অলিভার টুইস্ট – ৯

নবম পরিচ্ছেদ

ফ্যাগিন্ তার আড্ডায় অগ্নিকুণ্ডের সামনে মুখভার করে বসেছিলো, আর ধুরন্ধর, চার্লস বেটস্‌ ও চিটলিং বসে তাস খেলছিলো। 

সহসা সদর-দরজায় শব্দ শুনে ধুরন্ধর আগন্তুককে দেখতে গেল। অন্য দু’জন ফ্যাগিনের নির্দেশে চুপ করে বসে রইলো। 

ধুরন্ধরের পেছনে-পেছনে ঘরে ঢুকলো টোবি ক্র্যাকিট—এক-মুখ দাড়ি, রুক্ষ কর্কশ বীভৎস তার চেহারা। ঢুকেই ফ্যাগিকে সে জিজ্ঞেস করলো : কেমন আছো, ফ্যাগিন্?” 

যে-শালখানায় তার মুখ আর গলা ঢাকা ছিলো, সেখানা ধুরন্ধরকে রাখতে দিয়ে সে জামা খুলে ফেললো। তারপর উনুনের গায়ে পা তুলে বসে বললো : “অনেকদিন পেটে দানা পড়েনি। সময়ে জানতে পারবে সব——আগে কিছু খেতে দাও।” 

ফ্যাগিনের নির্দেশে ধুরন্ধর ক্র্যাকিটকে খেতে দিলে। সে পরম তৃপ্তির সঙ্গে ধীরে ধীরে খেতে লাগলো। ফ্যাগিন্ মনে-মনে অধীর হয়ে উঠলেও মুখে কিন্তু কোনো কথা বললো না। 

খাওয়া শেষ করে টোবি অন্য সবাইকে ঘর থেকে বের করে দেবার জন্যে ফ্যাগিকে বললো। তারপর সবাই বেরিয়ে গেলে সে জিজ্ঞাসা করলো : “আগে বলো ফ্যাগিন্, বিল্ কেমন আছে?” 

—“কি!” ফ্যাগিন্ সভয়ে চেঁচিয়ে মাটিতে পা ঠুকে জিজ্ঞাসা করলো : “কোথায় তারা? সাইক্‌স্ আর ছেলেটা কোথায়?”

টোবি কাঁপা গলায় বললো : “আমাদের অভিযান ব্যর্থ হয়েছে।” 

ফ্যাগিন্ তার জামার পকেট থেকে একখানা খবরের কাগজ টেনে বের করে বললো : “তা তো জানি। তারপর হয়েছে কি, তাই বলো।” 

টোবি জানালো যে, বাড়ির লোকের গুলিতে আহত অলিভারকে পিঠে নিয়ে সাইক্‌স্ ছুটতে থাকে….বাড়ির লোকজনও তাদের তাড়া করে পিছু নেয় এবং শেষে ধরা পড়ার উপক্রম হতেই সাইক্স অলিভারকে পথের ধারে একটা খানার মধ্যে ফেলে রেখে পালাতে বাধ্য হয়,–ছেলেটা বেঁচে আছে কি মারা গেছে, তা টোবি জানে না। 

একটা ভয়ার্ত চিৎকার করে ফ্যাগিন্ দু’হাতে নিজের চুল টানতে টানতে ঘর ছেড়ে পথে বেরিয়ে পড়লো। 

***

রাস্তায় বেরিয়ে একখানা গাড়ি ভাড়া করলো ফ্যাগিন্। তারপর সাইকসের আস্তানার সিকি মাইল তফাতে পৌঁছে, গাড়িখানা ছেড়ে দিলো সে। 

খানিকটা পথ হেঁটে একটা গলির ভেতর ঢুকে পড়লো সে। গলির চেহারা দেখে সহজেই বোঝা যায় সেখানে সমাজের অতি নিচু স্তরের লোকেরা বাস করে। গলির শেষ প্রান্তে এসে ফ্যাগিন্ একটা দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে কথা কইলো দোকানের সেলম্যানের সাথে। তার কাছ থেকে সে জানতে পারলো যে সাইক্‌স্ এখনো তার ঘরে ফিরে আসেনি। 

সাইকসের আস্তানার পাশ দিয়ে এগিয়ে ফ্যাগিন্ একটা শুঁড়িখানায় ঢুকে পড়ল চুপি চুপি। শুঁড়িখানার মালিকের সাথে ফিসফাস কথা কইলো অনেকক্ষণ নিজের পেশার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। তারপর চলে আসার সময় সে জিজ্ঞাসা করলো : “সে কি আজ রাতে এখানে আসবে?” 

“মসের কথা বলছো কি?”—জানতে চাইলো শুঁড়িখানার মালিক। “চুপ!”—ফ্যাগিন্ বলে উঠলো, তারপর ছোট্ট ‘হুঁ” বলে জবাবের আশায় তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। 

শুঁড়িখানার মালিক বেশ নিচু গলায় জবাব দিলো : “এতক্ষণ এখানে তার এসে যাওয়া উচিত ছিলো। এখনও এলো না কেন তা তো বুঝতে পারছি না। আর দশ মিনিট অপেক্ষা করলে হয়তো —”

বাধা দিয়ে ফ্যাগিন্ তেমনি চুপিচুপি বললো : “সে এলে তাকে বলো আমি তার খোঁজে এসেছিলুম। সে যেন আজ রাতে—না, না—কাল রাতে আমার সাথে অতি অবিশ্যি একবার দেখা করে, বুঝেচো?” 

এই বলে উত্তরের অপেক্ষা না করে হনহন করে শুঁড়িখানা থেকে বেরিয়ে পড়লো সে। এবার সাইকসের ঘরে ঢুকে ফ্যাগিন্ দেখলো, অতি বিষণ্ণভাবে টেবিলের ওপর মাথা রেখে বসে আছে ন্যানসি। কোনো খবরই সে পায়নি বিল্‌ সাইকসের—সে-ই বরং সাইকসের কথা ফ্যাগিনের কাছে জানতে চাইলো। ফ্যাগিন্ তাকে টোবির মুখে শোনা বিবরণ জানালে সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে 

লাগলো। 

ফ্যাগিন্ বললো : “হতভাগা ছেলেটার কথা ভাবো ন্যানসি,—তাকে কিনা ওরা ফেলে এসেছে একটা খানার মধ্যে।” 

ন্যানসি হঠাৎ মাথা তুলে বললো: “সে ছেলেটা যেখানেই থাক, আমাদের সঙ্গে থাকার চেয়ে ভলোই থাকবে। আমি ভাবছি শুধু বিলের কথা। তার যেন কোনো ক্ষতি না হয়।” 

***

গভীর রাতে নিজের বাড়ির সামনে এসে ফ্যাগিন্ যখন চাবি দিয়ে দরজা খুলছে, এমন সময়ে কে যেন তার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে ডেকে উঠলো : “ফ্যাগিন্!” 

ফ্যাগিন্ চকিতে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো : “তুমি কখন এলে মস্‌?” 

—“তা ঘণ্টা দুই হলো বই কি। আমি তোমার জন্যে তখন থেকে অপেক্ষা করছি—কোথায় ছিলে এতক্ষণ?” 

—“তোমারই কাজে বন্ধু, তোমারই কাজে। সব বলছি।” 

মঙ্কসকে নিয়ে ফ্যাগিন্ বাড়ির ভেতর ঢুকলো। তারপর একটা নিরালা-কোণে দাঁড়িয়ে দু’জনে ফিস্‌ফিস্ করে আলাপ করতে লাগলো। 

মঙ্কস বারকয়েক ঘাড় নেড়ে বেশ জোর গলাতেই বললো : “ফন্দিটা তোমাদের তেমন সুবিধে হয়নি। ওকে এখানে আটকে রেখে গাঁটকাটা করে তুললে না কেন?” 

ফ্যাগিন্ জানালো : “তা করার সুবিধে ছিলো না মোটেই।” 

মঙ্কস বেশ ঝাঁঝালো সুরে বলে উঠলো : “তুমি ইচ্ছে করলে তা করতে পারতে। এর আগে তো কত ছেলেকে তুমি পাকা পকেটমার, সিঁধেল তৈরি করেছো, আর আজও তাদের কাছ থেকে কমিশন খাচ্ছো। তুমি তাকেও পকেটমার করে জেলে পাঠিয়ে আমাকে নিশ্চিন্ত করতে পারতে—হয়তো সে সারাজীবনের মতো দেশ থেকে নির্বাসিত হতো একদিন।” 

রাগে গজগজ করতে লাগলো মস্‌, আর ফ্যাগিন্ তাকে শান্ত করার জন্যে নিজের সাফাই গাইতে লাগলো : “চেষ্টা তো করেছিলুম, কিন্তু ধরা পড়ে ছেলেটা সব গোলমাল করে দিলে, আর যে মেয়েটাকে দিয়ে তাকে আবার রাস্তা থেকে নিজেদের আস্তানায় ফিরিয়ে আনলুম, সে মেয়েটা তার দিকে নেকনজর দিতে শুরু করেছে। সেটাই হচ্ছে এখন সবচেয়ে বড় বাধা।” 

“তাহলে মেয়েটাকে গলা টিপে মেরে ফেলো।” বলে উঠলো মস্‌। ফ্যাগিন্‌ বললো : “তা করার সময় আসেনি এখনো। হয়তো একদিন আমি নিজেই তা করবো। এখন অপেক্ষা করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। ছেলেটা পাকা চোর হয়ে গেলে মেয়েটার সহানুভূতি হারাবে, আর ছেলেটা যদি আমাদের হাতেই মারা যায় তাহলে তো কোনো কথাই নেই!” 

বাধা দিয়ে বলে ওঠে মঙ্কস্ : না-না, মেরে ফেলো না তাকে। চুরি-ডাকাতি করতে গিয়ে যদি সে মারা যায়, তাহলে তো আমার বিরুদ্ধে কারুর বলার কোনো কিছুই নেই। মোদ্দা কথা, তাকে নিয়ে যা খুশি করতে পারো, কিন্তু নিজেরা মেরে ফেলো না। ওতে আমার ক্ষতি হতে পারে।” 

কথা বলতে বলতে মঙ্কস চমকে উঠে বললো : “ওকি! একটা ছায়া দেখলাম যেন!” 

তখন দু’জনে ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে চারদিকে খুঁজলো, কিন্তু কাউকেই দেখতে পেলো না। 

ফ্যাগিন্ বললো : “কিছুই দেখনি তুমি! ও তোমার চোখের ধাঁধা।” 

কাঁপতে কাঁপতে মঙ্কস বললো : “না-না, ধাঁধা নয়, আমি দিব্যি গেলে বলছি যে স্পষ্ট দেখলাম একটা মেয়েমানুষের ছায়া সরে গেল।” 

ফ্যাগিন্ জোর দিয়েই বললো : “এ বাড়িতে কোনো মেয়েমানুষ থাকে না যে গভীর রাতে তার ছায়া দেখতে পাবে।” 

রাগে গজগজ করতে করতে চলে গেল মস্‌। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *