৪৭
আজিজ মাস্টারের মন খুব অস্থির লাগছিল। তিনি সকালে ঘুম থেকে উঠে স্কুলে গেলেন। কিন্তু তার মন স্থির হলো না। স্কুলে ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের সাথে অযথা দুর্ব্যবহার করলেন। দুপুরে তার অস্থিরতার মাত্রা আরো বাড়ল। আকাশ মেঘলা। ঝড়ো হাওয়া বইছে। আজিজ মাস্টারের মনে হলো, এই ঝড়ো হাওয়া যতটা না বাইরে বইছে, তার চেয়ে বেশি বইছে তার মনে। কিন্তু এর কারণ তিনি খুঁজে পেলেন না। দুপুরে তিনি স্কুলের সহকারি শিক্ষক আলমগীর মিয়াকে ডেকে বললেন, ‘আমার শরীরটা ভালো লাগছে না আলমগীর সাব।’
.
আলমগীর মিয়া তটস্থ ভঙ্গিতে বললেন, ‘শ্বাসকষ্টটা আবার বাড়ছেনি স্যার?’
আজিজ মাস্টার রুগ্ন গলায় বললেন, ‘বাড়তেও পারে, নাও বাড়তে পারে। তবে অস্থির অস্থির লাগছে। মনে হচ্ছে বুকের ভেতরে শুকনা পাতা জড় করে কেউ সেই পাতায় আগুন ধরাই দিছে।’
‘আপনার প্রেসার মাপাইছেন স্যার? প্রেসার ঠিক আছে?’
আজিজ মাস্টার বিরক্ত গলায় বললেন, ‘ধুত্তুরি! এইসব হাবিজাবি কথা বাদ দিয়ে আপনি এক কাজ করেন, ক্লাস ফোর আর ফাইভে আমার দুটা ক্লাস আছে, সেই ক্লাস দুইটা নেন। আমি বাড়ি যাব।’
আলমগীর মিয়া অবাক চোখে আজিজ মাস্টারের দিকে তাকিয়ে থাকলেও কিছু বললেন না। আজিজ মাস্টার ছাতা মাথায় বাড়ি ফিরলেন। বাড়ি ফিরতে গিয়ে কাদা রাস্তায় আছাড় খেলেন। তার ধোয়া ধবধবে সাদা পাঞ্জাবী কাদা জলে মাখামাখি হলো। তিনি সেই কাদা জলে মাখা পাঞ্জাবী পরেই বাড়ির উঠানে গিয়ে দাঁড়ালেন। তারপর চিৎকার করে সুমির মাকে ডাকলেন, ‘সুমির মা, ও সুমির মা’। সুমির মা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন। আজিজ মাস্টার বললেন, ‘আলনার সাথে ঝোলান আমার কালো ব্যাগটা দাও।’
‘কালো ব্যাগ দিয়ে এখন কী করবেন?’
‘ঢাকায় যাবো। ওই ব্যাগে জামা কাপড় ভাঁজ করাই আছে। কুইক’।
‘আপনি এখন ঢাকা যাবেন? এই অবস্থায়?’
‘এই অবস্থায় ঢাকা যাবো মানে? অবস্থা কী?’
‘কথা নাই বার্তা নাই, হঠাৎ ঢাকা কী? আর আপনার জামা কাপড়ের অবস্থা দেখছেন?’
আজিজ মাস্টার তিরিক্ষি গলায় বললেন, ‘আজিজ মাস্টার জামা কাপড় ছাড়া ঢাকা গেলেও লোকে তারে চেনে। চেনা বামুনের যেমন পৈতা লাগেনা, তেমনি আজিজ মাস্টারেরও ভালো জামা কাপড় লাগেনা।’
‘আসমানের অবস্থা দেখছেন? এই ঝড় বৃষ্টির মধ্যে…।’
সুমির মা কথা শেষ করতে পারলেন না। তার আগেই আজিজ মাস্টার খেঁকিয়ে উঠলেন, ‘ঝড় বৃষ্টি হইলে তুমি খাটের তলায় গিয়ে বইসা থাকো। আমি যেইটা বলছি সেইটা কর।’
লঞ্চের তখনও দেরি। আজিজ মাস্টার একা একা সন্ধ্যা অবধি লঞ্চঘাটে দাঁড়িয়ে রইলেন। লঞ্চ এলেও অবশ্য খুব একটা যাত্রীর দেখা মিললো না। নদী পথে ঝড় বৃষ্টির ভয়ে সবাই সতর্ক। আজিজ মাস্টার পরদিন ভোরে ঢাকা পৌঁছালেন। তিনি যখন সুমির হলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন, তখনও হলের গেট খোলেনি। সুমিকে চমকে দিবেন বলে তিনি হল খোলা অবধি অপেক্ষা করলেন। একা একা দীর্ঘসময় তিনি হলের গেটে বসে রইলেন। খানিক আলো ফুটলে হলের গেট খুললো। আজিজ মাস্টার ভাবলেন তিনি সুমিকে সরাসরি ফোন করবেন না। কারো কাছে সুমির রুম নম্বর লিখে একটা চিরকুট পাঠাবেন। সুমি নিশ্চয়ই এত ভোরে এই ঝড় বৃষ্টির মধ্যে সেই চিরকুট দেখে চমকে যাবে। হলে ঢুকছে এমন এক ছাত্রীকে পেয়ে আজিজ মাস্টার চিরকুট লিখে দিলেন, ‘মা গো, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তার মাকে দেখার জন্য ঝড়ের রাতে নদী সাঁতরে পারি দিয়েছিলেন। আজিজ মাস্টারেরতো আর মা নেই। এইজন্য সে তার মেয়েকে দেখার জন্য ঝড়ের রাতে নদী পারি দিয়ে ঢাকায় চলে এসেছে। এই মেয়েই তার মা। সে এখন এতিম ছেলের মতো মায়ের অপেক্ষায় গেটে দাঁড়িয়ে আছে।’
.
আজিজ মাস্টার সুমির অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইলেন। সুমি অবশ্য এলো না। এলো সেই মেয়েটিই। সে এসে বললো, সুমির রুমমেট জানিয়েছে, সুমি নাকি পরশু তার কোন চাচার বাসায় গিয়েছে। সে এখনো আসেনি। আজিজ মাস্টার একটু অবাক হলেন। সুমিতো তাকে না জানিয়ে কখনো কোথাও যায়না। তিনি চিন্তিত মুখে সুমির ফোন নম্বরে ফোন করলেন। প্রথম কিছুক্ষণ সেই ফোন কেউ ধরল না। অনেকক্ষণপর সেই ফোন ধরল একটি পুরুষ কণ্ঠ। আজিজ মাস্টার সেই পুরুষ কণ্ঠের সাথে কথা বললেন না। কিছু বলার আগেই ফোন কেটে দিলেন। তিনি ভেবেছেন, ভুলে অন্য কোনো নম্বরে হয়তো ফোন করে ফেলেছেন। তিনি কেটে আবারো ফোন করলেন। আবারো ফোন ধরলো সেই পুরুষ কণ্ঠটিই। আজিজ মাস্টার রাগান্বিত কণ্ঠে বললেন, ‘কে আপনি? এই ফোন আপনার কাছে কেনো? আমার মেয়ে সুমি কই? সুমি?’
ফোনের ওপারে বান্দরবান থানার ওসি। তিনি আজিজ মাস্টারকে কী বললেন কে জানে! আজিজ মাস্টারকে দেখা গেলো পাগলের মতো মেয়েদের হলের গেটের দিকে ছুটে যেতে। কিন্তু তিনি গেট পেরিয়ে হলের ভেতরে ঢুকতে পারলেন না। দারোয়ান তাকে আটকাল। আজিজ মাস্টার অবশ্য তাতে দমলেন না। তিনি চিৎকার করে বলতে লাগলেন, ‘আমার মায় এইখানে থাকে, আমার সুমি মায়। চারশো তিরিশ নম্বর রুম আমার মায়ের। আপনেরা আমারে একটু ঢুকতে দেন। তার ফোন চুরি হইছে। সেই ফোন নিয়া কে একজন উল্টপাল্টা বলতেছে। বলতেছে সে নাকি বান্দরবান থানার ওসি। আরো কীসব আবোল তাবোল বকতেছে। ও ভাই, ভাই, ভাইগো, আমার মায়ের কাছে একটু আমারে যাইতে দেন। আমার সুমি মায়। চারশো তিরিশ নম্বর রুম। ও বাবা, বাবাগো, আমার মার কাছে একটু যাইতে দেন। চারশো তিরিশ নম্বর রুম। আমার মায় থাকে ওইখানে। ও মা মাগো, ও সুমি মারে। সুমিগো… ও সুমি… সুমি… সুমি… মা, ও মা, মাগো…।’