৮
ফোনটা এলো দুপুর দুটোয়। মুনিয়া তখন স্কুলে রাজ্যের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। ফোন করেছে তার ননদ সেলিনা। সেলিনা সাধারণত তার সাথে কথা বলে না। এই ভর দুপুরে সেলিনার ফোন দেখে মুনিয়া খুবই অবাক হলো। সে ভ্রু কুঁচকে ফোনটা ধরলো, ‘হ্যালো।’
‘ব্যস্ত তুমি?’ মুনিয়া স্বাভাবিক গলায় বলল।
‘না, ঠিক আছে। বলো।’
‘একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে ভাবি।’
‘দুর্ঘটনা?’
‘হুম। আমাদের বাসার সামনে রাস্তার উল্টো পাশে একটা লাশ পাওয়া গেছে।‘
‘কী!’ মুনিয়ার মেরুদণ্ড বরাবর একটা তীক্ষ্ণ শীতল স্রোত নেমে গেল, ‘লাশ!’
‘হ্যাঁ।’
‘কী বলছো তুমি?’
‘হ্যাঁ। দিনের আলো ফুটলেও পথচারীরা কেউ বুঝতে পারেনি। সবাই ভেবেছিল ওভাবেই কেউ ঘুমিয়ে আছে বোধহয়। লাশ আবিষ্কার হয়েছে ঘণ্টা কিছুক্ষণ হয়। তারপর পুলিশ এসেছে। হুলুস্থুল অবস্থা।’
মুনিয়া কোনো কথা বলছে না। আচ্ছা, সেলিনা এই খবর দিতে তাকে কেন ফোন করল? সে পারতপক্ষে মুনিয়ার সাথে কথা বলে না। বাড়িতে এত লোক থাকতে সে-ই কেন ফোন করল? বিষয়টা ভালো ঠেকল না মুনিয়ার। সে বলল, ‘বাড়ির অন্য সবাই জানে?’
‘নাহ। বাবা মাতো ঘর থেকেই বের হয়নি। আর অন্য কেউ তো এই সময়ে বাসায় নেই। সেই ভোরে বেরিয়ে গেছে সবাই।
‘তাদের জানিয়েছো?’
‘নাহ। শুধু তোমাকেই জানালাম।’
‘আমাকেই?’ একটু থেমে কী যেন ভাবল মুনিয়া। তারপর বলল, ‘আর কাউকে জানাওনি কেন?’
মনে হলো সবার আগে তোমাকেই জানানো উচিত।’
‘কেন?’ মুনিয়ার কণ্ঠ খানিক কঠিন হলো।
এবার আর সাথে সাথেই জবাব দিল না সেলিনা। চুপ করে রইল। বিষয়টাতে খুবই অস্বস্তি লাগতে লাগল মুনিয়ার। তার এখন রাফির জন্য ভয় হচ্ছে। একটা অনিশ্চিত আশঙ্কায় বুক কাঁপছে তার। সে আবারো বলল, ‘কী হলো? কথা বলছো না কেন?’
‘তুমি কাল অনেক রাত পর্যন্ত বারান্দায় ছিলে। এইজন্য ভাবলাম সবার আগে তোমাকেই জানাই। তুমি হয়তো কিছু দেখে বা জেনে থাকতে পারবে!’
এই কথায় মুনিয়া দমে গেল। সে যে অনেক রাত পর্যন্ত বারান্দায় ছিল এ কথা সেলিনা জানল কী করে! আর কী কী জানে সেলিনা? রাফির কথাও জানে? মুনিয়া যতটা সম্ভব নিজেকে সামলে নিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘তুমি জানলে কী করে আমি রাতে বারান্দায় ছিলাম?’
সেলিনা সামান্য হাসল, ‘আমারও রাতে ঘুম হয় না ভাবি।’
‘তো?’ একটু রুষ্ট গলায়ই প্রশ্নটা করল মুনিয়া।
‘আমিও মাঝে মাঝে সারারাত বারান্দায় বসে থাকি। আমার মাথার ঠিক ছুঁইছুঁই ওপরেই তোমার বারান্দা। পুরনো বাড়ি। মাঝরাতে কেউ হাঁটলেও শব্দ টের পাওয়া যায়।
‘তা হলেতো তোমারও কিছু দেখার কথা ছিল?’
‘আমি সারারাত জাগিনি ভাবি। চারটার দিকে খানিক্ষণ জেগেছিলাম। তখন বুঝলাম তুমি বারান্দায় বসে আছো।’
মুনিয়া আর কথা বাড়াল না। তার রাফির জন্য ভয়ংকর দুশ্চিন্তা হচ্ছে। সেলিনার ফোন রেখে সে রাফিকে ফোন করল। রাফির ফোন বন্ধ। ভোরেও বন্ধ ছিল। এবার ভয় লাগতে লাগল মুনিয়ার। সে একটানা চেষ্টা করে যেতে থাকল, কিন্তু লাভ হলো না। বিশাল রিভলভিং চেয়ারটাতে শরীর এলিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ পড়ে রইলো সে। তার হাতে অনেক কাজ, কিন্তু কিছুতেই মন বসাতে পারছে না সে। বছর দুই হলো স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পেয়েছে মুনিয়া। এর আগে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবেও প্রায় মাস ছয়েক দায়িত্ব পালন করেছিল। এই দায়িত্ব তাকে অনেক কিছুই শিখিয়েছে। সবচেয়ে বেশি যেটি শিখিয়েছে সেটি হলো কৌশল। স্কুলের মতো এমন ক্ষুদ্র পরিসরেও যে বৃহত্তর রাজনীতি এতটা সক্রিয়, তা সে নিজের অভিজ্ঞতা না হলে বিশ্বাসই করত না। এলাকার ছিঁচকে নেতা থেকে শুরু করে এমপি-মন্ত্রীরা অবধি এর সাথে যুক্ত। এমনকি স্কুলের ভেতরে শিক্ষকদের মধ্যেও চলে ভয়াবহ কূটকৌশলের খেলা। তবে আজকাল এসবে অভ্যস্ত হয়ে গেছে মুনিয়া। যত বড় ঝামেলাই হোক না কেন সে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে জানে। ভয়াবহ বিপদেও বিচলিত হয় না। কিন্তু আজ এই মুহূর্তে কোনোকিছুতেই সে নিজেকে শান্ত রাখতে পারছে না।
অস্থির ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ বসে থেকে অবশেষে রথিকে ডেকে পাঠালো মুনিয়া। রথি রাফির বোন। ঋদ্ধি আর সে একই ক্লাসে পড়ে। তারা পরস্পরের বন্ধুও। মুনিয়াকে সালাম দিয়ে রথি বলল, ‘আমাকে ডেকেছিলেন ম্যা’ম?’
মুনিয়া হাসার চেষ্টা করল, ‘হ্যাঁ। কী খবর তোমার?’
‘এইতো ম্যা’ম ভালো।’
‘বাসার সবাই ভালো?’
‘জি।’
‘পড়াশোনা কেমন চলছে?’
‘জি ভালো।’
‘মিডটার্মে রেজাল্ট কেমন হলো?’
‘মোটামুটি।’
‘মোটামুটি কেন?’
এই প্রশ্নে রথি জবাব দিল না। চুপ করে রইলো। মুনিয়া বলল, ‘তোমার ভাইয়াকে তো বলতে পারো তোমাকে নিয়ে একটু বসতে। সেতো বাইরেও টিউশন করায়। করায় না?’
‘জি ম্যা’ম।’
‘তাহলে? বাসায় তোমাকে একটু সময় দিলেওতো পারে।’
‘ভাইয়াতো বাসায়ই থাকে না।’
‘বাসায় না থাকলে কোথায় থাকে?’
‘এই ফ্রেন্ডদের বাসায়। না হলে ইউনিভার্সিটিতে।’
এতক্ষণে যেন আসল প্রশ্নটা করার সুযোগ পেল মুনিয়া, ‘এখন কোথায়?’
‘তাতো জানি না ম্যা’ম।’
‘কেন? সকালে বাসায় দেখে আসো নি?
‘উহু। কাল রাতেতো ভাইয়া বাসায় ফেরেনি।’
মুনিয়ার বুকটা ধক করে উঠল। মাথাটা ঝিমঝিম করছে তার। সে বলল, ‘আচ্ছা, যাও। আর পড়াশোনাটা ঠিকঠাক করো।’
রথি কিছুই বুঝল না। ম্যা’ম তাকে হঠাৎ এভাবে আলাদা ডেকে খোঁজ খবর নিলেন কেন? এমনিতে তার রেজাল্টের যে খুব বেশি হেরফের হয়েছে, তা কিন্তু নয়। সে মাঝারি মানের ছাত্রী। সব ক্লাসেই তার রেজাল্ট এমন। আচ্ছা, সে কি কোনো অন্যায় করেছে? এই স্কুলের নিয়ম-কানুন খুবই কড়া। পান থেকে চুন খসলেই বাসায় খবর চলে যায়। অভিভাবক ডেকে আনা হয়। রথি চিন্তিত মনেই ক্লাসে ফিরে গেল। স্কুল শেষে ঋদ্ধিকে জিজ্ঞেস করতে হবে ঘটনা। ম্যা’ম কেন এভাবে তাকে ডেকে নিল। কিন্তু স্কুল শেষে সেই সুযোগ পেল না রথি। এক ক্লাস আগেই ঋদ্ধিকে নিয়ে বাসায় চলে গেছে মুনিয়া।
.
মুনিয়ার অস্থিরতা আরো বাড়ল বিকেলের দিকে রথির ফোনে। রথি স্কুল থেকে ফিরেই তার মায়ের ফোন থেকে মুনিয়াকে ফোন করেছে, ‘ম্যাম, আসসালামু আলাইকুম।’
মুনিয়া কোনোমতে সালামের জবাব দিয়ে রুদ্ধশ্বাস কণ্ঠে বলল, ‘বলো?’
রথি বলল, ‘ঋদ্ধি আছে ম্যাম? ওকে কি একটু দেয়া যাবে?’
‘ওতো ঘুমাচ্ছে। কেন? কিছু হয়েছে?’
‘নাহ। কী হবে?’ রথি স্বাভাবিক গলায়ই বলল। ‘আচ্ছা, ও ঘুম থেকে উঠলে আমাকে একটু ফোন দিতে বলবেন প্লিজ।’
‘আচ্ছা। তোমার ভাইয়া ফিরেছে বাসায়?’ অনেক ভেবেও প্রশ্নটা করা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারল না মুনিয়া। সে জানে, বিষয়টি দৃষ্টিকটু হয়ে যাচ্ছে। রাফির বিষয়ে এত খোঁজ খবর নেয়ার কোনো যৌক্তিক কারণ থাকতে পারে না তার। রথি বলল, ‘না এখনো ফেরেনি।’
আরো কিছু জিজ্ঞেস করবে ভেবেও শেষে আবার নিজেকে সংযত করল মুনিয়া। সে সম্ভবত শুধু শুধুই ভয় পাচ্ছে।
তবে বিকেলের দিকে আকবর আলীর ফোন পেয়ে অবাক হলো মুনিয়া। আকবর আলী গম্ভীর গলায় বললেন, ‘ঘটনা নিশ্চয়ই শুনেছেন?’
মুনিয়া যতটা সম্ভব ভাবলেশহীন থাকার চেষ্টা করল, ‘কী ঘটনা?’
‘রফিকুল সাহেব খুন হয়েছেন!’
‘রফিকুল সাহেব! কোন রফিকুল সাহেব?’ মুনিয়ার সারা শরীর বেয়ে যেন ভয়ের তীব্র স্রোত নেমে গেল।
আকবর আলী শান্ত গলায় বললেন, ‘আমাদের গভর্নিং বডির সদস্য রফিকুল আলম।’
‘কী বলছেন!’ যেন জায়গায় জমে গেছে মুনিয়া।
আকবর আলী বললেন, ‘হ্যাঁ। শেষ পর্যন্ত আমার আশঙ্কাটাই সত্যি হলো।’
মুনিয়া কী বলবে বুঝতে পারছে না।
আকবর আলী বললেন, ‘আর অদ্ভুত বিষয়টা হলো, লাশটা পাওয়া গেছে আপনার বাসার কাছাকাছি। আপনি দয়া করে একটু স্কুলে আসবেন?’
‘এখন!’
‘হুম। পুলিশের সহকারী কমিশনার সাহেব স্কুলে এসেছেন। উনি একটু সবার সাথে কথা বলতে চান। আমরা সবাই এর মধ্যে চলেও এসেছি।’
মুনিয়া আর কথা বাড়ালো না। বাইরে বিকেলের নিস্তেজ সূর্য। ব্যস্ত রাস্তা। মানুষের কোলাহল। গতরাতে যেই জায়গায় রাফি দাঁড়িয়েছিল, ঠিক তার খানিকটা দূরেই লাশটা পড়েছিল। এখন সেই জায়গাটাই ঘরমুখী সারি সারি মানুষের ত্রস্ত পদক্ষেপে মুখরিত। সে মুখে সামান্য পানি ছিটিয়ে ঘর থেকে বের হলো।