২৪
বাড়ি থমথমে। বিষয়টা প্রথম আফজাল আহমেদ বুঝতে পারেননি। তিনি রাতের বেলা মছিদা বেগমকে ডেকে বললেন, ‘তুমি কি মেজো বৌমাকে একটু এই ওষুধটা দেখিয়ে আনতে পারবে?’
মছিদা বেগম টিপ্পনী কাটার স্বরে বললেন, ‘তোমার মেজো বৌ যে এত বড় ডাক্তার, তাতো জানতাম না!’
‘ডাক্তার হতে হবে কেন? ডাক্তার না হলে বুঝি ওষুধ দেখে বোঝা যায় না রকমটা কী? অনেকদিন আগে আনা ছিল বলেই নাম দেখে বুঝতে পারছি না। মেজো বৌমা ওই ছোট লেখাটা দেখে বলতে পারত।’
‘সে পারলে তুমিও পারবে। সারাক্ষণ শুধু মেজো বউ মেজো বউ। যেন এ বাড়িতে মেজো বউ ছাড়া আর কেউ থাকে না!’
‘তুমি হঠাৎ তার ওপর ক্ষেপলে কেন বলোতো?’
‘ক্ষেপেছি তোমাকে কে বলল? উচিত কথা বললেই ক্ষেপা হয়ে গেল?’
আফজাল আহমেদ বুঝতে পারছেন কোনো একটা সমস্যা হয়েছে। কিন্তু সেই সমস্যা আসলে কী, সেটা তিনি বুঝতে পারছেন না। তিনি বিড়বিড় করে বললেন, ‘আমিতো এত ছোট ছোট লেখাগুলো পড়তে পারি না। তুমি বরং সেলিনা বা দিপুকে ডেকে দাও।’
‘দিপু এখনো ফেরেনি। আর সেলিনাকে এখন ডাকা যাবে না।’
‘ডাকা যাবে না কেন?’
‘কেন ডাকা যাবে না, সেটা তুমি তাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করো। মেয়েতো একা আমার না, আমার?’
আফজাল আহমেদ কিছু বলতে গিয়েও বললেন না। তিনি বিছানা থেকে নেমে সেলিনার ঘরের দিকে গেলেন। তার কোমরের ব্যথাটা হঠাৎ করেই আবার বেড়েছে। সেলিনার ঘরের দরজা বন্ধ। তাকে বেশ কয়েকবার ডাকা হলো, দরজায় নক করা হলো, কিন্তু সে দরজা খুলল না। আফজাল আহমেদ ফিরে আসতে গিয়ে সেলিনার কান্নার শব্দ শুনতে পেলেন। ঘরের ভেতর খুব নিচু স্বরে সে কাঁদছে। সেলিনা এমনিতেই কারণে-অকারণে কান্নাকাটি করেই থাকে। কিন্তু এতরাতে সে একা ঘরে অন্ধকারে কাঁদছে দেখে বিষয়টা স্বস্তি দিল না তাকে। তিনি মছিদা বেগমকে ডেকে কারণ জিজ্ঞেস করলেন। মছিদা বেগম মুখ ঝামটা মেরে বললেন, ‘সেটা তোমার কলিজার টুকরা মেজো বৌকেই গিয়ে জিজ্ঞেস করো।’
আফজাল আহমেদ এতক্ষণে সতর্ক হয়ে গেলেন। মুনিয়ার সাথে সেলিনার কোনো ঝামেলা হতে পারে এটা তিনি কস্মিনকালেও ভাবেননি। এমন নয় যে এ বাড়িতে সবাই-ই মুনিয়াকে পছন্দ করে। কিন্তু তারপরও মুনিয়ার সাথে সরাসরি কারো সমস্যা হতে তিনি দেখেননি। এমনকি সেলিনা আসার পর তার সাথে সবারই একটু-আধটু খটোমটো লেগে থাকলেও মুনিয়ার সাথে তার একটা সহাস্য হৃদ্যতা তিনি সবসময়ই দেখেছেন। কিন্তু মুনিয়ার কারণে এই রাতে ঘরের দরজা বন্ধ করে সেলিনা কাঁদছে, বিষয়টা নিতে পারছেন না আফজাল আহমেদ। তার খুবই মন খারাপ হয়ে গেল। নানা কারণেই সেলিনার হাসি-কান্নাকে খুব একটা গুরুত্ব দেন না তিনি। সে ছোটবেলা থেকেই প্রচণ্ড একগুঁয়ে, জেদি। কারো কোনো মতামত সে শুনবে না, কারো পরামর্শ নেবে না। একের পর এক ভুল করেও আবার সেই কাজটিই করবে। এই নিয়ে মনে মনে তিনি ভীষণ বিরক্ত হলেও আজ এই মুহূর্তে ওই বন্ধ ঘরের দরজার ওপাশে অন্ধকারে থাকা একাকী মেয়েটার জন্য হঠাৎ তার মন কেমন করে উঠল।
তিনি কাউকে কিছু না বলেই ধীর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতে লাগলেন। এত রাতে সবারই ঘুমিয়ে পড়ার কথা। কিন্তু তারপরও আফজাল আহমেদ মুনিয়ার ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালেন। তার ঘরের দরজাটা ভেজানো। দরজার ফাঁক দিয়ে এক চিলতে আলো এসে পড়েছে বাইরে। তিনি বার দুয়েক নক করতেই ভেতরের বারান্দা থেকে মুনিয়ার কণ্ঠ শোনা গেল, ‘কে?’
আফজাল আহমেদ মৃদু গলা খাকড়ি দিয়ে বললেন, ‘আমি বউ মা।’
‘বাবা, আপনি এত রাতে!’
এই তো, শরীরটা একটু খারাপ লাগছিল মা। এই ওষুধটা একটু তোমাকে দেখানো দরকার ছিল।’
‘তা আপনি আসতে গেলেন কেন বাবা? আমাকে একটা ফোন করলেইতো হতো।’
আফজাল আহমেদ জবাব দিলেন না। তিনি ঘরে ঢুকে বসলেন। মুনিয়া ওষুধের গায়ে ছোট ছোট অক্ষরে লেখা কথাটা পড়ে বলল, ‘বাবা, এখনতো অনেক রাত হয়ে গেছে, আমি আমার ডাক্তার ফ্রেন্ডটাকে কাল সকালে ফোন করে জেনে আপনাকে জানাই?’
‘কোন সমস্যা নেই।’ বলে একটু থামলেন আফজাল আহমেদ। তারপর বললেন, ‘ তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি মা?’
‘কী কথা বাবা?’
মানে ধরো, তুমিতো আমার মেয়ের মতোই। আর এ বাড়ির অঘোষিত অভিভাবকও কিন্তু তুমিই। তাই সবকিছুতে তোমার কাছেইতো সবাই ছুটে আসে। এটা কিন্তু কম প্রাপ্তি না মা। এই জায়গাটা তুমি তৈরি করেছো। এমন না যে এ জন্য তোমাকে কোনো ত্যাগ স্বীকার করতে হয়নি। বা কষ্ট করতে হয়নি। সবই করতে হয়েছে। কিন্তু মা, জায়গাটাও কিন্তু তুমিই তৈরি করেছো। এখন সবারই তোমার কাছে অনেক প্রত্যাশা।’
‘আপনি বলুন বাবা।‘
আফজাল আহমেদ সামান্য সময় নিয়ে বললেন, ‘সেলিনার কী হয়েছে বলোতো মা?’
‘সেলিনার? সেলিনার আবার কী হবে বাবা?’
‘সে সন্ধ্যা থেকে কাঁদছে। দরজা বন্ধ করে শুয়ে আছে। দরজা খুলছে না।’ তাই নাকি! কই, আমিতো কিছু জানি না বাবা।’
‘শোনো মা, আমাদের সবারই কিন্তু আলাদা একটা জগৎ আছে। সেই জগতে অন্য কেউ ঢুকতে পারে না। সেই জগতের দুঃখ কষ্ট, যন্ত্রণা, সব আমাদের একান্ত নিজের। তোমার, আমার, আমাদের সবারই। সেগুলো অন্যরা জানতেও পারে না। তাই না মা?’
‘জি বাবা।’
‘এগুলো তোমাকে বলার কিছু নেই। তুমি আমার চেয়ে অনেক বেশি জানো, বোঝো। তারপরও মা, তুমিতো একটা মেয়ে মানুষ, সেলিনার অবস্থাটাতো তুমি বুঝবে। আমরা সবাই-ই হয়তো বাইরে ওর খিটখিটে মেজাজ, বিরক্তিকর আচরণ এগুলোই দেখি। এগুলো দেখে দেখে হয়তো ওর প্রতি আমাদের সবারই এক ধরনের বিরক্তিও তৈরি হয়েছে। এইজন্য ওর সত্যিকারের কষ্টগুলোকেও হয়তো আমরা গুরুত্ব দিই না। ভাবি, ও তো এমনই! একবার ভাবোতো, এই বয়সে ডিভোর্সড, বাবার উপার্জন নেই। ভাইদের উপার্জনের ওপর নির্ভর করে থাকতে হয়, এটা কেমন কষ্টের? বোঝো?’
মুনিয়া চুপ করে রইলো। সে বুঝতে পারছে না কী বলবে!
‘শোনো মা, একটা কথা আছে, বাপের আয়ে রাজা, ভাইয়ের আয়ে প্রজা। এইটা দুনিয়ারই নিয়ম। যতই ভাই, ভাবি, বোনরা আদর করুক, যত্ন করুক। দামি দামি পোশাক দিক, টাকা-পয়সা দিক, তারপরও সবসময় মনে হয়, আমি পরনির্ভরশীল। কিন্তু বাপে যদি দুই টাকাও আয় করে, সন্তান যদি ছিঁড়া জামাও পরে, তারপরও সে ভাবে আমি বাপের হোটেলে খাই, মায়ের হোটেলে ঘুমাই। আমিই রাজা। এইটাই দুনিয়ার নিয়ম মা।’
‘কী হয়েছে একটু বলবেন বাবা?’
‘আমিতো জানি না মা। তোমরাই ভালো জানো। তোমরা এক মেয়ে যদি আরেক মেয়ের দুঃখ না বোঝো, তাহলে কীভাবে হবে? মেয়েদের নিজস্ব কিছু কষ্ট থাকে, এইগুলো কিন্তু মা পুরুষরা বোঝে না। শুধু মেয়েরাই বোঝে। সেলিনার অবস্থা একবার চিন্তা করো? তার ভবিষ্যৎ কী? বর্তমান কী? তার বন্ধু নাই, বান্ধবী নাই। ভাই-বোনও নাই। কারণ সবাই সবাইকে নিয়ে ব্যস্ত। কারো কি একটু সময় আছে তাকে সময় দেয়ার? এই সময়ে তার মানসিক সাপোর্ট দরকার। কিন্তু উল্টা আমরা সবাই কিন্তু তাকে প্রেসারে রাখি। কারণে-অকারণে সবসময় ভয় দেখাতে থাকি, সামনে কী হবে, সামনে কী হবে! কী এক আতঙ্কে তার প্রত্যেকটা মুহূর্ত কাটে? ‘
‘বাবা, এটা আমি বুঝতে পারছি। আপনি সেলিনাকে জিজ্ঞেস করে দেখবেন, আমি সবসময়ই চেষ্টা করি, যতটা সম্ভব ওকে ভালো রাখা যায়, আনন্দে রাখা যায়।’
‘তাহলে মা, কী এমন হলো যে সে সন্ধ্যা থেকে কাঁদছে?’
মুনিয়া বলবে না বলবে না করেও শেষ অবধি বলল, ‘বাবা, কথাটা আপনাকে কীভাবে বলব আমি জানি না। কিন্তু আমার বিশ্বাস, অন্যরা না বুঝলেও আপনি বুঝবেন। আপনি বড় চাকরি করেছেন, চাকরির সিস্টেম, রিক্রুটমেন্ট পলিসি, প্রসেস সম্পর্কে আপনার ধারণা আছে। মা আর সেলিনার হয়তো এই ধারণাটা না থাকার কারণে তারা আমাকে ভুল বুঝছে।’
‘কী হয়েছে?’
‘আমাদের স্কুলে দুজন টিচার রিক্রুট হচ্ছে। এখন মা বলছেন সেখানে সেলিনাকে একটা চাকরি দিয়ে দিতে। কিন্তু বাবা, প্রথমত, যে রিকোয়ারমেন্টস চাওয়া হয়েছে, সেলিনার তা নেই। দ্বিতীয়ত, আমার কী সেই অথোরিটি বা ক্ষমতা আছে যে আমি চাইলেই যে কাউকে আমার একক সিদ্ধান্তে চাকরি দিয়ে দিতে পারি? এখন এটা নিয়ে মা আর সেলিনা খুব রিয়্যাক্ট করছেন। উনাদের ধারণা আমি ইচ্ছে করেই সেলিনাকে চাকরিটা দিচ্ছি না, কিন্তু আমি চাইলেই এটা করতে পারি।’
‘ওওওহ, আচ্ছা।’ আফজাল আহমেদ ঘটনা শুনে যেন খানিক হতাশ হলেন।
‘এখন বাবা আপনিই বলুন, এটা কি কোনোভাবেই সম্ভব? আর আমার ক্ষমতা থাকলে আমি সেলিনাকে চাকরিটা কেন দেব না বাবা, আপনিই বলুন? ওকে চাকরিটা দিতে পারলেতো আমার কোনো ক্ষতি নেই, তাই না? বরং লাভই। স্কুলে ও কতভাবে আমাকে হেল্প করতে পারত, তাই না?’
আফজাল আহমেদ এতক্ষণে বিষয়টা সম্পর্কে পরিষ্কার হলেন। মনে মনে তিনি মছিদা বেগম এবং সেলিনার ওপর খুবই বিরক্ত বোধ করছেন। এই সামান্য বিষয়টা তারা বুঝবে না! শুধু শুধু এই এতরাতে এসে তিনি মেয়েটাকে বিরক্ত করলেন, কী সব কথাও শোনালেন। এখন নিজের কাছেই নিজের লজ্জা লাগছে তার। তিনি উঠতে উঠতে বললেন, ‘আমি বুঝতে পারছি মা। তুমি কিছু মনে করো না। ওরাতো এই সব বোঝে না। তুমি চিন্তা করো না। আমি যতটা সম্ভব ওদের বুঝিয়ে বলব।’
আফজাল আহমেদ অবশ্য কিছুই বোঝাতে পারলেন না। বরং তার কথা শুনে মছিদা বেগম এবং সেলিনা তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল। সেলিনা বলল, ‘তোমাকে যা বোঝালো আর তুমি তা-ই বুঝে এলে, না?’
আফজাল আহমেদ বোঝানোর চেষ্টা করলেন, ‘সবকিছুরই একটা সিস্টেম আছে বুঝলি? একটা স্কুলতো আর একজনের সিদ্ধান্তে চলে না। এটা একটা প্রতিষ্ঠান। সব প্রতিষ্ঠানেরই কিছু নিয়ম-কানুন আছে। ব্যক্তি যত ক্ষমতাবানই হোক না কেন, সেই নিয়ম-কানুনের বাইরে সে যেতে পারে না।’
মছিদা বেগম বললেন, ‘এসব আমাকে বোঝাতে এসো না।’
আফজাল আহমেদ হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন। সেলিনা বলল, ‘সে কী করে এতবড় স্কুলে চাকরি পেল? আমরা কিছুই বুঝি না ভেবেছো? কত কথা আমাদের কানেও আসে। কেবল আর দশজনের ননদের মতো কিছু বলি না বলে ভেবো না, কিছু জানি না আমরা। চাকরি পাওয়ার কদিনের মধ্যেই অত বড় বড় সব সিনিয়রদের টপকে কীভাবে সে হেড টিচার হয়ে গেল? এতই যদি নিয়ম কানুন থাকে?’
আফজাল আহমেদের এবার লজ্জাই লাগছে। তিনি ছি ছি করতে করতে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। লজ্জায় তার মাথা নিচু হয়ে আসছে। মাঝে মাঝে তিনি সেলিনাকে চিনতেই পারেন না। মছিদা বেগমকেও না। মনে হয়, এই মছিদা বেগম অন্য কেউ। এর কোনো হিতাহিত কাণ্ডজ্ঞান নেই। ভালো-মন্দের বোধ নেই। এ যেন প্রবল প্রতিহিংসা বুকে পুষে রাখা ভয়ানক এক মানুষ।
পরদিন সন্ধ্যায় সেলিনা যেন আটঘাট বেঁধেই তার সাথে দেখা করতে এলো। কিন্তু সেটি প্রথমে তার আচরণে বোঝা গেল না। সে খুব শান্ত, স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, ‘আমার একটা কথা আছে বাবা?’
‘কী কথা?’
‘শুনে আবার রেগে যেও না।’
আফজাল আহমেদ হাসলেন, ‘সেই সুযোগ কি আমার আছে?’
সেলিনা আফজাল আহমেদের কথার জবাব দিল না। সে সরাসরি প্রসঙ্গে চলে গেল, ‘এই বাড়িতে এখন সবচেয়ে অসহায় মানুষ কে বাবা?’
আফজাল আহমেদ বুঝতে পারছেন, নিশ্চয়ই আবারো কোনো গুরুতর ঘটনা ঘটেছে। তিনি নিরীহ মানুষের মতো বললেন, ‘কে আবার? আমি।’
‘উহু, তুমি না।’
‘তাহলে কে?’
‘এই বাড়িতে সবচেয়ে অসহায় মানুষ এখন আমি।’
‘তুই অসহায় কেন হবি?’
সেলিনা মলিন হাসল, এটা তুমি বা তোমরা কেউই বুঝবে না বাবা। যে অসহায় সে-ই কেবল তার কষ্টটা বোঝে। যাই হোক, তোমাকে একটা কথা বলতে চাই বাবা।’
‘কী কথা?’
‘তোমার বয়স হয়েছে না?’
‘হ্যাঁ, হয়েছে।’
‘ধরো, এখন তোমার যদি কিছু হয়ে যায়, তখন আমার কী হবে?’
‘তোর কী হবে মানে? এই এত বড় বাড়ি আছে। তোর ভাইয়েরা আছে। তোর মা আছে। তারপর আবার তোর কী হবে মানে কী?’
‘একটা কথা বলি বাবা, আমাকে খারাপ মনে করো না। কিন্তু শান্ত মাথায় কথাটা শোনো।’
‘কী কথা?’ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন আফজাল আহমেদ।
‘আল্লাহ না করুক, তোমার যদি হঠাৎ কিছু হয়ে যায়, তারপর এ বাড়ি থেকে যদি কেউ আমাকে বের করে দেয়, বা মাকেও বের করে দেয়, তখন আমরা যাব কই?’
আফজাল আহমেদের প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হচ্ছে। গতরাতে বন্ধ ঘরে সেলিনাকে একা একা কাঁদতে দেখে সেলিনার প্রতি যে মায়া তিনি অনুভব করেছিলেন, তা যেন ক্রমশই কর্পূরের মতো উড়ে যাচ্ছে। তবুও যতটা সম্ভব নিজেকে সংযত রেখে তিনি বললেন, ‘কে বের করে দেবে তোদের?’
‘যে কেউ বের করে দিতে পারে বাবা। তুমিতো একটা ঘোরের ভেতর থাকো, এ কারণে তুমি বাস্তব চোখে দেখতে পারো না। এই যে পেপার-পত্রিকা পড়ো, টেলিভিশন দেখো, তাতে কখনো দেখো নাই যে বৃদ্ধা মাকে বাড়ি থেকে বের করে দিল ছেলেরা? দেখো নাই, পিতৃসম্পত্তি থেকে বোনকে উচ্ছেদ করল ভাইরা?’
‘ছি ছি ছি।’ আফজাল আহমেদ এবার রেগেই গেলেন, ‘দিন দিন এ কী নোংরা চিন্তা-ভাবনা হচ্ছে তোর সেলিনা? তুই তো আগে এমন ছিলি না? এগুলো কে ঢোকাচ্ছে তোর মাথায়? তোর মা? কোথায় সে? কোথায়?’
মছিদা বেগম আশপাশে কোথাওই ছিলেন। তিনি আড়াল থেকে বের হয়ে এসে বললেন, ‘ও তো ভুল কিছু বলে নাই। তা ছাড়া তোমার সন্তানদের মধ্যে ও-ই তো এখন সবচেয়ে অসহায়। ওর কথাই তোমার সবার আগে ভাবতে হবে। কোন একটা বিপদ আপদ হলে, সবাই যার যার মতো একটা ব্যবস্থা করে নিতে পারবে। কিন্তু ও কী করবে?’
আফজাল আহমেদ আক্ষরিক অর্থেই অসহায় বোধ করছেন। তার তুলনায় মছিদা বেগমের বাস্তব জ্ঞান-বুদ্ধি ভালো। তিনি হতাশ গলায় বললেন, ‘তাহলে এখন আমার কী করা উচিত?’
‘বাড়ির কোন অংশ কে পাবে, সেটা সেটেল করে লিখে দেয়া উচিত।’ বলে মছিদা বেগম একটু থামলেন। তারপর আবার বললেন, ‘ধরো এখন যদি রুবেল হঠাৎ বিয়ে করে, তাহলে সেলিনা কই থাকবে?’
‘রুবেলের বিয়ের কথা আবার কোত্থেকে এলো?’ আফজাল আহমেদ অবাক চোখে তাকালেন, ‘সে তো বলেছে সে বিয়েই করবে না। আর এই বয়সে তাকে মেয়েই বা দেবে কে?’
‘এই দেশে মেয়ের অভাব নেই। তুমিও এখনো বিয়ে করতে চাইলে বলো, আমি মেয়ের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।’ ঝাঁজের সাথে বললেন মছিদা বেগম। ‘তিন তলায় আশফাকদের থাকতেই সমস্যা হয়। দোতলায় জাফররা থাকে। ওখানে আর কারো যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। আর এখানে দিপু আর রুবেল এক রুমে থাকে। রুবেল রেগুলার থাকে না বলে ওই ছোট ওইটুক রুমটাতে দিপু একা কোনোমতে থাকতে পারে। সেলিনার বিয়ের পর তার রুমটা ফাঁকা ছিল, মাঝেমধ্যে রুবেল বা অতিথ-মেহমান আসলে সেখানে থাকতো। কিন্তু এখনতো সেই রুমে সেলিনাই থাকে।
‘হুম।’
‘হুম কী? আজ হোক কাল হোক, দিপুওতো বিয়ে করবে, করবে না? তখন কী হবে? তখন সেলিনা কই যাবে? তার যাওয়ার কোনো জায়গা আছে?’
আফজাল আহমেদ রেগে যেতে যেতেও নিজেকে সংবরণ করলেন। আসলে মছিদা বেগমের কথার যুক্তিসংগত কোনো উত্তর তিনি খুঁজে পাচ্ছিলেন না। বাকিটা সময় তিনি থম মেরে বসে রইলেন। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার পর মছিদা বেগম যেন খানিকটা নরম হলেন। তিনি বললেন, ‘আমি জানি তুমি আমার ওপর রাগ করছো। ভাবছো, আমি কী আজেবাজে চিন্তা করছি। কিন্তু আমিতো মা। মা না?’
আফজাল আহমেদ কোনো কথা বললেন না। মছিদা বেগম বললেন, ‘শোনো, আমার সব সন্তানের জন্যই সমান মায়া, স্নেহ, মমতা। কিন্তু যেই সন্তানটা একটু দুর্বল, তার জন্য দুশ্চিন্তাটা একটু বেশিই হয়।’
তিনি আফজাল আহমেদের খানিকটা কাছে এসে তার বাহুতে হাত রেখে বললেন, তোমার চিন্তা না থাকলেও আমার অনেক চিন্তা। তুমিতো সেলিনাকে চেনোই। ছোটবেলা থেকেই ও একটু অন্যরকম। এখন অন্যরকম বলেতো আর আমরা ওকে ফেলে দিতে পারব না, তাই না? আমরা হলাম মা-বাবা। সন্তান যেমনই হোক, সে আমাদেরই। এখন অন্যরা কিন্তু সেটা বুঝবে না। তারা ঠিকই সহ্য করতে পারবে না। দূর দূর করে তাড়িয়ে দেবে। আর তখন যদি আমরাও না থাকি, ও যাবে কই? একবার ভেবেছো?’
আফজাল আহমেদ এবারও কথা বললেন না। মছিদা বেগমই বললেন, ‘আল্লাহ না করুক, আমার বা তোমার যদি কিছু একটা হয়ে যায়, তখন এই মেয়েটা কই যাবে? একটু ভাবোতো? হয়তো অন্য সবাই তাকে ফেলে দেবে না। আদর-যত্নই করবে। কিন্তু একটা জিনিস মাথায় রাখতে হবে, এখন সবারই কিন্তু নিজেদের সংসার আছে, জীবন আছে। আছে না? সেই জীবন নিয়ে তারা ব্যস্ত। তাদেরও নানা প্রয়োজন আছে। একবার ঠাণ্ডা মাথায় ভাবো, এখনই কারো সময় নেই সেলিনার খোঁজ-খবর নেয়ার। আজ দুই মাস হলো জাফর তাকে কোনো টাকা-পয়সা দেয় না। সে হয়তো ভুলেই গেছে সেলিনার কথা।’
‘ভুলে যাবে কেন?’
‘কারণ সে ব্যস্ত। ইচ্ছে করে যে ভুলেছে তা তো না। কিন্তু তার অফিস, চাকরি, এই ট্যুর সেই ট্যুর। এই সমস্যা, সেই সমস্যা। মনে থাকবে কী করে! সেদিন সেলিনার জন্য একটা চাকরির কথা বললাম জাফরের কাছে, সে গ্রাহ্য করল না। মুনিয়াকে বললাম, সেও বলল পারবে না। তাহলে আমরা না থাকলে তখন কী হবে, ভেবেছো? তখন কি কারো সময় হবে তার খোঁজখবর নেয়ার? তখন তার পায়ের নিচেতো একটু মাটি থাকা দরকার। মাথার ওপর একটু ছাদ থাকা দরকার। দরকার না?’
এই এতক্ষণে মছিদা বেগমের কথাগুলো যেন বোধগম্য হতে লাগল আফজাল আহমেদের কাছে। তিনি বাঁ হাতের উল্টো পিঠে তার দাড়ি ঘষতে ঘষতে বললেন, ‘কিন্তু এখনই এভাবে বাড়ি ভাগ করে দেয়া কি ঠিক হবে? আমার একটুও মন সায় দিচ্ছে না। এতে ছেলেমেয়েদের মধ্যে না আবার একটা দ্বন্দ্ব তৈরি হয়! তা ছাড়া অন্যদের মতামতওতো নেয়ার দরকার আছে, আছে না?’
‘বাড়ি তোমার, মতামতও তোমার। তুমি যা বলবে তাই অন্যরা শুনতে বাধ্য। এখানে আবার এই সেই কী!’
আফজাল আহমেদ রাতভর মছিদা বেগমের কথা ভাবলেন। এবং রাত যত বাড়তে থাকল, ততই মছিদা বেগমের কথাগুলো তার যুক্তিসংগতও মনে হতে লাগল। কিন্তু তারপরও তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারলেন না যে তার জীবদ্দশায়ই তার ছেলে মেয়েদের মধ্যে এই বাড়ি ভাগ করে দিতে হবে তাকে! এ যেনো শুধু বাড়িই ভাগ নয়, এ যেন তার বুকের ভেতর আদরে, ওমে, মমতায় বড় করে তোলা সেই তুলতুলে তুলোর বলের মতো সুবাসিত শরীর আর নিষ্পাপ মুখগুলোর মধ্যেও স্পষ্টই একটা বিভাজন তৈরি করে ফেলা। বিষয়টা তিনি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলেন না। বুকের ভেতর এলোমেলো করে দেয়া এক অস্থিরতা নিয়ে রাত কাটালেন তিনি।