১৮
আনন্দে ঋদ্ধির শরীর কাঁপছে। এই চৌদ্দ বছরের জীবনে এমন আনন্দময় অনুভূতি সে এর আগে কখনো অনুভব করেনি। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে রাফি। রাফির গায়ে কালো শার্ট। শার্টের বোতাম খোলা। ভেতরে ধবধবে সাদা টি-শার্ট। টি- শার্টের বুকের ওপর লেখা, ‘আমাকে হারাতে দিলে নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তিতে ছেয়ে যাবে তোমার শহর…।’ লেখার নিচে রাফির নিজের নামটাও সুন্দর করে লেখা। রাফি এসেছিল স্কুল থেকে রখিকে নিয়ে যেতে। মুনিয়ার আজও মিটিং চলছে। ফলে তার বের হতে খানিক দেরি হচ্ছে। ঋদ্ধি তাই মার জন্য অপেক্ষা করছিল। রাফি বলেছিল, ‘তুমি কি একা একা অপেক্ষা করবে? নাকি মা আসা অবধি আমরাও থাকব তোমার সাথে?’
ঋদ্ধি কী বলবে বুঝে উঠতে পারছিল না। এই এক সমস্যা তার, রাফির সামনে কোনোকিছুই গুছিয়ে বলতে পারে না সে। সহজ, সাধারণ কথাটাও না। বাড়িতে বসে কতবার যে সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলার অনুশীলন করেছে, কিন্তু লাভ হয়নি। রাফি সামনে এলেই তার জগৎসংসার এলোমেলো হয়ে যায়। সে কী বলতে গিয়ে কী বলে ফেলে। তবে এক্ষেত্রে তাকে রক্ষা করল রথি। রথি বলল, ‘একটু থাকি ভাইয়া। ম্যাডামের যদি মিটিং শেষ করতে দেরি হয়ে যায়?’
‘ওতো তাহলে ওর আম্মুর রুমেই গিয়ে বসতে পারে?’ রাফি পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিল।
রথি বলল, ‘ওখানেও অনেক লোকজন বসে আছে।‘
রাফি অবশ্য আর কথা বাড়াল না। সে ওদের থেকে দূরে গিয়ে একটা বেঞ্চিতে বসে হেডফোনে গান শুনতে লাগল। ঋদ্ধি কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। রথি বলল, ‘তোর মা কি চলে এসেছে?’
ঋদ্ধি উত্তর দিল না। সে হনহন করে হেঁটে রাফির সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
তারপর বলল, ‘আপনি আমাকে একটা কবিতা লিখে দেবেন?’
রাফি তার কান থেকে হেডফোনটা খুলে উৎসুক চোখে তাকাল। তারপর বলল, ‘একবার না তোমাকে কবিতা লিখে দিলাম?
‘উহুম। ওরকম কবিতা না।’
‘তাহলে কী রকম কবিতা?’
‘স্কুলের ফাংশানে মার ডায়েরিতে যেমন লিখে দিয়েছিলেন।’
রাফি ভ্রু কুঁচকে তাকাল, ‘কী লিখেছিলাম তাতো ভুলে গেছি!’
ঋদ্ধি খানিক চুপ করে থেকে বলল, ‘চোখ নিয়ে।’
‘চোখ নিয়ে?’ রাফি অবাক হলো। এবং এই প্রথমবারের মতো সে আবিষ্কার করল ঋদ্ধি দু চোখ ভর্তি করে কাজল পরেছে। যদিও তার আনাড়ি হাতে পরা সেই কাজল লেপ্টে গিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে চোখের দু পাশে। দেখতে কেমন অদ্ভুত লাগছে। আবার ওই সলজ্জ, সঙ্কোচে গুটিয়ে থাকা দ্বিধান্বিত কিশোরী মুখখানায় ওই লেপ্টানো কাজলটুকুই যেন ছড়িয়ে দিয়েছে প্রগাঢ় মায়া। সে ঋদ্ধির হাত থেকে নোটবুকটা নিল। এই মুহূর্তে লেখার মতো কিছুই তার মাথায় আসছে না। তবুও ঋদ্ধির নোটবুকটাতে সে খসখস করে আগে লেখা তার একটা কবিতার দু লাইন লিখে দিল।
‘দহনের দিনে, কিছু মেঘ কিনে, যদি ভাসে মধ্য দুপুর,
তবু মেয়ে জানে, তার চোখ মানে, কারো বুক পদ্ম পুকুর।’
নোট বুকটা হাতে নিয়ে ঋদ্ধি মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলো। তার বিশ্বাস হচ্ছে না রাফি তাকে এই লাইনগুলো লিখে দিয়েছে! এই কথাগুলো কেবল তার। সে বারবার বিড়বিড় করে কথাগুলো পড়ল। কিছু বুঝল, কিছু বুঝল না। কিন্তু শেষ লাইনের কথা কটি তার ছোট্ট বুকের খুব গহীনে কোথাও যেন তিরতির করে বইয়ে দিতে লাগল এক স্রোতস্বিনী নদী।
.
মুনিয়া বের হলো তারও কিছুক্ষণ পর। এই পুরোটা সময় ঋদ্ধি তন্ময় হয়ে বসে রইলো। খটখটে দুপুর, খাঁখাঁ রোদ্দুর, তীব্র গরম আর একটা লু হাওয়া বয়ে যাচ্ছে শহরজুড়ে। কিন্তু ঋদ্ধির সবই ভালো লাগছে। অজানা কোনো এক ফুলের রেণু যেন তার ভাবনার জগৎটাকে সুবাসিত করে রাখল পুরোটা সময়। বাড়ি ফেরার সময় রিকশায় সে মাকে বলবে না বলবে না করেও কথাটা বলে ফেলল, ‘আচ্ছা মা, দহনের দিন মানে কী?’
মুনিয়া আনমনা ভঙ্গিতে বলল, ‘দহন মানে জানিস না তুই?’
ঋদ্ধি ভয়ে ভয়ে বলল, ‘ইটস বার্নিং, মানে বার্নিং ডে, তাই না মা?’
‘বাংলা শব্দের অর্থ ইংরেজিতে বুঝতে হচ্ছে, এই হলো ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ার ফলাফল?’
‘তা না মা। আমি বুঝতে পারছি, আবার পারছিও না।’
‘কী বুঝতে পারছিস না?’
‘ধরো, দহনের দিনে, কিছু মেঘ কিনে, যদি ভাসে মধ্য দুপুর, এই লাইনটা আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না।’
মুনিয়ার আনমনা ভাবটা হঠাৎ কেটে গেল। সে ঋদ্ধির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কী ব্যাপার বলতো? এই লাইন তুই কই পেলি?’
ঋদ্ধির আচমকা মনে হলো সে মাকে কথাটা বলতে চায় না। বা বলাটা ঠিকও হবে না। মা হয়তো রেগে যাবে। এমনিতেই বেশ কিছু দিন থেকে মা প্রয়োজনে- অপ্রয়োজনে তার ওপর রেগে যাচ্ছে। সে কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বলল, ‘একজন বলল লাইনটা।’
‘কে বলল?’
‘আমাদের ক্লাসের একজন, তুমি চিনবে না।’
‘আর কিছু ছিল না?’
‘উহু। শুধু এটুকুই।’
‘আবার বলতো?’ ঋদ্ধির কথাটা কেন যেন বিশ্বাস হলো না মুনিয়ার।
ঋদ্ধি আবার বলল। মুনিয়া খানিক ভেবে বলল, ‘হয়তো বৃষ্টি হচ্ছে না এমন কোনো একটা প্রচণ্ড গরমের দুপুরে মেঘের কাছ থেকে বৃষ্টি প্রার্থনা করছে কেউ। মানে কিনতে চাইছে। তারপর মেঘ বৃষ্টি ঝরাতেই সে সেই বৃষ্টিতে ভিজে শীতল হলো।’
‘মেঘ কি কেনা যায় মা?’
‘ধুর বোকা, এটাতো আর সরাসরি কেনা নয়। কবিতায় এমন থাকে। কোনো একটা শব্দ বা বাক্য দিয়ে ভাবটা বোঝানো হয়।’
‘রাফি ভাইয়ার কবিতাগুলো খুব ভালো, তাই না মা?’
মুনিয়া হঠাৎ সতর্ক হয়ে গেল, ‘সেটা আমি কী করে বলব? আমিতো আর রাফির কবিতা পড়িনি।’
‘কেন? তোমাকে যে একবার কী সুন্দর একটা কবিতা লিখে দিল!’
মুনিয়া তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বলল, ‘কী জানি! অত কী আর মনে আছে আমার? এই বয়সের সব ছেলেপুলেরাই এমন ছাইপাশ লেখে। এগুলোকে তেমন গুরুত্ব দেয়ার কিছু নেই।‘
‘সত্যি?’
‘হুম। কিছুদিন গেলে একটু ম্যাচিওর হলে তারা নিজেরাই বুঝতে পারবে, এতদিন যা লিখেছে, তার কিচ্ছুই হয়নি। সব ফালতু।’
‘ওহ।’ ঋদ্ধি মনে মনে খুবই আহত হলো। কিন্তু মাকে সেটি বুঝতে দিল না সে। হতে পারে মা ঠিক কথাই বলছে। তাকেও তো মা সবসময়ই বলে, ‘আরেকটু বড় হ, তারপর সব বুঝবি। এখনো বোঝার বয়স হয়নি।’
কে জানে, হয়তো সে ছোট বলেই এসব তার ভালো লাগে। কিংবা এমনও হতে পারে রাফি ভাইয়াকে তার ভালো লাগে বলে সে যা করে তার সবকিছুই তার ভালো লাগে। এমন নানা এলোমেলো ভাবনায় চুপ করে রইলো ঋদ্ধি। বাকিটা পথ আর একটা কথাও বলল না সে। কিন্তু আজ ঋদ্ধির এমন অপ্রত্যাশিত প্রশ্ন, কৌতূহল তারপর হঠাৎ এমন চুপ হয়ে যাওয়া চোখ এড়াল না মুনিয়ার
কেমন একটা অব্যক্ত অস্থিরতা বুকে পুষে বাড়ি ফিরল সে।
.
বাড়ি ফিরেও স্বস্তি পেল না সে। বরং একটা চাপা, একটা সূক্ষ্ম কিন্তু তীব্র অস্বস্তি ভেতরে ভেতরে অগোছালো করে রাখল তাকে। জাফর বাড়ি ফিরল সন্ধ্যার খানিক পর। মুনিয়া তখন ক্লাস টেস্টের খাতাগুলো নিয়ে বসেছিল। জাফর পোশাক পাল্টেই শুয়ে পড়ল বিছানায়। এই ভর সন্ধ্যায় তাকে শুয়ে পড়তে দেখে মুনিয়া বলল, ‘কী হলো, শরীর খারাপ লাগছে?’
জাফর বলল, ‘উহু।’
‘তাহলে? এখুনি শুয়ে পড়লে যে!’
অফিসে হঠাৎ করেই অনেক কাজের চাপ। একটা ফরেন ডেলিগেটস টিম এসেছে। সারাটা দিন বকবক করে মাথাটা ধরিয়ে দিয়েছে।’ জাফরের গলাটা খুব ক্লান্ত আর ম্লান লাগল মুনিয়ার কাছে। সে আড় চোখে তাকাল। জাফর কি কিছুটা মোটা হয়ে গেছে? তার চোখের নিচে কি কালি জমেছে? মনে মনে একটু ধাক্কার মতো খেল মুনিয়া। এক ঘরে একই বিছানায় থেকেও কতদিন সে জাফরকে দেখার মতো করে দেখে না? সামনে ছড়ানো-ছিটানো খাতাগুলো সরিয়ে রেখে উঠে এলো মুনিয়া। তারপর জাফরের পাশে এসে দাঁড়াল, ‘তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে শরীর খারাপ।’
‘শরীর খারাপ নাতো!’
‘তাহলে চোখের নিচে কালি কেন? রাতে ঘুম হয় না?’
‘সেটাতো আমার চেয়ে তোমারই ভালো জানার কথা। আমার নাক ডাকায়তো উল্টো তোমারই ঘুম হয় না।’ জাফর হাসল। তার হাসিটা বড় ফ্যাকাশে লাগল মুনিয়ার কাছে। সে জাফরের গা ঘেঁষে বসল। কতদিন পরে এভাবে বসল সে নিজেও জানে না। তারপর বলল, ‘তোমার কি ওয়েট বাড়ছে?’
‘বুঝব কী করে!’
‘কেন, মাপাও না?’
‘উহু। ওটাতো তোমাদের মেয়েদের কাজ।’
‘ওয়েট মাপা মেয়েদের কাজ হবে কেন?’
‘ওজন বাড়া-কমা নিয়ে তোমরা যা কনসার্ন! এক কেজি বাড়লে-কমলেই যেন পৃথিবী ওলট-পালট হয়ে গেল।’
‘ভালো স্বাস্থ্য কিন্তু কেবল মেয়েদের ব্যাপার না জাফর। তোমারও বয়স হচ্ছে, এই বয়সে হুট করে ওজন বাড়া ভালো লক্ষণ না। তুমি কী রেগুলার ব্লাড টেস্ট- ঠেস্ট করাও? কোলেস্টেরল দেখো?’
‘সময় পাই কই?’
‘উহু। সময়ের অজুহাত দিও না। এটা সিরিয়াসনেসের অভাব।’
জাফর হাই তুলতে তুলতে বলল, ‘আমি রাতে আর খাব না। বাইরে থেকে ভারী খাবার খেয়ে এসেছি।’
মুনিয়া আরো কিছু বলবে বলে ভেবেছিল। কিন্তু তার আগেই জাফর পাশ ফিরে শুইলো। আর সাথে সাথেই তার নাক ডাকার শব্দ শোনা গেল। মুনিয়ার একটু দুশ্চিন্তাই হচ্ছে। এমনিতে জাফরের ভালো ঘুম হয়। অন্য কোনো সমস্যাও নেই। তারপরও হঠাৎ করেই আজ তাকে দেখে খানিকটা ধাক্কার মতোই খেয়েছে মুনিয়া। কোথায় যেন বড় ধরনের একটা শারীরিক পরিবর্তন ঘটে গেছে জাফরের। এবং পরিবর্তনটা ভালো নয়। তাকে ভালো একজন ডাক্তার দেখানো দরকার। কিন্তু মুনিয়ার হাতেও একদমই সময় নেই। তা ছাড়া দুজনের সময় মেলানোটাও প্রায় অসম্ভব। সবচেয়ে ভালো হয় জাফর একা গিয়েই ডাক্তারটা দেখিয়ে এলে। কিন্তু এসব ব্যাপারে তার যে অনীহা, মনে হয় না সে একা যাবে।
মুনিয়া আবার খাতা দেখতে বসল। কখন যে অনেক রাত হয়ে গেছে টেরই পেল না সে। এর মধ্যে রাফি বার কয়েক ফোন করেছে তাকে। কিন্তু কেন যেন রাফির ফোন ধরতে ইচ্ছে করছিল না মুনিয়ার। সে খাতাগুলো গুছিয়ে রেখে ঋদ্ধির ঘরে উঁকি দিল। ঋদ্ধি ঘুমিয়ে পড়েছে। প্রতিদিনকার মতোই তার চারপাশে ছড়ানো-ছিটানো এলোমেলো বই-খাতা। মুনিয়া আলতো পায়ে ঘরে ঢুকল। তার চোখ সতর্ক। দুপুরে বাড়ি ফেরার পথে ঋদ্ধির বলা কথাগুলো একটা অস্বস্তির কাঁটা হয়ে এখনো কোথায় যেন বিঁধে আছে। খানিক খুঁজতেই নোট বুকটা পেয়ে গেল সে। সেখানে গোটা গোটা অক্ষরে রাফির হাতের লেখা—
‘দহনের দিনে, কিছু মেঘ কিনে, যদি ভাসে মধ্য দুপুর,
তবু মেয়ে জানে, তার চোখ মানে, কারো বুক পদ্ম পুকুর।‘
লেখাটার দিকে এক দৃষ্টিতে দীর্ঘ সময় তাকিয়ে রইলো মুনিয়া। তার হঠাৎ মনে হলো, সময় বুঝি থমকে গেছে। স্থির হয়ে গেছে সবকিছু। সেই অনন্ত স্থিরতায় একমাত্র তার অনুভব করার ক্ষমতাটুকুই কেবল সচল। সেই সচল অনুভূতিটুকু তাকে ক্রমশই তীব্র এক যন্ত্রণার চোরা কাঁটায় ক্রমাগত ক্ষতবিক্ষত করতে লাগল।
রাফির সাথে সেই রাতে আর কথা হলো না মুনিয়ার। তবে দিন দুই বাদে দেখা হলো তাদের। অফিসের ফরেন ডেলিগেটসদের নিয়ে আবারও চট্টগ্রাম অফিসে যেতে হলো জাফরকে। অফিস থেকে পাওয়া তার গাড়িটা পড়ে আছে বাড়ির গ্যারেজে। এই গাড়িটা যখন প্রথম অফিস থেকে পেয়েছিল জাফর, তখন কী যে উত্তেজনা কাজ করেছিল মুনিয়ার! শখ করে ড্রাইভিংটাও শিখে ফেলেছিল সে। মাঝেমধ্যে চালাতোও। কিন্তু তারপর কিছু কিছু ব্যাপারে জাফরের সাথে দূরত্ব তৈরি হতে থাকল। আর ধীরে ধীরে জাফরের সবকিছুর প্রতি আগ্রহও হারিয়ে ফেলতে শুরু করল সে।
মুনিয়া এখনো জানে না দোষটা আসলে কার ছিল? তার না জাফরের? ঋদ্ধির বয়স তখন তিন কী চার। দীর্ঘ বিরতির পর মুনিয়া আবার চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এখানে সেখানে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছিল সে। আর ঠিক সেই মুহূর্তে হঠাৎ করেই একদিন জাফর তাকে বলল, ‘তোমার কি আর চাকরি করার দরকার আছে?’
‘থাকবে না কেন? অবশ্যই আছে।’
‘কেন বলোতো?’
‘কেন বলোতো মানে কী জাফর? আমি কনসিভ করার আগেওতো জব করতাম, করতাম না?’
‘হ্যাঁ করতে। কিন্তু তখনতো আর ঋদ্ধি ছিল না। এখন ঋদ্ধি আছে। ওকে দেখাশোনার ব্যাপার আছে। তাই না?’
‘হ্যাঁ আছে। তো?’
‘তো তুমি চাকরিতে ঢুকলে ওর দেখাশোনা কে করবে?
‘তুমি করবে।’
‘মানে?’ জাফর চমকে ওঠা গলায় বলল।
মুনিয়া ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে বলল, ‘ঋদ্ধির জন্যতো আমি চার বছর চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলাম, নাউ ইটস ইওর টার্ন। তুমি এখন চার বছরের জন্য চাকরি ছেড়ে দাও।‘
‘কী বলছো তুমি?’
ঠিকই বলছি। ঋদ্ধিতো আর আমার একার না, তাই না? সে তোমারও। তাহলে তার জন্য কেন একা আমাকে চাকরি ছাড়তে হবে?’
‘তুমি কিন্তু খামখেয়ালি করছো।’
‘আমি মোটেই খামখেয়ালি করছি না। খামখেয়ালি করছো তুমি।’ মুনিয়া কিছুটা উত্তেজিত ভঙ্গিতেই কথাগুলো বলল। তারপর আবার সাথে সাথেই নিজেকে সংযত করল সে। বলল, ‘আচ্ছা, তুমি আমাকে বলোতো যাদের বাচ্চা কাচ্চা আছে তারা জব করে না?’
জাফর বলল, ‘করবে না কেন? প্রয়োজন থাকলে নিশ্চয়ই করবে। কিন্তু তোমারতো প্রয়োজন নেই।’
‘আমার প্রয়োজন নেই?’ মুনিয়া কপাল কুঁচকে তাকাল।
‘কী প্রয়োজন বলো? তোমার হাত খরচের টাকা আমি দেই। তুমি চাকরি ছাড়ার পর থেকে এই তিন চার বছর আমি তোমার সব খরচ দিইনি? তোমার যাতায়াতের জন্য গাড়ি রয়েছে। থাকার জন্য বাড়ি রয়েছে। আর কী দরকার তোমার?’
মুনিয়া সাথে সাথেই জবাব দেয়নি। সেদিন তার হঠাৎই মনে হয়েছিল সে এক নতুন জাফরকে তার চোখের সামনে আবিষ্কার করছে। শিক্ষিত, আধুনিক, উদার যে জাফরকে সে এতদিন চিনত, সেই জাফর এ নয়। এই জাফরকে সে আগে কখনো দেখেনি।
অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে সে বলল, ‘মানুষের প্রয়োজন কি শুধু এগুলোই জাফর? মানুষের আর কোনো প্রয়োজন নেই?’
‘আর কী প্রয়োজন থাকবে মানুষের? এসবের জন্যই মানুষ এত পরিশ্রম করে, এত ছোটা-ছুটি করে রাতদিন।’
‘আমি যদি তোমাকে টাকা-পয়সা, গাড়ি-বাড়ির ব্যবস্থা করে দিই, তুমি ঘরে বসে থাকবে জাফর? ঘরে বসে বাচ্চা-কাচ্চা পালবে, ঘর-সংসার করবে?’
‘এসব কী বলছো তুমি? তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?
মুনিয়া দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘জানি না জাফর। তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে সত্যি সত্যিই আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আচ্ছা একটা কথা বলোতো, এই যে আমি এত পড়াশোনা করলাম। এতকিছু জানলাম, বুঝলাম, শিখলাম। বাকিটা জীবন আমার সেই জানা, পড়াশোনা মূল্যহীন হয়ে রইবে? এই ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে আমি হেঁশেল ঠেলে কাটিয়ে দেব? তুমি তাই চাও?’
‘তুমি বিষয়টাকে এভাবে কেন দেখছো? তুমিতো বিষয়টাকে এভাবেও দেখতে পারো যে আমরা দুজন মানুষ, সংসারে আমাদের দুজনের আলাদা কিছু রোল আছে। উই হ্যাভ টু প্লে আওয়ার ওউন রোলস। তাই না?’
‘তোমার রোলটা কী? চাকরি করা, টাকা উপার্জন করা? আর আমার রোল হচ্ছে ঘরে বসে বাচ্চা পালা আর সংসার করা?’
জাফর যা বলতে চাইছে, তা যেন ঠিক মতো বুঝিয়ে বলতে পারছিল না। সে খানিক নরম গলায় বলল, বিষয়টা তা না মুনিয়া। আমি তোমাকে বোঝাতে পারছি না। এই বয়সের একটা বাচ্চা বাবা-মা থাকা সত্ত্বেও যে অন্যের হাতে মানুষ হবে। এটা তোমার ভালো লাগবে?’
‘অন্যের হাতে কেন মানুষ হবে? এ বাড়িতে তার দাদা-দাদি আছে। তারা কি অন্য মানুষ? আর আমি জব করা মানেতো এই নয় যে আমি দিন-রাত চব্বিশ ঘন্টা বাইরে পড়ে থাকব। আমি তেমন জবই খুঁজছি যাতে আমাকে খুব একটা বেশি সময় বাইরে থাকতে না হয়। হয়তো পেয়েও যাব। কিন্তু এবার তোমাকে একটা প্রশ্ন করি আমি?’
‘কী প্রশ্ন?’
‘এই যে তুমি তোমার সন্তানের অন্য কারো হাতে মানুষ হওয়া নিয়ে এত চিন্তিত কিন্তু তুমি আমাকে বলোতো, গত তিন বছরে তুমি তোমার সন্তানের জন্য কী করেছো? কদিন তুমি ঋদ্ধিকে খাইয়েছো? কয় রাত তুমি ঋদ্ধির জন্য না ঘুমিয়ে জেগেছিলে? কতবার তুমি তার ন্যাপি বদলেছো? বলো?’
জাফর এই প্রশ্নের জবাব দেয়নি। মুনিয়াই বলেছিল, ‘শুধু তাই-ই না, তুমি বলোতো মাসে কদিন তুমি ঢাকায় থাকো? কদিন তুমি রাত দশটার আগে বাড়ি ফেরো? আর সেই তুমি যদি তোমার সন্তানের অন্য মানুষের হাতে মানুষ হওয়া নিয়ে টেনশন করো, তাহলে সেটা মাছের মায়ের পুত্র শোকের মতো হয়ে যায় না?’
সেদিন কথা আর বেশিদূর এগোয়নি। তবে দুজনের মাঝখানে একটা অদৃশ্য দেয়ালের সেই শুরু। একটা থমথমে হাওয়া। সেই হাওয়া মাঝেমাঝেই ঝড় তুলেছে। লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে সম্পর্কের ঘর-দোর, খুঁটি। তারপর হয়তো আবার নতুন করে জোড়াও লেগেছে। কিন্তু কে না জানে, ভেঙে যাওয়া আয়না এবং ভেঙে যাওয়া সম্পর্ক আর কখনো আগের মতো জোড়া লাগে না।
মাসখানেক বাদে মছিদা বেগম মুনিয়াকে ডেকে বলেছিলেন, ‘শুনলাম তুমি নাকি চাকরি খুঁজছো?’
‘এখন আর খুঁজছি না মা।
‘আলহামদুলিল্লাহ। তোমার আর চাকরি খোঁজার কী দরকার বৌমা? ঘরের বৌ ঘরে থাকবা। আল্লাহ তো তোমার স্বামীকে কম দেয়নি। কম দিয়েছে?’
‘জি না।’
হুম। সে আল্লাহর রহমতে ভালো আয়-রোজগার করে। তুমি এখন বাচ্চাটাকে ঠিক ঠাকভাবে মানুষ করবা। সারাদিন পরিশ্রম করে রোজ অতোরাতে বাসায় ফেরে জাফর, তার একটু সেবা-যত্ন দরকার। সেটা করবা। এমনতো না যে তোমার বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়ি তোমার কাছ থেকে আলাদা কোনো সেবা-যত্ন আশা করে। তারা চায়, তোমাদের সংসার নিয়ে তোমরা যেন ভালো থাকো
মুনিয়া তার শাশুড়ির সব কথা মন দিয়ে শুনল। তারপর বলল, ‘মা আমি চাকরি করব না বলে চাকরি খুঁজছি না, বিষয়টা তা না।’
‘তাহলে?’
‘আসলে আমি অলরেডি একটা চাকরি পেয়ে গেছি। আগামী মাসেই জয়েন করব। এ জন্য আর চাকরি খুঁজছি না।’
মুনিয়ার কথা শুনে মছিদা বেগম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। তিনি মুনিয়ার কাছ থেকে এমন আচরণ আশা করেন নি। তবে এ বিষয়ে আর কথাও বাড়ালেন না মছিদা বেগম। তিনি প্রতিশোধ নিলেন অন্যভাবে। মুনিয়া চাকরি শুরু করার পর প্রায়ই বাসায় ফিরে দেখে তার জন্য খাবার নেই। থাকলেও বাসী কনকনে ঠাণ্ডা খাবার। কাজের মেয়েরা তার ঘর মুছে রাখেনি। কাপড় ধোয়নি। ঋদ্ধির ময়লা কাঁথা-কাপড় সে যেমন রেখে গিয়েছিল, ঠিক তেমনই পড়ে রয়েছে। এমন চূড়ান্ত অসহযোগীতার পরও চাকরিটা ছাড়ল না মুনিয়া। বরং সে বাইরে থেকে ফিরে চুপচাপ তার কাজগুলো করতে লাগল। এতে তার দ্বিগুণ তিনগুণ পরিশ্রম হলেও দাঁতে দাঁত চেপে সে চাকরিটা চালিয়েই গেল। চাকরিটা তখন তার কাছে একটা চ্যালেঞ্জের মতো। এই চ্যালেঞ্জে সে হারতে চায় না। হারেওনি মুনিয়া। বাসা থেকে অতদূরের স্কুলটা তিন বছর চালিয়ে গেল সে। তারপর ভাগ্য যেন তার দিকে ফিরে তাকাল। বছর তিন অমানুষিক কষ্ট করার পর অপ্রত্যাশিত সুযোগ পেয়ে গেল বাড়ির কাছের টুমরো’স গ্লোরি স্কুলটাতে। তারপর কেমন কেমন করে অল্পদিনে প্রধান শিক্ষকও হয়ে গেল সে।
এই পুরোটা সময় জাফরের সাথে তার দূরত্ব বাড়তে থাকল ভয়ংকরভাবে। মুনিয়া ভাবত, জাফর হয়তো মছিদা বেগমের এসব অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ করবে। কিন্তু দিনের পর দিন সবকিছু দেখেও যেন না দেখার ভান ধরে থাকত জাফর। এমনকি মুনিয়া বারকয়েক বলার পরও কোনো উচ্চবাচ্চ্য করেনি সে। বরং কখনো কখনো মুনিয়াকেই দুষেছে। যেন বিশাল এক অন্যায় করে ফেলেছে মুনিয়া। এখন সেই অন্যায়ের যথাযথ শাস্তি পাচ্ছে সে।