৪০
রাফির ঘুমের সমস্যা আরো বেড়েছে। সাথে ভয়ানক অস্থিরতা। এই মুহূর্তে তার সবচেয়ে বেশি কথা বলা দরকার মুনিয়ার সাথে। কিন্তু সেদিনের পর থেকে মুনিয়া কেমন শীতল হয়ে গেছে। বিষয়টা যে রাফি বুঝতে পারেনি তা নয়। কিন্তু সম্পর্কের উষ্ণতা ফিরিয়ে আনার জন্য যে সময়টুকু দরকার, মুনিয়া তা তাকে দিচ্ছে না। শরীর খারাপের অজুহাতে স্কুল থেকে বেশ কিছুদিনের জন্য ছুটিও নিয়েছে মুনিয়া। সমস্যা হচ্ছে বেশির ভাগ সময়ই তার ফোন বন্ধ থাকে। ফলে মুনিয়ার সাথে যোগাযোগও করতে পারছে না রাফি। তার সমস্যাও বাড়ছে। অনেক ভেবেচিন্তে সে একজন সাইকিয়াট্রিস্টের সাথে দেখাও করেছে। ডক্টর আব্দুল বাতেন নামকরা মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। প্রথম দিনে তিনি তেমন কিছু জিজ্ঞেস করেননি রাফিকে। রাফি নিজ থেকে তার সমস্যার কথা যতটুকু বলেছে, তিনি কেবল ততটুকুই শুনেছেন। রাফির ঘুমের সমস্যা। ঘুমের ভেতর সে নানারকম দুঃস্বপ্ন দেখে। এই দুঃস্বপ্ন দেখার আতঙ্কে এখন আর তার ঘুমই হচ্ছে না। আব্দুল বাতেন দ্বিতীয় দিন জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কি এই দুঃস্বপ্ন কোনো একজনকে নিয়েই দেখেন?’
রাফি সামান্য ভেবে বলল, ‘নাহ।’
‘যাদের নিয়ে দেখেন, তারা সবাই কী আপনার পরিচিত?’
‘নাহ।’
‘পরিচিত কাকে কাকে দেখেন?’
রাফি এই প্রশ্নের উত্তর ঠিকঠাক দিতে পারল না। তার এখন মনে হচ্ছে তার স্বপ্নটা আজকাল আর স্পষ্ট না। সে মানসিক আতঙ্ক থেকে যেকোনো স্বপ্নকেই ভয়ের স্বপ্ন ভাবে। ফলে স্বপ্নগুলো সে আর মনে রাখতে পারে না। কিন্তু আতঙ্কটা থেকে যায়। মুনিয়ার সাথে এসব নিয়ে একটু কথা বলতে পারলে ভালো হতো। এখন অবশ্য সে উপায় নেই। মুনিয়া একভাবে তার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নই করে রেখেছে। এই বিষয়টাও খুব কষ্ট দিচ্ছে রাফিকে। তার ধারণা সে তার এই অস্থির মানসিকতার কারণেই গত কয়েকদিনে মুনিয়ার সাথে খুব বেশি উল্টাপাল্টা কথা বলে ফেলেছে। আর এই অবস্থায় মুনিয়া সেটা নিতে পারেনি। রাফি জানে, মুনিয়া এমনিতেই নানা মানসিক, পারিবারিক, পেশাগত ঝামেলায় থাকে। তার কাছে রাফি একঝলক ফুরফুরে দখিনা হাওয়ার মতো। যেখানে এসে সে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারে সে। অথচ এমন একটা সময় রাফিই কিনা আরো উল্টাপাল্টা কথা বলে তার মানসিক অস্থিরতাটা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। এমনকি ওই সময়েই স্বামীর সাথে ঝগড়া করে মুনিয়া চলে গিয়েছিল বাবার বাড়ি। রাফি কোথায় তাকে মানসিক সাপোর্ট দেবে। কিন্তু সেটা না করে সে উল্টো তাকে মানসিকভাবে আরো বেশি দুর্বল করে দিয়েছে। এটি নিয়েও এখন ভয়াবহ এক ধরনের মানসিক চাপে ভুগছে রাফি।
এই সময়ে অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটল। সন্ধ্যেবেলা রুম অন্ধকার করে শুয়েছিল রাফি। রথি দরজায় নক করে বলল, ‘ভাইয়া আসব?’
‘আয়।’
রথি ঘরে ঢুকে আলো জ্বালাতেই রাফি চেঁচাল, ‘বাতি জ্বালাস না, বাতি জ্বালাস না।‘
‘কেন?’
‘আলো ভালো লাগছে না। কী হয়েছে বল?’
‘তোমার ফোন।’ রথি তার হাতের ফোনটা রাফির দিকে এগিয়ে দিল।
‘আমার ফোন?’ ভারি অবাক হলো রাফি। ‘কে করেছে?’
‘ঋদ্ধি।’
‘ঋদ্ধি? ও কেন আমাকে ফোন করেছে? আর ফোনই পেল কোথায়?’
‘ওর বাবার ফোন থেকে করেছে। ধরো।’
রাফি ফোন হাতে নিয়ে বিস্মিত গলায় বলল, ‘হ্যালো ঋদ্ধি?’
ঋদ্ধি তটস্থ ভঙ্গিতে সালাম দিল। রাফি বলল, ‘কী ব্যাপার বলোতো?’
ঋদ্ধি কী বলবে ভেবে পেল না। অনেকদিন রাফি আর স্কুলে যায় না। কেন যায় না সে জানে না। কিন্তু রাফির কাছে একটা প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য খুব ছটফট লাগছিল তার। যদিও সে নিশ্চিত না, এই প্রশ্নটি করা তার ঠিক হবে কিনা। সে দ্বিধাগ্রস্ত কণ্ঠে বলল, ‘আপনি আর স্কুলে আসেন না যে!’
রাফি একই রকম সন্দিগ্ধ গলায় বলল, ‘কেন বলতো, কোনো দরকার?’
‘নাহ।’
‘তাহলে?’
‘এমনি।’ ঋদ্ধি কতকিছু ভেবে রেখেছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে বলার জন্য চট করে কোনো উত্তর খুঁজে পেল না। রাফি বলল, ‘বাড়ির সবাই ভালো?’
‘হুম।’
‘তোমার মা?’
‘মাও ভালো।
‘কিন্তু উনিতো অনেকদিন ধরে স্কুলে যান না। আর উনার ফোনও অফ। আমি অনেকবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু পাইনি। কী হয়েছে বলোতো?’ কথাটা বলেই রাফির মনে হলো এভাবে জিজ্ঞেস করা হয়তো ঠিক হয়নি তার। ঋদ্ধিও যেন বিষয়টা ঠিকভাবে নিল না। সে বলল, ‘মাকে আপনি ফোন করেছিলেন? অনেকবার?’
রাফি সতর্ক হলো, ‘হুম, একটু দরকার ছিল।’
‘কী দরকার?’
রাফি ইতস্তত করে বলল, ‘তেমন কিছু না। একটা ইনফরমেশন দরকার ছিল, কিন্তু উনার ফোন অফ। তা ছাড়া বেশ কিছুদিন ধরে উনিতো স্কুলেও আসেন না। কবে থেকে আসবেন কিছু জানো?’
ঋদ্ধি গম্ভীর গলায় বলল, ‘মা স্কুলে যায় না বলে আপনিও আসেন না?’
রাফি তটস্থ হয়ে বলল, ‘তা কেন? আসলে আমারও একটু ব্যস্ততা যাচ্ছে। আচ্ছা, রথি বলল উনি অসুস্থ বলে নাকি ছুটি নিয়েছেন? কী অবস্থা এখন?’
ঋদ্ধি এই প্রশ্নের জবাব দিল না। সে জানেনা কেন, রাফি মার কথা এত আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করায় কেন যেন তার মন খারাপ লাগছে। এই মন খারাপে তার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। দৃশ্যমান কোনো কারণও হয়তো নেই। তারপরও সে বুঝতে পারছে, ভেতরে ভেতরে আপনা আপনিই যেন খানিকটা দমে গেছে সে। বাবার ফোন থেকে ফোন করে রাফিকে চাওয়া তার জন্য দুঃসাহসী এক কাজ। সেই কাজটি সে করেছিল তীব্র এক তেষ্টা থেকে। কিন্তু সেই তেষ্টাটা যেন আর মিটল না। বরং অস্বস্তিকর এক খারাপ লাগা লেগে রইলো বুকের ভেতর। তা ছাড়া মারতো তেমন কিছু হয়নি। সে এমনি এমনিই স্কুল থেকে ছুটি নিয়েছে।
রাফি বলল, ‘তুমি কিছু বলবে? আমার একটু কাজ আছে।’
ঋদ্ধির এত মন খারাপ হলো! কত আগ্রহ নিয়ে, কত কতদিন কত কত পরিকল্পনা করেই না সে অবশেষে আজ ফোন করল। অথচ রাফি তার সাথে কথা বলছে কী নির্লিপ্তভাবে। তাহলে কি সে ভুলই ভেবেছে? তাদের বাড়ির উল্টোদিকে রাফির লেখা ওই কবিতাগুলো তার জন্য নয়। অন্য কারো জন্য? কিন্তু অন্য কার জন্য?
ঋদ্ধি এই প্রশ্নের উত্তর মেলাতে পারছে না। তবে মুহূর্তের জন্য তার সন্দিগ্ধ, বিচলিত, অস্থির মন যেন ভাবনার সূক্ষ্ম, তীক্ষ্ণ এক চিলতে বিদ্যুৎ চমকে দিয়ে আবার মিলিয়ে গেল। তবে তার রেশ থেকে গেল ঋদ্ধির বুকের ভেতর, ভাবনার ভেতর। তার আচমকা খুব কান্না পেতে লাগল। সে শতভাগ নিশ্চিত দেয়ালে লেখা ওই কবিতার লাইনগুলো রাফির লেখা কবিতাই। আর তার নিজের হাতেই লেখা হয়েছে দেয়ালের ওই লেখাগুলো। কিন্তু ওখানে সে কার জন্য ওভাবে দেয়াল ভর্তি কবিতা লিখে রাখবে?
ঋদ্ধি আর একটা কথাও বলল না। সে চুপচাপ ফোন কেটে দিয়ে অন্ধকারে লীন হয়ে রইলো। তার ছোট্ট বুকের ভেতর কত কত শঙ্কা, কত কত সম্ভাবনা, কত কত কষ্ট আর কান্নার নদী বয়ে যেতে লাগল বিরামহীন তা কেবল সে একা জানে। আর কেউ না।
মার সাথে তার অদ্ভুত এক দূরত্ব তৈরি হয়েছে। এটা ঋদ্ধি টের পায়। হয়তো এর অনেক দৃশ্যমান কারণই রয়েছে। কিন্তু ঋদ্ধির কেন যেন মনে হয় কোথাও কোনো একটা অদৃশ্য কারণও রয়েছে। সেই কারণটা ঋদ্ধি জানে না। যদিও এই সময়ে তার আর সব বন্ধুদেরও তাদের মায়েদের সম্পর্কে বিস্তর অভিযোগ। সেইসব অভিযোগ অবশ্য নানাবিধ শাসন-বারণ নিয়ে। বাধ্যবাধকতা নিয়ে। কিন্তু ঋদ্ধি জানে তার আর মায়ের সম্পর্কে গলায় বিঁধে থাকা সুক্ষ্ম কাঁটার মতো অন্যকিছু একটাও যেন বিঁধে আছে।
সন্ধ্যার খানিক পরে মুনিয়া অন্ধকারে বারান্দায় বসে ছিল। ঋদ্ধি পা টিপে টিপে মায়ের পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। মুনিয়া প্রথমে খেয়াল করল না। ঋদ্ধি চুপচাপ মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। মাকে দেখে মনে হচ্ছে কিছু একটা নিয়ে প্রবল চিন্তায় ডুবে আছে সে। এই বিষয়টা অনেক দিন থেকেই হচ্ছে। মা যেন নিজের মধ্যে নেই। সবকিছু ঠিকঠাক দেখালেও তার ভেতর যেন অন্যকিছু একটা সারাক্ষণ রয়ে যাচ্ছে। তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। যদিও কখনো সে কাউকে কিছু বুঝতে দেয় না। ঋদ্ধি ডাকল, ‘মা?’
মুনিয়া মাথা তুলে তাকাল, ‘হুম?’
‘তোমার কাছে একটু বসি?’
‘বোস।’ মুনিয়া সরে ঋদ্ধিকে জায়গা করে দিল।
ঋদ্ধি বলল, ‘আমার ওপর তোমার খুব মন খারাপ তাই না মা?’
‘মন খারাপ হবে কেন?’
‘এই যে তুমি চলে গেলে, কিন্তু আমি থেকে গেলাম। তোমার সাথে যাইনি…।’
মুনিয়া ম্লান হাসল, ‘উহু। আমি জানি, বড় হলে মায়ের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়। তখন অন্যদের প্রয়োজন বাড়ে। আমিও ছোটবেলায় মাকে ছাড়া একটা মুহূর্ত থাকতে পারতাম না। আর এখন দেখিস না, অন্যদের এত বেশি প্রয়োজন যে মার সাথে একটু কথা বলারও সময় হয় না!’
কথাটা লাগল ঋদ্ধির। কিন্তু কী বলবে তা বুঝে উঠতে পারল না সে। খানিক চুপ করে থেকে আলতো করে মাকে ডাকল সে, ‘মা।’
‘হুম।’
‘আমার না কিছুই ভালো লাগছে না।’
মুনিয়া আধো অন্ধকারেই ঋদ্ধির দিকে ফিরে তাকাল। ঋদ্ধি হঠাৎ মায়ের কাঁধে মাথা রাখল। মুনিয়া ঋদ্ধির মাথাটা তার কাঁধের সাথে চেপে ধরে বলল, কী হয়েছে?’
ঋদ্ধি জবাব দিল না। চুপচাপ মায়ের কাঁধে মাথা রেখে তাকিয়ে রইলো সামনে। সেখানে ছাদের কার্নিশ বেয়ে নেমে এসেছে কী একটা এলোমেলো লতা। একটা আমগাছের নুয়ে পড়া ডাল। তারপরে রাস্তা। রাস্তার ওপারে ফুটপাত। ফুটপাতের ওপারে একটা ল্যাম্পপোস্ট। সেই ল্যাম্পপোস্টের নিচে সাদা ধবধবে দেয়াল। দেয়ালের গায়ে লাল রঙে বড় বড় করে লেখা, ‘আমি একদিন নিখোঁজ হবো, উধাও হবো রাত প্রহরে, সড়ক বাতির আবছা আলোয়, খুঁজবে না কেউ এই শহরে…’
ঋদ্ধি এবং মুনিয়া দুজনই দুজনের অগোচরে ওই লেখাটার দিকে চুপচাপ তাকিয়ে রইলো। তাদের বুকের ভেতর তখন একজন মাত্র মানুষের জন্য অদ্ভুত এক অভিমান, অব্যক্ত এক দহন, অস্পৃশ্য এক গল্প। সেই গল্পে তারা দুজনই যেন বিষে জরজর নীল কষ্ট। ঋদ্ধি হঠাৎ কাঁদতে লাগল। মুনিয়া তার হাতের মুঠোয় ঋদ্ধির হাতজোড়া নিয়ে শক্ত করে চেপে ধরল। তারপর মায়াময় কণ্ঠে বলল, ‘কী হয়েছে মা?’
ঋদ্ধি জবাব দিল না। সে কাঁদতেই থাকল। মুনিয়া কি জানে ঋদ্ধি কেন কাঁদছে?
.
কী মনে করে গভীর রাতে ফোনটা খুলল মুনিয়া। আর তাকে অবাক করে দিয়ে ঠিক সাথে সাথেই ফোন বেজে উঠল। রাফির ফোন। মুনিয়া ফোনটা ধরলো। রাফি কোনো অভিযোগ করল না। সরাসরি বলল, ‘আমার কিছু ভালো লাগছে না।’
কথাটা কানে লেগে রইলো মুনিয়ার। ঋদ্ধিও ঠিক এই কথাটিই বলেছিল। তাদের সাথে কি কথা হয়? রাফি কি রোজ স্কুলে আসে আজকাল? আসার কথা না। রাফি বলল, ‘খুব অস্থির লাগছে।’
মুনিয়া বলল, ‘কিন্তু আমি কী করব?’
‘তুমি আমার সাথে কথা বলবে।’
‘উহু।’
‘কেন?’
‘কারণ খুব বেশি কাছে যেতে নেই। খুব বেশি কাছে গেলে তখন আর কিছুই দেখা যায় না, সবকিছু ঝাপসা, অস্পষ্ট লাগে। ঠিকঠাক দেখতে হলে কিংবা পেতে হলে বরং কিছুটা দূরত্বই ভালো।’
কথাটা শুনে রাফি থমকে গেল। মুনিয়ার কথাটা কি আসলেই সত্যি? সবকিছু জানা হয়ে গেলে, সব কিছু পাওয়া হয়ে গেলে কি সবকিছু হারিয়ে যায়? খুব বেশি কাছে গেলে কি সব অস্পষ্ট, ঝাপসা হয়ে যায়? রাফির মনে হলো কথাটা মিথ্যে নয়। সকল সম্পর্কেই কিছুটা দূরত্ব ভালো।
সে তারপরও বলে, ‘আমার তোমাকে আগের মতো করেই চাই। আগের মতো আমার সাথে বাইরে ঘুরতে যাবে। সময় দেবে। নাহলে পাগল হয়ে যাব আমি।’
মুনিয়া হাসল, ‘উহু। হবে না। তুমি ঠিকই ঠিকঠাক থাকবে।’
‘থাকব না। তুমি জানো না। আমি খুব খারাপ আছি, খুব খারাপ আছি মুনিয়া!’
মুনিয়ার বুকের ভেতর যেন ছলকে উঠলো জল। রাফি সাধারণত তাকে নাম ধরে ডাকে না। কালেভদ্রে হয়তো ডাকে। কিন্তু আজ অনেকদিন পর রাফির কণ্ঠে তার নামটা শুনে যেন শিরশির করে উঠল শরীর। বিষয়টা এক ধরনের দ্বিধাবিভক্ত অনুভব দিচ্ছে মুনিয়াকে। সে বিরক্ত হবার চেষ্টা করলেও পারছে না। ভেতরে ভেতরে বরং একটা স্পষ্ট, তীব্র ভালোলাগা। এই ভালোলাগাটাকে সে উপেক্ষা করতে পারছে না।
‘খারাপ আছো কেন? কোনো সমস্যা হয়েছে?’
‘কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু তুমিতো কোথাও নেই।’
‘তাতে কী? তোমার চারপাশেতো অসংখ্য মানুষ আছে। সেদিন তুমিইতো বললে, আমি নাহয় আমার নিঃসঙ্গতার জন্য তোমার সঙ্গ চেয়েছি। কিন্তু তুমিতো নিঃসঙ্গ নও। তোমার চারপাশে অনেক মানুষ। আমার শরীর ছাড়াতো তোমার আর কিছু দরকার নেই।’
রাফি সামান্য চুপ করে থেকে বলল, ‘কিন্তু তারপরও আমার কেবল তোমাকেই দরকার।’
‘আমাকেই?’
‘হুম। তোমাকেই।’
মুনিয়া চায় না রাফির এই কথাগুলো তাকে এলোমেলো করে দিক। কিন্তু তারপরও ভেতরে ভেতরে সে যেন রাফির গলা শুনেই নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে। জাফরের প্রতি সে একটা মায়া আজকাল নতুন করে টের পায়। কিন্তু সেই মায়া প্রবল ভালোবাসা হয়ে উঠতে পারে না যেন। যেন একটা নিস্পন্দন জলাশয়ের মতো। স্থির, গতিহীন, ঢেউহীন। রাফি কি তাহলে ঠিকই বলেছিল? সম্পর্কও পুরনো হলে তার প্রাবল্য হারায়। পরস্পরকে পাওয়ার দুর্দমনীয় আকর্ষণটা আর থাকে না। ক্ষ্যাপাটেপনা থাকে না। প্রলয়ঙ্করী উচ্ছ্বাস, তুমুল তেষ্টা আর থাকে না? নাকি তার একার ক্ষেত্রেই এমনটা হয়? অন্যরা ঠিকঠাক পরস্পরের প্রতি প্রবল ভালোবাসা নিয়েই সারাটা জীবন একসাথে থেকে যায়? এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর মুনিয়া জানে না। তবে আজকাল নিজেকে তার খুব একা মনে হয়।
রাফি বলল, ‘তোমাকে একটা কবিতা শোনাই?’
মুনিয়া কথা বলল না। তবে গভীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।
রাফি ভরাট গলায় পড়ল,
‘এই যে লোকে লোকারণ্য শহর, সকাল-সন্ধ্যা ভিড় ভাট্টা জাগে,
তবুও এমন একলা লাগার মানে, ‘নিজের একটা মানুষ সবার লাগে।’
মুনিয়া কোনো কথা বলল না। চুপ করে রইলো। রাফি এরপর আরো কী কী সব পড়ে গেল। কিন্তু সেসবের কিছুই মুনিয়া শুনল না। তার কেবল মনে হলো তার বুকের ভেতর সারাক্ষণ যে তীব্র তেষ্টাটা সে বয়ে বেড়ায়, যে চিনচিনে ব্যথা, গলায় বিঁধে থাকা সূক্ষ্ম কাঁটার মতো যে অস্বস্তি, যে অস্থিরতাটুকু সে প্রতি মুহূর্তে অনুভব করে, রাফি যেন এই দুটো লাইনেই তার সবটুকু বলে ফেলেছে। সবটুকু। আসলেইতো, তুমুল ব্যস্ততার এই শহর, এই লোকে লোকারণ্য পথ-ঘাট, এই ভিড়ভাট্টার রোজকার দিন, প্রতিটি মুহূর্ত, তারপরও নিজেকে কী ভীষণ একা মনে হয় তার। কী ভীষণ নিঃসঙ্গ মনে হয়। মনে হয় কোনো এক বিচ্ছিন্ন জনমানবহীন দ্বীপের একাকী নির্বাসিত এক মানুষ সে। রাফির প্রতি তার রাগ হয়, অভিমান হয়, কষ্ট হয়। কিন্তু তারপরও একমাত্র রাফিই যেন তাকে বুঝতে পারে। মুনিয়ার সবসময়ই মনে হয়, সে নয়, বরং রাফিই আসলে তার চেয়ে বয়সে বছর কুড়ি বড়। না হলে একটা মানুষ তাকে এমন অকপটে কী করে পড়ে ফেলতে পারে! কী করে সে যা ভাবে, যা অনুভব করে. তার সবটুকু এক নিমিষেই অমন গড়গড় করে বলে দিতে পরে। মনে হয় রাফি যেন তার বুকের ভেতর ঢুকে বসে আছে। সে যেন মুহূর্তেই সব দেখতে পায়, সব বুঝতে পারে। মুনিয়া যেন রাফির কাছে টলটলা স্বচ্ছ জলের মতো উন্মুক্ত, স্পষ্ট।
রাফি বলল, ‘আমার সাথে দেখা করবে না?’
মুনিয়া বলল, ‘উহু।‘
‘কেন?’
‘আমারও কিছু ভাল্লাগছে না’, ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল মুনিয়া।
‘তাহলে বাইরে চলে এসো। আজ সারারাত রাস্তায় রাস্তায় হাঁটি।’
‘তারপর?’
‘তারপর শহরের দেয়ালে দেয়ালে লিখে দিই, আমাদের হারিয়ে যেতে দাও। নিভিয়ে দাও শহরের সকল আলো। তারপর মুছে ফেল তোমাদের হৃদয় কিংবা আমাদের শহরের দেয়ালে দেয়ালে থাকা সকল নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি।’
মুনিয়া হাসল, ‘এত রাতে দেয়ালে লিখবে কী করে?’
‘কেন?’
‘রঙ-তুলি কোথায় পাবে?’
রাফি যেন একটু থমকাল। তারপর বলল, ‘তুমি মুঠো ভরে লিপস্টিক নিয়ে নামো। টকটকে লাল লিপস্টিক। ওটা দিয়েই লিখে দেব।
রাফির কথা শুনে মুনিয়ার খিলখিল করে হাসতে ইচ্ছে করছে। খুব খুশি হলে ঋদ্ধি যেমন হাসে, ঠিক তেমন। তুমুল হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে যাওয়া ধানের ডগার মতো এলোমেলো হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে তার। অমন করে হাসতে ইচ্ছে করছে। তারপর রাফির সাথে সারারাত শহরের পথে পথে ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কী করে তা করবে মুনিয়া? আবারো তার বুক চিড়ে বেরিয়ে এলো দীর্ঘ এক দীর্ঘশ্বাস। তারপর মিশে গেল শহুরে বাতাসে।