1 of 2

অর্ধবৃত্ত – ২৯

২৯

হাফসার ঘুম ভেঙে গেছে মাঝরাতে। ঘুমের ঘোরে তিনি ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখেছেন। ঘুম ভেঙে তিনি ফ্যাসফেঁসে গলায় নাদিয়াকে ডাকলেন, ‘নাদিয়া, ও নাদিয়া, নাদিয়া।’

নাদিয়া পড়ছিল। সে পেছন ফিরে তাকিয়ে বলল, ‘বলো মা।’

‘এদিকে একটু আয়তো মা।’

নাদিয়ার পড়া অনেক বাকি। সে বলল, ‘বাথরুমে যাবে?’

‘নাহ।’

‘তাহলে? ক্ষিদে পেয়েছে? কিছু খাবে?’

‘নাহ। তুই একটু এদিকে আয়।’ হাফসার গলায় বিরক্তি।

নাদিয়া মায়ের কাছে গেল। মশারির বাইরে দাঁড়িয়ে সে বলল, ‘বলো।’

‘মশারিটা তোল।’

মশারি তুলব কেন? তুমি না বললে বাথরুমেও যাবে না, কিছু খাবেও না?’

তুই মশারি তুলে ভিতরে আয়।’

‘ভিতরে আসব কেন?’

‘আসবি কারণ আমি নড়তে পারছি না।’

‘বাথরুমে না গেলে তোমার নড়তে হবে কেন?’

হাফসা এবার বিরক্ত হলেন, ‘বাথরুমে যাওয়া ছাড়া আমার নড়ার প্রয়োজন পড়তে পারে না? আমার জীবনে কি খাওয়া আর হাগামুতা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই?’

নাদিয়া আর কিছু বলল না। সে মশারি তুলে মায়ের কাছে গিয়ে বসল। হাফসা অতি কষ্টে তার ডান হাতখানা নাদিয়ার হাতের ওপর রাখলেন। গত কদিনে তার শরীরের ব্যথাটা আবারও অসহ্যরকম বেড়েছে। হাত-পা নড়াতেও কষ্ট হচ্ছে তার। তিনি নাদিয়ার হাতখানা ধরে বললেন, ‘আমার বুকের ওপর একটু আয়তো মা।’

‘বুকের ওপর আসব কেন?’

‘আমার বুকের ওপর তোর মাথাটা একটু রাখ।’

নাদিয়া তার মায়ের ঘটনা কিছুই বুঝতে পারল না। মাঝে মাঝে তিনি এমন অদ্ভুত সব কর্মকাণ্ড করেন যে নাদিয়ার বিরক্তই লাগে। তাও সে কিছু বলে না। হাফসা অসুস্থ। দীর্ঘদিনের দুরারোগ্য ব্যাধি তার। এ সময় মানুষ এমনিতেই ভয়াবহ মনঃকষ্টে থাকে। তার শারীরিক কষ্টের চেয়েও মানসিক কষ্ট হয়ে ওঠে প্রবল। ফলে সামান্য কথাতেই সে আহত বোধ করে। নিজেকে অপাঙ্ক্তেয় মনে করে। বিষয়টা নাদিয়া বোঝে। আর বোঝে বলেই সে মায়ের নানা অন্যায় আবদারও বিনা বাক্যে মেনে নেয়। নাদিয়া মায়ের বুকের ওপর তার মাথাটা রাখল। হাফসা ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে। সে তার হাতটা উঠিয়ে নাদিয়ার গাল ছুঁয়ে দিল। তারপর আলতো হাতে চেপে ধরে রাখল কিছুক্ষণ। নাদিয়া হঠাৎ আবিষ্কার করল হাফসা কাঁদছেন। সে বলল, ‘তুমি কাঁদছো কেন আম্মা?’

হাফসা জবাব দিলেন না। তার কান্নার তোড় বাড়ছে। নাদিয়া আলগোছে সরে গিয়ে মায়ের পাশে বালিশে মাথা রাখল। তারপর এক হাতে মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘কী হয়েছে বলো? দুঃস্বপ্ন দেখেছো?’

হাফসা কোনো মতে কান্না থামিয়ে বললেন, ‘খুব খারাপ স্বপ্ন দেখেছি।’

‘খারাপ কী স্বপ্ন?’

রাতের খারাপ স্বপ্ন বলা যায় না।

‘বলা যায় না কেন?’

‘তাহলে সত্যি হয়ে যায়।’

‘তুমি এসব বিশ্বাস করো আম্মা?

হাফসা এই কথার জবাব দিলেন না। তিনি আবার কাঁদতে লাগলেন। তারপর বললেন, ‘তোর আপুর অনেক দিন কোনো খোঁজখবর নেই। ওর একটু খবর নিবি মা?’

‘এই এত রাতে আমি তাকে ফোন করব আম্মা?’

‘বিপদ আপদের আবার রাত দিন কী?

‘তোমার ধারণা সে বড় কোনো বিপদে পড়েছে?’

‘পড়তেও তো পারে।’

‘কেন? তুমি তাকে নিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখেছো বলে?

‘কাকে নিয়ে দেখেছি তা মনে করতে পারছি না। তবে তোদের দুজনের একজনই হবে! একবার মনে হলো তুই আবার একবার মনে হলো নাবিলা। ঠিক স্পষ্ট করে মুখটা দেখতে পেলাম না। খুব অন্ধকার ছিল। একটা জঙ্গলের মধ্যে। মেয়েটা ভয় পেয়ে দৌড়াচ্ছিলো আর চিৎকার করে কাঁদছিল। দেখে মনে হচ্ছিল তাকে কেউ তাড়া করছিল।’

‘তোমার ধারণা এই এত রাতে তোমার বড় মেয়ে একলা একলা জঙ্গলের ভেতর দৌড়াচ্ছে?’

হাফসা এই প্রশ্নের উত্তর দিলেন না। তিনি জানালার বাইরের অন্ধকারে তাকিয়ে রইলেন। বাইরে মৃদু হাওয়া বইছে। একটু ঠাণ্ডা ঠাণ্ডাও লাগছে। শীতের আগমনী কি বোঝা যাচ্ছে? শহরে অবশ্য আজকাল আর শীত নেই। কখন আসে আর কখন চলে যায়, টেরই পাওয়া যায় না।

হাফসা সেদিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘বাইরে গেটের কাছে আগে একটা শব্দ হতো না?’

‘কীসের শব্দ?’

‘ঘটাং ঘটাং একটানা শব্দ?’

‘কী বলছো? আমি কখনো শুনিনি।’

‘আমি শুনেছি। কয়েকদিন পরপরই শুনতাম। একটানা ঘটাং ঘটাং।’

‘সারাক্ষণ একা একা শুয়ে থাকতে থাকতে তোমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে আম্মা? তুমি আজেবাজে চিন্তা করো আর ভাবো, এই সবকিছুই সত্যি। আসলেতো সবই তোমার কল্পনা। এই এতদূর তিন তলা থেকে তুমি নিচতলার গেটের ঘটাং ঘটাং শব্দ শুনতে পেতে?’

‘হ্যাঁ পেতাম।’

‘কীভাবে?’

‘কীভাবে, তাতো আর জানি না। তবে আমি শব্দের ভেতরের সূক্ষ্ম শব্দও শুনতে পাই। ঘ্রাণের ভেতরেও ঘ্রাণ পাই। গেটের ওই শব্দটা অবশ্য অনেকদিন আর পাই না।’

‘আম্মা,আমি একটা কথা বলি?’

‘বল।’

‘মাঝে মাঝে তোমাকে আমার ভয় হয়। তোমার কথা শুনলে ভয় লাগে।

হাফসা শব্দ করে হাসলেন। তারপর বললেন, ‘দুনিয়াতে মনে হয় আমিই একমাত্র মা। যার কথা শুনলে তার মেয়ের ভয় লাগে। হা হা হা।’

‘আম্মা এই এত রাতে এভাবে হেসো না প্লিজ।’

‘কেন তোর ভয় লাগছে? তোর মায়ের হাসি শুনেও তোর ভয় লাগছে? কী মনে হচ্ছে তোর, আমি ভূত-প্রেত কিছু? হা হা হা।’

নাদিয়ার এবার সত্যি সত্যিই ভয় হচ্ছে। হাফসা যে মাঝে মধ্যে একটু আধটু পাগলামি করে না তা নয়। আসলে বছরের পর বছর এই একই বিছানায় একইভাবে শুয়ে থাকতে থাকতে সে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, এলোমেলো হয়ে গেছে।

তুমি কি আরেকটা ঘুমের ওষুধ খাবে আম্মা?’

হাফসা শান্ত গলায় বললেন, ‘দে, আরেকটা দে। খেয়ে একটা শান্তিমতো ঘুম দেই।’

নাদিয়া মাকে আরো একটা ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিল। হাফসার অবশ্য তাতে ঘুম এলো না। তিনি নাদিয়াকে ধরে বললেন, ‘তুই আংটিটা কেন খুলে রেখেছিস আমাকে বলবি মা?’

নাদিয়া জবাব দিল না। সে চুপচাপ মায়ের কাছে শুয়ে রইলো। হাফসা বললেন, ‘আমার খুব কষ্ট মা! খুব কষ্ট। নাবিলাকে নিয়ে যে আমার কী কষ্ট হয়, সেটা মা না হলে বুঝবি না। তোকে একটা অনুরোধ করি মা?’

‘হুম।’

‘তুই আমার মাথায় হাত রেখে বলবি, তোর কি অন্য কাউকে পছন্দ?’

নাদিয়া এই প্রশ্নের উত্তর দিল না। হাফসা নাদিয়ার হাতটা এনে তার মাথায় রাখলেন। তারপর বললেন, ‘বল, এবার বল।’

নাদিয়া তবুও কথা বলল না। হাফসা হঠাৎ কেঁদে ফেললেন, ‘তুই আমার এই সর্বনাশটা করিস না রে মা। নাবিলাকেতো চোখের সামনে দেখেছিস। দেখিস নাই? তারপরও তুই এমন কিছু করিস নারে মা। মারে, আমার যে কী কষ্ট হয়রে মা। এই কষ্ট আমি এই দুনিয়াতে কাউরে বোঝাতে পারব না গো মা।’

নাদিয়া কী বলবে! তার আসলেইতো কোনো পছন্দ নেই। সে অনেক ভেবেছে, ভেবেও পছন্দ করার মতো কারো কথা তার মনে আসেনি। কিন্তু একটা জিনিস সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে, কোথাও কোনো একটা ঝামেলা আছে। সেই ঝামেলাটা তার নিজের মধ্যেই। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও সেই সমস্যা সে ধরতে পারছে না। অথচ রাত- দিন সারাটাক্ষণ তার বুকের ভেতরটা কী যে অস্থির হয়ে থাকে! তীব্র অশান্তিতে সবকিছু এলোমেলো লাগে তার। হাফসা কাঁদতে কাঁদতেই বললেন, আমার মাথা ছুঁয়ে বল, তুই নাবিলার মতো কিছু করবি না। আমাকে কসম কেটে বল।’

নাদিয়ার হাতটা মৃত মানুষের মতো তার মায়ের মাথায় পড়ে রইলো। এত অসহায় লাগছে নাদিয়ার! সে নিজেই স্পষ্ট কিছু বুঝতে পারছে না, অন্য কাউকে কী করে বোঝাবে সে! হাফসা এবার হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন, ‘তুই আমাকে তার চেয়ে মেরে ফেল মা। নিজের হাতে মেরে ফেল। আমি আর এত যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছি না। মা রে…।’

নাদিয়া অবশেষে অস্ফুট স্বরে কথাটা বলল, ‘না মা, কেউ নেই।’

হাফসার কান্না মুহূর্তেই থেমে গেল। তিনি ভেজা গলায় বললেন, ‘আমাকে কথা দে, তুই কখনো উল্টাপাল্টা কিছু করবি না।’

নাদিয়া সুবোধ বালিকার মতো বলল, ‘করব না মা।’

‘মুকিতকে তোর পছন্দ না?’

নাদিয়া চুপ করে রইলো। হাফসা বললেন, ‘বল। বল, কেন মুকিতকে তোর পছন্দ না। বল? এত ভালো ছেলে! আমরাইতো তার যোগ্য না। বল কেন তাকে তোর পছন্দ না?’

‘আমিতো বলি নাই যে পছন্দ না।’

‘সব কথা বলতে হয় না। আমি তোর মা না? আমি বুঝি না, তোর মনে কী চলছে? তোর চোখের দিকে তাকালেই আমি বুঝতে পারি।’

‘কী বুঝতে পারো?’

‘মুকিতকে তোর পছন্দ না। তোর অন্য কাউকে পছন্দ, কিন্তু সেই কথা তুই বলতে সাহস পাচ্ছিস না। বল, কথা সত্য কি না বল?’

নাদিয়া এবার যেন খানিক রুঢ় হল, ‘আমিতো একবার বলেছিই মা, আমি তোমাদের অমতে কখনোই কিছু করব না। তারপর আবার কী? তোমার মাথা ছুঁয়েতো আর আমি মিথ্যে বলব না।

মায়ের পাশ থেকে উঠে চলে গেল নাদিয়া। হাফসা তাকিয়ে রইলেন। তার বুকের ব্যথাটা আরো বাড়ছে। নাদিয়া নাবিলার মতো অস্থির, চঞ্চল নয়। সে শান্ত, চুপচাপ। নিজের ভেতরে অসহ্য কষ্ট, অভিমান নিয়েও সে চুপচাপ কাটিয়ে দেবে। কাউকে কিছু বলবে না। এ কারণেই তাকে নিয়ে আরো বেশি ভয়। কী এমন রয়েছে নাদিয়ার মনে যে এত করে বলার পরেও সে সেটা বলছে না!

সেই সারারাত জেগে রইলেন হাফসা। মাঝে মাঝে খানিক সময়ের জন্য তার তন্দ্রা এলো, তবে তা বেশিক্ষণ থাকল না। এই আধো ঘুম আধো জাগরণেই তিনি ভয়াবহ সব দুঃস্বপ্ন দেখতে লাগলেন। কিন্তু সেই দুঃস্বপ্ন কারো কাছে বলার সাহস তার হলো না। তাতে যদি দুঃস্বপ্ন সত্যি হয়ে যায়!

.

পরদিন দুপুরে ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরে ঘরে ঢুকতেই ধাক্কার মতো খেল নাদিয়া বসার ঘরে শফিক বসে আছে। নাদিয়াকে দেখে শফিক অবশ্য হুড়মুড় করে উঠে দাঁড়াল না। তটস্থ ভঙ্গিতে সালামও দিল না। মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে রইলো। তার হাতে একটা পুরনো পত্রিকা। গভীর মনোযোগে সে সেই পত্রিকা পড়ছে। নাদিয়া ইচ্ছে করেই খানিক শব্দ করল। শফিক চোখ তুলে তাকাল, তবে কথা বলল না। নাদিয়া জানে না কেন, সেও কোনো কথা বলল না। চুপচাপ হেঁটে ঘরের ভেতর চলে গেল। এর আগে এমন কখনো হয়নি। শফিককে দেখলেই খোঁচাতে চাইত নাদিয়া। এটা-সেটা জিজ্ঞেস করত। কিন্তু কী এমন হলো আজ?

এই সামান্য একটু সময়। শব্দহীন, গল্পহীন, বাক্যহীন। কিন্তু সেই নিঃশব্দ সময়টুকুই যেন অগোচরে অদ্ভুত, গোপন সব কথা বলে গেল। যেন এই দুজন মানুষ তাদের অবচেতনেই একটা অদৃশ্য দ্বৈরথে আবির্ভূত হয়েছে। কোথায় যেন একটা তীব্র অস্বাভাবিকতা। সবকিছু আরো বেশি স্বাভাবিক রাখতে গিয়ে নিজেদের অগোচরেই যেন তারা অতি সতর্ক হয়ে উঠেছে। তাদের সেই অতি সতর্কতা ক্রমশই একটা অনুচ্চারিত অনুভূতিকে দৃশ্যমান করে তুলেছে। এই যে নাদিয়া, সে সবসময় শফিককে দেখলেই সহজাত ভঙ্গিতেই প্রগল্ভ হয়ে ওঠে। নানা হাসি ঠাট্টা করে। শফিককে উত্ত্যক্ত করে আনন্দ পায়। কিন্তু সেও কেন আজ হঠাৎ এমন গম্ভীর হয়ে গেল?

শফিকের সাথে আলাদা করেতো কিছু হয়নি তার! তাদের মধ্যে কোনো অনুরাগ, অভিযোগ কিংবা অভিমানের সম্পর্কও নেই। কোনো রাগ, ক্রোধ কিংবা ক্ষোভের কারণও থাকার কথা নয়। তারা পরস্পরের অতটা কাছেরও কেউ নয়। রাস্তায় পথ চলতে হঠাৎ দেখা হওয়া দুজন মানুষের যেটুকু পরিচয়, তারাও অনেকটা তেমনই। তাহলে?

নাদিয়া কেন আজ হঠাৎ শফিককে এড়িয়ে গেল? এই প্রশ্নের উত্তর নাদিয়া জানে না। সে কি তবে শফিককে আলাদা করেই উপেক্ষা করতে চাইছে? কিংবা এড়িয়ে যেতে চাইছে? কিন্তু শফিকতো এমন গুরুত্বপূর্ণ কেউ নয় তার কাছে যাকে এড়িয়ে যেতে হবে, উপেক্ষা করতে হবে! তাহলে শফিককে সে আলাদা করে এতটা গুরুত্ব কেন দিচ্ছে? নাদিয়া ঘরে ঢুকলেও এই প্রশ্নটা ঘুণপোকার মতো খোঁচাতে থাকল তাকে। হাফসা বললেন, ‘আমার নাবিলাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। এত বাজে একটা স্বপ্ন দেখলাম, তারপর থেকে মনটা কেমন খচখচ করছে।

‘এইজন্য শফিক ভাইকে আসতে বলেছো?’

হুম। শফিককে বলব, নাবিলাকে যেন দিন কয়েকের জন্য একটু নিয়ে আসে।

‘আচ্ছা।’

তুই একটু নাবিলার সাথে কথা বলে দেখবি?’

‘আমি কেন?’

‘আমিতো বললাম, কিন্তু সে এখন আসতে চাইছে না। বারবার বলছে, সব ঠিকঠাক আছে। কিন্তু আমার মনটা কেমন করছে!’

‘আমি বললেই সে আসবে?’

‘এ বাড়িতে কারো কথা যদি সে শোনে, তা ওই তোর কথাই।’

‘তুমি এক কাজ করো, শফিক ভাইয়ের সাথে ফরিদপুর চলে যাও।’

‘আমার শরীরে কুলালে সে কথা আর তোর বলতে হতো না।’

নাবিলা অবশ্য নাদিয়ার কথাও শুনল না। সে আসতে রাজি হলো না। হাফসাও ইনিয়ে বিনিয়ে নানাভাবে তাকে রাজি করানোর চেষ্টা করলেন ফোনে, কিন্তু লাভ হলো না। শেষে হাফসা বললেন, ‘এক কাজ করবি নাকি?’

‘কী কাজ?’

তুই শফিকের সাথে চলে যাবি ফরিদপুরে? তারপর ধরে নিয়ে এলি?’

‘না মা। লাভ হবে না। ও যে একগুঁয়ে! একবার যখন বলেছে, আর আসবে না। তা ছাড়া আমার পরীক্ষাওতো আছে।’

শফিককে খেতে দেয়া হয়েছে। সে অবশ্য তেমন কিছু খেল না। বের হয়ে যাওয়ার আগ মুহূর্তে আচমকা নাদিয়া এলো। কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে সে সহজ, স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল, ‘আপনি সবসময় এই একই শার্ট পরেন কেন শফিক ভাই?’

শফিক জবাব দিল না। মৃদু হাসল কেবল। তার সেই হাসির কোনো অর্থ করতে পারল না নাদিয়া। শফিক কি খানিক অন্যরকম হয়ে গেছে? আগে সে যেমন চুপচাপ ছিল, এখনো তেমনই আছে। কিন্তু তারপরও কোথায় যেন একটা অন্য মানুষ সে। নাদিয়া বলল, ‘সেদিন অমন বৃষ্টির ভেতর হেঁটে চলে গেলেন কেন?’

শফিক এবারও জবাব দিল না। নাদিয়া বলল, ‘আমি পেছন থেকে এত করে ডাকলাম, আপনি শুনলেন না অবধি!’

শফিক শোনেনি এটা ঠিক নয়। সে শুনেছে। বেশ ভালো করেই শুনেছে। কিন্তু তারপরও এক বেপরোয়া অভিমান যেন তার বুকের ভেতরটা ভেঙেচুরে তছনছ করে দিয়েছিল। শফিক জানে না, সেই অভিমানটা কার সাথে! কখনো কখনো মনে হয় স্রষ্টার সাথে। তিনি কেন তাকে এমন বঞ্চিত, হতভাগ্য, অভিশপ্ত এক মানুষের আদল দিয়েছেন? কেন কোথাও তার এতটুকু প্রাপ্তি নেই, শান্তি নেই, আনন্দ নেই? আর যদি তার জন্য কিছু নাই থাকবে, তাহলে তার বুকের ভেতর তার অবচেতনেই কেন এই অসম্ভব প্রত্যাশাটুকু এমন কঠিনভাবে গেঁথে দিলেন? তিনি কি জানেন না, কী ভয়াবহ যন্ত্রণা প্রতি মুহূর্ত তাকে বিদ্ধ করে চলে!

নাদিয়া বলল, ‘কী হলো, কথা বলবেন না আমার সাথে?’

‘বলব না কেন?’

‘সেটা আপনি জানেন। এই যে এলাম, আপনার সাথে দেখাও হলো, কই কথাতো বললেন না?’

শফিক অনেক কিছু বলবে ভেবেও শেষ পর্যন্ত কিছুই বলতে পারল না। গত বেশ কিছুদিন থেকে সে নিজের সাথে যুদ্ধ করছে। নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে, এই অসহনীয় মানসিক যন্ত্রণা আর নিতে পারছেনা সে। নাদিয়ার প্রতি যে দুর্দমনীয় অনুভূতি সে অনুভব করে, তা তার পৃথিবীটাকে এলোমেলো করে দিচ্ছে। তার স্বাভাবিক জীবনটাকে অস্বাভাবিক করে তুলেছে। যে করেই হোক এর থেকে মুক্তি তাকে পেতেই হবে। আর এর জন্য সবার আগে নাদিয়ার ছায়া থেকেও তাকে দূরে সরে থাকতে হবে। কিন্তু আজ হাফসার জরুরি ফোন পেয়ে সে না এসে পারেনি।

নাদিয়া বলল, ‘আপনি থাকেন কোথায় শফিক ভাই?’

‘মহাখালী।’

নাদিয়া হাসল, ‘এত খালি নিয়ে কীভাবে থাকেন?’

শফিক চট করে কথাটা ধরতে পারল না। নাদিয়া বুঝতে পেরে বলল, ‘আপনি খুব ভালো আছেন, তাই না?’

‘তাই?’

‘হুম। কেন ভালো আছেন জানেন?’

শফিক তাকাল। নাদিয়া বলল, ‘কারণ আপনি সবকিছু খুব কম বোঝেন। ভালো থাকতে হলে এই কম বোঝাটা খুব দরকার। যেসব মানুষ বেশি বোঝে, তাদের কষ্টটাও বেশি।’

শফিক হাসল। সেই হাসি যে কান্নার মতো, নাদিয়া কি তা বুঝতে পারল? কতটা ভালো আছে শফিক? কতটা কম বোঝে সে? শফিক জানে, সে কম বোঝে তা নয়, বরং সে যতটা বোঝে ততটা বোঝাতে পারে না। এর চেয়ে খারাপ থাকা আর হয় না।

নাদিয়া কী মনে করে শফিককে নিচতলা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এলো। শফিক অবাক হলেও নাদিয়াকে বুঝতে দিল না। গেটের বাইরে দাঁড়ানো শফিককে আচমকাই কথাটা বলল নাদিয়া, ‘আপনি আর এই শার্টটা পরবেন না শফিক ভাই।’

শফিক হেঁটে যাচ্ছিল দুপুরের রোদ মাথায় করে। কিন্তু তার বুকের ভেতর ফুরফুর করে বয়ে যাচ্ছিল সন্ধ্যার হাওয়া। সেই হাওয়ায় ভেসে যাচ্ছিল মন কেমনের সুবাস! এই সুবাস থেকে সে যতই দূরে যেতে চায়, ততই কাছে চলে আসে। কী অদ্ভুত!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *