অলীক প্রেমিক – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়
সন্ধে নেমে আসার পর কলকাতার এই সাহেবপাড়াটা মৃত্তিকার কাছে বরাবরই কেমন যেন বিদঘুটে, গা—ছমছমে। বিশাল অট্টালিকাগুলোর অবস্থান বেশ দূরে—দূরে বলেই আলোর চেয়ে অন্ধকারের পরিমাণ বেশি, তার ওপর বাড়িগুলোর কম্পাউন্ডের ভেতর অকারণ ঝুপসি—জঙ্গল, অবহেলায় বহুকাল সাফসুফ করেনি কেউ।
আজ আবার সারাদিন ঝুপঝুপ করে বৃষ্টি হয়েছে, এখনও তার টিপটিপানি কমেনি। এমন মন—খারাপ মন—খারাপ মুহূর্তে হঠাৎ দপ করে লোডশেডিং হওয়ায় ক্যানভাসের সামনে দাঁড়ানো মৃত্তিকার হাতের তুলিটা কেঁপে উঠল একমুহূর্ত।
রাত দশটা বাজেনি এখনও, অথচ নিষ্প্রদীপ হলেই মধ্য—কলকাতার এই এলাকা ঝপ করে ডুবে যায় এক প্রাগৈতিহাসিক অন্ধকারে। এতক্ষণ তবু ফ্যানের হাওয়ায় ঘূর্ণায়মান ছিল চারপাশের সামান্য কলরব, এখন একদম ধীর, শান্ত, চুপচাপ পটভূমি। শুধু বৃষ্টির একটানা ঝিরঝির ঝিরঝির।
খুবই বিরক্ত হয়ে মৃত্তিকা অন্ধকারে হাতড়াতে লাগল দশফুট দরজাটা। হাতের কাছে মোমবাতিটাও আজ রাখেনি বলে খুবই রাগ হচ্ছিল নিজের ওপর, দেশলাই খুঁজতেও যেতে হবে সেই কিচেনে। এখন ঝুপ—অন্ধকার দু—হাতে ঠেলে তাদের এই বসতবাড়িটার বিশাল বিশাল ঘর, লম্বা বারান্দা পেরিয়ে মোমবাতি—দেশলাই খুঁজে বিকল্প আলোর ব্যবস্থা করাটা এই মুহূর্তে তার কাছে এক হারকিউলিয়ান টাস্ক।
হাতের তুলিটা টেবিলের ওপর কোনোক্রমে রেখে দু—পা এগিয়েছে কি এগোয়নি, হঠাৎ তার নাকের লতিতে এসে ঠোনা দিল সেই অদ্ভুত গন্ধটা। বেশ কড়া গন্ধ, তীব্র অথচ মিষ্টি। চুরুটের গন্ধ বলে মনে হয় তার। এর আগে দু—একবার গন্ধটা ঠারেঠোরে তার মস্তিষ্ক ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেছে, কিন্তু সেসময় তার ঝাঁজ এমন প্রবল মনে হয়নি, আজ যেন বেশ তীব্রই। এগোতে গিয়ে কেন যেন থমকে দাঁড়াল মৃত্তিকা।
এমন বিজাতীয় গন্ধ এ—বাড়িতে পাওয়ার কথা নয়। হয়তো গন্ধটা চুরুটের নয়। অন্য কোনো পোড়া গন্ধও হতে পারে। সে ব্যাপারে বেশি ধ্যান না দিয়ে মৃত্তিকা আপাতত তার সবে—শুরু—করা ছবিটা শেষ করে ফেলাই জরুরি বলে মনে করল। মাস দুয়েকের মধ্যে অন্তত গোটা দশেক ছবি তার আঁকার কথা। একজন শৌখিন এন. আর. আই, এদেশে এসে শিমুলতলার পাহাড়ি— এলাকায় একটি বাংলোবাড়ি তৈরি করেছেন, তার ইন্টেরিয়র ডেকরেশনের কাজও প্রায় শেষ। তিনিই তরুণ প্রজন্মের এই উঠতি শিল্পী মৃত্তিকাকে বরাত দিয়েছেন কিছু অয়েল পেন্টিং—এর, যেগুলি শিমুলতলার সেই নির্জন বাংলোটির এ—ঘরে ও—ঘরে টাঙাবেন। একটাই শর্ত, ছবিগুলো হবে বাংলোর নির্জন, রোমাঞ্চকর পরিবেশের সঙ্গে বেশ মানানসই। একটু রহস্যের ছোঁয়াও যেন থাকে।
রাতের ডিনার সেরে সবে মৃত্তিকা আঁকতে শুরু করেছিল ছবিটা, রবার্টকে বলেওছিল, ‘তুমি বিছানায় শুয়ে পড়ো, আমার শুতে রাত হবে।’ রবার্ট অবশ্য খুবই লিবারাল, কোনো কিছুতে আপত্তি করে না। তবে ছবিগুলো শেষ করতে পারলে মৃত্তিকা যে—অঙ্কের পারিশ্রমিক পাবে, তা তার চব্বিশ বছরের জীবনে একটা মস্ত ব্রেক। রবার্টের কাছে প্রমাণ করাও যাবে, তার সঙ্গিনী এই বাঙালি—কন্যাটি নিতান্ত অবহেলার বস্তু নয়। রবার্ট অবশ্য তাকে অবহেলা করেনি এখনও পর্যন্ত। বরং তার ছবি—আঁকার ধারাবাহিক ব্যস্ততা দেখে, গোঁফদাড়ির জঙ্গল থেকে হাসি উপচিয়ে বলে, হোয়াটস দ্য ইউজ অফ সো মাচ ওয়ার্ক, মৃট্টি। আই অ্যাম রিচ এনাফ।
ঘোর অন্ধকারে এহেন ভাবনার মুহূর্তে গন্ধটা আরও একবার ছুঁয়ে যেতেই ভুরু দুটোয় কোঁচ পড়ল মৃত্তিকার। কী আশ্চর্য, কীসের গন্ধ এটা! আর শুধু কি এই অদ্ভুত গন্ধটা! এই বিশাল বাড়ির অনেক কিছুই তো বিপুল রহস্যে মোড়া। একদা হলুদবর্ণ, এখন বিবর্ণ, পলেস্তারা খসো—খসো, সাহেবি ধাঁচের বিশাল দোতলা বাড়িটায় যেদিন পাকাপাকি থাকতে এসেছিল মৃত্তিকা, তার শরীরে কোথাও যেন ছুঁয়ে যাচ্ছিল একটা চোরা রহস্যের আবহ। ছোটোখাটো রাজপ্রাসাদের মতোই দেখতে, ওপর—নীচ মিলিয়ে ষোলো—আঠারোখানা ঘর। সব ঘর পেল্লাই—পেল্লাই। এত বড়ো বাড়ির দোতলায় বাসিন্দা বলতে তারা মাত্র দু—জন, সে আর রবার্ট। নীচের তলায় অবশ্য দারোয়ান—চাকর—বাবুর্চিরা থাকে। দিনের বেলা তাদের কথাবার্তা, চলাফেরা, চকিত হাঁকেডাকে তবু একটা প্রাণ থাকে বাড়িটার, কিন্তু সন্ধের কিছুটা পরে তাদের নিত্যনৈমিত্তিক কাজ সারা হলে, সবাই সেঁধিয়ে যায় নীচের তলায় যার—যার ঘরো। তখন গোটা ওপরতলাটা শান্ত, স্তব্ধ, শুনশান।
সেরকমই এক শুনশান প্রহরে, কিছুটা হাসতে হাসতেই সে একদিন জিজ্ঞাসা করেছিল রবার্টকে, এত বড়ো বাড়িতে তুমি এতদিন একা থাকতে। ভয় করত না?
রবার্টের চুল যিশুর মতো লম্বা—লম্বা, মুখময় দাড়িগোঁফের রাশ, তার স্বপ্নালু চোখ বিস্ফারিত করে হেসে উঠেছিল হো হো করে, ভয়! হোয়াট ভয়!
রবার্ট খাস কলকাতার এই সাহেবিপাড়ার বর্ন অ্যান্ড ব্রট—আপ, তার আঠাশ বছরের ক্যালকেশিয়ান জীবনে কিছু—কিছু বাঙালিয়ানা রপ্ত হয়ে গেছে। বাংলাটা মোটামুটি বোঝে, তবে ভালোমতো বলতে পারে না এখনও। তবে মৃত্তিকাকে বলেছে, তোমার সঙ্গে বছরখানেক ঘর করলেই সব শিখে নেব। ডোন্ট ওরি।
মৃত্তিকা অবশ্য বেশিরভাগ ইংরেজিতেই কথা বলে রবার্টের সঙ্গে, কখনো বাংলায়ও। তার দীর্ঘ বাংলা বাক্যগুলি কান খাড়া করে কিছুটা বুঝে কিছুটা না—বুঝে অবোধ বালকের মতো ঘাড় নাড়তে থাকে রবার্ট, তখন একরাশ কৌতুকে, কৌতূহলে উপচে পড়ে মৃত্তিকার মুখ। রবার্টের সব ব্যাপারটাই অবশ্য এখনও তার ভারী মজার মনে হয়। বস্তুত একটা আস্ত বিদেশি যুবকের সঙ্গে ঘর করার কথা সে তিন—চার মাস আগেও স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি, এখনও তার কাছে সমস্ত ব্যাপারটা ভারী অবিশ্বাস্য মনে হয়, চমকপ্রদও।
মাত্র চারমাস আগে রবার্টের সঙ্গে তার আলাপ অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসের সাউথ গ্যালারির এক প্রদর্শনীতে। মৃত্তিকারই গোটা কুড়ি ছবি নিয়ে প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল ‘কনটেম্পোরারি আর্টিস্টস’ নামে একটি টগবগে সংস্থা, যেখানে রবার্ট নিতান্তই বোকা—বোকা মুখ করে এ—দেওয়ালে ও—দেওয়ালে ঘুরে ঘুরে দেখছিল মৃত্তিকার ‘ইনফিনিটি’ সিরিজের নতুন ছবিগুলো, আর মাঝেমধ্যে তার গোঁফদাড়ির সুন্দরবন থেকে বিড়বিড় শব্দ বেরুচ্ছিল, ফাইন, ফাইন। বিউটিফুল।
তখন অবশ্য একটুও মাথা ঘামায়নি মৃত্তিকা, এরকম ফ্লোটিং সমঝদার কতই তো আসে রোজ রোজ, কিন্তু হঠাৎ বিদেশিটি কড়কড়ে আড়াই হাজার টাকায় তার মাঝারি সাইজের একটি ছবি কিনতেই টনক নড়ল তার। খোঁজখবর নিয়ে যে—বৃত্তান্ত জানল, তা ভারী অদ্ভুত, কেননা রবার্ট নাকি সাধারণত অ্যান্টিক কেনারই পক্ষপাতী, হঠাৎ এই ছবিটার ভেতর সে খুঁজে পেয়েছে পৃথিবীর সেই আদিম যুগ, যখন মানুষ গুহায় বাস করত, জীবনধারণ করত ফলমূল কিংবা পশুপাখির ঝলসানো মাংস তারিয়ে তারিয়ে খেয়ে।
তারপর কিছুদিনের খেজুরে কথাবার্তা, আলাপচারিতার পর রবার্টের সঙ্গে এই লিভ—টুগেদারের সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে তিন মাসও লাগেনি মৃত্তিকার, যদিও তার এহেন গা—জুয়ারি কার্যকলাপে ইতিমধ্যে ভূমিকম্প বয়ে গেছে তাদের একান্নবর্তী পরিবারে, তত রক্ষণশীল নয় এমন শিক্ষিত আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের ভেতরও।
সেই ভুঁইকাঁপের কিছু সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অংশ মৃত্তিকার শরীরেও চারিয়ে না যায়নি তা নয়, কিন্তু ততক্ষণে তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে রবার্টজনিত এক মাধ্যাকর্ষণ টান।
কিন্তু রবার্টসম্পর্কিত কারণে যতটা রহস্য ঘনীভূত হয়েছিল তার ভেতর—শরীরে, এখন এই সাবেকি সাহেবি প্যাটার্নের অট্টালিকাটি তার দ্বিগুণ কৌতূহলের কারণ। এ তল্লাটের সবক’টা বাড়িই বেশ পুরোনো। সেকালের ইংরেজি সিনেমায় সাবেক লন্ডনের শহরতলিতে যে—ধরনের দোতলা বাংলো বাড়িগুলো দেখা যায়, ঠিক তেমনই এইসব বাড়ি, অনেকটা জায়গা নিয়ে তৈরি। চারপাশে উঁচু পাঁচিল, ভেতরে গুল্মলতা—ঝোপেঝাড়ে ভরতি। দু—একটা বকুল, ছাতিম কিংবা কাঠটগরের মতো বড়ো গাছও। অথবা বৃদ্ধ পামগাছের সারি। অনেকগুলো বাড়িই অর্ধশতবর্ষ অতিক্রম করেছে। কোনোটা আরও পুরোনো, যেমন রবার্টদের ঠিক সামনের বাড়িটাই হাড়গোড় বেরিয়ে আপাতত মহেঞ্জোদারো। এ তল্লাটে শুধু একটাই বাড়ি ঝকঝকে নতুন, মাল্টিস্টোরিড, সেটা এ বাড়ির উত্তর দিকে। রবার্ট জানিয়েছে, ওখানে একটা মস্ত বড়ো পুকুর ছিল, সেটা বুজিয়েই এখন আকাশচুম্বীটা উঠে এসেছে হু হু করে, অসীম উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে।
রবার্টের বাড়ির মস্ত গেটটাতেও যা এখনও খোদিত হয়ে আছে অস্পষ্ট অক্ষরে : এস্টাব্লিশড এইট্টিন থার্টি এইট। অন্তত আধ বিঘে জমির ওপর তৈরি প্যালেসপ্রতিম বাড়িটার চারপাশেও বড্ড ঝোপঝাড়, কত যে গুল্মলতা।
এত বড়ো বাড়িতে প্রথম প্রথম তার বেশ গা ছমছমে লাগলেও মাসদুয়েক কেটে গেল রবার্টকে বুঝতেই। রবার্ট অবশ্য ছিমছাম, রুচিসম্মত যুবক, তার জীবনযাপন সাধারণ, বাঙালি—খানা খেতেও অভ্যস্ত, শুধু একমাত্র ছবি অ্যান্টিক কলেকশন। এত বড়ো বাড়িটার এ—ঘরে ও—ঘরে, বারান্দায়, সিঁড়ির মুখে, দেওয়ালে অজস্র সব পুরোনো মূর্তি, ইতিহাস—ছুঁয়ে—থাকা দেওয়াল—চিত্র,প্রাচীন ঐতিহ্যের কারুকাজ করা পালঙ্ক—ড্রেসিংটেবিল— আলমারি—ছাইদান, আরও টুকিটাকি অপার বিস্ময়।
কিন্তু এতসব অ্যান্টিকের সঙ্গে আরও যে কৌতূহলটি মৃত্তিকাকে জারিত করে, তা হল এ—বাড়ির কিছু অলৌকিকতা। হয়তো কোনোদিন মেঘলা দুপুরে বেডরুমে ছড়িয়ে—ছিটিয়ে একা শুয়ে আছে, হঠাৎ মনেহয় দু—পায়ে শব্দ তুলে কেউ যেন কিচেনে সরিয়ে সরিয়ে রাখছে ভরতি বয়ামগুলো।
তবে তার চেয়েও যে অস্বস্তিকর ব্যাপার আপাতত সবচেয়ে শিরঃপীড়ার কারণ, তা হল যখন তার ক্যানভাসের সামনে দাঁড়িয়ে তুলি হাতে ব্যস্ত থাকে নতুন কোনো ছবি আঁকা, তখন হঠাৎ কোথা থেকে যেন ভেসে আসে চুরুটের গন্ধ।
গন্ধটা কেন যেন আজকাল প্রায়ই পাচ্ছে সে। বেশ তীব্র আর কড়া ঝাঁজের, তবে তার সঙ্গে একটা অদ্ভুত মিষ্টি গন্ধ ওতপ্রোত হয়ে থাকে, ফলে গন্ধটায় যেন বেশ রোমান্টিক—রোমান্টিক আমেজ। চুরুটের এহেন গন্ধ খুব একটা খারাপ লাগে না, আসলে চুরুট মুখে দেওয়া পুরুষদের এমনিতেই দারুণ ব্যক্তিত্বময় বলে মনে হয় তার। তার ওপর চুরুটে যদি এমন মিষ্টি গন্ধ থাকে তাহলে তো সেই পুরুষটির রুচিবোধ নিশ্চিত তারিফ করার মতোই।
গন্ধটা প্রথম যেদিন এ—বাড়িতে এসে পেয়েছিল, বেশ অবাক হয়ে চোখ বড়ো বড়ো করে জিজ্ঞসা করছিল রবার্টকে, তুমি চুরুট খাচ্ছিলে নাকি।
রবার্ট তার যিশুর মতো লম্বা, ঝাঁকড়া, লালচে চুল ঝাঁকিয়ে বলেছিল, নো—
মৃত্তিকা অবশ্যই জানতই যে রবার্ট চুরুট খায় না, সিগারেটও কদাচিৎ। বস্তুত পুরোনো ঐতিহ্য কেনা ছাড়া তার যে তেমন কোনো নেশাই নেই এমন একটা তথ্য আবিষ্কার করেছে মৃত্তিকা। সকালে উঠে কফির কাপ এগিয়ে দিলে বেশ জম্পেশ করে চুমুক দেবে তাতে, না দিলেও বলবে না ‘কফি কই!’ একদিন বিস্মিত হয়ে বলেওছিল, এই অ্যান্টিক বাড়িটায় আমাকে তুমি কী মনে করে নিয়ে এলো বলো তো?
রবার্ট নির্দ্বিধায় উত্তর দিয়েছিল, তোমার মধ্যে একটা প্রাচীন বাঙালিয়ানা আছে, যা আমার অ্যান্টিক কালেকশনের পাশাপাশি ভারী মানবে বলে মনে হয়েছিল।
—রিয়্যালি! ঝকঝকে হাসিতে চলকে উঠে মৃত্তিকা অবাক হয়েছিল কম নয়। একটু থিতু হতে এও ভেবেছিল সে ইংলিশ মিডিয়ামের ছাত্রী হলেও, মুখে তুখোড় ইংরেজি আর কখনো পরনের জিনস সত্ত্বেও সত্যিই তথাকথিত আধুনিকতা তাকে তেমন স্পর্শ করতে পারেনি। হয়তো উত্তর কলকাতায় এক একান্নবর্তী পরিবারের পুরোপুরি বাঙালি ঘরানায় বড়ো হয়ে উঠে সে এখনও মনেপ্রাণে বাঙালি। সাহেব বরের সঙ্গে ঘর করতে এসেও শাড়িই পরে বাড়িতে।
যাই হোক, রবার্ট চুরুট খায় না, আশেপাশের বাড়িগুলো ঢের দূরে দূরে, তাহলে এ বাড়িতে চুরুটের গন্ধ আসে কোত্থেকে ভেবে—ভেবে হাল্লা হয়ে গেল মৃত্তিকা।
রবার্টকে এ—বাড়ির এতসব অলৌকিকতার কাহিনি শোনালে বেমালুম উড়িয়ে দিয়ে হেসে বলে, এ বোধহয় তোমার একধরনের ইলিউশন। হ্যালুসিনেশনও বলতে পার। তবে কেউ যদি থেকেও থাকে তো থাকুক না। তোমার তো কোনো ক্ষতি করছে না। মনে করো ‘ফ্রেন্ড’।
সেই অদৃশ্য বন্ধুর কথা ভেবে ভারী আশ্চর্য হয়ে রবার্টের দিকে তাকিয়ে থাকে মৃত্তিকা। রবার্টের কথাগুলো যেন কেমন—কেমন। একমুখ দাড়িগোঁফ আর লালচে চুলের এই বোহেমিয়ান যুবকও যেন সেই মুহূর্তে মৃত্তকার একদম অচেনা। রবার্টের বাবা ইংরেজ ছিলেন, মা অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। চাকরিতে রিটায়ারমেন্টের পর তার বাবা—মা এ—দেশ ছেড়ে ইংলন্ডে পাড়ি জমালেও পিতৃপুরুষের তৈরি এই বিশাল দোতলা বাড়িটিতে সে রয়ে গেছে হয়তো বা বাড়িটির অ্যান্টিক হয়ে ওঠার কারণেই। রবার্ট একদিন গল্পে—গল্পে এও শুনিয়েছে, তাদের বাড়ির সামনে যে—মহেঞ্জোদারোপ্রতিম হাড়গোড়—বেরোনো দোতলা বাড়িটা এখন প্রায় নিঃসঙ্গ, শুনশান, সেটা কোনো এক আর্মেনীয় পরিবারের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আমলে জাপানি বোমারু বিমানের আক্রমণের আতঙ্কে তারা বাড়িটা ছেড়ে সপরিবারে পালিয়ে গিয়েছিল কোথাও, আর ফিরে আসেনি কখনো। তবে তাদের কোনো এক উত্তরাধিকারী বহুকাল পরে দখল নিতে এলেও চলে গিয়েছিল কোনো অজ্ঞাত কারণে, কারণটা রবার্ট বলতে পারেনি অবশ্য।
যাই হোক, পুরোনো আমলের ইতিহাস থেকে উঠে আসা এই বিদেশি ধাঁচের বাড়িতে বসবাস করাটা ক্রমে যেমন রোমাঞ্চকর হয়ে উঠল মৃত্তিকার কাছে তেমনই অস্বস্তিকর। মস্ত বাড়িটার দোতলায় পশ্চিমের বিশাল বারান্দা—সংলগ্ন পর—পর গোটা ছয়েক ঘর, তারই কোনোটা ড্রয়িং, কোনোটা বেডরুম, কোনোটা ডাইনিং বা কিচেনে রূপান্তরিত করে একেবারে সবশেষে, উত্তরের পেল্লাই ঘরখানা তার বিশাল স্টুডিয়ো করে দিয়েছে রবার্ট। সেখানে ক্যানভাসের সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিরুপদ্রব দাঁড়িয়ে দু—খানা প্রমাণ সাইজের অয়েল পেন্টিং এঁকে ফেলার পর আজ সেই চুরুটের গন্ধটা যেন বেশ গাঢ় হয়ে ঘিরে ফেলল মৃত্তিকাকে।
অন্ধকার একটু থিতু হতেই ঘরের দেওয়াল ঠাহর করে এগোবার সময় সে এও খেয়াল করল, গন্ধটাও চলছে তার সঙ্গে। কিন্তু দরজা পেরিয়ে বারান্দায় পা দেওয়ার আগেই হঠাৎ তার শাড়ির আঁচলটা যেন বেধে গেল। নিশ্চয়ই দরজার ল্যাচকিতে বেধে গেছে আঁচল এই ভেবে ছাড়াতে গিয়ে দেখল, কোথায় ল্যাচকি! কেউ যেন ইচ্ছে করে টেনে ধরেছিল তার আঁচল, সে ফিরতেই ছেড়ে দিয়ে লুকিয়ে পড়েছে কোন চোরা অন্ধকারে।
বুকের ভেতরটা ছাঁত করে উঠল মৃত্তিকার। বুঝে উঠতে পারল না, অন্ধকারের সুযোগে কেউ ঢুকে পড়ল কি না বাড়ির ভেতর। ওপরে তো আপাতত সে ছাড়া আর কেউই জেগে নেই। রবার্ট এতক্ষণে নরম বিছানায় অবাধ ঘুমের কবলে। নীচের বাসিন্দারা তথৈবচ। তাহলে!
দ্রুত বারান্দা পেরিয়ে হাতড়ে হাতড়ে কিচেনে ঢুকে আশ্চর্য দক্ষতায় খুঁজে বার করল মোমবাতি আর দেশলাই। মোমবাতিটা জ্বালাতেই এতক্ষণের হারানো সাহস আবার ফিরে পেল। একবার ভাবল, রবার্টকে ঘুম থেকে ডাকবে কি ডাকবে না, পরক্ষণে মনে হল, না তাক, সারাদিনে ব্যবসার কাজে খুবই ধকল যায় তার ওপর।
স্টুডিয়ো—ঘরটিতে দ্রুত ফিরে এসে ক্যানভাসের সামনে টেবিলের ওপর জুতজাত করে বসাল মোমবাতিটা। ক্যানভাসের শরীরে আলো একটু পড়েছে বটে, কিন্তু আঙুলের ডগায় তুলি উদ্যত করে সে এল অনুভব করল যে, ছবিটার আদ্যন্তে বেশ রহস্যময়তা ফুটেছে, এমন আলো—আঁধারি পরিবেশ রহস্য বাড়াতে সাহায্যই করবে নিশ্চয়।
কিছুটা দম নিয়ে, হাতের তুলিতে রং মাখিয়ে যে মুহূর্তে মৃত্তিকা ঝুঁকে পড়তে যাবে ক্যানভাসের ওপর, অমনই কী আশ্চর্য দপ করে নিভে গেল মোমবাতিটা। সে অবাক হল, কারণ কোথায় তো কই তেমন হাওয়া নেই। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে বটে, কিন্তু আপাতত সে বৃষ্টি একটুও দামাল নয়।
বিরক্ত হয়ে আবারও দেশলাই জ্বালাল সে, মোমবাতির শিখাটা উসকে উঠতেই আঁকতে শুরু করবে, সেই মুহূর্তে মোমবাতিটা ফস করে নিভে গেল আগের মতোই। ভুরুতে মস্ত কোঁচ ফেলে মৃত্তিকার মনে হল, হাওয়া নয়, কেউ যেন নিভিয়ে দিল মোমবাতিটা। চারপাশে থই থই চুরুটের সেই অদ্ভুত গন্ধ। ঘোর অন্ধকারে, বাইরে একটানা বৃষ্টির ধারাপতনের শব্দ শুনতে শুনতে কেন যেন এতক্ষণে বিপুলভাবে কেঁপে উঠল মৃত্তিকার শরীর। চেঁচিয়ে উঠতে যাচ্ছিল, রবার্ট, রবার্ট, হেল্প মি—
কিন্তু তার আগেই দপ করে আলো জ্বলে উঠতেই ঘাম দিয়ে জ্বল ছেড়ে গেল তার। ওহ, কী সাংঘাতিক ঝামেলাতেই না পড়ে গিয়েছিল সে। স্বস্তির শবাস ফেলে রং—তুলি নিয়ে ক্যানভাসের ওপর পুনর্বার মনঃসংযোগ করতেই বুঝল, ছবি আঁকার ঘোরটাই যেন কেটে গেছে। কিছুক্ষণ আঁকিবুকি কেটে, বিরক্ত হয়ে ফিরে গেল তার বিছানায়। কিন্তু সে রাতে তার চোখে ঘুমই এল না।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে সমস্ত ঘটনাটাই তার মনে হল একটা স্মৃতি, তাতে একটা ক্ষীণ রহস্য শুধু মাখানো। একবার মনে হল, গভীর ঘুমন্ত রবার্ট কাল রাতে কিছুই জানেনি, শোনেনি, তাকে ব্যাপারটা জানানো দরকার, পরমুহূর্তে মনে হল, রবার্ট শুনলে হয়তো হো হো হেসে উঠবে। বলবে, বাঙালি মেয়ে তো, তাই এত ভিতু। আমি তো এই বাড়িতে একা—একা এত বছর কাটিয়েছি—
অতএব মনের খুঁতখুঁতানিটা মনের কোল্ড স্টোরেজেই ঢুকিয়ে রেখে মৃত্তিকা যথারীতি সারাদিন তার টুকিটাকি পাঁচমিশেলি কাজে ব্যস্ত থেকে, তারই ফুরসতে কখনো ক্যানভাসে আত্মনিয়োগ করে কাটিয়ে দিল দিনটা। সন্ধের পর একদম ফ্রি। আরও মনোনিবেশে ছবির অবয়বে প্রাণসঞ্চার করতে যেতেই যথারীতি কালকের মতোই নিষ্প্রদীপ। আজ অবশ্য পুরোনো ভুলটা আর করেনি। হাতের কাছে গোছানোই ছিল মোমবাতি—দেশলাই, চট করে জ্বেলে ফেলল দ্রুত ও দক্ষ হাতে। কিন্তু মোমবাতিটা টেবিলে ন্যস্ত করার মুহূর্তেই কে যেন নিভিয়ে দিল এক ফুঁয়ে। মৃত্তিকা বিস্মিত হল, শরীরটা ছমছমও কর উঠল তৎক্ষণাৎ। মনে হল কাছেই কারও যে নিশ্বাস পড়ল ফস শব্দে। এবার একটু ভয় পেয়েই মোমবাতিটা দ্রুত জ্বালিয়ে নিল আবার, কিন্তু তাকে অবাক করে মোমবাতিটা নিভিয়ে দিল কেউ।
একরাশ গা—ছমছমে আবহের মধ্যে বিরক্তি প্রকাশ করে সে বলে উঠল, ডিস্টার্বিং।
তার ক্ষোভে একরাশ জল ঢেলে কেউ যেন হেসে উঠল, তার আশেপাশে কোথাও, সে হাসি প্রায় ফিসফিসানির মতোই।
পরক্ষণেই মৃত্তিকা যেন শুনল, কেউ হিসহিস করে বলছে, আর লাইক টু ডিস্টার্ব ইউ।
মৃত্তিকা ঘোর অন্ধকারের ভেতর একবার চোখ চালিয়ে দেখার চেষ্টা করল, সত্যিই কোথাও কেউ দাঁড়িয়ে আছে কি না। না দেখতে পেয়ে নিজের মনেই বিড়বিড় করল, বাট হোয়াই?
তক্ষুনি ফিসফিস করে কেউ যেন বলল, বিকজ ইউ আর সো বিউটিফুল—
মৃত্তিকার শরীর থর থর করে কেঁপে উঠল একলহমা। মিশ—অন্ধকারের পটভূমিতে দাঁড়িয়ে একা কারও সঙ্গে সে কথা বলছে, সেও উত্তর দিচ্ছে মৃত্তিকার সংলাপের, সমস্তটা তার কাছে অদ্ভুত, অবিশ্বাস্য। তবু ‘ইউ আর সো বিউটিফুল’ সংলাপটি শুনে সে ভারী আশ্চর্য হল, সুন্দরী শুনলে সব মেয়েই যেরকম খুশি হয়।
একটা বিজাতীয় ঘোর ক্রমশ মৃত্তিকাকে ঘিরে ধরছে তখন। কী করবে সে, এই অলৌকিকতা থেকে তার পরিত্রাণ কী, এমন ভাবতে ভাবতে দপ করে আলো জ্বলে ওঠায় সে একটা স্বস্তির শ্বাস ফেলে নিজের মনে উচ্চারণ করল, উফ, বাঁচা গেল।
বলবে—না—বলবে—না করেও শেষমেশ দু—দিনের এই অলৌকিক ঘটনাপ্রবাহ রবার্টের কাছে বলেই ফেলল মৃত্তিকা। জিজ্ঞাসা করল, কী ব্যপার বলো তো। একটা মিস্ট্রি আছে মনে হচ্ছে।
রবার্ট আগের মতোই হেসে বলল, অল বোগাস।
—না, সত্যিই কেউ সারাক্ষণ এ—বাড়িতে ঘুরছে ফিরছে মনে হয়।
—দেন ইগনোর হিম। বলল বটে রবার্ট, কিন্তু মৃত্তিকা কিছুতেই এই অদ্ভুত ব্যাপারটা ঝেড়ে ফেলতে পারল না গা থেকে।
সেদিন রবার্ট দুপুরে বেরিয়ে গেছে তার কাজে, সে একা ড্রইঙে বসেছে, হঠাৎ কে যেন তার গায়ে গভীর নিশ্বাস ফেলল একটা। চমকে এদিক—ওদিক ফিরে ভুল বুঝতে পারলেও চুরুটের গন্ধটা কিন্তু উড়িয়ে দিতে পারল না। কী আশ্চর্য, কে চুরুট খাচ্ছে, কোথায়!
কিন্তু দিনের বেলায় তবু একরকম, ঘাড়ের ওপর গরম নিশ্বাসের স্পর্শ তবু ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিতে পারে, কিন্তু যত রাত হয়, ততই একটা বিদঘুটে ভয় সারাক্ষণ জড়িয়ে জড়িয়ে উঠতে থাকে তার শরীর বেয়ে। বিশেষ করে কাল রাতের সেই বিচিত্র সংলাপ—
মৃত্তিকা অবশেষে খুব চেষ্টা করতে লাগল, যাতে দিনের আলোয়, বেলা শেষ হওয়ার আগেই যতটা পারে তার ছবি—আঁকার কাজ শেষ করে ফেলে। তবু কয়েকদিন একটানা স্থির পর্যবেক্ষণে সে আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করল, যতক্ষণ সে ঘাড় গুঁজে আঁকছে, কেউ যেন তার আচরণ, নড়াচাড়া সারাক্ষণ লক্ষ করে চলেছে অলক্ষ্যে দাঁড়িয়ে। কখনো দূর, থেকে কখনো কাছে এসে, কখনো মনে হচ্ছে তার পেছনে দাঁড়িয়ে তার ঘাড়ের ওপর দিয়ে উঁকি মেরে পরখ করছে তার আঁকাজোকার কাজ। শরীর ছমছম করছে তার, শিউরে উঠছে গা, তবু উপায় নেই বলেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা একাগ্র পরিশ্রমে একনিষ্ঠ সাধনায় তাকে এঁকে যেতে হচ্ছে একটার পর একটা ছবি। এর পরের কয়েকদিন একরত্তিও লোডশেডিং না হওয়াতে কিছুটা স্বস্তিই অনুভব করল মৃত্তিকা। ছবি আঁকার কাজটা কিছুটা এগিয়ে ফেলল ক—দিনে। তবু সারাটা দিন, গভীর রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে পর্যন্তও সেই অলীক, অপার্থিব ঘোরটা যেন লেগেই রইল তার শরীরে।
সেদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে রবার্ট ‘কফি, কফি’ বলে দু—তিনবার তাগিদ দিতেই মৃত্তিকা দ্রুত কিচেনে গিয়ে দু—কাপ কফি বানিয়ে ফেলল চোখের নিমেষে। প্লেট বার করল কাবার্ড খুলে, ফিরে এসে অবাক বিস্ময়ে আবিষ্কার করল, গ্যাসের স্ল্যাবের ওপর মাত্র একটাই কাপ। অপর কাপটি এলোপাথাড়ি খুঁজতে খুঁজতে হাল্লা হয়ে গিয়ে অবশেষে ভাবতে বসল, তাহলে কি সে এককাপ কফিই বানিয়েছে ভুল করে। এটা কি তার শিল্পীসম্মত অন্যমনস্কতা,—না কি সে একটু ভুলোমনা বলেই! ওদিকে রবার্ট চতুর্থবার তাগিদ দিতেই মৃত্তিকা দ্রুত রবার্টের কাপটা দিয়ে এল ড্রইঙে, যেখানে সে খালি গায়ে শর্টস পরে বসে আছে ঘুমভাঙা চোখে। মৃত্তিকার হাতে এক কাপ কফি দেখে তার চোখে বিস্ময়, তুমি কফি খাবে না?
—খাব। তুমি শুরু করো। আমি আসছি। চোখের পলকে মৃত্তিকা কিচেনে ফিরে এসে দ্বিতীয় কাপ কফি বানাতে গিয়ে স্তম্ভিত হয়ে দেখল, যে—কাপটি একটু আগেই তার চোখে পড়েনি, সেটি বহাল তবিয়তে স্ল্যাবের ওপর অপেক্ষমান, কিন্তু খালি।
মৃত্তিকার চোখ বিশ্বাসই করতে পারছিল না ঘটনাটা। আবার গ্যাস জ্বালিয়ে কফি তৈরি করতে করতে হঠাৎ কে যেন তার ঘাড়ের কাছে নিশ্বাস ফেলল, পরক্ষণেই ফিসফিস করে বলল, ইট ওয়াজ মাইন। আমি খেয়ে নিয়েছি।
মৃত্তিকা নিমেষে ঘুরে দেখতে চাইল, সত্যিই তার পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে কি না। না দেখে বিরক্তিতে বিড় বিড় করল, ডিস্টার্বিং। তার মন্তব্যে কোথাও কেউ যেন হেসে উঠল প্রায় ফিসফিসানির মতো, কৌতুকের স্বরে বলল, আই লাইক টু ডিস্টার্ব ইউ—
কফি সংক্রান্ত এপিসোডটি এক সপ্তাহের মধ্যে বারতিনেক ঘটে যাওয়ার পর মৃত্তিকা একদিন শুনল, আমার জন্যেও এককাপ করে বানাও না রোজ।
সমস্ত ব্যাপারটা চরম অবিশ্বাস্য হলেও মৃত্তিকা অতঃপর তার অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনকাপ করে কফি তৈরি করতে শুরু করল। এককাপ কফি স্ল্যাবের ওপর জিরোতে দিয়ে অন্য দু—কাপ নিয়ে যেত ড্রইঙে। ফিরে এসে দেখত, তৃতীয় কাপটি খালি।
ঘটনাটা একই সঙ্গে বিস্ময়ের, অবিশ্বাসের, সেইসঙ্গে ভারী কৌতুকের মনে হল মৃত্তিকার।
ক—দিন এমন অদ্ভুত টানাপোড়েনে তার ছবি—আঁকার কাজটা পিছিয়ে পড়তে লাগল ক্রমশ। ফলে আবারও গভীর রাত জেগে ছবি আঁকতে শুরু করতে হল। আঁকতে আঁকতে একদিন ঠিক রাত বারোটার সময় দপ করে আলো নিভে গেল গোটা সাহেবপাড়ায়। ঠিক এরকমই একটা আশঙ্কা করছিল আনমনে। তৎক্ষণাৎ তার তুলি—ধরা আঙুলগুলো আচমকা কেঁপে উঠতে ছবিটির একটা অংশ ধেবড়ে গেল বিশ্রীভাবে।
কেউ যেন তার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিল এতক্ষণ, কৌতুক—কৌতুক মুখে তাকিয়ে দেখছিল তার তন্ময় হয়ে ছবি আঁকা। আলো নিভে যেতে, ছবি নষ্ট হয়ে যেতে হেসে উঠে বলল, দ্যাট’স রাইট।
যেন ‘বেশ হয়েছে’ বলে হেসে উঠল কোনো খুনসুটে যুবক।
খুব রাগ হয়ে গেল মৃত্তিকার। দেশলাই খুঁজছিল মোমবাতি জ্বালবে বলে, অন্ধকারে টাল খেতে খেতে কাঁপা গলায় জিজ্ঞাসা করল, ব্যাট হু আর ইউ?
ফিসফিস কণ্ঠে কেউ জবাব দিল, সে তুমি চিনবে না।
—কিন্তু তুমি আমার সঙ্গে এরকম করছ কেন? উত্তরে সেই কণ্ঠস্বর খুকখুক করে হেসে উঠল, অদ্ভুত ভঙ্গিতে বলল, আমার ইচ্ছে। খুব ভালো লাগছে তোমাকে রাগাতে। রাগলে তোমাকে ভারী সুন্দর দেখায়। মৃত্তিকা ভুরু কোঁচকাল, অবাক হল, একটা আশ্চর্য শিরশিরানি বয়ে গেল তার সমস্ত শরীরে। অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াচ্ছিল মোমবাতিটা। টেবিলের কোণে যেখানে রাখা ছিল সেটা, এই মুহূর্তে সেখানে নেই। কোথায় গেল, কোথায় রাখল, গোটা টেবিলে খুঁজতে খুঁজতে যখন জেরবার হচ্ছে সেসময় হঠাৎ কোত্থেকে মেঝের ওপর গড়িয়ে পড়ল মোমবাতিটা। সঙ্গে সঙ্গে ফিসফিস কণ্ঠস্বর শুনতে পেল, কেমন জব্দ করেছি, বলো দেখি।
—রাবিশ। মৃত্তিকা ধমকে উঠল, দেশলাইটা জ্বেলে দেখতে চাইল মোমবাতিটার অবস্থান, সেদিকে দ্রুত এগিয়ে যেতে গিয়েই মনে হল তার আঁচল পেছন থেকে টেনে ধরেছে কেউ। পেছন ফিরতেই আঁচলটা আলগা হয়ে চলে এল তার পিঠে, কিন্তু মোমবাতির কাছে পৌঁছোবার আগেই আরও গড়িয়ে গেল মোমবাতি। সঙ্গে সঙ্গে কেউ হেসে উঠল অন্ধকারের ভেতর।
মৃত্তিকা বিরক্ত হয়ে বলল, কেন এরকম করছ আমার সঙ্গে?
সেই আশ্চর্য কণ্ঠস্বর আবার ফিসফিস করল, বিকজ ইউ আর সো বিউটিফুল।
মৃত্তিকা যে সুন্দরী সেটা তার বয়ঃসন্ধির দিন থেকেই শুনে আসছে এর—ওর মুখে, আয়নায় নিজেকে দেখে না—বোঝেও তা নয়, তবু অশরীরী কণ্ঠস্বরে আরও একবার শুনে হঠাৎ হাসি পেয়ে গেল তার। এমন বিচিত্র অভিজ্ঞতা তার চব্বিশ বছরের জীবনে কখনো ঘটবে তা ভাবেইনি কখনো। অদ্ভুত অনুভূতিটুকু নিজের মধ্যে চালান করে দিয়ে বলল, কিন্তু তার জন্য আমার ছবি—আঁকার কাজে ডিস্টার্ব করছ কেন? আর ক—দিনের মধ্যে এতগুলো ছবি এঁকে ফেলতে হবে আমাকে—
এবার মৃত্তিকাকে স্তম্ভিত করে অস্পষ্ট কণ্ঠস্বর ভীষণ আবেগজড়িত গলায় বলল, বিকজ আই লাভ ইউ।
মৃত্তিকা হালকা—পলকা শরীরটা এক অদ্ভুত শিহরনে হু—হু করে কেঁপে উঠল সহসা। তিন শব্দে ভালোবাসার এহেন প্রকাশ তার এ তাবৎ জীবনযাপনে আরও বহু যুবকের কাছ থেকে উপহারের মতো পেয়েছে। একমাত্র রবার্টের কাছে ছাড়া ভয়ংকর অন্ধকারের মধ্যে এক অশরীরী কণ্ঠে বহুবার শোনা কথাটা নতুন করে শুনে তার শরীর জুড়ে ঘনিয়ে এল অসম্ভব জ্বর। সে স্তব্ধ হয়ে গেল, ভুলে গেল হাতের দেশলাই কাঠিটা জ্বালাতে, শুধু হিম—কণ্ঠস্বরে বলল, তা কী করে হবে? উত্তরে কিছু বলার ছিল বোধহয় সেই কণ্ঠস্বরের, কিন্তু দপ করে আলো জ্বলে ওঠায় তখনকার মতো নিষ্কৃতি পেল মৃত্তিকা।
কিন্তু না, পরবর্তী ক—দিন সেই অশরীরী ক্রমশ আরও দামাল হয়ে উঠল তাকে বিরক্ত করতে। দুপুরে স্নানটান করে চুল বেঁধে, তাতে কাঁটা গুঁজে টুকিটাকি কাজ করতে ব্যস্ত, সহসা কে যেন তার চুলের গোছা ফস করে খুলে ফেলল। মৃত্তিকা ব্যস্ত হয়ে চুল বাঁধতে গিয়ে দেখল, কাঁটাটাই নেই। কাঁটা খুঁজতে এ—ঘর ও—ঘর তোলপাড়, শেষে নতুন একটা কাঁটা খুঁজে তবে রেহাই।
আর কী আশ্চর্য, কাঁটাটা কি না পাওয়া গেল ওয়ারড্রোবে ঝুলিয়ে রাখা রবার্টের টি—শার্টের পকেটে। রবার্টই পরদিন খেয়েদেয়ে বেরোনোর সময় টি—শার্টের পকেট থেকে বের করল চোরাই মালটি, অবাক হয়ে বলল, আরে, তুমি কি আজকাল আমার পকেটটাকেই ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার ভেবেছ নাকি!
মৃত্তিকা এতদিনে অভিমানে ঠোঁট ফোলাল, আমি রাখতে যাব কেন?
—তবে কি আমিই রেখেছি?
—না। আর একজন। এ—বাড়ির আর একজন যে বাসিন্দা থাকে, সে—ই।
রবার্ট মৃত্তিকার দিকে তাকাল কীরকম অচেনার চোখে, গায়েই মাখল না কথাটা, বলল, তাই!
—হ্যাঁ, বলে গত কয়েক দিনের ঘটনা কিছুটা চেপে, কিছুটা না—চেপে গড়গড় করে বলে গেল মৃত্তিকা। শুনে রবার্ট খুব যে একটা আশ্চর্য হল তা নয়, হেসে বলল, ইন এনি কেস, ইগনোর হিম।
—কিন্তু ঘটনাটা আসলে কী?
রবার্ট এগিয়ে গিয়ে বলল, আমি কী করে জানব! সে তো আমাকে ডিস্টার্ব করে না, আসেও না আমার কাছে। হয়তো তোমাকে তার ভালো লেগেছে—
ভালো—লাগার কথাটি কিন্তু মৃত্তিকা ঘুণাক্ষরেও বলেনি রবার্টকে। বলার কথাও নয়, তবু রবার্ট কী করে যে ঘটনাটা আঁচ করল বুঝে উঠতে পারল না সে। কিন্তু বিষয়টা যেদিকে ক্রমশ মোড় নিচ্ছে, তাতে কোনোক্রমেই স্বস্তিবোধ করছে না মৃত্তিকা। সে তো রবার্টকে বলতে পারে না, অদৃশ্য কণ্ঠস্বর কীভাবে রেইন করতে চাইছে তার ওপর। সত্যিই বলছে, তাকে ভালোবাসে—
আর কী আশ্চর্য, ছবিগুলোও যেন শেষ হতে চাইছে না কিছুতেই। নির্ধারিত দিনও যত এগিয়ে আসছে, ততই চাপ বেড়ে চলেছে মৃত্তিকার ওপর, গভীর রাত পর্যন্ত জেগে রং আর তুলি নিয়ে সে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে তার ক্যানভাসের উপর, আর প্রতি মুহূর্তে এও অনুভব করছে তার পিছনে দাঁড়িয়ে কেউ যেন ঘাড়ের ওপর নিশ্বাস ফেলতে ফেলতে ধারাবাহিকভাবে দেখে চলেছে তার আঁকা। কখনো এটা মনে হচ্ছে মৃত্তিকার, তার তুলি আর যেন তার আঙুলের বশে নেই, তুলিটা কোনো অদৃশ্য আঙুলের নির্দেশে যা খুশি এঁকে চলেছে ক্যানভাসের ওপর। বিরক্ত হয়ে একদিন আঁকা বন্ধ করে শুতে চলে গেল নিজের ঘরে। বারান্দায় কিছুটা অন্ধকার ছিল, টানা বারান্দা পার হওয়ার সময় কেউ যেন ফিসফিস করে বলল, ভালোই তো আঁকছিলে, বন্ধ করে দিলে কেন?
মৃত্তিকা রেগেমেগে জবাব দিল, তোমার জন্যই তো। ইউ আর অ্যান আনকালচার্ড ডিস্টার্বিং এলিমেন্ট।
—ইস, আমাকে এরকম বললে। অস্পষ্ট কণ্ঠস্বর তৎক্ষণাৎ মিলিয়ে গেল হাওয়ায়। পরদিন সকালে যথারীতি তিনকাপ কফির দু—কাপ ড্রইঙে নিয়ে গেল তার আর রবার্টের জন্য। কফি শেষ ফিরে এসে দেখল, কী আশ্চর্য, আজ আর কফির কাপ ছোঁয়ইনি কেউ। দারুণ অবাক লাগছিল তার, কী একটা কৌতুক ঘনিয়ে উঠছিল তার ভেতর। কাল রাতে যে গালাগালটা দিয়েছিল, বোধহয় তাতেই অভিমান হয়েছে তার।
মনে হল, ঠিকই করেছে সে। তার সঙ্গে বাড়াবাড়িই করছিল ক—দিন ধরে। এবার নিশ্চিন্তে আঁকতে পারবে ছবিগুলো। পরপর কয়েকদিন সে নির্বিঘ্নে ক্যানভাসে মন দিতে পারল। দ্রুত এগোতেও পারছিল তার বিশাল কর্মযজ্ঞে। এখন আঁকার সময় আর মনে হয় না কেউ তার কাছাকাছি আছে, কিংবা নিশ্বাস ফেলছে তার ঘাড়ের ওপর, অথবা তার তুলি—ধরা আঙুল চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কোনো অদৃশ্য শক্তি।
বেশ খুশি খুশি লাগছিল মৃত্তিকার, কিন্তু হঠাৎ কেন কে জানে তার মনে হল, ছবি আঁকার মুহূর্তে সে যে একটা অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে থাকত, একটা অলৌকিক আবেগ ঘিরে থাকত তার শরীর ও মন, তা যেন হঠাৎই অদৃশ্য। তা ছাড়া কেউ একজন অলক্ষ্যে থেকে তার ছবি—আঁকা দেখত, অনুসরণ করত তার নড়াচড়া, তন্ময়তা, সেই চোরা নজরটি উধাও হয়ে যাওয়ায় ঠিক যেন মন বসাতে পারছে না ক্যানভাসে। অনুভূতিটা ভারী বিচিত্র বলে মনে হল তার। কী আশ্চর্য, এরকম তো হওয়ার কথা নয়। প্রায় জোর করেই সেই অশরীরীর উপস্থিতির কথা ভুলে সে মনঃসংযোগ করতে চাইল তার কাজে, নিমগ্ন হতে চেষ্টা করল তার অভীষ্ট অনুভূতির ভিতর, কিন্তু কোথায় যেন একটা তাল কেটে গেছে। আর কী কারণে যেন তার খুব কষ্টও হতে লাগল সেদিনকার অস্বাভাবিক খারাপ ব্যবহারের জন্য।
পরদিনই রাতে একটা বিশাল ক্যানভাসে সে দ্রুত তুলি বুলিয়ে চলেছে, আর কয়েক ঘণ্টা কাজ করলেই শেষ করে ফেলতে পারবে ছবিটা, সে সময় হঠাৎ লোডশেডিং। চারদিক অন্ধকারে ডুবে যেতেই সে আশা করছিল; নিশ্চয়ই অশরীরী আবার এসে খুনসুটি করতে শুরু করবে তার সঙ্গে, কিংবা দুষ্টু—দুষ্টু কথা বলে টিজ করতে চাইবে, কিন্তু না, কোনো অঘটন ঘটল না তো! এ ক—দিন লোডশেডিং তেমন হয়নি বলে মোমবাতি—দেশলাই কাছে রাখতে ভুলে গিয়েছিল বেমালুম। বিরক্ত হয়ে, অন্ধকারে হাতড়াতে হাতড়াতে বারান্দায় বেরোতেই তার যেন দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনল একটা। মৃত্তিকা দাঁড়িয়ে এদিক—ওদিক তাকাল একবার। গাঢ় নিশ্চিদ্র অন্ধকারে তখন বিশাল বাড়িটা ঝুপ হয়ে আছে, কোথাও কোনো শব্দ নেই, মৃত্তিকাও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এগোচ্ছে, হঠাৎ সেই ফিসফিস কণ্ঠস্বর, আমি কিন্তু তোমাকে আর বিরক্ত করছি না। মৃত্তিকার শরীরে একটা হিমশিরানি কুলকুল করে বয়ে গেল তৎক্ষণাৎ, জোর করে হাসতে চাইল, থ্যাঙ্ক য়্যু।
বলে এগোতে যাচ্ছিল, হঠাৎ কী ভেবে থমকাল, তুমি কি রাগ করেছ?
—কার ওপর রাগ করব! ফিসফিস কণ্ঠস্বর তৎক্ষণাৎ বলল, বিশ্বসংসারে কেউ তো আমাকে ভালোবাসে না—
কী ভেবে মৃত্তিকা আবার বলল, তুমি কি খুব দুঃখী?
—খুব। অস্পষ্ট কণ্ঠস্বরের সঙ্গে আবার একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস, তুমিও তো আমাকে সেদিন বকলে।
—ও কিছু না, ফরগেট ইট, মৃত্তিকা বলতে বলতে এগোল কিচেনের দিকে।
সেদিন মোমবাতি জ্বেলে ক্যানভাসে মনঃসংযোগ করতেই মৃত্তিকা আবার খেয়াল করল, তার খুব গা ঘেঁষেই দাঁড়িয়ে আছে সে, তার আঁকা দেখছে, অনুসরণ করছে তার নড়াচড়া, কিন্তু একটুও বিরক্ত করছে না। তার এই অলক্ষ্যে উপস্থিতি বেশ পছন্দও করে ফেলল মৃত্তিকা।
পরদিন সকালে যথারীতি কফির কাপ খালি। অর্থাৎ তিনি যে অভিমান করে এতদিন এড়িয়ে থাকছিলেন মৃত্তিকাকে, আপাতত শান্ত, সুবোধ, ক্রোধহীন। মৃত্তিকার বেশ মজাই লাগল ঘটনাটা।
সেদিন সন্ধেবেলা তাদের বাড়িতে ছোট্ট একটা পার্টির আয়োজন করেছিল সে। ‘কনটেম্পোরারি আর্টিস্টস’ নামে যে সংস্থাটির সঙ্গে সে জড়িত, তার অধিকাংশ তরুণ—তরুণী অনেকদিন ধরেই আবদার করছিল, এই মৃত্তি, তোর বিদেশি বন্ধুর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দে না একদিন—
রবার্টও এই পার্টির আয়োজনে ভারী চমৎকৃত, পুলকিত, সারাদিন ছটফট করছ আর বলছে, কই, তোমার বন্ধুরা কখন আসবে, মৃট্টি?
পার্টি মানেই তো কিছুই আড্ডা, জমাটি পানভোজন। রবার্ট আবার আর্টিস্টদের সঙ্গে পরিচিত হতে ভারী আগ্রহী। বিকেল থেকেই লখনউয়ের—কাজ—করা চমৎকার গেরুয়া রঙের একটা পাঞ্জাবি, তার সঙ্গে ধবধবে সাদা চুস্ত পরে বারবার পায়চারি করছে তাদের বারান্দায়। বরার্ট নিয়মিত ড্রিঙ্ক করুক তা অবশ্যই পছন্দ করে না মৃত্তিকা, কিন্তু এদিন শিল্পীবন্ধুরা বাড়িতে এলে তারা যে বেলাগাম হাতে চাইবে তা তো নিশ্চিতই, সেই সঙ্গে রবার্টও।
তরুণ শিল্পীবন্ধুরা এসে মৃত্তিকার আঁকা ছবিগুলো দেখে কিন্তু বেশ হইচই বাধিয়ে দিল। ছবির ভেতর যে একটা অদ্ভুত রহস্যময়তা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে, একটা আশ্চর্য অলৌকিকতা মিলমিশ হয়ে আছে ক্যানভাসে, তা নাকি মৃত্তিকার এ—তাবৎ আঁকা কোনো ছবিতে দেখা যায়নি। সেদিন ক্যানভাসের জায়গাটা ধেবড়ে গিয়েছিল, সেট নাকি একটা ভূতুড়ে আবহাওয়া তৈরি করেছে ছবিটায়। শুধু তা—ই নয়, মৃত্তিকার তুলি নাকি আগের চেয়ে ঢের ঢের ম্যাচিওর্ড। সন্ধেয় মস্ত ড্রাইংটার ছড়ানো—ছিটানো সোফায় ঋত্বিক—পৃথ্বী—প্রিয়ংবদা— রমিতা—রোহিত তুমুল আড্ডা জমিয়েছিল রবার্ট আর মৃত্তিকাকে ঘিরে। বস্তুত রবার্টই আজ ওদের কৌতূহলের প্রাণকেন্দ্র। প্রিয়ংবদা আর রমিতা বারবার রবার্টকে টিজ করে দেখছিল ইংরেজ—তনয়টির সঙ্গে বসবাস করতে কীরকম লাগছে মৃত্তিকার। রবার্ট অবশ্য ভারী উপভোগ করেছিল একঝাঁক তরুণ—তরুণীর সান্নিধ্য আর হইরই। তার দাড়ি—গোঁফের জঙ্গলের ভেতর থেকে ক্রমাগত বেরিয়ে আসছিল, বিউটিফুল, ওহ, হাউ বিউটিফুল। ইউ আর অল ভেরি নাইস।
প্রিয়ংবদা একসময় একান্তে মৃত্তিকাকে বললও, ‘তোর কিন্তু ভারী সাহস, মৃত্তি। ওরকম একটা ভূতুড়ে চেহরার বাড়িতে সাহেব বর নিয়ে বাস করছিস!’ ততক্ষণে পৃথ্বী ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, কই মৃত্তি, গলা যে শুকিয়ে গেল, একটু ভেজাবার ব্যবস্থা করো।
—স্যরি। একটু অপেক্ষা করো, এখনই ব্যবস্থা করছি, মৃত্তিকা বহুদিন পর তার প্রিয়বন্ধুদের কাছে পেয়ে এত হইচইয়ের মধ্যে যেন ভুলেই গিয়েছিল যে সে সারাদিন ধরে এটা—ওটা রান্না করে ভাজাভুজি করে আপ্যায়নের ব্যবস্থা করেছে তার বন্ধুদের।
পৃথ্বীর তাড়া খেয়ে ততক্ষণে সে গেলাসে গেলাসে ঢেলে ফেলেছে সোনালি পানীয়। সেই সঙ্গে ফিশফ্রাই, চিকেনফ্রাই, বাদাম, চানাচুর। অনতিবিলম্বে সবাই যার—যার গেলাস তুলে ধরল, চিয়ার্স।
—চিয়ার্স, মৃত্তিকা বলল, কিন্তু তার ততক্ষণে নজরে পড়েছে সাতজনে সাতটা গেলাসের দখল নেওয়ার পরেও একটা গেলাস অতিরিক্ত, তাতে সোনালি পানীয় মালিকের অভাবে তাকিয়ে আছে হাঁ করে বাকি সাতজনের দিকে।
ঋত্বিক চকাস করে তার গেলাসে একটা চুমুক দিয়ে বলল, বাট হু ইজ দ্য এইটথ পারসন,মৃত্তি? রবার্ট হো হো করে হেসে উঠে বলল, মৃট্টি লাভস মি সো মাচ, সেই জন্যই আমার ডাবল গ্লাস।
পৃথ্বী ঘাড় ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল, নো, দ্যাটস মাইন। হইচই চেঁচামেচিতে সবাই এতই মশগুল যে কিছুক্ষণ পর মৃত্তিকা আবিষ্কার করল, অষ্টম গেলাসটি একদম নিঃশেষ। নিশ্চয়ই তাদেরই কেউ হট্টগোলের মধ্যে ওটা সাবাড় করে ফেলেছে যদিও তাদের নিজেদের গেলাস তখনও শেষ হয়নি। বুকের ভেতর সহসা কেন যেন ছ্যাঁত করে উঠল মৃত্তিকার, সে সবার অলক্ষ্যে গেলাসটা ভরতি করে দিল আবার, পাশে শূন্য গেলাস দেখে পাছে কেউ কোনো প্রশ্ন তোলে এই আশঙ্কায়।
কিন্তু ততক্ষণে ড্রাইঙের নিবু—নিবু আলোয় যেন ভোজবাজি ঘটে চলেছে। অন্যদের প্রথম গেলাস তখনও শেষ হয়নি, ইতিমধ্যে অষ্টম গেলাসটি দ্বিতীয়বার শূন্য। মৃত্তিকার বুকের ভেতর একটা কাঁপ ধরছিল, সে কী করবে না করবে ভাবতে ভাবতে কেউ যেন আলো—আঁধারি অস্পষ্ট পরিবেশ মৃত্তিকার কানে—কানে বলল, প্লিজ ওয়ান পেগ মোর—
মৃত্তিকা তখন থরথর করে কাঁপছে। এক মুহূর্ত মনে হল তার গায়ে প্রায় গা ঠেকিয়ে আর একজন বসে আছে, নিঃশব্দে তাকে সম্মোহিত করে ফেলেছে ক্রমশ। তিনের পর চার, চারের পর পাঁচ। পূর্ণ গেলাসটা দ্রুত শেষ হয়ে চলেছে সবার অলক্ষ্যে।
মৃত্তিকার কপাল অবশ্য ভালো। কারণ কয়েক পেগ পেটে পড়তেই অনেকেই তখন টালমাটাল,অষ্টম গেলাসের ম্যাজিক কারও চোখে পড়েনি। অনেক রাতে সবাই খেয়েদেয়ে রওনা দিতে হবে হাঁপ ছেড়ে বাঁচে সে।
বরার্ট নিজেও তখন প্রায় বেহুঁশ। মৃত্তিকার বুকের ভেতর তখনও একটা হিমকাঁপ। কী এক আনকা শিরানি তাকে সম্মোহিত কর রখেছে অবশ, নিথর করে।
রবার্ট ততক্ষণে গভীর নিদ্রায়। ঘুমের কোন অতল গহনে তলিয়ে গেছে চেতনা। মৃত্তিকা শোওয়ার আয়োজন করার আগে একবার পরখ করে নেয় সব ঘরের দরজা ঠিকঠাক বন্ধ আছে কি না। বরান্দায় বেরিয়েছে সবে, লাইটটা নিভিয়েছে, হঠাৎ আশেপাশে সেই অদৃশ্য কণ্ঠস্বর, থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাডাম ফর ইয়ের হসপিটালিটি।
—নট টু বি মেনশনড, বলে দ্রুত তার ঘরের দিকে ফিরে আসতে চাইছিল। কিন্তু কেউ যেন তার আঁচলটা আগের মতো টেনে ধরে বলছে, প্লিজ, মৃট্টি। একটু দাঁড়াও। মৃত্তিকা খেয়াল করছিল অদৃশ্য কণ্ঠস্বর আজ যন অন্যদিনের মতো পরিষ্কার নয়, কেমন জড়ানো অস্পষ্ট, নেশাগ্রস্ত। তার বুকের ভেতরটা ভীষণ ঢিবঢিব করছে, আঁচলটা ছাড়িয়ে সে চলে আসতে চাইছে তখন, কিন্তু পারছেই না। বাধ্য হয়ে বারান্দার আলোটা জ্বালাতে গিয়েও পারল না। তার হাতও যেন কেউ শক্ত করে ধরে রেখেছে।
—ছাড়ো, মৃত্তিকা তখন ছটফট করে উঠেছে, এ কী করছ? ছাড়ো, ছাড়ো—
তার তখন মনে হচ্ছে কেউ যেন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরতে চাইছে তাকে, ছাড়াবার কোনো ক্ষমতাই নেই। পরক্ষণে স্তম্ভিত হয়ে শুনল সেই জড়ানো গলা, চলো মৃট্টি, লেট আস লাভ টু নাইট।
মৃত্তিকা শিউরে উঠল, প্রায় চেঁচিয়ে বলল, ডোন্ট বি সিলি। দাঁড়াও, আলোটা জ্বেলে দি।
—উঁহু, আলো জ্বেলো না প্লিজ। অন্ধকারে তোমাকে ভারী সুন্দর লাগছে। প্লিজ, অ্যায়্যাম ডাইং ফর ইউ।
—না, না, মৃত্তিকা নিজেকে ছাড়ানোর জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করছে, কিন্তু তার হাত—পা—শরীর সব ততক্ষণে সিল্যুট।
—প্লিজ, লেট মি কিস ইউ, সেই অস্পষ্ট কণ্ঠস্বরে যেন আবদার ঝরে পড়ল।
—নো, নো, মৃত্তিকা চিৎকার করতে চাইল, কিন্তু কী এক অতৃপ্ত চরম আকাঙ্ক্ষায় কেউ যেন বন্ধ করে দিয়েছে তার ঠোঁট। একটা তীব্র জ্বালায় ছটফট করে উঠল তার ঠোঁটজোড়া। সেই সঙ্গে তীব্র হয়ে উঠেছে চুরুটের সেই মিঠে কক্ষা গন্ধটাও। প্রায় জবরদস্তি করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সে চিৎকার করে উঠল, ইটস ব্যাড, ভেরি ব্যাড, ইতর, বদমাশ, ছোটোলোক—
অন্ধকার বারান্দায় কিছুক্ষণ ঘোর স্তব্ধতা। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল কেউ, ফিসফিস করল, আমি তোমাকে এত ভালোবাসি, আর তুমি আমাকে এমন করে বললে! ছি—
মৃত্তিকা ততক্ষণে বারান্দায় আলোটা জ্বেলে ফেলেছে দ্রুত হাতে। আলো ঝলমলে বারান্দায় কোথাও কেউ নেই, শুধু অনুভব করতে পারল, গ্যালন—গ্যালন ঘাম ভিজিয়ে দিচ্ছে তার শাড়ি—জামা, সমস্ত শরীর।
পরদিন সকালে রবার্ট ঘুম থেকে উঠতেই তাকে বেপরোয়া চেপে ধরল মৃত্তিকা, প্রায় সশস্ত্র বিপ্লবের ভঙ্গিতে। অশরীরীটার উপস্থিতি যে তার দৈনন্দিন জীবনে ভীষণ ব্যাঘাত ঘটিয়ে চলেছে তা বিবৃত করে জানতে চাইল, বলো তো, আসল ব্যাপারটা কী। নিশ্চয় কিছু একটা চেপে যাচ্ছ আমার কাছে।
রবার্ট প্রথমে কিছুক্ষণ ব্যাপারটা উড়িয়ে দিতে চাইলেও শেষপর্যন্ত পারল না। একটু একটু করে যে—কাহিনি প্রকাশ করল তা রীতিমতো ট্র্যাজিক। রবার্ট স্বীকার করল তার চেয়ে প্রায় দশ বছরের বড়ো এক ভাই ছিল, তার নাম পল। সে তার প্রথম যৌবনে প্রেমে পড়েছিল সামনের অট্টালিকাপ্রতিম বাড়িটির একটি তরুণীর সঙ্গে। সামনের বাড়িটি বহুকাল ফাঁকা পড়ে থাকার পর সেখানে একটি অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পরিবার থাকতে আসে, তরুণীটি তাদেরই। কিন্তু ট্র্যাজেডির বিষয় এই যে, পলের প্রেমে সাড়া দেয়নি সেই তরুণী। ব্যর্থপ্রেম পল অতঃপর রবার্টদের উত্তরের ঘরটি যেখানে আপাতত মৃত্তিকার স্টুডিয়ো, সেখান থেকে ঝাঁপ দিয়েছিল পুকুরে। পুকুরটি অবশ্য এখন আর নেই, পুকুর বুজিয়েই ওখানে মালটিস্টোরিড বিল্ডিংটা তৈরি হয়েছে ক—বছর আগে।
শুনতে শুনতে শিউরে উঠল মৃত্তিকা, এ রকম একটা সাংঘাতিক গল্প বেমালুম তার কাছে এতদিন চেপে রেখেছিল রবার্ট! আর সে কিনা উত্তরের ঘরটাতেই গভীর রাত পর্যন্ত জেগে ছবির পর ছবি এঁকে গেছে পল নামে তরুণটির সঙ্গে মোকাবিলা করে।
সেদিনই মৃত্তিকা তার স্টুডিয়ো সরিয়ে নিয়ে এল তাদের বেডরুম—সংলগ্ন ঘরটিতে। মাঝখানের দরজাটা খোলা থাকলে অন্তত রবার্টের উপস্থিতি সাহস জোগাবে তার মনে, যদিও পল নামের সেই প্রেমিক তরুণটির জন্যে খুব, খুবই কষ্ট হচ্ছিল তার। পল তো কাল রাতে তার কাছেও যথেষ্ট অপমানিত হয়েছে, আর মৃত্তিকা এও বুঝেছে যে, অভিমানী তরুণটি আর কখনো তার কাছে ঘেঁষবে না।
তখনও মৃত্তিকার একটা ছবি আঁকা বাকি। সময়ও হাতে আছে মাত্র তিনদিন। সেই শেষ ছবিটা আঁকতে গিয়ে সে সহসা অনুভব করল যে, গত দু—মাস যে—ঘোর রহস্যময়তায় লীন হয়ে বাকি ন—খানা ছবি এঁকেছে, যে—ছবি দেখে কাল তার তরুণ শিল্পীবন্ধুরা বারবার উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিল, সেই ঘোরটা যেন তার মগজে আর একবিন্দুও নেই।
ক্যানভাসের সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তুলি হতে দাঁড়িয়ে মৃত্তিকার মনে হল, আসলে তার এই মিস্টিক সিরিজের প্রেরণা ছিল অশরীরী পলই, এখন দশম ছবিটি সেই আশ্চর্য মগ্নতায় আর এঁকে উঠতে পারবে না কিছুতেই।