৩৮
বাড়িতে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে গেছে। বহুদিন পর বউকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিল রুবেল। ফিরে এসে দেখে তাদের ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। জিনিসপত্র যা ছিল, তাও সব দিপুর ঘরের একপাশে স্তূপ করে রাখা। জাফর কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় মায়ের কাছে গেল। মছিদা বেগম গম্ভীর, অসহায় হয়ে বসে আছেন। রুবেল উত্তেজিত ভঙ্গিতে বলল, ‘এসব কী মা?’
মছিদা বেগম কথা বললেন না। আফজাল আহমেদও চুপচাপ বসে আছেন। যেন কারো কিছু করার নেই, বলার নেই। বাড়ির দুই বৃদ্ধ মানুষ যেন নিজেদের গুরুত্বহীনতা নতুন করে উপলব্ধি করতে পারছেন।
রুবেল বলল, ‘এটা কী ধরনের অসভ্যতা? এটা কি কোনো সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের বাড়ি?’
মছিদা বেগম বললেন, ‘চিৎকার করিস না। আগে ঠাণ্ডা হয়ে বোস। আমার কথা শোন।’
‘ঠাণ্ডা হয়ে বোস মানে!’ রুবেলের গলা ক্রমশই চড়তে লাগল। কী শুনব তোমার কথা? কী শুরু করেছো তোমরা?’
‘আগেতো শুনবি আমার কথা?
‘এরপরও তোমার কথা শুনব? বিয়ের দিন থেকে এইসব শুরু করেছে সেলিনা। আমি কিচ্ছু বলিনি। বলিনি মানে আমি কিছু বুঝিনি, তাতো না। কিন্তু তোমরা কী করেছো? সে যে নতুন একটা বউকে অপমান করছে, এটা বোঝোনা তোমরা?’
মছিদা বেগম নরম গলায় বললেন, ‘বুঝবো না কেন বাবা? আমরাতো ওকে বোঝানোর চেষ্টা করছি, তাই না? তুই চিন্তা করিস না, আমরা একটা ব্যবস্থা করছি।’
রুবেলের উত্তেজনা তাতে কমল না। সেই একই ভঙ্গিতে বলল, ‘কী ব্যবস্থা করবে তোমরা? আমারতো মনে হয় এই বাড়িতে কেউ দয়া করে আমাকে থাকতে দিয়েছে। আমি আশ্রিত।’
‘ছিঃ! এটা কেমন কথা? তুই অনেকদিন বাড়িতে থাকতি না। হঠাৎ বিয়ে করে বউ নিয়ে চলে এলি। এই জন্য প্রথম প্রথম একটু ঝামেলা হচ্ছে। প্ল্যান-প্রোগ্রাম করে কিছু করলেতো আগেভাগেই আমরা একটা ব্যবস্থা করতাম না?
‘ওহ, আমাকে কিছু করতে হলে সবকিছু আগেভাগে জানিয়ে করতে হবে। নাহলে এই বাড়িতে আমার জায়গা হবে না? আর তোমার মেয়ে যে কাউকে কিছু না বলে ডিভোর্স নিয়ে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে, তা খুব ঠিক আছে?’
‘এটা কী ধরনের কথা? ও এই অবস্থায় আর যাবে কই? ওর কি যাওয়ার আর কোনো জায়গা আছে? এটাইতো ওর একমাত্র যাওয়ার জায়গা, না?’
রুবেল শ্লেষাত্মক ভঙ্গিতে হাসল, ‘ওওওও…। তার কোনো যাওয়ার জায়গা নেই বলে সে বহাল তবিয়তে এখানে এসে বসে গেল। আর আমার কোনো রাইটস নাই? এ বাড়িতে সবার জায়গা আছে। ওপর তলার পুরোটা বড় ভাই, দোতলার পুরোটা মেজো ভাই। আর আমি? আমিতো পুরো একটা ফ্লোর চাইনি। চেয়েছি? একটা মোটে রুম, তাও তোমাদের সহ্য হলো না? নতুন বউ শ্বশুর বাড়িতে এসে যদি দেখে এমন জঘন্য উপায়ে…।’ রুবেল কথা শেষ করতে পারল না। রাগে তার গলা ধরে এলো।
মছিদা বেগম ঠাণ্ডা স্বরে বললেন, ‘এত উত্তেজিত হওয়ার মতো কিছু হয়নি। আমি তোদের থাকার ব্যবস্থা করছি।’
‘কী ব্যবস্থা করবে তুমি, হ্যাঁ? কী ব্যবস্থা করবে? নিজের মেয়ে বলে লাই দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলেছো। এখনতো বুঝতে পারছো, কেন সে স্বামী সংসার করতে পারেনি! কে করবে তার সাথে সংসার? এমন নোংরা, জঘন্য…।’
‘রুবেল!’ মছিদা বেগম এবার ধমকালেন, নিজের বোনের সম্পর্কে কীভাবে কথা বলতে হয়, সেটাও ভুলে গেছিস!’
রুবেল শ্রাগ করল, ‘হা হা হা। বোন? সে আমার বোন? বোন হলে এই কাজ সে করল কীভাবে?’
তুই কীভাবে করলি? এই এতোদিনে কোনোদিন নিজের বোনের খবর নিয়েছিস? একবারের জন্য মনে হয়েছে যে বোনটা এই অবস্থায় কেমন আছে, কী করছে?’
‘ওহ! এখন এইসব হিসেব কষা শুরু করেছো না?’
‘হিসেব টানলেই হিসেব আসে। আমিতো বলেছি তোদের থাকার ব্যবস্থা আমি করে দিচ্ছি।
রুবেল ফোঁড়ন কাটার ভঙ্গিতে বলল, ‘থাকার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি মানে কী? আমি কি ভিক্ষুক নাকি? এতই যখন হিসেব কষা শুরু করেছো, তখন এই বাড়িতে আমার হিসেব বুঝিয়ে দাও। আমি কেন ওইটুক এক রুমে থাকব? এ বাড়িতে অন্য সবার বউ বউ, আর আমার বউ বউ না? তারা সবাই বাড়িওয়ালার ছেলে হয়ে রাজার হালে থাকবে, আর আমি থাকব সাবলেট? কেন, আমি আফজাল আহমেদের ছেলে না?’
রুবেলের কথা শুনে মছিদা বেগম হতভম্ব হয়ে গেলেন। রুবেল যে এমন ভঙ্গিতে তার সাথে কথা বলতে পারে, এটা তিনি কখনো ভাবেননি। তারপরও যতটা সম্ভব শান্ত থেকেই তিনি বললেন, ‘আস্তে কথা বল।’ মছিদা বেগম চান না এসব কথা তুলি বা মুনিয়ারা কেউ শুনুক। তুলি বসে আছে দিপুর ঘরে। নিশ্চয়ই তার কানে অল্প বিস্তর হলেও কথাগুলো যাচ্ছে। রুবেল অবশ্য থামল না। সে বরং ক্রোধোন্মত্ত গলায় বলল, ‘আস্তে আবার কী! তুমি আজকের মধ্যে বাড়ি ভাগ করার ব্যবস্থা করবে। বাবা, বাবা।’ সে আফজাল আহমেদের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর উত্তেজিত ভঙ্গিতে বলল, ‘তুমি আজকের মধ্যে বাড়ি ভাগ করার ব্যবস্থা করবে। আমি এইভাবে আর থাকব না। তোমার অন্য ছেলে মেয়েরা সব রাজার মতো থাকব, আর আমি থাকব রাস্তার ফকিরের মতো, কেন? তুমি আমাকে জন্ম দাওনি?
আফজাল আহমেদ উত্তর কী দেবেন! রুবেলের কথা শুনে লজ্জায়, অপমানে তার মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে। তিনি ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় জড়সড় হয়ে বসে রইলেন। মছিদা বেগম অবশ্য এবার আর ছাড়লেন না। তিনি ক্ষুব্ধ ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর বললেন, ‘এতই যখন অধিকার ফলাতে এসেছো, তো এতদিন কই ছিলা? বুড়া বাবা-মা কেমন আছে, বেঁচে আছে না মরে গেছে, সে খবরটা পর্যন্ত কোনোদিন নিছো? বাবা-মায়ের দেখভালে কোনো ভাগ নেই, বাড়ির খুব ভাগ আছে না?’
রুবেল অকস্মাৎ থমকে গিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। সে ভাবেনি তার মা তাকে এমন কথা বলতে পারে। মছিদা বেগম বললেন, ‘দায়িত্ব শুধু বাপ-মায়ের না, সন্তানেরও দায়িত্ব আছে। তারও সেই দায়িত্ব পালন করতে হয়। শুধু বড় বড় কথা বললেই হয় না। দুই দিন হয় নাই বিয়ে হয়েছে, এর মধ্যেই সারাদিন বউয়ের আঁচল ধরে বসে থাকো, লজ্জা করে না? আর এতদিন ধরে যে মাসের পর মাস ফোন দিতাম, কই কোনোদিন তো নিজ থেকে একটা ফোনও দিতি না? দেখতে আসাতো দূরের কথা! আর আজ খুব বাপ-মা হয়ে গেছি না? খুব অধিকার শেখাতে আসছোস?’
মছিদা বেগম ক্ষোভের সাথে কথাগুলো বললেও রুবেল তা গ্রাহ্য করল না। সে চিৎকার করে বলল, ‘হয় বাড়ি ভাগ করে আমারটা আমাকে বুঝিয়ে দিবা। নাহলে কালই আমি ডেভলপার নিয়ে আসবো। এই বাড়ি ভেঙে আমি অ্যাপার্টমেন্ট বানাব। এইভাবে আমি আমার বউ নিয়ে বস্তির এত থাকতে পারব না।’
মছিদা বেগম এবার সত্যি সত্যি উত্তেজিত হয়ে উঠলেন, ‘এই বাড়ি তোর? তুই এই বাড়ি ভেঙে অ্যাপার্টমেন্ট করবি? তোর মতো বড় সাহস? তুই এখন এই মুহূর্তে ওই বউ নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবি।’
রুবেল দমল না। বরং চাপা, ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, ‘এত সহজ না, বুঝলা? দুনিয়া এত সহজ না। দরকার হলে আমি মামলা করব। তোমরা যা ইচ্ছা তাই করবা, আর আমি চুপচাপ সব মেনে নিব? কক্ষণো না। কখনো কিছু বলি না বলে ভেবেছো সবাই যা ইচ্ছা তাই করবে? একদম না।’
আফজাল আহমেদ ছেলের কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলেন। তার বিশ্বাস হচ্ছে না তার ছেলে রুবেল তার সামনে দাঁড়িয়ে এই কথাগুলো বলছে। তার বুকের ভেতর একটা চিনচিনে ব্যথা যেন থেকে থেকে জেগে উঠছে। তিনি অসহায়, দিশেহারা, নির্বাক এক মানুষের মতো বসে রইলেন। মছিদা বেগম অবশ্য রুবেলের থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। নিজেদের ঘরখানা ছেড়ে তারা দুই বুড়োবুড়ি চলে গেলেন উত্তর দিকের ছোট স্টোর রুমটাতে। ভাগ্য ভালো যে ছোট হলেও একটা খাট বসানোর ব্যবস্থা সেখানে আছে। ছোট্ট একটা জানালাও আছে। তবে সেটা পুরোপুরি খোলা যায় না। দিপুর ঘরখানা দিপুর দরকার। জায়গার অভাবে সে অনেকদিন থেকেই ড্রইংরুমে ঘুমায়। ফলে তাকে আর কষ্ট দিতে চাইলেন না মছিদা বেগম। স্টোর রুমের ওই অপ্রশস্ত, বদ্ধ, নোংরা ঘরখানাতে কোনো মতে উঠে গেলেন তারা। প্রায় অর্ধশত বছরের অভ্যস্ত, প্রশস্ত, আলো-হাওয়ায় বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়া চিরচেনা ঘরখানা ছেড়ে কবরের মতো অন্ধকার, নিস্তব্ধ সঙ্কীর্ণ এক ঘরে জবুথবু হয়ে বসে রইলেন দুই বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা। সেই ঘরের ঘুপচি অন্ধকারে আফজাল আহমেদের খুব কষ্ট হতে লাগল। তিনি বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছেন না। ভোর রাতে ঘুম ভেঙে তিনি মছিদা বেগমকে ডেকে ওঠালেন। তারপর বললেন, ‘আমার খুব শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে মছিদা।’
মছিদা বেগম ঘুমের ঘোরে বললেন, ‘কষ্ট হচ্ছে কেন? ইনহেলার নাওনি?’
আফজাল আহমেদ অস্পষ্ট কণ্ঠে বললেন, ‘নিয়েছি, কিন্তু ইনহেলারে এই কষ্ট যাবে না।’
মছিদা বেগম কথা বললেন না। তিনি বিছানা থেকে উঠে মশারিটা খুলে ফেললেন। তারপর শাড়ির আঁচলে আফজাল আহমেদকে বাতাস দিতে লাগলেন। আফজাল আহমেদ দরদর করে ঘামছেন। ফ্যানের বাতাসেও তার কিছু হচ্ছে না। মছিদা বেগম ভয়ার্ত গলায় বললেন, ‘খুব খারাপ লাগছে?’
‘হুম।’
‘কেমন খারাপ লাগছে?’
‘মনে হচ্ছে দম বন্ধ হয়ে মারা যাব।’
‘মেজো বৌকে ডাকব?’
‘উহু, এতোরাতে আর মেজো বৌকে ডেকো না।’
‘তাহলে?’
আফজাল আহমেদ কথা বললেন না। তিনি পাগলের মতো বিড়বিড় করে কীসব বলতে লাগলেন। মছিদা বেগম বললেন, ‘কী হয়েছে তোমার? ডাক্তার ডাকব?’
আফজাল আহমেদ তার কথার জবাব দিলেন না। তবে তিনি বিড়বিড় করে একনাগাড়ে বলে যেতে লাগলেন, ‘এই বাড়ি আমি ভাগ করব না। এই বাড়ি আমি কিছুতেই ভাগ করব না। প্রয়োজনে বিক্রি করে ফেলব। প্রয়োজনে বড় একটা হাতুড়ি এনে আমি নিজ হাতে এই বাড়ি ভেঙে গুঁড়াগুঁড়া করে ফেলবো। তবুও এই বাড়ি আমি ভাগ করব না। এই বাড়ির একটা ইটও আমি ভাগ করব না।’
আফজাল আহমেদ হঠাৎ হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন। মছিদা বেগম দু হাতে আফজাল আহমেদের হাত চেপে ধরে বললেন, ‘তোমার কিচ্ছু করতে হবে না। তুমি না চাইলে তোমার কিচ্ছু করতে হবে না।
‘কিন্তু রুবেল এইগুলা কী বলল? কী বলল সে এইগুলা? সেইদিন সেলিনাও বলল? আমি কী করব মছিদা? আমার কিছু ভালো লাগছে না। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। খুব কষ্ট হচ্ছে। আমার বুকের ভেতর, আমার পাঁজরের ভেতর সবকিছু ভেঙেচুড়ে যাচ্ছে। আমি শ্বাস নিতে পারছি না মছিদা।’
মছিদা বেগমের ভয় করছে। তিনি কী করবেন বুঝতে পারছেন না। আফজাল আহমেদ কাঁদছেন। যেন বুকের ভেতর জমা কষ্টের জমাট পাথর ধুয়ে দিতে চাইছেন চোখের জলে। তিনি সেই কান্না জড়িত কণ্ঠেই বললেন, ‘তুমি আমাকে একটু জড়াই ধরবা মছিদা? একটু শক্ত করে জড়াই ধরবা?’ মছিদা বেগম তার সত্তরোর্ধ্ব বয়সের স্বামীকে শক্ত করে তার শুকনো বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলেন। কিন্তু তার সেই শুকনো বুকের ভেতর যেন সযতনে সঞ্চয় করা আছে মমতার থইথই জল। সেই জলে ভিজে যেতে থাকলেন আফজাল আহমেদ। তারা দুজন বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা, দুজন স্বামী ও স্ত্রী, বিগত যৌবন নারী ও পুরুষ পরম মমতায় পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে রাখলেন। তাদের এই মমতায়ও শরীরের স্পর্শ আছে। কিন্তু সেই জীর্ণ, পুরনো, ফুরিয়ে যাওয়া শরীরের স্পর্শের আড়াল থেকে প্রবল মমতার স্পর্শ ছড়িয়ে জেগে উঠল একজোড়া মন। শরীরের সাধ্য নেই সেই মনকে প্রভাবিত কিংবা উপেক্ষা করে!