৭
ফজলে নূর এসেছেন মুনিয়ার সাথে দেখা করতে। স্কুলে এই লোকটাকে মুনিয়া সবচেয়ে বেশি ভয় পায়। ফজলে নূরের মতো ঠাণ্ডা মাথার লোক সে খুব কম দেখেছে। সরকারি দলের রাজনীতি না করেও কেবল বুদ্ধি আর কৌশলের কারণে সে এখনো তার চারপাশে বিপুল প্রভাব বিস্তার করে রেখেছে। আরেকজন হলেন সভাপতি আকবর আলী। ভেতরে ভেতরে এই দুজনের সম্পর্কে ভয়াবহ রেষারেষি থাকলেও বাইরে থেকে তা বোঝার উপায় নেই। যদিও আকবর আলী নিজে কখনো কিছু করেন না। তিনি তার সকল উদ্দেশ্য সাধনে ব্যবহার করেন রফিকুল আলমকে। রফিকুল আলম নানা কারণে মানসিকভাবে হতাশ, বিধ্বস্ত একজন মানুষ। ফলে আকবর আলী সামনে না এলেও যেকোনো ঝামেলায় তিনি রফিকুল আলমকে দিয়ে তার স্বার্থ হাসিল করে নেন। এ জন্য কোথাও কোনোকিছুতেই তাকে সামনে দেখা যায় না। কিন্তু মুনিয়া জানে, পেছন থেকে আসল কলকাঠি নাড়ছেন আকবর আলীই। তবে এসব জেনেও যতটা সম্ভব চুপচাপ থাকারই চেষ্টা করে সে। স্কুলের এই বহুমুখী রাজনীতির চাপে পড়ে গত কয়েক বছরে অনেক কিছুই শিখেছে মুনিয়া! আজ সকালেই খানিক আগে আকবর আলীও এসেছিলেন। নানা বিষয়ে তিনি পরামর্শ করে গেছেন। তবে যাওয়ার আগে হঠাৎ বললেন, ‘ফজলে নূরের উদ্দেশ্য কিন্তু ভালো না বুঝলেন?’
মুনিয়া মৃদু কণ্ঠে বলল, ‘আমি ঠিক বুঝতে পারছি না স্যার।’
আকবর আলী হাসলেন, ‘এত বড় স্কুল চালান, না বুঝলে হবে?’
মুনিয়াও হাসল, ‘আমি আর কী স্কুল চালাব স্যার! স্কুল চালানোর আসল মালিক আপনারা।’
‘তারপরও আপনার একটু চোখ-কান খোলা রাখা উচিত। এই লোক খুব বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। আমার সামনে বসে সে সেদিন রফিকুল আলমের সাথে কীভাবে কথা বলল, দেখলেন!’
মুনিয়া চুপ করে রইল। আকবর আলী বললেন, ‘রফিকুলকে একটু সাবধান করে দেয়াও দরকার বুঝলেন? আজকাল হঠাৎ হঠাৎ কারণে অকারণে তার মাথা গরম হয়ে যায়। বোকার মতো কখন কী করে বসে কে জানে! ‘
মুনিয়া এবারও কথা বলল না। আকবর আলী বললেন, ‘আপনার সাথে আমার খুব জরুরি কিছু কথা আছে। কথাগুলো এখন বলা যাবে না। পরে সময় করে একসময় বসতে হবে।’
‘জি স্যার।
‘আপনি একটু ফ্রি হন, তারপর একসময় বসব আপনার সাথে, ওকে?’
‘জি স্যার।’
.
আকবর আলী চলে যাওয়ার ঘণ্টাখানেক পরেই এলেন ফজলে নূর। প্রথম কিছুক্ষণ এ কথা সে কথার পর আচমকাই কথাটা বললেন তিনি, ‘রফিকুল আলমের বিষয়ে আমার কাছে কিছু তথ্য আছে।’
‘জি স্যার?’ মুনিয়া প্রশ্নবোধক চোখে তাকাল।
‘হুম। খুব সিরিয়াস কিছু অভিযোগ।’
মুনিয়া কথা না বললেও উৎসুক চোখে তাকিয়ে রইল। ফজলে নূর বললেন, ‘স্কুলের অনেক মহিলা টিচারের কাছ থেকেই সে আলাদা সুবিধা নেয়। ‘
‘জি স্যার!’ মুনিয়া যেন চমকালো।
‘হুম। বিষয়টার একটা সুরাহা হওয়া দরকার। আর এই বিষয়ে আমি আপনার সহযোগিতা চাই।’
‘আমার!’ মুনিয়া এবার রীতিমতো অবাকই হলো।
‘হুম।’
‘আমি কী সহযোগিতা করব স্যার?’ মুনিয়ার গলায় উদ্বিগ্নতা।
‘আপনি চাইলেই পারবেন। এটা এমন কোনো কঠিন কাজ না।’
মুনিয়া তাকিয়েই রইল। কথা বলল না। ফজলে নূর বললেন, ‘এ বিষয়ে আপনি আমাকে সামান্য একটু হেল্প করবেন। আমি চাই প্রধান শিক্ষক হিসেবে সবার সব অভিযোগ একত্র করে আপনি একটি লিখিত ফর্মাল অভিযোগপত্র পেশ করবেন গভর্নিং বডির কাছে।’
‘আমি?’ মুনিয়া রীতিমতো আঁতকে উঠল।
‘জি. আপনি।’
‘আমি এটা কীভাবে করব স্যার? আমার কাছেতো কেউ কখনো এমন কোনো অভিযোগ করেনি।’
ফজলে নূর হাসলেন, ‘না করলে এখন করবে।’
‘মানে?’
‘মানে কিছু না। শুনুন ম্যাডাম, অনেকেই কিন্তু এটাও মনে করে যে, আপনার এমন দুম করে প্রধান শিক্ষক হয়ে যাওয়ার পেছনেও…!’ কথা শেষ না করলেও ইঙ্গিতে যেন কিছু একটা বলতে চাইলেন ফজলে নূর। তার সেই ইঙ্গিতপূর্ণ চোখের দিকে তাকিয়ে ঘৃণায় মুনিয়ার সারা শরীর রিরি করে উঠল। সে বলল, ‘স্যার…
ফজলে নূর মুনিয়ার কথা শেষ করতে দিলেন না। তিনি সাবধানী কণ্ঠে বললেন, ‘আপনি আমাকে হেল্প করলে, আমিও আপনাকে হেল্প করব। ধরুন, যদি এমন হয় যে আপনাকে আমি কলেজ শাখার প্রিন্সিপ্যাল বানিয়ে দিলাম? তার বিনিময়েও এটুকু করতে পারবেন না? কলেজ শাখার বর্তমান প্রিন্সিপ্যালের মেয়াদ কিন্তু শেষের দিকে!’
মুনিয়া এবার পুরোপুরি দিশেহারা বোধ করতে লাগল। এ কী ভয়ানক পরিস্থিতির ভেতর পড়তে যাচ্ছে সে! সে মিনমিন করে বলল, ‘আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন স্যার। আমার পক্ষে কারো বিরুদ্ধেই এমন মিথ্যে অভিযোগ করা সম্ভব নয়। এমনকি তারা কেউ এসে যদি একইভাবে আপনার বিরুদ্ধেও এমন কোনো মিথ্যে অভিযোগ করতে বলে, আমি সেটাও করতে পারব না।’
মুনিয়ার কথার উত্তর দিতে গিয়েও ফজলে নূর থমকে গেলেন। দরজায় রফিকুল আলমকে দেখা যাচ্ছে। তাকে এলোমেলো, উদ্ভ্রান্ত লাগছে। সে সতর্ক পা ফেলে ঘরে ঢুকল। রফিকুল আলমকে দেখে ফজলে নূর প্রথমে চমকে গেলেও সাথে সাথেই নিজেকে সামলে নিলেন। স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই তিনি মুনিয়াকে বললেন, ‘আমি আজ উঠি। পরে আপনার সাথে কথা হবে।’ কথাটা বলেই ফজলে নূর উঠে দাঁড়ালেন। কিন্তু ঘটনাটা ঘটে গেল কেউ কিছু বোঝার আগেই। রফিকুল আলম ঝট করে ফজলে নূরের পাঞ্জাবির কলার চেপে ধরলেন। তারপর বিশ্রি গাল বকে বললেন, ‘তুই নাকি আমার বিরুদ্ধে কীসব এভিডেন্স জোগাড় করছিস? দেখা, কী এভিডেন্স তোর কাছে আছে, দেখা!’
ফজলে নূর অবশ্য উত্তেজিত হলেন না। তিনি শান্ত ভঙ্গিতে বললেন, ‘কলারটা ছাড়ুন রফিক সাহেব।’
রফিকুল আলম চিৎকার দিয়ে বললেন, ‘তুই যদি এইখানে বসে এখন কোনো এভিডেন্স না দেখাতে পারিস, আমি তোকে গলা টিপে মেরে ফেলব, হারামজাদা।’
মুনিয়া বুঝতে পারছিল যে রফিকুল আলম স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। তিনি অসংলগ্ন ভঙ্গিতে কথাবার্তা বলছেন। ফজলে নূর ধীরে রফিকুল আলমের হাতটা তার কলার থেকে সরিয়ে নিয়ে আবারও চেয়ারে বসলেন। তারপর বললেন, ‘আপনি শুধু শুধু নিজের বিপদ ডেকে আনছেন রফিক সাহেব।’
‘কে কার বিপদ ডেকে আনছে, সেটা আমি আজ তোকে বোঝাব।
আপনি মানুষটা বোকা। আপনি নিজেও বুঝতে পারছেন না, পেছন থেকে কে আপনাকে কীভাবে ব্যবহার করছে…।’
ফজলে নূর আরো কিছু বলতে চাইছিলেন। কিন্তু তার আগেই সপাটে তার গালে চড় বসালেন রফিকুল আলম। তারপর চিৎকার করে বললেন, ‘আমি বোকা, না? আমি বোকা? তোরা সবাই মিলে আমাকে বোকা বানাস? আমি তোদের সবগুলারে খুন করব। আই উইল কিল ইউ অল…।’ মুনিয়া হতভম্ব চোখে আবিষ্কার করল চেয়ার উল্টে মেঝেতে ছিটকে পড়েছেন ফজলে নূর। তিনি এক হাতে নিজের গাল চেপে ধরে রাজ্যের অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে আছেন। মুনিয়া হন্তদন্ত হয়ে তাকে মাটি থেকে তুলতে গেল। কিন্তু পারল না। তিনি ঝটকা মেরে মুনিয়ার হাত সরিয়ে দিলেন। তারপর ধীরে সুস্থে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর দীর্ঘসময় সাপের মতো ঠাণ্ডা চোখে রফিকুল আলমের দিকে তাকিয়ে রইলেন। রফিকুল আলম তখনো ফুঁসছেন। এক নাগাড়ে আবোল তাবোল কীসব বকে যাচ্ছেন তিনি। ফজলে নূর থক করে একদলা থুতু ফেললেন মেঝেতে। তারপর ঘুরে চুপচাপ ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
পরের কয়েকটা দিন এক ভয়াবহ দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে স্কুলে গেল মুনিয়া। সেদিনের ঘটনার পর আর কেউ তার সাথে দেখা করতে আসেনি। কারো সাথে কথাও হয়নি তার। তবে প্রবল ঝড়ের আগে পরিবেশ যে আচমকা থমথমে, শান্ত হয়ে যায় তা স্পষ্টই বুঝতে পারছিল সে। এ কয়দিন রাফির সাথেও ঠিকঠাক কথা হয়নি তার। দিন কয়েক বাদে এক গভীর রাতে রাফি আবার এসে দাঁড়ালো তাদের বাড়ির উল্টো পাশের সেই ফুটপাতে। খানিক আগে বৃষ্টি হয়েছে। রাফি ইদানীং রাতের বেলা একা একা শহরের ফাঁকা রাস্তায় সাইকেল চালায়। বৃষ্টি হয়েছে বলে তার গায়ে নীল রেইনকোট। রেইন কোটে তাকে সুন্দর লাগছে। তবে হাতঢাকা গ্লাভস আর মাথার হেলমেটে কেমন অন্যরকম লাগছে তাকে। মুনিয়া ফোন হাতে চুপচাপ গিয়ে দাঁড়াল বারান্দায়। হাতে সিগারেট। রাফি ফিসফিস করে বলল ‘বারান্দায় তোমার মাথার ওপর যে আলোটা আছে, ওটা একটু জ্বালাবে?’
মুনিয়া বলল,
‘কেন?’
‘কতদিন তোমাকে দেখি না। আজ না হয় একটু দেখলাম!’
‘এখন দেখা যাবে না।’
‘কেন?’
‘কেন আবার? এতরাতে কেউ দেখে ফেলবে!’
‘কেউ দেখবে না, এখন সবাই ঘুমাচ্ছে। এখন এই রাত তোমার আমার।’ রাফি তরল গলায় বলল।
মুনিয়া কেমন কিশোরীদের মতো করে বলল, ‘ইশ, ঢং!’
রাফি দুষ্টুমির স্বরে বলল, ‘তা ছাড়া এতোরাতে নিশ্চয়ই নাইটি পরে আছো তুমি!’
মুনিয়া কপট রাগের ভান করে বলল, ‘বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু।’ কথাটা বললেও নিজের ভেতরে কেমন একটা অদ্ভুত শিহরণ টের পেল সে। রাফি হাসল, ‘বেশি বেশি আর কই হলো! তুমি ওই কত দূরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে, আর আমি এই এখানে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আছি। বেশি কিছুতো আর চাইলেই করা যাবে না।’
‘মাইর!’ মুনিয়ার কণ্ঠে চাপা উচ্ছ্বাস। রাফি বলল, ‘আমার কিন্তু খুব ইচ্ছে করছে দেয়াল ডিঙিয়ে তোমার কাছে চলে আসি।’
‘একদম না। খবরদার!’
মুনিয়া জানে রাফিকে বিশ্বাস নেই। তাই খানিক কঠিন হলো সে। রাফি বলল ‘মাঝে মাঝে আমার কি মনে হয় জানো?’
‘কী?’
‘মনের চেয়েও সম্পর্কে শরীরের ভূমিকা অনেক বেশি। শুধু মন না, বরং অনেক ক্ষেত্রে শরীরই মনকে নিয়ন্ত্রণ করে।’
‘শরীর?’
‘হুম।’
‘কীভাবে?’
‘মানে, ধরো আমি যদি বুড়িয়ে যাই, কিংবা তুমি, তাহলে কি আমাদের মধ্যে পরস্পরের জন্য এই এখন যেমন আছে, এই তীব্র আকর্ষণ বা রোমান্টিসিজমটা আর থাকবে?’
মুনিয়া চট করে উত্তর দিতে গিয়েও থমকে গেল। মাঝে মাঝে রাফিকে সে ঠিকঠাক বুঝতে পারে না। কিংবা কে জানে, রাফির প্রতি তার যে এই প্রবল ঘোর, এই ঘোরের কারণও হয়তো তার এই অনুনমেয় আচরণ। এই যে হুটহাট এমন অনভিপ্রেত কথা বলে ফেলতে পারে সে। যে কথাগুলো মেনেও নেয়া যায় না, আবার পুরোপুরি অস্বীকারও করা যায় না। মুনিয়া বলল, শরীর বুড়িয়ে গেলে ভালোবাসা থাকে না?’
‘থাকে। থাকবে না কেন? তবে সেই ভালোবাসাটা অন্যরকম।’
‘অন্যরকম কেমন?
রাফি একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘সেই ভালোবাসাটাতে দায়িত্ব থাকে, নির্ভরতা থাকে, দায়বদ্ধতা থাকে, অভ্যাস থাকে। কিন্তু উচ্ছ্বাস কিংবা রোমান্টিসিজমটা আর থাকে না।’
‘থাকে না?’
‘উহু। খেয়াল করে দোে। এই যে তোমার শ্বশুর-শাশুড়ির কথাই ভাবো,
তারা একজন আরেকজনকে ভালোবাসেন না?’
‘খুব বাসেন। সারাদিন ঝগড়া করলেও একজন আরেকজনকে ছাড়া থাকতে পারেন না।’
‘এর কারণ কি জানো?’
‘কী?’
‘ওই যে পরস্পরের প্রতি নির্ভরতা, দায়িত্ব, এতদিনকার অভ্যাস। এটা বার্ধক্যের চির অনিবার্য আচরণ বা প্রয়োজন। এখন এটাকে তুমি ভালোবাসা ও বলতে পারো। ভালোবাসার যেহেতু অনেক রকম থাকে, সেহেতু সেই অনেক রকমের মধ্যে এটাও একটা রকম বা ধরন। কিন্তু দেখো, এখানে আর সবকিছুই আছে, শুধু রোমান্টিসিজমটাই আর নেই। আছে?’
মুনিয়া চুপ করে রইলো। রাফির এই প্রশ্নের উত্তরটা চট করে দিতে গিয়েও মুনিয়ার হঠাৎই মনে হলো এই প্রশ্নের উত্তরটা সে যত সহজ ভেবেছিল তত সহজ নয়। বরং অনেক জটিল।
রাফি বলল, ‘এটা হচ্ছে রোমান্টিসিজম বিহীন ভালোবাসা। এই ভালোবাসায় ভালোবাসার প্রচণ্ডতা বা তীব্রতাটাই আর নেই।’
‘সব ভালোবাসায় কেন প্রচণ্ডতা থাকতে হবে? তীব্রতা থাকতে হবে? বয়স বেড়ে গেলে তখন নির্ভরতাটাই জরুরি। স্থিতিটাই জরুরি। তাই না?’
‘একদম। সেটা নিয়ে আমার সমস্যা নেই। আমার সমস্যা হচ্ছে, মানুষ ভালোবাসায় শরীরের ভূমিকাকে সবসময় আড়াল করতে চায়। সবসময় ভালোবাসার একটা শরীরবিহীন ডিভাইন রূপ দিতে চায়। ধরি মাছ, না ছুঁই পানি আর কী! হা হা হা।’ রাফি শব্দ করে হাসল। ‘যেন ভালোবাসায় শরীরের ভূমিকাটাকে প্রবল দেখালে সেটা কদাকার বা ঠুনকো হয়ে যাবে! তখন যেন আর সেটা ডিভাইন থাকবে না। কিন্তু বিষয়টা হচ্ছে, শরীর ইজ ভেরি সিগনিফিকেন্ট ইন লাভ। প্রোবাবলি মোস্ট সিগনিফিকেন্ট। তুমি যে বয়স বেড়ে যাওয়ার কথা বলছো, সেটাকে অন্য অ্যাঙ্গেল থেকেও দেখা যায়।’
‘অন্য কী অ্যাঙ্গেল?’ মুনিয়া কপাল কুঁচকে তাকাল।
‘বয়স বেড়ে যাওয়া মানেই কিন্তু শরীর বুড়িয়ে যাওয়া বা পুরনো হয়ে যাওয়া। আর শরীর বুড়িয়ে যাওয়া মানেই শারীরিক আকর্ষণ কমে যাওয়া। আর শারীরিক আকর্ষণ কমে যাওয়া মানেই রোমান্টিসিজম ফুরিয়ে যাওয়া। ভালোবাসার প্রচণ্ডতা, পাগলামি, উচ্ছ্বাসটা কমে যাওয়া, তাই না?’
‘কী জানি! আমার তা মনে হয় না।’
রাফি হাসল, ‘মনে না হলেও ঘটনা এটাই। কিন্তু এটা আমরা স্বীকার করতে চাই না। এটাকে অশালীন মনে হয় বলে এই ভাবনার প্রকাশটা আড়াল করে রাখি। অথচ এটাই সত্যি বা বাস্তব। সময় মূলত ফুরিয়ে দেয় শরীর। শরীর ফুরালে শরীরের প্রতি মনের আগ্রহও ফুরায়। কিন্তু মন ফুরালে শরীর নাও ফুরাতে পারে। তাই না?’
মুনিয়া জবাব দিল না। তার মনে হলো, রাফির সাথে সে একমত নয়। তারও কিছু যুক্তি আছে। কিন্তু সেই যুক্তিগুলো সে ঠিক এই মুহূর্তে গুছিয়ে আনতে পারছে না। কিছু একটা নিয়ে তার অস্বস্তি হচ্ছে। হয়তো এ জন্যই যুতসই কোনো উত্তরও দিতে পারছে না সে।
রাফি বলল, ‘এ কারণেই শরীর পুরনো হয়ে গেলে সবার আগে রোমান্টিসিজম মরে যায়। অথচ রোমান্টিসিজমটাই কিন্তু ভালোবাসার প্রাণ। আর প্রাণ না থাকলে যা হয় আরকি, অনেকটা শিকড় কাটা লতার মতো। আছে, কিন্তু সেই থাকাটা আর আলাদা করে আগের মতো স্পষ্ট, উজ্জ্বল হয়ে চোখে পড়ে না। সেটা নিস্তেজ, নিস্প্রভ, প্রাণহীন।’
‘তাহলে?’
‘তাহলে কী?’
‘এই যে আমি, এই আমিতো বুড়িয়ে যাচ্ছি!’ খানিকটা তির্যকভঙ্গিতেই কথাটা বলল মুনিয়া।
রাফি দুষ্টুমির স্বরে বলল, ‘তাহলে আর কী! যতদিন সময় আছে, অবহেলা করে সেই সময়টা নষ্ট করা যাবে না। ঠিকঠাক কাজে লাগাতে হবে, বুঝলে? হা হা হা।’
রাফি হাসলেও মুনিয়া কেন যেন হাসতে পারল না। শুধু রাফি বলেছে বলেই নয়, সে নিজেও এই বিষয়টা নিয়ে ভাবে, নারী হিসেবে আজকাল যেন সে আলাদা করেই টের পায় তার শরীর তার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। সেটি কেউ স্বীকার করুক আর না করুক। এই শরীর, এই বয়স, এই মসৃণ ত্বক, এই সময়, এসব নিয়ে ভেতরে ভেতরে সেও কি উৎকণ্ঠিত নয়! শুধু সে কেন, তার কলিগ, বান্ধবী কিংবা সমবয়সী আরো কতজনের মধ্যে এই বিষয়টি সে দেখেছে! সময় এবং বয়স যেন ক্রমশই একটা নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে ছুটে আসছে তাদের দিকে। আয়নায় যতবার সে মুখ দেখে, যতবার সে প্রসাধনীতে চোখের নিচের, গালের দাগ লুকাতে যায়, ততবারই তার মনে হয়, এই দাগটা কি আগে থেকেই ছিল? নাকি বয়স বেড়ে গেল বলে! সদা সন্ত্রস্ত হরিণের মতো প্রতিটি দিন যেন আয়নায় সতর্ক চোখ রেখে দাঁড়াতে যায় সে।
রাফি যে এমন কথা আজ প্রথম বলেছে, তাও নয়। বরং এমন কথা সে মাঝে মধ্যেই বলে, কিন্তু সেসব নিয়ে আগে খুব একটা ভাবত না মুনিয়া। সে জানে, রাফির কতটা জুড়ে সে আছে। রাফির এমন পাগলামি, এমন বাঁধনহীন ভাবনা, বেপরোয়া চলন এবং টুপটাপ সেসব মুখের ওপর বলে ফেলা এর সবই এক স্বচ্ছ জলের মতো অথচ গভীর সমুদ্রের অনুভবই তাকে দিয়েছে। যে সমুদ্র হঠাৎ শান্ত হয়ে যেমন বুকে জড়িয়ে নিতে পারে। আবার মুহূর্তেই প্রবল জলোচ্ছ্বাস হয়ে ভেঙে চুরমার করে ভাসিয়েও নিতে পারে। মুনিয়ার এটা ভালো লাগে। কিন্তু এই যে ভালো লাগে, সেটা সে রাফির সাথে তার পরিচয় কিংবা বোঝাপড়া তৈরির আগ অবধিও বুঝতে পারেনি। এই দীর্ঘ বিবাহিত জীবনেও না। কখনো টের পায়নি, তার বুকের ভেতর এমন ওলট-পালট করে দেয়া রোমান্টিসিজমের তেষ্টা, এমন উথাল-পাথাল ভাসিয়ে নেয়া ক্ষ্যাপাটে প্রেমের আকুতি লুকিয়ে ছিল!
নিচ থেকে একটা টুংটাং শব্দ ভেসে আসছে। মনে হচ্ছে কেউ গেটের কাছে শব্দ করছে। এতরাতে অবশ্য গেটের কাছে কারো আসার কথা না। এই বাড়ির গেটে দারোয়ান নেই। সবার কাছেই চাবি আছে। যে যার মতো বের হয়ে যায়। কিন্তু এতরাতে কী হচ্ছে গেটে?
মুনিয়ার হঠাৎ গেটের বাইরে ঝুলে থাকা সেই আঙটাটার কথা মনে হলো। নির্ঘাৎ আবারো কেউ ভুলে সেটা বাইরের দিকে ঝুলিয়ে রেখেছে। হয়তো মৃদু বাতাসে গেটের সাথে বাড়ি খেয়ে আবারো সেটা একটা নির্দিষ্ট ছন্দে টুংটাং শব্দ করছে। নির্জন রাতে সেই শব্দই খুব কানে বাজে। মুনিয়া একবার ভাবল নিচে গিয়ে আটাটা সরিয়ে দিয়ে আসবে। যাবে কী যাবে না করতে করতেই দীর্ঘ সময় চলে গেল। তারপর ধীর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেল সে।
ফিরল অনেকক্ষণ বাদে। এসে দেখে ঋদ্ধির ঘরে আলো জ্বলছে। এত রাতে জেগে জেগে কী করছে ঋদ্ধি! মুনিয়া বাথরুমে ঢুকে একটু পানি ছেটাল মুখে। তার শরীরটা কেমন ক্লান্ত আর অস্থির লাগছে। সম্ভবত টানা রাত জাগায় শরীরটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে। সে আঁজলা ভরে কিছু পানিও ঢালল মাথায়। তারপর ঋদ্ধির ঘরে গেল। ঋদ্ধি খাটে বসে আছে। তার চোখে মুখে ভয়। মুনিয়া বলল, ‘কী হয়েছে?’
ঋদ্ধি কথা বলল না। মুনিয়া কাছে গিয়ে বসল, ‘দুঃস্বপ্ন দেখেছিস?’
‘মনে হয়। কেমন একটা চিৎকারের মতো শুনলাম।’
‘ওহ। দিন রাত হাবিজাবি বই পড়লে আর সিনেমা দেখলে উদ্ভট স্বপ্নইতো দেখবি!’
ঋদ্ধি আড়ষ্ট গলায় বলল, ‘ঠিক তা না মা। কিছু একটা যেন হয়েছে কোথাও।’
‘ধুর। সারাক্ষণ যে কী করিস কে জানে! মাথাভর্তি করে ফেলেছিস আজেবাজে চিন্তায়। আয়, এদিকে আয়।’
ঋদ্ধি আর কথা বাড়াল না। সে মায়ের কোলের কাছে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। মুনিয়া তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। মেয়েটা কোন ফাঁকে যে এমন বড় হয়ে গেল মুনিয়া যেন টেরই পায়নি। কিন্তু মুখটা এখনো মায়াময়, স্নিগ্ধ, শিশুসুলভ। মুনিয়া তার ঘরে ঢুকে দেখে হাতের মোবাইল ফোনটা বন্ধ হয়ে গেছে, চার্জ নেই। সে ফোনটা চার্জে দিয়ে বাথরুমে ঢুকল। কুসুম গরম জলে একটা লম্বা গোসল দরকার তার। সারারাত জেগে থাকার ক্লান্তিটা যদি তাতে কিছু কমে।
সময় নিয়ে গোসল সারল মুনিয়া। খুব অস্থির আর অস্বস্তি লাগছে তার!