1 of 2

অর্ধবৃত্ত – ৪

নাবিলার শরীর খুব খারাপ করেছে। গত সপ্তাহখানেক ধরে টানা জ্বর। এরমধ্যে হঠাৎ করেই সাজ্জাদের কোনো খোঁজ নেই। সেই রাতের ঘটনার পর নাবিলা হাসপাতাল থেকে যখন বাসায় ফিরল, তখনও সাজ্জাদ ঠিকঠাক। কিন্তু তারপর হঠাৎই কাউকে কিছু না জানিয়ে উধাও হয়ে গেল সে। কোথায় গিয়েছে, কবে আসবে তার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। এই ঘটনা যে এবারই প্রথম তাও নয়। এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটে। হুটহাট দীর্ঘ সময়ের জন্য উধাও হয়ে যায় সাজ্জাদ। শফিকের ছুটিও প্রায় শেষ। সমস্যা হচ্ছে এ অবস্থায় নাবিলাকে একা রেখে সে যাবে কী করে! প্রথমে ভেবেছিল নাবিলাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে ঢাকায় তাদের বাড়িতে রেখে আসবে। কিন্তু নাবিলা তাতে রাজি নয়। সে এরকম চেহারা-শরীর নিয়ে বাড়ি যেতে চায় না। গেলেও আগে সুস্থ হয়ে, শরীরের ক্ষতগুলো শুকিয়ে তারপর যাবে। শেষ অবধি সিদ্ধান্ত হলো নাদিয়া কিছুদিনের জন্য এখানে এসে থাকবে। বোনের দেখাশোনা করবে। তাকে ঢাকায় গিয়ে নিয়ে আসতে হবে শফিকের। হাফসা অবশ্য বিষয়টা আঁচ করতে পেরেছেন। নাবিলা কিংবা নাদিয়া কেউই সাজ্জাদের বিষয়ে তাকে কিছু না বললেও তিনি অনেক কিছুই বুঝতে পারেন। নাবিলা যখন ফোন করে বলল, ‘মা, সাজ্জাদ একটা জরুরি কাজে কিছুদিনের জন্য বরিশাল যাবে। এখন আমি একা বাসায় কী করে থাকব? আমার শাশুড়ির শরীরটাও বেশি ভালো না। তুমি কি একটু নাদিয়াকে পাঠাতে পারবে?’

হাফসা বললেন, ‘তুই সাজ্জাদকে বল ঢাকা হয়ে বরিশাল যেতে। ঢাকা থেকে বরিশাল যাওয়ার প্লেনের ভাড়া আমি দেব। সে তোকে ঢাকায় রেখে যাক।’

‘কী যে বলো না মা। এখান থেকে বরিশাল কতক্ষণের পথ! সে কেন অযথা কষ্ট করে আবার ঢাকা হয়ে বরিশাল যাবে!’

হাফসা বিরক্ত গলায় বললেন, ‘বললামইতো, তোকে বাসায় রেখে যাওয়ার জন্য।

‘ও খুব ব্যস্ত মা। নতুন একটা ব্যবসার প্ল্যান করছে। তুমি এক কাজ করো না, নাদিয়াকে একটু পাঠানোর ব্যবস্থা করো। দিপু চাচ্চুকে দিয়ে পাঠাও। কতদিন হলো নাদিয়াতো আসে না।’

হাফসা আর কথা বাড়ালেন না। তিনি বুঝতে পারছিলেন কোনো একটা ঝামেলা আছে। কিন্তু দিপুকে পাওয়া গেল না। ফলে শফিককেই ঢাকায় আসতে হলো নাদিয়াকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। গাবতলী বাসস্ট্যান্ড থেকে তারা যাবে আরিচা ফেরিঘাট। ফেরিতে পদ্মা নদী পার হলেই ফরিদপুর। মোহাম্মদপুর থেকে সিএনজিতে তারা যাবে গাবতলী। তাদের সাথে খুব একটা লাগেজও নেই। ছোট একটা ব্যাগ নাদিয়ার। কিন্তু সিএনজিতে শফিক এমন জড়সড় হয়ে বসে রইল যে নাদিয়ার দেখে হাসি পেয়ে গেল। সে বলল, ‘শফিক ভাই, আপনি আরাম করে বসুন।’

শফিক কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বলল, ‘আমি আরাম করেই বসেছি। আপনার কোনো সমস্যা হলে বলবেন!’

‘আমার আবার কী সমস্যা হবে? অবস্থা এমন যে আমি চাইলে এই সিএনজির ভেতরে ঘুমিয়েও যেতে পারব।’

শফিক এই কথার অর্থ বুঝতে পারল না। সে বলল, ‘কী বলছেন! এখানে ঘুমাবেন কী করে!’

নাদিয়া হাসল, ‘আপনি এমন কেন শফিক ভাই?’

শফিক বুঝল না সে কেমন। কোনো ভুল করে ফেলেছে ভেবে সে রীতিমতো সংকুচিত হয়ে গেল। জড়ানো গলায় বলল, ‘আমি কিছু করেছি?’

‘হ্যাঁ, অবশ্যই করেছেন।’

‘কী!’ ভীত কণ্ঠে বলল শফিক।

‘আপনি আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়, তারপরও আমাকে আপনি আপনি করে বলেছেন।’

‘আমি সবাইকেই আপনি করে বলি।’

‘কিন্তু সিএনজিওয়ালাকে যে তুমি করে বললেন!

‘ও তো বাচ্চা একটা ছেলে। আমার চেয়ে কত ছোট হবে! বড় হলে আপনি করেই বলতাম।’

‘তাহলে কী দাঁড়াল শফিক ভাই? আমিওতো আপনার চেয়ে বয়সে ছোট। ভালোই ছোট। আমাকে কেন তাহলে আপনি করে বলছেন?’

শফিক চট করে এর কোনো উত্তর খুঁজে পেল না। তার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে সে এতবড় বিপদে এর আগে কখনো পড়েনি। নাদিয়া বলল, ‘বলুন। তাড়াতাড়ি বলুন।

শফিক জড়োসড়ো ভঙ্গিতে বলল, ‘মেয়েদের আমি আপনি করে বলি।’

‘সবাইকেই?’

শফিক এই প্রশ্নেরও জবাব দিল না। নাদিয়া বলল, ‘অপরিচিত মেয়েদের না হয় আপনি করে বলেন, তাই বলে পরিচিতদেরও আপনি করে বলবেন? আমিতো আপনার পরিচিত, তাই না?’

‘জি।’

‘তাহলে? এই নিয়ে আপনার সাথে আমার চারবার দেখা হলো। আপনি সম্পর্কে আমার আত্মীয়, তাই না?’

শফিক জানে না সে কী জবাব দিবে। সে চুপ করে বসে রইল। নাদিয়ার প্রশ্নের উত্তর যে সে জানে না, তা নয়। কিন্তু সেই উত্তর দেয়ার সাহস তার এই জীবনে কখনো হবে বলে মনে হয় না।

নাদিয়া বলল, ‘আপনিতো আপনার ভাবিকে ঠিকই তুমি করে বলেন।

শফিক সন্ত্রস্ত ভঙ্গিতে বলল, ‘ভাবি কে? কোন ভাবি?’

শফিক রীতিমতো ঘামছে। তার অবস্থা দেখে আবারও হাসল নাদিয়া। তারপর বলল, ‘ভয়ে নিজের ভাবির কথা পর্যন্ত ভুলে গেলেন? আমি আমার বোনের কথা বলছি। নাবিলা। সে আপনার ভাবি হয়।’

‘ওহ!’ শফিকের ধড়ে যেন প্রাণ ফিরে এলো। নাদিয়া বলল, আপনি কি আমাকে ভয় পান শফিক ভাই?’

‘নাহ।’

আমাকে ভয় পান না?’

শফিক ঢোক গিলে বলল, ‘আপনাকে ভয় পাবো কেন?’

‘আপনি অবশ্যই আমাকে ভয় পান শফিক ভাই। আপনাকে যতবার আমি দেখেছি, ততবারই খেয়াল করেছি, খানিক আগেও আপনি ঠিকঠাক ছিলেন। কিন্তু যেই আমার সাথে দেখা হলো, আর অমনি আপনি অস্বাভাবিক আচরণ করা শুরু করলেন। কারণটা কি আমাকে বলবেন?’

শফিক চুপ করে রইল। এই প্রশ্নের উত্তরও তার কাছে আছে। কিন্তু সেই উত্তরও সে কখনো দিতে পারবে বলে মনে হয় না।

নাদিয়া বলল, ‘আপনি আজ থেকে একটা কাজ করবেন।’

শফিক উদ্বিগ্ন গলায় বলল, ‘কী কাজ?’

‘আপনি এখন থেকে আমাকে নাদিয়া আপা বলে ডাকবেন।’

‘জি?’

‘হ্যাঁ।’

‘পারবেন না?’

শফিক জবাব দিল না। নাদিয়া বলল, ‘কী হলো, বলুন?।’

‘কী বলব?’

‘বলুন নাদিয়া আপা, স্লামালিকুম। আপনি কেমন আছেন?’

শফিক চুপ করে বসে রইল। নাদিয়া বলল, ‘হয় আমাকে তুমি করে বলবেন, না হলে নাদিয়া আপা বলবেন। মাঝামাঝি কিছু থাকবে না। ঠিক আছে?’

শফিক মাথা নাড়াল, ঠিক আছে।

সে অবশ্য বাসে ওঠার পর আর নাদিয়ার সাথে কথাই বলল না। তার সিটে জড়োসড়ো হয়ে বসে রইল। রাতে জার্নি করে ঢাকায় এসে আবার খুব ভোরেই সে নাদিয়াকে নিয়ে ফরিদপুরের উদ্দেশে রওয়ানা দিয়েছে। ফলে ক্লান্তিতে তার শরীর ভেঙে পড়ছিল। কিন্তু ঘুমের মধ্যে হঠাৎ যদি সে নাদিয়ার গায়ে ঢলে পড়ে, এই দুশ্চিন্তায় শক্ত হয়ে বসে রইল শফিক। তার হাতে একটা কাপড়ের ব্যাগ। সে সেই ব্যাগ রেখেছে তার ডান পাশে। যাতে কোনোভাবেই নাদিয়ার শরীরের সাথে তার ছোঁয়াছুঁয়ি না হয়।

নাদিয়া বলল, ‘আপনি কি একটু ঘুমিয়ে নেবেন শফিক ভাই?’

শফিক ত্রস্ত ভঙ্গিতে বলল, ‘না না। আমি ঠিক আছি।’

‘আপনার চোখ লাল। গতরাতেও সারারাত আপনি ঘুমাননি। আর এখনো ঘুমে

আপনার চোখ জড়িয়ে আসছে।’

‘নাহ। আমার একটুও ঘুম পাচ্ছে না।’

‘তাহলে আপনার চোখ এমন লাল কেন? আপনিও কি আপনার বড় ভাইয়ের মতো নেশাটেশা ধরেছেন নাকি?’

কিছু একটা বলতে গিয়েও শফিক শেষ পর্যন্ত বলল না। বরং চোখ নামিয়ে নিল। যেন তাকে কেউ এমন কোনো প্রশ্ন করতে পারে, এটা সে কখনো ভাবতেই পারেনি। এমনকি এই প্রশ্ন শুনেই সে অপরাধবোধে ভুগতে শুরু করেছে।

শফিক অবশ্য খানিক বাদেই ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু ঘুমের ভেতরও যে সে সন্ত্রস্ত হয়ে আছে তা তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। অসহায় শিশুর মতো ঘুমাচ্ছে সে। কিন্তু তার সেই ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে নাদিয়ার কেন যেন খুব হাসি পেল। বহুদিন সে এমন সহজ কোনো মানুষের সাথে মেশেনি। হয়তো এ কারণেই শফিককে খোঁচাতে তার ভালো লাগছে। ভয় পাইয়ে দিতে বা বিব্রত করতেও এক ধরনের আনন্দ হচ্ছে।

শফিকের ঘুম ভাঙল আরিচা এসে। ততক্ষণে আকাশ কালো করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আরিচা ফেরিঘাটে বিশাল গাড়ির সারি। পদ্মায় তুমুল ঢেউ। ফলে নদী পারাপারের ফেরি, লঞ্চ, স্পিডবোট সব বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সে কাঁচা ঘুম ভাঙা চোখে প্রায় লাফিয়ে উঠল। তারপর বিব্রত ভঙ্গিতে বলল, ‘আমরা কোথায়?’

নাদিয়া গম্ভীর মুখে বলল, ‘দিকশূন্যপুর।’

এমন কোনো জায়গার নাম শফিক আগে কখনো শোনেনি। সে হতবিহ্বল কণ্ঠে বলল, ‘দিকশূন্যপুরটা কোথায়?

‘তাতো আমি জানি না। আমিতো এখানে আগে কখনো আসিনি।’

শফিক অবশ্য বাইরে দোকানের সাইনবোর্ড দেখে বুঝল নাদিয়া ইচ্ছে করেই তার সাথে দুষ্টুমি করছিল। রাস্তার দু ধারে সবুজ ফসলের মাঠ। খানিক দূরেই নদী দেখা যাচ্ছে। এই নদীর কোনো কুলকিনারা আছে বলে মনে হচ্ছে না। বিশাল বিশাল ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে তীরে। এমন জায়গায় আগে কখনো বৃষ্টি দেখেনি নাদিয়া। সে মুগ্ধ গলায় বলল, ‘আমাদের এখানে কতক্ষণ আটকে থাকতে হবে?’

শফিক গাড়ি থেকে নেমে খবর নিয়ে এলো। বলল, ‘সঠিক কোনো টাইম নেই। ঢেউ কমলেই ফেরি ছাড়বে।’

‘তার মানেতো অনেক সময়।’

‘হুম। সামনে গাড়ির লম্বা সারি জমে গেছে।’

‘তাহলে এক কাজ করলে কেমন হয়?

‘কী কাজ?’

‘আমি যদি ওই মাঠের ওই পাশটায়, নদীর কাছে গিয়ে কিছুক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজি, তাহলে কোনো অসুবিধা আছে?’

শফিকের খুব বলতে ইচ্ছে করছিল, অসুবিধা আছে। খুব অসুবিধা আছে। আশপাশের এই সব মানুষ নাদিয়ার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবে, এটা তার কিছুতেই ভালো লাগবে না। কিন্তু শফিক সে কথা বলতে পারল না। সে বিড়বিড় করে বলল, ‘কোনো অসুবিধা নেই।’

নাদিয়া অবশ্য গেল না। সে চুপচাপ বাসের ঝাপসা হয়ে আসা জানালায় বৃষ্টি দেখতে থাকল। একটানা বৃষ্টি হচ্ছে। ভেসে যাচ্ছে মাঠ, ঘাট, নদী, পথ। সে সেই বৃষ্টি দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ল। তার মাথা হেলে পড়েছে শফিকের কাঁধে। তার গাল ছুঁয়ে যাচ্ছে শফিকের গলা। তার এলোমেলো চুল ছড়িয়ে আছে শফিকের মুখে। সেই চুল শফিকের বুকের ভেতর ছড়িয়ে দিতে থাকল গন্ধরাজ কিংবা দোলনচাঁপার সুবাস। সেই সুবাসে শফিকের হঠাৎ কান্না পেতে থাকল। সে আচমকাই আবিষ্কার করল, তার গাল ভিজে যাচ্ছে জলে। কী আশ্চর্য, এই বাসভর্তি লোক এখন এই দৃশ্য দেখলে তাকে কী ভাববে?

সে জানালার দিকে তাকিয়ে বাইরের বৃষ্টি দেখার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু পারল না। তার চোখের সামনে দৃশ্যমান সকল কিছুই কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে। শফিক বুঝতে পারছে না, তার দৃষ্টি হঠাৎই এমন ঝাপসা হয়ে আসছে কেন? একি তার চোখ বেয়ে নেমে আসা অবিশ্রান্ত অশ্রু ফোটার কারণে? নাকি বাসের জানালার কাচে জমা অবিশ্রান্ত বৃষ্টি ফোটার কারণে!

বুকের ভেতর গন্ধরাজ কিংবা দোলনচাঁপার সুবাস শুষে নিতে নিতে সে এই রহস্যময় প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে লাগল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *