1 of 2

অর্ধবৃত্ত – ৪৫

৪৫

দিপুর মন খারাপ। সে থমথমে গলায় বলল, ‘দেখলে আমার ভাগ্য?’

সুমি বলল, ‘কেন, কী হয়েছে?’

‘কী হয়েছে মানে? সারাটা দিন কী ঝলমলে রোদ ছিল। আর বিকেল হতেই আকাশের অবস্থা দেখেছো?’

‘তাতে কী? এই মেঘে ঢেকে থাকা পূর্ণিমাও কিন্তু সুন্দর!’

‘তোমার যতসব উদ্ভট কথা। কই পাহাড়ের ওপর থেকে সারারাত জোছনা দেখব, আর সেখানে আকাশ কালো করে মেঘ করল। বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ঝড়ও হবে কিনা কে জানে!’

সুমি দিপুকে শান্ত করার চেষ্টা করল, ‘আমার কিন্তু ভালো লাগছে। হোটেলটা এত সুন্দর! পাহাড়ের গা ঘেঁষে এত উঁচুতে এত দারুণ হোটেল হতে পারে আমি ভাবিইনি কখনো। আর বারান্দাটা এত দারুণ!’

দিপু ঠোঁট ওল্টাল, ‘এখনতো সবই ভালো লাগছে। কিন্তু পেইনতো কম দাওনি। কম দিয়েছো?’

সুমি হাসল, ‘সব কিছু সহজে পেয়ে গেলে, পাওয়ার আনন্দটাও কম হয় বুঝলে?’

দিপু যেন খানিক প্রশ্রয় পেল, ‘তাহলে আজ সবকিছু পেয়ে যাব বলছো? কখন? কখন? বলনা…।’

সুমি কপট রাগের ভঙ্গিতে বলল, ‘খবরদার। উল্টাপাল্টা কিছু একদম বলা যাবে না। শুধু তোমার মন খারাপ হবে বলেই একরুমে থাকতে রাজি হয়েছি আমি। না হলে কিন্তু এখনো সময় আছে, অন্য রুমে চলে যাব।’

‘অন্য রুম ফাঁকা থাকলেতো! গভমেন্ট হলিডের কারণে হোটেলের অবস্থা দেখোনি?’

‘তাহলে আর কী? উল্টাপাল্টা কিছু মাথায় আনলে তোমাকে বারান্দায় পাঠিয়ে দেব। তুমি সারারাত বৃষ্টিতে ভিজে বারান্দায় বসে থাকবে। আর আমি আরাম করে কম্বল গায়ে ঘুমিয়ে থাকব।

দিপু আত্মবিশ্বাসী গলায় বলল, ‘রাততো আগে বাড়ুক। তারপর দেখা যাবে কে কোথায় ঘুমায়!’

বারান্দার ওপরটা চমৎকার। চাইলেই মাথার ওপর বাঁশের চাটাইয়ের মতো একটা ছাদ মেলে দেয়া যায়। আবার প্রয়োজনে সরিয়েও নেয়া যায়। বৃষ্টিটা বন্ধ হয়েছে। তবে আকাশ এখনো মেঘলা। গভীর রাতে ছাদবিহীন বারান্দায় খোলা আকাশের নিচে বসে আছে তারা। সামনে বিস্তীর্ণ পাহাড় সারি। আকাশে মস্ত চাঁদের ঝলকানি। কিন্তু সেই চাঁদ দেখা যাচ্ছে না। তবে মেঘে ঢাকা চাঁদের আলো ছিটকে বেরিয়ে আসতে চাইছে যেন। সেই আলো কেমন রহস্যময়। কেমন অপার্থিব। সুমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো। দিপু বলল, ‘বৃষ্টি নামবে কিন্তু।’

‘নামুক।’

‘তোমার কিন্তু সমস্যা হবে।’

‘হোক।’

‘এমনিতেই কিন্তু সারাটা পথ তোমার শ্বাসের প্রবলেম হয়েছে। এখন আবার ঠাণ্ডা লাগালে সমস্যা। তার চেয়ে চলো ভেতরে কম্বলের ভেতর গিয়ে বসি।’ বলেই চোখ টিপল দিপু। তারপর ফিসফিস করে বলল, ‘একটু উষ্ণতা কিন্তু দরকার তোমার!’

সুমি কঠিন চোখে তাকাল। দিপু বলল, ‘লাভ নেই। এমন চাঁদের আলোয়, মরি যদি সেও ভালো, সে মরণ স্বর্গ সমান… মেরেও ফেলতে পারো, তবুও লাভ

হবে না।’

সুমি অবশ্য আর কথা বলল না। সে আলতো করে দিপুর কাঁধে মাথা রাখল। তারপর ফিসফিস করে বলল, ‘থ্যাংক ইউ দিপু।’

দিপু বলল, ‘থ্যাংকস কেন?’

‘এই যে এমন স্বপ্নের মতো একটা মুহূর্ত উপহার দেয়ার জন্য। আমার কী মনে হয় জানো?’

‘কী?’

‘আমি যে তোমাকে প্রায়ই বলতাম না যে আমি এমন একটা জায়গায় যেতে

চাই, যেখানে কোনো অশান্তি থাকবে না, কোনো কষ্ট থাকবে না, কোনো কোলাহল, দুশ্চিন্তা, দুঃখ থাকবে না?’

‘হুম।’

‘আমার মনে হতো, পৃথিবীর কোথাও বুঝি অমন কোনো জায়গা আর নেই।’

‘এখন কী মনে হচ্ছে?’

‘এখন মনে হচ্ছে এই আমি আমার সেই কল্পনার জায়গাটিতে চলে এসেছি। কী নিস্তব্ধ চারপাশ! কী সুনসান, শান্ত! কেবল একটা বাতাসের শব্দ। ওই শব্দটাও বুকের ভেতর কেমন শান্ত নদীর মতো অনুভব দেয়। মনে হয়, বাকিটা জীবন এখানে বসে চুপচাপ কাটিয়ে দিই। আর কোথাও যাব না, কিচ্ছু করব না। আমার কোনো তাড়া থাকবে না।’

দিপু দু হাতে আলতো করে জড়িয়ে ধরল সুমিকে। সুমি বলল, ‘আমার একটা ইচ্ছে জানো?’

‘কী?’

‘একবার বাবা-মা কে এখানে নিয়ে আসব। তারাতো কখনো কোথাও যায়নি। ওই যে গ্রাম, ওই যে বাড়ির চৌহদ্দির ভেতর ছোট্ট একটা ঘর, একটুকরো উঠান— ওর বাইরেতো কখনো আর কিছু দেখা হয়নি তাদের। একবার যদি এমন কোথাও নিয়ে আসতে পারতাম!’

দিপু তার হাতের মুঠোয় থাকা সুমির হাতটা শক্ত করে চেপে ধরল। সুমি বলল, ‘পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর জিনিস কি জানো?’

‘কী?’

মানুষের আনন্দ দেখা। ধরো তোমার কারণে কোনো মানুষ তীব্র আনন্দে ঝলমল করছে, সে তার জীবনের সবচেয়ে দুঃসহ স্মৃতি ভুলে গিয়ে মুহূর্তের জন্য হলেও পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষটা হয়ে উঠছে। ওই দৃশ্যটা দেখার চেয়ে আনন্দময় কিছু কি আর এই জগতে আছে?’

‘উহু।’

আমার খুব ইচ্ছে, আমি বাবা-মা কে এখানে নিয়ে আসব। তারপর তাদের দিকে তাকিয়ে থাকব। দেখব ওই ছাপোষা মানুষ দুটি, ওই চির ভীত, ওই আঙুলের কর গুনে হিসেব কষে জীবন কাটিয়ে দেয়া সদা সন্ত্রস্ত মানুষ দুজন তখন কী করেন? আমি সারাটাক্ষণ চুপচাপ তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে চাই। দেখতে চাই, কী করেন তারা? কেমন করে এই অন্যরকম পৃথিবীটা দেখেন?’

দিপু আলতো করে চুমু খেল সুমিকে। সুমির গাল ভেজা। সে কাঁদছে। দিপু শক্ত করে তাকে জড়িয়ে ধরল। মেঘের আড়ালে তখন পুরোপুরি ঢেকে গেছে চাঁদ। তুমুল হাওয়া বইতে শুরু করেছে। সেই হাওয়া বয়ে নিয়ে আসছে কনকনে হিম। সুমি সেই ঠাণ্ডায় কুঁকড়ে গিয়ে যেন দিপুর বুকের ভেতর ঢুকে যেতে চাইল। দিপু ফিসফিস করে বলল, ‘চলো ভেতরে যাই?’

সুমি কম্পিত কিন্তু উষ্ণ আদুরে গলায় বলল, ‘উহু। আরেকটু থাকি?’

‘তোমার ঠাণ্ডা লেগে যাবে কিন্তু।’

‘লাগুক।’ সে আদুরে বেড়ালের মতো দিপুর বুকের ভেতর গুটিসুটি মেরে শুয়ে রইলো। দিপু বলল, ‘তুমি কি জানো, পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মেয়েটা তুমি?’

‘জানি।’

‘জানো?’

‘হুম।’

‘আর আমি?’

‘পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ ছেলেটা।’

‘মানে কী?’

‘মানে হলো পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মেয়েটা পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ ছেলেটাকে ভালোবেসে ভুল করেছে।’

দিপু দু হাতে সুমির মুখ তুলে ধরলো। তারপর আধো আলোয় সুমির গভীর কালো চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ভুল করেছে?’

‘হুম।‘

‘তাহলে শুদ্ধ কী?’

সুমি দুষ্টুমির ভঙ্গিতে বলল, ‘মেয়েটারও কখনো কখনো ছেলেটার মতো খারাপ হয়ে যাওয়া। তাহলে কী আর এমন অপার্থিব মুহূর্তটা এভাবে নষ্ট হতো?’

সুমির কথা শুনে দিপু এলোমেলো হয়ে গেল। সে আচমকা তার ঠোঁট ডুবিয়ে দিল সুমির ঠোঁটে। দীর্ঘসময় পর সে গাঢ়, ভারি গলায় বলল, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি সুমি।’

সুমি কথা বলল না। সে দিপুর ঘাড়ের কাছটায় ঠোঁট গুঁজে দিল। দিপু বলল, ‘আমরা ভেতরে যাই?’

সুমি ঘোরগ্রস্ত গলায় বলল, ‘উমমম।’

তখন রাত গভীর। দূরে কোথাও নাম না জানা কোনো বাঁশির সুর। কোনো এক নিশাচর পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ। একটা দমকা হাওয়া হঠাৎ উড়িয়ে নিয়ে এলো ঝুম বৃষ্টি। সেই বৃষ্টির শব্দ অপার্থিব এক সংগীত হয়ে ঝড় তুলে দিতে থাকল বুকের ভেতর। একজোড়া তৃষ্ণার্ত মানব-মানবী যেন পরস্পরকে আকণ্ঠ তেষ্টার জলের মতো শুষে নিতে থাকল।

কিন্তু জীবনের অন্য কোথাও হয়তো লেখা ছিল অন্য কোনো পাণ্ডুলিপি। সেই পান্ডুলিপিতে জীবনের গল্পটা আর পরিপূর্ণ কোনো বৃত্ত হয়ে উঠতে পারল না। এক অর্ধবৃত্তের মতো অসমাপ্ত এক গল্প হয়েই হঠাৎ থমকে গেল। প্রচণ্ড বুকে ব্যথায় সুমি কুঁকড়ে গেল। আচমকা সে আবিষ্কার করল তার চারপাশের জগৎ বাতাস শূন্য হয়ে গেছে। সামান্য একটু অক্সিজেনের জন্য তার ফুসফুস হাঁসফাঁস করতে লাগল। সুমি হাঁ করে মুখ ভরে বাতাস টেনে নেয়ার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু পারল না। তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। সে চিৎকার করে বলল, ‘আমার ইনহেলারটা দাও দিপু, আমার ইনহেলারটা।’

দিপু আঁতিপাতি করে খুঁজেও সুমির ইনহেলারটা কোথাও পেল না। কোথাও না। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় প্রায় অবশ হয়ে থাকা সুমির সেই মুহূর্তে হঠাৎ মনে পড়লো, সে ইনহেলার আনতে ভুলে গেছে। বার দুই হেঁচকির মতো উঠল তার। সে দিপুর দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে ডাঙায় তোলা মাছের মতো হাঁ করে রইলো। সে নিঃশ্বাস নেয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। তার চোখের কোণে ফোঁটা ফোঁটা জল জমতে শুরু করেছে। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে সে বলার চেষ্টা করতে লাগল, ‘আমি বাঁচতে চাই দিপু। আমি বাঁচতে চাই।’ কিন্তু সেই কথাটা আর বলতে পারল না সে। বিছানার এক দিকে হঠাৎ কাঁত হয়ে ঢলে পড়ল। দিপু পাগলের মতো চিৎকার করে সুমিকে ডাকছে। কিন্তু সেই ডাক আর সুমি শুনতে পেল কিনা কে জানে! তার নিথর, নিস্পন্দন, নিষ্প্রাণ শরীর পড়ে রইলো ধবধবে সাদা বিছানায়।

তখন তার চোখে জমা জলের বিন্দুগুলো টপটপ করে গড়িয়ে পড়ছে বিছানায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *