৩৪
সুমির সাথে দিপুর আবারো ঝগড়া হয়েছে। ঝগড়ার বিষয় সেই এক ও অভিন্ন। দিপুর খুব ইচ্ছে, সে ভরা পূর্ণিমায় পাহাড় কিংবা সমুদ্র দেখতে চায় সুমির সাথে। কিন্তু সুমির অবস্থানও সেই এক ও অভিন্ন, সে কোনোভাবেই দিপুর এই প্রস্তাবে রাজি নয়। যথারীতি ঝগড়া শেষে তারা রিকশায় ঘুরতে বেরিয়েছে। দিপু থম মেরে বসে আছে। সুমি অবশ্য খানিকটা নমনীয় আজ। আকাশে মেঘ করেছে। যেকোনো সময় বৃষ্টি শুরু হবে। বিষয়টা নিয়ে দিপু মনে মনে আতঙ্কিত। ঢাকা শহরে বৃষ্টিতে হুড খোলা রিকশায় শাড়ি পরা তরুণী নিয়ে ঘোরার অনেক বিপদ। চারপাশের মানুষ ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু এই কথা এই মুহূর্তে সুমিকে বলা যাবে না। সে আগ বাড়িয়ে সুমিকে কিছু বলতেও চায় না।
সুমিই হঠাৎ বলল, ‘আকাশ মেঘলা হলে কি হয় জানো?’
‘না।’
‘চাতক নামের এক পাখি আছে তারা আনন্দে পাগল প্রায় হয়ে যায়।
‘হু।’
‘আর উইপোকার দল, যারা মাটিতে উইঢিবি বানিয়ে বাস করে, তারা আতঙ্কে ছোটাছুটি করে।’
দিপু কথা বলল না। সুমি বলল, ‘কেন জানো?’
দিপু চুপ। সুমি মৃদু হেসে কোলের ওপর ফেলে রাখা দিপুর হাতখানা ধরল। তারপর বলল, ‘চাতক বৃষ্টি ছাড়া অন্য কোনো জল পান করে না। ফলে দিনের পর দিন প্রচণ্ড জলতেষ্টায় মৃতপ্রায় হয়ে গেলেও সে শুধু বৃষ্টির জলের অপেক্ষায় থাকে। বৃষ্টি মানেই তার জীবন। এই নিয়ে অসংখ্য গান আছে। তবে লালনের এই গানটা আমার খুব প্রিয়।’ বলেই গুনগুন করে গান ধরল সুমি, ‘চাতক পাখির এমনি ধারা তৃষ্ণায় জীবন যায় গো মারা, অন্য বারি খায় না তারা, মেঘের জল বিনে…’
দিপু তন্ময় হয়ে তাকিয়ে আছে সুমির দিকে। তার পাশে বসা অতি সাধারণ, চুপচাপ, শান্ত ধরনের এই মেয়েটাকে সে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। এই তার মনে হয়, জগতের সবচেয়ে দুর্বোধ্য, সবচেয়ে কঠিন হৃদয়ের মেয়ে সে। আবার পরক্ষণেই মনে হয় তার মতো এমন সংবেদনশীল, এমন মায়াময় কেউ আর এ জগতে নেই। দিপু নির্বিকার ভঙ্গিতে অন্যদিকে তাকাল। সে সুমিকে বুঝতে দিতে চায় না যে এত আগ্রহ নিয়ে সে সুমির গান শুনছে।
বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। সুমি আচমকা গান থামিয়ে বলল, ‘বৃষ্টি এলে মাটিতে বানানো উই পোকার ঢিবিগুলো মাটিতে মিশে যায় জানোতো? জীবন আর মৃত্যুর কী অদ্ভুত সমীকরণ, তাই না?’
দিপু বুঝতে পারছে না সুমি হঠাৎ এমন কথা কেন বলছে। সে তার হাতের মুঠোয় থাকা সুমির হাতটা শক্ত করে ধরল। তারপর বলল, ‘কী হয়েছে তোমার?’
‘আমার আজকাল খুব ভয় হয় দিপু। বাবা খুব অসুস্থ। তার অসুস্থতাটা সারছেই না। আর দেখো? আমি এখানে ঠিকঠাক পড়াশোনাটাও করছি না। এই সেই করে সময় নষ্ট করছি। প্রতি মাসে এত কষ্ট করে পাঠানো বাবার টাকাগুলো অপ্রয়োজনে খরচ করছি। পরপর অনেকগুলো পরীক্ষায় আমার রেজাল্ট খারাপ হলো। অথচ জানো, বাবার কত স্বপ্ন যে আমি পাস করেই টিচার হয়ে যাব!’
