চতুর্থ পরিচ্ছেদ
সেদিন রাতেই মিস্টার বাম্বলের সাথে অলিভার হাজির হলো মিঃ সোয়ারবেরীর বাড়িতে। খোলা জানালা দিয়ে তাদের আসতে দেখে মিঃ সোয়ারবেরী বেরিয়ে এসে চেঁচিয়ে উঠলেন : “অ গিন্নী, দয়া করে একবার বাইরে আসবে কি?”
মিসেস্ সোয়ারবেরী বেরিয়ে এলেন। অলিভারকে দেখেই তিনি মন্তব্য করলেন : “ভারি ছোট যে!”
“তা বটে”, বলে মিঃ বাম্বল এমনভাবে তাকালেন অলিভারের দিকে, যেন ছোট হওয়ার জন্যে সে-ই দায়ী। তারপর বলেন মিঃ বাম্বল : “ছোট, তবে বড় তো হবে!”
—“তা হবে—গুণ আছে আমাদের দানাপানির, তবে আশ্রমের ছেলেদের দিয়ে যতটা কাজ পাওয়া যায়, তার চেয়ে খরচ হয় বেশি ওদের পুষতে।” বললেন মিসেস্ সোয়ারবেরী। তারপর অলিভারকে নিয়ে একটা সরু সিঁড়ি বেয়ে হাজির হলেন একটা অন্ধকার ভ্যাপসা রান্নাঘরে এবং তাকে কিছু বাসি মাংস খেতে দেবার জন্যে হুকুম করলেন পরিচারিকা শার্লটিকে।
মাংস! জিভে জল এলো অলিভারের। অনাথ-আশ্রমে ও বস্তুটি কোনোদিন সে খেতে পায়নি। অলিভারের মাংস খাওয়া শেষ হলে মিসেস্ সোয়ারবেরী বলে উঠলেন : “য়্যাঁ! সবটা খেয়ে ফেললি!” ভবিষ্যতে অলিভারের খোরাক যে কি দাঁড়াতে পারে, মনে-মনে তার হিসেব করে শিউরে উঠলেন তিনি।
মিসেস্ সোয়ারবেরী তারপর অলিভারকে দোকান-ঘরে নিয়ে গিয়ে বললেন : “যা, ওই টেবিলটার তলায় গিয়ে ঘুমো। কফিনের পাশে ঘুমোতে ভয় করবে নাকি রে? তা, ভয় করলেও উপায় নেই—ওখানেই ঘুমোতে হবে তোকে।”
দোকান-ঘরের দরজা বন্ধ করে তার মধ্যে একলা শুয়ে চারদিকের কফিনগুলোর দিকে তাকিয়ে ভয়ে ঘামতে ঘামতে একসময় ঘুমিয়ে পড়লো অলিভার।
ঘরের দরজায় দুড়ুম-দড়াম লাথির আওয়াজ শুনে অলিভারের ঘুম ভাঙলো ভোরে। উঠে দরজা খুলে দিতেই ঘরে ঢুকলো একটা ধাড়ী ছেলে রুটি-মাখন খেতে-খেতে।
তাকে খরিদ্দার ভেবে অলিভার জিজ্ঞাসা করলো, “আপনার কফিন চাই নাকি?”
ছেলেটা এ-কথা শুনে ক্ষেপে গিয়ে বললো : “ফের এরকম কথা যদি বলিস তো তোকেই কফিনে শোয়াবো। জানিস, আমি হচ্ছি নোয়া ক্লেপোল্; তোর ওপরওয়ালা রে হতভাগা!” এই বলে সে একটা লাথি মারলো অলিভারকে।
এইসময় শার্লটি এলো সকালবেলার জলখাবার নিয়ে। নোয়ার জন্যে সে মনিবের খাবার থেকে চুরি করে কিছু মাংস এনেছে, কিন্তু অলিভারের জন্যে এনেছে শুধু এক বাটি চা।
জলখাবার খেতে-খেতে অলিভারের দিকে তাকিয়ে ব্যঙ্গ করতে লাগলো নোয়া। শার্লটিকে বললো সে : “হতভাগাটিকে দুনিয়ার সব্বাই দূর করে দিয়েছে, বাপ-মারও কোনো হদিস্ মেলেনি।…হাঃ…হাঃ!”
***
নোয়াও অনাথ-আশ্রমে মানুষ হয়েছে। তবে সে অলিভারের মতো অজ্ঞাতকুলশীল নয়—তার মা ছিল ধোপানী, তার বাপ ছিল লড়াই-ফেরত বিকলাঙ্গ মাতাল সৈনিক। চিরকাল প্রতিবেশী বালকদের বিদ্রূপ চুপচাপ সয়ে এসেছে নোয়া। আজ নিজের চেয়েও হীন ও অসহায় একটি ছেলেকে নিজের কবজায় পেয়ে সে তার গায়ের ঝাল মেটাতে লাগলো।
শার্লটিও এ বিষয়ে নোয়ার জুড়ি ছিলো। সেও অলিভারকে নানাভাবে হেনস্থা করতে লাগলো। অনেক পোড়-খাওয়া ছেলে অলিভার। তাই নীরবে হাসিমুখে সব কিছু সইতে লাগলো সুদিনের আশায়।
এত নিপীড়নের মাঝে অলিভারের একটা সান্ত্বনা ছিল যে তার মনিব তাকে মোটামুটি ভালো চোখেই দেখতেন। মিস্টার সোয়ারবেরীর কাজের ঝক্কি-ঝামেলা বেশি। তাঁকে প্রায়ই এখানে-ওখানে ছোটাছুটি করতে হয় কবরের ব্যবস্থা করতে। ভালোভাবে কাজকর্ম করতে পারলে দু’চার পয়সা বাড়তি রোজগারও হয় তাঁর। তাই অলিভারকে মিঃ সোয়ারবেরী মাঝে মাঝে সঙ্গে নিয়ে যেতেন তাঁর কাজে সাহায্য করার জন্যে। মনিবকে খুশি করার জন্য অলিভারের আগ্রহ ছিলো আন্তরিক। তাই অতি অল্পদিনেই মিস্টার সোয়ারবেরী বুঝতে পারলেন যে অলিভার বাস্তবিকই কাজের ছেলে এবং তার ওপর ছোটখাটো কাজের ভার দিয়ে নির্ভর করা যায়।
মাসখানেক পরে অলিভারের বিষয়ে গিন্নীকে বললেন মিস্টার সোয়ারবেরী : “বেশ দেখতে ছেলেটি! কেমন যেন একটা বিষাদের ছায়া আছে ওর মুখে।”
স্বামীর মুখে একথা শুনে মিসেস্ সোয়ারবেরী কিন্তু খুশি হলেন না। স্বামীর সব কথারই তিনি সমালোচনা করতেন কড়া ভাষায়, কাজেই অলিভারের ব্যাপারেও তার ব্যতিক্রম হলো না। অলিভারের বিষয়ে স্বামী যে বড় বাড়াবাড়ি করছেন একথা শুধু মনে করিয়ে দিলেন মিসেস্ সোয়ারবেরী।
মিস্টার সোয়ারবেরীর সুনজরে আসার ফলে তাড়াতাড়ি অলিভারের পদোন্নতি হয়ে গেল। দোকানে যারা কফিন কিনতে আসতো, তাদের শবযাত্রায় শোক প্রকাশ করার জন্যে একজন লোক রাখতে হতো মিস্টার সোয়ারবেরীকে। তাতে কফিন বেচার সুবিধা হতো। অলিভার সেই পদটা পেয়ে গেল।
কয়েকমাস ধরে নোয়ার অত্যাচার নীরবে সয়ে আসছিল অলিভার অলিভারের পদোন্নতিতে নোয়ার হিংসে আরো বেড়ে গেল, তার ফলে তার অত্যাচারের মাত্রাও গেল বেড়ে।
***
একদিন রান্নাঘরে অলিভার ও নোয়া খাওয়ার জন্যে বসলো পাশাপাশি। তাদের পরিবেশন করবে শার্লটি, কিন্তু মনিবগিন্নীর ডাকে সাড়া দিয়ে সে কি একটা অন্য কাজে ব্যস্ত রইলো। এর ফলে অলিভার ও নোয়াকে খাবার টেবিলে অপেক্ষা করতে হলো খানিকক্ষণ।
সুযোগ-সুবিধে পেলেই নোয়া অলিভারের ওপর জোরজুলুম চালিয়ে নানাভাবে অত্যাচার করতো। সেদিনও তাই নোয়া অলিভারের পাশে চুপ করে বসে থাকতে পারলো না। অলিভারকে ক্ষেপাবার জন্যে খাবার টেবিলের ওপর নিজের ঠ্যাং তুলে দিলো নোয়া। অলিভার ওদিকে নজরই দিলো না। তাতে চটে গিয়ে নোয়া অলিভারের চুল ধরে হেঁচকা মেরে কান মলে দিলো। অলিভার তবু কাঁদলো না, কোনো প্রতিবাদ পর্যন্ত করলো না। তাতেও যখন অলিভারকে ক্ষেপাতে পারলো না নোয়া, তখন সে কুৎসিত ভাবে অলিভারকে প্রশ্ন করলো : “ওরে হতভাগা! মায়ের খবর কি রে?”
অলিভার বললো : “তিনি মারা গেছেন—তাঁর সম্বন্ধে আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করো না।”
অলিভারের চোখ দিয়ে জল গড়াতে দেখে নোয়া বলে উঠলো : “কি রে ছিচ্- কাঁদুনে! কাঁদছিস কেন আবার?”
চট্ করে চোখের জল মুখে অলিভার বললে : “তোমার ভয়ে কাঁদিনি। কিন্তু খবরদার! আমার মায়ের সম্বন্ধে কখনও কোনো কথা বলো না।”
—“ইস! ভয় দেখাচ্ছিস আমাকে শুয়োর? জানিস তোর মা ছিল একটা বদ মেয়েমানুষ।” চেঁচিয়ে বলে ওঠে নোয়া।
—“কি বললে?” অলিভার নোয়ার দিকে মুখ তুলে তাকালো।
নোয়া আরও চেঁচিয়ে বললো : “তোর মা ছিল একটা বদ মেয়েমানুষ রে হতভাগা—একেবারে চরিত্তির খারাপ মরেছে, আপদ গেছে!”
রাগে লাল হয়ে উঠে দাঁড়ালো অলিভার। তারপর চেয়ার-টেবিল উলটে ফেলে, নোয়ার চুঁটি টিপে ধরে পাগলের মতো ঝাঁকানি দিতে লাগলো।
“খুন করলে রে আমাকে! অ শার্লটি! অ গিন্নীমা! বাঁচান! আমাকে বাঁচান! অলিভার ক্ষেপে গেছে। শার্–লটি!” চেঁচিয়ে উঠলো নোয়া!
ছুটে এলেন মিসেস্ সোয়ারবেরী! তাঁর পেছনে পেছনে এলো শার্লটি।
—“তবে রে হতাভাগা!” বলে শার্লটি ছুটে গিয়ে চেপে ধরলো অলিভারকে। তারপর “নে-মক-হারাম, খুনে…ডাকাত” বলতে বলতে একনাগাড়ে কিল-চড়-ঘুষি চালাতে লাগলো তার মুখে-বুকে-পিঠে।
শার্লটির কবজিতে জোর কম ছিল না, তবু পাছে তাতে তেমন কাজ না হয়, তাই মিসেস্ সোয়ারবেরী নিজে এক-হাতে অলিভারকে চেপে ধরে অপর-হাতে খিমচে আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত করে দিলেন তার সারা দেহ। এই সুযোগে নোয়াও পিছন থেকে অলিভারের কোঁকে ঘুষি চালাতে লাগলো।
মারতে মারতে হাঁপিয়ে পড়লো সকলে। তখন সকলে মিলে অলিভারকে ধরে বেঁধে আটকে রাখলো কয়লা-কুঠুরীতে। তারপর নোয়াকে হুকুম করলেন মিসেস্ সোয়ারবেরী : “মিস্টার বাম্বলের কাছে ছুটে যাও, নোয়া—এখনি যেন তিনি আসেন—এক মিনিটও দেরি করো না…যাও…যাও….চটপট যাও…টুপি নেবার দরকার নেই নোয়া।”
নোয়া তখন ছুটে গেল মিঃ বাম্বলের কাছে।
নোয়ার হাবভাব দেখে অবাক হয়ে গেলেন মিস্টার বাম্বল। নিজের শরীরটা বান মাছের মতো মোচড়াতে মোচড়াতে নোয়া তাঁকে জানালো যে, অলিভার আজ মিসেস্ সোয়ারবেরী, শার্লটি এবং তাকে খুন করতে চড়াও হয়েছিল। এ-কথা শুনে মিঃ বাম্বল তখনই নোয়ার সঙ্গে মিঃ সোয়ারবেরীর বাড়িতে হাজির হলেন।
কয়লা-কুঠুরীর বন্ধ-দরজায় লাথি মেরে মিঃ বাম্বল হাঁক দিলেন : “অলিভার!”
ভেতর থেকে অলিভার গর্জে উঠলো : “আগে দরজা খুলে দিন।”
মিস্টার বাম্বল জিজ্ঞাসা করলেন : “আমার গলা চিনতে পারছো?”
—“খুব।”
—“তবু ভয় করছে না তোমার?”
—“না।” বেপরোয়া ভাবে জবাব দিলো অলিভার।
অলিভারের মুখ থেকে এ-রকম জবাব পাবার আশা করেননি মিঃ বাম্বল, তাই ঘাবড়ে গিয়ে দরজার কাছ থেকে সরে এলেন।
মিসেস্ সোয়ারবেরী বললেন : “নিশ্চয়ই ক্ষেপে গেছে, দেখছেন না ক্ষ্যাপা কুকুরের মতো চোখ-মুখের চাহনি…নইলে এমনভাবে আপনার সাথে কথা বলবার হিম্মত হয় ওর!”
—“ক্ষেপে যায়নি, মিসেস্ সোয়ারবেরী, এ হলো মাংস খাওয়ানোর ফল, মাংস খেয়েই ওর এতখানি তেজ বেড়েছে।” বললেন মিস্টার বাম্বল।
একথা শুনে মিসেস্ সোয়ারবেরী খেদ প্রকাশ করতে লাগলেন : “হায় হায়! ভালমানুষির এই ফল!”
মিঃ বাম্বল বললেন : “ওকে কয়েকদিন কিছু খেতে না দিয়ে কয়লা-কুঠুরীতে আটকে রাখুন। মেজাজ একটু ঠাণ্ডা হলে তবে বাইরে বের করে রোজ এক হাতা লসি খেতে দেবেন। ওর জান বড়ো কড়া—ওতে ও মরে যাবে না। ওর মতো ওর মায়ের জানও ছিল বড়ো কড়া। ডাক্তার ও নার্স দুজনেই বলেছিলো, ওর মা যতোটা কষ্ট সয়ে বহু দূরের পথ হেঁটে এসেছিলো তার সামান্য একটুও ভদ্রঘরের কোনো মেয়ে সইতে পারত না।”
মিঃ বাম্বলের শেষের কথাগুলো শুনে অলিভার কুঠুরীর ভেতরে দাপাদাপি শুরু করে দিলো।
এমন সময় মিস্টার সোয়ারবেরী বাড়ি ফিরে সব শুনলেন। তিনি কয়লা- কুঠুরীর দরজা খুলে অলিভারকে জামার কলার ধরে টেনে নিয়ে এলেন বাইরে। তারপর একটা ঝাঁকি দিয়ে সজোরে তার কানে একটা ঘুষি মেরে তিনি বললেন, “এই বুঝি তোর ভালোমানুষি? নোয়াকে মেরেছিস কেন?”
অলিভার শান্ত গলায় বললে : “আমার কোনো দোষ নেই…ও আমার মাকে যা-তা গালাগালি দিয়েছে।”
মিসেস্ সোয়ারবেরী বললেন, “দিয়ে থাকলেই বা কি! সে যা বলেছে, তোর মা তো তাই ছিলো।”
—“না, ছিলো না।” প্রতিবাদ করলো অলিভার।
মিসেস্ সোয়ারবেরী জোর দিয়ে বললেন : “ছিলো বৈকি!”
—“মিথ্যে কথা!” গর্জে উঠলো অলিভার।
একটা ছোট ছেলে, তা-ও আবার চাকর, তাঁর মুখের ওপর তাঁকে মিথ্যাবাদিনী বললো। মিসেস্ সোয়ারবেরী দুঃখে, অভিমানে কেঁদে ফেললেন।
স্ত্রীর চোখে জল দেখে মিস্টার সোয়ারবেরী ধৈর্য হারিয়ে ফেলে অলিভারকে এমন বেদম পিটলেন যে, মিসেস্ সোয়ারবেরী তাতে খুশি হলেন এবং মিস্টার বাম্বলের বেত চালাবার আর দরকার হলো না।
সেদিন রাতে একলা অন্ধকারে শুয়ে অনেকক্ষণ ধরে কাঁদলো অলিভার। তারপর ঊষার প্রথম আলো ফুটে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে নিজের সামান্য জামাকাপড়ের একটা পুঁটলি করে নিয়ে, ঘরের দরজা খুলে চুপি চুপি সে বেরিয়ে পড়লো মিঃ সোয়ারবেরীর বাড়ি থেকে অজানা অচেনা পথে।