অলৌকিকতাকেও হার মানায়

অলৌকিকতাকেও হার মানায়

লিপা উপত্যকা। সাড়ে নয় হাজার ফিট উচ্চতা তার। সাড়ে নয় হাজার ফিট উঁচু পাহাড়ের চূড়া সেটা। লিপা উপত্যকা নাম তার। কিয়ান উপত্যকাও বলা হয় একে। পাহাড়ের পাদদেশে এই নামেই একটি গ্রাম আছে। সৌন্দর্য মুগ্ধতা আর মনোলোভা দৃশ্যের অপার প্রদর্শনী এই উপত্যকা।

লিপা উপত্যকা আযাদ কাশ্মীরের করনাহ উপত্যকার এক তৃতীয়াংশ জায়গা জুড়ে রয়েছে। এ উপত্যকা দৈর্ঘ্যে চৌদ্দ মাইল আর প্রস্থে আট মাইল। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা পাঁচ হাজার ফিট। আর পাহাড়ের উচ্চতা আট হাজার ফিট থেকে চৌদ্দ হাজার ফিটেরও অধিক।

ভৌগোলিক দিক থেকে এ উপত্যকার অবস্থান এরকম। উত্তর প্রান্তে রয়েছে চৌদ্দ হাজার ফিট উঁচু শামসবারী রেঞ্জ নামক পাহাড়, যা সারা বছর বরফে আচ্ছাদিত থাকে। দক্ষিণ প্রান্তে রয়েছে সাড়ে বার হাজার ফিট উঁচু কাযীনাগ পাহাড়। পশ্চিম প্রান্তে রয়েছে দশ হাজার ফিট উঁচু পাঞ্জাল গালি, ভারতওয়ার গালি ও খন্ডায়াস্তাদাহ পাহাড়।

আকাশ ছোঁয়া এই পাহাড়গুলো লিপা উপত্যকাকে কেল্লার প্রাচীরের মতো ঘিরে রেখেছে। এই উপত্যকার অধিবাসীদের অধিকাংশই কিয়ানি বংশের মুসলমান। এ কারণে কিয়ান উপত্যকা হিসাবেই এ উপত্যকার পরিচিতি বেশী। যার কারণে এ উপত্যকা ইতিহাসের পাতায় সমুজ্জল আছে। তিনি কর্নেল কিয়ানি শহীদ। তবে তিনি এই কিয়ান উপত্যকার কেউ নন। তিনি দূরের জাদ্দাহ নামক এক অখ্যাত গ্রামের লোক।

বছরের প্রায় আট মাস পাঞ্জালগালি ও ভারতওয়ার গালি পর্বতের আশ পাশের জমি থেকে লোকেরা খানিকটা ফসল ঘরে তুলতে পারে। আর বাকী চার মাস পুরো এলাকা বরফে তলিয়ে যায়। লোকদের জীবন নির্বাহের পথ বন্ধ হয়ে যায়। মানব জীবন এখানে নীরব– নিস্তব্ধ হয়ে যায়। সেখানে কারো প্রাণচাঞ্চল্য থাকলে তা কেবল আযাদ কাশ্মীরের বীর সেনাদের থাকে। যারা এই বরফে ঢাকা দুনিয়ায় কেবল জীবনদীপ্ত থাকে না বরং তাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব তারা অত্যন্ত সচেতনতার সঙ্গে পালন করে।

বরফে ডুবন্ত উপত্যকা ও পাহার চূড়ার উপর তাদের ঈগল দৃষ্টি সব সময় সচকিত থাকে। কারণ, শত্রুর কুদৃষ্টিও সব সময় আযাদ কাশ্মীরের এই উপত্যকা ও পর্বত চূড়ার ওপর আঠার মতো লেগে থাকে। দখলদার ভারতীয়রা শুরু থেকেই কিয়ান উপত্যকা দখলের নীল নকশা তৈরী করে যাচ্ছে। কারণ, এ উপত্যকার প্রতীক্ষীয় ও ভৌগোলিক গুরুত্ব অনেক। রাবার ও কাঠ গাছের অভয়ারণ্য হওয়াতে বাণিজ্যিক গুরুত্বও কম না।

১৯৭০এর শেষ দিকের ঘটনা। ইসলামের শত্রুরা বিশাল শক্তি নিয়ে আক্রমণ করে এ উপত্যকায়। কিন্তু আযাদ কাশ্মীরের হাতে গোনা কিছু সৈন্য তাদের আক্রমণ ব্যর্থ করে দেয়। শুধু তাই নয়, শক্র আক্রমণ প্রতিহত করতে গিয়ে শত্রুর দখলকৃত একটি এলাকা দখল করে নেয়। এলাকাটির নাম জম্মু বিলিজ। ভারতীয় হিন্দু জঙ্গীদের আস্তানা ছিলো সেটা। জম্মু বিলিজ বেদখল হওয়াতে তাদের রসদ ও গোলা বারুদের সহজ সরবরাহ এক প্রকার বন্ধ হয়ে যায়।

এখন তাদের রসদ সগ্রহ করতে হলে প্রায় চার-পাঁচ দিনের পথ ঘুরতে। হবে। আর সে পথের প্রায় সবটাই হাজারো ফুট উঁচু বরফে মোড়া পাহাড় বাধার প্রাচীর হয়ে আছে। ওদের যোগাযোগের মাধ্যম টেলিফোনের তারও সে পথে গিয়েছে। সেটাও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।

স্বাধীনতাকামী মুক্তিযোদ্ধা ও শত্ৰুদলের মধ্যে যখন গোলাগুলি শুরু হলো তখন জম্মু বিলিজ মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি ডিভিশন শত্রু পক্ষের প্রায় বেষ্টনির মধ্যে পড়েছিল। মুক্তিযুদ্ধাদের সে পোষ্টে রসদ সরবরাহের পথ এমন দুটি পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে অতিক্রম করেছে যা দুশমনের দখলে ছিলো। তবে সে পথের মধ্যবর্তী এক পথ দিয়ে চোরা একটি নদী যাচ্ছিলো। কৌশলে এই নদী পথে রেশন পৌঁছানো হচ্ছিল সেই শত্রু পরিবেষ্টিত মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে। কিন্তু দুশমনের কাছে তাদের ক্যাম্পে রসদ পৌঁছানোর এমন বিকল্প কোন পথছিলো না।

১৯৭২ এর এপ্রিলের শুরুতে ভারতীয় শত্রু বাহিনী মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারদের কাছে চিঠির মাধ্যমে অনুরোধ করলো, জম্মু বিলিজ থেকে তাদেরকে রসদ সরবরাহের পথ ও টেলিফোনের তার স্থাপনের সুযোগ যেন দেওয়া হয়। এ যেন মামার বাড়ির আবদার। মুক্তি কমান্ডাররা এপ্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করলেন।

৭২এরই ২৭ এপ্রিল ভারতীয় জঙ্গিবাহিনী গায়ের জোরে তাদের পছন্দ মতো এলাকা ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করালো। জম্মু বিলিজের দুটি গুরুত্বপূর্ণ পোষ্ট গুরসী ডানা ও গিডডী পাথার এর ওপর প্রচন্ড গোলা বর্ষণ শুররা করলো। তারপর রীতিমতো যুদ্ধাংদেহী রণ কৌশলে হামলা শুরু করলো। পোষ্ট দুটিতে আযাদ কাশ্মীরের কেবল একটি করে প্লাটুন সৈন্য ডিউটিরত ছিলো। দুশমনের সংখ্যা ছিলো সে তুলনায় প্রায় তিনগুণ। স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছিলো আযাদ কাশ্মীরের এই পোষ্ট দুটি স্বল্প সময়ের মধ্যেই হানাদারদের দখলে চলে যাবে।

কিন্তু মুক্তিকামী সেনারা এমন ঈমানদীপ্ত জযবায় জবাবী হামলা চালালো, দুশমন পিছু হটতে বাধ্য হলো। দুশমনের এ প্রচেষ্টা যখন ব্যর্থ হলো তখন মুক্তিবাহিনীর সেই পোষ্টের রসদ সরবরাহের পথ বন্ধ করে দিলো। বীরুওয়ালী নাড় সেই পোষ্টের নাম। অথচ যুদ্ধবন্দি চুক্তির সময় থেকে এপথ আষাদ কাশ্মীরের সীমানাভুক্ত। মূলতঃ বীরু ওয়ালী নাড় মুক্তি বাহিনীর দুর্বল একটি ক্যাম্প। কারণ, এর তিন দিকের উচ্চতায় শত্রুরা সবসময় মোর্চা বদ্ধ হয়ে থাকে। তিন দিকের শত্রু বাহিনীর তিনটি অতি শক্তিশালী ক্যাম্প রয়েছে। সে শক্তির দাপটেই বীরু নাড়ের সৈন্যদের রসদ সাপ্লাই বন্ধ করে দিয়েছে।

স্থানীয় কমান্ডাররা উভয় পক্ষের মধ্যে সমঝোতা কনফারেন্স করার সিদ্ধান্ত নিলো। শত্রুপক্ষ থেকে ৯নং শিখ রেজিমেন্ট থেকে এলেন কমান্ডিং অফিসার চাঙ্গাপা আর এদিক থেকে গেলেন কর্নেল হক নেওয়ায় কিয়ানী।

শত্রু দলের কমান্ডিং অফিসার কর্নেল চাঙ্গিয়া কনফারেন্সের শুরুতেই দাবী করলেন, তাদেরকে জম্মু বিলিজের রাস্তা দিয়ে দিতে হবে। তার এই দাবীর সুর অনুরোধের নয়, বরং স্পষ্ট হুমকির। কর্নেল হক নেওয়ায কিয়ানী চ্যালেঞ্জ গ্রহণের দৃঢ়তায় তার দাবী প্রত্যাখ্যান করলেন। এই কনফারেন্সটি অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭২ সালে। দুই কর্নেলের দ্বিতীয় সাক্ষাৎ ঘটে একই বছরের ৩ মে।

দ্বিতীয় সাক্ষাতে কর্নেল চাঙ্গাপা কর্নেল হক কিয়ানী কে বললেন, আমাদের ব্রিগেড কমান্ডার বলেছেন, আযাদ কাশ্মীরের ফোর্স যেন বীরুওয়ালী নাড় ক্যাম্পটি খালি করে দেয় অথবা জম্মু বিলিজের গিড্ডীর পাথর ক্যাম্প ছেড়ে চলে যায়। না হয় আমরা বীরু ওয়ালী নাড় এর পথ খুলবো না।

কর্নেল হক নেওয়া কিয়ানী অসম্ভব শীতল দৃষ্টি হেনে তাকালেন কর্নেল চাঙ্গাপা এর দিকে। চাঙ্গাপা সে দৃষ্টির সামনে যেন কেঁপে উঠলেন। তার সে দৃষ্টি– অন্যদিকে কিরিয়ে হক কিয়ানী বললেন, আমরা নিজেরাই রাস্তা খুলে নিবো। একথা বলে কর্নেল কিয়ানী উঠে দাঁড়ালেন।

তাহলে প্রথম গুলি আমাদের রাইফেল থেকে বের হবে না। কর্নেল চাঙ্গাহা দ্রুত হেসে বললেন।

কর্নেল এমন ভাব করলেন যেন তার কথা শুনতেই পাননি। বা শুনলেও কিছু এসে যায় না এতে। তিনি চলে গেলেন। তার সঙ্গে ছিলেন মেজর ইতশতিয়াক আহমদ ও মেজর ইয়ার আফজাল আফরিদী।

কর্নেল কিয়ানী তার অধীনস্ত অফিসারদেরকে, জোয়ানদের বেটা বলে সম্বোধন করতেন। তিনি সেনা ক্যাম্পে ফিরে এসে মেজর ইশতিয়াক ও মেজর আফ্রিদীকে বললেন।

দেখো বেটা! আমরা নিজেরাই আমাদের পথ খুলে নিতে পারবো ইনশাআল্লাহ। তার গলায় এমন দৃপ্ত উচ্চারন ছিলো যে। দুই মেজরও দারুণ সংকল্পবদ্ধ হয়ে উঠলেন।

রাতেই এগারটা পঞ্চান্ন মিনিটে শত্রুদল আযাদ কাশ্মীরের মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পগুলোতে মুহুর্মুহু গুলি বর্ষণ শুরু করলো। ভোর ৪ টার দিকে দুশমনে ৪নম্বর মহার রেজিমেন্ট আজ কাশ্মীরের বীরুওয়ালী নাড় এর ওপর এলোপাথাড়ি আক্রমণ শুরু করলো। এ ক্যাম্পটি আগ থেকেই শক্রদলের ঘেরাও এর মধ্যে ছিলো। তার ওপর দুশমন কয়েক দিন থেকেই সে ক্যাম্পের রসদ সরবরহের রাস্তাও বন্ধ করে রেখেছিলো।

সে ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন জাভেদ আনওয়ার। যার কাছে রেশন তো ছিলোই না। ইমোনেশনও ছিলো সীমিত। তবুও তার উপস্থিত বুদ্ধি-কৌশল ও বীরত্বপূর্ণ নেতৃত্বে জোয়ানরা পাল্টা জবাব দিতে পুরো করলো।

শত্রুপক্ষ নিশ্চিত ছিলো ইমোনেশন খতম হলেই ক্যাপ্টেন জাবেদ আনওয়ার আত্মসমর্পণ করবেন বা ক্যাম্প ছেড়ে তার বাহিনী নিয়ে পালিয়ে যাবেন।

অবস্থা দৃষ্টে তাই মনে হচ্ছিলো। কিন্তু আযাদ কাশ্মীরের এই যুবক ক্যাপ্টন ও তার মুষ্টিমেয় জোয়ানরা জানবাজি রেখে লড়তে লাগলো। কর্নেল হক নেওয়াজ কিয়ানী তৎক্ষনাৎ জবাবী হামলার প্ল্যান ঠিক করে ফেললেন। সেটা তার ব্রিগেড কমান্ডার আতা মুহাম্মদকে দেখালেন। ব্রিগেডিয়ার কমান্ডার ডিভিশন কমান্ডার মেজর জেনারেল আবদুল মাজীদ মালিককে রিপোর্ট করলেন। তিনি তখন ছিলেন মীরি শহরে। মাত্র একদিন হয় তিনি সেখানে সিকড়ি থেকে বদলি হয়ে এসেছেন।

মেজর জেনারেল আবদুল মজীদ মালিক তখনই হেলিকপ্টার যোগে লিগা উপত্যকায় এসে পৌঁছলেন। হেলিকপ্টার অবতরণের পূর্বেই শত্রুপক্ষ ও মুক্তি বাহিনীর অবস্থান তিনি দেখে নিলেন। কর্নেল হক কিয়ানীর প্ল্যান তার সামনে রাখা হলো। অধিক চিন্তা ভাবনার সময় ছিলো না। দুশমনের অনবরত গুলি বর্ষণ ও আক্রমণের প্রচন্ডতা এমন তীব্র ছিলো যে, পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিলো, অবিলম্বে পাল্টা ব্যাবস্থা না নিলে পুরো উপত্যকায় শত্রুপক্ষ ছেয়ে যাবে। জেনারেল মজীদ মালিক কর্নেল কিয়ানীকে জবাবী হামলার অনুমতি দিয়ে দিলেন। হামলা শুরুর সময় ঠিক হলো রাত আড়াইটা।

চক পাতরা নামক এক পাহাড়ের ওপর হামলা করতে হবে। চক পাতরা পাহাড়ের উচ্চতা সাড়ে নয় হাজার ফিট। এই সাড়ে নয় হাজার ফিট উচ্চতা অতিক্রম করে হামলা করতে হবে। আযাদ কাশ্মীরের ফোর্সের যুদ্ধ শক্তি বলতে ছিলো কেবল এক প্লাটুন সৈন্য। তাও বিভিন্ন পাহাড়ের চূড়ায় মোচাবদ্ধ অবস্থায় বিক্ষিপ্ত তারা। চারটি মাত্র তোপ কামান ছিলো তাদের। যার গোলা বড় জোর মাত্র তিন মাইল দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে। আর ছিলো ১২০ মিলি মিটারের দুটি মর্টার গান। এর বিপরীতে শত্রুপক্ষের ছিলো পুরো ব্রিগেড। আর এর সঙ্গে ছিলো পঁচানব্বই পাউন্ড গুলি। নয় মাইল রেঞ্জের ছয় মিডিয়াম তোপ। শত মাইল রেঞ্জের বারটি ফিল্ড তোপও বিশটি মর্টার গান।

আযাদ কাশ্মীরের মুক্তিকামী জোয়ানরা পাহাড় চড়তে শুরু করলো। তদের মাথার ওপর সাক্ষাৎ মৃত্যু দূত হয়ে দুশমন মোর্চাবদ্ধ হয়ে অবস্থান করছে। জোয়ানরা জায়গায় জায়গায় পুতে রাখা মাইনের মধ্য দিয়ে পথ করে অবিরাম পাহাড় জয় করার মতো এগিয়ে যাচ্ছে। ওরা কোন ধরনের অঘটনে না পড়ে সঠিক সময়েই তাদের টার্গেটে পৌঁছে গেলো।

তারপর লড়াই শুরু হলো। প্রায় সম্মুখ সমর। এক অসম লড়াই। যার মধ্যে ঝলকিত হচ্ছিল ঈমাণদীপ্ত কারিশমা। কর্নেল হক নেওয়াজ কিয়ানী শহীদ এ লড়াইয়ের নেতৃত্ব দেন। তিনি প্রমাণ করে দেন পবিত্র কুরআনের প্রতি পূর্ণ ঈমান থাকলে ঈমানের দৃঢ়তায় অনড় থাকলে সূরা আনফালের ভাষ্যমতে দুইশ কাফেরের ওপর বিশজন ঈমানদার বিজয় লাভ করতে পারে।

কর্নেল হক কিয়ানী এমনিতেই মর্দে মুমিন শব্দের বাস্তব প্রতিচ্ছবি ছিলেন। সত্যিকার অর্থে আল্লাহর সৈনিক ছিলেন। তার প্রকৃত অস্ত্র ছিলো পবিত্র কুরআন। পবিত্র কুরআনের সু-সংবাদের ওপর অবিমিশ্র বিশ্বাস পোষণ করতেন তিনি। লিপা উপত্যকায় হাজার হাজার ফিট উচ্চতার চেয়ে তার আবেগ, চেতনা, বিশ্বাস ও ব্যক্তিত্ব আরো উচ্চতর ছিলো। কাশ্মীর স্বাধীনতার আকাংখা তার রক্তের অণু পরমাণুতে মিশে গিয়েছিলো। তিনি প্রায়ই লিপা বা কিয়ান উপত্যকার সুউচ্চ চূড়া দেখিয়ে তার অফিসারদেরকে বলতেন।

বেটা! যদি আমরা এই পাহাড় জয় করতে পারি তাহলে দৃষ্টি সীমা পর্যন্ত আদিগন্তের সেই পাহাড় প্রণালি আমাদের পদতলে চলে আসবে। তখন খুব সহজেই আমরা পরাধীন কাশ্মীরের কমান্ডো অভিযান পরিচালনা করতে পারবো।

তিনি নতুন অফিসারদেরকে এই বলে উৎসাহিত করতেন, বেটা! সবসময় এই চিন্তা ও পরিকল্পনা এবং জিজ্ঞাসা যেন তোমাদের মস্তিষ্কে সচল থাকে যে, শ্রী নগর জয় করতে তোমরা কোন পথ অবলম্বন করবে?

এভাবে তিনি নওজোয়ান অফিসারদের মন-মানসে পরাধীন কাশ্মীরকে স্বাধীন করার সংকল্প গেঁথে দিতেন। ১৯৬৫ এর যুদ্ধে শত্রুর দখলকৃত কাশ্মীরের দূর দূরান্ত পর্যন্ত অনেক কমান্ডো অপারেশনের নেতৃত্ব দেন এবং অবিশ্বাস্য বীরত্ব প্রদর্শন করে শত্রু পক্ষের কোমর ভেঙ্গে দেন। যার প্রতিদানে তিনি লাভ করেন বীরশ্রেষ্ঠ পদক।

লিপা উপত্যকায় সে রাতের হামলা সম্পর্কে তার ঐটা জানা ছিলো, সাধারণ রণকৌশল অবলম্বন করে হামলা চালালো কোন কাজ হবে না। কারণ, এ অবস্থায় হামলা করতে হলে অতিরিক্ত দু পাটুন সৈন্য ও পুরো তোপখানা রেজিমেন্ট নিয়ে হামলা করা উচিত। না হয় বীরুওয়ালী নাড় ক্যাম্প ও পুরো উপত্যকা শত্রুপক্ষের দয়ার ওপর ছেড়ে দিতে হবে।

কিন্তু কর্নেল হক কিয়ানী প্রতিটি পদক্ষেপে চরম দুঃসাহসিকতার পরিচয় দিচ্ছিলেন। তিনি তার অফিসারদেরকে যুদ্ধের কলাকৌশল সম্পর্কিত দিক নির্দেশনা দিয়ে দিলেও জানতেন, এ লড়াইয়ে শেষভাগে জয়ের সম্ভাবনা একমাত্র শত্রু পক্ষের। কারণ তার দলের সৈন্য সংখ্যা যেমন কম তেমনি অস্ত্রশস্ত্রও অতি নগণ্য। অধিকন্তু, তাদের কাছে গরম পোষাকও নেই। খাকি উড়িই তাদের শীত নিবারক বস্ত্র। তার ওপর সেনা সাহায্য পৌঁছারও কোন ব্যবস্থা এ অবস্থায় অন্তত নেই।

এজন্য জোয়ানদের মধ্যে ঈমানের উত্তপ্ত মশাল জ্বালিয়ে দেয়া জরুরী ছিলো। কর্নেল কিয়ানী অফিসার ও জোয়ানদের উপত্যকার এক জায়গায় দাঁড় করালেন। তারপর তাদের উদ্দেশ্যে ঈমান– তাজা কণ্ঠে বললেন,

ছেলেরা আমার! আজ রাতে তোমাদেরকে যে পরিস্থিতির সম্মুখীন করা হচ্ছে সে পরিস্থিতির সম্মুখীন তোমরা আর কখনো হওনি। তোমরা এতদিন যেভাবে লড়াই করেছে এ লড়াই সে রকম নয়। আজ তোমরা সে দশমনের ওপর হামলা করতে যাচ্ছে যে দুশমনের শক্তি তোমাদের চেয়ে অনেক বেশি। ওরা পাহাড়ের ওপর মোর্চাবদ্ধ– সুরক্ষিত অবস্থায় আছে। আজ তোমাদেরকে সে লড়াই লড়তে হবে ইসলামের সূচনা লগ্নের মুজাহিদরা যে লড়াই লড়ে পৃথিবীতে অমর হয়ে আছেন। তোমাদেরকে আজ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাল্লামের স্বর্গীয় স্মৃতিকে তাজা করে তুলতে হবে। বিধর্মীরা আজ তোমাদের আত্মমর্যাদাকে চেলেঞ্জ করেছে। আজ রাতে তোমাদের বিজয় রা. শাহাদাত। জাতি আজ তোমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।

তারপর কর্নেল কিয়ানী সবার উদ্দেশ্যে বললেন আল্লাহর সিপাহীরা! মাথায় কাফনের কাপর বেঁধে লড়াই করো। একথা বলে তিনি পাতলুনের পকেট থেকে একটি সাদা কাপড় বের করে সেটা মাথায় বাঁধলেন। তারপর বললেন,

দেখে নাও সবাই, এটা আমার কাফনের কাপড়ের ওপরের অংশ। আমি এটা মাথায় বেঁধে নিলাম।

কর্নেল কিয়ানী নিজের কাছে সবসময় কাফনের কাপড় রাখতেন। এর ওপর সুগন্ধি লাগিয়ে রাখতেন। কর্নেলের কথা শেষ হতেই এ হামলার অন্যতম কমান্ডার মেজর মুহাম্মদ সাবির খান এক ঝটকায় দাঁড়িয়ে গেলেন। পকেট থেকে রুমাল বের করলেন। তারপর সেটা মাথায় বেঁধে ফেললেন। বললেন,

আমার কাছে কাফনের কাপড় নেই। আজ রুমালকেই আমি কাফনের কাপড় মনে করছি।

এদৃশ্য জোয়ানদের মধ্যে যেন অগ্নি শেলের উন্মত্ততা সৃষ্টি করলো। তারা আর এখন আর কোন সেনাবাহিনীর জোয়ান নয়। আল্লাহর জোতির্ময় জানবার্য সৈনিক।

আমি লিপা উপত্যকার সে জায়গা দেখে এসেছি যেখানে কর্নেল কিয়ানী তার জোয়ানদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়েছিলেন। তখনকার মুক্তিকামী কয়েকজন জোয়ানের সঙ্গে পরে আমার সাক্ষাৎ হয়।

কর্নেল কিয়ানী মাথায় কাফনের কাপড় বাঁধার সময় তাদের কি অনুভূতি হয়েছিলো সেটা জিজ্ঞেস করেছিলাম। এ প্রশ্ন শোনার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি জোয়ানের চেহারা আবেগে উজ্জ্বল হয়ে উঠে। তারা বলেন।

যখন আমাদের কর্নেল ও কোম্পানি কমান্ডার মাথায় কাফনের কাপড় বাঁধলেন তখন আমাদের মধ্যে এক অজানা শক্তির বিচ্ছুরণ ঘটলো। আমরা একেবারেই ভুলে গেলাম দুশমনের শক্তি কয়েক গুণ বেশি এবং ওরা দশ হাজার ফিট উচ্চতার দারুণ সুবিধায় রয়েছে। আমাদের মনে হচ্ছিল দুশমন আমাদের পদতলে লুটিয়ে পড়েছে।

সেই বীর জোয়ান আরো বললেন,

কর্নেল কিয়ানী শহীদের এক ভবিষ্যৎ সুসংবাদ দানের কথা আজ মনে পড়ছে। তিনি কুরআন অন্তপ্রাণ ছিলেন। প্রতিটি বিষয়ের প্রতিটি ফায়সালা পবিত্র কুরআনের আলোকে করতেন। তিনি সেদিন সংক্ষিপ্ত ভাষণের পর জোয়ানদের এ সুসংবাদ দিলেন যে,

তোমরা যে পথ দিয়ে পাহাড়ে চড়বে সে পথের প্রতি স্কয়ার ফিট জায়গায় দুশমন মাইন পিন্ড পুঁতে রেখেছে। আমি তোমাদেরকে এ নিশ্চয়তা দিচ্ছি, চলার সময় তোমাদের কারোরই পায়ের নিচে বা বুটের তলায় একটিও ফিল্ড মাইন বিস্ফোরিত হবে না। পবিত্র কুরআন থেকে আমি এই সুনিশ্চিত ইংগিত পেয়েছি। আরেকটি সু-সংবাদ শুনে নাও, দুশমন অন্ধ হয়ে যাবে। তোমাদের এই স্বল্প সংখ্যক সেনা ওদের চোখে দশগুণ হয়ে ধরা দিবে।

হলোও তাই। জোয়নরা যখন রাতের গভীর অন্ধকারে নিঃশব্দে পাহাড় চড়ছিলো তখন তারা টেরও পেলো না বিধ্বংসী ফিল্ড মাইনের ওপর দিয়ে ওরা এগিয়ে যাচ্ছে। একজন জোয়ানও মাইন বিস্ফোরণে আহত হলো না। একটি মাইনও যদি বিস্ফোরিত হতো কোন জোয়ান কেবল আহত বা শহীদই হতো না। বরং সবচেয়ে বড় ক্ষতি যেটা হতো সেটাহলো মাইন বিস্ফোরণের বিকট শব্দে শত্রুপক্ষ সচকিত হয়ে উঠতো। তারপর তাদের গ্রেনেড আর মেশিনগানের গোলায় নিমিষেই খতম করে দিতো আযাদ কাশ্মীরের এই গুটি কয়েক মুক্তিযোদ্ধাকে।

এভাবে স্বাধীনতাকামী মুক্তি সেনারা শত্রুর একেবারে ঘাড়ের পেছনে গিয়ে পজিশন নিলো যমদূত হয়ে। তারপর যে লড়াই হলো সেটা প্রায় এক তরফা লাড়াই হলো। শিখ রেজিমেন্টের সৈন্যরা সামান্য প্রতিরোধেরও সময় পেলো না। হামলার আকস্মিকতায় শিখ সেনারা পালাতে শুরু করলো। যে মাইন ফিল্ড আযাদ কাশ্মীরের জোয়ানদের পায়ের তলায় অলৌকিকভাবে বিস্ফোরিত হয়নি সেগুলোই একের পর এক বিস্ফোরিত হয়ে শিখদের ছিন্ন ভিন্ন করে ফেলতে লাগলো।

কর্নেল কিয়ানীর দ্বিতীয় ভবিষ্যদ্বাণীও সত্য বলে প্রমাণিত হলো। দুশমন অন্ধের মতো পালাতে লাগলো। আযাদ কাশ্মীরের জোয়ানরা এমন ভয় ডরহীন দুঃসাহস নিয়ে জানবাযী রেখে হামলা চালালো যে, দুশমনের অতি মজবুত শক্তিশালী বাংকারগুলো অল্প সময়েই দখল করে নিলো। অনেক শিখ অস্ত্র ফেলে আত্মসমর্পণ করলো। কিন্তু যারাই লড়তে চাইলো বা প্রতিরোধের চেষ্টা করলো তাদের বুক বা মাখা বুলেটের আঘাতে ঝাঁঝরা হয়ে গেলো।

বাংকারগুলো থেকে শিখদের পালানোর পর দেখা গেলো, প্রতিটি বাংকারে একাধিক মেয়ে রয়েছে। সব কটাই সুন্দরী যুবতী। এরা জানালো, কমান্ডিং অফিসাররা জোরপূর্বক এদেরকে ভোগ করার জন্য নিয়ে এসেছে। এরা শিখ রেজিমেন্টের রক্ষিতা। পরে এদের সবাইকে সসম্মানে ছেড়ে দেওয়া হলো। আযাদ কাশ্মীরের কোন জোয়ান তো দূরের কথা কোন অফিসারও এদের দিকে চোখ তুলে তাকায়নি।

কর্নেল হক কিয়ানী তার দূরদর্শী রণকৌশলের আরেকটি অপার প্রদর্শনী দেখালেন। হামলার আগে যেখানে তিনি তার জোয়ানদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়েছিলেন সেটা পাহাড়ের এমন একটি প্রশস্ত কন্দর ছিলো যে, সব সময় সে জায়গাটা শত্রুপক্ষের আড়ালে পড়ে থাকতো। তাদের দৃষ্টিসীমায় সে স্থানটি ধরা পড়তো না।

ভাষন শেষ করার পর কর্নেল কিয়ানী জোয়ানদেরকে সারি বন্ধ করে খোলা জায়গায় নিয়ে গিয়ে এমন পথ দিয়ে নদী পার করলেন যেখান থেকে দুশমন তাদেরকে দেখতে পেতো। কিন্তু এই সারিটি নদীর পারে গিয়ে দুশমনের দৃষ্টি থেকে সরে পড়তে এবং লুকানো অবস্থায় নদী পার হয়ে আবার এপারে চলে আসতো, এরপর আবার সারিবদ্ধ হয়ে দুশমনের দৃষ্টিসীমা দিয়ে নদী পার হতো। আবার গা ঢাকা দিয়ে এপারে এসে পুনরায় ভোলা জায়গা দিয়ে নদী পার হতো। কর্নেল কিয়ানী এভাবে তার জোয়ানদেরকে কয়েকবার এপার ওপার করালেন। কিন্তু শত্রু বাহিনী ওপার থেকে দেখছিলো, আযাদ কাশ্মীরের জোয়ানদের সারির পথচলা যেন শেষই হচ্ছে না। এবং একের পর এক সেনা সারি নদী পার হচ্ছে। আর তাদের দৃষ্টিতে এ ছিলো পুরো ব্রিগেডের সৈন্য। আড়াই তিনশত জোয়ানকে কর্নেল এমন ভাবে নদী পার করালেন যে, তাদের দৃষ্টিতে তা আড়াই তিন হাজারে রূপান্তরিত হয়ে গেলো।

এই মুষ্টিমেয় জোয়ানরা যখন প্রায় দশ হাজার ফিট উচ্চতায় চক পাতা পাহাড়ে হামলা চালালো তখন তারা রক্ত মাংসের মাত্র আড়াই তিনশ জোয়ান ছিলো না। তারা হয়ে গেলো একেকজন উৎক্ষিপ্ত আগুনের গোলা। আর এই আগুন ছিলো কুরআন ও ঈমানের। হামলার মধ্যে এমন প্রচন্ডতা ছিলো যে, শত্রুপক্ষের এবিশ্বাস জন্মালো যে, এ কেবল একটি কোম্পানি না, বেশ কয়েকটি প্লাটুন তাদের ওপর হামলা চালিয়েছে। তাদেরকেই তারা সন্ধায় নদী অতিক্রম করতে দেখছিলো।

জোয়ানদের মধ্যে ঈমানের জাগ্রত শক্তি তো ছিলোই আর ছিলো কর্নেল কিয়ানীর সংকল্পবদ্ধ গভীর ব্যক্তিত্বের প্রভাব। সঙ্গে সঙ্গে তাদের মধ্যে এ অনুভূতিও ছিলো, কোন বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটলেও আল্লাহ তাআলা তাদের জেনারেল আব্দুল মজীদ সালিককে পাঠিয়ে দিয়েছেন। তিনিও বসে থাকবেন না। কারণ, তিনিই নিজের প্রশাসনিক পদকে প্রশ্নের সম্মুখীন করে এই বিপদজনক হামলার অনুমতি দিয়েছেন।

লড়াইয়ের একেবারে শেষ দিকে যখন শিখ রেজিমেন্টের পরাজয় নিশ্চিত হয়ে গেছে তখন কর্নেল কিয়ানি শহীদ হয়ে যান। তার বিভিন্ন পত্রাবলি থেকে এর প্রমাণ পাওয়া যায় যে, এই শাহাদাত বরণের সুসংবাদ তিনি আগেই পেয়েছিলেন। এই লড়াইয়ের আগে তিনি তার মা, তার ছেলে ও তার ভাইকে চিঠি লিখেন। তার মাকে তিনি লিখেন,

প্রিয় শ্রদ্ধাস্পদ মা!
আসোলামু আলাইকুম
আশা করি আপনি সুস্থ আছেন। আমাদের এখানকার পরিস্থিতি অনেকটা ঘোলাটে। শিগগিরই এখানে লড়াই বেধে যাবে। অবশ্য এ নিয়ে আমাদের কোন দুশ্চিন্তা নেই। আমরা তো আমাদের সবকিছু আল্লাহর জন্য উৎসর্গ করে রেখেছি। আল্লাহ তাআলা চাইলে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমরা আমাদের ও ইসলামের শত্রুর বিরুদ্ধে লড়ে যাবো। আমার নয়নের মনি! আজ আমি আপনার দুআর কাঙাল। আল্লাহ তাআলা আপনার জীবনকে সম্মানিত করুন। আল্লাহ তাআলা যদি এবার আমাকে কবুল করে নেন তাহলে আপনি শোকাহত হবেন না। এমন হলে নিশ্চিত জানবেন আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা এমনই ছিলো। সন্তানের কিছু হলে মা বাবার জন্য তো তা মেনে নেওয়া বড় কষ্টদায়ক হয়। কিন্তু এতে তো কারো হাত থাকে না। তবে এটা তো নিশ্চিত আল্লাহ তাআলা যাকে শহীদী জীবন দেন সে তো বড় সৌভাগ্যবান।
আসগর, জানো, খানো,– ওরা তো আপনার সন্তান। আশা করি ওরা সবাই আপনার স্নেহাধীন– অনুগত।
প্রিয় আম্মাজান! আপনার কাছে সর্বশেষ আর্তি। আপনি আমার প্রতি সব সময় সন্তুষ্ট থাকবেন। ইনশাআল্লাহ পরকালেও আমি আপনার অনুগত থাকবো।
ইতি–
আপনার নয়নের মণি
হক নেওয়াজ কিয়ানী।

সেদিনই তিনি ইংরেজীতে তার ছেলে আসগর নেওয়াজ কিয়ানীকে একটি চিঠি লিখলেন। আসগর তখন মিলিটারী কলেজের ছাত্র। সেনাবাহিনীর অফিসার পদে কমিশন লাভের জন্য আগেই দরখাস্ত দিয়ে রেখেছিলেন। তাকে দারুণ তাৎপর্যপূর্ণ একটি চিঠি লেখলেন।

লিপা উপত্যকা
১মে ১৯৭২
আমার কলিজার টুকরো বেটা! আল্লাহ তাআলা সব সময় তোমার সঙ্গে থাকুন। তোমাদের সবার কাছ থেকে বিদায়ের সময় আমি তোমার কামিয়াবী ও আনন্দময় ভবিষ্যতের জন্য দুআ করছি। সেনাবাহিনীর অফিসার হওয়ার সুবাদে নিজের মধ্যে কঠোর পরিশ্রমের অভ্যাস গড়ে তোলো। দায়িত্বের প্রতি নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সমর্পণ করো। নিষ্ঠার সঙ্গে নিজের জীবন যৌবনকে ব্যবহার করবে। অধীনস্ত জোয়ানদেরকে এবং নিজেকেও নিজের কমান্ডো রাখবে। সব সময় ইসলামের নামে প্রাণ উৎসর্গের জন্য প্রস্তুত থাকবে। নিজের বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ দীক্ষা অর্জন করে নিয়ে। প্রতিটি পরিস্থিতির অণু বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা ও যোগ্যতা অর্জন করো, যাতে তুমি একজন সুযোগ্য অফিসার হতে পারো।
বেটা আমার! মনে রেখো খুব দ্রুত আমার স্থানে তোমাকে বসতে হবে। আমি এমন সময় তোমার কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি যখন তুমি মাশাআল্লাহ পরিণত বয়সে পৌঁছে গেছে! যখন তোমার দাদাজান বিদায় নিয়েছেন তখন আমি অনেক ছোট। তবুও আমাকে অনেক কিছু সামলে উঠার গুরু দায়িত্ব নিতে হয়েছিলো। তোমার মা বোন ভাইদের প্রতি খেয়াল রেখো। ওদের সঙ্গে কঠোরতা করো না।
ইতি–
তোমার বাবা হক নেওয়াজ।

তার বড় ভাইকেও সেদিন ইংরেজীতে একটি চিঠি লিখেন।

শ্রদ্ধেয় ভাইজান!
আপনার প্রতি যে আমি কতটা কৃতজ্ঞ তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। এই প্রৌঢ় বয়সের ভঙ্গুর শরীরে আমার ও আমার পরিজনকে কতই না মমতার সঙ্গে আগলে রেখেছেন। দায়িত্ব নিয়ে সবার দেখাশুনা করছেন। অথচ আমার দায়িত্ব ছিলো আপনার দেখাশুনা করা। হায় আমি সে দায়িত্ব পালন করতে পারিনি। আমি মহান আল্লাহর দরবারে মাথা অবনত করছি যিনি আমাকে শাহাদতের জন্য মনোনীত করেছেন। আমার চেহারায় স্বতঃস্ফূর্ত হাসি মেখে আমি বিদায় নিচ্ছি। আমার সন্তান ও তাদের অনাগত সন্তানদের জন্য অনুসৃত একটি পথ রেখে যাচ্ছি। যাতে তারা সে পথের পথিক হতে পারে গর্ব ও নিষ্ঠার সঙ্গে। আল্লাহ তাআলা যেন আমার আকাংখা পূরণ করেন।
আফসোস হচ্ছে, পরিতাপ হচ্ছে, আমার জীবন সঙ্গীনীর জীবন আমি নিষ্কন্টক আনন্দময় করতে পারিনি। আল্লাহ তায়ালা যেন সব সময় তার সাহায্যকারী থাকেন।
বিস্ময়কর মনে হতে পারে, ভবিষ্যতের কোন কোন বিষয় পূর্বেই তার সরল ছায়া বিস্তার করে থাকে।
ইতি–
আপনার স্নেহের ছোট ভাই
হক নেওয়াজ কিয়ানী

ছেলে ও ভাইয়ের কাছে কর্নেল কিয়ানীর চিঠিতে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠে, তিনি তার শাহাদাত বরণের ইংগিত পবিত্র কুরআনের বরকতে পূর্বেই পেয়েছিলেন। তার মায়ের কাছে চিঠিতে অনেকটা সংযত ভাষা ব্যবহার করেছেন। কিন্তু ভাইও ছেলেকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি তাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছেন। তাদের কাছে ইংরেজীতে লেখার সম্ভবত কারণ এটাই ছিলো। যাতে তার মা টের না পান তার ছেলে শহীদ হচ্ছেন।

কর্নেল কিয়ানীর জোয়ানরা মেজর সাবের খান ও মেজর ইয়ার আফজাল আফরিদীর নেতৃত্বে পাহাড়ের ওপর কিভাবে চড়েছিলো সেটা বেশ দীর্ঘ কাহিনী। এত বড় কাহিনী এখানে উল্লেখ করা সম্ভব নয়।

প্রায় হাজার ফিট উচ্চতা অতিক্রম করার পর জানা গেলো স্কাউটের আশিজন জোয়ান কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। সম্ভবত: ওব্রা পথ হারিয়ে ফেলেছিলো। রাতের আঁধার ও পাহাড়ের অজানা গিরি করে পথ হারা না স্বাভাবিক ব্যপার।

আযাদ কাশ্মীরের এই স্বল্প সংখ্যক সেনার মধ্যে এই আশিজন জোয়ান ছিলো বাহিনীর এক-তৃতীয় অংশ। কর্নেল কিয়ানী তখন অন্য পাহাড়ে অবস্থান করছেন। ওয়ারলেসে যখন তাকে এঘটনা জানানো হলো, তিনি মোটেও বিচলিত হলেন না। যোদ্ধার সংখ্যা তো এমনিতেই হাতে গোনা। তারপর এক তৃতীয়াংশ যোদ্ধা পাত্তা, এ অবস্থায় যত বড় দুর্ধর্ষ জেনারেল বা কর্নেল হোক না কেন, হামলা মুলতুবীর নির্দেশ দিতেন। কিন্তু কর্নেল কিয়ানী দুর্ঘর্ষেরও দুর্ধর্ষ। তিনি নির্দেশ দিলেন, পাহাড় চড়াই অব্যাহত রাখো। আল্লাহ তাআলা তোমাদের সঙ্গে আছেন হামলা মুলতুবী হবেনা।

চক পাথার পাহড় থেকে একটু সরে আট হাজার ফিট উঁচু আরেকটি পাহাড় কর্নেল কিয়ানীর ছোট একটি সেনাদল মোর্চাবদ্ধ হয়ে আছেন। এ কোম্পানীর কমান্ডার ফটোহার এলাকার মেজর জামশেদ গুলজার। যিনি এক্স সোর্স এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট লেফটেনেন্ট কর্নেল (অব) মুহাম্মদ গুলজার খানের ছেলে। এ কোম্পানীর এক অংশ আগেই অন্য পাহাড়ে গিয়ে পজিশন নিয়েছে। কর্নেল কিয়ানী মেজর জামশেদ গুলজারকে ওয়ারলেসে নির্দেশ দিলেন, তোমার পোষ্ট থেকে নিচে নেমে আসে এবং পাহাড়ের অন্যদিক থেকে চক পাথার এর ওপর হামলা করো।

মেজর জামশেদ গুলজারকে তার জোয়ানদের নিয়ে আট হাজার ফিট উচ্চতা থেকে নেমে তারপর সারে নয় হাজার ফিট পাহাড়ে চড়ে এবং কোন ধরনের বিশ্রাম না নিয়ে হামলা করতে হবে। পাহাড় থেকে অবতরণ পাহাড় আরোহণের চেয়ে কষ্টদায়ক ও কঠিন কাজ। তবুও মেজর জামশেদ খুব দ্রুত পাহাড় থেকে নেমে শত্রু কবলিত পাহাড়ে আরো দ্রুত জোয়ানদেরকে নিয়ে উঠলেন।

মেজর জামশেদ বলেন, আমার ওয়ারলেসে কর্নেল কিয়ানীর দরাজ কণ্ঠ একটু পর পর শোনা যাচ্ছিলো। একবার তিনি বললেন, বেটা মেজর জামশেদ! পবিত্র কুরআনের এই আয়াতটি জপতে জপতে এগিয়ে যাও। ফিল্ড মাইন ও দুশমনের মেশিনগানের গোলা তোমাদের পথ দেখাবে।

আয়াতটি তিনি পাঠ করতে লাগলেন। যার অর্থ হলো, যারা ঈমানদার ও সকর্মী তাদেরকে পৃথিবীর কর্তৃত্ব দানের ওয়াদা দিয়েছেন আল্লাহ তাআলা।

ফায়ারিং ও গোলাগুলির এমন প্রচন্ডতা ছিলো যে, ধোয়ায় চারদিক ঝাপসা হয়ে আসছিলো। পাহাড়ি গাছগুলো ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়ছিলো। পুরোটা পরিবেশ আগুনের গোলায় পরিণত হলো। নমরূদের এই অগ্নিকুন্ডের মধ্য দিয়ে মেজর জামশেদ ও তার জোয়ানরা অক্ষত- নিরাপদে বেরিয়ে গেলো। কর্নেল কিয়ানী যখন তার পজিশনে দাঁড়িয়ে লড়াই কন্ট্রো করছিলেন তখন থেকে থেকে বিড় বিড় করে তার ঠোঁট দুটি নড়ে উঠছিলো।

মেজর জামশেদ গুলজার সে সময়ের প্রতিক্রিয়া ও অনুভূতি একটি চিঠির মাধ্যমে তার বাবা লেফটেনেন্টে কর্নেল মুহম্মদ গুলজারকে যুদ্ধ শেষে জানান। চিঠিতে লড়াইয়ের অনেকখানি উঠে আসে। চিঠিটি ছিলো এরকম,