‘তুমি খুব অস্থির হয়ে গেছো। এখনোতো সময় চলে যায়নি। অনেক সময় তোমার হাতে। আর টিচারই হতে হবে এমন কোনো কথা আছে?’
‘হয়তো নেই, কিন্তু ওই যে বাবার স্বপ্ন। ওইটুকু আমি রাখতেই চাই।’
‘তোমার কোনো স্বপ্ন নেই?’
‘বাবার স্বপ্ন পূরণ করাটাই আমার স্বপ্ন।’
‘আর আমার?’
‘তোমার আবার কী?’
‘আমার স্বপ্ন পূরণ করাটা তোমার স্বপ্ন না?’
সুমি ডান হাতের আলতো ধাক্কায় দিপুকে সরিয়ে দিয়ে বলল, ‘তুমি এমন কেন দিপু?
‘কেমন?’
‘সারাক্ষণ অস্থির। জীবন নিয়ে সিরিয়াস কোনো চিন্তা-ভাবনা নেই। কোনো পরিকল্পনা নেই। অথচ সামনেই সবচেয়ে কঠিন সময়।’
দুজনই একসাথে সিরিয়াস হয়ে গেলে বিপদ। দেখা গেল বাচ্চা-কাচ্চা সব পেট থেকেই আইনস্টাইন-নিউটন হয়ে জন্ম নিচ্ছে। জীবনে রোয়ান এটকিনসন ও দরকার আছে। বুঝলে?’
‘বুঝলাম। কিন্তু তুমিওতো মনে হচ্ছে সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছো। আজকাল দেখি রোজ ভোর ছ-টা, সাতটায় ফোন করো, মেসেজ দাও। জীবনেতো কোনোদিন সকাল আঁটার ক্লাস করতেও দেখিনি। ঘুম থেকেই উঠতে পারোনি।’
‘বেকার হলে এমন অনেক কিছুই করতে হয়, যা কেউ ভাবেনি আগে।’ দিপু হাসতে হাসতে বলল।
‘ঘটনা কী?’
‘ঘটনা হলো দুই সিরিয়াস মানুষের ঝগড়া হয়েছে। ঝগড়ার ফলাফল একজন বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। আরেকজন অফিস, কাজ নিয়ে ব্যস্ত। এখন তাদের একমাত্র কন্যাকে স্কুলে আনা নেয়ার দায়িত্ব পড়েছে আমার।’
‘মুনিয়া ভাবির সাথে জাফর ভাইয়ার ঝগড়াও হয়?’
‘জি হয়। শুধু ঝগড়াই না আরো অনেক কিছুই হয়। এবার দেখলেতো, অতো সিরিয়াস হয়েও আসলে লাভ কিছু নেই।’
‘তারা দুজনই এত ব্যস্ত, ঝগড়া করার সময় পায় কখন?’
দিপু চোখ টিপে বলল, ‘অত ব্যস্ততার মধ্যেও যেভাবে বাচ্চার বাবা মা হবার সময় পেয়েছে, সেভাবে!’
সুমি আবারও দিপুর ঘাড়ে চাটি মেরে বলল, ‘মাথায় কখনোই কোনো সুস্থ চিন্তা আসে না তোমার, না?’
‘আসবে না কেন? অবশ্যই আসে। চোখ বন্ধ করো।’
‘চোখ বন্ধ করব কেন?’
‘তোমাকে একটা সুন্দর ভাবনা বলব। তুমি চোখ বন্ধ করে সেই ভাবনা ভাববে। মনে করবে আমার বলা দৃশ্যটা তুমি দেখতে পাচ্ছো, অনুভব করতে পারছো।‘
‘ধুর!’
প্লিজ। মাত্র ত্রিশ সেকেন্ডস।’ দিপুর কণ্ঠে অনুনয়। সুমি চোখ বন্ধ করল। দিপু বলল, ‘ভাবো। না আলো না অন্ধকার, এমন একটা সময়। মানে স্বপ্নে যেমন দেখা যায় আরকী!’
‘হুম।’
‘খুব মায়াময়, কোমল একটা আলো, ধরো থিয়েটারে যেমন থাকে, স্বপ্নের দৃশ্য বোঝাতে, অমন। অনেকটা বিভ্রমাত্মক। সেই আলোতে একটা অদ্ভুত বিষণ্ন সুন্দর মেঘ শরীরের চারপাশ দিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে। ভরা জোছনার আলোয় নীল কুয়াশার চাদরের মতো জড়িয়ে আছে। সেই মেঘের চাদরের ভেতর একজোড়া তরুণ-তরুণী পরস্পরের কাঁধে মাথা রেখে বসে আছে। তাদের মনে হচ্ছে, চারপাশের এই জীবন ও জগৎ, কিছুই বাস্তব নয়। অবাস্তব, অপার্থিব। মেয়েটা গুনগুন করে গান গাইছে, আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে…। গভীর নিঃশব্দ রাতে সেই গানের অপার্থিব সুর ভেসে বেড়াচ্ছে দূরের পাহাড়ে পাহাড়ে। কারণ ছেলেটা আর মেয়েটা বসে আছে সবচেয়ে উঁচু পাহাড়টার চূড়ায়। কী অদ্ভুত সুন্দর না দৃশ্যটা? আর ধরো তখন যদি বৃষ্টি হয়?’
দিপুর গলায় কিছু একটা ছিল। এমন করে এর আগে কখনো কিছু বলেনি দিপু। সুমি খানিক মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো। তারপর নরম গলায় বলল, ‘তোমার কথাটা শুনে কী মনে হলো জানো?’
‘কী?’
‘আমি আমার চোখের সামনে দৃশ্যটা দেখতে পাচ্ছি। কী যে সুন্দর, কী যে মায়াময়!’
দিপুর নিভে যাওয়া আশার আলো যেন আবার দপ করে জ্বলে উঠল। সে উত্তেজিত গলায় বলল, ‘সত্যি?’
‘হুম, সত্যি। সেদিন তোমাকে আমি বলেছিলাম না যে আমার এমন একটা জায়গায় যেতে ইচ্ছে হয়, যেখানে কোনো দুশ্চিন্তা থাকবে না, ভয় থাকবে না। চারদিকে কেবল অদ্ভুত সুন্দর মায়াময় এক পৃথিবী! কোনো দুঃখ নেই, অশান্তি নেই, অস্থিরতা নেই। জায়গাটা তেমন মনে হচ্ছে।’
‘সত্যি বলছো?’
‘হুম।’
‘চলো না তাহলে যাই?’
‘কোথায়’
‘বান্দরবান। নীলগিরি। পায়ের তলায় জাহাজের মতো মেঘ ভেসে যায়। হাত বাড়ালেই ছুঁয়ে দেয়া যায়। আর ভরা পূর্ণিমায় মরে যেতে ইচ্ছে হয়। প্লিজ…।’
সুমি সাথে সাথেই জবাব দিল না। কী যেন ভাবলো সে। তারপর আচমকা বলল, ‘আমাকে আরেকটু ভাবতে দাও। তবে আমার কিছু শর্ত আছে।’
‘কী শর্ত? কী শর্ত?’ দিপুর যেন আর তর সইছে না।
‘বললামতো আগে আমাকে ভাবতে দাও। যদি ভেবে মনে হয়, হ্যাঁ, যাওয়া যায়। তাহলে তখন শর্তগুলোও বলব।’
‘আমি সব শর্তে রাজি।’
‘সব শর্তে?’
‘হুম।’
যদি বলি রাতটা আমরা আলাদা ঘরে থাকব?’
দিপু যেমন দপ করে জ্বলে উঠেছিল, ঠিক তেমনই করেই নিভে গেল সে। সুমি বলল, ‘কী হলো? এখনোতো অন্য শর্তগুলো বলিইনি।’
দিপু ম্লান গলায় বলল, ‘এরপরে আবার শর্ত কী? এরপর দুনিয়ার আর সব শর্ত দিলেই কী?’
সুমি মৃদু হাসল, ‘যদি এই শর্তে রাজি থাকো, তবে বাদবাকি শর্তগুলোও এক এক করে বলব। তারপর ভাবব। তারপর সিদ্ধান্ত নেব। এগুলো হলো ভাবার প্রি কন্ডিশন।’
দিপু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘আচ্ছা। আমি রাজি।’
‘শুধু মুখে মুখে রাজি বললে হবে না দিপু।’ সুমি হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল। ‘আমি আমার এইটুক জীবনের সব সংস্কার, সব দ্বিধা, লজ্জা উপেক্ষা করে তোমার ইচ্ছেটা পূরণ করার কথা ভাবছি। তেমনি বাকি জীবন কাটানোর জন্য তোমার ওপর নির্দ্বিধায় অন্ধের মতো বিশ্বাস করা যায় কী না, তার পরীক্ষাও এটা
দিপু থমথমে মুখে বলল, ‘বাদ দাও। তোমার যেতে হবে না। তোমার মতো এমন স্কুল টিচার টাইপ খুঁতখুঁতে, গম্ভীর, পিউরিটান মেয়ের সাথে ভরা পূর্ণিমায় নীলগিরি দেখতে যাওয়ার কোনো মানে হয় না। এই রিকশা থামান।
দিপু প্রায় চলন্ত রিকশা থেকেই নেমে গেল।
.
আজিজ মাস্টার ঢাকায় এসেছেন সুমির সাথে দেখা করতে। কিন্তু সুমি তাকে দেখে চমকে গেছে। এর আগেরবার যখন তিনি সুমির সাথে দেখা করতে এসেছিলেন, তখনো এতটা খারাপ অবস্থা ছিল না তার। এবার শুকিয়ে প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছেন তিনি। গাল ভেঙে ভেতরে ঢুকে গেছে। মুখের লম্বা দাড়িও সেই ভাঙা গাল ঢাকতে পারছে না। হাতগুলো জীর্ণ-শীর্ণ। বাবাকে দেখে এতোটা ধাক্কা এর আগে কখনো লাগেনি সুমির। সে অবশ্য আজিজ মাস্টারকে সেটা বুঝতে দিল না। গতকাল এক সাথে দু মাসের টিউশনের বেতন পেয়েছে সে। বাবা ঢাকা আসবে শুনে তাই মনে মনে খুশিই হয়েছিল।
আজিজ মাস্টার অবশ্য বললেন তিনি বিকেলের লঞ্চেই আবার চলে যাবেন। তার এক দুঃসম্পর্কের খালাতো ভাই আছে। সে থাকে পুরান ঢাকার নারিন্দায়। তিনি এখন তার বাসায় চলে যাবেন। সেখানে গিয়ে একটু বিশ্রাম নেবেন। যতটা সম্ভব ঘুমিয়ে আবার বিকেলের লঞ্চেই বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করবেন। বাড়ি থেকে সুমির জন্য এক গাদা খাবার পাঠিয়েছেন তার মা। পাকা পেঁপে, গাছের কচি শশা, দুই রকমের পিঠা পাঠিয়েছেন। সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে খোসা ছিলে দুটো ঝুনা নারিকেলও পাঠিয়েছেন তিনি। সুমির কথা হচ্ছে ইউনিভার্সিটির হলে বসে এই শক্ত নারিকেল ভেঙে কে খাবে!
মাকে অবশ্য এতকিছু বলে লাভ নেই। যত যাই বলা হোক, তিনি এর কিছুই শুনবেন না। বরং খুঁজে খুঁজে আরো উদ্ভট উদ্ভট জিনিস পাঠাবেন। সুমি ছোটবেলায় কী কী খেতে পছন্দ করত, সেসব পাঠাবেন। সেসব খাবার হয়তো এখন দু চোখে দেখতেই পারে না সুমি। তারপরও পাঠাবেন।
সুমি বাবার হাত থেকে পোটলাগুলো নিয়ে রুমে রেখে এলো। তারপর বলল, ‘একটা কাজ করলে কেমন হয় আব্বা?’
‘কী কাজ?’
‘তুমি এখন নারিন্দায় চাচার বাসায় গিয়ে একটু ঘুমিয়ে নিলে, তারপর আমি এসে তোমাকে নিয়ে একটু ঘুরতে বের হলাম?’
‘এই রোদে ঘোরাঘুরির আবার কী দরকার? এমনিতেই তোর গায়ের রং ময়লা হয়ে গেছে।’
সুমি মিষ্টি করে হাসল, ‘দরকার আছে আব্বা। রোদের মধ্যে ভিটামিন আছে।’
‘তোর যতসব উল্টাপাল্টা কথা। এমনিতেই না খেয়ে না খেয়ে শরীরের এ কী দশা করেছিস?’
‘এটাকে না খাওয়া বলে না আব্বা। এটাকে ডায়েট কন্ট্রোল বলে। আজকাল সব মেয়েরাই ডায়েট কন্ট্রোল করে। যত বেশি শুকনা, তত বেশি সুন্দর।’
আজিজ মাস্টার বিরক্ত গলায় বললেন, ‘না খেলে মানুষ সুন্দর হয়, এই কথা আমি জীবনেও শুনি নাই। সারাজীবন শুনে আসছি, বেশি বেশি খেতে হয়। এখন তোদের কাছে এসে নিজেরে মূর্খ মনে হয়। তোর পরীক্ষার রেজাল্টের কী খবর?’
সুমির বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। সে বাবার কাছে সহসা মিথ্যে বলতে চায়না। পড়াশোনা নিয়েতো নয়ই। তারপরও সে বলল, ‘এই তো আব্বা, ভালোই।’
আজিজ মাস্টার আরো কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই সুমি বলল, ‘তুমি এখন যাও আব্বা। এই সাত সকালে হলের গেটে দাঁড়িয়ে এইসব আলাপ না করলেও হবে। আমি যখন আসব তখন করো।
‘কখন আসবি?’
‘জাস্ট এগারোটায়। তুমি কিন্তু রেডি হয়ে থাকবা।’
‘আচ্ছা।’
আজিজ মাস্টার নারিন্দায় গিয়ে লম্বা ঘুম দিলেন। ঘুম থেকে উঠে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তিনি আঁতকে উঠলেন, দুপুর দুটা বাজে। কী সর্বনেশে ব্যাপার! সুমি তাকে বলেছিলেন এগারোটার মধ্যে রেডি হয়ে থাকতে। কিন্তু সুমি কেন এখনো এলো না?
তিনি বিছানায় উঠে বসতে গিয়ে আবিষ্কার করলেন সুমি তার পায়ের কাছে চেয়ারে বসে আছে। তার গাল ভেজা। আজিজ মাস্টার হতচকিত গলায় বললেন, ‘কী হয়েছে মা?’
সুমি হন্তদন্ত হয়ে দুহাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছতে মুছতে বলল, ‘কী হবে আব্বা?’
‘তুই কাঁদছিস কেন?’
‘ধুর, তুমি যে কী বলো আব্বা! ভেবেছিলাম এবার তোমার অ্যাজমার ডাক্তারটা দেখাব। এখনতো দেখি চোখের ডাক্তারটাও দেখাতে হবে।’ হাসার চেষ্টা করছে সুমি। ‘তুমি চট করে হাত মুখটা ধুয়ে নাওতো আব্বা। আমরা এক্ষুনি বেরুবো।’
‘তুই কখন এসেছিস?’
ঠিক এগারোটায়।’
‘তাহলে এতক্ষণ ডাকিসনি কেন?’
তুমি ঘুমাচ্ছিলে তো তাই।’
আজিজ মাস্টার আর কথা বললেন না। তিনি চুপচাপ বাথরুমে ঢুকে গেলেন। তার মেয়েটা এমন হয়েছে কেন কে জানে! তাকে যে সব বলে দিতে হয় তা নয়, তিনি অনেক কিছুই বোঝেন। মেয়েটা যে সারাক্ষণ তার বাবার জন্য উৎকণ্ঠিত হয়ে থাকে তা তিনি বোঝেন। ছোটবেলায় মা হারিয়ে সমায়ের কাছে মানুষ হয়েছেন তিনি। মায়ের স্নেহটা তাই দেখেই বুঝতে চেষ্টা করেছেন। অনুভব করার সুযোগটুকু আর হয়নি। কিন্তু মেয়েটা যেদিন থেকে বড় হতে শুরু করল, যেদিন থেকে বুঝতে শুরু করল, সেদিন থেকেই কী কী করে যেন তিনিও অনুভব করতে শুরু করলেন মায়ের মমতা। যতবার মেয়েটার কথা তার মনে হয়, ততবারই মনে হয় আরো কটা দিন যদি বেঁচে থাকা যেত। যদি আরো কটা দিন অপেক্ষায় থাকা যেত! কিন্তু জীবন কি তাকে সে সুযোগ দিবে? শরীরের যে অবস্থা তার, তাতে মনে হয় না এই সুযোগ আর তিনি বেশিদিন পাবেন। কিন্তু আজকাল বড্ড বেঁচে থাকতে ইচ্ছে হয় তার। সুমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকে সবচেয়ে বেশি। কিন্তু তিনি জানেন, তার হাতে সময় বেশি নেই। শরীর তাকে সেই সময় আর দেবে না। নিজের অজান্তেই আজিজ মাস্টারের বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো, আহারে জীবন, আহারে!
রিকশায় বাবা মেয়ে পাশাপাশি বসে ঢাকা শহর দেখছে। তারা দোয়েল চত্বর দিয়ে টিএসসির দিকে ঢুকলো। সুমি আচমকা রিকশা থামিয়ে বলল, ‘হাওয়াই মিঠাই খাবে আব্বা?’
আজিজ মাস্টার বললেন, ‘খাবো।’
তারা হাওয়াই মিঠাই খেতে খেতেই সুমি বলল, ‘চটপটি খাবে আব্বা?’
আজিজ মাস্টার বললেন, ‘খাবো।’
চটপটি খেতে গিয়ে সুমি বলল, ‘কোনটা খাবে, চটপটি না ফুচকা?’
আজিজ মাস্টার বললেন, ‘দুই প্লেট চটপটি, দুই প্লেট ফুচকা।’
সুমি বাবার দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে দিল, ‘তোমার হঠাৎ কী হয়েছে আব্বা?’
শরীরটা মনে হচ্ছে ঠিক হয়ে গেছে রে মা। কী যে ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে পেটভর্তি খিদে। গত এক মাস কিছু খেতে পারছিলাম না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ওই প্লাস্টিকের প্যাকেটটাও কচকচ করে চাবিয়ে খেয়ে ফেলতে পারব।’
‘তোমার কিন্তু শরীর খারাপ করবে আব্বা।’
‘করলে করুক।’ বলেই দুই প্লেট ফুচকা আর এক প্লেট চটপটি খেয়ে ফেললেন আজিজ মাস্টার। শুধু যে এগুলোই খেলেন তাই নয়, বিকেলে তারা ভারি খাবারও খেলেন। সুমি বলল, ‘আব্বা তোমার শরীর খারাপ লাগছে?’
আজিজ মাস্টার ঝলমলে গলায় বললেন, ‘নারে মা। আমার শরীর ঝরঝরে লাগছে।‘
সন্ধ্যার আগে আগে বাবাকে নিয়ে শপিং করতে গেল সুমি। দুটা দামি পাঞ্জাবি কিনে দিল। মায়ের জন্য শাড়ি আর জুতো। আজিজ মাস্টার বললেন, ‘তুই টিউশনির টাকা পেয়েছিস তাই না?’
সুমি কাচুমাচু গলায় বলল, ‘আমার যে আজ কী ভালো লাগছে, আমি তোমাকে বোঝাতে পারব না আব্বা। তুমি দয়া করে আজ আমাকে টিউশন নিয়ে বকো না।’
আজিজ মাস্টার বললেন, ‘বকব কেন? তোর কাছে টাকা থাকলে তুই আমাকেও একজোড়া জুতা কিনে দে। নরম দেখে কিনবি। আর ফিতাওয়ালা কিনবি না।’
সুমির যে কী আনন্দ হচ্ছে! সে জীবনে প্রথম তার উপার্জনের টাকা দিয়ে বাবা মাকে কত কিছু কিনে দিল। তার ধারণা, বিষয়টা বাবা বুঝতে পেরেছিলেন। আর বুঝতে পেরেছিলেন বলেই তিনি সুমিকে কিছু বলেননি। সুমির এই আনন্দটা তিনি নষ্ট করে দিতে চাননি।
মাগরিবের আজানের সময় সুমি বলল, ‘লঞ্চ কটায় আব্বা?’
‘আটটায়।’
‘কিন্তু এখন কি এই জ্যাম ঠেলে সদরঘাট গিয়ে লঞ্চ ধরতে পারবে?’
‘পারব।’
‘রওয়ানা দেব তাহলে?’
‘নাহ।’ কথাটা খুবই ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে বললেন আজিজ মাস্টার। কিন্তু সেই কথাটি শুনেই সুমির এত ভালো লাগল। বাবাকে সে এমন আনন্দিত হতে আর কখনো দেখেনি। সে বলল, ‘তাহলে?’
‘তাহলে কী?’ নির্বিকার ভঙ্গিতে জবাব দিলেন আজিজ মাস্টার।
‘তুমিতো লঞ্চ মিস করবে?’
আজিজ মাস্টারের হাতে চিকেন ফ্রাইয়ের লেগ পিস। তিনি সেই লেগ পিসে আয়েশ করে কামড় বসালেন। তারপর মুখভর্তি খাবার নিয়ে গমগমে গলায় বললেন, ‘করলে করব।’
তুমি আজ বাড়ি যাবে না আব্বা?’
‘নাহ, যাব না মা।’
তারা পিতা-কন্যা আরো কিছুক্ষণ এখানে সেখানে ঘুরল। আজিজ মাস্টারের মনে হলো এই দিন তার জীবনের শেষ দিন। এমন আনন্দময় দিনের পর আর বেঁচে না থাকলেও ক্ষতি নেই। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে তার বেঁচে থাকার প্রতি লোভ বেড়ে যাচ্ছে। তিনি সুমিকে হলে পৌঁছে দিতে দিতে বললেন, ‘কাল সকাল সকাল চলে আসিস মা। আমরা সারাদিন ঘুরলাম। বিকেলের লঞ্চে আমি বাড়ি চলে গেলাম।‘
সুমি বলল, ‘কাল সকালেতো আমার ক্লাস আছে আব্বা। আজতো শুক্রবার ছিল। এইজন্য সারাদিন ঘুরতে পেরেছি।’
আজিজ মাস্টারের মন খারাপ হয়ে গেল। তার এখন মনে হচ্ছে একদিনের জন্য একটা দুটো ক্লাস না করলে কী হবে! তারপরও তিনি গম্ভীর মুখে বললেন ‘সমস্যা নেই। ক্লাস সবার আগে মা। ভালো রেজাল্ট সবার আগে।’
সুমি অবশ্য ক্লাস করতে পারল না। সারাদিন তাকে ফোন করেও পায়নি দিপু। এই নিয়ে দিপুর সাথে রাতে তার তুমুল ঝগড়া হলো। দিপু অবশ্য তাকে ফোন দিয়েছিল বিশেষ একটা খবর দিতে। খবরটা দিপুর জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি সুমির জন্যও। দিপু খবরটা এমনি এমনি দিতে চায়নি। সে চেয়েছিল সুমিকে চমকে দিতে। কিন্তু সারাদিন সুমির ফোন বন্ধ পেয়ে উল্টো সে নিজেই চমকে গেছে। এই নিয়ে রাতে তুলকালাম হয়ে গেল দুজনের। সুমি ঘুমাল শেষ রাতের দিকে। তার ঘুম ভাঙল সকাল দশটায়। ততক্ষণে আটটার ক্লাস মিস হয়ে গেছে তার। রাতে দিপুর সাথে ঝগড়া করে ফোন বন্ধ করে রেখেছিল সুমি। কিন্তু সকালে ঘুম থেকে উঠে ফোন খুলতেই দেখে দিপুর মেসেজ। সে দীর্ঘ মেসেজ লিখেছে। সেই মেসেজের মূল বক্তব্য হচ্ছে, একটা বিদেশি প্রতিষ্ঠানের ঢাকা অফিসে তার চাকরি হয়েছে। চাকরিতে তার শুরুর যা বেতন, তা ঢাকা শহরে পরিবার নিয়ে ভালোভাবে বসবাস করার জন্য যথেষ্ট।
মেসেজ দেখে সুমির খুবই মন খারাপ হয়ে গেল। সে শুধু শুধু দিপুর সাথে চোটপাট করেছে। ছেলেটা এত বড় একটা আনন্দের সংবাদ সবার আগে তার সাথে ভাগাভাগি করতে চেয়েছিল। অথচ সে কী না সারাদিন ফোন বন্ধ করে রেখেছিল। উপরন্তু রাতে ফোন দেয়ার পর দিপুর কঠিন কঠিন কথা শুনে তুমুল ঝগড়াও করল সে। অন্তত শান্ত হয়ে তার রাগ কিংবা অভিমানের কারণটা সে শুনতে পারতো! আজকাল কিছু একটা হয়েছে তার। কথায় কথায় দিপুর সাথে রেগে যায় সে। বিষয়টা নিয়ে সুমি খুবই আড়ষ্ট বোধ করতে থাকল। কিন্তু এখন দিপুর মন ভালো করে দেবে কী করে সে?
আচমকাই বুদ্ধিটা মাথায় এলো সুমির। আজ বাবার সাথে দিপুকে দেখা করিয়ে দিলে কেমন হয়! দিপু যে এতবড় একটা চাকরি পেয়ে গেল তার একটা উদযাপনও না হয় হয়ে যাবে।
শেষ পর্যন্ত তাই হলো। দিপু অবশ্য বেশিক্ষণ তার রাগ ধরে রাখতে পারে না। সুমি ফোন করে বলল, ‘আমিও একটা সারপ্রাইজ জমা করে রেখেছি।’
দিপু থমথমে গলায় বলল, ‘কী সারপ্রাইজ?’
‘আজই তোমাকে আব্বার সাথে পরিচয় করিয়ে দেব। হবু জামাইর মুখটা দেখে যাক না হয়! ‘
দিপু খুশিই হলো। সেও চায় সুমির পরিবারের কারো সাথে তার পরিচয় থাকুক। তা ছাড়া চাকরিটা যখন হয়েই গেছে, তখন তাদের বিয়েটা হয়ে যেতেতো আর সমস্যা থাকার কথা না। সেই সম্পর্কের শুরুটা না হয় আজই হোক।
দুপুরে এক সাথে খেল তারা। আজিজ মাস্টার অবশ্য সুমির সাথে দিপুকে দেখে ভারি বিরক্ত হয়েছেন। সুমি বলল, ‘ওর নাম দিপু বাবা।’
‘হুম?’
‘আমার বন্ধু।
‘হুম।’
‘ও ক্যামেস্ট্রিতে পড়ে।
‘হুম।’
সুমি চোখ টিপে দিপুকে ইশারা দিল কথা বলতে। দিপু অবশ্য ঠিকঠাক গুছিয়ে কিছুই বলতে পারল না। সে যে এত বড় চাকরি পেয়েছে তাও না। আজিজ মাস্টার বিকেলে লঞ্চে ওঠার আগে বললেন, ‘মেয়ে বড় হলে বিয়ে শাদি দিতে হয়, এটা আমি জানি মা।’
সুমি কথা বলল না। আজিজ মাস্টার বললেন, ‘কিন্তু মেয়ে মানুষের জীবনে বিয়েটাই সব না মা। তুমি যেখানে বড় হইছো সেখানে সব বাবা মা মেয়ে বড় হতে না হতেই বিয়ে দিয়ে দেয়। আমি কিন্তু তা করি নাই। আমার মেয়েরে নিয়ে আমার স্বপ্ন অনেক বড়। আমি মরার আগে সেই স্বপ্নটা পূরণ হতে দেখার খুব শখ আমার মা।‘
সুমি চুপচাপ বাবার সামনে দাঁড়িয়ে রইলো। আজিজ মাস্টার হঠাৎ মেয়ের কাঁধে হাত রাখলেন, ‘এজন্য আবার বেশি টেনশন করিস না। যা হওয়ার হবে। তোর শরীর স্বাস্থ্যটা কিন্তু আমার ভালো লাগতেছে না মা।’
‘আমি ঠিক আছি আব্বা। তুমি চিন্তা করো না।’ সুমি মৃদু কণ্ঠে বলল।
‘চিন্তাতো আর কেউ ইচ্ছা করে করে না মা। চিন্তা আপনাআপনি চলে আসে। নিজের শরীরের দিকে খেয়াল রাখিস।’
‘আচ্ছা আব্বা।’
‘আর তোর শ্বাসকষ্টের সমস্যা কি এখনো কষ্ট দেয়।’
সুমি মাথা নাড়াল, ‘না আব্বা, একদম নেই। পুরোপুরি সেরে গেছে। ‘
সুমি আসলে মিথ্যা কথা বলেছে। তার শ্বাসকষ্টের সমস্যা আগের চেয়ে বেড়েছে। কিন্তু সেই কথাটা সে বাবাকে বলতে চায় না। তার কেন যেন বাবার জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে বাবার সাথে এই তার শেষ দেখা। এরপর আর কখনো তার বাবার সাথে দেখা হবে না। তার ইচ্ছে হচ্ছে বাবাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু সে সেটি পারছে না।
সে বলল, আব্বা যাই?’
আজিজ মাস্টার মেয়ের মাথায় হাত বুলালেন। তারপর বিড়বিড় করে দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে দিলেন। তারপর আলতো করে কপালে চুমু খেয়ে বললেন, ‘আল্লাহু শাফি, আল্লাহু মাফি। ফি আমানিল্লাহ মা।’
সুমি ঘুরে হাঁটা দিল। বাবার দিকে আর ফিরে তাকাল না। তার চোখ ভর্তি জল। সে এই জল ছলছল চোখ বাবাকে দেখাতে চায় না।