১৬
সুমির মন খারাপ। মন খারাপের কারণ তার বাবা আব্দুল আজিজ মাস্টার। তার আবার শরীর খারাপ করেছে। আজিজ মাস্টারের বয়স বড়জোর পঞ্চাশ। কিন্তু নানাবিধ অসুখের কারণে তাকে দেখতে লাগে ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধের মতো। তিনি হাজিগঞ্জ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। তার একমাত্র কন্যা সুমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। সে হলে থাকে। আজিজ মাস্টার স্কুল থেকে যে বেতন পান তাতে গ্রামে তার সংসার মোটামুটি ভালোই চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু মেয়ের পড়াশোনা আর নিজের চিকিৎসার খরচ জোগাতেই তাকে হিমশিম খেতে হয়। সবচেয়ে বেশি ভোগায় হাঁপানির সমস্যা। দুশ্চিন্তার বিষয় হচ্ছে, তার এই হাঁপানির অসুখটা পেয়েছে সুমিও।
দুপুরে বাড়িতে ফোন করার পর থেকে সুমির মন খারাপ। বাবার শরীরটা বেশ খারাপ। দুদিন স্কুলে যেতে পারেননি আজিজ মাস্টার। সুমি ফোন দিতেই বললেন, ‘এ মাসের টাকা পাঠাতে দেরি হয়ে গেলরে মা।’
‘সমস্যা নেই আব্বা। ‘
‘সমস্যা নেই মানে? অবশ্যই সমস্যা আছে। আমি কালই হাজিগঞ্জ বাজারে গিয়ে তোকে টাকা পাঠিয়ে দেব।’
‘তাড়াহুড়া করার কিছু নেই আব্বা। আমি টিউশনের বেতন পেয়েছি কাল।‘
আজিজ মাস্টার আঁতকে উঠলেন, ‘তুই এখনো টিউশনি ছাড়িস নাই? তোকে না বললাম টেউশনির দরকার নাই?’
‘কেন দরকার থাকবে না আব্বা?’
‘কার না কার বাসায় গিয়ে পড়াবি। কেমন না কেমন মানুষ তারা। তার ওপর তোর পড়াশোনারও ক্ষতি হবে। হাজিগঞ্জের দশগ্রামের মধ্যে কেউ কোনোদিন ইউনিভার্সিটিতে চান্স পেয়েছে? পায় নাই। তুই এই হাজিগঞ্জের গর্ব। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো রেজাল্ট করে তুই ভার্সিটির টিচার হবি। একবার চিন্তা করত, কত বড় গর্বের বিষয়?’
‘এগুলো এখন থাক আব্বা।’
‘থাকবে মানে? আমিতো ঘুমালেও এই দৃশ্য স্বপ্নে দেখি। তুই ইউনিভার্সিটির প্রফেসর হয়ে গ্রামে আসছিস, সেই আনন্দে গ্রামের স্কুল ছুটি দিয়ে দেয়া হয়েছে। রাস্তার দুই ধারে ছেলে-মেয়েরা ফুল হাতে দাঁড়াই আছে। গ্রামের বউ-ঝিয়েরা আড়াল থেকে তাদের বাচ্চা-কাচ্চারে বলতেছে, দ্যাখ দ্যাখ, দেইখ্যা রাখ তারে। বড় হইয়া তার মতন হওন চাই। আহারে, আহারে।’ আজিজ মাস্টারের গলা ধরে এলো।
সুমি বলল, ‘ডাক্তার বলেছেন তোমার শরীর খারাপ হলে তোমাকে কথা কম বলতে। আর তুমি তখন কথা বলো সবচেয়ে বেশি। কেন আব্বা?’
আজিজ মাস্টার সামান্য হকচকিয়ে গেলেন। তিনি বার দুই গলা খাকাড়ি দিয়ে বললেন, ‘আমার শরীর খারাপ তোকে কে বলেছে? তোর মা বলেছে?’
‘মার বলতে হবে কেন? আমি বুঝি না? আজ মাসের আট তারিখ। জীবনে কোনোদিন এমন হয়েছে যে তোমার বড় ধরনের শরীর খারাপ না হলে তুমি টাকা পাঠাতে দেরি করেছো?’
আজিজ মাস্টার কিছু একটা বলতে গিয়েও থমকে গেলেন। অনেক ভেবেও বলার এত জুতসই কোনো কথা তিনি খুঁজে পেলেন না। সুমি বলল, ‘আব্বা?’
‘হুম।
‘তুমি কি আল্লাহরস্তে একটু নিজের খেয়াল নিবা? আমার সারাক্ষণ খুব দুশ্চিন্তা হয় আব্বা। কেন যে আমার পড়াশোনা শেষ হয় না! সেই কবে ভর্তি হলাম, মনে হয় এক যুগ। কিন্তু হিসেব করলে দেখি মাত্র দুই বছর। এখনো সেকেন্ড ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষাটা পর্যন্ত হলো না।’
‘হলে কী করতি? এত তাড়াতাড়ি পাশ করে কী করবি তুই?’
‘একটা চাকরি করব আব্বা। তারপর ঢাকা শহরে একটা বাসা নিবো। তারপর তোমাকে আর মাকে ঢাকায় নিয়ে আসব। আমার আর এত টেনশন ভালো লাগে না। সুস্থ থাকো আর অসুস্থ থাকো, সবসময় আমার চোখের সামনে থাকবা।’
আজিজ মাস্টার কিছু বলতে গিয়েও পারলেন না। তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। গলা ধরে আসছে। তিনি চুপচাপ ফোনটা কেটে দিলেন। মেয়েটা তাকে এত ভালোবাসে কেন? পৃথিবীর সব মেয়েরাই কি বাবাদের এমন করে ভালোবাসে? তিনি জানেন না। তার কোনো বোন ছিল না। ছিল একগাদা ভাই। তারা বাবার সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে ভয়াবহ ঝামেলা শুরু করেছিল। মামলা-মোকদ্দমা পর্যন্ত। সেসব দেখে তিনি ত্যক্তবিরক্ত হয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছিলেন।
.
বাবার সাথে কথা বলার পর থেকে সুমির মন খারাপ। দিপু নানাভাবে তার মন ভালো করার চেষ্টা করছে। কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। সুমি বলল, ‘আমি হলে চলে যাই দিপু?’
‘এখুনি? এই না কেবল এলে?’
‘আমার কিছু ভালো লাগছে না।’
‘কী করলে ভালো লাগবে বলো?’
সুমি জবাব দিল না। কোথা থেকে একটা দোয়েল পাখি উড়ে এসে বসল তাদের পাশে। তারপর টুকটুক করে খুঁটে খেতে শুরু করল ঘাসের ফাঁকে। সেদিকে তাকিয়ে সুমি দীর্ঘশ্বাসের মতো করে বলল, ‘আব্বাকে সুস্থ করে দাও।’
দিপু কী বলবে ভেবে পেল না। অসহায় মুখে তাকিয়ে রইলো সে। সুমিই আবার বলল, ‘আব্বার শ্বাসকষ্টটা যখন শুরু হয়, আমি তোমাকে বোঝাতে পারব না, কী কষ্টটা সে পায়!
‘আমি বুঝি।’ দিপু নরম গলায় বলল।
‘উহু, বোঝো না। ওই কষ্টটা যে নিজে কখনো পায়নি, সে কোনোদিনও বুঝবে না। মাঝে মাঝে আব্বার মতো আমারওতো হয়, এ জন্য আমি বুঝি। আমার না হলে কখনোই বুঝতাম না। আচমকা মনে হয়, বাতাসে কোনো অক্সিজেন নেই।’
দিপু আলতো করে সুমির হাতটা তার হাতের মুঠোয় নিয়ে নিল। কিন্তু সেই হাত শীতল, নিরুত্তাপ। এইসব মুহূর্তে খুব অসহায় লাগে দিপুর। প্রিয়তম মানুষটির দুঃসহ যুদ্ধে নির্দিষ্ট দূরত্বে নিরাপদে দাঁড়িয়ে দেখা আর সহানুভূতি প্রকাশ ছাড়া যেন কিছুই করার নেই তার। একটা চাকরি-বাকরি জুটিয়ে ফেললেও হয়তো কিছু করা যেত। কিন্তু সেই উপায়ও এখন নেই। মাস্টার্স পরীক্ষার ডেটটা আজ-কাল করতে করতে পিছিয়েই যাচ্ছে। পরীক্ষাটা শেষ হওয়া অবধি তাকে অপেক্ষা করতেই হবে।
আকাশ খানিক মেঘলা। সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে ঝলমলে আলোর দিন ও কেমন বিষণ্ন হয়ে যায়। আকাশ মেঘলা থাকার কারণে আজ সেই বিষণ্ণতা যেন আরো গাঢ় হয়েছে। মন খারাপ সংক্রামক এক ব্যাধি। তা চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে দ্রুত। দিপুরও মন ভার হয়ে রইলো। সে চুপচাপ বসে রইলো সুমির পাশে। সুমি দীর্ঘ সময় পরে বলল, ‘আমার না কোথাও চলে যেতে ইচ্ছে হয় দিপু। দূরে কোথাও।’
‘কোথায়?’
‘তাতো জানি না, তবে এমন কোথাও যেখানে কোনো দুশ্চিন্তা থাকবে না। কারো জন্য মন কেমন করবে না। কষ্ট হবে না। মনে হবে সবকিছু ঠিকঠাক। চারদিকে কেবল শান্তি আর শান্তি।’
‘এমন কোথাও কি আছে?’
‘নেই। তারপরও ইচ্ছে করে।’ মৃদু হাসল সুমি। তারপর বলল, ‘ক্রুয়েল রিয়েলিটি হচ্ছে, যেখানে যন্ত্রণার অনুভূতি নেই, সেখানে শান্তির অনুভূতিও অনুভব করতে পারার কথা না।’
‘একদম তাই…।’ দিপু যেন আরো কিছু একটা বলতে গিয়েও শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিল। সুমি হঠাৎ বলল, ‘চলো কিছুক্ষণ রিকশায় ঘুরি?’
দিপু বলল, ‘চলো।’
একটা ভেজা হাওয়া আলতো করে ছুঁয়ে যাচ্ছে বিষণ্ন সন্ধ্যা। সেই সন্ধ্যাটা চড়ুই পাখির ডানায় ফুড়ুত করে উড়ে চলে গেল যেন। কত কত কথা হলো দুজনের। খানিক আগের বুক ভার ব্যথার শ্লথ সময়টুকু সন্ধ্যার সেই ভেজা হাওয়ায়
ভেসে ভেসে কোথায় যেন চলে গেল!
হলের গেটে সুমিকে নামিয়ে দিতে গিয়ে খানিক আগে বলতে চেয়েও বলতে না পারা কথাটা আচমকা বলে ফেলল দিপু, ‘চলো না দূরে কোথাও দুয়েকদিনের জন্য ঘুরে আসি?’
‘দূরে কোথাও মানে?’ সুমি চলে যেতে গিয়েও ঘুরে দাঁড়াল।
‘এই ধরো কক্সবাজার বা বান্দরবান কোথাও? বেশি না, দিন দুয়েকের জন্য? চট করে গিয়ে ফিরে এলাম। তোমার ভালো লাগবে।’
‘মানে কী!’ সুমির গলায় ঈষৎ বিরক্তি।
দিপু এবার সপ্রতিভ হবার চেষ্টা করল, ‘মানে আবার কী? আমরা রাতের গাড়িতে চলে গেলাম। পরের সারা দিন, একটা রাত আর তার পরদিনটা থেকে আবার রাতের গাড়িতে ঢাকায় ফিরে এলাম।’
‘আচ্ছা। তারপর?’ সুমি সরাসরি দিপুর চোখে তাকাল।
‘তারপর কী?’
তারপর হলো, তুমি আর কখনো এগুলো আমাকে বলবে না দিপু। কখনো না। তোমাকে আগেও আমি বলেছি। আমার এগুলো ভাল লাগে না।’
‘তুমি সবসময় কেন এমন করো? আমি বুঝি না।
‘কী বোঝো না তুমি?’ সুমির স্বর খানিক কঠিন।
‘আমাদের দুজনের মতো এমন উদ্ভট প্রেম আর কেউ করছে কী না!’
‘এটা উদ্ভট সম্পর্ক?’
‘নয়তো কী? তুমিই বলো আমরা দুজনই কি শুধু প্রেম করছি?’ দিপুর গলা একটু চড়ল, ‘আর কেউ করছে না? আশপাশে সবাই কত কত জায়গায় যাচ্ছে। নিজেদের মতো করে একটু সময় কাটাচ্ছে। কাটাচ্ছে না?’
‘হ্যাঁ কাটাচ্ছে।’ সুমির কণ্ঠ সামান্য কোমল হলো যেন।
‘তাহলে?’
‘তাহলে তুমি এক কাজ করো দিপু।’
‘কী কাজ?’
‘তুমি সেই অন্যদের সাথে প্রেম করো।
‘মানে?’
‘মানে আমার সাথে তোমার পোষাবে না। আমি ব্যাকডেটেড, পুরনো মানুষ। আর তোমরা আধুনিক। ওসব রুমডেট কিংবা হোটেল, রিসোর্টে গিয়ে রাত কাটানো আমাকে দিয়ে হবে না। কিন্তু তোমারতো এতে পোষাবে না। তাহলে আর উপায় কী!
‘সুমি! আমি কি এগুলো মিন করেছি? তুমি শুধু শুধু আমাকে ভুল বুঝছো।’
সুমি স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই হাসল, ‘তাহলে কি মিন করেছো তুমি? আমি তোমার সাথে কক্সবাজার গিয়ে আলাদা হোটেলে আলাদা রুমে থাকব? নাকি একই রুমে আলাদা থাকব?’
দিপু হতাশ ভঙ্গিতে হাত নাড়ল। সুমি বলল, ‘এমন না যে আজ প্রথম তুমি এই কথা বললে। এর আগেও একাধিকবার তুমি একই কথা বলেছো। বলোনি?’
‘হ্যাঁ, বলেছি। তো? তোমাকে বলব না তো কি অন্য কোনো মেয়েকে গিয়ে বলব?’
‘হ্যাঁ, বলবে!’
‘তাই করব।’
যাও করো। এক্ষুণি যাও। আর এতদিনে যে অন্য কাউকে নিয়ে যাওনি, তারই বা নিশ্চয়তা কী? না হলে দুদিন পরপরই কেন এই একই কথা বলো? শুনেতো মনে হচ্ছে যেন কক্সবাজার, বান্দরবান সব তোমার নখদর্পণে। যখন তখন যে কাউকে নিয়ে চলে যাও। তাই না?’
দিপু হতভম্ব ভঙ্গিতে সুমির দিকে তাকিয়ে রইলো। চারপাশে গিজগিজে ভিড়। সে এদিক-সেদিক তাকালও বারকয়েক। চেনা কোনো মুখ চোখে পড়ল না। অনেক চেষ্টা করেও সুমির কথার প্রত্যুত্তর দেয়ার মতো কোনো কথা খুঁজে পেল না সে। প্রবল রাগে তার গা কাঁপছে। সুমি বলল, ‘এমন করছো কেন? আমি কি ভুল কিছু বলেছি?’
এবার জবাব দিল দিপু। শান্ত, স্বাভাবিক গলায় সে বলল, ‘না, ভুল কিছু বলোনি। একদম ঠিক বলেছ।’
সুমি আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তাকে সেই সুযোগটুকু দিল না দিপু। তার আগেই ঘুরে হাঁটা দিল সে। টিপটিপ করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে তখন।
.
বাড়ি ফেরার পথে মুনিয়ার সাথে দেখা হয়ে গেল দিপুর। সাথে ঋদ্ধি। ফুটপাত ধরে হাঁটছে তারা। মুনিয়া মাথার ওপর ছাতা ধরে আছে। ঋদ্ধি লম্বায় প্রায় মায়ের সমান হয়ে গেছে। দিপু পেছন থেকে ডাকল, ‘ভাবি?’
মুনিয়া ঝট করে পেছনে ফেরল, ‘ও তুমি?’
‘কেন, রাস্তাঘাটে এমন কিন্নর কণ্ঠে ভাবি বলে ডাকার মতো আরও লোক আছে নাকি?’
মুনিয়া হাসল, ‘যতদিন তোমাদের কিন্নরী কণ্ঠে ভাইয়া বলে ডাকার মতো মানুষ থাকবে, ততদিন আমাদেরও কিন্নর কণ্ঠে ভাবি বলে ডাকার মতো লোকের অভাব হবে না।
‘এতক্ষণে স্কুল থেকে ফিরছো?’
