২০
সেলিনা খুব অস্থির হয়ে আছে। প্রতিমাসে এর-ওর কাছে হাত খরচের টাকা চাইতে আর ভালো লাগে না তার। বেশির ভাগ সময় মেজো ভাই জাফরই তাকে হাত খরচের টাকা দিয়ে থাকে। কিন্তু অফিসে কী এক ঝামেলা চলার কারণে ইদানীং জাফর কখন বাড়ি ফেরে আর কখন বের হয়ে যায়, তা কেউই টের পায় না। এবার মাস ফুরোলেও নিজ থেকে সেলিনার খবরও নেয়নি জাফর। এ নিয়ে বারদুয়েক মায়ের কাছে অভিযোগও করেছে সেলিনা। মছিদা বেগম বলেছেন, ‘সবসময় কি সবকিছু একইরকম যায়? দুয়েকটা মাসতো একটু এদিক-সেদিক হতেই পারে, পারে না?’
তা পারে। কিন্তু দুয়েক মাস এদিক সেদিক হলে কি বাড়িতে বাজার বন্ধ থাকবে মা?’
‘বাজার বন্ধ থাকলে সবাই খাবে কী?’
‘তাহলে আমার হাত খরচের টাকা না থাকলে আমি চলব কী করে?
‘তোর আবার হাত খরচ কী? তুইতো বাসায়ই থাকিস সারাদিন।’
‘বাসায় তো আর এমনি এমনি থাকি না মা। হাতে টাকা-পয়সা নেই বলে থাকি।’
‘বাইরে কী কাজ তোর?’ মছিদা বেগম কিছুটা বিরক্ত।
‘বাইরে কী কাজ মানে? আমি কি সারাজীবন তোমাদের গলগ্রহ হয়ে থাকব? আমাকে চাকরি-বাকরি পেতে হবে না? ঘরে বসে থাকলে তো আর কেউ ডেকে নিয়ে গিয়ে আমাকে চাকরি দেবে না, দেবে?’
সেলিনার কথায় যুক্তি আছে। মছিদা বেগম এ বিষয়টা ভেবে দেখেননি। তবে অন্য একটা বিষয় নিয়েও তিনি চিন্তিত। এই বয়সের ডিভোর্সড মেয়েদের নিয়ে সমাজে নানা সমস্যা। রাস্তাঘাট থেকে অফিস আদালত পর্যন্ত পুরুষ মানুষ সারাক্ষণ লোলুপ দৃষ্টি নিয়ে ওত পেতে বসে থাকে। মেয়েটার বিয়ে না দেয়া অবধি তাই তিনি শান্তি পাবেন না। সমস্যা হচ্ছে, সেলিনার মতিগতির কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। এখন এই কথা বলছে তো পরক্ষণেই অন্য কথা। ফরিদের সাথে তার ডিভোর্সের বিষয়ে তাকে ছাড়া আর কাউকে কিছু বলেনি সেলিনা। এমন কী ডিভোর্সও দিয়েছে কাউকে কিছু না জানিয়ে। সমস্যার শুরুর দিকে অবশ্য মছিদা বেগম অল্পবিস্তর জানতেন। তখন তিনি নানাভাবে সেলিনাকে বোঝানোর চেষ্টাও করেছেন। কিন্তু সেলিনার এক কথা, যে পুরুষের চরিত্রের সমস্যা, তার সাথে সে কোনোভাবেই সংসার করবে না। ফরিদের চরিত্রে কী সমস্যা তা অবশ্য সে প্রথম দিকে খুলে বলেনি। বলেছে পরে।
মছিদা বেগম বলেছিলেন, ‘কী সমস্যা সেটা তুই খুলে না বললে কী করে বুঝব যে সমস্যা কার?’
সেলিনা বলেছিল, ‘তোমরা শাশুড়িরা কোনোদিন জামাইদের কোনো সমস্যা দেখেছো? জামাই অন্য মেয়ের সাথে শুয়ে এলেও বলবে পুরুষ মানুষের ওরকম একটু-আধটু দোষ থাকেই। বলবে না?’
মছিদা বেগম মেয়ের কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলেন। তিনি বললেন, ‘এটা কী ধরনের কথা? ফরিদ মোটেই এ ধরনের ছেলে না।’
‘ফরিদ কী ধরনের ছেলে বলে তোমার ধারণা? দুধে ধোয়া তুলশী পাতা সে?’
‘পৃথিবীতে কোনো ছেলেই দুধে ধোয়া তুলশী পাতা না।’
‘কেউ না?’
‘না।’
‘আমার বাবাও না?’
‘না। তোর বাপ-ভাই কেউ না। তোর কাছে তারা বাপ-ভাই হতে পারে, কিন্তু অন্য মেয়ের কাছে তারা কী, সেটা হলো আসল ব্যাপার।’
‘তো আমার বাপ যদি ভালো না হয়, তাহলে তুমি তার সাথে এত বছর থাকলে কেন?’
‘মানুষ বলেই থেকেছি। কোনো মানুষই এক শ ভাগ ভালো না। দোষ-গুণ মিলিয়েই মানুষ। মানুষতো আর ফেরেশতা না যে তাদের লোভ লালসা, কাম, ক্রোধ, হিংসা, বিদ্বেষ থাকবে না। এগুলো মেনে নিয়েই মানুষের সাথে থাকতে হবে। তুই নিজেও কি ফেরেশতা?’
এবার সেলিনার অবাক হবার পালা। সে তার মায়ের দিকে দীর্ঘ সময় তাকিয়ে থেকে বলল, ‘আরেকজনের ছেলের সাফাই গাইতে গিয়ে তুমি নিজের ছেলে- মেয়ে, স্বামী-সন্তানের চরিত্র নিয়ে কথা বলছো, তোমার লজ্জা করছে না? তুমি কী বলোতো?’
‘আমি কী সেটা আমার বয়সে না পৌঁছালে বুঝবি না। এতগুলো ছেলে-মেয়ের মা না হলে বুঝবি না। এখনতো রক্ত গরম, শরীর টানটান, চোখে রঙিন চশমা, এইজন্য যা দেখিস সবই রঙিন।’
‘আমি কিছুই রঙিন দেখি না মা। রঙিন দেখলে ফরিদের এইসব নোংরা কাজ কর্ম আমি একদিনও সহ্য করতাম না।’
তুই যে কী সহ্য করতে পারিস, তা আমার জানা আছে। কী করেছে ফরিদ?’
‘কী করেছে শুনবে?’
‘হ্যাঁ শুনব।’
‘তোমার সোনার টুকরা জামাই তার অফিসে ইন্টার্নি করতে আসা এক মেয়েকে নিয়ে থাইল্যান্ডে সাত দিনের ট্যুর করে এসেছে। আমাকে বলে গেছে অতি গুরুত্বপূর্ণ অফিসিয়াল ট্যুর, এই সাত দিন সে ভাত খাওয়ারও সময় পাবে না। আমি যেন যখন-তখন তাকে ফোন দিয়ে বিরক্ত না করি। এর মধ্যে তার মা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাকে হাসপাতালে নিতে হবে, অপারেশন করাতে হবে। আমার তখন পাগলের মতো অবস্থা। যতবার তাকে ফোন দিই, ফোন বন্ধ। সে তখন কচি মেয়ে নিয়ে হোটেলে ফূর্তি করছে। আর তার বুড়া মাকে নিয়ে আমি হাসপাতালে হাসপাতালে দৌড়াচ্ছি।’
মছিদা বেগম এতটা আশা করেননি। তিনি ফুটো বেলুনের মতো চুপসে গেলেন। সেলিনা বলল, ‘কী এখন কথা বলছো না কেন?’
মছিদা বেগম সামান্য চুপ থেকে বললেন, ‘এই কথা তুই জানলি কী করে?’
‘আমি কী করে জানলাম সেটা গুরুত্বপূর্ণ না মা। ঘটনা যে ঘটেছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ।’
‘ঘটনা যে ঘটেছে সেটা তুই নিশ্চিত হলি কী করে?
‘কেন? তোমার ধারণা আমি তোমার সোনার টুকরো জামাইয়ের নামে বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে কথা বলছি?’
‘তুই মিথ্যে না বলতে পারিস। কিন্তু তোর জানায়ওতো কোনো ভুল থাকতে পারে, পারে না?’
সেলিনা অগ্নিদৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। যেন চোখের দৃষ্টিতেই সে মছিদা বেগমকে ভস্ম করে ফেলবে। মছিদা বেগম অবশ্য তার সেই অগ্নিদৃষ্টি উপেক্ষা করে বিড়বিড় করে বললেন, ‘সত্য-মিথ্য যাই হোক। আমার বিশ্বাস তোর কোথাও কোনো ভুল হচ্ছে।
‘আমার ভুল হচ্ছে?’
‘হ্যাঁ হচ্ছে। কেন তুই কি জগতের একমাত্র শুদ্ধচারী মানুষ নাকি যে তোর ভুল হতে পারবে না! ফরিদ কোনদিন তোর গায়ে হাত তুলেছে? ভাতের কষ্ট দিয়েছে? কাপড়ের কষ্ট দিয়েছে?’
‘না দেয়নি।’
‘তাহলে?’
‘তাহলে কী? স্বামী যদি মারধর না করে, ভাতে-কাপড়ে কষ্ট না দেয়, তাহলেই তার সাথে আজীবন থাকতে হবে? তার চরিত্রের দোষ থাকলেও? সে খুনি, ধর্ষক, লম্পট হলেও?’
‘সে খুনিও না, ধর্ষকও না। তাকে আমি চিনি। সে মানুষ ভালো। আর যদি সে উল্টাপাল্টা কিছু করেও থাকে। এ নিয়ে এত হৈচৈ করার কিছু নাই। মেয়ে মানুষ তার স্বামীর দোষ দশজনরে বলে বেড়াবে না। সে তার স্বামীর দোষ রাখবে ঢেকে। আর পুরুষ মানুষের এমন একটু-আধটু দোষ থাকেই। সবারই থাকে। এর চেয়ে খারাপ দোষও থাকে। সব ধরলে চলে না।’
সেলিনা কী বলবে ভেবে পেল না। সে হঠাৎ শব্দ করে হেসে ফেলল। তারপর বলল, ‘দেখলে, আমি ঠিক বলেছিলাম না? আমি বলেছিলাম না যে তুমি বলবে পুরুষ মানুষের এমন একটু-আধটু দোষ থাকেই। বলেছিলাম না?’
‘যেটা ঠিক, সেটা যার মুখ থেকেই বের হোক সেটা ঠিকই থাকে। তুই বা আমি বলেছি বলে সেটা ভুল হয়ে যায় না। ‘
সেদিন এই বিষয় নিয়ে তাদের আর কোনো কথা হয়নি। উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের পর দীর্ঘ সময়ের জন্য মা মেয়ের সম্পর্ক হয়ে গেল বরফের চেয়ে শীতল। এই শীতল সময়েই যে সেলিনা তার ডিভোর্সের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিবে তা মছিদা বেগম বুঝতে পারেননি। বুঝলে তিনি হয়তো নিজ থেকেই সেলিনার সাথে কথা বলতেন। পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করতেন। কিন্তু যতদিনে তিনি পরিস্থিতি বুঝলেন ততদিনে দেরি হয়ে গেছে। সেলিনার ডিভোর্স হয়ে গেছে।
.
এখন এই সেলিনার চিন্তায় তার ঘুম হয় না। সেজো ছেলে রুবেলকে নিয়েও চিন্তার অন্ত নেই মছিদা বেগমের। রুবেলের সব বন্ধুরা বহু আগেই বিয়ে করে ফেলেছে।
অনেকের বাচ্চা-কাচ্চা হাই স্কুলেও পড়ে। অথচ সে এখনো বিয়ের নাম গন্ধও নিচ্ছে না। মাঝে মাঝে নিজের জীবনটা নিয়ে আক্ষেপের আর শেষ থাকে না মছিদা বেগমের। নিজেকে গানের সেই জলে ভাসা পদ্ম মনে হয়। যেন কোথাও কোনো ঠাই নেই। সবচেয়ে বেশি রাগ হয় স্বামীর ওপর। সারাটা জীবন স্ত্রীর কাঁধে সংসার- সন্তানদের দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে নিজে নিশ্চিন্ত জীবন যাপন করে গেলেন। এখন এই মেয়েটাকে নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন দুশ্চিন্তা। এই দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তির উপায় কী কে জানে?
তিনি রাতে সেলিনাকে নিয়ে বসলেন। বললেন, ‘তুই এখন কী ভাবছিস সেটা আমাকে বল?’
‘কী ভাবছি মানে? তোমাকে তো বলেছিই একটা চাকরি দরকার আমার।
তারপর আর তোমাদের মাথার ওপর বোঝা হয়ে থাকব না।
‘তোকে কি কেউ বলেছে যে তুই আমাদের মাথার ওপর বোঝা হয়ে আছিস?’
‘বলতে হবে কেন? তোমাদের ধারণা আমি বোকা? আর বোকা হলেও এটুকু বোঝার ক্ষমতা আমার আছে।’
‘শেলী! তুই কি বুঝতে পারছিস যে তুই দিন দিন অসুস্থ হয়ে যাচ্ছিস?’
‘আমি অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি না, তোমরা সবাই মিলে আমাকে অসুস্থ করে দিচ্ছো। এর মধ্যে ওই ফালতু লোকটা আবার আমাকে বিরক্ত করা শুরু করেছে। রাত বিরাতে যখন তখন ফোন দেয়া শুরু করেছে।’
‘ফালতু লোকটা কে? ফরিদ?’ মছিদা বেগমের গলার স্বর খানিক উষ্ণ
‘সে ছাড়া আর কে? এমন বেহায়া, এমন চরিত্রহীন সে ছাড়া আর কে আছে?’ মছিদা বেগম সেলিনার গা ঘেঁসে এসে বসলেন। তারপর নরম গলায় বললেন, ‘কী বলছে সে?’
‘কী বলছে সে মানে কী? আমি কী বসে বসে তার সাথে প্রেমালাপ করেছি? আমি তার সবগুলো নম্বর ব্লক করে দিয়েছি। কিন্তু সে এখন নিত্য নতুন নম্বর থেকে ফোন দেয়া শুরু করেছে। এইজন্য আমি এখন অপরিচিত নম্বর থেকে আসা ফোন ধরাও বন্ধ করে দিয়েছি।’
মছিদা বেগম সেলিনার কাঁধে হাত রাখলেন। তারপর বললেন, ‘একবারতো কথা বলে দেখ, কী বলতে চায় সে?’
সেলিনা ঝটকা মেরে তার কাঁধ থেকে মায়ের হাতখানা ছুঁড়ে ফেলে দিল। তারপর বলল, ‘খবরদার মা। তুমি আর কখনো আমাকে এই বিষয়ে কোনো কথা বলবে না।
‘আচ্ছা বলব না।’ মছিদা বেগম আরো নরম হলেন। মেয়েকে এখন আর ঘাটাতে চান না তিনি। ‘তা চাকরি-বাকরি কই খুঁজছিস?’
‘অনেক জায়গায়ইতো সিভি দিলাম। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে অনেকদিন গ্যাপ হয়ে গেছে তো। সবাই এ বিষয়টাকেই আগে বিবেচনায় আনে। তবে এনজিওগুলাতে চেষ্টা করছি।’
‘এনজিওতে!’
‘কেন? এনজিওতে আবার কী সমস্যা?’
‘শুনেছি এনজিওতে চাকরি করলে দূরে গ্রামে গ্রামে গিয়ে থাকতে হয়।’
‘দূরে গ্রামে গ্রামে গিয়ে থাকলে অসুবিধা কী? মানুষ দূরে দূরে গিয়ে চাকরি করে না? জাফর ভাইয়াতো আজ এখানে কাল সেখানে যায়। কদিন আগেওতো চিটাগং থেকে এলো।’
‘তুইতো আর মেজো ভাইয়া না।’
‘আমি তাহলে কী, মেজো আপা?’
‘তুই বুঝতে পারছিস না। তুই যদি এখন এখানে সেখানে গিয়ে থাকিস, এই নিয়ে পাঁচজনে পাঁচ কথা বলবে।’
‘বুঝলাম না, পাঁচজনে পাঁচ কথা বলবে মানে কী? আমি কি একাই এনজিওতে চাকরি করছি? আর কেউ করছে না? বাংলাদেশে হাজার হাজার মেয়ে এনজিওতে চাকরি করছে। আমি করলে সমস্যা কী?
মছিদা বেগম বলবেন না বলবেন না করেও শেষ অবধি কথাটা বললেন, তুইতো আর অন্য মেয়েদের মতো না। এমনিতেই তোর ডিভোর্স নিয়ে আত্মীয়- স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী আকারে-ইঙ্গিতে নানা কথা বলে। এখন যদি তুই আবার এনজিওতে চাকরি নিয়ে একা একা ঢাকার বাইরে গিয়ে থাকিস, তখন লোকজনের মুখ আটকানো যাবে?’
মায়ের কথা শুনে সেলিনা কী বলবে ভেবে পেল না। রাগে, ক্রোধে তার সারা শরীর কাঁপছে। একবার মনে হলো মাকে এখুনি তার চোখের সামনে থেকে চলে যেতে বলে সে। কিন্তু পরক্ষণেই আবার মনে হলো মাকে কিছু কঠিন কথা তার শোনানো উচিত। সে বলল, ‘আমি ডিভোর্সড মেয়ে বলে এনজিওতে চাকরি করতে পারব না?’
‘তা না, তুই আমার কথা বুঝতে পারছিস না। এই এক বদ অভ্যাস তোর। কথায় কথায় রেগে যাস। এভাবে রেগে যাওয়া ঠিক না। এখন অন্তত অভ্যাসটা পাল্টা।’
‘কেন? রেগে যাওয়া যাবে না কেন? রাগের কথা বললে রেগে যাব না? নাকি ডিভোর্সড মেয়ে বলে রাগের কথায়ও মুখ বুজে চুপ করে থাকতে হবে?’
মছিদা বেগম কিছু বললেন না। মাঝে মাঝে তার খুব অসহায়, খুব দিশেহারা লাগে। তিনি চুপ করে বসে রইলেন। সেলিনা বলল, ‘বুঝলাম। মেয়েদের ডিভোর্সড হলে রেগে যাওয়া যাবে না, এনজিওতো চাকরিও করা যাবে না। আর কী কী করা যাবে না, একটু বলো। আমি একটা লিস্ট করে নিই। আচ্ছা, খাওয়া- দাওয়া করা যাবে? মানে তোমার আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের এই বিষয়ে কী মত?’
সেলিনার গলা ক্রমশই উঁচু হচ্ছিল। মছিদা বেগম ইশারায় তাকে গলা নিচু করে কথা বলতে বললেন। কিন্তু সেলিনা শুনল না। সে বরং চিৎকার করে বলল, ‘একজন ডিভোর্সড মেয়ের যদি খাওয়া-পরায় নিষেধ না থাকে, কিন্তু চাকরি বাকরিতে নিষেধাজ্ঞা থাকে, তাহলে তার এই খাওয়া-পরা কে জোগাবে? তোমার পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন? যদি তাই হয়, তাহলে এখন থেকে তাদের বলবে মাসে মাসে আমার সব খরচ দিয়ে যেতে। আমি চাকরি-বাকরি কিছু করব না। গলা উঁচু করে কথা বলব না। সারাদিন ঘরে বসে খাব দাব, ঘুমাব আর টিভি দেখব। ঠিক আছে?’
মছিদা বেগম বললেন, ‘তুই কথায় কথায় ফট করে রেগে যাস। তোর সাথে কোনো কথা বলা যায়?’
‘এতক্ষণ কী করলে তাহলে?’
‘তুই বললি আর আমি শুনলাম।’
‘আচ্ছা, এবার তুমি বলো আমি শুনি।’
মছিদা বেগম শান্ত গলায় বললেন, ‘মাথা ঠাণ্ডা করে শোন। আগেই কেন ঢাকার বাইরে যাওয়ার কথা ভাবছিস? আগেতো ঢাকার মধ্যে সম্ভব এমন চাকরির কথা ভাববি, তাই না?’
‘আমি তাই-ই ভেবেছিলাম মা। কিন্তু সবাই ঢাকায় থাকতে চায়। এইজন্য ঢাকার মধ্যে চাকরি পাওয়া কঠিন।’
‘জাফরের সাথে কথা বল। সেতো কত মানুষকে কত চাকরি দিল।’
‘তুমি বলো। আমি একবার বলেছিলাম। কিন্তু সে পাত্তা দেয়নি। বলল নিজের অফিসে নিজের বোনকে চাকরি দিলে লোকে এটা সেটা বলবে।’
তাহলে অন্য কোনো অফিসে দিক।
‘সেটা আমি বলতে পারব না। তুমি বলো।’
মছিদা বেগম অনেকক্ষণ কী ভাবলেন। তারপর বললেন, ‘আচ্ছা, তুই এখন মাথা ঠাণ্ডা করে ঘুমাতে যা। আমি কাল জাফরকে যা বলার বলব।’
পরদিন অবশ্য জাফরকে কিছু বলতে পারলেন না তিনি। ভোরবেলা গিয়ে তাকে ঘরে পাওয়া গেল না। তবে মুনিয়ার সাথে তার দেখা হয়ে গেল। তিনি বললেন, ‘জাফর কি রাতে ফেরেনি বৌমা?’
‘ফিরেছিল মা। কিন্তু আজ সাতটার ট্রেনে ময়মনসিংহ যেতে হলো ওর।’
‘ময়মনসিংহ কেন?’
‘অফিসের কী এক কাজে।’
‘ওহ, আচ্ছা। কবে ফিরবে কিছু বলেছে?’
‘না বলেনি। তবে দুয়েকদিন লাগবে হয়তো।’
‘আচ্ছা। তুমি যে আজ এখনো বের হওনি?’
‘আজতো স্কুল ছুটি মা। তবে তারপরও আমাকে যেতে হবে। দুপুরের পর।’ ছুটির দিন হলে আবার যেতে হবে কেন?’
‘আমাদের ডে সেকশনে দুজন টিচার নিয়োগ দেয়া হবে, এই বিষয়ে একটা মিটিং আছে।’
মছিদা বেগমের মাথায় চট করে একটা বুদ্ধি খেলে গেল। তিনি বললেন, ‘কবে নিয়োগ দেয়া হবে?’
‘এ মাসেই মা। আজকের মিটিংয়ের পর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়া হবে। কী কী রিকোয়ারমেন্টস লাগবে, সে বিষয়েও সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’
‘আচ্ছা, তুমি এক কাজ করো, আজ স্কুল থেকে ফেরার পর আমার সাথে একটু দেখা করো।’
মুনিয়া বলল, ‘আচ্ছা মা।’
মিটিং শেষে বাসায় ফিরতে সামান্য দেরি হলো মুনিয়ার। দোতলার সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময়ই তাকে ডাকলেন মছিদা বেগম। খুব আদুরে গলায় বললেন, ‘আজও এত দেরি করে ফিরলে মা?’
মুনিয়া অবাক চোখে তাকাল। এই এত বছরের বিবাহিত জীবনে মছিদা বেগম কখনোই তাকে এমন করে ডাকেননি। সে ঘুরে তাকিয়ে বলল, ‘লম্বা মিটিং হলো মা।’
‘কী হলো মিটিংয়ে?’
‘অনেক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে মা। আসলে স্কুলতো কারো একার সিদ্ধান্তে চলে না। সবকিছুইতো অনেকগুলো মানুষের আলাপ-আলোচনার পরে চূড়ান্ত হয়।’
তাতো হবেই। তাতো হবেই। অত বড় স্কুল। এত বড় বড় মানুষ ওই স্কুলের সাথে যুক্ত। কত শত শত ছেলে মেয়ের ভবিষ্যৎ এখানে। চাট্টেখানে কথাতো নয়। তার ওপর তুমি একা মানুষ। কত দিক তোমাকে সামলাতে হয়। এ কেবল তুমি বলেই সম্ভব মা। অন্য কোনো মেয়ে হলে কবেই হাল ছেড়ে দিত!’
মছিদা বেগমের মুখে এমন কথা শুনে মুনিয়া যারপরনাই অবাক হলো। আজ অবধি কখনো স্কুল নিয়ে কোনো ভালো কথা তিনি বলেননি। আজ হঠাৎ তার মুখে এমন কথা শুনে মুনিয়া ভেতরে ভেতরে একটু ঘাবড়ে গেল। কোথাও কোনো সমস্যা নয়তো?
মছিদা বেগম কিছুটা ইতস্তত ভঙ্গিতে বললেন, ‘তোমার সাথে একটু কথা ছিল মা। অবশ্য তেমন জরুরি কিছু না। পরেও বলা যাবে।’
সকাল থেকেই শরীরটা একটু খারাপ লাগছিল মুনিয়ার। তারপর দীর্ঘ সময় মিটিং করে এসে এখন মাথাটাও ব্যথা করছে। সে নরম গলায় বলল, ‘আমি একটু হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে আসি মা? মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে। চোখে-মুখে একটু পানি ছেটালে হয়তো ভালো লাগবে।’
মছিদা বেগম কেমন আঁতকে ওঠা গলায় বললেন, ‘কী বলছো তুমি! যাও, যাও। এক্ষুনি গিয়ে একটু মাথায়ও পানি ঢালো। আর শোনো, সারাদিন এমন খাটাখাটনি করোনা বুঝলে! নিজের শরীরের দিকেও একটু খেয়াল রাখো।’
মুনিয়া সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল। তারপর ধীর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করল দোতলায়। মছিদা বেগমের আচরণে সে রীতিমতো বিভ্রান্ত। তার এই দীর্ঘ সংসার জীবনে এমন ঘটনা আর কখনো ঘটেনি। মছিদা বেগমের সাথে তার সম্পর্ক যে খারাপ, এমন নয়। বরং আর দশজন শাশুড়ি-বৌমার চেয়ে ঢের ভালো। কিন্তু সেই সম্পর্ক আনুষ্ঠানিক। সেখানে প্রবল যুদ্ধ যেমন নেই, নেই প্রগাঢ় সম্প্রীতিও।
ঘরে ফিরে খানিক চুপ করে বসে রইলো মুনিয়া। তারপর হালকা গরম পানিতে গোসল সেরে ফেলল। এখন শরীরটা খানিক ঝরঝরে লাগছে। এক কাপ গরম চা পেলে খুব ভালো হতো। কাউকে ডেকে এক কাপ চায়ের কথা বলবে ভেবে উঠে দাঁড়াল মুনিয়া, আর ঠিক সেই মুহূর্তে মছিদা বেগমকে চোখে পড়ল তার। মছিদা বেগম ঘরে ঢুকলেন। তার হাতে কাচের জগ আর গ্লাস। তিনি সেই জগ আর গ্লাসটা মুনিয়ার সামনে রাখতে রাখতে বললেন, ‘গ্রাম থেকে তোমার মেজো খালু আসছিল গতকাল। গাছপাকা বেল নিয়াসছিল। সেই বেলের শরবত। কোনো চিনি টিনি দিই নাই, তারপরও খেয়ে দেখো। চিনির চাইতেও বেশি মিষ্টি। নাও।’
এই মুহূর্তে কোনোভাবেই বেলের শরবত খেতে ইচ্ছে করছিল না মুনিয়ার। কিন্তু তারপরও সে শরবতটা খেল। মছিদা বেগম বললেন, ‘কি, মিষ্টি না? চিনির চাইতেও বেশি মিষ্টি। বলছিলাম না?’
মুনিয়া বলল, ‘জি মা।’
‘হুম। আর চিন্তা করো, এই ঢাকা শহরের কোনো ফল ফলাদি আছে যে মুখে নিয়ে টেস্ট পাওয়া যায়? যায় না। তরমুজ, বেল, আনারস, পেঁপে সব ফলই চিনি মিশিয়ে মিষ্টি বানাতে হয়। আহারে মানুষ, কী খেয়ে বাঁচবে বলো? সবকিছুতে বিষ আর বিষ। শরীর-স্বাস্থ্য আর ঠিক থাকবে কেমনে!’ তিনি তার হাতের গ্লাস আর জগ টেবিলের ওপর রাখতে রাখতে বললেন, ‘শোনো, এই বাকিটাও এইখানে থাকল। তুমি পরে খেয়ে নিও কিন্তু।’
‘আচ্ছা মা।’ মুনিয়া অস্ফুট স্বরে জবাব দিল। সে আসলে অপেক্ষা করছে মছিদা বেগমের আসল কথাটা শোনার জন্য। এতক্ষণে যা বোঝার বুঝে ফেলেছে মুনিয়া। মছিদা বেগম নিশ্চয়ই তাকে কোনো না কোনো বিশেষ কথা বলতে চান। কিন্তু সেই বিশেষ কথাটা কী, তা কোনোভাবেই অনুমান করতে পারছে না সে।
মছিদা বেগম বললেন, ‘স্কুলে কী হলো শেষ পর্যন্ত?’
‘কোন বিষয়ে মা?’
‘সকালেই না বললে, দুজন নতুন শিক্ষক নেবে স্কুলে?’
‘জি মা।’
‘সেই বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত হলো?’
‘এখন সার্কুলার হবে। তারপর যোগ্যতা অনুযায়ী আবেদনের ভিত্তিতে পরীক্ষার
জন্য ডাকা হবে।
‘কী কী লাগবে?’
‘ইংরেজিতে কমপক্ষে অনার্স থাকতে হবে। রেজাল্ট ভালো হতে হবে। সাথে ইংরেজি গ্রামার, ভোকাবুলারি আর লিটারেচারেও ভালো দক্ষতা থাকতে হবে।’
‘অত কী আর আমি বুঝি মা? তবে আমার একটা কথা আছে।’
‘কী কথা মা?’
‘সেলিনার সম্পর্কেতো তুমি জানোই। সে ছাত্রী হিসেবে কিন্তু খারাপ ছিল না। ওই কেবল পড়াশোনায় মনোযোগটাই যা একটু কম ছিল। না হলে তার রেজাল্টও কিন্তু ভালোই থাকত।’
‘জি মা।’ এতক্ষণে মছিদা বেগমের আসল উদ্দেশ্যটা বুঝতে পারল মুনিয়া। মছিদা বেগম বললেন, ‘সে কিন্তু প্রাইমারিতে ওয়ান থেকে ফাইভ পর্যন্ত ফার্স্ট ছিল। অঙ্কে একবার এক শতে বিরানব্বুইও পেয়েছিল। শুধু তাইই না। ইংরেজিতেও ফট ফট কথা বলতে পারত।’ মছিদা বেগম বিগলিত গলায় কথাগুলো বললেন। মুনিয়া শাশুড়ির হাসির জবাবে মৃদু হাসল। মছিদা বেগম বললেন, ‘তুমি চাইলে কিন্তু সেলিনাকে তোমাদের স্কুলে নিয়ে নিতে পারো। আমি সেলিনার মা দেখে বলছি না, সেলিনাকে নিলে তোমাদের খুবই উপকার হবে।’
মুনিয়া বিনীত ভঙ্গিতে বলল, ‘আসলে মা বিষয়টাতো আর আমার একার এখতিয়ার না। এসব স্কুলে অনেক নিয়ম-কানুন আছে। বোর্ড আছে। তাদের নিয়ম-কানুনের বাইরে কাউকে কোথাও ঢুকানো সম্ভব না। একজন সামান্য দপ্তরিও না।’
মছিদা বেগম দমে গেলেন না। তিনি তার মুখে আগের হাসি ধরে রেখেই বললেন, ‘আরে এসব আমরা বুঝি। ওই যে শোনোনি, বজ্রআঁটুনি, ফস্কা গেঁড়ো? যেখানে যত বেশি নিয়ম কানুন, সেখানে তত বেশি ফাঁকফোকড়। তুমি একটা ফাঁকফোকড় দিয়ে ওকে ঢুকিয়ে দাও। আমি জানি তুমি পারবে। তুমি পারো না এমন কোনো কাজ আছে? তোমার মতো মেয়ে কটা হয় বলোতো? তুমি আমাদের সবার গর্ব।’
মুনিয়া এবার সাবধান হলো। সে সতর্ক ভঙ্গিতে বলল, ‘মা এটা সত্যিই আমার হাতে নেই। যদি থাকত, তাহলে আপনাকে বলতে হতো না। তা ছাড়া আমাদের সাবজেক্ট চেয়েছে ইংরেজি, কিন্তু সেলিনার সানজেক্টতো ছিল সোশিওলোজি। মানে সমাজবিজ্ঞান।’
‘তাতে কী? সাবজেক্ট যাই থাকুক, সে কী ইংরেজি জানে না? সমাজবিজ্ঞানেও কিন্তু তাকে ইংরেজিতেই পড়তে হয়েছে। হয়েছে না? শোনো মা, এটা কোনো ব্যাপার না। সে যেই সাবজেক্টেই পড়ুক, তার ইংরেজি জ্ঞান ভালো। তুমি দেখো মা। তোমার ওপর আমার বিশ্বাস আছে, তুমি একটু চেষ্টা করলেই পারবে। আমি এখন যাই। গিয়ে সেলিনাকে বলি মাসখানেক কোথাও একটু ইংরেজি কোচিং টোচিং করতে। আগেরতো সব জানাই। শুধু অনেকদিন পড়াশোনার মধ্যে নেই বলে কয়টা দিন একটু প্র্যাকটিস করতে হবে। তারপরই দেখবা আবার আগের মতো গড়গড় করে ইংরেজি বলা শুরু করবে।’
মুনিয়াকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই মছিদা বেগম ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। মুনিয়া তার চলে যাওয়া পথের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। সে বুঝতে পারছে, একটা ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে যাচ্ছে সে। বাড়িতে নতুন করে একটা অশান্তি শুরু হতে যাচ্ছে। কিন্তু সবকিছু আগেভাগে বুঝতে পারার পরও এই পরিস্থিতি থেকে তার কোনো মুক্তি নেই। উত্তরণের কোনো পথও নেই।