শ্রদ্ধাস্পদ আব্বাজান
আসোলামু আলাইকুম।
আপনি লিপা উপত্যকায় অপারেশন সম্পর্কে অনেক কথাই শুনে থাকবেন। কিন্তু সেখানে যা ঘটেছিলো তা এরকম :
১৯৭২ এর শেষের দিকে ভারতীয়রা বিশাল সৈন্যবহর নিয়ে আচমকাই লিপা উপত্যকার অনেকখানি অংশ দখল করে নেয়। তারপর থেকে তাদের অতি আক্রমণাত্মক আচরণ আমরা সয়ে যেতে লাগলাম। উপত্যকার সব উঁচু অংশগুলো তাদের দখলে চলে গেলো। প্রতিটি মুহূর্তে আমাদের চরম সংকটের মধ্যে থাকতে হতো। যেকোন সময় ওরা আমাদেরকে মুজাফফর আবাদের দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যেতে পারতো।
যুদ্ধ বন্ধের সামরিক চুক্তির কারণে ওরা হামলা মুলতবী রাখলেও মৌখিকভাবে কয়েকবারই এ হুমকি দিয়েছে, আমরা যেন উপত্যকা খালি করে চলে যাই। ওদের অবস্থান এমন উচ্চতা ও অনুকূল ছিলো যে, আমাদের প্রতিকূল অবস্থানে থেকে মনে হতো, আমরা ওদের পায়ের নিচে বসে আছি। ওদের পা চাটছি আমরা। তারপরও আমরা এমন এক ট্রাজেডির সম্মুখীন ছিলেম যে, দুশমন আমাদেরকে মাটির পুতুলের অধিক কিছু মনে করতো না। সেটা হলো, যুদ্ধ বন্ধ চুক্তির পর আযাদ কাশ্মীরের একটি ব্যাটালিয়ান চারদিক থেকে দুশমনের ঘেরাওয়ের মধ্যে রয়ে গেলো। তাদের ওখানে রসদ সরবরাহের জন্য ছিলো অতি সংকীর্ণ একটি রাস্তা। এই রাস্তাও দুশমনের করুণার ওপর আমরা ব্যবহার করতাম।…
দুশমনের লোলুপ দৃষ্টি উপত্যকার অবশিষ্ট অংশের ওপর এমনভাবে গেঁথে রইলো যে, আমরা যেন এর কাটা সব সময় অনুভব করতাম। দুশমনের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও প্রতিশোধের আগুন যেন দিন দিন আমাদের জোয়ানদের মধ্যে দ্বিগুণ থেকে দিগুণতর হতে লাগলো। ১ মে ১৯৭২ দুশমন তাদের পরিবেষ্টিত আযাদ কাশ্মীরের রসদ সরবরাহের পথটি বন্ধ করে দিলো। ওদের ধারণা ছিলো কোম্পানী ইমোনেশন ও রসদের অভাবে ঘাবড়ে গিয়ে হয় আত্মসমর্পণ করবে না হয় পোষ্ট খালি করে দিবে।…
কিন্তু দুশমন যখন দেখলো, আযাদ কাশ্মীরের জোয়ানরা একেবারেই নির্বিকার তখন তারা ভীষণ ক্ষেপে উঠলো। ৩/৪ মে রাত লিপা উপত্যকায় কেয়ামতের বিভীষিকা নামিয়ে দিলো ওরা। মটরগান ও দূরপাল্লার কামানগুলো অবিরাম গর্জাতে লাগলো। আমাদের সৈন্যসংখ্যা ও ফায়ার পাওয়ার এতই দুর্বল ছিলো যে, দুশমন শতভাগ নিশ্চিত ছিলো সহজেই আমরা লেজ গুটিয়ে পালাবো। পরিস্থিতির বিচারে এটাই ছিলো স্বাভাবিক। কিন্তু সেই অমিত শক্তি সম্পর্কে তাদের কোন উপলব্ধিই ছিলো না, যা আমাদের আত্মার খাঁজে খাঁজে যথাসময়ে ঝলকে উঠে। ওরা ভুলে গিয়ে ছিলো সে খোদায়ী নুসরতকে যা আমাদের প্রতিনিয়তের সঙ্গি।…
পুরো উপত্যকার প্রতিটি ধূলি কণা প্রকম্পিত হচ্ছিলো। কালো ধোয়ায় চারদিক ঢেকে গিয়েছিলো। স্থানীয় দিন মজুর শ্রেণীর লোকেরা পাহাড়ের নিরাপদ গুহায় আশ্রয় নিয়েও ঠক ঠক করে কাঁপছিলো। রাত শেষ হয়ে সকাল দুপুর বিকাল সারা দিনই চললো দুশমনের এই ধ্বংসযজ্ঞ।…
এমন কিংকর্তব্যবিমূঢ় পরিস্থিতিতে যে কোন কমান্ডার দিশেহারা হয়ে দিগবিদিক ছুটে পালাবে। তাছাড়া এখানে শত্রু পক্ষ কয়েকগুণ বেশি শক্তিশালী এবং তাদের অবস্থানও অনেক সুবিধাজনক স্থানে। এ অবস্থায় জবাবী হামলার কথা কল্পনা করাও হাস্যকর। কিন্তু কর্নেল কিয়ানী ছিলেন আমাদের অধিনায়ক। আমাদের অভিভাবক। যিনি একেবারেই অন্য ধাতুতে গড়া পার্থিব সকল সীমাবদ্ধতার উর্ধ্বে। সাক্ষাত বজ্রের ভয়াবহতা নিয়ে তিনি আমাদের হাল ধরলেন। জবাবী হামলার প্রায় অসম্ভব এক প্লান তৈরী করলেন। …
৫মে রাত সাড়ে তিনটায় কর্নেল কিয়ানী রেডিও ওয়ারলেসে আমাকে নির্দেশ দিলেন, তুমি তোমার মতো করে দুশমনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ো। মেজর সাবির শহীদকেও একই নির্দেশ দেয়া হলো। পর মুহূর্তে আমার ওয়ারলেস আবার বেজে উঠলো। কর্নেল কিয়ানীর গলা! তিনি বলছেন, বেটা জামশেদ! তোমার জোয়ানদের বলে দাও দুশমন তোমাদেরকে দেখে অন্ধ হয়ে যাবে। ওদের পুতে রাখা বোমাগুলো তোমাদের এক চুলও ক্ষতি করতে পারবে না।
আমি আমার সিংহপ্রাণ জোয়ানদের হামলার হুকুম দিলাম। জোয়ানরা এ হুকুমের জন্যই আকুল হয়ে অপেক্ষা করছিলো।
দিগন্ত রেখায় ভোরের প্রথম আলো ছড়িয়ে পড়ার আগেই জোয়ানরা চিতার মতো ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়লো। প্রতিটি জোয়ান জযবা আর আবেগে পাগল
হয়ে যাচ্ছিলো। আমাদের এ হামলা এতই ক্রোধ উন্মত্ত ছিলো যে, দুশমনের মেশিন গান, মর্টার, কামান ও গ্রেনেড আমাদের পথে যে আগুনের নিরেট দেয়াল দাঁড় করিয়ে রেখেছিলো, সে দেয়াল আমরা যেন তুরি মেরে উড়িয়ে দিয়ে এগিয়ে গেলাম। আগুনের সে সমুদ্রে আমার জোয়ানরা কয়েকগুণ আগুনের উত্তপ্ততা নিয়ে দুশমনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো।…
এক একটি বাংকারে ঝাঁপিয়ে পড়ছিলো আর বিদ্যুৎ গতিতে দশ বারজন করে শিখকে জাহান্নামে পাঠিয়ে দিচ্ছিলো। ওদের মাথার খুলি উড়ে যাচ্ছিলো। বুক ঝাঁঝরা হয়ে যাচ্ছিলো। দুশমনের মৃত্যু চিৎকার জোয়ানদের উন্মাদনা- জযবা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছিলো।…
ক্রোধে পাগলপারা হয়ে যাচ্ছিলাম আমিও। আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো সেই হারানো স্বাধীনতাকামী ভাইদের মুখগুলো; দুশমনরা অন্যায়ভাবে আটকে রেখে যাদেরকে নিপীড়ন করছে। তখনকার নিরস্ত্র নিরপরাধ মুসলমানকে হত্যা করছে। ভেসে উঠছে সেসব শিশুর কচি মুখ; কসাই ভারতীয়দের পৈশাচিক হামলায় মার মুখ খালি করে শহীদ হয়েছে। সেই দুশমন আজ আমাদের খোলা অস্ত্রের মুখে। নর পিশাচ শিখরা অস্ত্র ফেলে আত্মসমর্পণ করছিলো। প্রাণ ভিক্ষা চাচ্ছিলো। যারা ধমক ছাড়া আমাদের সঙ্গে কথা বলতে না। অহংকার ও ঔদ্ধত্যে যাদের ঘাড় সব সময় বেঁকে থাকতো। তারা আজ আমাদের পদতলে; আমাদের করুণার ওপর।….
তাদের জীবন মরণ আমাদের অনুগ্রহের ওপর, আজ ওরা সেদিনকে গালি দিচ্ছে যে দিন ওদের মা ওদেরকে ভূমিষ্ঠ করেছিলো। ওরা আজ ওদের সে সব জেনারেলকে নিকুচি করছে যারা ওদেরকে সাক্ষাৎ যমদূতের কাছে ঠেলে দিয়েছে।
দুপুরের আগেই আমরা চক পাথর পাহাড় দুশমন থেকে ছিনিয়ে নিলাম। তারপর প্রতিরক্ষীয় পজিশন নির্ধারণে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। আচমকা দুশমন তাজাম সৈন্য নিয়ে জবাবী হামলা চালালো। এবার যেন ওরা কেয়ামততের বিভিষিকা নিয়ে আমাদেরকে গ্রাস করে ফেলবে। আমরা আরেকবার মহান আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইলাম। আমাদের না ছিলো সেনা সাহায্যের আশা, না ছিলো তাজাম সৈন্য। আর না ছিলো ইমোনেশন। আল্লাহর ওপর ভরসা করে আমরা লড়তে থাকলাম। আমার চোখের সামনে শহীদ হয়ে গেলেন মেজর সাবির খান মাত্র একশ গজ দূরে। আমি মোটেও বিচলিত হলাম না। সঙ্গে সঙ্গে আমি মেজর সাবির খান শহীদের জোয়ানদের নেতৃত্ব আমার হাতে নিয়ে নিলাম। আল্লাহ তাআলা সম্ভবতঃ আমাকে একারণেই জীবিত রেখেছেন দুশমনের তাজাম সৈন্য স্রোতের মতো এগিয়ে আসছিলো। ওরা আসছিলো জয় হিন্দ শ্লোগান তুলতে তুলতে। কিন্তু যখন আমাদের জোয়ানরা রুখে দাঁড়ালো তখন তাদের জয় হিন্দ শ্লোগান মৃত্যুর শেষ আর্তনাদে রূপান্তরিত হতে লাগলো। যেমন স্রোতের মতো ওরা আসছিলো তেমনি একের পর এক ঢলে পড়ছিলো মৃত্যু দূতের কোলে।
দুশমনের এই জবাবী হামলা এমন ভাবে ব্যর্থ হলো যে দুশমন কোন কিছু বুঝেও উঠতে পারলো না। অসংখ্য লাশ আর যখমীদের ফেলে বেঁচে থাকা দুশমন দিক-বিদিক পালাতে লাগলো। যখমীরা পানি পানি করে গোঙ্গাচ্ছিলো। কিন্তু এখন আর পানি ওদের রক্তের শূন্যতা পূরণ করতে পারবে না …।
দুশমনের যেসব কমান্ডাররা হুমকি ধামকি ছাড়া আমাদের কমান্ডারদের সঙ্গে কথা বলতো না তারা এখন অনুনয় বিনয় করতে লাগলো নতুন করে যুদ্ধ বন্ধ চুক্তি করার জন্য…।
৬মে তাদের সে অনুরোধ আমাদের কমান্ডাররা মেনে নেন…।
খোদার অপার সাহায্য যে ছিলো এ বিজয়ের একমাত্র কারণ, এতো দিনের সূর্যের মতো স্পষ্ট। আর এই সাহায্য পাওয়ার একমাত্র মাধ্যম ছিলেন কর্নেল কিয়ানীর মতো মুমিন পুরুষ ও আমাদের ভাঙ্গাচোরা ঈমানী জজবা। ওয়ালেসে তিনি বার বার বলছিলেন। বেটা! দুশমন পালাচ্ছে… দুশমন অন্ধ হয়ে গিয়েছে … আমার প্রিয় জোয়ানদের বলে দাও… নিজেদের পরাজয়ের বদলি নাও… কর্নেল কিয়ানীর এ শব্দগুলো আমাকে পাগল করে তুললো। আমি অনুভব করছিলাম, আমি আর রক্ত মাংসের সেই দেহ বিশিষ্ট মানুষ নই যা বোমা, গুলির আঘাতে ক্ষত বিক্ষত হবে। আপাদমস্তক রূহ-আত্মা বনে গেলাম আমি। আর এই রূহ বিদ্যুৎ চমকের মতো এগিয়েই যেতে লাগলো।…
হ্যাঁ, গত দুমাস ধরে লক্ষ করছি দুশমনের ঘাড় এখন আর আগের মতো অহংকারে বাঁকা হয় না। তাদের গলার সেই তেজও নেই এখন। ওরা বুঝতে পারছে আমাদেরকে ভুল বুঝে ওরা চরম ভুল করছে।…
পরিণামে শত শত সঙ্গী হারিয়েছে। হারিয়েছে ওদের দখলকৃত বিপুল পাহাড়ি এলাকা। এ দুআ করবেন আমাদের আত্ম মর্যাদা যেন আল্লাহ তাআলা এভাবে সমুন্নত রাখেন। আমৃত্যু বিজয়ের মালা আমাদের সঙ্গী করে দেন।
ইতি–
আপনার ছেলে জামশেদ গুলজার।

আযাদ কাশ্মীরের জোয়ানদের বিজয় যখন সুনিশ্চিত হলো কর্নেল কিয়ানী তখন চিন্নাই রেঞ্জ নামক পাহাড়ে মোর্চাবদ্ধ। তার সঙ্গে ব্যাটালিয়ান কমান্ডার মেজর গোলাম আহমদ। এখান থেকেই তারা পুরো যুদ্ধ নিয়ন্ত্রণ করছিলেন। অবশেষে তিনি যখন শুনলেন তার জোয়ানদের বিজয়ের সুনিশ্চিত খবর তখন তিনি তার মোচা থেকে বেরিয়ে এলেন। তার দু পাশে তখন মেজর গোলাম আহমদ। হাবিলদার গুলজার। ল্যান্স নায়ক কবির ও ল্যান্স নায়ক যাকির হুসাইন।

আচমকা মর্টার গানের একটি গোলা তাদের মাঝখানে এসে বিস্ফারিত হলো। সঙ্গে সঙ্গে শহীদ হয়ে গেলেন কর্নেল কিয়ানী শহীদ, মেজর গোলাম আহমদ শহীদ ও ল্যান্স নায়ক কবির শহীদ। কর্নেল কিয়ানীর মাথায় তখন কাফনের কাপড়টি বাঁধা। তার মুখখানি কেমন সজীব-স্নিগ্ধ। এভাবে শহীদ হওয়ার জন্যই মনে হয় তিনি মোর্চা ছেড়ে বেরিয়া এসেছিলেন, যার সুসংবাদ তিনি পেয়েছিলেন এ লড়াইয়ের আরো অনেক আগে।

কর্নেল হক নেওয়াজ কিয়ানী শহীদকে আরো একবার (মরণোত্তর) স্বাধীনতা পদক দেওয়া হয়। কারণ কর্নেল কিয়ানী স্বাধীনতার সেই মহান সৌধ যা কখনো পরাজিত হয়নি। যার অমরত্ব আরশ পর্যন্ত উচ্চকিত হয়েছে।

তার শহীদ হওয়া ও এ সম্পর্কিত আভাস-ঈংগিত পূর্ব থেকেই পাওয়ার ব্যাপারটি পুরো লিপা উপত্যকায় ছড়িয়ে পড়েছিলো। এ লড়াইয়ের প্রায় মাস তিনেক পর আগষ্টের শুরুতে এক বিকালে দেখা গেলো, ভারতীয় শিখ রেজিমেন্টের একটি বড় দল নিরস্ত্র হয়ে হাতে সাদা পতাকা নিয়ে আযাদ কাশ্মীরের ক্যাম্পের দিকে আসছে।

ক্যাম্পের কমান্ডার তখন মেজর জামশেদ গুলজার। শিখ কমান্ডার অমরনাথ শিখ তার সঙ্গে নিচু স্বরে কিছুক্ষণ আলাপ করলো। যার সারমর্ম হলো, সে লড়াইয়ে আযাদ কাশ্মীর তথা মুসলমানদের এমন অসম্ভব বিজয় তাদের অন্তরের চোখ খুলে দিয়েছে। এবং কর্নেল কিয়ানীর এভাবে শহীদ হওয়ার ঘটনা তাদের ভেতর আলো জ্বেলে দিয়েছে। তারা এখানে ৩০৯ জন জোয়ান আছে। সবাই মুসলমান হতে চায়।

সেদিনই আসরের নামাজের পর ৩০৯ জন বিধর্মী মুসলমান হয়ে গেলো। এভাবেই একটি প্রাণের বিশ্বাসের ঝলকে ঝলকে উঠলো শত শত প্রাণ।