৮
এই ঘরখানা পছন্দ না করে উপায় নেই।
একটু দূরে দুটি পেল্লায় চেহারার গুদাম। অর্ধগোলাকার, ওপরে টিনের ছাউনি। একটাতে থাকে নানারকম ওষুধপত্তর, অন্যটিতে গজ-ব্যাণ্ডেজ, তুলো, স্টিচিং প্লাস্টার, নী-ক্যাপ, ডেটল ইত্যাদি। কোম্পানির কারখানা থেকে এইসব জিনিস এখানে এনে জমা করা হয়, আবার বিভিন্ন জায়গায় সাপ্লাই হয়ে যায়। সেসব কি আসছে না যাচ্ছে, তা নিয়ে আমাকে মাথা ঘামাতে হয় না, তা দেখার অন্য লোক আছে। আমি ঐ গুদাম দুটোর মধ্যে একবারও ঢুকিনি।
আমার কাজটা বলা যায় এক ধরনের গ্লোরিফায়েড দারোয়ানের।
কিংবা টাইম-বাবু বলা যেতে পারে। কিংবা নিজেকে আমি বড়বাবুও ভাবতে পারি। আমার হাতে বেশ ক্ষমতা আছে। বাইরে থেকে যত লোক এখানে ঢুকবে কিংবা বেরুবে, আমার সঙ্গে দেখা না করে তাদের যাবার উপায় নেই। তাদের নাম ঠিকানা লিখে, তাদের হাতে একটা চিরকুট দিলে তবে দু’দিকের দারোয়ান তাদের ছাড়বে। এখানে কোম্পানির যে-ক’জন নিজস্ব স্টাফ তাদের সম্বন্ধে অন্য ব্যবস্থা। তাদের আসা-যাওয়ার সময় লিখিয়ে যেতে হবে আমার কাছে। ছুটির সময় তারা যখন বেরুবে, তখন আমার মনে কোনো সন্দেহ হলে আমি দারোয়ান দিয়ে তাদের বডি সার্চ করাতে পারি। কিন্তু আমার বডি কেউ সার্চ করবে না। সেই হিসেবে আমি বড়বাবু!
মূল লোহার গেটের থেকে খানিকটা দূরে আমাকে একটা চমৎকার ঘর দেওয়া হয়েছে। ঘরটা খানিকটা উঁচুতে, দোতলার মতন, যদিও একতলায় কিছু নেই, শুধু পিলার। আমার ঘরের তিন দিকে বড় বড় কাচের জানলা। পুরো গুদাম এলাকাটা যদিও দেড় মানুষ সমান দেয়াল দিয়ে ঘেরা, কিন্তু আমার ঘর থেকে বাইরেটাও দেখা যায়।
সবচেয়ে ভালো হচ্ছে বাঁ দিকটা। দেয়ালের ওপাশেই অনেকখানি জলাভূমি, কচুরিপানায় পুরোটা ভরা, মাঝে মাঝে কিছু লাল শালুকও রয়েছে, যতদূর চোখ যায়, শুধু সবুজ। কত রকম ফড়িং, বক, শালিক আর শঙ্খচিল ওড়াউড়ি করে সেই জলার ওপর। ওদিকে একটা ছোট বারান্দাও আছে। সেখানে মাঝে মাঝে উঠে গিয়ে আমি চোখ জুড়োই!
আমি এই ঘরটার নাম দিয়েছি জলটুঙ্গি।
কাজ সত্যি বেশ কম। নিজস্ব তেরোজন স্টাফ ছাড়া বাইরের মানুষ পাঁচ—সাত জনের বেশি আসে না। খুচরো বিক্রির তো ব্যাপার নেই এখানে।
অনায়াসেই আমি এখানে মাঝে মাঝে বই পড়তে পারি। ইচ্ছে করলে একটু ঘুমিয়েও নেওয়া যায় দুপুরের দিকে। তিন-চারদিনের মধ্যেই রেকর্ড কিপিং, টোকেন দেওয়া, খাতা লেখা রপ্ত হয়ে গেল। আর কেউ আমার ঘরে বসে না আমার মাথার ওপর খবরদারি করার মতনও কেউ নেই, এর চেয়ে আনন্দের আর কী আছে! এরকম একটা চাকরি অনায়াসে চালিয়ে দেওয়া যায়।
.
দিন পাঁচেক বাদে দুপুরবেলা একজন আমার ঘরে ঢুকে বলল, নমস্কার স্যার, আপনার সঙ্গে একটু আলাপ করতে এলুম। আপনার অসুবিধে নেই তো!
লোকটির বয়েস আমার অন্তত দেড়গুণ হবেই, জামাকাপড় ও মুখের চেহারা দেখলে মধ্যবিত্ত ভদ্রশ্রেণীর বলেই মনে হয়। তবে আমাকে স্যার বলছে কেন? আমাকে কি সত্যি সত্যি অফিসার ভেবেছে নাকি?
আমি বললুম, বসুন, বসুন, কোনো অসুবিধে নেই।
সামনের চেয়ারটায় বসে তিনি বললেন, আমার নাম মিথিলেশ্বর রায়, আমাকে সবাই এখানে মিথিলাবাবু বলে ডাকে।
আমি বললুম, বেশ নতুন ধরনের নাম।
মিথিলাবাবু বললেন, আমি এখানকার স্টোরকিপার। নিন, সিগারেট খান তো! ভদ্রলোকের গায়ের জামাটা ওভারঅল ধরনের। হাঁটু পর্যন্ত ঢোলা, অন্তত গোটা ছয়েক পকেট। তার এক পকেট থেকে দুটি দামি বিলিতি সিগারেট প্যাকেট বার করে একটা ঠেলে দিলেন আমার দিকে।
আমি আঁতকে উঠে বললুম, পুরো প্যাকেট? না, না, লাগবে না।
—রাখুন না, রাখুন! ওটা খুলতে হবে না এখন, আমারটা থেকে নিন!
—এত দামি সিগারেট খাওয়া আমার অভ্যেস নেই। শুধু শুধু নষ্ট হবে!
—আরে মশাই, সব সিগারেটই এক। নেশার দ্রব্য পেলেই হলো। ও নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কী লাভ! আপনি এই প্রথম নতুন চাকরিতে ঢুকেছেন বুঝি?
–হ্যাঁ, মানে, ঠিক প্রথম নয়। দ্বিতীয় বলতে পারেন। এর আগে একদিনের জন্য আর এক জায়গায়।
—হেড অফিসে তো? দীনেন বোসের জায়গায় বসিয়ে দিয়েছিল তো? খুব বেঁচে গেছেন, ভালো জায়গায় ট্রান্সফার করেছে। এখানে আরামে কাজ করতে পারবেন। নিন, এগুলোও রাখুন!
