়েছি
শেফালি যে আমার সমবয়সী শেফালি যে ফ্রক ইজার পরতো
শেফালি যার তখন বুক উঠছে
শেফালি আমি যার পেয়ারার মতো বুক উঠতে দেখেছি
সেই শেফালিরা চ’লে গেলো।
মুসলিম লিগের রহমৎ খাঁ, যার মাথায় জিন্না টুপি জিন্নার মতোই
শোভা পেতো, তার সাথে শেফালিকে সাতটি
রাত কাটাতে হয়েছে। ফয়জনরা এলো রাড়িখাল।
তারা আসাম না ত্রিপুরার কোথায় থাকতো।
আসার কয়েক মাস পর ফজু যার বিয়েই হয় নি
বাচ্চা বিয়োতে গিয়ে মারা গেলো।
বাচ্চাটি হয়তো কোনো দেশপ্রেমিক কংগ্রেস নেতার।
শেফালি কি বেঁচে আছে?
চারপাশে ডানে বাঁয়ে ভাঙছেই কেবল।
আমার বাল্যকালে আমি কিছু গড়তে দেখি নি
না সড়ক না ব্রিজ না কুটির না ইস্কুল
চারদিকে ভাঙছেই কেবল
মাত্র একটি গড়া আমার বাল্যকাল দেখতে পেয়েছে
সে-স্মৃতি রক্তের দাগের মতো লেগে আছে আমার ভেতরে
জেলাবোর্ডের ভাঙা সড়ক দিয়ে একটি প্রচণ্ড স্রোত গেলো মানুষের
ছোট্ট আমি বুঝতে পারি নি কেনো মানুষেরা এমন প্রচণ্ড নদী
এমন লেলিহান আগুন হয়ে ওঠে
সেই আমার জীবনের আদি স্রোত জীবনের প্রথম আগুন
তারা রাষ্ট্রভাষা বাঙলা চেয়ে ভাঙা সড়ক দিয়ে কোন দিকে গেলো?
আমি তা বুঝতে পারি নি। আজ বুঝি তারা গিয়েছিলো আমারই
ভবিষ্যতের দিকে।
আমার বাল্যকাল রাজিয়া কায়সার বিল্লাল হারুন
আমার বাল্যকাল জোনাকির গুচ্ছ মাছ লম্বা ইস্কুল
আমার বাল্যকাল স্তব্ধ নদীর তীর নৌকো কাদা বালি
আমার বাল্যকাল দুঃস্বপ্নের গর্ভে ফোটা ভয়ঙ্কর ফুল
বাঙলাদেশ বিবর্ণ হচ্ছে সাথে সাথে আমি ও ধূসর
আদর্শলিপির পৃষ্ঠার মতোন ফ্যাকাশে
আব্বার খোলায় ঘোড়ার আনাগোনা ক’মে গেছে
মায়ের বাহুতে সেই শিহরণ নেই
আব্বার চোখ আগে ভিটার শব্জির মতোই সবুজ ছিলো
সেখানে নামলো ধূসরতা বুকে পোড়া ঘাস
মায়ের বুকের মধ্যে কনিষ্ঠ পুত্রের লাশ
এর মাঝে পাকিস্থান ম’রে গেছে পোকারা কেটেছে পতাকা
টিনের বাক্সের মধ্যে
দুর্দান্ত বাঘের পিঠে চেপে আমি ইস্কুল ছেড়ে কলেজে এলাম
চারদিকে মত্ত হাওয়া কালাকানুন রক্ত ১৪৪ ধারা
সামনে সুদীর্ঘ রাত্রি দীর্ঘ পারাবার
রক্তের লাল রঙ বুলেটের থেকে বেশি ধার
এলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। অনেক বাগান
জ্বলে গেছে। চ’লে গেছে অনেক বাউল।
বাতিস্তম্ভ থেকে খসে গেছে আলো।
চারদিকে অন্ধকার, সারাদেশ ঘুমহীন স্তব্ধ নিঃশ্চুপ,
রক্ত খাচ্ছে দশ দিকে এনএসএফ মোনেম আইউব।
বিশ্ববিদ্যালয় স্বপ্ন–ভগ্নস্বপ্ন পুনর্নির্মাণ
বিশ্ববিদ্যালয় আশ্চর্য দুরূহ আলোক
বিশ্ববিদ্যালয় কয়েকটি অপার্থিব অমিতাভ গান
রাজনীতি, বুকের বন্ধুরা গেলো কারাগারে
শ্লোগান, রক্তের বিনিময়ে ফিরিয়ে আনবো তাদের
কবিতা, প্রদীপের মতো জ্বলে সবুজ হীরক
এলো প্রেম প্রেম এলো
দূর দেশ থেকে এলো অনিন্দ্য চন্দন
বন্ধুরা সবাই অত্যন্ত তৃষ্ণার্ত
ঠোঁট দিলো ঠাণ্ডা প্রেমে।
ডালপালা থেকে কিছু ফুল এলো নেমে
বুকে ও বুকপকেটে। কেউ কেউ প্রেমের কামড় ভুলতে দল বেঁধে
গেলো পতিতাপল্লীতে, ফিরে এলো তৃপ্ত হয়ে। রফিক শরমিন
কোর্টে গিয়ে ছাপ মেরে পাকা ক’রে নিয়ে এলো
অবিনশ্বর প্রেম গৃহনির্মাণের প্রতিশ্রুতি। তাও টিখলো না।
আমার নিকট এলো প্রেম হাতে নিয়ে শোক কষ্ট অবিশ্বাস
দীর্ঘশ্বাস অদ্রি নিশীথ। আমি প্রেমে আর কামে জ্ব’লে
জ্ব’লে নিজের রক্তের দুধে প্রস্তুত ক’রে
চললাম আশ্চর্য গরল।
কিন্তু প্রেম, আজো স্বীকার করি, আমার নিকট বড়োবেশি ছিলো।
বিশ্বাস, কবিতা পড়তে ভালো লাগা, ছন্দ মেলানো,
প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান পাওয়া,
তার চেয়ে বড়ো বেশি ছিলো প্রেম, বড়োবেশি
ছিলে তুমি, আমার বিষাক্ত প্রেম, ব্যর্থ ভালোবাসা।
আজো কি তা আছে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ?
চশমার কাচ ভারি হচ্ছে দিন দিন
সুপ পোচ মাংস যদিও খাচ্ছি তবুও আমি শুকিয়ে যাচ্ছি
এবং শুকোচ্ছে বহু কিছু।
শুকোচ্ছে জলের নদী, কবিতার থেকে দূরে যাচ্ছি, মানুষের থেকেও
উদ্যমপরায়ণ ছাত্রীও আর জাগায় না উল্লাস
রবীন্দ্ররচনাবলি বুকে নিয়ে ঘুমিয়েছি মনে পড়ে
আজ ফেরিঅলার ডাক শুনলেই বেচে দিতে ইচ্ছে হয়
ঘুমোতে দেরি হয় উঠতে দেরি হয়
ক্লাশে যেতে দেরি হয় বাসায় ফিরতে দেরি হয়
ক্লাবে যেতে দেরি হয় বাসায় ফিরতে দেরি হয়
এলো ২৫ মার্চ ১৯৭১
যে-কোনো কারণে মারা যেতে পারতাম। আমি বাঙালি,
বাঙলা পড়াই, ভাত খাই, প্রেমে পড়ি, ব্যর্থ হই, রাত্রে ঘুমাতে
দেরি হয়, আমি মানুষ, এর যে-কোনো একটির জন্যে রাষ্ট্রদ্রোহী
বিবেচনায় আমাকে নিয়ে যেতে পারতো ওরা বধ্যভূমিতে।
বেঁচেছিলাম একটি আলোর জন্যে যা এসে পৌঁছলো ষোলোই ডিসেম্বর।
‘জয় বাঙলা’, চিৎকার করে উঠি, ‘এতো দিনে স্বাধীন হলাম।’
আমার সন্তান আজো জন্মে নি। যদি জন্মে
সে কি জন্মেই পাবে স্বাধীনতা? আমার বাবার
স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়েছিলো আমার জীবনে।
আমার স্বাধীনতা কী রকম হবে আমার সন্তানের জীবনে?
নাকি তাকেও বলতে হবে আমার মতোই কোনোদিন,
‘এতো দিনে স্বাধীন হলাম।’
আমার সন্তান কি চাইবে জানি না। পরবর্তীরা সর্বদাই
অধিক সাহসী, তাদের চাহিদা অধিক।
আমি চাই আমার আলোক সত্য হোক তার মধ্যে
আমি শুধু চাইতে পারি তার মধ্যে সত্য হোক আমার জ্যোৎস্না।