৪১
আশফাক দুরুদুরু বুকে বাড়িতে ঢুকেছেন। ইদানীং তিনি হাফসাকে খুব ভয় পান। তার ধারণা হাফসার সামনে দাঁড়ালেই হাফসা তার ভেতরের সবকিছু স্পষ্টভাবে দেখতে পান। তিনি এসেছেন নাদিয়াকে নিয়ে যেতে। কিন্তু নাদিয়াকে কেন নিয়ে যেতে এসেছেন সেই কথা তিনি এখুনি কাউকে বলতে চান না। নাদিয়ার সাথে দেখা করার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে আফসানা। সে নাদিয়ার সাথে কথা বলতে চায়। সবকিছু জেনে বুঝে নাদিয়ার জন্য ভালো পাত্রের ব্যবস্থা সে নিজেই করবে। শুধু যে পাত্রের ব্যবস্থাই করবে তাই না, বিয়ের সব খরচাপাতিও তার। প্রথম দিকে দোনোমনো করলেও শেষ দিকে এসে আশফাকের মনে হয়েছে আফসানা যা করতে চাইছে তা সর্বৈব অর্থেই মঙ্গলজনক। এবং নাদিয়ার ক্ষতি হয় এমন কিছু সে কিছুতেই করবে না।
কিন্তু বাড়িতে ঢুকেই থমকে গেলেন আশফাক। সারা বাড়িতে থমথমে একটা অবস্থা। সবচেয়ে বেশি থমথমে হয়ে আছে হাফসা। তিনি হাফসার এই অবস্থা দেখে মনে মনে দমে গেলেন। বললেন, ‘কী হয়েছে?’
‘কী আর হবে? অথর্ব স্বামীর সংসার করলে যা হয় তা-ই হয়েছে।’
আশফাক থতমত খাওয়া ভঙ্গিতে বললেন, ‘আমি আবার কী করলাম?’
তুমি কিছু করলেতো আর সমস্যা থাকত না। কিছু করছো না বলেইতো সমস্যা’
‘কী হয়েছে বলবেতো?
‘তোমার ভাই-বোন দুজনইতো কাউকে কিছু না জানিয়ে পাল্লা দিয়ে বিয়ে করেছে। জামাই, বউ নিয়ে তারা দুজনই এসে উঠেছে এ বাড়িতে। এখন তারা থাকবে কই?’
আশফাক অনিশ্চিত ভঙ্গিতে বললেন, ‘এখন কই আছে? এখন যেখানে আছে সেখানেই থাকবে।’
‘সেলিনাতো জামাই নিয়ে তার ঘরেই আছে। কিন্তু রুবেল তার বউ নিয়ে কই থাকবে? সে তার বউ নিয়ে উঠেছে বাবা-মায়ের ঘরে।’
‘কী বলছো? বাবা-মা তাহলে কই?’
‘কই আর? স্টোর রুমের ঘরটাতে। কিন্তু ওইখানে মানুষ থাকতে পারে? বাবাতো অসুস্থ হয়ে গেছে, তাকে হাসপাতালেও নিতে হয়েছিল।’
আশফাক এবার সত্যি সত্যিই চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তিনি বললেন, ‘রুবেলকে দোতলা বা তিনতলার কোনো ঘর দিলেওতো হতো?’
হাফসা মুখ ঝামটা দেয়ার ভঙ্গিতে বললেন, ‘তোমার মেজো ভাই-ভাবি এখন এ বাড়ির হর্তা-কর্তা, তারা তাদের কাছে আর কোনো ঝামেলা পোহাবে? বলেই দেখো একবার। আমাদের সুদ্ধ না বাড়ি থেকে বের করে দেয়।’
আশফাক নরম গলায় বললেন, ‘এভাবে বলছো কেন? ওদের কাছে নানা লোকজন আসে। এইজন্য ওদের না হয় একটু ফ্রি স্পেস লাগে। আমাদের তো তেমন কোনো সমস্যা নেই। একটা রুমতো মোটামুটি ফাঁকাই পড়ে থাকে। ওই রুমটা না হয় ওদের…।’
আশফাক কথা শেষ করতে পারলেন না। তার আগেই তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন হাফসা, ‘ও আচ্ছা, তুমিও এখন সবার মনের কথাটা বলতে শুরু করেছো? তোমার মেয়ে যে বড় হয়েছে, সে খেয়াল আছে? আর মেয়ের বিয়ে দিতে হবে না? তখন অতিথি মেহমান আসবে না? তারা এসে যখন দেখবে ঘরে থাকার জায়গা নেই, ঘুমানোর জায়গা নেই। একটা গরুর হাঁটের মতো মানুষ গিজগিজে নোংরা জায়গায় এসে তারা উঠেছে, তখন কেমন লাগবে তোমার?’
আশফাকের একবার মনে হলো তিনি বলেন যে নাদিয়াকে নিয়ে আর হাফসাকে দুশ্চিন্তা করতে হবে না। ব্যাপারটা তিনি নিজেই দেখবেন। নাদিয়ার সবচেয়ে ভালো ব্যবস্থাটাই তিনি করবেন। কিন্তু এক্ষুনি এই কথা বলার সাহস তার হলো না। তা ছাড়া কোনো কিছু নিশ্চিত করার আগেই বলে ফেলাও ঠিক নয়।
তিনি বিকেলের দিকে কথা বলতে গেলেন মছিদা বেগমের সাথে। মছিদা বেগম তাকে দেখেই বললেন, ‘বাড়ির খবরতো কিছু রাখিস না। কে কেমন আছে, কোনো খবর আছে?’
আশফাক মিনমিন করে বললেন, ‘আমি একটু ঝামেলায় ছিলাম মা।’
‘তোরতো সারা জীবনই ঝামেলা। কিন্তু বাবা-মা, ভাই-বোনকে নিয়েতো কোনোদিন কোনো ঝামেলা পোহাতে দেখলাম না। এই যে সেলিনা কাউকে কিছু না বলে বিয়ে-করে বাড়িতে জামাই নিয়ে চলে এলো, কোনো খোঁজ রেখেছিস? রুবেল যে বিয়ে শাদি করে বউ নিয়ে এসে আমার ঘর দখল করে উঠে গেল, আমরা কে কই থাকব না থাকব, তা ভাবলোও না। কই একবারও কোনো খোঁজ নিয়েছিস?’
আশফাক বিব্রত গলায় বললেন, ‘কী অবস্থা এখন ওদের?’
মছিদা বেগম এদিক-সেদিক তাকিয়ে বললেন, ‘রুবেলকেতো আর চেনাই যায় না।’
‘চেনা যায় না মানে?’
মানে সেতো আর বউয়ের আঁচলের নিচ থেকে বেরই হয় না। কাম কাজ সব বাদ দিয়ে সারাক্ষণ বউয়ের সাথে গুটুর গুটুর। পারলে বউয়ের রান্নাবান্না, কাপড়- চোপড় ধোয়া পর্যন্ত সে করে দেয়।’
আশফাক বুঝতে পারলেন মছিদা বেগম রুবেলের ওপর প্রচণ্ড বিরক্ত। তিনি অবশ্য এ বিষয়ে কোনো কথা বললেন না। মছিদা বেগমই বললেন, ‘এমন ছেলে আমি জীবনেও দেখিনি। সারাটাক্ষণ বউ বউ আর বউ। তার ওপর আছে শ্বশুর, শাশুড়ি। তারা এ বাড়িতে আসলে মনে হয় যেন পীর-ফকির আসছে। আর সে হলো গিয়ে তাদের মুরিদ। কথায় কথায় গলে গলে পড়ে। পা ধরে বসে থাকে। যেন আমি না, তারাই তারে পেটে ধরছে। আর বউয়ের কথা কী বলব? বউ যদি বলে দিন, তো দিন। বউ যদি বলে রাত তো, রাত। এই হলো অবস্থা। বউয়ের কথা ছাড়া মনে হয় হাগামুতাও করে না।’
আশফাক বললেন, ‘ছিঃ, এ কী ধরনের কথা মা?’
‘একদম উচিত কথা। এমন পোলা আমি বাপের জন্মেও দেখিনি। আমরাওতো বিয়ে শাদি করেছিলাম, করিনি? তোর বাবাকে কিছু অর্ডার দেয়া দূরে থাক, কথা বলতেও ভয় পেতাম। কখন কী লাগবে, এই নিয়ে তটস্থ থাকতাম। আর এইখানে এ কী চলছে, আল্লাহগো আল্লাহ! এগুলা দেখার জন্য আমি বেঁচেছিলাম?’
আশফাক তখন আর কথা বললেন না। তবে রাতে মছিদা বেগম নিজেই তাকে ডাকলেন। আশফাক কী মনে করে সেলিনার কথা জিজ্ঞেস করলেন, ‘সেলিনার কী অবস্থা মা?’
মছিদা বেগম ঝলমলে গলায় বললেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ। এতদিন পর আল্লাহমনে হয় আমাদের দিকে মুখ তুলে তাকাইছে। আহসান এত ভালো একটা ছেলে তুই চিন্তাও করতে পারবি না। মাশাল্লাহ, এই যুগে এমন জামাই পাওয়া সাত জনমের ভাগ্য।‘
‘ভালো কীভাবে? শুনলাম সে নাকি ইংল্যান্ডে পড়াশোনাই করেনি। মিথ্যে কথা বলছে। এখন বিজনেসে লস দিয়ে চাকরি-বাকরিও নাকি কিছু করতে পারছে না?’
মছিদা বেগম ঠোঁট ওল্টালেন, ‘পড়াশোনা করতেইতো গিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কী একটা ঝামেলায় পড়াশোনা আর শেষ করতে পারেনি। তাতে কী? সোনার টুকরা ছেলে সে। না দেখলে বুঝবি না, এমন জামাই আল্লাহ নিজ থেকে দিছেন। সেলিনার কথা ছাড়া কোনো কাজই করে না। সেলিনা যা বলবে তাই।’
‘মানে?’ আশফাক চমকালেন। সকালে বলা মায়ের কথাগুলোর সাথে যেন সে মেলাতে পারছে না।
‘কী যে ভালো ছেলেটা, একদম ঘরের ছেলের মতো। আদব-লেহাজের সীমা নেই। দেখলে প্রত্যেকবারই যেন পা ছুঁয়ে সালাম করবে। এত বিনয়ী। সেলিনা সেদিন বাজারে যেতে বলল, তারপর থেকে প্রত্যেকদিন সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই বাজার-সদায় করে ফেলে। সেলিনার কথা ছাড়া কিচ্ছু করে না। সে যদি বলে রাত তো রাত। সে যদি বলে দিন তো দিন। একবারও কোনো ঝামেলা করবে না। এমন হীরের টুকরা ছেলে এই যুগে সম্ভব, তুই ই বল? যা নম্র-ভদ্র ছেলে, মাশাল্লাহ, মাশাল্লাহ! সেলিনার ভাগ্যে ছিল বলেই এত ঝই-ঝামেলার পরও এমন ছেলে পাওয়া গেছে।
আশফাক আহমেদ মায়ের কথা শুনে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। এই জগৎ ঘর, সংসার, সম্পর্কের হিসেব-নিকেশ বোঝা বড় দুষ্কর। এ তিনি কখনো পারেননি। পারবেনও না।
মছিদা বেগম বললেন, ‘আমি চিন্তা করেছি ছাদে ওদের জন্য কখানা ঘর তুলে দেবো, ওরা একটাতে থাকল। আর বাকিগুলাতে অফিস করে নেবে!’
আশফাক আহমেদ বললেন, ‘ওহ! আর তার আগ পর্যন্ত? বাবা নাকি ওই ছোট ঘরটাতে থাকতে থাকতে অসুস্থ হয়ে গেছেন?’
‘এইজন্যই তোকে ডেকেছি। নাবিলাতো এখন আর শ্বশুর বাড়ি থেকে আসে না। ওর ঘরটাতো ফাঁকাই পড়ে আছে। রুবেলরা না হয় আপাতত ওর ঘরটাতেই কিছুদিন থাকুক। এর মধ্যে ছাদে ঘর হলে সেলিনাদের ওখানে পাঠিয়ে দেবো। তখন ওরা আবার নিচে চলে আসবে। তুই বড় বউকে বলে এটা একটু ব্যবস্থা কর।’
আশফাক কী করবেন বুঝতে পারছিলেন না। তবে মায়ের মুখের ওপর তিনি নাও করতে পারলেন না। তা ছাড়া আফজাল আহমেদ এ কদিনেই খুব ভেঙে পড়েছেন। কিন্তু এতবড় একটা সিদ্ধান্ত আশফাক একা বাস্তবায়িত করতে পারবেন বলে তার মনে হলো না। তারপরও নাদিয়াকে ডেকে তিনি বিষয়টা বললেন।
নাদিয়া অবশ্য নানা কারণে মানসিকভাবে খুবই বিধ্বস্ত। সে কোনো কিছুতেই যেন স্বস্তি পাচ্ছে না। দিন কয়েক আগে নাবিলা ফরিদপুর থেকে তাকে হঠাৎ ফোন দিয়ে বলল, ‘ঘটনা শুনেছিস?’
‘কী ঘটনা?’
শফিকের কোনো খবর নেই।’
শফিকের কোনো খবর নেই মানে?’
‘তার ফোন অফ। সে মেসেও নেই।’
‘মানে কী?’
‘হুম।’
‘কতদিন ধরে?’
‘প্রায় সপ্তাহ হয়ে এলো।
‘কী বলছো!’ নাদিয়া খুবই অবাক হলো। সে কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বলল, ‘কিছুই জানিস না?’
‘উহু।’
বিকেলে সে নিজেই ফোন করল নাবিলাকে। সারাক্ষণ একটা অস্বস্তির কাঁটা খোঁচাতে লাগল তাকে। নাদিয়া বলল, ‘কিছু হয়েছিল?’
‘না, কী হবে?’
‘তাহলে? হঠাৎ করে একটা মানুষ উধাও হয়ে যাবে? কেউ কোনো খবর জানবে না?’
‘কীভাবে জানবে? তার ফোন অফ, কোথায় গেছে কাউকে বলেও যায়নি। তার সাথে আমার লাস্ট কথা হলো তোর বিয়ে নিয়ে।’
বিয়ে নিয়ে কী কথা?’
‘তেমন কিছু না। আমি বললাম যে আমাকে তার ঢাকায় নিয়ে যেতে হবে। কারণ সামনেই তোর বিয়ে।’
‘তারপর?’
‘ও কিছু জিজ্ঞেস করেনি। শুনে চুপ হয়েছিল। যেমন সবসময় থাকে আর কী! ওতো কেমন জানিসই।’
‘তুই কী বললি?’ নাদিয়া উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল।
নাবিলা বলল, ‘আমি তখন নিজে থেকেই মুকিতের কথা এটা-সেটা বললাম। ও ইউনিভার্সিটির টিচার, ভালো ফ্যামিলি, এইসব আর কী!’
‘তারপর?’
তারপর আর কী! হঠাৎ কী কাজের কথা বলে ফোন কেটে দিল। পরে আমি ফোন দিয়ে দেখি ফোন অফ।’
‘তারপর থেকেই ফোন অফ?’
‘হুম। পরে ওর রুমমেটকে ফোন করে শুনি ওর কোনো খোঁজ নেই।’
কথাটা শোনার পর থেকে এক মুহূর্তের জন্যও স্বাভাবিক হতে পারছিল না নাদিয়া। শফিক নেই? তার বিয়ের খবর শোনার পর পরই উধাও হয়ে গেছে সে? এই এতদিনে এসে নাদিয়ার বুকে ঘাপটি মেরে থাকা প্রলয়ঙ্করী ঝড় যেন বিধ্বংসী দানব হয়ে উঠল। শফিকের জন্য তার বুকের ভেতর যে এত অস্থিরতা, এত তীব্র যন্ত্রণা লুকিয়ে ছিল, তা এর আগে কখনোই যেন এমন স্পষ্টভাবে, এমন পরিপূর্ণরূপে সে বুঝতে পারেনি। খবর শোনার পর দীর্ঘসময় স্তব্ধ হয়ে বসে ছিল নাদিয়া। অনেক ইতস্তত করে শেষ অবধি সে শফিকের নম্বরে ফোনও করেছিল। কিন্তু শফিকের নম্বর বন্ধ। তারপরের কয়েকদিন বিষয়টাকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে সে। কিন্তু লাভ হয়নি। বরং চেষ্টাটা যত প্রবল হয়েছে, একটা দমবন্ধ কষ্ট তার থেকেও বেশি তীব্র হয়ে বারবার ফিরে এসেছে। এই মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তির উপায় তার জানা নেই।
নাদিয়া কি আগে কখনোই তার জন্য শফিকের এই তীব্র ভালোবাসা টের পায়নি? এই সুতীব্র অনুরাগ অনুভব করেনি? কিংবা শফিকের জন্য তার নিজের এই নিস্পন্দন অথচ প্রগাঢ় অনুভূতি?
নাদিয়ার এখন মনে হচ্ছে, সে হয়তো সবই বুঝতে পারত, অনুভব করতে পারত। কিন্তু সে এও জানত, সে এক অক্ষম, অসহায় মানুষ। চাইলেও কিছুই করার ক্ষমতা নেই তার। তার এই প্রবল অপারগতায় একটা তুমুল অসম্ভাব্যতার ভাবনা সারাক্ষণ তাকে তটস্থ করে রাখত। কিছুই বুঝতে দিতে চাইত না। দুর্লঙ্ঘ্য এক বাধার পাহাড় দাঁড় করিয়ে দিত তার ইচ্ছের চারপাশে। নিজের একান্ত ব্যক্তিগত ভালোলাগাটাকে যেকোনো উপায়ে উপেক্ষা করতে চাইত সে। বড় বোন নাবিলার জীবনের নিষ্ঠুরতম অভিজ্ঞতার গল্প তার জীবনে তুলে দিয়েছে কঠিন এক নিষেধের দেয়াল। ওই দুর্লঙ্ঘ্য দেয়াল সে সচেতনভাবে কখনো অতিক্রম করার কথা ভাবেনি। কিন্তু তার অবচেতন মন আড়ালে-আবডালে কখন যে এমন বেপরোয়া, বেহিসেবি হয়ে উঠেছিল তা সে টেরই পায়নি।
মুকিত বিয়ের জন্য রোজ নাদিয়াকে তাড়া দেয়। তাড়া দেন হাফসাও। নাদিয়া কেবল আরো খানিক অপেক্ষার কথা বলে। আরো খানিকটা সময় চায়। কিন্তু তার সেই সময় চাওয়া কিংবা অপেক্ষার পেছনে যৌক্তিক কোনো কারণই কেউ খুঁজে পায় না। আর হাফসাও তাই ক্রমশই শঙ্কিত হয়ে ওঠেন। তার মনে কু-ডাক ডাকতে থাকে। তিনি যেন নিজের অজান্তেই টের পান, একটা অনিশ্চয়তার কালো মেঘ ক্রমশই এগিয়ে আসছে। সেই মেঘ নিমেষেই বিষাক্ত ফণা তুলে ঝড় হয়ে যাবে। তিনি সেই মেঘটাকে একদম কাছে গিয়েও দেখতে পাচ্ছেন না। এই নিয়ে সারাক্ষণ শঙ্কিত হয়ে থাকেন তিনি।
এতকিছুর মধ্যেও এক ফাঁকে নাদিয়া গিয়ে শফিকের খোঁজ নিয়ে এলো। কিন্তু শফিক মেসে নেই। তার খবরও কেউ জানে না। শফিকের থাকা কিংবা না থাকাটা কখনোই নাদিয়া আলাদাভাবে অনুভব করেনি। কিন্তু সেদিন শফিকের মেস থেকে ফেরার পথে নাদিয়ার হঠাৎ মনে হতে লাগল, এই পুরো শহর, এই লোকে লোকারণ্য পথ-ঘাট, রাস্তা, বাস, রিকশা কোথাও যেন কেউ নেই। যেন এক বিরান শহরে সে একা, নিঃসঙ্গ ব্যথাতুর এক পাখি। যেন এ শহরে তার কোনো ঘর নেই। বাড়ি নেই। নিজের কোনো মানুষ নেই। কখনো ছিলও না কেউ। বুকের ভেতরটা কখন কোন আবডালে শফিকের মতো অপাঙ্ক্তেয় এক মানুষের জন্য এমন শূন্য চরাচর হয়ে গেছে, কে জানত!
ঘরে ফিরে দরজা বন্ধ করে সেই প্রথম শফিকের জন্য কাঁদল নাদিয়া। এই কান্নার দৃশ্যমান কোনো অর্থ নেই, এই কান্না কেউ দেখবে না, কেউ শুনবে না। কিন্তু তারপরও নাদিয়াতো জানে, জগতে এরচেয়ে গভীর, এরচেয়ে শুদ্ধ, এরচেয়ে তীব্র আর কিছু নেই। সে সেই তীব্রতম বেদনার অনুভবে গভীর অন্ধকারে লীন হয়ে রইলো।
মুকিতের সাথে দুদিন ঠিকঠাক কথাও বলল না সে। বিষয়টা নিয়ে জাহানারা খুবই অস্থির হয়ে গেলেন। অস্থির হয়ে গেলেন হাফসাও। তবে নাদিয়ার হঠাৎ এমন চুপচাপ হয়ে যাওয়া তাদের যেন খানিক শঙ্কিতও করে তুলল। জাহানারা সতর্ক ভঙ্গিতে হাফসাকে বললেন, ‘একদম কোনো প্রেসার দিবি না। আগে একটু সময় দে, একটু দেখ ঘটনা কী? অনেক সময় এমন হয়। সেতো এর আগে কখনো উল্টাপাল্টা কিছু ঘটায়নি। ঘটিয়েছে?’
হাফসা বললেন, ‘না।’
‘তাহলে চিন্তার কিছু নেই। আপাতত সময় দে। দেখ কী হয়। কোনো প্রেসার দিস না। স্বাভাবিক হতে দে।
হাফসারও তাই মনে হলো। শেষ মুহূর্তে এসে মেয়ে বেঁকে বসলে সমস্যা। তা ছাড়া নাদিয়া এখনো অবধি মুকিতের বিষয়ে নেতিবাচক কিছু বলেনি। হতে পারে হঠাৎ বিয়ের মতো এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে শেষ মুহূর্তে এসে কিছুটা হলেও এলোমেলো হয়ে গেছে সে। এমন নিজের ক্ষেত্রেও হয়েছিল হাফসার। সব বিচার-বিবেচনা করে বিষয়টা নিয়ে যতটা সম্ভব সহনশীলই থাকার চেষ্টা করলেন তিনি।
আশফাক এসে মছিদা বেগমের কথাটা যখন নাদিয়াকে বললেন, নাদিয়া তখন প্রথম কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর বলল, ‘আমাকে কিছুদিনের জন্য তোমার সাথে কোথাও নিয়ে যাবে বাবা? ওই যে বললে একটা নদী আছে? বন আছে?’
আশফাক এতটা আশা করেননি। তিনি আনন্দ চাপা কণ্ঠে বললেন, ‘অবশ্যই নিয়ে যাব।’
‘আমার মনটা একদম ভালো নেই বাবা। কটা দিন কোথাও থেকে একটু ঘুরে আসতে পারলে বোধহয় ভালো লাগত।’
আশফাক বললেন, ‘অবশ্যই ভালো লাগবে। তোকেতো আমি নিয়েই যেতে চেয়েছি। সেই যে পরীক্ষার আগে, মনে নেই?’
‘হুম, আছে।’
‘তাহলে?’
‘মা যদি যেতে না দেয়?’
এই কথায় আশফাকও দমে গেলেন। নাদিয়া সেই রাতেই মায়ের কাছে গেল। কিন্তু প্রথমেই এই কথা বলল না সে। সে বলল রুবেলদের নাবিলার রুমে ওঠানোর কথা। কিন্তু এই কথা শুনেই ভয়ংকর রকম ক্ষেপে গেলেন হাফসা। এতটা তীব্র প্রতিক্রিয়া আশা করেনি নাদিয়া। বরং মায়ের প্রতিক্রিয়া দেখে মন খারাপ হয়ে গেল তার। তারপরও ভয়ে ভয়েই সে বাবার সাথে দিন দুয়েকের জন্য বেড়াতে যাবার কথাটাও বলল। হাফসা এবার রীতিমতো অগ্নিমূর্তি ধারণ করলেন। তিনি তারস্বরে চিৎকার করে বললেন, ‘এখন আসছে দরদ দেখাতে না, দরদ? খবরদার। একদম খবরদার! এই লোকের সাথে তুই ঘরের বাইরেও যাবি না। এক পাও না।’
মায়ের কথা শুনে নাদিয়া অবশ্য উত্তেজিত হলো না। সে যেন জানতোই যে মা এমন প্রতিক্রিয়াই দেখাবে। হাফসা দীর্ঘসময় ধরে আশফাককে অকথ্য ভাষায় আক্রমণ করতে লাগলেন। নাদিয়ার পুরো বিষয়টা এখন অসহনীয় লাগছে। মনে হচ্ছে, এই মুহূর্তে যদি সে এ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে পারত! হাফসা অবশ্য বেশিক্ষণ আর ঝগড়াটে থাকলেন না। তিনি আচমকা হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন। বিছানায় শুয়ে থেকেই দু হাতে নাদিয়ার পা জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করতে লাগলেন, ‘মারে, তুই কোথাও যাস নারে মা। আমার এই কথাটা শোন। ও মা, মারে…।’
নাদিয়া জানে না কেন, মায়ের এই আর্তনাদ তাকে একটুও বিচলিত করতে পারল না। বরং তার বুকের ভেতর জেগে ওঠা অসহনীয় কষ্ট, তীব্র যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য হলেও তাকে যেন মায়ের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে হবে। সারাটা দিন বিয়ে ছাড়া আর কোনো কথা নেই তার মুখে। কয়েকটা দিনের জন্য হলেও মায়ের থেকে, এই বাড়ি থেকে দূরে যেতে চায় সে। পরদিন সকালে হাফসাকে কিছু না জানিয়ে বাবার সাথে বাড়ি ছাড়ল নাদিয়া। মায়ের বিছানার কাছে একটা ছোট্ট চিরকুট লিখে রেখে এলো সে, ‘তুমি চিন্তা করো না মা। আমার কিছু ভালো লাগছিল না। দুটো দিন বাবার সাথে থেকেই আমি আবার চলে আসব।’
নাদিয়া তখনো জানে না, কী ভয়ংকর এক বিপর্যয় সে ডেকে এনেছে তার জীবনে। কী নৃশংস এক সময় অপেক্ষা করছে তার জন্য!