৪৩
রফিকুল আলম যে নম্বরটিতে কথা বলতেন, সেই নম্বরটিও প্রায় বছরখানেক ধরে বন্ধ। ফলে সেটারও কোনো কল রেকর্ড পাওয়া গেল না। এমনকি সিমটি অব্যবহৃত থাকায় বর্তমানে সিমের লোকেশনও ট্র্যাক করা গেল না। তবে বছরখানেক আগে সিমটা সর্বশেষ যেখানে ব্যবহার করা হয়েছে সেই লোকেশন ট্র্যাক করা সম্ভব হলো। এবং সেটি স্কুল কম্পাউন্ডের ভেতরেই। বিষয়টা আতাহার মিয়াকে সন্দিগ্ধ করে তুলল। তিনি আকবর আলীর সাথে দেখা করলেন। যদিও এই ফোনের কল লিস্টে কখনোই আকবর আলীর নম্বর পাওয়া যায়নি।’
আকবর আলী দেখা হতেই বললেন, ‘কী বলেছিলাম মনে আছে?’
‘কী?’
‘মেয়ে মানুষের বুদ্ধি থাকে হাঁটুর নিচে।’
‘এটা কেন বলছেন?’
‘কারণ কেসটা যেই জায়গায় ছিল, তার চেয়ে ভালো কিছু কি আর হতে পারত? আপনিই বলেন? অথচ রফিকুল আলমের স্ত্রী কি করল, সে এমপি-মন্ত্রী ধরে তদন্তকাজটাকে ঘোলা করে ফেলল। তার কি ধারণা, আমি তার স্বামীকে খুন করেছি?’
‘আপনার কথাতো কেউ বলেনি!’
‘সবকিছু বলতে হবে কেন? আমিতো ঘাস খেয়ে বড় হইনি। চারপাশের ফিসফাসতো অনেকদিন থেকেই কানে আসে, আসে না?’
‘নিজের স্বামীর হত্যাকাণ্ডের তদন্ত অকারণে ভুল দিকে নিয়ে গেলে তারু লাভ কী?’
‘লাভতো আছেই।’
‘কী লাভ?’ আতাহার মিয়া সামনের দিকে সামান্য ঝুঁকলেন।
আকবর আলী বললেন, ‘ধরেন দলের মধ্যেইতো কয়েকজন ছিল, যাদের সাথে রফিকুল আলমের একটু-আধটু প্রতিদ্বন্দ্বীতা ছিল। থাকে না এমন?’
‘হুম। কিন্তু আপনার সাথে কি তেমন কিছু ছিল?’
‘আমার সাথে কেন থাকবে? তাকে আমি আপন ছোট ভাইয়ের মতো দেখতাম।’
‘তাহলে? তার স্ত্রী কেন আপনাকে ফাঁসাতে চাইবেন?’
‘শোনেন ওসি সাব। সে শুধু আমারে একা না, দলের আরো কয়েকজনরে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ফাঁসাতে চাইছে।’
‘কিন্তু কেন? তাতে তার লাভ কী?’
‘রফিকুল আলম যখন নমিনেশন পেল, তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই দলের আরো অনেকেই নমিনেশন চেয়েছিল। এখন বললে ভালো শোনায় না, কিন্তু তারা রফিকুলের চেয়ে যোগ্যই ছিল। তারা কিন্তু পায় নাই। এই নিয়ে ভেতরে ভেতরে একটা দ্বন্দ্বতো ছিলই। এখন তাদের ফাঁকা মাঠ না?’
‘হুম।
‘তো রফিকুল আলমের স্ত্রী যদি এখন এই সুযোগে তার স্বামীর সেই প্রতিদ্বন্দ্বীদের ঘায়েল করতে পারে, তাহলে তার লাভ না?’
‘এতে তার কী লাভ?’
‘তার লাভ হলো, এতে মাঠ ফাঁকা হয়ে যাবে, আর ফাঁকা মাঠে গোল দেয়া সহজ!’
‘তার আবার ফাঁকা মাঠ কী? সেতো আর রাজনীতি করে না যে সে এই সুযোগে ফাঁকা মাঠে গোল দেবে। রাজনীতি করতেন তার স্বামী।’
আকবর আলী হাসলেন, ‘হাসালেন ভাই। এতদিন পুলিশের চাকরি করেন আর এই সিম্পল বিষয়টা বুঝলেন না! মাঠ যদি ফাঁকা করা যায়, তাহলে রফিকুল আলমের জায়গায় সামনে নমিনেশন কে পাবে?’
‘তার স্ত্রী?’ এতক্ষণে যেন বিষয়টা খোলাসা হলো আতাহার মিয়ার কাছে। ‘তার স্ত্রীও কি রাজনীতিতে আসতে চান?’
আকবর আলী হাসলেন, ‘এতদিনে বুঝলেন? তারা পলিটিক্যাল ফ্যামিলি। আর পাবলিক সিম্প্যাথি কিন্তু এখন তার দিকেই। সো রফিকুল আলম হারলেও তার স্ত্রী কিন্তু সামনের ইলেকশনে হারবে না। সো সেও চাইবে না, দলের মধ্যে আগে যারা তার স্বামীর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল, তারা এখনো আবার তার প্রতিদ্বন্দ্বী হোক।’
‘কিন্তু স্বামীর মৃত্যুর সাথে সাথেই তিনি এতকিছু ভেবে ফেললেন?’
আকবর আলী বাঁকা ঠোঁটে হাসলেন, ‘আমিতো এতকিছু জানি না। তবে ফজলে নূরকে বাচাতে ওনারতো এভাবে উঠে পড়ে লাগার কথা না। কে জানে, ভেতরে ভেতরে কার সাথে কার কী সম্পর্ক! নাহলে ফজলে নূর ওনার স্বামীর সাথে সবার সামনেই যা করেছে, তারপরওতো ওনার তাকে সেভ করার জন্য এমন মরিয়া হওয়ার কথা না। তাই না?’
আতাহার মিয়া বিষয়টা ভাবলেন। আকবর আলী কথাটা মিথ্যে বলেননি। একটা মানুষ রাতের অন্ধকারে এভাবে খুন হয়ে গেল। কিন্তু তার কোনো ক্লু থাকবে না সেটা কী করে হয়! অথচ খুনের ধরন এবং ময়নাতদন্ত রিপোর্ট দেখে প্রথম দিকে তাদের মনেই হয়েছিল এটা কোনো পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড নয়। কিন্তু দিন যত যাচ্ছে, ততই মনে হচ্ছে এই খুনের পেছনে অন্য কোনো কারণ রয়েছে। সেই কারণ খুঁজে বের করতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। যতই মনে হচ্ছে সমাধান অতি সহজ, ততই সেটি আরো বেশি অন্ধকারাচ্ছন্ন, অস্পষ্ট, জটিল হয়ে যাচ্ছে।
তিনি দেখা করলেন রফিকুল আলমের স্ত্রী জান্নাতের সাথে। জান্নাত খুবই অসন্তোষ প্রকাশ করলেন, ‘এতদিন হয়ে গেল, অথচ এখন পর্যন্ত আপনারা কিছুই করতে পারলেন না?’
আতাহার মিয়া বললেন, ‘বিষয়টা খুবই কনফিউজিং হয়ে যাচ্ছে। আপনি কিছু মনে না করলে আপনাকে একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে চাই।’
জান্নাত কপাল কুঁচকে তাকাল, ‘ব্যক্তিগত প্রশ্ন?’
‘হুম।’
‘জি বলুন।’
‘আপনার সাথে রফিক সাহেবের আন্ডারস্ট্যান্ডিং কেমন ছিল?’
‘ভালো।
‘না মানে হয় না, হাজবেন্ড ওয়াইফের মধ্যে নানা ধরনের ভুল-বোঝাবুঝি থাকে। দাম্পত্য জীবনে নানারকম সংকট থাকে। এমনতো হয়ই। তাই না?’
‘নাহ, আমাদের তেমন কিছু ছিল না।’
‘রফিক সাহেব শেষের দিকে এসে খুব ড্রিংক করতেন। তার অফিস থেকে জেনেছি আমরা। সময়ে অসময়ে প্রায় সারাক্ষণই উনি ড্রিংক করতেন। বাড়িতেও ঠিকঠাক আসতেন না। এর পেছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ ছিল?’
‘বাড়িতে ঠিকঠাক আসতেন না, কথাটা ঠিক না। আসলে ইলেকশনে হারার পর উনি মানসিকভাবে খুব অস্থির হয়ে গিয়েছিলেন। এলাকায় অনেক বিজনেসই ছিল তার। ইলেকশনে হারার পরও সেগুলো উনি নিজের নিয়ন্ত্রণেই রেখেছিলেন। কিন্তু শেষ দিকে আর পারছিলেন না। কিছু লোন-টোনও ছিল। এগুলো নিয়ে মেন্টালি খুব আপসেট ছিলেন।’
‘আর কিছু?’
‘আমার জানা মতে আর কিছু ছিল না।‘
‘শেষের দিকে ওনার বিজনেস হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু আমরাতো ভিন্ন বিষয় জেনেছি। বরং নির্বাচিত কাউন্সিলর সরকারের বিরোধী দলের হওয়ায় উনি এলাকার কোনো বিজনেসেই ঢুকতে পারছিলেন না।’
‘আমিতো বারবার বলছিই যে ওনার আসল বিরোধটা ছিল দলের মধ্যেই। যখন নির্বাচনে হেরে গেলেন, তখন দলের ভেতর থেকে অনেকেই ওনাকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টায় ছিলেন। ওনার বিজনেসগুলোও নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার চেষ্টা করছিলেন।’
তাদের কয়েকজনের নাম বলবেন?’
‘আমি কারো নাম বলব না। এটা আপনাদের দায়িত্ব। আমিতো ভুলও করতে পারি তাই না?’
‘তারপরও সন্দেহজনক কেউ?’
জান্নাত দীর্ঘসময় চুপ করে থাকার পর বলল, ‘উনি মাঝেমাঝেই একটা কথা বলতেন…।‘
‘কী কথা?’
‘বলতেন যে সবচেয়ে কাছের লোকগুলোই তার সবচেয়ে বড় শত্রু।’
‘কে সে?’
জান্নাত আরো খানিক চুপ করে থেকে বলল, ‘আপনারতো বোঝার কথা। যে সারাক্ষণ তাকে আপন মায়ের পেটের ছোট ভাই ছোট ভাই করে।’
‘আকবর আলী?’
‘আমি ওনাকে তাই বলতাম। কিন্তু উনি প্রথম প্রথম সেটি বিশ্বাস করতে চাইতেন না।’
‘কিন্তু উনিই যদি সবচেয়ে বড় শত্রু হবেন, তাহলে ওনাকে এত কাছে রাখতেন কেন?’
‘ওই যে বললাম, প্রথমে সেটি বুঝতে পারেননি। যখন বুঝতে পেরেছেন তখন চট করে দূরে সরেও যাওয়া যায় না। তা ছাড়া কথায় আছে, কিপ ইওর ফ্রেন্ড ক্লোজ বাট কিপ ইওর এনিমিস ক্লোজার।’
‘কিন্তু ফজলে নূরের সাথেওতো ওনার সম্পর্ক খুব খারাপ ছিল। আমরা জেনেছি হাতাহাতি পর্যন্ত হয়েছে। আর তাদের মধ্যে যে সাপে-নেউলে সম্পর্ক ছিল, এটাও সবাই জানত।’
জান্নাত সামান্য হাসল, ‘শোনেন ওসি সাহেব। আপনি যদি বুদ্ধিমান মানুষ হন, তাহলে যার সাথে আপনার হাতাহাতির সম্পর্ক, চরম দ্বন্দ্ব এবং এটা সবাই জানে, তখন চট করে আপনি তাকে খুন করে ফেলবেন না। কারণ আপনি জানেন, তাহলে সবার আগে সন্দেহের তীরটা আপনার দিকেই তাক হবে। তাই না?’
‘হুম।’
‘বরং আপনার সাথে তার এই কোন্দলের সুযোগটা নেবে ওত পেতে থাকা অন্য কেউ। সে ঝোপ বুঝে কোপটা মারবে। যাতে তাকে কেউ সন্দেহ করতে না পারে। কারণ সে জানে, ঘটনা ঘটা মাত্র ওই অন্যজনকে সবাই প্রথমেই সন্দেহ করবে। মাঝখান থেকে তার উদ্দেশ্য হাসিল।’
জান্নাতের কথা যুক্তিযুক্ত। তা ছাড়া এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ফজলে নূরকে ফাঁসানোর জন্য আকবর আলীর অতি আগ্রহ, প্রভাবিত করার চেষ্টাও আতাহার মিয়ার চোখ এড়ায়নি। তারপরও তিনি প্রশ্নটা করলেন, ‘আপনার হাজবেন্ডের কী অন্য কোনো সম্পর্ক ছিল?’
‘অন্য কোনো সম্পর্ক মানে?’
‘না মানে উনি কেন লুকিয়ে একটা ফোন ইউজ করতেন?’
‘সেটা আমি বলতে পারব না। উনি প্রচণ্ড ব্যস্ত মানুষ। শত শত লোকের সাথে রোজ ওঠাবসা। সো কেন উনি কী করতেন, সেটাতো সবসময় আমার জানার কথা না।‘
‘আরেকটা প্রশ্ন।’
‘জি।’
ইতস্তত করে হলেও প্রশ্নটা করলেন আতাহার মিয়া, ‘ফজলে নূরের সাথে আপনার কী সম্পর্ক?
‘মানে?’ এই প্রথম উত্তেজিত হয়ে উঠল জান্নাত। ‘কী বলতে চাইছেন আপনি?’ আতাহার মিয়া ঠাণ্ডা গলায় বললেন, ‘আপনার সাথে ফজলে নূরের সাথে প্রায়ই মোবাইল ফোনে কথা হতো, এই সংক্রান্ত তথ্য আমাদের কাছে আছে। ঘটনাটা আনইউজুয়াল না?’
জান্নাত এই প্রশ্নের উত্তর দিল না। তবে আতাহার মিয়ার দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে রইলো সে।