২৬
ঋদ্ধি ডাকল, ‘বাবা?’
জাফর বসেছিল বারান্দায়। সে ফিরে তাকিয়ে বলল, ‘তুই এত সকালে? প্রতিদিন না বলিস, কবে ফ্রাইডে আসবে, ভোরবেলা একটু মন ভরে ঘুমাব?’
‘হয় না জানোতো বাবা! ওই রোজ ভোরে উঠতে উঠতে একটা অভ্যাস হয়ে গেছে। ঘুমেরও একটা রুটিন আছে বুঝলে? ঠিক ঠিক ছটায় ভেঙে যায়।’
জাফর হাসল, ‘কথা সত্য। আমারও রোজ মনে হয়, ইশ, যদি আরেকটু ঘুমানো যেত। কিন্তু ফ্রাইডে এলে ঠিক ঠিক ঘুম ভেঙে যায়।’
ঋদ্ধি হাসল, ‘মা-ই ভালো। ঘুমটাকে ইচ্ছে মতো কন্ট্রোল করে ফেলেছে। সুযোগ পেলে যখন তখন ঘুমিয়ে নিতে পারে।’
জাফর হাসল। ছুটির দিনের অলস সকাল। মুনিয়া এখনো ঘুমিয়ে। সে ঘুমিয়েছে শেষ রাতে। এত ভোরে ঋদ্ধিকে দেখে একটু অবাকই হয়েছে জাফর। সে ভেবেছিল ঋদ্ধি ছুটির দিনে অনেক বেলা অবধি ঘুমায়। কিন্তু ভোরের এই মেঘাচ্ছন্ন নিশ্চুপ নির্জনতায় চোখের সামনে এলোমেলো ঋদ্ধিকে দেখে কেমন অন্যরকম লাগল জাফরের। ঋদ্ধি বড় হয়ে যাচ্ছে। এই সেদিনের সেই এতটুকু ঋদ্ধি! কতদিন মেয়েটার সাথে একটু সময় নিয়ে কথা বলা হয়ে ওঠে না। কোথাও ঘুরতে নিয়ে যাওয়া হয় না। দেখাইতো হয় না ঠিকঠাক। জাফর রোজ ঘুম থেকে উঠে দেখে ঋদ্ধি আর মুনিয়া বাসায় নেই। আবার বাসায় ফিরে দেখে ঋদ্ধি ঘুমিয়ে পড়েছে, কিংবা জরুরি কোনো পরীক্ষার পড়া নিয়ে ব্যস্ত। সে ঋদ্ধিকে পাশের চেয়ারটা দেখিয়ে বলল, ‘বোস।’
‘চা করে আনি বাবা?’
‘তুই চা-ও করতে পারিস?’ জাফর সত্যি সত্যিই অবাক হলো।
ঋদ্ধি ঠোঁট উল্টে বলল, ‘চা- তো সবাই করতে পারে। এ আর এমন কী!‘
‘তাও তো কথা। আচ্ছা, যা নিয়ে আয়।’
ঋদ্ধি চা করে নিয়ে এলো। এই ফুরসতটুকুতে কত কিছু ভাবল জাফর। ঋদ্ধির ভেতর কেমন একটা নরম, মায়াবী ব্যাপার চলে এসেছে। কোথায় যেন একটা আগলে রাখা মায়াময় ছায়া। এটা কি সব মেয়েদের মধ্যেই থাকে? তারা কি নিজেদের ভেতরে ভেতরে অগোচরেই ক্রমশ এই মাতৃসুলভ মায়াটা পুষতে থাকে? কিংবা এমন অনেকগুলো ব্যাপারই তাদের ভেতর থাকে, সেই ব্যাপারগুলো তারা আলগোছে আড়াল করে রাখে নিজের ভেতর। যখন যেটির প্রয়োজন হয়, তখন সেটি স্থান, কাল, পাত্রভেদে উন্মোচিত করে। চায়ে চুমুক দিয়ে জাফরের মনে হলো, ঋদ্ধি দারুণ চা বানায়। সে বলল, ‘তোকে চা বানানো কে শেখাল?’
‘কে আবার? মা।’
‘তোর মা আর কী কী শেখায় তোকে?’
‘মার যা যা পছন্দ
‘কেন, তোর পছন্দের কিছু শিখতে দেয় না?’
ঠিক তা না। কিন্তু মাতো আমার চেয়ে ভালো বোঝে, তাই না?’
‘হ্যাঁ! তাতো বটেই।’
ঋদ্ধি একটু থেমে বলল, ‘আচ্ছা বাবা, তোমার কি মনে হয়, সব বাবা মাই সবসময় ঠিক?’
‘তা কেন হবে? সবাই কি আর কখনো সবসময় ঠিক হয়? ভুল-ত্রুটি নিয়েইতো মানুষ।’
‘কিন্তু সেটা কি মানুষ স্বীকার করতে চায়?’
‘তা চায় না। তবে চাওয়াতো উচিত।’
‘হুম।‘
‘কেন? কী হয়েছে? কিছু নিয়ে মায়ের ওপর রাগ?
‘উহু।’ বলে দূরে কোথাও শূন্য চোখে তাকাল ঋদ্ধি। তার চোখজুড়ে রাজ্যের বিষাদ। বিষয়টা দৃষ্টি এড়াল না জাফরের। সে বলল, ‘কিছু নিয়ে মন খারাপ?’
‘উহু।’ ঋদ্ধি মাথা নাড়ল। জাফর হাত বাড়িয়ে ঋদ্ধিকে কাছে টানল। এ কদিনেই পিতা-কন্যায় বিশাল এক দূরত্ব তৈরি হয়েছে। সে বলল, ‘মায়ের সাথে ঝগড়া হয়েছে কিছু নিয়ে?’
ঋদ্ধি ডানে-বাঁয়ে আবারো মাথা নাড়ল। জাফর বলল, ‘তাহলে কী হয়েছে?’
‘আমার না কিছু ভালো লাগে না বাবা।’
‘পড়াশোনা নিয়ে আপসেট? অনেক প্রেসার যাচ্ছে?
‘তা একটু যাচ্ছে। কিন্তু ওটাতো থাকবেই।’
‘তাহলে?’
‘সবকিছু কেমন অনর্থক লাগে। মানে, আই মিন মিনিংলেস।’
জাফর হাসল, ‘আমি জানি। কিন্তু তুই এত ভালো বাংলা বলিস কী করে?’
‘বলি?’
‘হুম। খুব ভালো।’
‘সম্ভবত মায়ের জন্য।
‘মা তোকে বাংলাও শেখায়?’
‘উহু, ঠিক তা না। আসলে মা বলেছে স্কুলের বাইরে কখনো ইংরেজি বলা যাবে না। আর আগে খুব বাংলা বই পড়তে দিতো। কবিতা, গল্পের বই। আমি বুঝতাম না। মা বসে বসে বোঝাত। ‘
‘ওহফ, দারুণ ব্যাপারতো!’
হুম, দারুণ ব্যাপার। তবে ছিল, এখন নেই।’ ঋদ্ধি মলিন হাসল।
‘কেন? নেই কেন? সব বই পড়া শেষ?’
‘না বাবা। আজকাল আর মা ক্লাসের বাইরের কোনো বইই পড়তে দিতে চায়
না। গল্প, কবিতাতো একদম না।’
জাফর ভারি অবাক হলো, ‘কেন? গল্প-কবিতা পড়াতো খারাপ কিছু নয়।
‘কী জানি! হয়তো আমার স্কুলের পড়াশোনায় সমস্যা হচ্ছে।’
‘এই নিয়ে তোর মন খারাপ?’
‘উহু। আমার মন খারাপ না বাবা।’
‘তাহলে?’
‘তাহলে কিছু না। আচ্ছা বাবা, আমি যাই। আজ টিচার আসবে।’
‘এখনো ওই মেয়েটা আসে তোকে পড়াতে?’
‘রেগুলার না। তবে ছুটির দিনগুলোতে আসে।
‘তাতে সমস্যা হয় না?’
‘হয়ইতো।’
‘তাহলে?’
‘মা বলেছে নতুন টিচার নেবে। কিন্তু মেয়ে টিচার পাওয়া যাচ্ছে না বলে নিচ্ছে না।‘
‘ওহ। মেয়ে টিচারই লাগবে?’
‘মাতো তা-ই বলল।
‘আচ্ছা।’
জাফর ঋদ্ধির চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে রইলো। কখন যে এমন আচরণে, কথায় এতটা বেড়ে উঠেছে ঋদ্ধি— তা সে টেরই পায়নি। আচ্ছা, এই বয়সের সব মেয়েরাই কি ঋদ্ধির এত এমন শান্ত, স্থির, গভীর? জাফর জানে না। তবে তার কেন যেন মনে হলো আর সবার চেয়ে ঋদ্ধি খানিক আলাদাই।
দুপুরে মুনিয়ার সাথে কথা হলো তার, ‘ঋদ্ধির কী হয়েছে?’
‘কী হবে?’
‘কেমন করে যেন কথা বলল!’
মুনিয়ার বুকটা ধক করে উঠল। ঋদ্ধি কি তবে কিছু টের পেয়ে গেছে, তার আর রাফির ব্যাপারে? সে কি কিছু বলেছে তার বাবাকে? বলার কথা নয়। সবচেয়ে বড় কথা রাফির আর তার ব্যাপারটা বোঝারও কথা নয় ঋদ্ধির। তেমন কিছু কখনো ঘটেইনি। তা ছাড়া মুনিয়া বুদ্ধিমতী মেয়ে। সে জানে কী করে বিষয়টা সহজ, স্বাভাবিক অথচ গোপন করে রাখতে হয়। রাফির সাথে তার এই সম্পর্কটা সে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ সতর্কতায় আড়াল করে রেখেছে। মুনিয়া জানে, সামান্য অসতর্কতায় তার এতদিনের সব অর্জন নিমিষেই ধুলোয় মিশে যাবে।
‘কেমন করে কথা বলল?’ মুনিয়া জিজ্ঞেস করল।
মানে একটু মন খারাপ মনে হলো। আসলে অনেকদিনতো ওর সাথে এভাবে কথা হয় না। মেয়েটা চোখের সামনে বড় হয়ে গেল, অথচ টেরই পেলাম না।’ জাফরের কথায় যেন চাপা দীর্ঘশ্বাস।
মুনিয়া বলল, ‘কই? আমাকেতো কিছু বলেনি?’
‘হয়তো তোমার ব্যস্ততার কারণে বলার সাহস পায় না। বা তোমার হয়তো শোনার সময়ও হয় না।’ ফোঁড়ন কাটল জাফর।
মুনিয়া কথাটা ধরল। সে বলল, ‘ঋদ্ধি কোন ক্লাসে পড়ে জানো?’
জাফর চট করে জবাব দিতে গিয়েও থমকে গেল। সে জানে ঋদ্ধি কোন ক্লাসে
পড়ে। কিন্তু এই মুহূর্তে যেন খানিকটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে গেল। মুনিয়া বলল, ঋদ্ধির ক্লাসে রোল নম্বর কত জানো? ওর জন্মদিন কয় তারিখে?’
জাফর কথা বলল না। মুনিয়া শ্লেষাত্মক ভঙ্গিতে হাসল এবার। বলল, ঋদ্ধির বন্ধুদের ধারণা ওর বাবা-মার মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। আই মিন উই আর ডিভোর্সড। আমি সিঙ্গেল মাদার। কারণ, ঋদ্ধির স্কুলের কোনো গার্ডিয়ান মিটিং, প্যারেন্টস ডে বা কোনো ইভেন্টেও কোনোদিন তারা ঋদ্ধির বাবাকে দেখেনি। এই নিয়ে অনেক গার্ডিয়ানদের মধ্যেও নানা কানাঘুষা।’
জাফর চট করে বলল, সেতো ও তোমার স্কুলেই পড়ে বলে। ওখানেতো তুমি সার্বক্ষণিক থাকছোই, আলাদা করে আমারতো আর যাওয়ার দরকার পড়ে না।’
‘আমার স্কুলে যাওয়া তোমার নিষেধ? অন্য যারা মেয়ে টিচার আছে, তাদের হাজবেন্ডরা যান না ওখানে?’
জাফর জবাব দিল না। সে জানত এ বিষয়ে কথা বলতে গেলেই মুনিয়া অনেক পুরনো কথাই টেনে আনবে। আনলোও মুনিয়া। সে খুব শান্ত, স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, ‘আমার পুরনো ক্ষতগুলো বাইরে থেকে দেখে শুকিয়ে গেছে মনে হয়, তাই না জাফর? কিন্তু ওগুলো ভেতরে ভেতরে এখনো কাঁচা। নতুন করে আর খুঁচিয়ো না।’
জাফরের ঝামেলা ভালো লাগে না। সে খানিকটা সমস্যা থেকে পালিয়ে বাঁচা মানুষ। কিন্তু আজ কেন যেন পারল না। সে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতেই বলল, ‘তুমি যেমন ভাবছো ক্ষতগুলো একা তোমার, আঘাতগুলো একা তুমি পেয়েছো। হয়তো অন্যপ্রান্তের মানুষটাও তেমনই ভাবছে।
‘তেমনই ভাবছে মানে? বাহ, আঘাতও করবে তুমি আবার কষ্টও পাবে তুমি?’
জাফর মৃদু হাসল, ‘সম্পর্কের আঘাতটা কেমন জানো? যে আঘাত করে সে কখনো বুঝতে পারে না যে সে কত তীব্র আঘাত করছে। কিন্তু যাকে আঘাতটা করা হয় কেবল সেই জানে আঘাতটা কতটা তীব্র।’
‘তুমি বলছো, আমিও তোমাকে আঘাত করেছি?’
‘করোনি?’
মুনিয়া উঠে এসে জাফরের মুখোমুখি হলো, ‘তোমাকে আমি কী আঘাত করেছি?’
‘আমাকে তুমি বোঝো?’
‘বুঝি না?’
জাফর কতকাল পরে মুনিয়ার সাথে এভাবে কথা বলল কে জানে! সে স্পষ্ট কণ্ঠে বলল, ‘নাহ। তুমি খুব ভালো করেই জানো, আমি খানিকটা ইন্ট্রোভার্ট। তুমি এমন অনেক কাজ করেছো যেগুলোতে আমি ভেতরে ভেতরে গুটিয়ে গেছি। কিন্তু কখনো তোমাকে বুঝতে দিইনি যে তুমি আমাকে ক্রমাগত কষ্ট দিচ্ছো। তোমার দুঃখগুলো দেখা যায়, কারণ তোমার বক্তব্য, বোঝাপড়া স্পষ্ট। বলাটাও। আমারটা দেখা যায় না, কারণ আমি সেগুলো চেপে রাখি। কখনো কাউকে বলতে ইচ্ছে করে না। অভিযোগ করতে ইচ্ছে করে না।’
‘তাহলে আজ বলছো কেন?’
‘কই? বলছিনাতো! আমি তোমাকে কখনো বলেছি, তোমার কোন কোন আচরণ আমাকে কষ্ট দেয় বা দিয়েছে?’
‘আজ বলো। তুমি না বললে আমি বুঝব কী করে!’
জাফর অবশ্য কিছু বলল না। সে চুপচাপ বসে রইলো। ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলিতে নিবিষ্ট চিত্তে টেবিলের কোনায় নরম কাঠের অংশটুকু নখ দিয়ে খুঁচিয়ে যাচ্ছে সে।
মুনিয়া বলল, ‘আমি জানি, তুমি বলবে না। কেন বলবে না, তাও জানি। তুমি যেই কারণগুলো বলবে, সেগুলো যে যুক্তিতে টেকে না, তা তুমি ভালো করেই জানো।’
জাফর বিষণ্ন হাসল, ‘যুক্তি সবারই থাকে। যে খুন করেছে, তারও সেই খুনের স্বপক্ষে যুক্তি থাকে। যে চুরি করেছে, তারও।’
‘তাই বলে ভুল-শুদ্ধ থাকে না? ন্যায়-অন্যায় থাকবে না?’
‘কেন থাকবে না? কিন্তু তোমার কাছে যেটি ন্যায়, সেটিই আমার কাছে অন্যায়ও হতে পারে। পারে না?’
মুনিয়া কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তাকে থামিয়ে দিল জাফর। বলল, ‘আবার আমার কাছে যেটি অন্যায় মনে হতে পারে, তোমার কাছে সেটিকে ন্যায়ও মনে হতে পারে।’
‘আমার চাকরি করা নিয়ে তোমরা সবাই মিলে যেটি করেছিলে, সেটা অমানবিক ছিল না? অন্যায় ছিল না? এখনো তোমার মা, তোমার বোন যা করছে, সেটাকে তোমার কোন অ্যাঙ্গেল থেকে ন্যায় মনে হয়?’
‘এটা ন্যায়-অন্যায়ের প্রশ্ন না মুনিয়া।’
‘তাহলে কীসের প্রশ্ন?’
‘এটা ভালো থাকার প্রশ্ন।’
‘ভালো থাকার প্রশ্ন?’ মুনিয়া যেন অবাক হলো।
‘হ্যাঁ।’
‘কীভাবে?’
‘আমরা যা করি, তা ভালো থাকার জন্যই করি। তো সেই ভালো থাকার জন্য একটু সেক্রিফাইস আমরা করতে পারব না?’
মুনিয়া জবাব দিল না। সে জাফরের বক্তব্যের মূলভাব বোঝার চেষ্টা করছে। জাফর বলল, ‘আমিও চাই আমরা ভালো থাকি। কিন্তু সেই ভালো থাকাতে দুজনের ভূমিকা, পার্টিসিপেশনই গুরুত্বপূর্ণ। তাই না?’
‘ওহ, তাহলে আমার চাকরি-বাকরি না করাটাই হলো আমার ভূমিকা? তোমাদের এই ভালো থাকায় সেটাই আমার পার্টিসিপেশন?’
‘ঠিক তা না। ধরো এই একটা বিষয় নিয়ে বছরের পর বছর এই বাড়িতে নানা অশান্তি হয়েছে। আমার বা ঋদ্ধির অসুস্থতায় তোমাকে পাওয়া যায়নি কখনো। মা- বাবারও। কারণ তোমার নানা ব্যস্ততা। এ বাড়িতে তোমার ভূমিকা সম্পর্কে তুমি জানো। বড় ভাবি অসুস্থ। ভাইজানও থাকেন না। রুবেলের কোনো খোঁজখবর নেই। বাবা-মা বৃদ্ধ, অসুস্থ। আর সবার কাছে তুমি এমন একটা মানুষ যে না চাইতেও সবাই তোমার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। তো এই জায়গাটা তুমি বুঝবে না? এ বাড়ির সবাই তোমাকে ভালোবাসে বলেই, তোমার ওপর নির্ভর করে বলেই তারা চায়নি তুমি এত দীর্ঘসময় বাড়ির বাইরে থাকো। তারা চায়নি যেটুকু সময় তুমি বাড়ি থাকো, সেই সময়টুকুও তুমি তোমার বাইরের কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকো।’
‘তার মানে, আমি ভালো এটাই আমার আসল সমস্যা? আমার ভালো হওয়াটাই হচ্ছে আমার দোষ? আমি যদি আর সব বউদের মতো খারাপ বউ হতাম, কাউকে কেয়ার না করতাম, তাহলে আমার প্রতি কারো কোনো এক্সপেক্টেশনও থাকত না, কারো কোনো অভিযোগও থাকত না? আমার যা ইচ্ছা, তাই আমি করতে পারতাম!’
জাফর অসহায় ভঙ্গিতে বলল, ‘তুমি আবারও বুঝতে পারছো না মুনিয়া।’
মুনিয়া আচমকা হেসে ফেলল, ‘কী বুঝব আমি? তোমাদের এই সব ছেলেমানুষি যুক্তি আমাকে বুঝতে বলো?’
জাফর জবাব দিল না। তাকিয়ে থাকল কেবল। মুনিয়া বলল, ‘আচ্ছা, আমার অসুস্থতায় আমি কখনো তোমাকে পেয়েছি? তুমি মাসে কদিন বাসায় থাকো? কদিন গভীর রাতের আগে বাসায় ফেরো?’
‘আমাকে চাকরি করতে হয়।‘
আমাকেও করতে হয়।
‘তুমি দয়া করে এই অসম তুলনাটা করো না। তোমাকে বুঝতে হবে, চাকরি তোমাকে করতে হয় না। তুমি শখ করে করো।‘
‘শখ করে করি?’
‘হ্যাঁ, শখ করে করো। আর তোমার সেই শখ মেটানোর কারণে সংসারে অশান্তি তৈরি হয়। তোমার চাকরিটা শখ আর আমার চাকরিটা প্রয়োজন। এই ফারাকটা তোমাকে বুঝতে হবে। আমি চাইলেই চাকরি না করে ঘরে বসে থাকতে পারি না। কিন্তু তুমি পারো।
‘কেন? কারণ তুমি বেতন বেশি পাও? তোমার টাকায় সংসার চলে। এই কারণে?’
‘হ্যাঁ, এই কারণে। আমি চাকরি না করলে এই এতবড় বাড়ির এতগুলো মানুষের সংসার চলবেনা। ভরণ পোষণ চলবেনা। কিন্তু তুমি চাকরি না করলেও সব চলে যাবে।’
মুনিয়া আচমকা থমকে গেল। জাফর ভেবেছিল তার এই যুক্তিতে মুনিয়া অন্তত একমত হবে। কিন্তু জাফরকে চমকে দিয়ে মুনিয়া হঠাৎ বলল, ‘তাহলে এক কাজ করো।’
‘কী কাজ?’
‘চলো আমরা আলাদা থাকি।’
‘আলাদা মানে?’ প্রায় আর্তনাদের ভঙ্গিতে বলল জাফর।
‘আলাদা মানে তুমি, আমি আর ঋদ্ধি আমরা এ বাড়ি থেকে অন্য কোথাও চলে যাই। আমরা আলাদা থাকলে আমাদের খরচও কমে যাবে। তখন আর তোমার চাকরি না করার কারণে কারো না খেয়ে থাকতে হবে না। আমার চাকরির কারণে কারো অশান্তিও হবে না।’
‘তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে?’
মুনিয়া শীতল, অনড় কণ্ঠে বলল, ‘নাহ। আমার মাথা ঠিক হয়ে যাচ্ছে। এতদিন খারাপ ছিল।’
‘এতদিন খারাপ ছিল!’
হ্যাঁ। খারাপ না থাকলে এত কিছু সহ্য করেও আমার মতো একটা মেয়ে এ বাড়িতে এভাবে পড়ে থাকে? থাকে না জাফর। আমরা খুব সহজে খুব মূল্যবান কিছু পেয়ে গেলে তার মূল্য বুঝি না, তাকে গ্রান্টেড ভেবে হেলাফেলা করি। তোমার ফ্যামিলি, তুমি, তোমরাও সেটাই করছো।’
জাফর অবাক চোখে মুনিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। এভাবে মুনিয়াকে কথা বলতে সে এর আগে কখনো দেখেনি। মুনিয়া বলল, ‘তোমার আশপাশে এই যে এত এত মেয়ে দেখেছো, তোমার বোনদের পর্যন্ত দেখেছো, কই? তারা কেউতো শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে এত বড় জয়েন্ট ফ্যামিলিতে থাকেনি! তাদের সবার আলাদা বাড়ি, আলাদা ঘর-সংসার দরকার। আলাদা জীবন দরকার। আমার আলাদা জীবন কই? নাকি সেসব পাওয়ার জন্য যা দরকার, তার কিছু কমতি আছে আমার?’
জাফর কী বলবে ভেবে পেল না। মুনিয়াই বলল, ‘যদি এই হয় তোমার ভাবনা যে এই এত বড় সংসার চালানোর জন্য তোমার চাকরি করাটা যতটা অপরিহার্য, আমার চাকরি করাটা ততটা অপরিহার্য না, তাহলে তার মানে কী দাঁড়াল?’
জাফর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল। মুনিয়া বলল, ‘তার মানে দাঁড়াল তোমার পরিবারের জন্য, তোমার মা, বাবা, ভাই, বোনের জন্য আমাকে আমার স্বপ্ন, আমার ক্যারিয়ার সেক্রিফাইস করতে হবে। তাইতো? কিন্তু কেন জাফর? কেন আমি তোমার পরিবারের জন্য আমার ক্যারিয়ার সেক্রিফাইস করব? আমার পরিবারের জন্য তুমি কী করেছো?’
জাফর জানে না কেন, মুনিয়ার শেষের দিকের কথাগুলো সে নিতে পারছিল না। সে হঠাৎ বলল, কী করেছি সেটাতো তোমার ভুলে যাওয়ার কথা না।’
‘কী করেছো তুমি? কী করেছো আমার ফ্যামিলির জন্য?’ মুনিয়ার গলা উচ্চকিত হলো। ‘এ বাড়িতে তাদের কাউকে এনে দুটো দিন আমি রাখতে অবধি পারি না। থাকার একটা রুম নেই। ভালো একটা বসার ঘর নেই। বাথরুমগুলো সেই মান্ধাতার আমলের। তো এতই যদি তোমার চাকরি করা অপরিহার্য হয়, তাহলে তোমার স্ত্রী, কন্যা কেন এভাবে থাকবে? বলো? এই জীবনে কোনোদিন দেখেছো, আমার কোনো বন্ধু-বান্ধবী, আত্মীয়-স্বজন বা কলিগ কাউকে আমি এ বাসায় বেড়াতে এনেছি? কেন আনিনি? আনিনি কারণ তাদের যে বসতে দেব, তেমন একটা ঘর নেই এ বাড়িতে। এ বাড়ির কেউ তাদের সহ্যও করতে পারবে না। শোনো, বাইরের জগতের কাছে আমি যতটা বড়, তারা ঘরে এসে দেখবে এখানে আমি ততটাই ছোট। এই ছোটত্বটা আমি কখনো তাদের দেখাতে চাই না।’ সামান্য থেমেই হঠাৎ যেন মনে পড়েছে এমন ভঙ্গিতে মুনিয়া বলল, ‘ওহ, হ্যাঁ বলো, তুমি কী করেছো আমার ফ্যামিলির জন্য? বলো।’
‘ওটা বলার বিষয় নয়। ওটা কৃতজ্ঞতাবোধের বিষয়। যার কৃতজ্ঞতাবোধ থাকে, অনুভব করার ক্ষমতা থাকে, সে ওটা আপনা আপনিই বুঝে যায়।’
‘তুমি বলতে চাইছো আমি, আমরা অকৃতজ্ঞ? আমার মা, আমার ভাই-বোন আমরা সবাই অকৃতজ্ঞ?’
জাফর এই প্রশ্নের জবাব দিল না। তার মনে হলো ঝগড়াটা অন্যদিকে চলে যাচ্ছে। কিন্তু কথাটা বুকে গেঁথে রইলো মুনিয়ার। সেই সারাটা দিন আর স্থির হতে পারল না সে। তবে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় তার হঠাৎ মনে পড়ল, তার ছোট বোন রুমির বিয়েতে বড়োসড়ো অঙ্কের টাকা দিয়েছিল জাফর। সেই টাকা আর ফেরত নেয়নি সে। মুনিয়ার বাবা মারা যাওয়ার পর তাদের বাড়ি নিয়েও কী একটা ঝামেলা হয়েছিল সেটাও মিটিয়েছিল সে। সেখানেও মামলা-মোকাদ্দমায় ভালোই টাকা-পয়সা খরচ হয়েছিল জাফরের। মাঝখানে মুনিয়ার ছোট ভাইটা অস্ট্রেলিয়ায় পড়তে যাওয়ার সময়ও নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেছে জাফর। কিন্তু সেই বিষয়গুলো টেনে এনে জাফর সরাসরি এভাবে কথা বলবে, মুনিয়া ভাবেনি। সারাটা রাত সে জেগে রইলো। বহুকাল পর তার মনে হলো, এই সংসারের জন্য সে যা করেছে, তারপরও কেউ তার প্রতি বিন্দুমাত্র কৃতজ্ঞ নয়। তার আলাদা করে কোনো মূল্যায়ন নেই। বরং সকলেই ভাবে, তারা নিজেদের জায়গায় সবাই ঠিক। যে যতটা নিয়েছে, সে ঠিক ততটাই সমানভাবে কিংবা তারও বেশি ফিরিয়ে দিয়েছে বলেই মনে করে সবাই। ফলে একের পর এক তীব্র আঘাত করেও তারা নির্বিকার ভঙ্গিতে সবকিছু অস্বীকার করে যায়। কিংবা সেই আঘাতের তীব্রতা, যন্ত্রণা তারা বুঝতেই পারে না।
মুনিয়ার ঠিক পাশেই শুয়ে জাফরেরও মনে হতে লাগল, মুনিয়ার জন্য সে যতটা করেছে তার কিছুই মুনিয়া কখনো অনুভবই করেনি। দিনের পর দিন সে একলা এক মানুষের মতো জীবন কাটিয়ে গেছে। অথচ কারণে-অকারণে নিজের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে তাকে ক্রমাগত আঘাতই করে গেছে মুনিয়া। কিন্তু কোনোদিন এতোটুকুও অনুভব করতে পারেনি। বুঝতে চেষ্টা করেনি তার পাশে শুয়ে থাকা মানুষটা তার আচরণে, তার ক্রমাগত স্বেচ্ছাচারিতায় কী তীব্র যন্ত্রণা নিয়েই না নিশ্চুপ হয়ে আছে! হয়তো কোনো একদিন সে বুঝবে।
দুজন মানুষ এক সমুদ্র যন্ত্রণা, অভিমান আর অভিযোগ নিয়ে পাশাপাশি শুয়ে রইলো। কাটিয়ে দিল নির্ঘুম এক রাত। অথচ কেউ কারো যন্ত্রণা কিংবা অভিমানটুকু ছুঁয়ে দেখল না। তারা পরস্পরের কাছে যেন হয়ে রইলো বৃক্ষ এবং কুঠার।
আর কে না জানে, জগতে সবাই কেবল কুঠার হতে চায়, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সবাইকেই কখনো না কখনো বৃক্ষও হতে হয়। আর তার আগ অবধি তারা কখনো বৃক্ষের যন্ত্রণা আর কুঠারের নৃশংসতা কোনোটাই বুঝতে পারে না।