অর্ধবৃত্ত – ৫২

৫২

আতাহার মিয়া অফিসে বসে আছেন। তার সামনে বসে আছে পুলিশের দুজন সোর্সের একজন বান্টি। তিনি বিরক্ত গলায় বান্টিকে বললেন, ‘ঘটনার পর থেকে তোকে ওই এলাকায় সার্বক্ষণিক নজর রাখতে বললাম, আর এতদিনেও তুই এই ছেলের বিষয়ে আমাকে কোনো খবর দিতে পারলি না?’

বান্টি বিগলিত ভঙ্গিতে বলল, ‘আমিতো ছার এই পোলারে দুয়েকদিন দেখছি। ওইখানে একটা বাড়ির সামনে দাঁড়াই থাহে। আমি ভাবছি অন্য কাহিনি। ওই বাড়িতে কম বয়সী এক মাইয়া আছে। আমি ভাবছি এরা অল্প বয়সের পোলা মাইয়া, প্রেম ট্রেমের ব্যাপার।’

‘এভাবেতো হবে না বান্টি।’

বান্টি হাসল, ‘হইবো ছার। সবকিছুই যে আমার চোউখ এড়াই গেছে এমন না। আমি চেষ্টা করছি যা দেখছি তাই নোট নিতে। কিন্তু বিষয়টা পোলাপানের প্রেম-পিরিতি মনে কইরা পাত্তা দিই নাই।’

বলেই সে তার ফোন বের করে আতাহার মিয়াকে দেখাল, ‘এই যে দেহেন ছার। আমি এই পোলার ছবিও তুইলা রাখছি। দেখেন, এই যে তার গেঞ্জিতে কী লেখা! এই একই কথা আবার সে ওই বাড়ির সামনে দেয়ালেও লেইখা রাখছে। হা হা হা। অল্প বয়সের প্রেম পিরিতিতে যা হয় আর কী!’

বান্টি হাসলেও আতাহার মিয়া হাসলেন না।

.

মুনিয়া স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। সে অনেক ঝুঁকি নিয়েই রাফির সাথে দেখা করতে এসেছে। রাফি বলল, ‘কী হয়েছে তোমার?’

মুনিয়া হাসার চেষ্টা করল, ‘কিছুনাতো!’

‘তাহলে?’

মুনিয়া সাথে সাথে জবাব দিল না। খানিক চুপ করে বসে রইলো। তার হঠাৎ খুব কান্না পাচ্ছে। কিন্তু রাফির সামনে সে কাঁদতে পারছে না। রাফি বলল, ‘বলো কী হয়েছে?’

মুনিয়া নিজেকে সামলে নিল যেন। তারপর বলল, ‘তুমি ভাগ্যে বিশ্বাস করো?’

রাফি বলল, ‘করি।’

‘মানুষের ভাগ্য কি আগে থেকেই নির্ধারিত থাকে?’

‘কী জানি! এসব ভাবতে ইচ্ছে করে না।’

‘কিন্তু ইচ্ছে না করলেই কি সবকিছু উপেক্ষা করা যায়?’

‘তা যায় না।’

‘এই যে আমি জীবনভর স্বপ্নের পেছনে ছুটেছি। সেই ছোটাটা কি অর্থহীন ছিল না?’

‘অর্থহীন কেন হবে?’

‘যদি আগে থেকেই আমার ভাগ্যে দুঃস্বপ্ন লেখা থাকে, তাহলেতো স্বপ্নের পেছনে ছোটা অর্থহীনই।’

‘অন্তত নিজেকেতো প্রবোধ দেয়া যায় যে আমি চেষ্টাটা করেছি।’

‘তাতে লাভ কী? জীবনতো শেষ অবধি কারো গল্পে লেখা চিত্রনাট্যই। সেটা কি আমরা বদলে দিতে পারি?’

রাফি এই প্রশ্নের উত্তর দিল না। মুনিয়াই বলল, ‘জীবনজুড়ে এই যে এত স্বপ্নের পেছনে ছুটেছি, কেন জানো?’

‘কেন?’

‘শান্তির জন্য। মানুষ শেষ অবধি আর কিছুই খোঁজে না। ভালো রেজাল্ট, ভালো চাকরি, অর্থ-বিত্ত, প্রেম, বিয়ে, সন্তান আসলে জীবনভর সে যা করে, তা কেবল ওই শান্তির জন্যই। এমন কি মৃত্যুর পরও সে অনন্ত শান্তিতেই থাকতে চায়। কিন্তু কী জানো?’

‘কী?’

‘এর কোথাও আসলে শান্তি নেই। শান্তি শেষ পর্যন্ত নিজের কাছেই। ওই যে ছোট্ট একটা ঘর, ছোট্ট একটা বিছানা, খুব কাছের মানুষটার গায়ের ঘ্রাণ, চেনা ফুলের সৌরভ, ওই যে রোজকার ঝগড়া, কান্না, দুঃখ, অপ্রাপ্তি ওর সবটাই আসলে শান্তি। কিন্তু ওই শান্তিটুকুই আমরা খুঁজে নিতে জানি না। আমরা কেবল দূরের, ধরা ছোঁয়ার বাইরের শান্তিটা চাই। সেই শান্তির জন্য কাছের সব উপেক্ষা করি, অবহেলা করি। আর ওই শান্তিটুকু খুঁজতে গিয়েই মানুষ এত বেপরোয়া হয়ে যায় যে হয়তো সবচেয়ে বেশি অশান্তি ডেকে আনে সে।’

মুনিয়া থামলেও রাফি কথা বলল না। সে নিষ্পলক তাকিয়ে আছে মুনিয়ার জল ছলছল চোখের দিকে। মুনিয়া বলল, ‘যা আমাদের কাছে আছে, তা সবসময়ই গুরুত্বহীন মনে হয়। আমরা তাই সবসময় তার জন্য ছুটি, যা আমাদের নেই।’

মুনিয়া যেন লুকিয়ে অগোচরে হাতের উল্টোপিঠে চোখ মুছল। তারপর বলল, ‘ওই যে তুমি বললে না, শরীর পুরনো হলে ভালোবাসা কমে যায়, নতুন শরীরের প্রতি ভালোবাসা বাড়ে। ওটা আসলে শুধু শরীর না। সবকিছুর ক্ষেত্রেই সত্য। একটা বই পড়া হয়ে গেলে, না পড়া বইটার প্রতিই আগ্রহ তৈরি হয়। এটা সত্যি। কিন্তু কী জানো? বইয়ের ভেতরের গল্পটাই শেষ অবধি আসল। মানুষের ভেতরের মনের মতো। শরীর পুরনো হয়, কিন্তু মন হয় না। বই পুরনো হয়ে যায়, কিন্তু গল্প না। পৃথিবীর সকল গল্প কিন্তু সেই একই। ভালোবাসা বা ঘৃণার গল্প। আনন্দ বা দুঃখের গল্প। সেই একই গল্প কিন্তু আমরা সৃষ্টির শুরু থেকেই শুনছি, শেষদিন পর্যন্তও এই একই গল্প চলতে থাকবে। গল্পের বইগুলো কেবল পুরনো হয়ে যাবে। শরীরের মতো।’

রাফি হাত বাড়িয়ে মুনিয়ার হাত ছুঁয়ে বলল, ‘এমন করে কেন বলছো?

মুনিয়া দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘হয়তো জীবন সবচেয়ে ভালো শিক্ষক বলে। তবে জীবনের শিক্ষাটা খুব রূঢ়, জানোতো! সে এমন নিষ্ঠুরভাবে শেখায় যে সেটা আর কাজে লাগে না। ততক্ষণে সব শেষ হয়ে যায়।’

‘কী হয়েছে তোমার?’

মুনিয়া এই প্রশ্নের জবাব দিল না। তবে সে রাফির বাড়িয়ে দেয়া হাতটা জড়িয়ে ধরল। তারপর বলল, ‘তোমার ইন্ডিয়ার ভিসা আছে?’

‘কেন?’

‘আছে কি না বলো?’

‘হ্যাঁ, আছে।’

তুমি কালই ইন্ডিয়া চলে যাবে রাফি! যেভাবেই হোক কালই। ইউ মাস্ট গো।’

‘কেন?

‘কোনো প্রশ্ন করবে না। আমি জাস্ট যেতে বলেছি, তুমি যাবে।’

‘কোনো সমস্যা?’

মুনিয়া শেষ অবধি চোখের জলটুকু আর আটকে রাখতে পারল না। সে ভাঙা গলায় বলল, ‘আমাদের বিপদ রাফি। খুব বিপদ। পুলিশ খুব কাছে পৌঁছে গেছে। যেকোনো মুহূর্তে…।’ প্রবল কান্নায় মুনিয়ার গলা বুজে এলো।

রাফি ভয়ার্ত গলায় বলল, ‘তুমি?’

মুনিয়া খানিক চুপ করে রইল। যেন নিজেকে সামলে নিল সে। তারপর বলল, ‘আমি জানি না আমার কী হবে, তবে যাই হোক, ও নিয়ে আমি আর ভাবি না। অপরাধ যেহেতু আমি করেছি, শাস্তি যদি পেতেই হয়, তবে সেটা আমাকেই পেতে হবে। কিন্তু আমার অপরাধের কারণে তোমার কিছু হলে…।’ মুনিয়া আবারও কথা শেষ করতে পারল না। সে নিজেকে সামলে নেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল। তারপর যতটা সম্ভব স্বাভাবিক হয়ে বলল, ইদি কখনো সবকিছু ঠিক হয়ে যায়, তুমি তখন ফিরে এসো।’

রাফির হাতে একটা মোটা খাম ধরিয়ে দিয়ে মুনিয়া বলল, ‘আর এটা রাখো। প্লিজ রাফি, যতদ্রুত সম্ভব, জাস্ট গো এওয়ে। প্লিজ…।’

রাফি মুনিয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। তার আচমকা মনে হলো ওই চোখের ভেতর সে তার নিজেকে দেখতে পাচ্ছে। সেই ভয়াল রাত্রির পর অবচেতনেই যে মুনিয়াকে সে ভয় পেতে শুরু করেছিল, সেই মুনিয়া যেন আচমকা উধাও হয়ে গেল।

মুনিয়া চিৎকার করে কাঁদল। তার সেই কান্না রাফিকে যেন একটুও বিচলিত করল না। সে স্থির চোখে একদৃষ্টিতে মুনিয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। মুনিয়া সেই কান্না জড়ানো কণ্ঠেই হুড়মুড় করে ভেঙে পড়া এক মানুষের মতো বলল, ‘প্লিজ রাফি, তুমি যাও। প্লিজ। আজই, এক্ষুণি। প্লিজ…’।

মুনিয়া কাঁদছে। তার চোখের কান্নার ফোঁটা ফোঁটা জল টুপটাপ ঝরে পড়ছে রাফির হাতে। রাফি সেই জলের ফোঁটার দিকে তাকিয়ে মুনিয়াকে অবাক করে দিয়ে হাসল।

মুনিয়া সেই হাসির দিকে বিভ্রান্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল। সে জানেনা রাফির সেই হাসিতে কী আছে!

.

রাফি পুলিশের কাছে ধরা দিল তার তিনদিন পর। রফিকুল আলম খুনের সকল দায়-দায়িত্ব সে স্বীকার করে নিয়েছে। খুনের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনাও দিয়েছে সে। তবে সেই বর্ণনার কোথাও মুনিয়ার কথা নেই। যেন রফিকুল আলমের খুনের ঘটনায় মুনিয়া কোথাও ছিলই না। যেন পুরোটা জুড়েই কেবল রাফি একা। আতাহার মিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাফির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। রাফি অবশ্য তাতে বিচলিত হলো না। সে বলল, ‘আমার খুব তেষ্টা পেয়েছে ওসি সাহেব। আমাকে এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি খাওয়াবেন?’

আতাহার মিয়া নিজ হাতে এনে রাফিকে পানি দিলেন। রাফি ঢকঢক করে এক চুমুকে সেই পানি খেয়ে ফেলল। আতাহার মিয়া বললেন, ‘এই কাজটি আপনি কেন করলেন?’

রাফি হাতের উল্টো পিঠে মুখ মুছতে মুছতে হাসল। তার সেই হাসিতে কী ছিল কে জানে! তবে আতাহার মিয়া তা বুঝতে পারলেন না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *