1 of 2

অর্ধবৃত্ত – ৯

জাফরের বাড়ি ফিরতে রাত হয়েছে। লম্বা এক মিটিংয়ে আটকে গিয়েছিল সে। কারো ফোনও ধরতে পারছিল না। মিটিং শেষ হতে হতে দেখে ফোন ভর্তি মিসড কল। বাসার প্রায় সবাই তাকে ফোন করেছে। খানিক চিন্তিত বোধ করলেও অস্থির হলো না জাফর। সে ধীর স্থির শান্ত মানুষ। হাত মুখ ধুয়ে এসে ফোন করল বাবাকে। আফজাল আহমেদ ঝাঁজালো গলায় বললেন, ‘এতক্ষণ কই ছিলি তুই? কখনো কী কান্ডজ্ঞান হবে না তোর?’

‘কী হয়েছে বলো?’ জাফর শান্ত নিরুদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল।

‘কী হয়েছে বলো মানে কী? এতক্ষণেতো ভূমিকম্প হয়ে ঢাকা শহর ধ্বংস হয়ে যেতে পারত। পারত না?’

‘হু, পারত।’

‘তাহলে?’

‘তাহলে কী? আমিতো আর ভূমিকম্প নিরোধক কোনো যন্ত্র না বাবা, যে সুইচ টিপে ভূমিকম্প বন্ধ করে দেব।’

আফজাল আহমেদ ছেলের কথায় হতভম্ব হয়ে গেলেন। তিনি থতমত গলায় বললেন, ‘বউমাকে থানায় নিয়ে গেছে পুলিশ।’

‘কোন বউমা?’ কথা বলতে বলতেই গাড়িতে উঠল জাফর।

‘মেজো বউমাকে।

মুনিয়াকে কেন পুলিশ থানায় নিয়ে যাবে? কী করেছে সে?

‘আমাদের বাসার উল্টোদিকের ফুটপাতে একটা লাশ পাওয়া গেছে।’

‘তার সাথে মুনিয়ার কী সম্পর্ক?’

‘তাতো জানি না। সন্ধ্যার পর থেকে তাকে অনেকবার ফোন করা হয়েছে। একবার ধরে বলল, বাবা পুলিশের সাথে কথা বলছি। পরে ফোন দিচ্ছি। কিন্তু তারপর থেকে আর ফোন ধরে নি।’

জাফর গম্ভীর হয়ে গেল। মুনিয়ার সাথে তার সম্পর্কটা নিস্তরঙ্গ পুকুরের মতো। স্তব্ধ, স্থির, গতিহীন। যেন একটা জায়গায় আটকে আছে অনন্তকাল। যেন কারো কোথাও যাওয়ার তাড়া নেই। কেবল এই থাকাটুকুই সত্যি, আছে থাকুক না! বাদবাকি সব অর্থহীন। পুকুরটা তাই রোজ একটু একটু করে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। চারধারের মাটি ধুয়ে এসে জমছে, লতা, পাতা, ঘাস, গুল্মে ভরে যাচ্ছে ক্রমশই। কিন্তু তাতেও কারো যেন কিচ্ছু আসে যায় না। যেন কেউ কিছু দেখছে না, শুনছে না। যেন সবকিছু চলছে একদম ঠিকঠাক।

সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই বাড়ি ফিরল জাফর। বারকয়েক মুনিয়াকে ফোন দেয়ার কথা ভাবলেও কেন যেন ফোন আর দেয়া হয়ে উঠল না। তাদের দু জনেরই আলাদা এক ব্যক্তিগত জীবন গড়ে উঠেছে। যেখানে তারা কেউ কাউকে ঘাটায় না। এ যেন এক অঘোষিত, অলিখিত চুক্তি। পারস্পরিক সীমারেখার বোঝাপড়া।

জাফর বাড়ি ফেরারও ঘণ্টাখানেক পরে ফিরল মুনিয়া। মুনিয়াকে দেখে ক্লান্ত এবং গম্ভীর লাগলেও তার মনের অবস্থা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। বাড়ির সবাই হুড়মুড় করে ছুটে এলো। মুনিয়া পুরোপুরি না হলেও যতটা সম্ভব স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই জানাল যিনি মারা গেছেন তিনি স্কুলের পরিচালনা পরিষদের সদস্য হওয়ায় স্কুলের গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সবাইকেই ডেকেছিল পুলিশ।

রাতে ঘুমানোর আগে অবশ্য জাফর জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছিল বলোতো?’

মুনিয়া আয়নার সামনে চুল আঁচড়াচ্ছিল। সে অভ্যস্ত ভঙ্গিতে বলল, ‘তেমন কিছুই না।’

‘কিন্তু তোমাকে থানায় কেন ডাকল পুলিশ?’

থানায়তো ডাকেনি!

‘তাহলে?’

স্কুলে ডেকেছিল।’

‘পুলিশ স্কুলে ডেকেছিল?’

‘হুম।

‘কেন?’

‘যিনি মারা গেছেন, উনি আমাদের স্কুলের গভর্নিং বডির মেম্বার।’

‘কী বলো!’

‘হুম।’

‘এখন?’

‘বুঝতেই পারছো বিষয়টি স্কুলের জন্য খুবই সিরিয়াস ইস্যু। আর আমি এখন প্রধান শিক্ষক। ফলে আমাকেতো যেতেই হতো। ওখানে অন্যান্য শিক্ষক আর স্কুলের পরিচালনা পরিষদের বাকি সদস্যরাও সবাই ছিল।’

‘ওহ।’ একটু থেমে জাফর বলল, ‘বাবা অবশ্য ভেবেছিলেন, তোমাকে থানায় ডেকেছে পুলিশ।’

মুনিয়া জবাব দিল না। সে দুহাত উঁচু করে চুল বাঁধতে বাঁধতে বিছানার কাছে এলো। তার পরনে হালকা গোলাপি রঙের গাউন। চোখের নিচে কাজল নেই। ফ্যাকাসে, ধূসর চোখ। তারপরও বহুকাল পর মুনিয়াকে দেখে এত মুগ্ধ হলো জাফর! কত বয়স হয়েছে মুনিয়ার? চল্লিশতো পেরিয়েছেই। কিন্তু সৌন্দর্য কিংবা আকর্ষণ কি কিছু কমেছে তাতে? নাকি বেড়েছে? প্রতিটি বয়সেরই আলাদা একটা সৌন্দর্য আছে। এই বয়সেরও। কোথায় যেন জাফর পড়েছিল, প্রদীপ নিভে যাওয়ার আগে শেষবারের মতো দপ করে জ্বলে ওঠে। মুনিয়ারও কি তাই?

মুনিয়া বিছানায় উঠতে উঠতে বলল, ‘তবে সামনে যে থানায় ডাকবে না, তা

কিন্তু নয়।’

‘কেন?’

‘অনেক ঝামেলা আছে ভেতরে ভেতরে।’

‘কী ঝামেলা?’

‘সবকিছুতে পলিটিকস ঢুকে গেলে যা হয় আর কী!’

‘এখানে আবার পলিটিকসের কী আছে?’

মুনিয়া হাসল, ‘স্কুলের চাকরিটাতে শেষ কবছরে কতকিছু যে শিখলাম!’

‘কী কী শিখলে?’ জাফর হাই তুলতে তুলতে বলল।

‘এই ধরো স্কুলে স্টুডেন্ট ভর্তি, ডোনেশন, কনস্ট্রাকশন, বাজেট এলোকেশন, প্রোফিট শেয়ারিং, বিভিন্ন পদসহ অসংখ্য বিষয় আছে। এগুলোর কর্তৃত্ব নিয়ে গভর্নিং বডির মধ্যেই অনেকগুলো গ্রুপ। আর তারা প্রায় সবাইই পলিটিক্যালি পাওয়ারফুল।’

‘বাচ্চাদের একটা স্কুল নিয়ে এত কিছু?’ জাফরের গলায় ঘুম ঘুম ভাব।

‘শুধু বাচ্চাদের স্কুলই নয়। এটার কিন্তু একটা কলেজ শাখাও আছে। তাছাড়া ঢাকার সবচেয়ে নামকরা স্কুলের একটি এটি। প্রচুর টাকার ব্যাপার আছে এখানে। আর যেখানে এত টাকা, সেখানে স্বাভাবিকভাবেই…।’

জাফরের মৃদু নাক ডাকার শব্দ শোনা যাচ্ছে। মুনিয়া একবার ফিরে তাকাল। তারপর বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ল। জানালার বাইরে হলুদ আলোর নির্জিব এক শহর। একা, নিঃসঙ্গ। দিনভর এই যে অসংখ্য মানুষের পদভার, এই যে তুমুল কোলাহল, এই কোলাহলের ভেতরেও কী কোথাও কেউ এই নিঃশব্দ, একাকী রাতের নিঃসঙ্গতাকে পড়তে পারে?

মুনিয়ার ধারণা সে পারে। সে জানে বুকের ভেতর সঙ্গোপনে কত কী লুকিয়ে রাখতে হয়। এই যে রফিকুল আলমের বিষয়টিকে সে সবার সামনে অতি তুচ্ছ ঘটনা হিসেবে প্রকাশ করল, কিন্তু আসল ঘটনা কি তাই?

আজ স্কুলে যতটুকু সময় মুনিয়া ছিল, সে দেখেছে, প্রতিটি মানুষ এক অজানা আতঙ্কে চুপসে আছে। মুনিয়ারও ভয় হচ্ছে। তীব্র ভয়। অবশ্য ভয় পাবার অনেক কারণই তার রয়েছে। কিন্তু সে সেই ভয়টাকে প্রকাশ করতে চায় না।

রাফির সাথে সন্ধ্যার দিকে কিছুক্ষণের জন্য দেখা হয়েছিল তার। সারাদিন ফোন অফ করে ঘুমিয়েছিল সে। এমন অবশ্য প্রায়ই করে রাফি। ফোন অফ করে হঠাৎ হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনাও রাফির আছে। কিন্তু আজ যে তীব্র আতঙ্ক নিয়ে রাফির জন্য অপেক্ষা করছিল মুনিয়া, তেমন এর আগে কখনো হয়নি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *