৪৯
আতাহার মিয়া জেলখানায় এসেছেন ফজলে নূরের সাথে দেখা করতে। ফজলে নূর এ কদিনেই যথেষ্ট ভেঙে পড়েছেন। আতাহার মিয়া বললেন, ‘আপনাকে এখনো কৌশলগত কারণে আটকে রাখা হয়েছে। আপনার বিরুদ্ধে কোনো চার্জশিট দেয়া হয়নি। তারমানে বুঝতেই পারছেন, বল এখনো আপনার কোর্টেই আছে। এখন ফলাফল নির্ভর করছে, আপনি কীভাবে খেলবেন তার ওপর।’
‘আমার আর খেলাখেলির কী আছে! ডিসিশনতো যা নেয়ার হয়েই গেছে।’
‘ডিসিশন হয়ে গেলে এতদিনেও চার্জশিট দেয়া হলো না কেন?’
ফজলে নূর কথা বললেন না। আতাহার মিয়া বললেন, ‘রফিকুল আলমের পরিবারের এখনো দৃঢ় বিশ্বাস, এই খুনের ঘটনায় আপনি জড়িত না। জড়িত অন্য কেউ।’
কিন্তু তাতেও কি কিছু বদলাবে? আপনারাতো আমাকে খুনি ধরেই নিছেন। আপনিই বলেন, আমি কি বোকা যে এমন একটা কাজ আমি করব?’
আতাহার মিয়া জবাব দিলেন না। ফজলে নূর বললেন, ‘অন্য কেউটা কে বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই।’
‘পারছি আবার পারছিও না।’
‘মানে?’
‘মানে জান্নাত ইঙ্গিত করছেন আকবর আলী। কিন্তু আমরাতো আর ইঙ্গিতের ওপর কিছু করতে পারি না। আমাদেরতো স্ট্রং এভিডেন্স থাকতে হবে তাই না? আকবর আলীর ক্ষেত্রে সে ধরনের কিছুই নেই। যা থাকার আপনার বিপক্ষেই আছে।’
ফজলে নূর ম্লান হাসলেন, ‘রফিকুল আলমের সাথে আমার সম্পর্ক খারাপ ছিল, কিন্তু তার মানেইতো এই নয় যে…। তা ছাড়া ওনার স্ত্রীওতো দাবী করছেন…।’
‘নতুন সমস্যাতো এখানেই।’
‘কী সমস্যা?’
‘আপনার সাথে ওনার স্ত্রীর কী সম্পর্ক?’
‘আমার সাথে ওনার স্ত্রীর সম্পর্ক মানে?’
‘আপনাদের দুজনের মধ্যে একটা নিয়মিত যোগাযোগ আছে। স্বামীর সরাসরি শত্রুর সাথে স্ত্রীর কী সম্পর্ক?’
ফজলে নূর হাল ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গিতে বললেন, ‘আমি বললে আপনি বিশ্বাস করবেন? সেটা বরং ওনাকেই জিজ্ঞেস করুন।’
‘বলুন আপনি।’
‘উনি আমার স্ত্রীর খুব কাছের বান্ধবী। যেহেতু ওনার স্বামীকে উনি কোনোভাবেই বোঝাতে পারতেন না, আর আমার সাথে তার সম্পর্কটা দিনকে দিন আরো খারাপ হচ্ছিল, সেহেতু আমার স্ত্রীর সূত্র ধরেই উনি আমাকে ফোন করতেন, যেন আমি বিষয়টা বুঝি।’
আতাহার মিয়া হাসলেন, ‘গালগল্প হয়ে গেল না? মানে বানানো গল্পওতো এত কাঁচা হয় না, হা হা হা।’
ফজলে নূর বললেন, ‘জানতাম আপনি বিশ্বাস করবেন না। আপনি এক কাজ করুন, স্কুলের হেড মিস্ট্রেস মুনিয়া ম্যাডামের সাথে কথা বলুন। তাহলে ভেতরের অনেক বিষয়ে আপনি আরো স্বচ্ছ ধারণা পাবেন।’
‘ওনার সাথেও আমার অনেকবার কথা হয়েছে। কিন্তু উনি অনেক সাবধানী মানুষ, কোনো বিষয়েই মুখ খুলতে চান না।’
‘কিন্তু একমাত্র উনিই আপনাকে ভেতরকার অনেক সঠিক খবর দিতে পারবেন। যেহেতু আমিও সন্দেহভাজন, আকবর আলীও একভাবে সন্দেহভাজন। সুতরাং আমাদের তথ্য নির্ভরযোগ্য না হওয়াই স্বাভাবিক। বাট উনি অনেক কিছু জানেন। তা ছাড়া রফিকুল আলমের সাথে এককালে উনার খুব ভালো সম্পর্ক ছিল।’
‘তাই? তাহলে পরে আর ছিল না কেন?’
‘স্কুলের নানা বিষয়ে বোঝেনইতো। তা ছাড়া স্কুলের অনেক সিনিয়র শিক্ষককে ডিঙিয়ে একমাত্র রফিকুল আলমের কারণেই উনি চট করে হেড মিস্ট্রেস হয়ে গিয়েছিলেন। এই নিয়ে পরবর্তিতে নানান কথা। বুঝতেই পারছেন, যা হয় আরকী! এগুলো নিয়ে নানান সমস্যাও তৈরি হয়েছিল। আশপাশে অনেক ফিসফিসানিও ছিল।’
আতাহার মিয়া চিন্তিত মুখে বের হলেন। তিনি গাড়িতে উঠেই মুনিয়াকে ফোন করার কথা ভাবলেন। যত দ্রুত সম্ভব মুনিয়ার কাছ থেকে কথা বলার সময় নিতে হবে। কিন্তু ফোন করতে গিয়ে দেখেন তার ফোনে চার্জ নেই। ফোন বন্ধ হয়ে আছে। অথচ মুনিয়ার সাথে কথা বলার জন্য তার যেন আর তর সইছিল না। রফিকুল আলমের ফোনটা আতাহার মিয়ার কাছেই ছিল। কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারিগরি কারণে ফোনটা একটিভও করা হয়েছে। কী মনে করে আতাহার মিয়া তার মানিব্যাগ থেকে মুনিয়ার ভিজিটিং কার্ড বের করলেন। তারপর সেখান থেকে মুনিয়ার ফোন নম্বরটা টুকে নিলেন রফিকুল আলমের নতুন ফোনটায়। তারপর বার কয়েক ডায়াল করলেন মুনিয়ার নম্বরে। কিন্তু মুনিয়ার নম্বরে ফোন ঢুকল না।
.
রাফি বসে আছে সাইকিয়াট্রিস্ট ড. আব্দুল বাতেনের সামনে। বাতেন হাসি হাসি মুখে বললেন, ‘একটা কথা বলি?’
‘জি স্যার।’
অনেকদিনতো হয়ে গেল, তাই না?’
‘জি স্যার।’
‘এখনতো আমার কিছু বলা উচিত।’
‘জি স্যার।’
‘আপনি কিন্তু এতদিনে আমাকে একটুও সহযোগিতা করেন নি।’
‘মানে স্যার?’
‘মানে, আমি আপনার কাছে যা যা জানতে চেয়েছি, আপনি তার কিছুরই ঠিকঠাক উত্তর দেননি। এখন ডাক্তারের কাছে এসে যদি আপনি আপনার সমস্যা লুকান, তাহলে হবে?’
রাফি কথা বলল না। সে মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে রইলো। বাতেন বললেন, ‘ওয়েল। আপনাকে কিছু বলতে হবে না, আমি বলি আপনি শুনুন। যদি আমি ভুল কিছু বলে থাকি, আপনি আমাকে শুধরে দেবেন, অলরাইট?’
রাফি মাথা নাড়ল
‘আপনি খুব বড় কোনো একটা ঘটনার সাথে জড়িয়ে পড়েছেন, রাইট?’
রাফি জবাব দিল না। তবে না-বোধক কিছুও বলল না সে। বাতেন বললেন, ‘এবং ঘটনাটা ভয়ংকর। মানে ওই ধরনের কাজে আপনি অভ্যস্ত না। কিন্তু ঘটনাটা ঘটে যাবার পর আপনি নানাভাবে নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে আপনি সেটার জন্য দোষী না।’
একটু থেমে ড. বাতেন আবার বললেন, ‘প্রথম দিকে কিছুদিন হয়তো আপনি সেটি পেরেছিলেন। কিন্তু তারপর ধীরে ধীরে বিষয়টা আপনার মাথায় ঘুরে ফিরে আসতে থাকল আর আপনি সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে থাকলেন বিষয়টা অগ্রাহ্য করতে, যতটা সম্ভব স্বাভাবিক থাকতে, তাইতো?’
রাফি চুপ। ড. বাতেন বললেন, ‘কিন্তু ঘটনাটা জোর করে ভুলে থাকার চেষ্টা, জোর করে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টাটাই একটা সময় আপনার জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা তৈরি করতে লাগল। রাইট?’
রাফি মাথা নিচু করে বসে রইলো। ড. বাতেনের কোনো প্রশ্নেরই জবাব দিল না সে। বাতেন বললেন, ‘কিছুদিন পর আপনি টানা ওই রিলেটেড দুঃস্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন। এমনকি দুঃস্বপ্নের ভয়ে আপনি ঘুমাতেও পারলেন না। আর এই সময়ে আপনি হাই ডোজের ঘুমের ওষুধ খেতে শুরু করলেন। বা এলকোহল টাইপ কিছু। কিন্তু ধীরে ধীরে সেগুলোও প্রপারলি কাজ করা বন্ধ করে দিল। কারণ ঘটনাটা এতটাই তীব্র ছিল যে আপনি কোনোভাবেই সেটিকে মাথা থেকে তাড়াতে পারলেন না। অথচ বাইরে আপনাকে দিনের পর দিন সম্পূর্ণ স্বাভাবিক মানুষের মতো আচরণ করে যেতে হলো। তাইতো?’
ড. বাতেন থামার পরও দীর্ঘ সময় চুপ করে রইলো রাফি। বাতেন বললেন, ‘আপনাকে কথা বলতে হবে রাফি। কথা না বললে আপনার সমস্যার সমাধান আমি কী করে করব? আমার ধারণা কি ঠিক?
রাফি এবারও কথা বলল না। তবে ওপর নিচ মাথা নাড়ল। ড. বাতেন বললেন, ‘এখন সবচেয়ে প্রথম কাজ হচ্ছে ঘটনাটা আমাকে খুলে বলা। সেটা যত ভয়ংকরই হোক না কেন। আপনি ঘটনা খুলে না বললে আমি কিন্তু আপনার জন্য কিছুই করতে পারব না। আপনি কি ঘটনাটা আমাকে খুলে বলতে চান?
রাফি একবার চোখ তুলে ড. বাতেনের চোখের দিকে তাকাল। তার চোখ টকটকে লাল। কিছুক্ষণ নিষ্পলক তাকিয়ে থেকে সে আবার তার চোখ সরিয়ে নিল। তবে কোনো জবাব দিল না সে। ড. বাতেন তার চেয়ার থেকে উঠে এসে রাফির পাশে দাঁড়ালেন। তারপর তার কাঁধে হাত রেখে বললেন, যত খারাপ ঘটনাই হোক না কেন, আপনি আমাকে নিশ্চিন্তে বলতে পারেন। ইউ আর মাই প্যাশেন্ট। সো আই উইল নেভার ডিসক্লোজ ইওর সিক্রেট। আমি কখনো কোনো সিচ্যুয়েশনেই আমার ক্লায়েন্টের কোনো গোপনীয়তাই প্রকাশ করি না। ইট উইল অলয়েজ বি সিক্রেট। ডোন্ট ওরি।
তিনি গিয়ে তার চেয়ারে বসলেন। তারপর স্পষ্ট গলায় বললেন, ‘এখন সিদ্ধান্ত আপনার।’
রাফি আরো কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলো। ড. বাতেনও। দুজনের কেউই কোনো কথা বলছে না। ঘরে পিনপতন নীরবতা। তবে খানিক পর হঠাৎই যেন দেয়াল ঘড়ির টিকটিক শব্দটা কানে বাজতে শুরু করল। ওই শব্দটাই যেন ঘরের এই নীরবতাটাকে আরো গাঢ় করে তুলেছে। রাফি আরো খানিক বসে থেকে আচমকা উঠে দাঁড়াল। তারপর হনহন করে হেঁটে চলে গেল ঘরের বাইরে। ড. বাতেন অবশ্য বিচলিত হলেন না। তিনি খোলা দরজার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার এসিসট্যান্ট সেই দরজায় উঁকি মেরে বলল, ‘নেক্সট প্যাশেন্ট আসতে বলব স্যার?’
ড. বাতেন মৃদু হেসে বললেন, ‘নাহ। এই যে ছেলেটা বেরিয়ে গেল, ও আবার আসবে। ওর আসা পর্যন্ত একটু অপেক্ষা করো।’
রাফি অবশ্য এলোও। সে এসে কাউকে কিছু না বলে গটমট করে ড. বাতেনের রুমে ঢুকে পড়ল। তারপর তার টেবিলের সামনে সামান্য ঝুঁকে স্পষ্ট, শান্ত কণ্ঠে বলল, ‘আই কিলড সামওয়ান। আমি একজনকে খুন করেছি।’
.
সেদিন রাতেই আতাহার মিয়াকে পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিট থেকে ফোন করে একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানানো হলো। তথ্যটি হলো রফিকুল আলম তার গোপন ফোন থেকে যে একটিমাত্র নম্বরে কথা বলতেন, সেই নম্বরটির কল লিস্টও উদ্ধার করা হয়েছে। ফোন নম্বরটি থেকে রফিকুল আলম ছাড়াও আরো একটি নম্বরে বছরখানেক আগেই বার দুয়েক ফোন করা হয়েছিল। রহস্যময় ব্যাপার হচ্ছে সেই নম্বরটি রাফির!