মিথিলাবাবু অন্য পকেট থেকে বার করলেন আট-দশ পাতা ওষুধ।
—এগুলো কি!
—অ্যান্টাসিড! আপনার অম্বলের প্রবলেম নেই?
—না তো!
–তা হলে আপনি তো লাকি লোক! বাড়ির অন্য লোকের কাজে লাগবে, রেখে দিন।
–আমাদের বাড়িতে কারুকে কখনো অ্যান্টাসিড খেতে দেখিনি।
—তা হলে আমাশার ওষুধ লাগবে তো? আমাশায় ভোগে না, এমন বাঙালি হতেই পারে না। আপনার যদি এখনো না হয়ে থাকে, বাড়ির বয়স্কদের নিশ্চয়ই হয়েছে দেখুন গে! আরে মশাই, ওষুধের ডিপোয় কাজ করছেন, আর পয়সা দিয়ে বাজার থেকে ওষুধ কিনবেন, তা কি হয়? লোকে শুনলে ছ্যা ছ্যা করবে যে! আপনি এর মধ্যে একদিনও আমাদের কাছ থেকে কিছু চাইলেন না, তাই ভাবলুম, লাজুক মানুষ, নিজেই গিয়ে দিয়ে আসি।
—মিথিলাবাবু, আমাদের বাড়িতে কেউ বিশেষ ওষুধ খায় না। শুধু শুধু নষ্ট করার তো কোনো মানে নেই। তাছাড়া, আমি তো শুনেছি, ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ খেতে নেই যখন তখন।
—আপনি মশাই ছেলেমানুষ। এইসব ছোটখাটো অসুখের জন্য ডাক্তারদের কেউ পয়সা দেয়? ডাক্তারদের প্রেসক্রিপশন মেনে যদি সবাই ওষুধ খেত, তা হলে এইসব ওষুধ কোম্পানিগুলো চলত কী করে? নাইন্টি পারসেন্ট ওষুধই তো বিনা প্রেসক্রিপশনে বাজারে কাটে! নিন, আপনার ভিটামিন লাগবে তো!
—আরে করছেন কী! এত ওষুধ নিয়ে আমি কী করব? না, না, আমার লাগবে না।
–আপনি ভাবছেন, কোম্পানির জিনিস বিনা পয়সায় নিচ্ছেন? সেটা খারাপ কাজ? আরে দাদা, স্টোরেজ অ্যাণ্ড ট্রান্সপোর্টের জন্য সব আইটেমে ফাইভ পার্সেন্ট ড্যামেজ ধরে রাখা হয়। ফাইভ পার্সেন্ট কি কম নাকি? অত ওষুধ আমি ড্যামেজ করব কী করে? হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে কিংবা জল ঢেলে ফাইভ পার্সেন্ট নষ্ট করব? তার চেয়ে যদি নিজেদের বাড়িতে কাজে লাগে, তাতে ক্ষতি কি?
—ফাইভ পার্সেন্ট নষ্ট করতেই হবে, এমন কোনো নিয়ম আছে? নষ্ট না হলে কোম্পানির তো খুশি হওয়ারই কথা।
—মাথা খারাপ! কোম্পানিকে খুশি করতে গিয়ে প্যাঁচে পড়ি আর কি? মনে করুন, এবার কিছু নষ্ট হলো না। সব ঠিকঠাক রইল। কোম্পানির বড় সাহেব আমার পিঠ চাপড়ে বলে গেল, বাঃ বাঃ! তারপর একটা কনসাইনমেণ্টে সত্যি সত্যি অনেকখানি ড্যামেজ হলো, তখন ঐ বড় সাহেবই এসে চোখ রাঙিয়ে বলবে, আগের বার নষ্ট হয়নি, এবার হলো কী করে? সব তোমার দোষ! বুঝুন ঠ্যালা!
–তা হলে নষ্ট করতেই হবে বলছেন?
—রেগুলার পাঁচ পার্সেন্ট বরাদ্দ করে দিতে হবে। সেগুলো যদি আমরা বাড়িতে নিয়ে যাই, তাতেই বা দোষ কী বলুন!
—আপনিই তো বললেন, ফাইভ পার্সেন্ট মানে অনেক ওষুধ। মাত্র তেরো জন স্টাফ। এত সব ওষুধ এই ক’জনে বাড়িতে নিয়ে গেলে, ভাত-টাত আর খেতে হবে না। শুধু ওষুধ খেয়েই পেট ভরে যাবে, তাই না!
-ওসব নিয়ে আপনি মাথা ঘামাবেন না। আপনার যখন যা লাগে বলবেন। আপনাকে শুধু একটা ফেবার করতে হবে। করবেন তো, বলুন!
—কী বলুন!
—আপনাকে আমাদের ওপর পাহারাদারি করার জন্য বসিয়েছে। দুপুরে একবার বাইরে বেরুতে হলেও আপনার কাছ থেকে পাশ নিতে হবে। ঠিক আছে, আপনার কাছ থেকে পাশ নিয়ে যাব। এসে ফেরৎ দেব। আপনি শুধু খাতায় নোট করবেন না। কোনো রেকর্ড রাখবেন না, ব্যাস! চাকরি করছি বলে কি দশটা—পাঁচটা জেলখানায় বন্দী থাকতে হবে?
—বাইরে যাওয়ার তো নিষেধ নেই। খাতায় নোট রাখলে অসুবিধে কি?
—রেকর্ড রাখতে নেই, রেকর্ড রাখতে নেই! হেড অফিসের বাবুরা যে দুপুরে হাওয়া খেতে বেরোয়, তার কোনো রেকর্ড থাকে!
কে যেন বাইরে থেকে চিৎকার করে ডাকল, মিথিলাদা! ও মিথিলাদা!
মিথিলাবাবু উঠে পড়ে বললেন, যাই, কেন ডাকছে দেখি? মনে রাখবেন কথাটা। কাল দুপুরেই আমার একটা দরকার আছে!
মিথিলাবাবু উঠে যেতেই আমি ওষুধের পাতাগুলো ফেলে দিলুম ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে। সিগারেটের প্যাকেটটার দিকে চেয়ে রইলুম একদৃষ্টিতে। ওটা ফেলতে হাত উঠছে না। পয়সা দিয়ে রোজ ওষুধ কিনতে হয় না, কিন্তু পয়সা দিয়ে রোজ সিগারেট কিনতে হয়।
ওষুধ কোম্পানির গোডাউনে তো সিগারেট থাকতে পারে না। এত দামি সিগারেট মিথিলাবাবু পেলেন কোথায়?
বিকেলের দিকে আবার আর এক কাণ্ড হলো।
পল্টু এখানকার একজন ক্লাস ফোর স্টাফ। চাকরির যে এত ক্লাস থাকে তাই-ই জানতুম না আগে। আমি ক্লাস থ্রি, পল্টু ক্লাস ফোর। যে যত উঁচু ক্লাসের, তার তত ছোট চাকরি!
পল্টু আজ একটু আগে ছুটি চায়। তা যাক না আগে, আমার তাতে আপত্তি করবার কী আছে? কিন্তু টিকিট লিখে খাতায় নোট করতে আমি পল্টুর দিকে বার বার না তাকিয়ে পারলুম না! তার চেহারাটা বেঢপ হয়ে গেছে। পেটটা গর্ভিনী নারীর মতন, দু’পায়ে গোদ!
পল্টু অভিমানের সুরে বললে, দেখছেন কি স্যার! মাত্র কয়েকখানা গজ—ব্যাঞ্জে নিয়েছি। কতই বা দাম হবে এর, কুড়ি-পঁচিশ টাকার বেশি দেবে না!
সুরঞ্জন দত্তরায় আমাকে নির্দেশ দিয়ে গেছেন, কোনো কর্মচারি এখান থেকে বেরুবার সময় জিনিসপত্র সরাচ্ছে এমন সন্দেহ যদি আমার হয়, তাহলে তার টিকিটে দুটো দাগ দিতে হবে। দারোয়ান তাই দেখে তাকে সার্চ করতে বাধ্য।
পল্টু আবার অভিযোগ করে বলল, আমাদেরটায় শুধু গজ-ব্যাঞ্জে ছাড়া আর কিছু স্টক নেই এখন। আর ওদের কত সুবিধে বলুন! হার্টের ওষুধ দু’তিন পাতা নিলে বুক পকেটে এঁটে যায়, কেউ বুঝতেও পারে না, অথচ তার দামই একশো টাকা!
টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়ে পল্টু বলল, টিকিটে দাগ দেবেন না, স্যার! এখানে ছেলেমেয়ে নিয়ে আমার পাঁচজনের সংসার। দেশে বাবা-মা আছে, সেখানে প্রতি মাসে টাকা পাঠাতে হয়। কেটে কেটে বারো শো টাকা মাইনে পাই, তাতে দুটো সংসার চলে এই বাজারে? আপনিই বলুন, স্যার। কিছু উপরি রোজগার না থাকলে না খেয়ে বউ-বাচ্চা মারা যাবে। এই মাসে আবার মায়ের অসুখের খবর পেয়ে মাইনের সব টাকা পাঠিয়ে দিয়েছি। হাত একেবারে খালি। আজ চাল কিনে নিয়ে না গেলে হাঁড়ি চড়বে না! কী জানি, মা এতক্ষণ বেঁচে আছে কি না!
গ্লিসারিন ছাড়াই চোখে জল এনে ফেলল পল্টু।
আমি বললুম, কিন্তু তুমি যা চেহারা করেছ, দারোয়ানরা তোমাকে দেখেই তো বুঝে ফেলবে।
চোখ মুছে পল্টু বলল, তা নিয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না। সে আমি ম্যানেজ করব।
পরীক্ষা করার জন্য আমি পল্টুর টিকিটে দাগ না দিয়েই ছেড়ে দিলুম। তারপর উঠে গিয়ে দাঁড়ালুম ডান দিকের জানলার কাছে। এখান থেকে মেইন গেটটা স্পষ্ট দেখা যায়।
পল্টু গেটের কাছে পৌঁছোতেই একজন দারোয়ান হাত বাড়িয়ে তার টিকিটটা নিল। উল্টে পাল্টে দেখল ভালো করে। তারপর পল্টুর চেহারা দেখে হাসল। বাড়িয়ে দিল আর একটা হাত।
পল্টু সেই হাতে একটা দশ টাকার নোট গুঁজে দিয়ে বেরিয়ে গেল নাচতে।
নাচতে নাঃ, বেশ চমৎকার ব্যবস্থা।
এখান থেকে বরাবরই এরকম চুরি যায়। কোম্পানি তা জানে। সেই চুরি আটকাবার জন্য কোম্পানি আমাকে এই জলটুঙ্গিতে বসিয়েছে। কিন্তু এই চুরি রোধ করার সাধ্য কি আমার আছে?
প্রত্যেকেই এসে আমার কাছে নানারকম দুঃখের গল্প বলে। বাবার অসুখ, মায়ের অসুখ। ছেলেমেয়েদের স্কুলে ভর্তি করার খরচ, কারুর ইলেকট্রিকের বিল এ মাসে তিন গুণ হয়ে গেছে, কারুর বা হারিয়ে যাওয়া রেশন কার্ড পুনরুদ্ধার করতে গিয়ে ঘুষ দিতে হয়েছে। কত রকম সমস্যা। সংসার চালাতে গেলে পদে পদে অতিরিক্ত খরচ, অথবা ঘুষ দিতে হয়। তা হলে বাঁধা মাইনের উপার্জনে চলবে কী করে?
কেউ কেউ এসে আবার অন্যের নামে নিন্দে করে যায়। একজন এসে মিথিলাবাবুর নামে একটা সাঙ্ঘাতিক কথা বলল। ওঁর নাকি দুটো বিয়ে। গোপন দ্বিতীয় সংসারটা বরানগরে। সেইজন্যই প্রায় প্রতিদিনই দুপুরে একবার বেরিয়ে সেখানে ঘণ্টা দু’-এক কাটিয়ে আসেন।
বাবাঃ, ভদ্রলোক দুটো সংসার চালান, তার ওপরেও বিদেশী সিগারেট ছাড়া খান না! কত রোজগার কে জানে!
এই রকমই চলতে লাগল। আমি কারুর টিকিটে দাগ দিই না। পাঁচ পার্সেন্ট ওষুধ নষ্ট হবেই বলে ধরা আছে। সেই পাঁচ পার্সেন্ট মানে কত তা কে জানে! সেই ওষুধ এখানকার কর্মচারিরা সত্যি সত্যি নষ্ট করুক কিংবা বাড়িতে নিয়ে গিয়ে মুঠো মুঠো খেয়ে পেট ভরাক, কিংবা বাজারে বিক্রি করুক, তাতে আমার কী আসে যায়?
বিপদ এল অন্য দিক দিয়ে।
কাল থেকে একজন নতুন দারোয়ান এসেছে। বয়েস বেশি না, বেশ চটপটে। মাথায় ঝাঁকড়া চুল, নাকের নীচে মস্ত বড় গোঁফ, এমন দুর্বোধ্য হিন্দি বলে যে বোঝাই যায় না।
দ্বিতীয় দিন দুপুরবেলা সে আলাপ করতে এল আমার কাছে। খাঁকি প্যান্ট ও শার্ট পরা, দরজার সামনে জুতো ঠুকে একটা মস্ত বড় স্যালুট করে বলল, আপকা সাথ থোড়া কুচ পেরাইভেট বাৎ হ্যায়, সাব!
আমি বললুম, আইয়ে, আইয়ে!
সে ভেতরে এসে দরজাটা ভেজিয়ে ছিটকিনি তুলে দিল। তারপর কাচের জানলাগুলোর পর্দা টেনে ঢেকে ঘর প্রায় অন্ধকার করে দিল একেবারে।
আমার বুক কেঁপে উঠল। এ আবার কী ব্যাপার? লোকটা কি আমাকে মারবে নাকি?
দারোয়ানটি একটা চেয়ার টেনে বসার পর মাথা থেকে টুপি খোলার মতন টেনে তুলে ফেলল সমস্ত চুল। চুল নয়, পরচুল। ওর মাথা জোড়া চকচকে টাক। একটানে ছিঁড়ে ফেলল মোটা গোঁফ। সেসব টেবিলের ওপর রেখে পরিষ্কার বাংলায় বলল, ওঃ কী গরম! এগুলো পরে থাকা দারুণ ঝামেলা!
এবার আমার দিকে হ্যাণ্ড সেকের জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আমার নাম সহদেব পাল। আমি কোম্পানির ভিজিলেন্স অফিসার। আপনার থেকে আমার র্যাঙ্ক একটু উঁচুতে। আমি ক্লাস টু!
আমি হঠাৎ তোতলা হয়ে গেলুম।
—আপনি…আপ…নি…আপ…নি…দারোয়ান সেজে থাকেন?
—ওনলি ফর ওয়ান মাথ! ঠিক এক মাস থাকব! এর মধ্যে আমার দুটো কাজ। কে কতটা চুরি করছে, সেটা ওয়াচ রাখা। আর একদিন আগুন ধরিয়ে দেবার ব্যবস্থা আছে।
—আগুন?
—হ্যাঁ। আগুন। আপনি আর আমিই এখানে হেড অফিসের লোক। আপনাকে জানিয়ে রাখা দরকার। এ মাসের মাঝামাঝি একটা ওষুধের লটের তারিখ এক্সপায়ার করে যাবে। তখন সেই ওষুধ তো আর বাজারে চালানো যাবে না! প্রায় দেড় লক্ষ পীস সেই ওষুধের কী হবে? কোম্পানি কি পুরো টাকাটা লস্ খাবে? আমার ওপর ভার পড়েছে, খুব সিক্রেটলি সেই ওষুধের লটায় আগুন ধরিয়ে দিতে হবে। তারপর পুরো টাকাটা ক্লেইম করতে হবে ইনসিওরেন্স কোম্পানির কাছ থেকে।
-এরকম হয় বুঝি?
—আকছার হয়। বছরে দু’বার আগুন লাগা আলাউড। আস্তে আস্তে সব শিখবেন। আর একটা কথা, এখানে কে কত চুরি করছে, সেটা আমি নোট রাখছি। এখন কারুকে আটকাচ্ছি না। পরে হুড়কো দেওয়া হবে। এখন নিচ্ছে নিক। আপনি কত পার্সেন্ট পাচ্ছেন?
—অ্যাঁ? আমি…আমি…
—লক্ষ্য করছি, আপনি কোনো টিকিটেই চেকিং মার্ক করছেন না। আপনার তো খুব সুবিধে, বসে বসেই রোজগার। ওরা কত করে দিচ্ছে আপনাকে? ক্যাশ নিচ্ছেন, না কাইণ্ড?
-আমাকে দেবে কেন?
—আমার সঙ্গে ন্যাকামি করবেন না, নীললোহিতবাবু! আমরা দু’জনেই হেড অফিসের লোক। আমাদের মধ্যে একটা আণ্ডারস্ট্যাণ্ডিং থাকা দরকার। আপনি যা পাচ্ছেন, তার আদ্ধেক আমাকে দেবেন। আমি কোনো হিসেব চাইব না। গুড ফেইথে ছেড়ে দিচ্ছি আপনার ওপর।
—মিঃ পাল, বিশ্বাস করুন, আমি কিছু নিই না। আমি কারুর সাতে পাঁচে থাকি না।
—এটা বিশ্বাস করা শক্ত। আপনি এই ঘরে বসে বসে অতিরিক্ত রোজগার করবেন, আমি দারোয়ান সেজে রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে থাকব শুধু শুধু! ভিজিলেন্সে কাজ করি বলে কি আমি মানুষ না? আমি আমার শেয়ারটা পাব না?
—ঠিক আছে, দেখবেন, এবার থেকে কারুর ওপরে সন্দেহ হলেই আমি তার টিকিটে মার্ক করব। তারপর দারোয়ানরা যা পারে, তা করবে! শুনেছি, দারোয়ানদের রোজগারই অনেক বেশি।
—আমি দারোয়ান সেজে থাকলেও আমি উচ্চবংশের ছেলে। ওদের কাছ থেকে ছিনিমিনি করে নিতে আমার প্রেস্টিজে লাগবে। আপনি যদি এ পর্যন্ত কিছু না নিয়ে থাকেন, ঠিক আছে, আজ থেকে নেওয়া শুরু করুন, কারুকে ছাড়বেন না। যা পাবেন, তার ভাগ দেবেন আমাকে! সবাই নেয়, আমরা নেব না কেন? আমাদের দুজনের ওপর চেক করার কেউ নেই!
—মাপ করবেন, আমার দ্বারা এসব হবে না।
—ঠিক আছে। আমি ওয়াচ রাখব। আমার চোখকে ফাঁকি দেওয়া খুব শক্ত!
আমাকে বেশ একটা শাসানি দিয়ে সে আবার গোঁফ আর মাথার চুল পরে নিল। রাগ-রাগ করে আর একবার আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি এখানে আসব মাঝে মাঝে! আমার কথা আর কারুক্কে যেন বলে দেবেন না!
লোকটি চলে যাবার পর আমি জলাভূমির দিকের বারান্দাটায় গিয়ে দাঁড়ালুম।
নিঃশ্বাস ভারি ভারি লাগছে। জ্বর এল নাকি? এই জায়গায় আর বেশিদিন চাকরি করলে আমার টিবি, ম্যালেরিয়া, অর্শ, ভগন্দর, হাড় মুড়মুড়ি ব্যামো, এরকম অনেক কিছু হয়ে যেতে পারে।
মেজমামা চলে গেছেন মুর্শিদাবাদ, এক্ষুনি আমি এই চাকরিতে লাথি মেরে দিকশূন্যপুরে চলে যেতে পারি। কেউ আর আমাকে খুঁজে পাবে না। কিন্তু ঐ তিন হাজার টাকার জন্য বড্ড লোভ লাগছে। কোনো রকমে দাঁতে দাঁত চেপে একটা মাস চালানো যাবে না? এক মাস পূর্ণ না হলে বোধহয় কিছুই মাইনে দেবে না।
সহদেব পাল নামে লোকটা মুখের ওপর আমাকে চোর বলে গেল। তবু যে আমি ওকে একটা ঘুষি মারতে পারলুম না, তার কারণও ঐ তিন হাজার টাকার টান। এই মাস মাইনের লোভেই লোকে আস্তে আস্তে চাকরিজীবনের দাস হয়ে যায়।
যথেষ্ট অভিজ্ঞতা হয়েছে। এবার এখান থেকে সরে পড়লেই হয়। মাস শেষ হতে আর বাকি আছে বারো দিন। তার মধ্যে দুটো রবিবার। এই কটা দিন কোনোরকমে কেটে যাবে ঠিকই।
সহদেব পালকে জব্দ করার জন্যে আমি এর পর থেকে প্রত্যেকের বাইরে যাবার টিকিটে দুটো করে দাগ দিতে লাগলুম। এবার দারোয়ানরা বুঝুক। আমি দাগ দিলে ওরা সার্চ করতে বাধ্য। তারপর কী কী পেল না পেল, তার হিসেব রাখাও ওদের দায়িত্ব। সহদেব পাল দারোয়ান সেজে থাকতে পারে, অথচ অন্য দারোয়ানদের কাছ থেকে ঘুষের ভাগ নিতে প্রেস্টিজে লাগবে!
মিথিলাবাবুর টিকিটে দাগ দিতেই তিনি আঁতকে উঠে বললেন, এ কী করছেন স্যার! আমি কী করেছি? আমার রেকর্ড খারাপ করে দিচ্ছেন!
গম্ভীরভাবে বললুম, আমি নিরুপায়। কোম্পানির অর্ডার এসেছে। বাইরে যাবার সময় প্রত্যেককে সার্চ করতে হবে।
মিথিলাবাবু বললেন, আমার কাছে কোনোদিন কিছু থাকে না। আপনি দেখুন, সার্চ করে দেখুন! আমার টিকিটে কক্ষনো দাগ পড়েনি।
আমি বললাম, মাপ করবেন, সার্চ করা আমার কাজ নয়। সেটা দারোয়ানরা করবে। তারা বুঝবে! আমাকেও প্রত্যেকদিন সার্চ করা হবে!
মিথিলাবাবু বললেন, আপনি মশাই ক্ষেপে গেলেন নাকি? তিলকে তাল করছেন দেখছি! এখানে এমন কিছুই হয় না। কোম্পানি মোটা লাভ করছে কী করে তবে?
আমি বললুম, সেসব নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। আমার যেটুকু ডিউটি সেটা আমি করে যাচ্ছি!
মিথিলাবাবু রাগ করার বদলে মুচকি মুচকি হাসলেন। দুবার বললেন, ঠিক আছে। ঠিক আছে।
পরেরদিন তিনি চরম আঘাত হানলেন আমার ওপরে।
আমার এই সুন্দর ঘরটার একটাই অসুবিধে, সঙ্গে বাথরুম নেই। ছোটবাইরে যেতে হলেও আমাকে যেতে হয় অনেকটা হেঁটে, গুদামগুলোর পেছনে কমন বাথরুমে।
দুপুরবেলা একবার সেই বাথরুম থেকে ঘরে ফিরেই আমার চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেল!
আমার টেবিলের ওপরেই দুটো বেশ বড় প্যাকেট। মোটা খয়েরি কাগজের প্যাকিং বক্স। হলুদ নাইলনের দড়ি দিয়ে বাঁধা। পাঁচ মিনিট আগেও এ দুটো এখানে ছিল না।
আমার শরীর কাঁপছে। মাত্র কয়েকদিনের চাকরিতে বড় বেশি রকমের অভিজ্ঞতা হয়ে যাচ্ছে, এতটা হজম করা শক্ত। এসব ঝঞ্ঝাট তো গল্পের বইয়ের চরিত্রদের হয়, আমার ওপর কেন বাবা? মাত্র একটা মাসও সুস্থিরভাবে চাকরি করতে দেবে না!
ভয়ের কাপুনি সত্ত্বেও কৌতূহল দমন করা যায় না। সন্তর্পণে দড়ির গিঁটগুলো খুললুম। একটার মধ্যে থরে থরে সাজানো ওষুধ। সাধারণ অ্যান্টাসিড-ফ্যাসিড নয়, দেখলেই বোঝা যায় সবগুলোই দামি। আর একটার মধ্যে দশ-বারো প্যাকেট বিদেশী সিগারেট, একটা স্কচের বোতল, গোটা দুয়েক পারফিউমের শিশি, একটা খামে এক গোছা নতুন কড়কড়ে টাকা, কত কে জানে!
এটা নিশ্চয়ই ঐ মিথিলা হারামজাদার কাজ!
উঠে জানলা দিয়ে উঁকি মারতেই দেখি যে নীচে একটু দূরে পল্টু আর হারাধন ‘নামে দুজন ক্লাস ফোর দাঁড়িয়ে আছে। ওরা পাহারা দিচ্ছে, যাতে আমি কেটে পড়তে না পারি!
আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই পল্টু একগাল হেসে বলল, আজ হেড অফিস থেকে দুজন সাহেব আসছেন, স্যার। চেকিং হবে। এক্ষুনি এসে পড়বেন, তাই এখানে দাঁড়িয়ে আছি।
জানলার কাছ থেকে সরে এলুম সঙ্গে সঙ্গে। এগুলো আপাতত লুকোতেই হবে। কিন্তু কোথায় লুকোই? এই ঘরে একটা আলমারি পর্যন্ত নেই। শুধু টেবিল, দুখানা চেয়ার, আর একটা খোলা র্যাক। টেবিলটাও এমনই ন্যাড়া যে একটা ড্রয়ার পর্যন্ত নেই।
প্যাকেট দুটো নামিয়ে রাখলুম টেবিলের নীচে। কিন্তু এতে কোনো লাভ নেই। ঘরে ঢুকলেই এদিকে নজর পড়বে। চেয়ারের কাছে এনে পা দিয়ে চাপা দেব? ধুতি থাকলে তবু ঢাকা যেত, কিন্তু প্যাণ্টে সুবিধে হবে না।
আর একটা বুদ্ধি মাথায় এসে গেল। ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটটা টিনের, সেটা বেশ বড়। ওটাকে উল্টো করে প্যাকেট দুটোকে চাপা দিয়ে রাখা যায়। ঘরের এক কোণে প্যাকেট দুটো টেনে নিয়ে বাস্কেটটা দিয়ে চাপা দিলুম, সেটা বেশ মাপে মাপে হয়ে গেল।
কিন্তু ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটের এরকম বিসদৃশ আচরণ কি অন্যরা বরদাস্ত করবে? আমি যদি কোথাও চেকিং করতে যেতুম, তা হলে এরকম অবস্থায় কী করতুম? প্রথমেই একটা লাথি মেরে এটাকে সোজা করবার চেষ্টা করতুম না?
আর কোনো উপায় আমার মনে আসছে না। হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। মাথার মধ্যে চিড়িক চিড়িক ব্যথাটা শুরু হয়ে গেল। খুব জোর ব্যথা।
দু’ হাতে মাথাটা চেপে বসে রইলুম নিজের চেয়ারে। মাথাটা ক্রমশ ঝুঁকে পড়ছে টেবিলের দিকে। সুরঞ্জন দত্তরায়ও আসছেন চেকিং-এ? ওঁকে আমি কী কৈফিয়ত দেব? চোর অপবাদ নিয়ে চাকরি খোয়াতে হবে! মা জানবেন, তাঁর ছেলে চোর। মেজমামার সম্মান নষ্ট হবে।
কিন্তু আমার আর কী করা উচিত ছিল? অন্য লোকদের চুরি করতে দিলেও ভিজিলেন্সের সহদেব পাল শাসিয়ে যাবে। আর চুরি আটকাতে গেলে স্টোরকিপার মিথিলা আমাকে জড়াবে। ওরা নিজেরা নিশ্চয়ই আজ ধোয়া তুলসিপাতা হয়ে আছে!
সুরঞ্জনবাবুকে সব সত্যি কথা খুলে বললে উনি বুঝবেন না?
আমি অনেক সময়েই লক্ষ করেছি, সত্যি কথাটাই সবচেয়ে অবিশ্বাস্য মনে হয়।
দরজার দিকে কিছু একটা শব্দ হতেই আমার মূর্ছা যাবার মতন অবস্থা হলো। এসে গেছে, হেড অফিসের বড়বাবুরা এসে গেছে এর মধ্যে?
কোনোরকমে তাকিয়ে দেখি, দরজায় নয়, বাইরের বারান্দার দিকের জানলার ওপাশে দাঁড়িয়ে টোকা মারছে নীলা।
সঙ্গে সঙ্গে আমার মাথার ব্যথা কমে গেল। আমি লাফিয়ে উঠে বারান্দায় গিয়ে নীলার হাত ধরে কাতর গলায় জিজ্ঞেস করলুম, তুমি এতদিন আসনি কেন? নীলা বলল, আসবার খুব চেষ্টা করেছি। পারছিলুম না। পৌঁছতে পারছিলুম না।
আমি বললুম, আমি আর তোমাকে যেতে দেব না।
নীলা হেসে বলল, যেতে দিও না। আমাকে ধরে রেখো।
আমার হাত ছাড়িয়ে নীলা ঘরের মধ্যে চলে এল। চেকিং স্টাফদের যা করা উচিত, ঠিক সেটাই করল নীলা। ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটটা তুলে নিয়ে বলল, এগুলো এখানে রেখেছ কেন? বাজে জিনিস!
নীলাও কি সত্যি কথাটা বুঝবে না?
আমি কিছু বলতে যাবার আগেই নীলা নীচু হয়ে প্যাকেট দুটো তুলে নিয়ে বলল, এস।
আবার সে বেরিয়ে এল বারান্দায়। একটা প্যাকেট আমার হাতে দিয়ে বলল, নাও, খুব জোরে ছুঁড়ে দাও!
দুটো প্যাকেট ঝুপ ঝুপ করে গিয়ে পড়ল জলার মধ্যে। কচুরিপানায় যেটুকু ফাঁক হয়েছিল, তাও জুড়ে গেল প্রায় সঙ্গে সঙ্গে। আর কেউ ওগুলোর খোঁজ পাবে না।
এত সহজ সমাধান ছিল?
আসলে আমার মধ্যবিত্ত মন চুরি বা ঘুষ নিতে ভয় পায়। অথচ প্রাণে ধরে এসব দামি জিনিস ফেলে দেবার কথাও চিন্তা করতে পারে না। স্কচের বোতল, বিলিতি সিগারেট, খামের মধ্যে একগোছা টাকা, এগুলো এত অবহেলায় যে ফেলে দেওয়া যায়, তা জানতুমই না।
কী চমৎকার হালকা হয়ে গেল শরীরটা।
এক ঝাঁক বক এসে বসেছে জলার মাঝখানে। কচুরিপানায় সবুজের মধ্যে ধপধপে সাদা বকগুলিকে মনে হচ্ছে বড় বড় ফুলের মতন
বারান্দায় রেলিং-এ ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে নীলা বলল, তুমি এমন গোমড়ামুখ করে বসেছিলে, আমার দেখে খুব মায়া লাগছিল।
আমি ওর মুখের দিকে নির্নিমেষে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলুম, তুমি কে বলো তো? ঝলমলে হাসিতে মুখখানা ভরিয়ে ও উত্তর দিল, আমি নীলা! তুমিই তো আমায় ঐ নামে ডেকেছ!
—তুমি আজও নীল শাড়ি পরে আছ। তোমার কি আর কোনো শাড়ি নেই?
—তুমি যদি চাও, আমি অন্য শাড়ি পরতে পারি। তবে নীল রঙটা আমার খুব পছন্দ।
—নীল রঙ আমিও ভালোবাসি। কিন্তু প্রত্যেকবার তোমাকে একইরকমভাবে দেখি, তুমি কোথা থেকে আস?
ওপরের দিকে আঙুল তুলে দুষ্টুমির সুরে নীলা বলল, ঐ আকাশ থেকে! আমি নীলার একটি হাত টেনে নিলাম নিজের কাছে। কী মসৃণ, নরম হাত ও কোনো চুড়ি পরে না, ঘড়িও পরে না। এরকম মেয়ে আকাশ থেকে নেমে আসে না।
আমি অনুনয় করে বললুম, সত্যি করে বলো, তুমি কোথায় থাক?
—দিকশূন্যপুরে।
-যাঃ, সে তো অনেক দূরে। পাহাড় পেরিয়ে যেতে হয়।
—-আজকাল কাছাকাছিও দিকশূন্যপুর তৈরি হয়েছে। তোমাকে একদিন নিয়ে যাব।
–সত্যি নিয়ে যাবে? কবে নিয়ে যাবে?
—যেদিন তুমি চাইবে।
সিঁড়িতে পায়ের শব্দ হচ্ছে, কেউ উঠে আসছে ওপরে।
আমি বললুম, নীলা, তুমি এই বারান্দায় থাকো। চলে যেও না।
আমি ফিরে গিয়ে চেয়ারে বসতেই ঘরে এসে ঢুকলেন সুরঞ্জন দত্তরায় এবং অন্য একজন। এই গরমের মধ্যেও দুজনেই সুট পরে আছেন।
বড় অফিসার এলে উঠে দাঁড়াতে হয়। নমস্কার করতে হয়। সুরঞ্জন দত্তরায় এখন আমার মামার বন্ধু নন, আমার বস্।
তিনি তাঁর সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে বললেন, মিঃ গ্যাডগিল, এই ছেলেটিকে এখানে নতুন পোস্টিং দেওয়া হয়েছে, মোটামুটি ভালোই কাজ করছে।
অন্য লোকটি ঘরের চারপাশে চোখ বুলিয়ে পকেট থেকে একটা কাগজ বার করলেন। তারপর আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার চেয়ারটায় আমি একবার বসতে পারি?
আমি উত্তর দেবার আগেই সুরঞ্জন দত্তরায় খুব খাতিরের সুরে বললেন, অবশ্যই! অবশ্যই!
বোঝা গেল, এই গ্যাডগিল সুরঞ্জন দত্তরায়ের ওপরের লোক। সম্ভবত ইনি এসেছেন বম্বে থেকে, যেখানে আসল হেড অফিস।
গ্যাডগিল আমার চেয়ারটায় বসে ঠোঁট চওড়া করে হেসে বললেন, জান দত্তরায়, আমি জীবনে চাকরি শুরু করি এই পোস্টে। বম্বে গোডাউনের ওয়াচম্যান। তখন এই ছেলেটির চেয়েও বয়েস ছিল আমার কম।
সুরঞ্জন দত্তরায় হেঁ হেঁ করে হেসে বললেন, আপনি নিজের চেষ্টায় এত বড় হয়েছেন! সেলফ-মেড ম্যান! আজ আপনি একেবারে টপ পজিশনে।
এক ঝলকের জন্য একটা দৃশ্য আমার চোখে ভেসে উঠল। নিজের বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে দোতলা থেকে নেমে আসছেন সুরঞ্জন দত্তরায়, ভেলভেটের ড্রেসিংগাউন পরা, দাঁতে কামড়ানো পাইপ, হাতে হুইস্কি ভর্তি গেলাশ, মুখে একটা গর্বিত ভঙ্গি। সেই সুরঞ্জন দত্তরায়কেও অন্য একজনের সামনে কাঁধ ছোট করে, বেঁকে দাঁড়িয়ে, দেঁতো হাসি হেসে মোসাহেবি করতে হয়।
গ্যাডগিল বললেন, না, না, সেলফ-মেড ম্যান-ট্যান কিছু না! স্রেফ লাক। শোনো ঘটনাটা। আমি ওয়াচম্যানের কাজ করি। একদিন কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর মিঃ ভুলাভাই দেশাই এলেন ইন্সপেকশান করতে। আজ আমরা যেরকম এসেছি। আমার ঘরে এসেই মিঃ ভুলাভাই দেশাই অবাক হয়ে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। আমার মুখে তিনি কী দেখতে পেলেন কে জানে। তাঁর পাশে ছিল মিঃ দেশপাণ্ডে, তাকে তিনি বললেন, এই ছেলেটি, এই ছেলেটি এই সামান্য কাজ করে? না, না, এটা ঠিক নয়। একে আরও ভালো কাজ দেওয়া উচিত!
সুরঞ্জন দত্তরায় বললেন, আপনার মুখে তিনি প্রতিভার জ্যোতি দেখতে পেয়েছিলেন! ওঁর দেখবার চোখ ছিল!
গ্যাডগিল বললেন, প্রতিভা না ছাই! তোমরা বাঙালিরাই প্রতিভা-ট্ৰতিভায় বিশ্বাস করো। ওষুধের কোম্পানি চালাতে আবার প্রতিভা লাগে নাকি? আসল ব্যাপারটা হয়েছিল, ভুলাভাই-এর একমাত্র মেয়ে তখন পলিটিক্সে জয়েন করে সদ্য সাতদিনের জেল খেটে বেরিয়ে এসেছে। ওরকম ফ্যামিলির মেয়ের পক্ষে পলিটিক্স করা, বিশেষত জেল খাটা মহাপাপ, তাই না? সেইজন্যই ভুলাভাই একটি গরিবের ছেলে খুঁজছিলেন, যার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিয়ে তাকে ঘরজামাই করতে পারবেন। আমাকেই ওঁর পছন্দ হয়ে গেল! আমি পেয়ে গেলাম রাজত্ব আর রাজকন্যা একসঙ্গে।
-এ যে স্যার গল্পের মতন!
—টুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশান! আজ আমি কোম্পানির এম ডি, কিন্তু আমার সেই প্রথম জীবনের কাজের দিনগুলো আমি ভুলিনি! এইরকম ঘরে এসে ঢুকলেই আমি নস্টালজিক হয়ে পড়ি!
আমার দিকে চোখ তুলে গ্যাডগিল আবার বললেন, ইয়াংম্যান, তোমার এ কাজ কেমন লাগে? উপভোগ করো নিশ্চয়ই?
সুরঞ্জন দত্তরায় সামান্য রসিকতা করার চেষ্টায় বললেন, এই ছেলেটিও এখনো বিয়ে করেনি। ভালো ঘরের ছেলে, স্বভাব-টভাব ভালো, আপনি ইচ্ছে করলে আপনার মেয়ের সঙ্গে—
ঘর ফাটিয়ে হাসলেন গ্যাডগিল।
তারপর বললেন, দত্তরায়, ইতিহাস সবসময় নিজেকে রিপিট করে না। প্রথম কথা, আমার দুই মেয়েরই বিয়ে হয়ে গেছে। দ্বিতীয় কথা, আজকাল কেউ ঘরজামাই রাখে না, আমার দুই মেয়েই থাকে ফরেনে। তৃতীয় কথা, এই ছেলেটি, এর নাম তো নীললোহিত, এর চরিত্র সম্পর্কে আমি অলরেডি অভিযোগ পেয়েছি। আমার কাছে ওর নামে একটা অ্যানোনিমাস লেটার এসেছে!
আমি বারান্দার দিকে আড়চোখে তাকালুম। নীলা এককোণে দাঁড়িয়ে আছে, তার মুখে সরল কৌতুকের হাসি।
গ্যাডগিল হাতের কাগজটা তুলে বললেন, এই সেই চিঠি! আজ সকালে আমার হোটেলে একজন এটা দিয়ে গেছে।
সুরঞ্জন দত্তরায় পাংশু মুখে জিজ্ঞেস করলেন, ওর নামে কী অভিযোগ করেছে?
গ্যাডগিল আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ডোনট গেট অ্যালার্মড! বেনামী চিঠি আমি ঘৃণা করি। সব অফিসেই যারা ভালো কাজ করে, তাদের নামে বেনামী চিঠি যায় মালিকদের কাছে। তুমি যেমন কাজ করছ, চালিয়ে যাও! অ্যাটেনডেন্স রেজিস্টারটা কোথায় দেখি?
টেবিলের ওপরেই রয়েছে বড় খাতাটা। গ্যাডগিল সেটার পাতা উল্টে উল্টে খুব মনোযোগ দিয়ে সব কর্মচারীদের সইগুলো দেখতে লাগলেন। আপন মনে বলতে লাগলেন, বোকা লোকটা চিঠিটা টাইপ না করে হাতে লিখেছে। এই লোককে ধরে ফেলা কিছুই শক্ত নয়।
হঠাৎ মুখ তুলে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি সিগারেট খাও? দেখি, তোমার প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট দাও তো আমাকে!
সুরঞ্জন দত্তরায় নিজের পকেট থেকে সিগারেট বার করে বললেন, এই যে, ‘ এই নিন!
গ্যাডগিল তবু হাত বাড়িয়ে রইলেন আমার দিকে।
আমাকে আমারটা বার করতেই হলো।
গ্যাডগিল ভুরু তুলে বিরাট অবাক হবার ভাব দেখিয়ে বললেন, তুমি এত বড় একটা স্টোরে কাজ করো, অথচ তুমি বিলিতি সিগারেট খাও না? আশ্চর্য! আশ্চর্য!
সুরঞ্জন দত্তরায় বললেন, আমারটা নিন। আমারটা খাঁটি বিদেশী। আমি কাস্টমস্ থেকে আনাই।
গ্যাডগিল বললেন, থ্যাংক ইউ! আই ডোনট স্মোক। আমি ওর প্যাকেটটাই শুধু দেখতে চেয়েছিলাম।
সিঁড়িতে জুতোর আওয়াজ তুলে মিথিলাবাবু, পল্টু আর ঝাঁকড়া-চুলো গোঁফওয়ালা দারোয়ানটি একসঙ্গে দরজার কাছে এসে দাঁড়াল।
তাদের চোখে বেশ বিস্ময়। ওদের মধ্যে কে রেখেছিল প্যাকেট দুটো? নাকি তিনজনই এক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত? ওরা আমার চেয়ারে বসা ম্যানেজিং ডাইরেক্টরকে প্রফুল্ল মুখে কথা বলতে দেখে বেশ ঘাবড়ে গেছে মনে হলো।
দারোয়ানবেশী সহদেব পাল এক লম্বা স্যালিউট দিয়ে বলল, স্যার, সব কুছ রেডি হ্যায়।
গ্যাডগিল জিজ্ঞেস করলেন, আমার জন্য লাল কার্পেট পাতা হয়েছে নাকি?
মিথিলা বলল, হ্যাঁ স্যার, কার্পেট মানে জুট কার্পেট, এটা আমরা নিজেরা চাঁদা করে কিনেছি।
গ্যাডগিল বললেন, সমস্ত নোংরা ঢেকে দিয়েছ তো কার্পেটের নীচে? আর কঙ্কালগুলো লুকিয়ে রেখেছ কাবার্ডে? বাঃ, বাঃ, চল যাই!
উঠে দাঁড়িয়ে গ্যাডগিল আমাকে বললেন, আমার বিবাহযোগ্যা মেয়ে নেই। কিন্তু আমার দুটো হার্ট-অ্যাটাক হয়ে গেছে। আমার পরে যে আসবে, সে হয়তো তোমাকে অনেক বেশি সুযোগ দেবে। আপাতত দাঁতে দাঁত চেপে চালিয়ে যাও!
গ্যাডগিল আমার কাঁধ দুটো চাপড় মেরে এগিয়ে গেলেন সিঁড়ির দিকে।
সুরঞ্জন দত্তরায় ওদের সঙ্গে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েও একবার চট করে ফিরে এসে আমার কানে কানে ফিসফিস করে বললেন, শোনো নীলু, গ্যাডগিল কক্ষনো কারুর কাঁধে চাপড় মারে না। এটা একটা বিরল ঘটনা। তোমার চেয়ারে বসেছেন, তোমার সঙ্গে হেসে কথা বলেছেন। তোমার উন্নতি হলো বলে। গ্যাডগিলের আর মেয়ে নেই তো কী হয়েছে! আমার তো আছে! ঠিক আছে, এ বিষয়ে তোমার সঙ্গে পরে কথা বলব।
ওরা সবাই নীচে নেমে যাবার পর আমি আবার চলে এলুম বারান্দায়।
নীলা বলল, আমি দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিলাম, আমায় কেউ দেখতে পায়নি।
আমি বললুম, তুমি সব শুনেছ?
নীলা বলল, হ্যাঁ, সব, এমনকি ফিসফিস করে কথাও এখান থেকে শোনা যায়। তোমার চাকরির উন্নতি হবে বলল।
—আমি চাই না! চাকরির উন্নতি মানে এই ঘরটা ছেড়ে যাওয়া। এই ঘরটার জন্যই তো চাকরিটা আমার তবু পছন্দ হয়েছে।
–হয়তো এর চেয়েও ভালো ঘর দেবে।
—নীলা, তোমারই জন্য। তুমি বাক্স দুটো ফেলে দেবার বুদ্ধি দিলে ভাগ্যিস!
—ও কিছু না। নীললোহিত, আমি এবার চলে যাচ্ছি।
–না, না, এক্ষুনি যেও না।
—থাকতে পারছি না। দ্যাখ, আমার শরীর কাঁপছে।
–আমি তোমাকে ধরে রাখব। যেতে দেব না।
–ধরে রাখো আমাকে। শক্ত করে ধরো।
আমি দু’ হাত বাড়াতেই নীলা আমার বুকে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমি এক হাত রাখলুম তার পিঠে, আর এক হাত কোমরে। তার বুক মিশে গেছে আমার বুকে, তার দুই ঊরু ঠেকেছে আমার ঊরুতে। আঃ কী আনন্দ! কী আকস্মিক প্ৰাপ্তি!
আমি তার উন্মুখ ঠোটে একটা আঙুল বুলোতে বুলোতে জিজ্ঞেস করলুম, এবার সত্যি করে বলো তো, তুমি কে? তুমি কি আমার স্বপ্ন, না মায়া, না মতিভ্ৰম, না আমার যাবজীবনের পুণ্যফল?
নীলা ব্যাকুল গলায় বলল, তোমার মনটা তরল হয়ে গেছে, নীললোহিত। আমি আর থাকতে পারছি না। আমাকে তুমি পরিপূর্ণ করো। আমাকে চলে যেতে দিও না। আমি যেতে চাই না।