৩২
মানসিকভাবে এতটা বিধ্বস্ত বহুকাল হয়নি মুনিয়া। শারীরিক-মানসিকভাবে ভঙ্গুর এক মানুষ যেন সে। তার চারপাশের চেনা পৃথিবী, চেনা মানুষ, চেনা সম্পর্ক ও সম্পর্কের সমীকরণ হঠাৎই যেন নতুন চেহারা নিয়ে মুখোমুখি হয়েছে। নিজেকে যতটা সম্ভব শক্ত, আত্মবিশ্বাসী রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করছে সে। কিন্তু পারছে না। কেমন একটা তীব্র আত্মপরিচয়ের সংকট সারাক্ষণ তাড়া করে বেড়াচ্ছে তাকে। রাফিও যেন দিন দিন অন্যরকম এক মানুষ হয়ে যাচ্ছে। এমনিতেই রাফি অনুনমেয়। তাকে প্রেডিক্ট করা খুব কঠিন। কিন্তু তারপরও আজকাল মাঝেমাঝে একদম চেনাই যাচ্ছে না তাকে। যেন ভয়াবহ কোনো মানসিক ট্রমার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সে। তবে রাফি ইদানীং হুটহাট যে কথাগুলো তাকে বলে, সেই কথাগুলো আবার নতুন করে ভাবাচ্ছে মুনিয়াকে। তার এতদিনকার ভাবনা, বোঝাবুঝি, অনুভব সব।
মুনিয়া সেদিন হঠাৎ রাফিকে জিজ্ঞেস করল, ‘সত্যি করে বলোতো, তুমি কি আমাকে ভালোবাসো?’
‘হ্যাঁ বাসি।’
‘কেন ভালোবাসো?’
রাফি সাথে সাথেই জবাব দিল না। ভাববার সময় নিল যেন। মুনিয়া বলল, ‘কেন ভালোবাসো সেটা বলতেও ভাবতে হয়?’
রাফি নিরুত্তাপ কণ্ঠে বলল, ‘অন্যরা যেমন বলে তেমন করে বললে হয়তো সময় লাগত না।
‘অন্যরা কেমন করে বলে?’
‘এই ধরো, ভালো লাগে বলে ভালোবাসি। তোমার মতো করে আমাকে আর কেউ বোঝে না। এইসব।
‘তা তুমি কী বলবে?’
‘আমি যেটা বলব, সেটা শুনলে তোমার খারাপ লাগবে।’
মুনিয়া আচমকা যেন শক্ত হয়ে গেল, ‘বলো, শুনি?’
রাফি সাথে সাথেই জবাব দিল না। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে ধীরে সুস্থে সিগারেট ধরাল সে। তারপর আয়েশ করে ধোঁয়া ছাড়ল। তারপর বলল, ‘শরীরের জন্য।’
মুনিয়া যেন অকস্মাৎ কথাটা বুঝতে পারল না। তবুও তার সারা শরীর ঝিমঝিম করে উঠল। সে বলল, ‘কী?’
রাফি এবার শান্ত এবং স্থির কণ্ঠে বলল, ‘তোমার শরীরের জন্য আমি তোমাকে ভালোবাসি।’
মুনিয়া জানে না সে কী বলবে! তার কেবল মনে হচ্ছে তার চারপাশের চেনা মন ও মানুষ, জগৎ ও জীবন সকলই কাঁচের দেয়ালের মতো হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ছে। সে আর্তনাদের ভঙ্গিতে বলল, ‘রাফি!’
রাফি বলল, ‘এই ধরনের সম্পর্কের কি কোনো পরিণতি আছে? তুমিই বলো, এ সম্পর্কের লক্ষ্য কী? তুমি কি তোমার ফ্যামিলি, হাজবেন্ড, সন্তান রেখে আমার কাছে চলে আসতে পারবে? কিংবা আমি? আমিও কি তোমাকে একসেপ্ট করতে পারব?’
মুনিয়া হতবিহ্বল বোধ করছে। এবং এতদিনে এই প্রথম সে আবিষ্কার করছে রাফির এই সহজ-সরল প্রশ্নের উত্তরটা তার কাছে নেই। তারপরও সে বলল, ‘তাহলে এই সম্পর্কের একমাত্র লক্ষ্য শরীর?’
রাফি হাসল, ‘আমারতো তাই মনে হয়। হ্যাঁ, হয়তো এর পাশাপাশি আরো অনেক কিছুই আছে, কিন্তু মূল ওই শরীরই।’
‘কিন্তু আমি তোমার সান্নিধ্য পছন্দ করি রাফি। সেটা কেবল শরীরী নয়।’ আর্তনাদের গলায় বলল মুনিয়া।
রাফি বলল, ‘হুম। তোমার ব্যক্তিগত জীবনে তুমি এক ধরনের নিঃসঙ্গতায় ভুগছো, সেই নিঃসঙ্গতা কাটাতে আমাকে তোমার প্রয়োজন। কিন্তু কখনো কি ভেবেছো, এই সম্পর্কে আমি কেন এলাম? আমারতো নিঃসঙ্গতা নেই, আমার চারপাশে অনেক মানুষ। তাহলে এই অসম সম্পর্কে আমি কেন এলাম?’
মুনিয়া তাকিয়ে আছে। এই প্রশ্নের উত্তরও তার কাছে নেই। রাফি বলল, ‘অনেস্টলি বললে, প্রথমে হয়তো ফিজিক্যাল ফ্যান্টাসি থেকেই আমি এই সম্পর্কে এসেছি। সমস্যা হলো আমরা কেউই সেটা স্বীকার করতে চাই না। আমরা কেবল নানা অনুভবের কথা বলি, ভালোবাসার কথা বলি। কিন্তু এই সম্পর্কের লক্ষ্য কিংবা গন্তব্য শেষ পর্যন্ত ওই শরীরই।
‘আর কিচ্ছু না?’ মুনিয়া যেন এক নিঃস্ব, প্রতারিত মানুষ।
‘নিশ্চয়ই আরো অনেক কিছুই আছে। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে সেগুলো অনেক পরে এসেছে। তোমার সাথে মিশতে মিশতে এক ধরনের ভালোলাগা তৈরি হয়েছে। তোমার সান্নিধ্য ভালো লাগতে শুরু করেছে, ডিপেন্ডেন্সিও তৈরি হয়েছে। কিন্তু প্রথম দিকে তোমার প্রতি আমার স্রেফ একটা শরীরী আকর্ষণই ছিল। আর কিছুই না!’
মুনিয়া বুঝতে পারছে না কী বলবে! তারপরও সে বলল, ‘আমারতো বয়স হয়ে যাচ্ছে, পুরুষের কাছে আমার শরীরী আয়ুতো ফুরিয়ে আসছে। তোমার কাছেও।’
রাফি হাত বাড়িয়ে মুনিয়ার হাতটা ধরল। তারপর ভরাট গলায় বলল, ‘সেটাও স্বাভাবিক। শরীর ফুরিয়ে গেলে ভালোবাসার পাগলামিটা আর থাকে না। তখন থাকে অভ্যস্ততা, নির্ভরতা। এমন আরো অনেক কিছু। কিন্তু সেটি স্বীকার করতে আমরা ভয় পাই। আমার কথায় তুমি মন খারাপ করো না।’
দূরে তখন সূর্য ডুবছে। ফুরিয়ে আসছে দিনের আলো। নিস্তেজ হয়ে আসছে ঝাঁজালো দিন। খানিক বাদেই অন্ধকার নামবে। মুনিয়ার নিজেকে হঠাৎ ওই অস্তগামী সূর্যের মতো মনে হতে লাগল। বিষণ্ন নিষ্প্রভ, একা।
.
পরদিন ভোরে ঋদ্ধিকে স্কুলে দিয়ে আসার পথে দিপু বলল, ‘কীরে, মার জন্য
খারাপ লাগছে না?’
ঋদ্ধি বলল, ‘লাগছে।’
‘কথা হয়েছে?’
‘হ্যাঁ, ফোনে।’
‘কেন? স্কুলে দেখা হয়নি?’
‘মাতো বেশ কদিন ধরে স্কুলে আসছে না।’
‘কেন? শরীর খারাপ?’
‘না শরীর খারাপ না।’
‘তাহলে কী হলো হঠাৎ!’ দিপু একটু চিন্তিতই হলো। ‘একবার যাবি নাকি? বেশি দূরতো নয়। ঘণ্টাখানেক লাগবে।’
‘হ্যাঁ, যাওয়া যায়।’
‘কী হলো, তুই কাঁদছিস কেন?’
‘আমি? কই? কাঁদব কেন আমি!’ ঋদ্ধি হাতের কুনুই ভাঁজ করে লুকিয়ে চোখ মুছল। তার হঠাৎ মায়ের সেদিনের কথাটা মনে পড়ে গেল। মা ঠিকই বলেছে, বড় হলে মানুষ খুব সহজে মিথ্যে বলা শিখে যায়!
.
মুনিয়ার সাথে দিপুর দেখা হয়ে গেল ঋদ্ধিকে স্কুল থেকে আনতে গিয়ে। আজ স্কুলে এসেছে মুনিয়া। সে ঋদ্ধিকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে গেটের কাছে। দূর থেকে মা মেয়েকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে— কিছু একটা হয়েছে তাদের। একটা অদৃশ্য দেয়াল যেন। তবে দুজনই সেই দেয়ালটা ভাঙার চেষ্টা করছে। সমস্যা হচ্ছে দৃশ্যমান দেয়াল ভাঙা যত সহজ, অদৃশ্য দেয়াল ভাঙা ততটাই কঠিন। রথিকে দেখা যাচ্ছে গেটের ভেতর। ঋদ্ধি কিছু একটা বলতে তার দিকে এগিয়ে গেল। মুনিয়া একা দাঁড়িয়ে। দিপু রিকশা থেকে নামতে নামতে বলল, ‘তুমিতো আরো সুন্দর হয়ে গেছো ভাবি। তবে মায়ের হাতে রান্না খেতে খেতে মোটা হয়ে যাচ্ছো।’
মুনিয়া ম্লান হাসল, ‘বয়সতো আর বসে থাকে না।’
‘তোমার আবার বয়স কী!’
‘যেহেতু মহাশূন্যে বসবাস করি না, বয়সের হিসেব তো পৃথিবীর নিয়মেই হবে, তাই না?’
‘তুমিতো দেখি এ কদিনেই দার্শনিক হয়ে গেছো। ঘটনা কী বলোতো, প্রেমে ট্রেমে পড়েছো নাকি?’
মুনিয়া চমকালো, ‘প্রেম? জীবনানন্দ পড়োনি?… প্রেম ধীরে মুছে যায়, নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়…।’
‘কবিতা!’ এবার দিপু চমকাল। ‘মাফ চাই বাবা। এর মধ্যে আমি নাই। ওসব তোমাদের ব্যাপার। ওই যে রাফি আসছে, তোমাদের বরং জমবে ভালো। সেও কবি। নিজের লেখা কবিতার লাইন টিশার্টের বুকে লিখে ঘুরে বেড়ায়।’
মুনিয়া ঘুরে তাকাল। অনেকদিন বাদে রথিকে নিতে এসেছে রাফি। মুনিয়া তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। সামান্য হাসল কেবল। রাফিও। তবে দিপুকে দেখে যেন উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো রাফি। বলল, ‘তোমার সাথে সেদিন দেখা হলো কিন্তু কথা আর হয়ে উঠল না। কী খবর?’
‘হ্যাঁ ভালো। তুমিতো বিখ্যাত হয়ে গেছো রাফি।
‘আমি! কীভাবে?’
‘কীভাবে দেখবে?’
রাফি এবং মুনিয়া অবাক চোখে তাকাল। দিপু তার পকেট থেকে ফোন বের করে তাদের বাড়ির সামনের উল্টোদিকের ফুটপাত ঘেঁষা দেয়ালে লেখা লাইনটা দেখিয়ে বলল, ‘দেখো।’
‘কী? মুনিয়া আর রাফি, দুজনই উৎসুক হয়ে দেখল। চুনকাম করা সাদা দেয়ালে লাল অক্ষরে লেখা ‘আমাকে হারাতে দিলে নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তিতে ছেয়ে যাবে তোমার শহর।
দিপু বলল, ‘লেখাটা তোমার না? সেদিন তোমার টিশার্টে দেখলাম। মজার ব্যাপার হচ্ছে আমাদের বাসার উল্টোদিকের দেয়ালেও কে যেন লাল রঙ দিয়ে ঠিক এই কথাটিই লিখে রেখেছে! শুধু এটি না, আরো কীসব কবিতার লাইন আছে। আমি একদিন নিখোঁজ হবো… এইসব হাবিজাবি কত কী!’
রাফি মনে মনে হকচকিয়ে গেলেও নিজেকে সামলে নিল, ‘কী বলছো তুমি!’ হ্যাঁ, ছবিতে দেখলে না! যদিও যে লিখেছে সে তোমার নাম দেয়নি।’ রাফি এবার হাসল, ‘ব্যাটাকে ধরতে পারলে হতো, চুরি করে অন্যের লেখা এখানে সেখানে লিখে রাখবে আবার নামও দেবে না, কী আশ্চর্য!’
ঋদ্ধি আর রথি কখন এসে দাঁড়িয়েছে পাশে, কেউ খেয়ালই করেনি। ফেরার পথে ঋদ্ধি বলল, ‘কী হয়েছে চাচ্চু?’
‘কীসের কী হবে?’
‘ওই যে আমাদের বাড়ির ওখানে দেয়ালে কী যেন লেখার কথা বলছিলে?’
‘ওহ।’ দিপু ঘটনা খুলে বলল ঋদ্ধিকে। ঋদ্ধি খুব আগ্রহ নিয়ে ছবিটা দেখতে চাইল। সাদা দেয়ালে লেখা লাল রঙের শব্দগুলো দেখে তার বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠল। ইশ, এই কথাগুলো যদি তার জন্য কেউ লিখতো! ঠিক কেউ না, কেবল রাফি, রাফি যদি এই কথাগুলো কখনো তার জন্য লিখতো!
বাড়ির সামনে এসে খুব মনোযোগ দিয়ে দেয়ালের লেখাটা দেখল ঋদ্ধি। একটু ম্লান হয়ে গেলেও এখনো স্পষ্ট। কিন্তু লেখাটা এতদিন তার চোখে পড়েনি কেন কে জানে! পাশের দেয়ালেও আরো কটা কবিতার লাইন লেখা। কিন্তু লেখাগুলো দেখার পর থেকেই কেমন এক অস্থিরতা বয়ে বেড়াতে লাগল ঋদ্ধি। সেই অস্থিরতা কিছুতেই কাটল না। গভীর রাতে কী মনে করে সে তার নোটবুকের পৃষ্ঠাগুলো ওল্টাতে লাগল। কোনো এক অজ্ঞাত অভিমানে কতদিন সে রাফির লেখা কবিতার লাইনগুলো ছুঁয়ে দেখে না! কিন্তু আজ এই প্রায় মধ্যরাতে, একলা ঘরে, সুনসান নীরবতায় তার নোটবুকে রাফির হাতে লেখা সেই কবিতার লাইনগুলো দেখে তার হঠাৎ দম বন্ধ হয়ে এলো। এক লহমায় বুকের ভেতর কী যেন কী ছলকে উঠল!
দেয়ালে লেখা ওই লাইনগুলো রাফির নিজের হাতে লেখা। ওটা রাফিরই হাতের লেখা। কিন্তু ওই লাইনগুলো কার জন্য লিখেছে সে? এখানে, এই বাড়ির সামনে, ঠিক ঋদ্ধির ঘরের জানালার সোজা রাস্তার ওপাশের দেয়ালে! কার জন্য?
সেই সারাটা রাত আর ঘুম হলো না ঋদ্ধির। সে জেগে রইলো সংশয় ও স্বপ্নের এক অদ্ভুত দোলাচলে।