২৫
রফিকুল আলম হত্যাকাণ্ডের প্রধান সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে টুমরো’স গ্লোরি স্কুলের গভর্নিং বডির সাধারণ সম্পাদক ফজলে নূরকে। কিন্তু এই নিয়ে রফিকুল আলমের পরিবারের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। তাদের ধারণা মূল আসামিকে আড়াল করতেই ফজলে নূরকে ইচ্ছে করে ফাঁসানো হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে তারা সংশ্লিষ্ট অনেকের সাথেই যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু কারো তরফ থেকেই তেমন কোনো সাড়া পাননি।
এ বিষয়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার সাথেও কথা হয়েছে রফিকুল আলমের স্ত্রীর। পুলিশের সেই কর্মকর্তা জানিয়েছেন যে তাদের প্রাথমিক তদন্তে প্রধান সন্দেহভাজন হিসেবে ফজলে নূরের নামই এসেছে। ফলে তদন্তকাজে যেন কোনো সমস্যা না হয়, এজন্যই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মানে এই নয় যে তাদের সন্দেহের তালিকায় আর কেউ নেই বা আর কাউকে গ্রেপ্তার করা হবে না। বরং আরো অনেকেই এই তালিকায় আছে। তাদের ওপরও পুলিশের নজরদারি রয়েছে। পুলিশ ফজলে নূরের জন্য সাত দিনের রিমান্ডের আবেদন করেছে। কিন্তু তার শারীরিক অসুস্থতার জন্য আপাতত রিমান্ড স্থগিত রাখা হয়েছে।
ফজলে নূরের গ্রেপ্তারের ঘটনায় সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছেন আকবর আলী। তিনি ওসি আতাহার মিয়ার সাথে দেখা করতে এসেছেন মিষ্টি নিয়ে। আতাহার মিয়া বললেন, ‘মিষ্টি কেন আকবর সাহেব?’
‘এত বড় একটা কাজ করলেন, আর মিষ্টি নিয়ে আসব না?’
‘এই কাজতো আমি করিনি ভাই সাহেব। এই কাজ করেছেন এসপি সাহেব। আমি তার নির্দেশ পালন করেছি মাত্র। আপনি বরং তাকে গিয়ে মিষ্টি খাওয়াতে পারেন।’
আকবর আলী হাসলেন, ‘তার কাছেও যাব।’
আতাহার মিয়াও হাসলেন, ‘আরো একজনের কাছে যেতে পারেন কিন্তু।’
আকবর আলী ভ্রু কুঁচকালেন, ‘আর কার কাছে?’
‘এসপি স্যারও তো নিজে নিজেই এই কাজ করেন নাই। তার কাছেও কোথাও না কোথাও থেকে নির্দেশ এসেছে। আমাদের এটা একটা চেইনের মতো বুঝলেন। ধাপে ধাপে ঘটনা ঘটে। এ ওরে অর্ডার দেয়, সে আবার তারে অর্ডার দেয়। চেইন অব অর্ডার। তো ওপরে যে আছে তারেও তো মিষ্টি খাওয়াতে হবে। হবে না?’
আকবর আলী ইঙ্গিতপূর্ণ হাসলেন। তবে জবাব দিলেন না। আতাহার মিয়া বললেন, ‘সকালে দেখলাম রাস্তায় পোস্টারও টানানো হয়েছে।
‘কীসের পোস্টার?’
‘রফিকুল আলম হত্যায় খুনি ফজলে নূরের ফাঁসি চাই। প্রচারে এলাকার সর্বস্তরের জনগণ। ঘটনা কী বলেনতো? এই কাজ কে করেছে?’
তাতো জানি না ওসি সাব।’
‘আপনি করাননি তো!’
‘আমি? ধুরো, কী যে বলেন! আমার কী আর সেই বয়স আছে? এগুলো করে এলাকার অতি উৎসাহী ইয়াং পোলাপান। বোঝেনইতো, দলে পোস্ট পাওয়ার জন্য এরা আগ বাড়িয়েই অনেক কিছু করে। চোখে পড়ার জন্য। এতে হিতে বিপরীত হয়।
‘হুম।’ আতাহার মিয়া একটু গম্ভীর হলেন। তারপর বললেন, আপনার সেদিনের সেই রেকর্ডটা শুনলাম।’
‘বাহ, শুনেছেন তাহলে?’ আকবর আলী নড়েচড়ে বসলেন। ‘কী ঠাণ্ডা মাথায় সে রফিকুল আলমকে হুমকি-ধমকি দিয়েছে, দেখেছেন? জীবন নাশের হুমকি পর্যন্ত দিয়েছে।’
‘জি শুনেছি।’
‘তাহলে বলেনতো, এখনো আপনারা কেন নিঃসন্দেহ হতে পারছেন না? আমিতো নিশ্চিত ফজলে নূর ছাড়া এই কাজ আর কেউ করেনি।’
‘আপনি নিশ্চিত?’
‘শুধু আমি কেন, সবাইই নিশ্চিত? আপনিই বলেন, নিশ্চিত না হয়ে আর কোনো উপায় আছে?’
‘আছে।’
‘কী আছে!’ আকবর আলী ভারি অবাক হলেন।
আতাহার মিয়া সাথে সাথেই জবাব দিলেন না। একটু সময় নিলেন তিনি। তারপর ধীরে-সুস্থে বললেন, ‘আপনার এই অতি উৎসাহ কিন্তু আপনার জন্যই ক্ষতিকর ভাইজান।’
‘অতি উৎসাহ কই দেখলেন? রফিকুল আমার দলের লোক, আমার ভাইয়ের মতো ছিল। তার মৃত্যুর বিচার আমি চাইব না? তদন্তে যাতে আসল খুনি ধরা পড়ে, সেটা আমি চাইব না?’
‘নিশ্চয়ই চাইবেন। কিন্তু আপনার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, আপনি পারলে তদন্ত, বিচার ছাড়া এখনই তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেন।
‘তা কেন, তা কেন!’ আকবর আলী বিগলিত ভঙ্গিতে বললেন, ‘শোনেন ওসি সাব, এই যে এত বছর ধরে রাজনীতি করি, দেখেনতো কোথাও কোনোদিন একটা স্পট আছে কী না?’
আতাহার মিয়া টেবিলে রাখা টিস্যু বক্সটা আকবর আলীর দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, ‘আচ্ছা আকবর সাহেব, একটা কথা?’
আকবর আলী টিস্যু বক্স থেকে টিস্যু নিতে নিতে বললেন, ‘কী কথা?’
‘আপনি আমাকে যে কল রেকর্ডটা দিয়েছেন, সেটার বাকি অংশ কই?’
‘বাকী অংশ মানে?’
‘আপনি দুই মিনিট ঊনচল্লিশ সেকেন্ডের একটা কল রেকর্ড দিয়েছেন। কিন্তু কথা শুনে মনে হয়েছে তার সাথে আপনার আরো অনেকক্ষণ কথা হয়েছে। কিন্তু আপনি রেকর্ড দিয়েছেন শুধু ওইটুকু। বাকি অংশটুকুওতো একটু লাগতো।’
আকবর আলী তটস্থ ভঙ্গিতে বললেন, ‘আমার কাছেতো ওইটুকুই রেকর্ড করা ছিল। মানে যেটুকু গুরুত্বপূর্ণ সেটুকুইতো রেকর্ড করা হয়েছে, তাই না? অযথা কথাবার্তা রেকর্ড করে লাভ কী?’
‘কিন্তু আপনি বুঝলেন কী করে যে কোনটুকু গুরুত্বপূর্ণ আর কোনটুকু অযথা?’
‘মানে?’
মানে আপনি যদি শুধু গুরুত্বপূর্ণ অংশটুকুই রেকর্ড করতে চান সেক্ষেত্রে আপনাকেতো আগেভাগেই বুঝতে হয়েছে যে সে এখন আপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলো বলবে। তাই না?’
আতাহার মিয়ার প্রশ্নে আকবর আলী দমে গেলেন। তিনি সাথে সাথেই জবাব দিলেন না। আতাহার মিয়া বললেন, ‘তো সেটাতো আপনার আগেভাগেই বোঝার কথা ছিল না যে ফজলে নূর কখন কী কথা আপনাকে বলবেন! কিন্তু সেটা আপনি আগেভাগেই কী করে বুঝে গিয়েছিলেন?’
আকবর আলী আমতা আমতা করছিলেন। আতাহার মিয়া সুযোগটা নষ্ট করলেন না। তিনি বললেন, ‘আমরা সাধারণত পুরো কথোপকথনই রেকর্ড করি। পরে সেখান থেকে এডিট করে প্রয়োজনীয় অংশটুকু রেখে বাকি অংশগুলো কেটে বাদ দিয়ে দিই। আপনার কনভারসেশনের সেই কেটে বাদ দেয়া বাকি অংশটুকু কই?’
আকবর আলী অগোছালো ভঙ্গিতে বললেন, ‘বাকী অংশের কথাতো আমি জানি না। এসব আমি কম বুঝি। আমার অফিসের আইটির একটা ছেলে আছে, ও- ই এসব করে দেয়। ওকে আমি জিজ্ঞেস করে দেখব, আগে-পিছে আর কিছু ছিল কী না!’
‘ছিল। আমি রেকর্ডটা শুনেছি। রেকর্ডটা শুরুও হয়েছে একটা অসমাপ্ত কথা দিয়ে। আবার শেষও হয়েছে একটা অসমাপ্ত কথার মাঝখানে। ওই অসমাপ্ত অংশটুকু আমার লাগতো।’
বিষয়টি নিয়ে আকবর আলী চিন্তিত হয়ে পড়লেন। এটি সত্যি যে একটা দীর্ঘ কথোপকথনের সুনির্দিষ্ট একটি অংশই তিনি আতাহার মিয়াকে দিয়েছেন। পুরো কথোপকথন তিনি দেননি। কিন্তু আতাহার মিয়া এই বিষয়টি নিয়ে যে এভাবে কৌতূহলী হয়ে উঠবেন, তা বুঝতে পারেননি আকবর আলী। তিনি বললেন, ‘বাকি অংশে তেমন কিছু ছিল বলেতো আমার মনে পড়েনা ওসি সাব। নরমাল কথাবার্তা। ইম্পরট্যান্ট কিছু ছিল না।’
আতাহার মিয়া হাসলেন, ‘নরমাল কথাবার্তা কিভাবে অ্যাবনরমাল হয়ে গেল, সেটাইতো জানা দরকার, তাই না? হা হা হা।’