৫৩
ঢাকার শীত ক্ষণস্থায়ী। কখন আসে কখন চলে যায় টের পাওয়া কঠিন। শীত এসে যে চলেও গেছে তা টের পাওয়া গেল বৃষ্টি দেখে। গত কিছুদিন ধরে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। সেই বৃষ্টির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নাদিয়া। গত কয়েকটা মাস সে এই ঘর থেকে বের হয়নি। কোথাও যায়নি। খুব প্রয়োজন না পড়লে কারো সাথে কথাও বলে না সে। আশফাক আহমেদ সারাক্ষণ মেয়ের ঘরের বাইরে বসে থাকেন। তিনিও কারো সাথে কথা বলেন না। তবে তার খুব নাদিয়াকে দেখতে ইচ্ছে করে। কিন্তু ওইটুকু এক দরজার বাধা পেরোতে পারেন না তিনি। তার কেবল মনে হয়, নাদিয়ার মুখ তিনি ভুলে গেছেন। নাদিয়ার হাসি ভুলে গেছেন। নাদিয়ার কণ্ঠ ভুলে গেছেন। তার খুব ইচ্ছে হয় নাদিয়ার হাসি মাখা মুখটা যদি তিনি দেখতে পারতেন। আর মাত্র একবার। সেই হাসির জন্য তিনি তার সবকিছু বিলিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু জীবন তাকে সেই সুযোগটা আর দেয় না। তিনি কাঁদেন। তবে তার সেই কান্না নিঃশব্দ। সেই কান্না কেউ শোনে না, কেউ দেখে না। কেবল তিনি একা জানেন, এই কান্নার চেয়ে কষ্টকর কিছু আর পৃথিবীতে নেই। হাফসাও চুপচাপ বসে থাকেন তার ঘরে। নাবিলা আর ও বাড়িতে যায়নি। সে সারাক্ষণ নাদিয়ার পাশে বসে থাকে। নাদিয়া অবশ্য তার সাথেও খুব একটা কথা বলে না। তবে সেদিন সেই বৃষ্টির সন্ধ্যায় নাবিলা হঠাৎ তড়িঘড়ি করে ঘরে ঢুকে পড়ল। নাদিয়া দাঁড়িয়ে ছিল জানালার কাছে। সে নাবিলার পায়ের শব্দ শুনে চোখ তুলে তাকাল। নাবিলা উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, ‘জানিস কী হয়েছে?’
নাদিয়া কোনো আগ্রহ দেখাল না। নাবিলা বলল, ‘শফিক আসছে। শফিক।’
নাদিয়া নির্বিকার ভঙ্গিতে চোখ ফিরিয়ে নিল। তার কোনো ভাবান্তর হলো না। সে যেমন ছিল তেমনই তাকিয়ে রইলো বাইরে। নাবিলা ছুটে গিয়ে নাদিয়ার কাঁধ চেপে ধরল, ‘এই।
নাদিয়া ফিরেও তাকাল না। বাইরে আমগাছটার পাতায় অবিরাম বৃষ্টি ঝরে পড়ছে। ল্যাম্পপোস্টের ভেজা আলো পড়ে সেই পাতা চকচক করছে। একটা কুকুর ভিজে যাচ্ছে ফুটপাতে। অন্ধকারে আমগাছটার ডালে একটা ভেজা কাক জবুথবু হয়ে ভিজছে। কাকটার কি কোনো ঘর নেই?
নাবিলা বলল, ‘শুনছিস তুই? এই নাদিয়া।’
নাদিয়া যেমন ছিল তেমনই দাঁড়িয়ে রইল। যেন কোনোকিছুই সে শুনতে পাচ্ছে না। তার সকল আগ্রহ ওই গৃহহীন কুকুরটার প্রতি। ওই ভিজে যাওয়া পাতাটার প্রতি। ওই জবুথুবু কাকটার প্রতি। আচ্ছা, ওই কাক আর ওই কুকুরটা কেনো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে? তাদেরও কি তার মতোই যাওয়ার কোনো জায়গা নেই? কোথাও না? একটা নিজের ঘর নেই? মানুষ নেই। আশ্রয় নেই? তার মতোই তারাও কি একা, নিঃসঙ্গ, যন্ত্রণাকাতর?
নাদিয়া কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল সে জানে না। কুকুরটা চলে গেছে। কাকটাও আর নেই। বৃষ্টিও ধরে এসেছে। আমগাছের পাতাটা নিস্পন্দন। সে কি মনে মনে হাসল? হয়ত সে ভাবলো, আর সবারই কোথাও না কোথাও যাওয়ার জায়গা আছে, হয়ত কেউ না কেউ তাদের অপেক্ষায় থাকে। কেবল নাদিয়ারই কেউ নেই। কেউ না। এই জগতে তার জন্য কেউ কখনো অপেক্ষা করবে না।
সে একা নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলো আরো দীর্ঘসময়। তারপর ঘুরে বিছানায় বসতে গিয়ে খানিক থমকে গেল নাদিয়া। শফিক জড়সড় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। তবে সে তাকিয়ে আছে মেঝের দিকে। নাদিয়ার চোখের পাতা কি খানিক কাঁপল? শফিক তা দেখলো না। তবে এক নিশ্চল, নিথর সময়ের নির্বাক সাক্ষী হয়ে রইলো তারা দুজন। যেন তারা দাঁড়িয়ে রইলো অনন্তকাল। কেউ কোনো কথা বলল না। কোনো শব্দ করল না। নাদিয়ার কেবল শরীরটা খুব খারাপ লাগতে লাগল। এতটা সময় সে অনেকদিন দাঁড়িয়ে থাকেনি। তার শরীর কাঁপছে। কিন্তু কোনো এক অদ্ভুত কারণে সে বসতে পারছে না। যেন তার শরীরে নড়ার শক্তিটুকুও নেই। নিজেকে পাথরের মূর্তির মতো মনে হতে লাগল নাদিয়ার। সে হঠাৎ কাঁদল। তার সেই কান্নাও অবশ্য শফিক দেখলো না। সে তখনো নতজানু মানুষের মতো দাঁড়িয়ে আছে। যেন নাদিয়ার দিকে চোখ তুলে চাইবার শক্তি তার নেই। নাদিয়ার চোখের নিঃশব্দ কান্নার ফোঁটা ফোঁটা জল টুপটাপ ঝরে পড়তে লাগল কংক্রিটের কঠিন মেঝেতে।
কে জানে কেন, শফিক হঠাৎ চোখ তুলে তাকাল। সেই ভীরু, সেই কুণ্ঠিত, সেই সদা সন্ত্রস্ত, ভীত শফিক আচমকা ঝোড়ো হাওয়ার মতো ছুটে এলো। তারপর তুমুল জলোচ্ছ্বাসের মতো গ্রাস করে নিল নাদিয়াকে। নাদিয়া যেন অকস্মাৎ ছোট্ট একটা পাখি হয়ে গেল। শফিক যেন বিশাল এক বৃক্ষ। সেই বৃক্ষের কোটরে সেই ছোট্ট পাখিটি যেন গুটিসুটি মেরে ঢুকে গেল। যেন এই জগতে আর কখনো কোথাও সে যেতে চায়না। যেন এই পৃথিবীর আর কিছুই কখনো সে দেখতে চায় না। যেন সে নিঃস্ব, নিঃসার, অতল আঁধারে ডোবা শূন্য এক মানুষ। এই মানুষটার বুকের ভেতরের এই মায়াময় আঁধারেই সে লীন হয়ে থেকে যেতে চায় অনন্তকাল।
শফিক ফিসফিস করে ডাকল, ‘নাদিয়া।’
নাদিয়া জবাব দিল না। সে কাঁদছে। তার সেই প্রবল কান্নায় কেঁপে কেঁপে উঠছে তার শরীর। শফিক তার সবটুকু শক্তি দিয়ে সেই কম্পন যেন শুষে নিতে চাইছে নিজের শরীরে। সবটুকু যন্ত্রণা নিঃশোষিত করে নিতে চাইছে নিজের বুকে। সেই বুক জানে, জগতে প্রিয়তম মানুষের বুকভার যন্ত্রণা শুষে নেয়ার চাইতে শুদ্ধ আর কিছু নেই। প্রিয়তম মানুষের শূন্য বুক প্রবল ভালোবাসায় পূর্ণ করে দেয়ার চাইতে শ্রেষ্ঠ আর কিছু নেই।
শফিক আবারো ডাকল, ‘নাদিয়া।’
নাদিয়া যেমন ছিল তেমনই ডুবে রইলো অন্য কোনো এক পৃথিবীতে। সেই পৃথিবীতে কদাকার কোনো মন নেই। কপট কোনো মানুষ নেই। ভান নেই। ভাবনা নেই। কেবল জীবন ও জগতের শ্রেষ্ঠ এক অনুভব আছে। সেই অনুভবের নাম ভালোবাসা। প্রগাঢ়, শুদ্ধতম ভালোবাসা।
.
বাইরে তখন তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সেই বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে রাতের আকাশ। পথ, ঘাট, মাঠ। ভিজে যাচ্ছে শহুরে শরীর। ভিজে যাচ্ছে মন ও মানুষ। ঋদ্ধি তার অন্ধকার ঘরের জানালায় তাকিয়ে আছে। তার বুকের ভেতর ছোট্ট এক পাখি ডানা ঝাপটায়। সারাক্ষণ অস্থির হয়ে থাকে। তারপর কখনো কখনো ক্লান্ত হয়ে যায়। স্তব্ধ হয়ে থাকে। কিন্তু তাতে ঋদ্ধির যন্ত্রণা কিছু কমে না। বরং বাড়ে। সে তাই সেই পাখিটার জেগে ওঠার অপেক্ষায় থাকে। ডানা ঝাপটানোর অপেক্ষায় থাকে। সেই যন্ত্রণাময় অপেক্ষা নিয়েই ঋদ্ধি নিস্পলক তাকিয়ে থাকে জানালায়।
সেখানে ল্যাম্পপোস্টের নিঃসঙ্গ আলোয় একটা রাস্তা, একটা ফুটপাত, একটা দেয়াল। দেয়ালের গায়ে ভিজে যাচ্ছে লাল অক্ষরে লেখা যন্ত্রণার কথকতা-
.
আমি একদিন নিখোঁজ হবো, উধাও হবো রাত প্রহরে…
.
দিপু এক দিকভ্রান্ত মানুষ। সে জেলখানা থেকে ছাড়া পেয়েছে। সুমির মৃত্যুর ঘটনা যে খুন নয়, স্বাভাবিক অসুস্থতার মৃত্যু তা প্রমাণিত হয়েছে। তারপরও দীর্ঘসময় জেল খাটতে হয়েছে দিপুকে। কিন্তু জেলখানা থেকে বের হয়েই আচমকা উধাও হয়ে গেলো সে। এই শহর, এই চেনা মানুষ, এই চেনা ঘর-বাড়ি, কিছুই তার ভালো লাগেনা। সে এক অচেনা গাঁয়ের এক অচেনা হিজল গাছের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সেখানে হিজলের রেশম কোমল রক্তাভ ফুলে ঢেকে যায় ঘাসের শরীর। ভোরের শিশিরে ভিজে যায় মাটির হৃদয়। সেই ঘাস আর মাটির বুকের ভেতর যেন রাখা আছে দিপুর বুকের বাঁ পাশ ছেড়া হৃৎপিণ্ডও। সুমি সেখানে শুয়ে আছে। দিপু ফিসফিস করে তার সাথে কথা বলে। কাঁদে। তারপর শূন্য এক জোড়া চোখ মেলে তাকায়। কিন্তু দিপু জানে পুরো পৃথিবী তার দিকে তাকিয়ে হাসে। কটাক্ষের হাসি। ঘৃণার হাসি। উপেক্ষা ও অপমানের হাসি। দিপুর অবশ্য তাতে কিছু আসে যায়না। তার আসলে কোনোকিছুতেই কিছু যায় আসেনা। সে কতদিন পর বাড়ি ফিরে এসেছে। কিন্তু তার কেবল মনে হয়, সব ফেরাই ফেরা নয়। সে হয়তো অন্য কোথাও রয়ে গেছে। অন্য কারো সঙ্গে। আজকাল প্রায়ই সেই অন্যকারো কথা সে মনে করতে পারেনা। তার সবকিছু কেবলই অন্ধকার মনে হয়। মনে হয় প্রগাঢ় অন্ধকারে ঢেকে আছে নিঃসঙ্গ দিন রাত্রি। সে জানে, যা পাওয়া হয় না, তাই হয়তো আরো বেশি রয়ে যায় চিরকাল। নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তিতে ছেয়ে থাকে বুকের গহিন দেয়াল। কেউ হয়তো একটা জীবনজুড়ে বুকের সেই গহিন দেয়ালে লিখে যেতে থাকে রাফির সেই নৈঃশব্দ্যের অন্তর্দহন-
‘আমাকে হারাতে দিলে নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তিতে ছেয়ে যাবে তোমার শহর…’।
.
মুনিয়াকে বুকের ভেতর আগলে ধরে আছে জাফর। সে জানে জগতে সবটুকু পাওয়ার নয়। তাই কিছু না পাওয়া মেনে নেয়াও আসলে পাওয়াই। হয়তো সে কারণেই মুনিয়ার সবকিছু জানার পরও সেই দূরত্বের পথটুকু হেঁটে গেছে সে নিজে। মুনিয়া জানে, এইখানে কত শত দুঃখ, কত সহস্র দহন পুষে বেঁচে থাকে মানুষ। মানুষের হিসেব তবু মেলে না। মেলে না বলেই সব হারিয়েও বেঁচে থাকে মানুষ। সব পেয়েও হারিয়ে যায় মানুষ। জানালার ওপারে বৃষ্টি। বৃষ্টির ওপারে কান্না। সেই কান্নায় ভিজে যাচ্ছে দেয়াল। দেয়ালের গায়ে ভিজে যাচ্ছে লাল অক্ষরে লেখা রাফির সেই শব্দ কিংবা নৈঃশব্দ্যের কান্নাও। সেই শব্দ কিংবা নৈঃশব্দ্যের কান্না কী অবিশ্বাস্য শক্তিতে নাড়িয়ে দেয় মানুষের জীবন ও জগত!
জলের কান্না আরো বাড়ে। বাড়ে মানুষের বুকের কান্নাও। সেই কান্না প্ৰেম নাকি প্রেমহীনতার, সেই গল্প পাওয়ার না হারিয়ে ফেলার, তা কেউ জানেনা। তবু এই নামহীন পুরনো বাড়িটার পলেস্তরা খসা দেয়ালের ওপারে, ওই পথের ধারে, ফুটপাত ঘেঁষা চুনকাম করা দেয়ালে জেগে থাকে অদ্ভুত এক জীবন ও যন্ত্রণার গান-
‘আমি একদিন নিখোঁজ হবো, উধাও হবো রাত প্রহরে,
সড়ক বাতির আবছা আলোয়, খুঁজবে না কেউ এই শহরে।
ভাববে না কেউ, কাঁপবে না কেউ, কাঁদবে না কেউ একলা একা,
এই শহরের দেয়ালগুলোয়, প্রেমহীনতার গল্প লেখা।‘
.
হয়তো সেই অন্তহীন হাহাকারের গান কেবল শুনতে পায় দুঃখ ও দহনের দীর্ঘশ্বাসে ডোবা এই মানুষগুলোই।
ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়েও কি রাফি জানতো, রোজ রাতে সড়কবাতির আবছা আলোয় এই শহরের মানুষের দীর্ঘশ্বাসের গল্পগুলো এমন আড়ালে আবডালে ছুঁয়ে যাবে সাদা দেয়ালে লেখা তার লাল অক্ষরের ওই নীল বেদনার কষ্টগুলো? সেই কষ্টগুলো হয়ে রইবে এমন অন্তহীন দীর্ঘশ্বাসের শব্দ?
ছড়িয়ে পড়তে থাকবে দীর্ঘশ্বাসে পরিপূর্ণ শহুরে হাওয়ার শরীর জুড়ে…
[সমাপ্ত]