২৭
নাদিয়াকে দেখাতে পাত্র নিয়ে এসেছেন নাদিয়ার খালা জাহানারা। তার ধারণা তার ছোটবোন হাফসা অথৈ পাথারে পড়েছে। এই অথৈ পাথার থেকে তার মুক্তির উপায় হচ্ছে ভালো দেখে নাদিয়ার একটা বিয়ে দিয়ে ঝাড়া হাত-পা হয়ে যাওয়া। এমনিতেই হাফসার শারীরিক অবস্থা ভালো না। তারপর তার স্বামী আশফাকেরও কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। এখন নাদিয়ার একটা গতি হয়ে যাওয়া সবচেয়ে জরুরি। এটা হলেই সে সব দিক থেকে নিশ্চিন্ত হতে পারবে। নাদিয়াকে পাত্রস্থ করার জাহানারার এই চেষ্টা আজকের নয়। নাদিয়া যখন এসএসসি পাস করে কলেজে ভর্তি হয়েছে, তখন থেকেই তিনি নাদিয়ার জন্য ছেলে দেখছেন। কিন্তু আশফাকের কারণে কোনো সম্বন্ধ নিয়েই বেশিদূর এগোতে পারেননি তিনি। কারণ আশফাক কখনোই চাননি, তার মেয়েদের এত তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়ে যাক। তিনি বরং চেয়েছিলেন নাবিলা আর নাদিয়া আগে পড়াশোনাটা ঠিকঠাকভাবে শেষ করুক। তারপর চাকরি-বাকরি করুক। তারপর না হয় বিয়ে শাদির কথা ভাবা যাবে। কিন্তু নাবিলার অমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পর ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড ভেঙে পড়েছিলেন আশফাক। এরপর থেকে কেউ আর তার সামনে নাদিয়ার বিয়ে নিয়ে কোনো কথাও তোলেনি। বিষয়টা তাকে এতটাই বিধ্বস্ত করে ফেলেছিল যে তিনি নাদিয়ার বিয়ের ব্যাপারটা ভাবতে ভয়ই পাচ্ছিলেন। তার কেবল মনে হচ্ছিল, যদি নাবিলার মতো নাদিয়ার ভাগ্যটাও খারাপ হয়!
নাদিয়া নিজে অবশ্য একদমই চুপচাপ। বড় বোন নাবিলার ঘটনার পর সে মনে মনে ভেবেই রেখেছে, সবাই মিলে যে সিদ্ধান্ত নেবে, সেটিই সে বিনাবাক্যে মেনে নেবে। নাবিলার ঘটনায় আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী থেকে শুরু করে সবার কাছে বাবা-মায়ের ছোট হওয়াটা যেমন সে দেখেছে, তেমনি দেখেছে তাদের সুতীব্র মানসিক যন্ত্রণাটাও। ফলে নিজে থেকেই সে সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে, বাবা মায়ের অমতে কখনোই কিছু করবে না সে। বাবা-মা যেখানে, যেভাবে তাকে বিয়ে করতে বলবে, সে তা-ই চোখ বুজে মেনে নেবে
এতদিন জাহানারার কথাকে গুরুত্ব না দিলেও আজকাল হাফসারও মনে হচ্ছে, যতদ্রুত সম্ভব নাদিয়াকে বিয়ে দিয়ে দেয়াটাই ভালো। তবে বিষয়টা চূড়ান্ত হওয়ার আগ অবধি আশফাকের কাছ থেকে আড়ালই রাখতে চান তিনি। জাহানারা যেই ছেলে নিয়ে এসেছে, সেই ছেলের নাম মুকিত। মুকিত পাস করেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছে। সে দেখতে শুনতে ভালো। মার্জিত, ভদ্র। হাফসাকে দেখেই সে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করল। কথাবার্তার পুরোটা সময় মাথা নিচু করে বসে রইলো। জাহানারা হাফসাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বললেন ‘এখনই বাড়ির কাউকে কিছু জানাস না। সবাইকে বলবি আমার আত্মীয়। বেড়াতে আসছে এই বাড়িতে।’
‘আচ্ছা।’
‘বলাতো যায় না, কে কোনদিক দিয়া কোন ক্ষতি করে বসে। এমন সোনার টুকরা ছেলেতো আর পাওয়া যাবে না। এই ছেলেরে আমি গত দশ বছর থেকে চিনি। ইউনিভার্সিটিতে ফার্স্ট ছিল। পাস করার সাথে সাথে টিচার। ফ্যামিলিও ভালো। আর কী আদব-কায়দা, দেখলি?’
ছেলেকে হাফসারও পছন্দ হয়েছে। সে বলল, ‘নাদিয়াকে একটু দেখানো দরকার না?’
‘অবশ্যই দেখানো দরকার। এটাতো আর ফর্মাল কোনো দেখা-সাক্ষাৎ না। আগে ছেলে মেয়েকে দেখুক। তারা কথাবার্তা বলুক। তারপর আলাপ করা যাবে।’
নাদিয়া অবশ্য ছেলেকে দেখে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখাল না। জাহানারার ধারণা ছিল, এই ছেলেকে দেখে নাদিয়া উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠবে। শুধু নাদিয়া কেন, যেকোনো মেয়েই এই ছেলেকে দেখে হাসতে হাসতে বিয়ে করে ফেলবে। কিন্তু নাদিয়ার সংযত আচরণে তিনি খানিকটা শঙ্কিতই হলেন। বললেন, ‘কীরে, ছেলে পছন্দ হয় নাই?’
নাদিয়া জবাব দিল না। জাহানারা বললেন, ‘এর রেজাল্ট জানোস? ইউনিভার্সিটিতে গোল্ড মেডেল পাইছে। দুই বছর বাদে পিএইচডি করতে যাবে আমেরিকার বোস্টনে। সাথে বউ নিয়ে যাবে। প্ল্যান আছে আমেরিকায়ই সেটেল করার।’
নাদিয়া এবারও কোনো কথা বল্ল না। জাহানারা শঙ্কিত চোখে বললেন, ‘কী হলো? ছেলে মনে হচ্ছে তোর পছন্দ হয় নাই। কোনো সমস্যা?’
নাদিয়া মৃদু মাথা নাড়ল, তার কোনো সমস্যা নেই। জাহানারা বললেন, ‘সমস্যা না থাকলে এখানে এসে এমন জড়ভরত হয়ে বসে আছিস কেন? যা, কফি নিয়ে যা। একটু গল্প-টল্প কর।’
নাদিয়া অবশ্য উঠল না। যেমন ছিল, তেমনই বসে রইলো। জাহানারা প্রমাদ গুনলেন, ‘সমস্যা কী বলতো? তোর কোনো পছন্দ-টছন্দ আছে নাকি?’
নাদিয়া মাথা নিচু করে বসে রইলো। এই প্রথম জাহানারার আশঙ্কাটা হাফসাকেও ছুঁয়ে গেল। তিনি নাদিয়ার কাঁধে থাক্কা দিয়ে কঠিন গলায় বললেন, ‘ঘটনা কী? আমার সাথে কোনো গেম খেলবা না। তোমার বড় বোন যা করার করেছে। তুমি খবরদার, এমন কিছু করবা না, যাতে আমার খারাপ কিছু করা লাগে!’
নাদিয়া চুপচাপ বসেই রইলো। হাফসা বললেন, ‘তোমার বড় বোন যা করছে। তুমি কিন্তু সাবধান। প্রয়োজনে আমি বঁটি দিয়া কেটে দুই টুকরা করে ফেলব। তারপরও আমি অন্য কিছু মেনে নেব না। এই কথা মনে রাইখো।’
নাদিয়া এবারও কথা বলল না। জাহানারা বললেন, ‘কী হলো? পছন্দের কেউ থাকলে সেটাওতো বলতে হবে, নাকি? থাকলে এখনো সময় আছে, বল।’
নাদিয়া চোখ তুলে তাকাল। হাফসা আগুন চোখে কন্যার দিকে তাকিয়ে আছে। যেন নাদিয়া হ্যাঁ বলা মাত্র সে পুড়িয়ে ছাই করে ফেলবে নাদিয়াকে। নাদিয়া অবশ্য সাথে সাথেই জবাব দিল না। খানিক সময় নিল সে। সেই সময়টুকু রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনার। হাফসা আর জাহানারার দুই জোড়া সন্ত্রস্ত, সন্দিগ্ধ চোখ নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে তার দিকে। নাদিয়া অবশ্য উত্তেজনা প্রশমিত করে ফেলল। সে মৃদু কণ্ঠে জানাল তার পছন্দের কেউ নেই। হাফসা আর জাহানারা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।
মুকিতকে অবশ্য ভালোই লাগল নাদিয়ার। ভদ্র, শিক্ষিত, পরিমিতিবোধ সম্পন্ন ছেলে সে। দিন দুই বাদে সে নাদিয়াকে মেসেজ পাঠাল, ‘আপনার যদি আপত্তি না থাকে আর অশোভন মনে না হয়, তাহলে আমি কি আজ আপনার সাথে দেখা করতে পারি?’
মুকিত তার সাথে দেখা করতে এলো ইউনিভার্সিটিতে। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে সে নাদিয়ার জন্য দোলনচাঁপা নিয়ে এসেছে। নাদিয়া ভারি অবাক হলো। মুকিত বলল, আপনি অবাক হয়েছেন?’
এই বিষয়টিও ভালো লেগেছে নাদিয়ার। মুকিত ফট করে তাকে তুমি বলে বসেনি। সে তাকে আপনি করে বলছে। যথেষ্ট সমীহ ও সম্মান দেখাচ্ছে। নাদিয়া বলল, ‘হ্যাঁ।’
‘আপনি কি জানতে চান যে আমি কিভাবে জানলাম আপনার দোলনচাঁপা পছন্দ?’
নাদিয়া কথা না বললেও উৎসুক চোখে তাকাল। মুকিত বলল, ‘আমি গত কয়েকদিন আপনার ফেসবুক স্টক করেছি। আশা করছি এ কারণে আপনি আমার ওপর বিরক্ত হবেন না। আসলে এটা ছাড়াতো আর কোনো উপায় ছিল না জানার।’
‘আচ্ছা।’
‘আমি যে এভাবে আপনার সাথে দেখা করতে চেয়েছি, আপনি কি এতে বিরক্ত হয়েছেন?’
নাদিয়া ডানে-বাঁয়ে মাথা নাড়লো, সে বিরক্ত হয়নি। মুকিত বলল, ‘আমরা কি কিছুক্ষণের জন্য আশেপাশে কোথাও বসতে পারি?’
নাদিয়া হ্যাসূচক মাথা নাড়ল। ছেলেটাকে তার পছন্দ হয়েছে। কথা বলতেও ভালো লাগছে তার। যদিও বেশির ভাগ সময় নাদিয়া শুধু শোনে। মুকিত সুন্দর গুছিয়ে কথা বলে। শুনতে ভালো লাগে। মুকিত বলল, ‘আমাকে দেখে বোঝা যায় না, আমি কিন্তু অনেক কথা বলি। আপনি বিরক্ত হলে বলবেন।’
নাদিয়া অবশ্য বিরক্ত হলো না। সে আনন্দ নিয়েই মুকিতের কথা শুনল। কিন্তু বাড়ি ফেরার পর একটা বিষয় তাকে অযথা অস্বস্তি দিতে থাকল। সেই অস্বস্তির স্পষ্ট কারণটা সে বুঝতে পারল না। বরং এই অস্বস্তি দিনদিন বাড়তেই থাকল। আজকাল মুকিতের সাথে তার প্রায় রোজই দেখা হয়। কথা হয়। তাদের মাঝখানের প্রাথমিক দূরত্বটা ক্রমশই ঘুচে যাচ্ছে। কিন্তু তারপরও কোনো এক অজ্ঞাত অস্বস্তি ভেতরে ভেতরে বিচলিত করে তুলতে লাগল নাদিয়াকে। সে মুকিতের সাথে দেখা করে ঠিকই। কিন্তু দিনকয়েক পরে নাদিয়া আবিষ্কার করল, এ সবই হয় মুকিতের আগ্রহে। এমনকি মুকিত যখন কথা বলে, তখনও সে কেবল শ্রোতাই। কিছু বলার আগ্রহ পায় না সে। বরং মুকিতের বেশিরভাগ প্রশ্নের উত্তরই সে হ্যাঁ, না এর মতো নৈর্ব্যক্তিকতায়ই সীমাবদ্ধ রাখে। এর কারণটা বুঝতে পারে না নাদিয়া। কোথায় যেন একটা অবচেতন অদৃশ্য অস্বস্তি। মুকিত মানুষ হিসেবে নিঃসন্দেহে ভালো লাগার মতো। নাদিয়ার ভালোও লাগে। কিন্তু সেই ভালো লাগাটা পরিপূর্ণ নয়। সেই ভালো লাগাটা বিচ্ছিন্ন। হয়তো মুকিতের বলা কোনো গল্প ভালো লাগে। তার সৌজন্যতাবোধ ভালো লাগে। কিন্তু একজন প্রেমিক কিংবা স্বামী হিসেবে মুকিত কেমন, সেটি যেন ভাবনাতেই আসে না নাদিয়ার। কিন্তু কেন?
এই প্রশ্নের উত্তর তার অজানাই রয়ে গেল। এমন নয় যে সে অন্য কাউকে পছন্দ করে। কিংবা কখনো করত। বরং বাবা-মার পছন্দ করা ছেলেকেই সে মেনে নেবে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়ার পর থেকেই মনে মনে একটা ভয়েই ছিল নাদিয়া। সেই ছেলে কেমন না কেমন হয় কে জানে! কিন্তু মুকিত সেখানে নিঃসন্দেহেই অসাধারণ এক পছন্দ।
অনেক খুঁজেও নাদিয়া এমন কোনো কারণ এখন পর্যন্ত পায়নি যাতে মুকিতকে অপছন্দ করা যায়। কিন্তু তারপরও গলায় বিঁধে থাকা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মাছের কাঁটার মতো নাদিয়ার মনের কোথায় যেন একটা সূক্ষ্ম অস্বস্তির কাঁটা বিঁধে আছে! সেই কাঁটার উৎস সে জানে না।
মুকিত অবশ্য এই নিয়ে কখনো অভিযোগও করেনি। দিন কয়েক আগে জাহানারা খালা হঠাৎ নাদিয়াকে বললেন, ‘সমস্যা কী তোদের? এখনো তোরা একজন আরেকজনকে আপনি আপনি করছিস কেন?’
নাদিয়া জবাব দেয়নি। জাহানারা খালা বললেন, ‘কোনো সমস্যা নাদিয়া?’
‘উহু।’
‘তাহলে?’
এই তাহলের উত্তরও নাদিয়া জানে না। মুকিতকে কেন যেন সে তুমি করেও বলতে পারছে না। মুকিত সরাসরি না বললেও বার কয়েক আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়েছে যে সে নাদিয়াকে তুমি করেই বলতে চায়, কিন্তু নাদিয়ার কাছ থেকে স্পষ্ট কোনো বার্তা না পাওয়ায় সাহস করে উঠতে পারছে না। জাহানারা বললেন, ‘এখন তাহলে মুকিতের পারিবারিক পর্যায়ে কথা এগোই, কি বলিস?’
নাদিয়া কী বলবে! হাফসা বললেন, ‘ওর বাবাকে এখনো কিছু জানাব না?’
‘নাহ। দেখা গেল আবার কোনো একটা ঝামেলা পাকাবে। তারচেয়ে ভালো সব ঠিকঠাক হওয়ার পর একেবারে জানাই। তা ছাড়া মুকিতের ফ্যামিলির লোকজনের আলাদা কোনো কথা নেই। তাদের কাছে আমার কথাই কথা। আর মুকিতেরতো নাদিয়াকে পছন্দই হয়েছে।’
মুকিতের মা আর বড় বোন এক ফাঁকে এসে নাদিয়াকে দেখেও গেলেন। অনানুষ্ঠানিক দেখা। তারা এ বাড়িতে এমনভাবে এলেন যেন হাফসা আর জাহানারার শৈশবের বন্ধু বা আত্মীয় তারা। সেই সূত্রেই জাহানারার ছোট বোন হাফসার বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন। বুদ্ধিটা অবশ্য জাহানারার। তিনি চান না বিয়ের চূড়ান্ত কথা হয়ে যাওয়ার আগে এ বাড়ির কাউকে কিছু জানাতে। নাদিয়াকে সামনাসামনি দেখে মুকিতের মাও ভীষণ পছন্দ করে ফেললেন। তিনি জাহানারাকে বললেন, ‘দুই মেয়ের মা আমি। মেয়ে বিয়ে দিয়ে এখন ঘর খাঁখাঁ। ছেলে যতই ঘরে থাকুক। ঘরে মায়া থাকে না। ঘরের মায়ার জন্য মেয়ে লাগে। আর এই মেয়েতো মায়াবতী মেয়ে। এই মেয়ে, তুমি সবসময় চোখে কাজল পরে থাকবে বুঝলে?’
মুকিতের মা এত আপন করে কথা বলেন। মনে হয়, কতদিনের চেনা- পরিচিত! তারপরও ভারি লজ্জা লাগছিল নাদিয়ার। সে মাথা নাড়াল।
জাহানারা হাসলেন, ‘দেখলিতো? এমন শাশুড়ি কটা মেয়ের ভাগ্যে জোটে, হ্যাঁ?’
শাশুড়ি আবার কিগো আপা? আমি এসব শাশুড়ি-টাশুড়ির মধ্যে নেই। আমার দুই মেয়েতো বিয়ের পর থেকে অন্যের মেয়ে হয়ে গেছে। তো নাদিয়াও এখন থেকে আমার মেয়ে, বুঝলেন? আমি তার মা।’
জাহানারার চোখ ঝলমল করছে আনন্দে। সেই আনন্দ আরো বাড়ল মুকিতের মাকে বিদায় দেয়ার সময়। তিনি ঘর থেকে বের হতে গিয়েও আবার ফিরে এলেন। তারপর নাদিয়াকে বললেন, ‘এদিকে আসোতো মা।’
নাদিয়া তার কাছে গেল। তিনি বললেন, ‘তোমার হাতটা দেখি?
নাদিয়া তার হাত বাড়িয়ে দিল। তিনি তার নিজের হাতের অনামিকায় থাকা আঙটিটা খুলে নাদিয়ার আঙুলে পরিয়ে দিতে দিতে বললেন, ‘মেয়ে আমি আনুষ্ঠানিকভাবে আমার করে রেখে গেলাম, বুঝলেন? যাতে আর কোনো ভয় ডর না থাকে। এই মেয়ে এখন থেকে আমার। আপনারা বিয়ের মাস তারিখ ঠিক করেন। আমার সমস্যা নেই। আমাকে কাল বললে আমি কালই মেয়ে নিয়ে যাব। কথা ফাইনাল।’
হাফসা যেন অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠলেন মনে মনে। আশফাককে নিয়ে ইদানীং তিনি নানা সংশয়ে ভোগেন কিংবা স্পষ্টই বুঝতে পারেন, কোথাও কিছু একটা সমস্যা চলছে। তবে তিনি এও জানেন, সেই সমস্যা কাটানোর ক্ষমতা তার নেই। তার যেটুকু ক্ষমতা, সেটুকু তিনি সর্বোচ্চ উপায়ে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছেন। নাদিয়ার জন্য ভালো একটা বিয়ের ব্যবস্থা করেছেন। এখন আশফাক যা ইচ্ছে করুক, তাতে কিছু আসে যায় না তার। তবে মুকিতের মা চট করে এভাবে আংটি পরিয়ে ফেলবেন, সেটি হাফসা ভাবেননি। ভদ্রমহিলাকে তার দারুণ পছন্দ হয়েছে। নাবিলার ঘটনার পর থেকে নাদিয়ার জন্য যে বুকভার শঙ্কার পাথর নিয়ে তিনি দিনের পর দিন নির্ঘুম রাত কাটিয়েছিলেন, আজ যেন তার অনেকটাই নেমে গেল। খুব ফুরফুরে আর হালকা লাগছে তার।
নাদিয়া অবশ্য তার অনুভূতিটা ঠিকঠাক বুঝতে পারছে না। মুকিতের মা চলে যাওয়ার পর থেকে কেমন এক আগন্তুক, অচেনা অনুভূতি তাকে আচ্ছন্ন করে রাখল। তার হাতের ওই আংটিটা সারাক্ষণ যেন তাকে নতুন এক পরিচয় মনে করিয়ে দিতে লাগল। সেই পরিচয় কতটা আনন্দের নাদিয়া তা জানে না। তবে তা একটা অন্যরকম আবেশের। সেখানে ভালো লাগাও নিশ্চয়ই রয়েছে। সেই রাতে প্রথম মুকিত তাকে তুমি করে বলল। সে ফোন করে বলল, ‘আমি যদি আপনাকে আজ তুমি করে বলতে চাই, আপনি কি রাগ করবেন?
নাদিয়া চুপ করে রইলো। মুকিত বলল, ‘আপনার আপত্তি থাকলে নিশ্চয়ই আমি আপনি করেই বলব। কিন্তু আমার খুব ইচ্ছে করছে…
নাদিয়া অস্ফুটে বলল, ‘সমস্যা নেই।’
মুকিত উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল, ‘সত্যি!’
‘হু।’
মুকিত অবশ্য তারপরও দীর্ঘসময় নাদিয়াকে তুমি করে বলতে পারল না। কোথায় যেন একটা অস্পষ্ট আড়ষ্টতা। একটা জড়তা। সে কথা বলতে থাকল ভাব বাচ্যে। নাদিয়া বলল, ‘আপনাকে একটা কথা বলি?’
এই প্রথম নাদিয়া নিজ থেকে কিছু বলতে চাইল। মুকিতের জন্য এ যেন বিশাল এক প্রাপ্তি! সে উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, ‘প্লিজ, প্লিজ।’
নাদিয়া খানিক চুপ করে থেকে বলল, ‘আমাকে নিয়ে সবার খুব ভয় জানেন?’
‘কেন?’
‘কারণ আমার বড় আপু। বড় আপু খুব বড় একটা ভুল করে ফেলেছে তার জীবন নিয়ে। বছরের পর বছর সেই জের টানতে হচ্ছে সবাইকে। হয়তো সারাজীবনই টানতে হবে। তার জীবনটা ভয়ংকর। তাকে দেখলে আমারও খুব ভয় হয়।‘
‘কেন?’
অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে নাদিয়া বলল, ‘কারণ একটা অমানুষকে সে তার জীবনের জন্য বেছে নিয়েছিল। একটা মানুষ এত খারাপ হতে পারে, এত জঘন্য হতে পারে, তাকে না দেখলে আমি জানতামই না। কিন্তু এই কথাগুলো বলার মতো একটা মানুষও নেই বড় আপুর। কারণ সবার বিরুদ্ধে গিয়ে ওই সিদ্ধান্তটা সে একা নিয়েছিল। বড় আপুর জন্য খুব কষ্ট হয় আমার। খুব।’
মুকিত কী বলবে বুঝতে পারছিল না। তার খুব অসহায় লাগছিল। তার ইচ্ছে হচ্ছিল নাদিয়ার হাতটা শক্ত করে ধরতে। কিন্তু সে উপায় নেই। নাদিয়া বলল, ‘আপনি কখনো ওই মানুষটার মতো হবেন নাতো?’
মুকিত সেই প্রথম তুমি করে বলল নাদিয়াকে। সে গাঢ় কণ্ঠে বলল ‘তুমি দেখে নিও, কখনোই না।’
তারপর একটা রাত, একটা নিঃশব্দ কথোপকথনের অস্থির সময় কেটে গেল সীমাহীন সম্ভাবনা নিয়ে। কিন্তু সেই সম্ভাবনার আড়ালে, আবডালে কোথাও যেন মিশে রইলো অচেনা অন্য কোনো অনুভব। সেই অনুভবের উৎস নাদিয়া জানে না। পরের সারাটা দিন কী যে অস্থির লাগতে লাগল তার। হাতের ওই আংটিটা যেন ঠিকঠাক লাগছিল না তার অনামিকায়। যেন নরম মাংস কেটে তীক্ষ্ণ যন্ত্রণায় চেপে বসছিল হাড়ে। সন্ধ্যায় আংটিটা খুলে রাখল সে। হাফসা বললেন, ‘কী হলো? আংটি কই?’
‘খুলে রেখেছি।’
‘কেন?’
‘ছোট হয়ে গেছে অনেক। একদম হাড়ে গিয়ে বিঁধছে।’
‘তাই বলে বিয়ের আংটি খুলে রাখবি? এতে অমঙ্গল হয়। দুয়েকদিন পরলেই দেখবি ঠিক হয়ে যাবে।’
নাদিয়া আর মায়ের সাথে কথা বাড়াল না। তবে সে আংটিটা পরল না। বিষয়টা চোখ এড়াল না হাফসার। তার অবচেতন মন সতর্ক হয়ে উঠল। তিনি কুঞ্চিত কপালে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন