1 of 2

অর্ধবৃত্ত – ৩৭

৩৭

নাদিয়ার পরীক্ষা শেষ। মুকিত সেই সকাল থেকে এসে দাঁড়িয়ে ছিল তার হলের সামনে। এখন তারা খেতে বেরিয়েছে। মুকিতকে বেশ হাসি-খুশি লাগছে। সে বলল, ‘আমরা তাহলে ডেটটা ফিক্স করে ফেলি?’

আচমকা যেন বুঝতে পারেনি এমন ভঙ্গিতে নাদিয়া বলল, ‘কীসের ডেট?’

‘কীসের ডেট মানে? বিয়ের!’

‘বিয়ের?’ নাদিয়া অবাক গলায় বলল।

‘হুম। এখনতো সব ঠিকঠাক। তোমার পরীক্ষাও শেষ। মাও খুব তাড়া দিচ্ছে। শী লাভস ইউ আ লট। সেদিন বলছিল, আর তর সইছে না তার। বড় আপারও না।‘

‘এত তাড়াহুড়ারতো কিছু নেই। আমরা কেউইতো আর পালিয়ে যাচ্ছি না, তাই না?’

‘তা যাচ্ছি না, কিন্তু সমস্যাওতো নেই। সবকিছুতো ঠিকঠাক।’

নাদিয়া জানে, মুকিতের সাথে তার বিয়েটা অবশ্যম্ভাবী। এখানে অনিশ্চয়তার কিছু নেই, অনির্দিষ্ট কিছু নেই। অযথা বিলম্ব করার কোনো যৌক্তিক কারণও তার নেই। তাহলে কোন অজানা কারণে, কোন অনিশ্চিত প্রত্যাশায় সে অপেক্ষা করতে চাইছে? আর করলেও সেই অপেক্ষা কীসের, সেই প্রত্যাশা কার জন্য, তার কিছুই স্পষ্ট করে জানে না সে।

মুকিত বলল, ‘বিয়েতে অনেক প্রস্তুতির দরকার হয়। আগেভাগে সব ঠিকঠাক না করে রাখলে পরে গিয়ে নানা ঝামেলা বাঁধে।

‘কী কী ঝামেলা বাঁধতে পারে?’ নাদিয়া কৌতূহলী গলায় জিজ্ঞেস করল।

‘এটা খুব সংবেদনশীল ব্যাপারতো। হঠাৎ কতকিছুই হয়ে যেতে পারে।’

‘কী, কী হতে পারে?’

‘অনেক কিছুই। এই ধরো, আত্মীয়-স্বজনের ব্যাপার। আরো নানাকিছু।’

‘হলে কী করবেন আপনি?’

মুকিত একটু থমকে যাওয়া গলায় বলল, ‘তুমি এখনো আমাকে তুমি করে বলতে পারছ না, নাদিয়া?’

নাদিয়া এই প্রশ্নের জবাব দিল না। সে বলল, ‘আচ্ছা, মানুষ তার একটা জীবনের ভেতর আর কটা জীবন লুকিয়ে রাখে?’

‘মানে?’

মানে, এমন হয় না যে আপনি এমন কিছু কষ্ট, এমন কিছু চাওয়া সারা জীবন আপনার নিজের কাছেই লুকিয়ে রাখলেন, সেই গোপন জীবনগুলোর কথা কাউকে কখনো কিছুই বললেন না?

‘তা কেন? এমন কিছু নেই আমার।’

‘আপনি তাহলে সুখী একজন মানুষ।’

‘তা বলতে পারো। তুমি কি দুঃখী?’

নাদিয়া ম্লান হাসল, ‘আমাকে দেখে কী মনে হয়?’

‘ঠিকঠাক। তবে একটু খেয়ালি।’

‘খেয়ালি?’

‘হুম।

নাদিয়া মৃদু হাসল, ‘শুনেছি খেয়ালি মানুষ নির্বিকারভাবে অন্যদের দুঃখ দেয়, কিন্তু সে নিজে কখনো দুঃখ পায় না। আপনার কী মনে হয়, আমার কোনো দুঃখ আছে?’

‘তাতো জানি না। তবে তোমার কোনো দুঃখ থাকলেও আর কিছুদিন পর থেকে সেই দুঃখগুলো আর থাকবে না।’

‘কেন?’

‘কারণ, আমি কোনোভাবেই তোমার আর কোনো দুঃখ থাকতে দিবো না। একটা কথা বলব তোমাকে?’

‘হুম।’

মুকিত কথাটা বলার জন্য একটু সময় নিল। তারপর বলল, ‘তোমাকে আমি কী অসম্ভব ভালোবাসি, তুমি কখনো চিন্তাও করতে পারবে না নাদিয়া। আমি ছেলেবেলা থেকেই পড়ুয়া টাইপ ছেলে ছিলাম। দিন-রাত বইয়ের ভেতর ডুবে থাকতাম। ভালোবাসার এই তীব্র অনুভূতিটা কখনো বুঝতে পারিনি। মনে হতো বই পড়লেইতো সবকিছু বোঝা যায়, জানা যায়। কিন্তু…।’

‘কিন্তু কী?’

মুকিত তার চশমার কাচটা শার্টের হাতায় মুছলো। তারপর বলল, ‘তোমার সাথে দেখা হওয়ার পর এই প্রথম আমি বুঝলাম, বই পড়ে জগতের সবকিছু হয়তো জানা যায়, কিন্তু বোঝা যায় না।’ মুকিতের কণ্ঠ ভারি। ভেজাও কী! ‘কেউ কাউকে এত তীব্রভাবে অনুভব করতে পারে, ভালোবাসতে পারে, তুমি না হলে এই অনুভূতিটা বোধকরি সারাজীবন আমার অজানাই থেকে যেত।

সে হাত বাড়িয়ে নাদিয়ার হাত ধরল। তার সেই হাতের ভেতর নাদিয়ার হাতখানা পড়ে রইলো নিথর, নির্জীব, প্রাণহীন।

.

শফিক যে মেসে থাকে তা টিনশেড এক সারি ঘর। ছুটির দিন খাঁখাঁ দুপুরবেলা শফিক অলস শুয়ে ছিল। এই সময়ে পাশের ঘরের ছেলেটা তাকে ডাকল, ‘আপনের কাছে গেস্ট আসছে শফিক ভাই।

শফিক একটু অবাকই হলো। তার কাছে সাধারণত কেউ আসে না। এই অসময়ে আবার কে এলো? সে আলসামিপূর্ণ কণ্ঠে বলল, ‘ভেতরে আসতে বলো।’

‘মাইয়া মানুষ ভাই। ভিত্রে আইলে বাড়িওয়ালা সবাইরে শুদ্ধা ধাওয়াইবো। আপনের মতোনতো আর আমরা সবাই হিরো না। আমরা হইলাম আমজনতা। হে হে হে।’ ইঙ্গিতপূর্ণ কণ্ঠে কথাটা বলল ছেলেটা।

শফিক ভারি অবাক হলো। তার কাছে মেয়ে গেস্ট কে আসবে? সে শার্টটা গায়ে চড়িয়ে দরজার বাইরে এসে দাঁড়াল। এবং সাথে সাথেই থমকে গেল। নাদিয়া দাঁড়িয়ে আছে। মুহূর্তের জন্য শফিকের হৃদস্পন্দন যেন থেমে গেল। সে হড়বড় করে অনেক কিছু বলতে গিয়েও কিছুই বলতে পারল না। অসহায়ের মত দাঁড়িয়ে রইলো। নাদিয়া বলল, ‘বাড়িতে কেউ এলে তাকে অন্তত বসতে বলতে হয় শফিক ভাই।’

শফিক একবার ঘরের ভেতর ঢুকল, একবার বের হলো, আবার ঢুকল। সে আসলে নাদিয়াকে বসানোর জায়গা খুঁজছে। কিন্তু পাচ্ছে না। ঘরে একটা ভালো চেয়ারও নেই যে সে চেয়ারটা বাইরে এনে নাদিয়াকে বসতে দেবে। নাদিয়া ডেকে

বলল, ‘আপনাকে এত অস্থির হতে হবে না শফিক ভাই। চলেন মোড়ের চায়ের দোকানটায় বসে চা খাই।’

শফিক ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া গলায় বলল, ‘চলেন।’

‘শুধু চলেন বললে হবে?’

‘তাহলে?’

‘বলেন, চলেন শ্রদ্ধেয় নাদিয়া আপা।’ বলেই উচ্চস্বরে হাসল নাদিয়া। তারা মোড়ের চায়ের দোকানটাতে বসল। শফিক বলল, ‘আমিতো টাকা আনি নাই। ভুলে মানিব্যাগ রেখে চলে আসছি।’

নাদিয়া বলল, ‘দোকানদার আপনাকে চেনে না? সে বাকিতে খাওয়াবেনা আমাদের?’

‘কখনো খাইনিতো।’

‘তাহলে এখন কী হবে?’

‘আমি দৌড়ে গিয়ে মানিব্যাগ নিয়ে আসি?’

উহু। আপনি এখন এখানে বসে থাকবেন।

শফিক বসে রইলো। তার সামনে রাখা চা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। একটা কুকুর ঘুরঘুর করতে করতে এসে তার হাতে ধরা টোস্ট বিস্কুটটা ছোঁ মেরে নিয়ে গেল। শফিক চমকে সচকিত হয়ে উঠল। কিন্তু তারপরও একবারের জন্যও সে নাদিয়ার মুখের দিকে তাকাতে পারল না। নাদিয়া হঠাৎ বলল, ‘আপনি কখনো কাউকে ভালোবেসেছেন শফিক ভাই?’

শফিক ত্রস্ত ভঙ্গিতে ডানে বাঁয়ে মাথা নাড়লো। সে কখনো কাউকে ভালোবাসেনি। নাদিয়া হাসল, ‘এইসব বোঝেনতো আপনি?’

শফিক জবাব দিল না। নাদিয়া বলল, ‘না বোঝাই ভালো। এগুলো সব বোগাস। ফালতু ব্যাপার-স্যাপার।’

শফিক সমর্থনসূচক মাথা নাড়ল। নাদিয়া বলল, ‘ধরেন, যদি এমন হয় যে, আপনি কখনো ভাবতেও পারেননি, আপনার দূরতম কল্পনাতেও ছিল না, এমন কারো জন্য হঠাৎ আপনার কষ্ট হওয়া শুরু করল? তখন কী করবেন আপনি?’

শফিক এবারও জবাব দিল না। নাদিয়া বলল, ‘এমন কখনো হয় আপনার? শফিক কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর আবারও ডানে-বায়ে মাথা নাড়ালো। তার কারো জন্য এমন কখনো হয় না। নাদিয়া বলল, ‘কখনো না?’

‘উহু।’

নাদিয়া উঠে দাঁড়াল। তারপর ব্যাগ বের করে দোকানের বিল মেটাল। তারপর বলল, ‘আজ তাহলে যাই শফিক ভাই?’

শফিকের খুব ইচ্ছে করছিল নাদিয়া কেন এসেছে সেটা জিজ্ঞেস করতে। কিংবা নাদিয়ার পাশাপাশি হেঁটে কিছুটা দূর যেতে। কিন্তু সেসবের কিছুই করা আর হলো না তার। সে বিচলিত ভঙ্গিতে ওপর নিচ মাথা নাড়ল। নাদিয়া দীর্ঘসময় শফিকের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘যাই।’

শফিক বাঁ দিকে মাথা কাত করল। তার মনে হচ্ছে এতক্ষণ সে একটা স্বপ্ন দেখেছে। এটা বাস্তবে ঘটা কোনো ঘটনা না। নাদিয়া অনেকটা দূর হেঁটে গিয়ে আবার ফিরে এলো। তার হাতে একটা প্যাকেট। সে প্যাকেটটা শফিকের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘এটা রাখবেন?’

‘কী এটা?’ জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করল না শফিক। সে প্যাকেটটা হাতে দাঁড়িয়ে রইলো। প্যাকেটের ভেতর দুটো শার্ট। কিন্তু সেই শার্ট দু খানায় আর চোখ নেই শফিকের। সে তাকিয়ে আছে নাদিয়ার দিকে। নাদিয়া হেঁটে চলে যাচ্ছে দূরে। আরো দূরে। শফিকের চোখের দৃষ্টি ক্রমশই ঝাপসা হয়ে আসছে। সেই ঝাপসা চোখে চারপাশের কিছুই দেখতে পাচ্ছে না সে। আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে তার সেই ঝাপসা দৃষ্টির ভেতরও নাদিয়ার মুখখানা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল। সেই মুখে সীমাহীন যন্ত্রণা। শফিকের আচমকা মনে হতে লাগল, নাদিয়া তারচেয়েও বেশি দুঃখী। তারচেয়েও বেশি যন্ত্রণাকাতর। সমস্যা হচ্ছে, শফিকের মতো সেও এই জগতের কারো কাছেই তার সেই কষ্টগুলো বলতে পারছে না। যন্ত্রণাগুলো প্রকাশ করতে পারছে না। কেবল পাথরচাপা ঘাসের মতো ক্রমশই হলুদ হয়ে যাচ্ছে। ক্রমশই বিবর্ণ, ধূসর হয়ে যাচ্ছে।

.

আরো দিন দশেক বাদে শফিককে ঘটনা জানাল নাবিলা। সে ফোন করে বলল, ‘আমাকেতো ঢাকায় যেতে হবে শফিক। ‘

‘হঠাৎ ঢাকায় কেন ভাবি?’

‘ঘটনা গোপন, এক্ষুনি কাউকে বলা যাবে না।

শফিক অবশ্য আগ্রহও দেখাল না। তবে নাবিলা নিজ থেকেই বলল, ‘কাউকে

বলো না কিন্তু, আমাদের নাদিয়ার বিয়ে।’

‘কার বিয়ে?’ শফিকের গলা কাঁপছে।

‘নাদিয়ার।’

শফিক ফ্যাসফেঁসে গলায় বলল, ‘কোন নাদিয়ার?’

নাবিলা বিরক্ত গলায় বলল, ‘তুমি কি গাধা নাকি শফিক? আমাদের নাদিয়াকে তুমি চেন না?’

শফিক জবাব দিল না। নাবিলা বলল, ‘ছেলে ইউনিভার্সিটির টিচার। ফ্যামিলি খুবই ভালো। আমি ঢাকায় এলে ডেট ফাইনাল হবে। আমার জন্যই ছেলে পক্ষ, মা, জাহানারা খালা সবাই অপেক্ষা করছে। যদিও বাড়ির কাউকে এখনো কিছু জানানো হয় নাই। বাবাকেও না। আমি গেলে, তারপর সবাইকে জানানো হবে।

নাবিলা এরপর আরো কতকিছু বলে গেল। কিন্তু তার কিছুই শফিকের কানে গেল না। তার মনে হলো, আবারও সেই ভয়াবহ যন্ত্রণাময় অনুভূতিটা ফিরে আসছে। এই অনুভূতিটা সে ভয় পায়। কারণ সে জানে, পৃথিবীতে এই যন্ত্রণা সহ্য করার শক্তি কারো নেই। তারও নেই। এই অসহ্য যন্ত্রণা সে আর পেতে চায় না। সে বরং নাদিয়ার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে চায়। অনেক দূরে। যতটা দূরে গেলে এই সর্বপ্লাবি যন্ত্রণা আর তাকে স্পর্শ করতে পারবে না। এই সীমাহীন কষ্টের আগুন আর তাকে পোড়াবে না।

.

শফিক নিজের অজ্ঞাতেই ফোন কেটে দিল। সেদিন আর তার সাথে কথা হল না নাবিলার। তবে তার দিন কয়েক পরে শফিককে ফোন করল নাবিলা। কিন্তু শফিকের ফোন বন্ধ। মেসে তার রুমমেটকে ফোন করা হলো। সে জানাল, তিনদিন আগে হঠাৎ কাউকে কিছু না বলেই শফিক মেস ছেড়েছে। তারপর আর ফিরে আসেনি। তার ফোনও বন্ধ। সেই বন্ধ ফোন আর খোলা পাওয়া যায়নি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *