৪৮
একটা বাড়ি। বাড়িটার কোনো নাম নেই। সেই নামহীন বাড়িটার তবু প্রাণ ছিল। বাড়িটা অকস্মাৎ প্রাণহীন হয়ে গেল। বাড়ির প্রাণ মূলত মানুষ। মানুষবিহীন বাড়ি কেবল ইটকাঠের কাঠামো। সেখানে প্রাণ নেই। বেঁচে থাকার ঘ্রাণ নেই। শব্দ নেই, কোলাহল নেই। হৃদস্পন্দন নেই। অথচ এই বাড়িটাতে এখনো মানুষ আছে। এই বাড়ির প্রতিটি ঘরে ঘরে তারা এখনো নিঃশ্বাস নিচ্ছে। তাদের হৃৎস্পন্দন আছে। কিন্তু সেই নিঃশ্বাস কিংবা হৃৎস্পন্দনে কোনো শব্দ নেই। যেন শব্দ হলেই অন্য কেউ তীব্র আতঙ্কে কেঁপে উঠবে। ডুকরে কেঁদে উঠবে। মানুষ মূলত মরে যায় মনে। এই মানুষগুলোও মনে মনে মৃত। যেন পাশাপাশি ঘরগুলো পাশাপাশি কবর। যেন প্রতিটি কবরে একেকটা নিষ্প্রাণ লাশ। আর বাড়িটা আস্ত এক গোরস্থান। এক নিঃশব্দ, প্রাণহীন, নির্জীব গোরস্থান।
একটা রাত। এক ভয়াল দুঃস্বপ্নের রাত। অসংখ্য স্বপ্ন আর সম্ভাবনার অবিশ্বাস্য যবনিকাপাত। জীবন যেন তার বুকভর্তি জমিয়ে রেখেছিল তীব্র গরল। সেই গরল সে ঢেলে দিল ভয়াল সেই কাল রাত্তিরেই। তারপর কত দিন এলো। কত রাত এলো। কিন্তু সেই রাত্রি আর কাটে না। যেন আরো গাঢ় হয়। যেন আরো জেঁকে বসে বুকের ভেতর। যেন আরো তীব্র শোকে চোখজুড়ে স্থির হয়ে থাকে। গেড়ে বসে আরো গভীরে। যেন এর থেকে মুক্তি নেই। আফজাল আহমেদ শূন্য চোখে বসে থাকেন। মছিদা বেগম কারো সাথে কথা বলেন না। সেলিনা আর মুখরা নেই। সে সারাক্ষণ চুপচাপ বাবার পাশে বসে থাকে। তারপর হাউমাউ করে কাঁদে, ‘বাবা, বাবা।’
আফজাল আহমেদ জবাব দেন না। সেলিনা চিৎকার করে ডাকে, ‘মা, মা, ও মা।’
মছিদা বেগম কথা বলেন না। সেলিনা বলে, ‘দিপুর কী হবে মা? নাদিয়ার কি হবে? ও মা, দিপুর কি হবে?’
মছিদা বেগম পাথরের মূর্তির মতো তাকিয়ে আছেন দেয়ালে। সেখানে একা এক টিকটিকি। আলোর কাছে ওত পেতে বসে আছে। একটা দুটো পোকা গিয়ে ভিড় করছে। সেই পোকাগুলো কি জানে, আর খানিক বাদেই কী ভয়াবহ বিপদ নেমে আসবে তাদের ওপর? জানে না। মানুষও জানে না। কত শত স্বপ্ন তাই সে বুকে পুষে রাখে, কিন্তু তার সেই স্বপ্ন হঠাৎ দপ করে নিভে যায়। নাকি স্বপ্ন কখনো নেভে না? কেবল মানুষই নিভে যায়? কিন্তু মানুষবিহীন স্বপ্ন কি কখনো হয়?
তাহলে নাদিয়া? নাদিয়ার স্বপ্নের কী হবে? সে কি অমন স্বপ্নহীন, বিবর্ণ, ধূসর আর দুঃসহ, কুৎসিত স্মৃতির এক মানুষ হয়েই বেঁচে থাকবে? মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসে সে কি মৃত্যুর চেয়ে ভয়ংকর এক জীবন নিয়ে বেঁচে থাকবে? জীবন এমন কেন?
সেলিনা চিৎকার করে বলে, ‘ও মা, মা। দিপুর কি হবে? বাবা, নাদিয়া… নাদিয়াকে নিয়ে এখন কী হবে? বাবা, ও বাবা… দিপুর কী হবে?’
কেউ কোনো কথা বলে না। যেন নিঃশব্দ এক গোরস্থানে সারি সারি লাশ নিশ্চুপ শুয়ে আছে। বসে আছে। দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মুখে কোনো শব্দ নেই। শরীরে কোনো শক্তি নেই। কেবল বুকের ভেতর বয়ে যাচ্ছে সুতীব্র যন্ত্রণার সুগভীর এক নদী। সেলিনা তার জমানো সব টাকা, সব গয়না এনে বাবার সামনে রাখল। তারপর বলল, ‘আমার সব গয়না আমি বিক্রি করে দেব বাবা। আমার কাছে যেখানে যা ছিল, তার সব। তুমি শুধু দিপুকে ছাড়িয়ে আনার ব্যবস্থা করো। বাবা, ও বাবা, বাবা।’
হাফসা বেগমের জ্ঞান ফিরেছে দিন কতক হলো। তবে এই জ্ঞান ফেরার চেয়ে না ফেরাই ভালো ছিল। তিনি যেন পুরোপুরি পাগল হয়ে গেছেন। কাউকে চিনতে পারছেন না। তার সামনে কেউ গেলেই জান্তব চিৎকারে উন্মাদ হয়ে যাচ্ছেন। আশফাক আহমেদ পাথরের মূর্তির মতো নিথর, নিশ্চল। নাদিয়া হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছে। বাড়ি ফেরার পর থেকে সে এখনো কারো সাথে কোনো কথা বলেনি। সারাক্ষণ অন্ধকার ঘরে চুপচাপ শুয়ে থাকে। তবে তার ঘুম হয় না। খানিক তন্দ্রার মতো পেলেই ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে ওঠে সে। নাবিলা ফরিদপুর থেকে চলে এসেছে। সে সারাক্ষণ নাদিয়ার পাশে বসে থাকে। নাবিলা রাতে বোনকে বুকের ভেতর চেপে ধরে কত কী করে! কিন্তু নাদিয়া তা বোঝে কিনা বোঝা যায়না।
নাবিলা বলে, ‘তুই আমার সাথে একটু কথা বলবি না সোনা?’
নাদিয়া ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। নাবিলা বলে, ‘ও সোনা, সোনা বোন আমার, তুই একটু আমার সাথে কথা বল। একটুখানি কথা বল। তুই কথা না বললে যে আমার বুক শুকিয়ে যায়। কান্না কান্না লাগে। তুই জানিস না? ও বোন। বোন রে…।’
নাদিয়া কথা বলে না। নাবিলা বলে, ‘তোর মনে নেই, তুই একবার আমার সাথে ঝগড়া করে মেজো খালার বাড়ি চলে গেলি। আমি যে কী খুশি হয়েছিলাম, একা একা আরাম করে কটা দিন থাকা যাবে। কিন্তু রাত হতেই আমার কেমন কান্না কান্না লাগতে লাগল। মনে হলো সারা বাড়িতে কেউ নেই। কেউ না। আমার হঠাৎ সবকিছু এত শূন্য লাগতে শুরু করল। রাতে একা ঘুমাতে গিয়ে চোখ বন্ধ করতেই মনে হলো, তুই আমার পাশে শুয়ে শুয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছিস। আমি ঝট করে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি তুই নাই। আমি আবার চোখ বন্ধ করি। আমার আবার মনে হয়, তুই আমার পাশে শুয়ে শুয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছিস। আমি সেই মাঝরাতে বাবা-মার রুমে গিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলাম। আমি তোকে ছাড়া রাতে থাকতে পারব না। তোর মনে নেই বোন? ও বোন তোর মনে নেই?’
নাদিয়া শূন্য চোখে ছাদের দিকে তাকিয়ে আছে। নাবিলা বলল, ‘তোর কিছু মনে নেই? সেই মাঝরাতে বাবা আমাকে নিয়ে মেজো খালার বাড়িতে গেলেন। কাক ভোরে মেজো খালাদের বাড়িতে গিয়ে দেখি ওই বাড়ির সবাই জেগে আছে। কারণ মাঝরাতে ঘুম ভেঙে বাড়ি ফেরার জন্য তোর সে কী কান্না! সকাল অবধি ও তর সইছে না। তোর মনে নেই? আমাকে দেখে তুই পাগলের মতো ছুটে এলি। তারপর জড়িয়ে ধরে সে কী কান্না। তোর একদম মনে নেই?’
নাদিয়া কথা বলে না। তবে নাবিলা সারাটাক্ষণ এমন কত কত কথা, কত কত গল্প যে বলে যায়, তার ইয়ত্তা নেই। গল্প বলতে বলতে মাঝে মাঝে তার চোখের কোণে জল জমে। সেই জল ফোঁটায় ফোঁটায় গড়িয়ে পড়ে নাদিয়ার কোলে। নাদিয়া ভাবলেশহীন চোখে তাকিয়ে থাকে। যেন এই জগতের কোনো কান্না, কোনো আনন্দ, কোনো স্মৃতি, কোনো অনুভূতি তাকে ছুঁয়ে যায় না। সে যেন সকল কিছু ছাড়িয়ে অনুভূতিহীন, স্মৃতিহীন এক মানুষ। যেন তার আর কোনো আনন্দ বেদনার অনুভব নেই!
মুকিত অবশ্য আর এ বাড়িতে আসে না। ফোনও করে না। জাহানারা কয়েকবার মুকিতের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু মুকিত তখন ব্যস্ত। ইউনিভার্সিটিতে তার জরুরি পরীক্ষা চলছে। এই মুহূর্তে সে কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। জাহানারা অবশ্য মুকিতের মাকে ফোন করলেন। তিনি প্রথম কয়েকদিন জাহানারার ফোন ধরেননি। পরে অন্য অচেনা নম্বর থেকে ফোন দিতে ধরলেন। জাহানারা সালাম দিতেই তিনি অপরিচিত মানুষের কণ্ঠে বললেন, ‘ও, আপনে?’
‘জি, কেমন আছেন আপা?’
‘এইতো রাখছে আল্লাহয় কোনো মতে। বাতের ব্যথায় আর বাঁচি না।’
‘ওহ, তা এখন কী অবস্থা?’
‘অবস্থা আর কী হবে! আল্লাহয় যেমন রাখছে, তেমনই থাকতে হবে।’
জাহানারা অনেক ইতস্তত করে অবশেষে কথাটা বললেন,
বললেন, ‘আপা, নাদিয়াকেতো একটু দেখতেও এলেন না!’
মুকিতের মা পান খাচ্ছিলেন। তিনি পান মুখে নেয়া অবস্থায়ই গমগম করে বললেন, ‘এই অবস্থায় ওইখানে দূরের মানুষ যত কম যাওয়া যায়, ততই ভালো। এই সময়ে আপনা মানুষের কাছে থাকা দরকার।’
‘আপনিতো আর দূরের মানুষ না আপা? আপনারাইতো সবচেয়ে কাছের মানুষ।’
মুকিতের মা পানের পিক ফেলতে ফেলতে বললেন, ‘কাছের মানুষ আর হতে পারলাম কই?’
‘কেন আপা!’
‘কেন আপা মানে? আপনি কি কচি খুকি নাকি? এমন ভাব করছেন যেন কিছুই বোঝেন না, জানেন না। দুনিয়ার সব মানুষ জানে। সব পত্রপত্রিকা, রেডিও টিভিতে খবর আসছে। আর আপনি এখন জিজ্ঞেস করছেন কেন আপা? যেন কিছুই হয় নাই। যেন কিছুই জানেন না আপনি!’
‘আপা, এটাতো একটা দুর্ঘটনা।’
‘তো দুর্ঘটনা হলে আমি কী করব? এই মেয়ে আমি ঘরে তুলতে পারব? আপনি পারবেন এই মেয়ে আপনার ছেলের বউ করে ঘরে তুলতে? দুনিয়ার মানুষ কী বলবে একবার চিন্তা করেনতো?’
‘আপা, কেন পারব না? আমার ছেলে থাকলে আর সেই ছেলের সাথে যদি বিয়ের কথাবার্তা এভাবে ফাইনাল থাকত, আমি অবশ্যই…।’
‘থামেন থামেন। নিজের কাঁধে না পড়লে এসব বড় বড় কথা সবাই বলতে পারে। কিন্তু কাজ করার বেলায় দেখা যায়। আর একটা কথা সত্যি করে বলেনতো আপা, এই ফ্যামিলির সাথে আমাদের কোনো দিক দিয়ে যায়? মা পাগল, বাপ শুনছি বিয়েও করছে। তা ছাড়া আমাদেরতো একটা সোশ্যাল স্ট্যাটাস আছে, তাই না? এই মেয়েকে ঘরে তুললে আমরা আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী কারো কাছে মুখ দেখাতে পারব? আপনিই বলেন?’
পরিবর্তিত পরিস্থিতি খুব ভালোই বুঝতে পারছেন জাহানারা। তারপরও তিনি মরিয়া হয়েই বললেন, ‘এর বেশির ভাগ জেনেশুনেই কিন্তু আপনারা…।’
এবারও জাহানারাকে কথা শেষ করতে দিলেন না মুকিতের মা। তিনি খানিকটা ধমকের স্বরেই বললেন, ‘শোনেন আপা, এই ঘরে আমি জীবনেও আমার ছেলেরে বিয়ে দিতাম না। আমাদের সম্পর্কে আপনার কোনো ধারণাই নেই। শুধু ওই এক ছেলের জন্য আমি কিছু বলতে পারি নাই। মেয়ে দেখার পর ছেলে গেল পাগল হয়ে। তাকে যতকিছু বুঝাই, কোনো লাভ নাই। সে ওই মেয়েকেই বিয়ে করবে। পরে ভাবলাম, যার যার জীবন, তার তার। কিন্তু এখনতো আপা, এই মেয়ের জন্য আমি সমাজে ছোট হতে পারব না। আমার জাত-কুল সব বাদ দিতে পারব না। তাই না?
‘আপা, একবার ভাবেনতো যদি এই একই ঘটনা আপনার মেয়ের ক্ষেত্রে ঘটত, তখন আপনি কী করতেন!
মুকিতের মা কথাটা শুনে যেন তেলেবেগুনে জ্বল উঠলেন। তিনি চিৎকার করে বললেন, ‘কী বললেন আপনি? কী বললেন? আপনার এত বড় সাহস, আপনি আমার মুখের ওপর আমার মেয়েকে নিয়ে এই ধরনের কথা বলেন…।’
তিনি এরপর অকথ্য ভাষায় কথা বলতে থাকলেন জাহানারাকে। জাহানারা ফোন রেখে দীর্ঘসময় চুপ করে বসে রইলেন। একবার ভাবলেন মুকিতের বড় বোনকে ফোন দেন। কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে হলো, তাতে কোনো লাভ হবে না। বরং মুকিতকে যদি সরাসরি কোথাও ধরা যায়। কেবল মুকিত রাজি হলেই এই সম্পর্ক সম্ভব। অন্য কোনোভাবেই না। যেহেতু নাদিয়ার প্রতি মুকিতের এক ধরনের প্রচণ্ড ভালোলাগা ছিল, সেহেতু মুকিতই এখন একমাত্র ভরসা!
তিনি মুকিতকে একদিন সরাসরি তার ইউনিভার্সিটিতেই ধরলেন। মুকিত তখন দিনের শেষ ক্লাসটি নিয়ে কেবল তার রুমে ঢুকেছে। সেই মুহূর্তে জাহানারা হাজির হলেন। তিনি মুকিতকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বললেন, ‘আমার কিছু কথা তোমার শুনতেই হবে বাবা।’
মুকিত অবশ্য তার কথা শুনল। সে শান্ত ভঙ্গিতে বলল, ‘আপনি বসুন। আমি চা দিতে বলি?’
‘আমার চা লাগবে না বাবা। তুমি আমার কথা কয়েকটা একটু শোনো।’
‘জি বলুন।
‘এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল, নাদিয়াকেতো তুমি একটু দেখতেও গেলেনা বাবা?’
‘আমি খুব ব্যস্ত ছিলাম খালা। ইউনিভার্সিটিতে ছেলে-মেয়েদের পরীক্ষা চলছিল।’
‘এখনতো পরীক্ষা শেষ, এখনতো একটু যেতে পারো?’
মুকিত কোনো কথা বলল না। জাহানারাই বললেন, ‘তুমি শিক্ষিত মানুষ। তোমাকেতো আর আমার বোঝানোর কিছু নেই। এইসময়ে তার সবচেয়ে বেশি দরকার তোমাকে। তুমি যদি একটু তার পাশে গিয়ে শক্ত করে তার হাতটা ধরো, একটু সাহস দাও, দেখবা সে সবকিছু ভুলে যাবে। দ্রুত সুস্থ হয়ে যাবে। তোমার একটু যাওয়া উচিত বাবা।’
মুকিত ইতস্তত করে বলল, ‘একটু সমস্যা আছে খালা।’
‘কী সমস্যা?’
‘মা বা বড় আপা কেউই চান না যে এই বিষয়টাতে আমি আর ইনভলভ হই!’ মুকিতের কথায় জাহানারা যেন খানিক আশার আলো খুঁজে পেলেন। মুকিততো এখনো তার নিজের ইচ্ছের কথা কিছু বলেনি। জাহানারা উৎসাহী গলায় বললেন, ‘তারা আগের মানুষ। তাদের ধ্যান-ধারণাও তেমন। কিন্তু তুমিতো বাবা শিক্ষিত, আধুনিক মানুষ। তোমার নিজেরতো একটা বিচার-বিবেচনা আছে, আছে না? তা ছাড়া তুমিতো নাদিয়াকে পছন্দ করো। আর নাদিয়াও তোমাকে পছন্দ করে!
‘সবই ঠিক আছে খালা। কিন্তু আমিতো আমার ফ্যামিলির সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কিছু করতে পারি না, তাই না?’
‘তুমি এখন বড় হয়েছো, তোমার একটা সিদ্ধান্ত আছে না?’
‘খালা, আমার বাবার মৃত্যুর পর আমার মা-ই আমার সব। তার কারণেই আমি যতটুকু যা করেছি। এখন তার সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কিছু করা আমার পক্ষে সম্ভব না।’
কিন্তু তোমার মায়ের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়েই কিন্তু তুমি নাদিয়াকে পছন্দ করেছিলে? তখন?’
‘হ্যাঁ, করেছিলাম। কিন্তু তখন সিচ্যুয়েশন ভিন্ন ছিল। আর মা তখন রাজিও হয়েছিল। কিন্তু খালা বুঝতেই পারছেন, এখন সিচ্যুয়েশন চেঞ্জ হয়ে গেছে। তা ছাড়া, আমার একটা সার্কেল আছে। সেই সার্কেলটা আমাকে মেইনটেইন করতে হয়। এই ঘটনা এখন সবার মুখে মুখে। আপনি একবার আমার কথা চিন্তা করেন, আমি এই কাজ করলে কাউকে মুখ দেখাতে পারব? তা ছাড়া এখন আমি চাইলেই অনেক কিছু করতে পারি না। আমার একটা পরিচিতি আছে, সম্মান আছে। এখন কিছু করার আগে আমাকে অনেক চিন্তা-ভাবনা করে কাজ করতে হয়
জাহানারা বেপরোয়া ভঙ্গিতে বললেন, ‘আচ্ছা মুকিত, আমাকে একটা কথা বলোতো বাবা?’
‘জি?’
‘এতদিনে কিন্তু নাদিয়ার সাথে তোমার বিয়েটা হয়েও যেতে পারত, পারত না?’
মুকিত জবাব দিল না। তবে কঠিন চোখে সে জাহানারার দিকে তাকিয়ে রইলো। জাহানারা বললেন, ‘তো নাদিয়ার সাথে যদি তোমার বিয়েটা হয়ে যেত, তখনতো নাদিয়া তোমার স্ত্রী হতো তাই না?’
মুকিত এবারও জবাব দিল না। জাহানারা বললেন, ‘তো তখন এই ঘটনা ঘটলে তুমি কী করতে? তোমার স্ত্রীকে কেউ রেপ করলে তুমি তোমার স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দিতে? ছেড়ে দিতে তাকে?’
মুকিত এই প্রশ্নেরও জবাব দিল না। তবে তার সময় শেষ এমন ভঙ্গিতে সে উঠে দাঁড়াল। জাহানারা অবশ্য উঠলেন না। তিনি তারপরও বললেন, ‘আমি জানি না তুমি কাকে বিয়ে করবে, কিন্তু একটা প্রশ্নের উত্তর আমাকে তোমার দিতেই হবে। আল্লাহ না করুক, তোমার ভবিষ্যৎ স্ত্রীর সাথে যদি এমন ঘটনা ঘটে, তাহলে তখন তাকে তুমি তালাক দিয়ে দেবে? ডিভোর্স দিয়ে দেবে? বা ধরো, তোমার মা কিংবা বোনের সাথে যদি এমন ঘটনা ঘটে, তাহলে তুমি আর তাদের তোমার মা বা বোন বলে পরিচয় দেবে না?’
এই প্রথম মুকিতের বিনয়ের খোলসটা যেন ঝরে পড়ল। সে হঠাৎই উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, ‘আপনি এখন, এই মুহূর্তে আমার রুম থেকে বের হন। এক্ষুণি বের হন। না হলে খুব বাজেভাবে আমি আপনাকে এখান থেকে বের করব। এক্ষুনি বের হন। এক্ষুনি।’
জাহানারা অবশ্য উত্তেজিত হলেন না। তিনি হাসলেন, ‘কীভাবে বের করবে, গলা ধাক্কা দিয়ে? আমার কিন্তু গলগণ্ডের সমস্যা আছে বাবা। ‘
জাহানারার কথা শুনে মুকিত খানিক অবাক হয়ে গেল। এখানে এই পরিস্থিতিতে সে জাহানারার কাছ থেকে এমন আচরণ আশা করেনি। জাহানারা এদিক সেদিক তাকিয়ে হঠাৎ ফিসফিস করে বললেন, ‘তোমার সাথে আমার একটা খুব জরুরি কথা আছে। কথাটা মন দিয়ে শুনবা।’
মুকিত উৎসুক চোখে তাকাল। জাহানারা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললেন, ‘ডাস্টবিন দেখলে আমি সহ্য করতে পারি না বাবা। সাথে সাথে আমার বমি চলে আসে। কিন্তু তোমাদের এখানেতো মনে হয় বমি করা যাবে না, এইজন্য ডাস্টবিন দেখেও আমি বমি করতে পারলাম না। তবে থুতুতো ফেলা যাবে, কি বলো?’
মুকিত জাহানারার কথা কিছুই বুঝতে পারল না। সে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। জাহানারা শান্ত ও নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন, ‘আমি তাই সেই ডাস্টবিনের উপর থুতু ফেলে গেলাম। থুতু। ওয়াক থুঃ।’
জাহানারা শব্দ করে এক দলা ঘন আঠালো থুতু ফেললেন মুকিতের মুখের ওপর। তারপর হনহন করে হেঁটে বেরিয়ে এলেন মুকিতের ঘর থেকে। মুকিত তার মুখভর্তি সেই ঘন আঠালো থুতু নিয়ে জাহানারার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে রইলো।