৩
আমার ধারণা ছিল, বিদেশে যারা থাকে, তাদের খুব খাটতে হয় বলে ছুটির দিনে অনেক বেলা করে ঘুমোয়। কিন্তু মেজমামা আমার অনেক আগেই, একেবারে ভোরবেলা জেগে বসে আছেন।
বৌদির সকালের স্কুল, তার এই সময় বেরুবার তাড়া থাকে। বৌদি নিজেই প্রথম চা-টা বানিয়ে দিয়ে যায়। তারপর জলখাবার ও বাকি রান্নার ভার মায়ের ওপর। একমাত্র আমারই আটটার আগে কোনো কাজ নেই। তবু আমাকেও আজ বিছানা ছাড়তে হলো।
অন্যদিন ঠিকে ঝি-র বাসনপত্র মাজার ঘ্যাস ঘ্যাস ঠনাৎ ঠন আওয়াজ শুনতে পাই, আজ তা ঢেকে গেছে মেজমামার গলা সাধায়। নিজের ঘরে বসে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত গাইছেন। খুব যে একটা বেসুরো তা বলা যায় না। বাজখাঁই ধরনের। কোকিলের স্বর মিষ্টি, তা বলে শালিক-চিলরা কি ডাকবেই না?
গান থামিয়ে মেজমামা হাঁক দিলেন, অলকা, আর এক কাপ চা খাওয়াবে? মা আমাকে ঠেলে তুলে দিয়ে বললেন, এই নীলু, বিস্কুট একেবারে ফুরিয়ে গেছে। চট করে নিয়ে আসবি? সকালবেলায় কি শুধু চা দেওয়া যায়? দুধটাও নিয়ে আয় এই সঙ্গে।
এই শুরু হয়ে গেল আমার চাকরি! কে বলে আমি বেকার?
বৃষ্টি একটু থামলেও আকাশে জমজমাট মেঘ। আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তায় এক হাঁটু জল জমে আছে। তা হলে ভবানীপুরে নিশ্চয়ই কোমর পর্যন্ত আজও খিচুড়ির দিন।
আমারই সঙ্গে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বৌদি বলল, আমি চট করে একবার ইস্কুলটা ঘুরে আসি। ক্লাস বোধহয় হবে না। তবু, কাল যাইনি তো। একবার হাজিরাটা দেওয়া দরকার। তুমি বিস্কুট আনতে যাচ্ছ তো, গোটা কয়েক ডিম.আর হাফ পাউণ্ড পাঁউরুটিও নিয়ে এসো একেবারে। বারবার যাবে কেন?
আমি বললুম, কাল বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখছিলুম, আমাদের এই রাস্তায় একটা কুকুর গাড়ি চাপা পড়ল।
বৌদি খানিকটা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল।
আমি নিস্পৃহ ভাবে আবার জানালাম যে, এমনিতেই করপোরেশনের গাড়ি সহজে দেখতে পাওয়া যায় না। কাল সারাদিন বৃষ্টির মধ্যে তো ওদের গাড়ি বেরোয়ইনি। সেই কুকুরটা পচে-গলে এই বৃষ্টির জলে মিশে আছে।
বৌদি চরম ঘেন্নায় নাক কুঁচকে বলল, এঃ মাগো! পচা কুকুর?
আমি বললুম, আমার কোনো অসুবিধে হবে না। খালি পায়ে এই জল ঠেলে চলে যাব, ফিরে এসে পা ধুয়ে নেব!
বৌদি ছটফট করতে করতে বলল, আমি কিছুতেই এই জলে পা দিতে পারব না। ওরে বাবারে, না, না, এই নীলু, তুমি প্লিজ আমাকে একটা রিক্সা ডেকে দাও!
—বৃষ্টির দিনে রিক্সা? তোমার মাথা খারাপ? ট্যাক্সির তিনগুণ ভাড়া চাইবে।
—আমি রিক্সা ছাড়া যেতে পারব না। লক্ষ্মীটি নীলু, একটা রিক্সা ডেকে দাও!
—আর ক’খানা একশো টাকার নোট লুকিয়ে রেখেছ?
বৌদিকে সদর দরজায় দাঁড় করিয়ে আমি নেমে পড়লুম জলে। বৌদি কুকুরের কু-টুকু শুনলেই ভয় পায়। একবার আমাদের পাশের বাড়ির একটা বাচ্চা মেয়েকে কুকুরে কামড়েছিল, তা শুনে বৌদির পায়ে ব্যথা হয়ে গিয়েছিল! বৌদির ধারণা, সারা পৃথিবীটাই পাগলা কুকুরে ভর্তি।
রিক্সা পাবার আশা এখন খুবই কম। এইসব রাস্তায় জল-জমা বৃষ্টির দিনগুলোতে রিক্সাওয়ালারাই রাজা। অন্য সময় তাদের যত হেলা-তুচ্ছ করা হয়, তার সব শোধ ওরা নেয় এই কটা দিনে।
জলের মধ্যে মুখ থুবড়ে এখানে ওখানে পড়ে আছে কয়েকটা অ্যাম্বাসাডর গাড়ি। তার পাশ দিয়ে সওয়ারি নিয়ে অবলীলাক্রমে দৌড়ে চলে যাচ্ছে রিক্সাওয়ালারা।
স্টেশনারি দোকানটায় আজকের কাগজ এসে গেছে। তাতে বেশ ভালো ভালো খবর পাওয়া গেল। বেলেঘাটায় আর ভবানীপুরে দুটো পুরোনো বাড়ি ভেঙে পড়েছে। তালতলায় খোলা হাইড্রান্টের মধ্যে হারিয়ে গেছে একটা বাচ্চা ছেলে। ট্রামের তার ছিঁড়ে গেছে, বাস উল্টে গেছে, অনেকগুলো লোক্যাল ট্রেন চলেনি, গাছ ভেঙে পড়ে কয়েকটা রাস্তা বন্ধ, তিন দিনের বৃষ্টিতে নাগরিক জীবন বিপর্যস্ত।
আজও অফিস-টফিসে বিশেষ কেউ আসবে বলে মনে হয় না।
গুরু গুরু করে একবার আধা-ঘুমন্ত সিংহের মতন মেঘ ডাকল!
আমি মনে মনে বললুম, আয় বৃষ্টি ঝেপে, ধান দেব মেপে! আরও বৃষ্টির দরকার। আজকের মতন মেজমামার সঙ্গে চাকরি খোঁজার অভিযানটা বন্ধ করতেই হবে!
সত্যিই আবার বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি নামল একটু পরেই। মেঘের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব আছে, মেঘ আমার কথা শোনে।
বৃষ্টির প্রতি আমার ভালোবাসা সুগভীর ও অকৃত্রিম। এপ্রিল-মে মাসে যারা গরমে হাঁসফাঁস করে, বৃষ্টির জন্য হা-পিত্যেশ করে তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে, তারাই অনেকে জুলাই-আগস্ট মাসে বিরক্তির সঙ্গে বলে, ওঃ সর্বক্ষণ বৃষ্টি আর বৃষ্টি, আর পারা যায় না! এরা অকৃতজ্ঞের দল। যে-কোনো জায়গায়, যে-কোনো সময় বৃষ্টি আমার প্রিয়। এমনকি মাঝরাস্তায় হঠাৎ বৃষ্টি এসে আমায় চুপচুপে করে ভিজিয়ে দিলেও আপত্তি নেই। কোনো ফাঁকা মাঠের মধ্যে বহুদূর বিস্তৃত বৃষ্টির দৃশ্যে আমি যেন একটা অলৌকিকের আভাস পাই।
বৃষ্টি কম না হলে যে চাষবাস নষ্ট, চাষীদের মাথায় হাত, সে কথা অনেকে বোঝে না। কেউ কেউ আবার বলে, কলকাতা শহরে এত বৃষ্টি হবার দরকারটা কি? এত জল শুধু শুধু নষ্ট। এইসব বৃষ্টি ধানখেতগুলোতে হলেই তো পারে।
কী আব্দার! বৃষ্টির দেবতা একখানা বিরাট কাঁচি দিয়ে কলকাতার আকাশ থেকে মেঘগুলো কেটে কেটে ধানখেতে ছুঁড়ে দেবেন!
ডিম পাঁউরুটি বিস্কুট আর দুধের বোতল নিয়ে ফেরার সময় দেখি যে আমাদের বাড়ির সামনে একটা জিপ গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। কলকাতায় জিপ দেখলেই আমার পুলিসের কথা মনে পড়ে। আমাদের বাড়িতে পুলিস?
দোতলার ভাড়াটেদের একটা ছেলে খুব গরম গরম ছাত্র-রাজনীতি করে। আমাকে প্রায়ই নানা কথা বোঝাতে আসে। নক্শাল আন্দোলনটাকে সে আবার চাঙ্গা করে তুলতে চায়। আমার চেয়ে বয়েসে বছর পাঁচেকের ছোট হলেও সে বলে, আপনাদের মতন বেকারদেরই তো উচিত সব কিছু ভাঙচুর শুরু করা! এর মধ্যে একবার সে তিন দিনের জন্য জেল খেটেছে বলে তাই নিয়ে গর্ব করে খুব।
তার জন্য পুলিস এসেছে? কিন্তু এমন দুর্যোগের দিনে নিছক এক ছাত্রনেতাকে ধরতে আসবে, পুলিসের কী মাথা খারাপ হয়ে গেল!
ওপরে এসে দেখি মেজমামার শালা ভন্তু বসে আছে।
ভন্তুর বয়েস বছর তিরিশেক। আমার থেকে কিছুটা বড় বলে আমার সঙ্গে কথা বলার সময় একটা ভারিক্কিভাব দেখায়। তাছাড়া ভন্তু সাকসেসফুল। আগে সে রাইটার্স বিল্ডিংসে ইউ ডি ক্লার্ক ছিল, বছর দু’-এক হলো সে চাকরি ছেড়ে দিয়ে অন্য দুই ভদ্রলোকের সঙ্গে পার্টনারশীপে ফ্ল্যাট বানাবার ব্যাবসা শুরু করেছে। একে বলে ডাবল প্রমোশন। এই বাজারে চাকরি পেয়েও ছেড়ে দেওয়া, তার ওপরে ব্যাবসা। আমাকেও সে একবার প্রস্তাব দিয়েছিল, তুই পঞ্চাশ হাজার টাকা ব্যাঙ্ক লোন ম্যানেজ কর নীলু, তোকেও আমাদের কম্পানির পার্টনার করে নেব।
এই ম্যানেজ কথাটা ভন্তুর মুদ্রাদোষ।
জিপ গাড়িটা ভন্তুই এনেছে। তার কোম্পানির নতুন গাড়ি। এই জিপ নিয়ে সে কাল এয়ারপোর্টে মেজমামাকে রিসিভ করতে গিয়েছিল। পৌঁছতে দেরি করেছিল চল্লিশ মিনিট, এই বৃষ্টি-বাদলার মধ্যেও যে প্লেন ঠিক সময়ে আসবে, তা সে বুঝবে কী করে?
মেজমামার কাছ থেকে কাল কোনো টেলিফোনও না পেয়ে সে আজ সকালেই খোঁজ নিতে এসেছে।
ভন্তুকে দেখেই আমি বেশ উৎফুল্ল বোধ করলুম। তা হলে আজই মেজমামার মুর্শিদাবাদে শ্বশুরবাড়ি চলে যাওয়ার কোনো বাধা নেই।
তিন কাপ চা নিয়ে বসার পর আমি বললুম, আজকের কাগজে লিখেছে, মুর্শিদাবাদের দিকে এবার বৃষ্টি কম হচ্ছে। কাল-পরশু বৃষ্টিই হয়নি, সব রাস্তা খোলা।
ভক্ত বলল, আমাদের ওদিকে সব সময় রাস্তা খোলা থাকে।
মেজমামা বললেন, দূর ছাই! ওদিকে বৃষ্টি হয়নি? তা হলে তো পুকুরে মাছও নেই?
আমি বললুম, মাছ থাকবে না কেন? বেশি বৃষ্টি হলেই বরং পুকুর উপছে মাছ বেরিয়ে যায়। কম বৃষ্টিতে মাছ ভালো থাকে।
মেজমামা একগাল হেসে বললেন, তুই মাছের এক্সপার্ট কবে থেকে হলি রে, নীলু?
আমি বললুম, ওয়েদার ফোরকাস্টে আছে আগামী আটচল্লিশ ঘণ্টা কলকাতা আর চব্বিশ পরগণায় হেভি বৃষ্টি হবে। এরপর তুমি আটকে যাবে মেজমামা, মুর্শিদাবাদ যেতেই পারবে না।
মেজমামা বললেন, আমি তো এবার বৃষ্টি দেখতেই এসেছি রে! ওদিকে তা হলে আর এখন যাব না! কান্দীতে গেলেই তো ভস্তুর মা ঘ্যানোর ঘ্যানোর করবে, কেন ঊষাকে আনিনি, ছেলেমেয়েদের আনিনি! ভন্তুর দিদিটা যে জেদি, একরোখা আর আধপাগলা তা কি সেই ভদ্রমহিলা বুঝবেন! বউ সঙ্গে না থাকলে শ্বশুরবাড়ি গিয়ে সুখ নেই।
ভন্তু বলল, জামাইবাবু, ও কথা বলবেন না। আপনার জন্য সব রেডি করা আছে। পুকুরের বড় বড় মাছগুলো ম্যানেজ করে রেখে দিয়েছি, জাল ফেললেই টপাটপ উঠবে। আপনি নিজে ছিপ ফেলেও ধরতে পারেন। দু’ছড়া মৰ্তমান কলা হয়েছে, গাছেই রেখেছি, কাটিনি এখনো। ভাগলপুরী গাই ম্যানেজ করেছি একটা, দুধ যা খাওয়াব না, ফার্স্টক্লাস। আমি তো চাইছি, আজই এই জিপ নিয়ে সোজা স্টার্ট করতে। বিকেলের মধ্যে পৌঁছে যাব
মেজমামা বললেন, তোর এই জিপটা জলে আটকায় না বুঝি?
ভন্তু বলল, জলে আটকাবে কি? ব্রাণ্ড নিউ সেকেণ্ড হ্যাণ্ড কিনেছি। ছোটখাটো নদী ম্যানেজ হয়ে যাবে অনায়াসে।
মেজমামা বললেন, গুড! তোর জিপটা নিয়েই আজ বেরুব। কলকাতায় কয়েকটা জায়গা ঘুরব। পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে হবে।
ভন্তু বলল, নো প্রবলেম। যেখানে যেতে চান, নিয়ে যাব।
তারপর আমার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, নীলু, চাকরি-টাকরি ম্যানেজ করেছিস এর মধ্যে?
যতবার দেখা হবে, ততবারই ভন্তু জিজ্ঞেস করবে এই কথাটা
আমি কিছু উত্তর দেবার আগেই মেজমামা অট্টহাস্য করে উঠলেন। তারপর বললেন, এবার দ্যাখ না কী করি। এতদিন বাবু গায়ে ফুঁ দিয়ে বেড়াচ্ছিল, এবার হালে জুড়ে দেব। নীলু আমাকে আজই মুর্শিদাবাদ পাঠাবার চেষ্টা করছে, তা আমি বুঝি না? আমরা সবাই চাকরিতে খেটে খেটে মরছি, আর তুই শালা সারা জীবন ছুটিতে কাটাবি?
আমি আঙুল তুলে বললুম, মেজমামা, আমি তোমার শালা নই। তোমার শালা ঐ যে!
মেজমামা বললেন, ভন্তুকে এখন আর শালা বলা যাবে না, সম্বন্ধী বলতে হবে। শিগগিরই ও আমার চেয়ে বেশি টাকা রোজগার করবে। এক সঙ্গে ক’টা ফ্ল্যাট বাড়ি বানাচ্ছিস রে?
ভক্ত বলল, তিনখানা প্রজেক্টে হাত দিয়েছি। আরও একটা ম্যানেজ হয়ে যাবে।
মা রান্নাঘর থেকে ডাকলেন, নীলু, এগুলো একটু নিয়ে গিয়ে ওদের দে!
আধডজন ডিম এনেছিলুম, মা দুটো ডবল ডিমের ওমলেট বানিয়েছে ভন্তু আর মেজমামার জন্য। আমার জন্য সিঙ্গল! ওদের ওমলেটের পাশে আমারটা কত সরু, গোবেচারা, করুণ চেহারা। শুধু শুধু একটা ডিম বাঁচাতে গেল কেন মা? দাদা বাড়িতে থাকলে কি তাকে কম দেওয়া হতো?
মায়ের এরকম পক্ষপাতিত্ব আমি আগে কখনো দেখিনি। বাড়িতে ডিম কম পড়লেও না হয় কথা ছিল! আমি আধখানা ডিম পেলেও খুশি থাকতে পারি, কিন্তু ভন্তু ডবল ওমলেট পাবে কেন? ও এখন অনেক টাকা করছে বলে? ভন্তুর রোজগারের এক পয়সাও মা কোনোদিন নেবেন না বা পাবেন না, তবু সে বড়লোক বলেই তাকে খাতির করতে হবে। আশ্চর্য মানুষের মনস্তত্ত্ব!
একটু বাদে ভন্তু ব্যস্ততার ভান দেখিয়ে চলে গেল। সাড়ে দশটার সময় সে জিপটা পাঠিয়ে দেবে।
মেজমামার বাঁ পায়ের গোড়ালিটা বেশ ফুলেছে। কাল হলুদ-চুন বা কোনো ওষুধ লাগাননি। পা টেনে টেনে বারান্দা পর্যন্ত এসে বললেন, মানুষ একটু খুঁড়িয়ে হাঁটলে আলাদা একটা ব্যক্তিত্ব আসে, তাই না রে?
আমি বললুম, আপনার ব্যক্তিত্ব তো কিছু কম পড়েনি।
মেজমামা বললেন, গোড়ালিটায় একটু ব্যথা হয়েছে। ব্যথাটা আমি বেশ এনজয় করছি, এমনিতে তো আমার অসুখ-বিসুখ প্রায় হয়ই না।
মা বললেন, বৃষ্টি তো থামছেই না। তা হলে আজ আর না বেরোলি, পিন্টু! আজ দুপুরটা খেয়েদেয়ে ঘুমো। একটা দিন বিশ্রাম নে।
মেজমামা বলল, তুমি টেস্ট করছ, ছোড়দি? দেখছ, আমার মনে আছে কিনা? নীলুকে নিয়ে আজ আমি ঠিকই বেরুব। তোমার ভাগ্যের জোর থাকলে আজই ওর চাকরি হয়ে যাবে।
মা বললেন, আহা, আজই যেতে হবে তার কি মানে আছে? এখন তো থাকছিস কয়েকটা দিন।
মেজমামা উদ্ভাসিত মুখে বললেন, শুভস্য শীঘ্রম! অশুভস্য কাল হরণম! কী রকম সংস্কৃতটা মনে আছে দেখলে? কই রে, নীলু, তৈরি হয়ে নে। ভালো জামা-প্যান্ট আছে তো? আমার একটা টাই দিচ্ছি, টাই বাঁধতে জানিস?
বৌদি ফিরে এসেছে একটু আগে। আমার সঙ্গে বৌদির আজ কথা বন্ধ থাকার কথা। সকালে আমি রিক্সা ডেকে না দিয়ে ওর স্কুলের লেট করিয়ে দিয়েছি।
বৌদি তবু নিজের ঘর থেকে মুখ বাড়িয়ে বলল, ও টাই পরবে কেন মেজমামা? বাঙালি অফিসে আবার টাই পরে যায় নাকি কেউ?
মেজমামা বললেন, বাঙালিরা টাই পরে না? আমি দেখিনি ভেবেছ? আমি ঢের ঢের বাঙালি সাহেব দেখেছি! সিঙ্গাপুরে বেড়াতে আসে, সব গলায় টাই ঝুলিয়ে!
বৌদি বলল, সে তো অফিসারদের চাকরি! নীলুর জন্য আপনি কি …
বৌদি আঁচলে মুখ চাপা দিয়ে হেসে উঠল। যেন আমার পক্ষে একটা অফিসারের চাকরি পাওয়ার কথা পাগলেও চিন্তা করতে পারে না!
এ ব্যাপারে অবশ্য আমি বৌদির সঙ্গে একমত। চাকরির ব্যাপারে আমার কোনো বাছ-বিচার নেই। সব চাকরিই আমার অপছন্দ! ‘পৃথিবীতে নাই কোনো বিশুদ্ধ চাকুরি!’
মেজমামা টাই পরা নিয়ে আর উচ্চবাচ্য করলেন না। কিন্তু জুতো নিয়ে একটা ঝঞ্ঝাট বাধল। আমি তো বরাবরই প্যান্টের সঙ্গে চটি পরে চালিয়ে দিচ্ছি, কিন্তু চাকরির ইন্টারভিউতে গেলে নাকি শু পরা বাধ্যতামূলক। চটি পায়ে দিয়ে গেলে কেউ কক্ষনো চাকরি পায় না।
যাক বাঁচা গেল। আমার শু নেই। আমি ইয়ার্কির সুরে বললুম, ধুতি-পাঞ্জাবি চলবে?
বৌদি বলল, যাঃ, বাঙালিরা আজকাল আর ধুতি পাঞ্জাবি পরে নাকি? সে তো শুধু বিয়ে আর শ্রাদ্ধের দিনে।
তা হলে যাওয়া হচ্ছে না তো? আগে শু কিনে কয়েকদিন পরা প্র্যাকটিস করে নিতে হবে। নতুন জুতো পায়ে দিলেই ফোস্কা পড়ে। ইন্টারভিউ দিতে গেলে খোঁড়ানো পায়ের ব্যক্তিত্ব কি সাহেবরা পছন্দ করবে?
মা কোথা থেকে একজোড়া পুরোনো জুতো টেনে বার করলেন। বছর দেড়েক আগে আমি একবার দার্জিলিং গিয়েছিলাম শীতকালে। অত ঠাণ্ডায় চটি পরে ঘোরা যায় না বলে আমার মামাতো ভাইয়ের কাছ থেকে এই জুতো ধার নেওয়া হয়েছিল। আর ফেরত দেওয়া হয়নি। এত দিনে সে ভুলেও গেছে।
জুতো জোড়ার ওপরে সবুজ ছাতকুঁড়ো জন্মে গেছে, ভেতরে মাকড়শার জাল। তবু সেই জুতোই পরিষ্কার করার জন্য মা আর বৌদির কি উৎসাহ!
বৌদি যে এতদিন ধরে আমার বেকার থাকাটা সমর্থন জানিয়ে যাচ্ছিল, সেটা আসলে আন্তরিক নয়? বৌদিও চায় আমি চাকুরিজীবীদের ব্যাণ্ড ওয়াগনে যোগ দিই? কিংবা, মেজমামার সঙ্গে বেরিয়ে বিভিন্ন অফিসে আমি কতটা নাকানি—চোবানি খাই, সেটা দেখাই ওর উদ্দেশ্য।
বেরুবার আগে মাকে প্রণাম করতেই মা আমার পকেটে কী সব পুজোর ফুল-টুল গুঁজে দিলেন। বৌদি গান গেয়ে উঠল, জয় যাত্রায় যাও গো।
মেজমামা গলা মেলালেন, ওঠো, ওঠো জয় রথে… ঐ যে জিপ এসে গেছে! এরকম বোকা বোকা মুখ করে আমি কোনোদিন বাড়ি থেকে বেরোইনি। ঠিক যেন নব-কার্তিক! পালিশ করা চকচকে জুতো, নিপাট চুল আঁচড়ানো, মা ও বৌদির দৃষ্টি যেন গায়ে ফুটছে। আপত্তি করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না, মেজমামা তা হলে আমায় বেড়ালছানার মতন শূন্যে তুলে নিয়ে যাবেন।
এরকম অবস্থায় রাগ করেই বা লাভ কী, আমি ঠোটের দু’পাশ দিয়ে ফুরফুরে হাসি ছড়াতে লাগলুম।
জিপে উঠে মেজমামা বললেন, প্রথমে যাব ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে। নীলু, তুই নিৰ্মল পত্রনবীশের নাম শুনেছিস? আই এ এস অফিসার, ভারি ভালো ছেলে। ইডেন হিন্দু হোস্টেলে আমার রুমমেট ছিল। আমার অত্যাচার সহ্য করেও টিকে ছিল, তা হলেই বুঝতে পারছিস, কতখানি ওর সহ্যশক্তি! খুব পরোপকারী। নির্মলের কাছে গেলেই তোর একটা হিল্লে হয়ে যাবে।
খবরের কাগজে যে-রকম লিখেছে, সে-রকম কোনো ভয়াবহ দৃশ্য চোখে পড়ল না। মাঝে মাঝে দু’-চারটে গাছ ভেঙে পড়েছে বটে, কিন্তু কোনো কোনো রাস্তায় জল কমে গেছে অনেকটা। ট্রাম বন্ধ, কিন্তু বাস ও ট্যাক্সি যাতায়াত করছে।
ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে পৌঁছোতে বেশি বেগ পেতে হলো না। এ রাস্তায় অবশ্য জল জমে অনেক, লাইট হাউজ সিনেমার সিঁড়িতে ঢেউ ছলাৎ ছলাৎ করছে।
এখানে ফুড ডিপার্টমেন্টের একটা অফিস আছে, সেখানে নির্মল পত্রনবীশ একবেলা বসেন, অন্য বেলায় তিনি রাইটার্স বিল্ডিংস চলে যান। এই সব খবর মেজমামা ভন্তুর কাছ থেকে পেয়েছেন, সে এই দফতরেই কাজ করে গেছে এক সময়।
ভন্তু ঐ নির্মল পত্রনবীশের প্রশংসায় একেবারে পঞ্চমুখ। ওরকম ভদ্র আর কর্মবীর অফিসার বিশেষ দেখা যায় না নাকি!
গত দু’দিন বোধহয় অনেকেই আসেনি, তাই আজ মরীয়া হয়ে বেশ কিছু কর্মচারী হাজিরা দিয়েছে। পত্রনবীশ সাহেবের ঘরের বাইরে একটা ছোট ঘর, সেখানে বেশ একটি চটপটে যুবক বসে আছে। মেজমামা মুখ খুলতেই সে জিজ্ঞেস করল, আপনাদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে? নেই? তা হলে তো আজ দেখা হবে না। উনি কনফারেন্সে ব্যস্ত আছেন।
মেজমামা বললেন, অ্যাপয়েন্টমেন্ট কী করে করব? টেলিফোন খারাপ।
যুবকটি বলল, সব টেলিফোন তো খারাপ নয়। আমাদের তিনটের মধ্যে একটা চালু আছে।
মেজমামা বললেন, আপনাদের তিনটি, কিন্তু আমাদের যে সবেধন নীলমণি। নাকি, কালোমণি। সে যে বোবা!
যুবকটি বলল, ঠিক আছে। আপনার নাম বলুন, আমি অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়ে দিচ্ছি। সামনের সপ্তাহে শুক্রবারের আগে হবে না। না, হচ্ছে না আগে।
মেজমামা বললেন, এ কি দূরপাল্লার ট্রেনের টিকিট, যা দশ দিনের পরেরটা ছাড়া কিছুতেই পাওয়া যাবে না? আমাকে যে আজই দেখা করতে হবে।
যুবকটি বলল, আজ অসম্ভব। উনি অলরেডি কনফারেন্সে বসে গেছেন, এর পর আরও দুটো আছে।
মেজমামা বুড়ো আঙুল ঝাঁকিয়ে বললেন, এই ঘরে কনফারেন্স? ক’জন মিলে কনফারেন্স হয়? সবাই মনে মনে কথা বলেন নাকি? কোনো আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি না তো?
যুবকটি উঠে দাঁড়িয়ে উত্তেজিতভাবে বলল, যাবেন না, যাবেন না, ওদিকে যাবেন না, খুব জরুরি।
মেজমামা হেসে বললেন, দ্যাখ ভাই, আমার নাম পিনাকপানি বাঁড়ুজ্যে, থাকি সিঙ্গাপুরে। কোনো কাজে দশ দিন দেরি করার হ্যাবিট নেই, আর শুধু শুধু ফিরে যাওয়াও আমার কুষ্ঠিতে লেখা নেই।
তারপরই তিনি বাজখাঁই গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন, নির্মল! নির্মল!
আমার হাত ধরে এক হ্যাঁচকা টান দিয়ে ঢুকে গেলেন চেম্বারের মধ্যে।
ভেতরে এসে কিন্তু খানিকটা হকচকিয়ে গেলেন ‘ মেজমামা। বড় সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওপাশে বসে আছেন একজন খুব রোগা, ছোট্টখাট্টো মানুষ, তিনি একমনে একটা ফাইল পড়ছেন। আর একজন মধ্যবয়েসী, টাক—মাথা ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটা ফাইল থেকে একটার পর একটা কাগজ ফেলে দিচ্ছেন মাটিতে।
মেজমামা দু’জনের দিকে পর্যায়ক্রমে বারবার দেখলেন, কিন্তু নিজের অন্তরঙ্গ বন্ধুটিকে চিনতে পারলেন না। অথচ বাইরে নির্মল পত্রনবীশ নাম লেখা আছে ঠিকই।
দু’জন ভদ্রলোকই মেজমামার চ্যাঁচামেচিতে বিচলিত না হয়ে নিজেদের কাজ করে যাচ্ছেন। একজন আর্দালিকে সঙ্গে নিয়ে বাইরের যুবকটি আমাদের পেছন পেছন ঢুকে বলতে লাগল, ট্রেসপাস, ট্রেসপাস!
মেজমামা বিমূঢ়ভাবে বললেন, নির্মল নেই এখানে? মিস্টার এন পত্রনবীশ, আই এ এস?
ছোট্টখাট্টো মানুষটি এবার মুখ তুলে কয়েক পলক দেখলেন মেজমামাকে তারপর নিষ্প্রাণ গলায় বললেন, পিন্টু? কবে দেশে ফিরলি?
মেজমামা চোখ গোল গোল করে বললেন, তুই…তুই…নির্মল? এমন পাল্টে গেলি কী করে? আমি চিনতেই পারিনি! বছর চারেক আগেও তোর সঙ্গে দেখা হয়েছিল।
নির্মলবাবু বললেন, বোস পিন্টু, বোস।
পেছনের যুবকটিকে তিনি ইঙ্গিত করে বললেন, ঠিক আছে। আপনি একটু চা দিতে বলুন।
দু’খানা চেয়ার টেনে আমার দিকে ফিরে মেজমামা বললেন, নীলু, বসে পড় এই হচ্ছে আমার বন্ধু নির্মল পত্রনবীশ, ওর ডাকনামটা এত খারাপ যে অফিস—টফিসে বলা যায় না। একটানা তিন বছর আমরা হোস্টেলের এক ঘরে কাটিয়েছি। দু’জনে একসঙ্গে সিগারেট টানতে শিখেছিলুম। তোর মনে আছে নির্মল?
নির্মলবাবু সিগারেটের প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিলেন।
মেজমামা বললেন, আমি ছেড়ে দিয়েছি। তোর বাড়ির খবর বল, বউ-বাচ্চারা সব ভালো আছে তো?
কিছুক্ষণ দুই বন্ধুতে পারিবারিক কথা, কলেজ জীবনের অন্যান্য বন্ধুদের খোঁজখবর চলল। এই সব গল্পে অন্য লোকদের কোনো আগ্রহ থাকতে পারে না। যাদের চিনি না, শুনি না, তাদের সম্পর্কে হাসির কথাতেও হাসা যায় না। এই ধরনের বিরক্তিকর সময়ে আমার টেবিলে তবলা বাজানো অভ্যেস।
একটুখানি বাজিয়েই হাত সরিয়ে নিলুম। চাকরির উমেদারি করতে এসে বোধহয় এটা চলে না।
অন্য ভদ্রলোকটি আপন মনে একটার পর একটা কাগজ ফাইল থেকে খুলে মাটিতে ফেলে দিচ্ছেন। এটা তো বেশ মজার কাজ!
খানিক বাদে মেজমামা জিজ্ঞেস করলেন, তুই এত রোগা হয়ে গেলি কী করে, নির্মল? একেবারে চেনাই যায় না।
নির্মলবাবু ফ্যাকাসে ভাবে হেসে বললেন, হ্যাঁ, খুব রোগা হয়ে যাচ্ছি। সবাই বলে।
—হেভি ডায়েটিং করছিস? কিন্তু এ যে রীতিমতন অসুস্থতার লক্ষণ মনে হচ্ছে।
—তাই হবে বোধ হয়। আর একটা জিনিস হচ্ছে। আমি দিন দিন ছোট হয়ে যাচ্ছি!
—ছোট হয়ে যাচ্ছিস? তার মানে?
—দিন দিন আমার হাইট কমে যাচ্ছে। তোর মনে আছে, আগে আমি পাঁচ নয় ছিলাম?
—হ্যাঁ, মনে আছে। আমি পাঁচ এগারো, তুই পাঁচ নয়!
—এখন কত হয়েছি দ্যাখ।
নির্মলবাবু উঠে গিয়ে দেয়ালের পাশে দাঁড়ালেন। সেই দেয়ালে ফুট-ইঞ্চির দাগ কাটা আছে, অর্থাৎ লম্বা একটা স্কেলের ছবি আঁকা। রঙিন।
পা থেকে জুতো খুলে, দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে নির্মলবাবু বললেন, দ্যাখ, পাঁচ সাত হয়ে গেছি। প্রত্যেক মাসে একটু একটু কমে ছোট হয়ে যাচ্ছি। রোজ মেপে দেখি।
মেজমামা বললেন, এ যে অদ্ভুত ব্যাপার। কখনো শুনিনি। ডাক্তার দেখাসনি?
—ডাক্তাররা কিছুই বলতে পারে না।
–তুই এক কাজ কর, নির্মল। ছুটি নিয়ে সিঙ্গাপুরে চলে আয়। ওখানে বিরাট বিরাট ডাক্তার আছে, তাদের মধ্যে দু’জন আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তুই চলে আয়, তোর কোনো পয়সা খরচা লাগবে না। আমার বাড়িতে থাকবি।
ফিরে এসে আবার চেয়ারে বসে নির্মলবাবু একটা মস্ত বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, সিঙ্গাপুর…অনেক দূর!
টাক-মাথা ভদ্রলোকটি এইসব কথায় ভ্রূক্ষেপ না করে কাগজ ফেলছিলেন, এবার তাঁর ফাইলটা শেষ হয়ে গেল। সারা মেঝেতে কাগজ ছড়ানো। হাতে লেখা বা টাইপ করা সব দরখাস্ত মনে হচ্ছে।
তিনি পা দিয়ে কাগজগুলো ঠেলে ঠেলে এক কোণে সরিয়ে দিয়ে বললেন, আমার কাজ শেষ হয়ে গেছে, স্যার। যাই!
নির্মলবাবু মাথা হেলিয়ে সম্মতি দিলেন।
মেজমামা জিজ্ঞেস করলেন, কই রে, তুই যে চা দিতে বললি, এখনো দিল না তো?
নির্মলবাবু বললেন, সাধারণত পঁয়তিরিশ মিনিটের আগে ওরা চা দেয় না। কখনো কখনো পঁয়তাল্লিশ মিনিটও লাগিয়ে দেয়। এই জন্যই ভিজিটররা এলে আমি চায়ের কথা বলিই না, তা হলে তারাও অতক্ষণ বসে থাকে। তবু এক একবার মুখ ফস্কে চায়ের কথা বেরিয়ে যায়।
মেজমামা বললেন, আসুক চা, আমাদের তাড়া নেই। তুই সিঙ্গাপুরে চলে আয়, ওখানে চিকিৎসা করালে তুই নির্ঘাৎ দু ইঞ্চি হাইট ফিরে পাবি। হ্যাঁ, একটা কাজের কথা বলে নি। এই যে একে দেখছিস, এ আমার ভাগ্নে। আপন ছোড়দির ছেলে। এর জন্য তোকে একটা চাকরির ব্যবস্থা…
নির্মলবাবুর বুকে যেন একটা গুলি লাগল। বিস্ফারিত হয়ে গেল চোখ, ওপরে দু’হাত তুলে আতগলায় বললেন, অ্যাঁ? কী বললি? কী বললি?
হঠাৎ চেয়ার উল্টে নির্মলবাবু সটান পড়ে গেলেন মাটিতে। দড়াম করে শব্দ হলো, ওঁর মুখ দিয়ে গোঁ গোঁ করে আওয়াজ বেরোতে লাগল।
আমি আর মেজমামা উঠে দাঁড়িয়ে উঁকি মেরে দেখি যে উনি হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে আছেন, শরীর একটুও নড়ছে না, দু’চোখ বোজা।
চোখের নিমেষে হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেল নাকি ভদ্রলোকের?
চেয়ার উল্টে পড়ার আওয়াজে সেই টাক-মাথা ভদ্রলোক, বাইরের ছোকরাটি ও দু’জন আর্দালি ছুটে এল। একজন একটা জলের জগ নিয়েই এসেছে হাতে। টাক-মাথা ভদ্রলোকটি বললেন, এই রে, স্যারের আবার ফিট হয়েছে। এই সুরেন, চোখে-মুখে জল ছেটাও, জল ছেটাও!
তারপর তিনি মেজমামার দিকে কটমট করে তাকিয়ে বললেন, নিশ্চয়ই আপনারা চাকরির কথা কিছু বলেছেন? জানেন না, চাকরি শব্দটা শুনলেই উনি অজ্ঞান হয়ে যান?
আমার অমন জাঁদরেল মেজমামা, তিনি পর্যন্ত বেশ ঘাবড়ে গেছেন ব্যাপার-স্যাপার দেখে। মিনমিন করে বললেন, আজ্ঞে, তা আমি কী করে জানব!
নির্মলবাবুর চোখে মুখে জল ছিটিয়ে ভিজিয়ে দেওয়া হলো পুরো জামাটা। পাখাটা ফুল স্পিড করা হলো।
ঘরের এক পাশে একটা ডিভান রয়েছে। নির্মলবাবুকে ওরা ধরাধরি করে এনে শুইয়ে দিল তার ওপরে।
টাক-মাথা ভদ্রলোক বললেন, এখানে আধ ঘণ্টা শুয়ে থাকুন, স্যার। বিশ্রাম নিন। কেউ আপনাকে ডিসটার্ব করবে না।
নির্মলবাবু একবার চোখ মেলে অসহায়ভাবে মেজমামার দিকে তাকালেন।
মেজমামা বললেন, এখন একটু ভালো ফিল করছিস তো নির্মল? কষ্ট হচ্ছে না তো? তোকে আমি সিঙ্গাপুর নিয়ে যাবই
নির্মলবাবু প্রায় ফিসফিস করে, হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, চায়ের আশায় বসে থাকিস না, পিন্টু, আজ বোধ হয় দেবেই না। আর চাকরি, সব শেষ! ওরে, আমাদের জেনারেশনেই লোকে লাস্ট চাকরি পেয়েছে, আর কোনো চাকরি নেই, আর হবেও না, এই জেনারেশনে কেউ চাকরি পাবে না…আর হবে না…কেউ পাবে না…কেউ পাবে না…কেউ পাবে না…
মেজমামা বললেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে, তোকে এখন ও নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না। আমি পরে আসব।
একজন আর্দালি আমার পিঠে হাত দিয়ে এর মধ্যে ঠেলতে শুরু করেছে, মেজমামাও বেরিয়ে এলেন চেম্বার থেকে। নিঃশব্দে হাঁটতে লাগলেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। কেমন যেন গুম মেরে গেছেন।
জিপে ওঠার পর খানিকটা আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়ে বললেন, নিমকহারাম! এক কাপ চা পর্যন্ত দিল না।
তারপর আমার পিঠে এক চাপড় মেরে বললেন, চীয়ার আপ! কুছ পরোয়া নেই। আর এক জায়গায় যাব! এই নির্মলটা আগে কত স্মার্ট আর ফুর্তিবাজ ছিল এখন এত দুর্বল হয়ে গেছে কেন জানিস? ডিম খায় না! ঐ যে একসময় আমাকে বলল, কোলেস্টেরলের ভয়ে ডিম খায় না, শুনিসনি? এ দেশে আমি যতগুলো অফিসার টাইপের লোকজনদের মীট করেছি, কেউ ঐ ভয়ে ডিম খায় না। আরে রোজ অন্তত দুটো করে ডিম না খেলে কোনো জাত উন্নতি করতে পারে? ডিম খায় না, তাই খাটতে পারে না। খাটে না, তাই কোলেস্টেরল হয়! হুঁ, যত্ত সব!
আমি জিজ্ঞেস করলুম, মেজমামা উনি সত্যিই বেঁটে হয়ে যাচ্ছেন?
মেজমামা বললেন, নিজের চোখেই দেখলুম। অবিশ্বাস করি কী করে?
ড্রাইভারকে পার্ক সার্কাসের দিকে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে আবার আমাকে মেজমামা বললেন, এবার কার কাছে যাব জানিস? রথীন তালুকদার। ফেমাস লোক। তুই রথীনের নাম শুনিসনি?
রথীন তালুকদার নামটা আমার চেনা চেনা মনে হলো। খবরের কাগজে দেখেছি বোধ হয়। কিন্তু কিসে তিনি বিখ্যাত, তা মনে পড়ছে না। আমি খবরের কাগজের প্রথম পৃষ্ঠাটা পারতপক্ষে পড়ি না। রোজই তো প্রথম পাতায় শুধু খুনো—খুনি আর গালাগালি ছাড়া আর কিছু থাকে না। শেষ পাতার খেলার খবরটা আমার বরাবর ভালো লাগত, কিন্তু এখন সেখানেও দেখি প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী, মেজো মন্ত্রী, সেজো মন্ত্রীর মতন সবাই সবাইকে চোর বলতে শুরু করেছে। আজকাল দেখছি, চোর-চোর খেলাটাই সব চেয়ে জনপ্ৰিয় খেলা!
রথীন তালুকদারের নামটা খবরের কাগজে প্রথম পাতায় দেখেছি, না শেষ পাতায়, তা অবশ্য মনে পড়ছে না।
মেজমামা বললেন, রথীন আমাদের আমলেই নাম-করা ছাত্রনেতা ছিল। এখন বেশ বড় দরের পলিটিক্যাল লিডার। ওরা এখন রুলিং পার্টি। রথীন ইচ্ছে করলেই মন্ত্রী-টন্ত্রী হতে পারত, কিন্তু পার্টি সংগঠনের কাজ নিয়ে আছে। কতখানি স্বার্থত্যাগ করেছে, বল? ছোটবেলা থেকেই রথীন খুব আইডিয়ালিস্ট। এক সময় আমি রথীনের দু-চারটে উপকার করেছি, ও নিশ্চয়ই মনে রেখেছে।
আমার পিঠে আর একটা চাপড় মেরে আরও খানিকটা উৎসাহের সঙ্গে মেজমামা বললেন, আজকাল বুরোক্রাটদের তুলনায় পলিটিশিয়ানদের ক্ষমতা অনেক বেশি। ওরা ফোন তুলে একটা কথা বললেই বুরোক্রাটরা হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে বলে, হ্যাঁ স্যার, হ্যাঁ স্যার। রথীন এইরকমভাবে একটা তুড়ি দেবে, আর সঙ্গে সঙ্গে তোর চাকরি হয়ে যাবে।
মেজমামা নিজেই চটাং চটাং করে তুড়ি দিতে লাগলেন।