‘হু। দেরি হয়ে গেল। ওইতো এক ঝামেলা। রোজ এটা সেটা চলছেই।’
‘সেই লাশের ব্যাপারটা?’
‘হুম।’
‘এখনো কোনো কুল-কিনারা হয়নি? কী অবস্থা?’
‘পুলিশতো বলছে তারা সমাধানের প্রায় কাছাকাছি। কিন্তু পলিটিক্যাল কারণে অপরাধিকে ধরতে পারছে না।’
‘কেন?’
‘স্কুলে গভর্নিং বডির মধ্যে দুটা গ্রুপ। দুটোই পলিটিক্যাল। একটা বিরোধী দলের, আরেকটা সরকারি দলের। আবার সরকারি দলের মধ্যেও আলাদা গ্রুপ আছে।
‘ওহ। এখানেও এই অবস্থা?’
‘সবখানেই।’
‘আচ্ছা, ঋদ্ধির কী খবর?’ প্রসঙ্গ পাল্টালো দিপু।
‘এইতো চলছে।’ মুনিয়া যেন দায়সারা উত্তর দিল। দিপু ঋদ্ধির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘পড়াশোনা কিছু করিস?।’
ঋদ্ধি বলল, ‘মাকে জিজ্ঞেস করো চাচ্চু।’
‘কেন? মাকে কেন? তোর কি নিজের পড়াশোনা নিয়ে কথা বলা মানা?’
‘মানা না। আমি ভালো বললেই মা বলবে আমি ভালো-মন্দের কী বুঝি!’
দিপু হাসল, ঠিকইতো, তুই আবার ভালো মন্দের কী বুঝিস, যেখানে তোর মা নিজেই হেড মাস্টার, হ্যাঁ?’
মুনিয়া বলল, ‘তা না। তার ধারণা, সে অনেক বড় হয়ে গেছে। কিন্তু আমি সেটা মানতে চাইছি না। তার সবকিছুতে আমি আগের মতোই রেস্ট্রিকশন দিয়ে রাখছি। এ কারণে তার আমার ওপর অভিমান ‘
ঋদ্ধির চুলের বেণী ধরে টানল দিপু। তারপর বলল, ‘তুই বড় হয়ে গেছিস?’
ঋদ্ধি জবাব দিল না। সে গম্ভীর। দিপু অবশ্য বিষয়টা পাত্তা দিল না। সে বলল, ‘একটা কথা বলোতো ভাবি?’
‘কী কথা?’
‘ছোট আপাকে নিয়ে কী করি?’
‘কেন? আবার কিছু করেছে সেলিনা?’
‘নতুন করে আবার কী করবে? যন্ত্রণাতো সারাক্ষণই দেয়। উদ্ভট সব কথাবার্তা বলে, কাজকর্ম করে। কিচ্ছু বুঝতে চায় না।’
মুনিয়া মৃদু হাসল, ‘ভালো একটা পাত্র দেখে বিয়ে দিয়ে দাও, দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে।’
‘মাফ চাই।’ দিপু হাত জোড় করার ভঙ্গি করল। তারপর বলল, ‘ওকে যে কেউ কী করে সহ্য করেছে, সেটা ভেবেই আমি অবাক হচ্ছি।’
‘ছিঃ। নিজের বোনকে নিয়ে ওভাবে বলতে নেই।’
‘সব মেয়েই কারো না কারো নিজের বোন-ভাবি। তুমিও। অবশ্য মেয়েরা কম-বেশি একইরকম।’
‘সবাই একইরকম হলে পুরুষরা মেয়েদের বুঝতে পারে না কেন? নারীর মন নাকি দেবা ন জানন্তি, দেবতারাও বোঝেন না?’
‘বোঝেন না কথাটা ঠিক না, আসলে বোঝার জন্য যে ঝামেলাটা করতে হয়, ওটা কেউ করতে চায় না। আর ছেলেরা সবসময় ঝামেলা এড়িয়ে চলতে চায়, বুঝলে?’
‘উহু, বুঝলাম না। সব মেয়েই যদি একরকম হয়, তাহলে আবার বুঝতে ঝামেলা হবে কেন?’
দিপু কথা বলল না। মুনিয়া আড়চোখে তাকাল। তারপর ফোড়ন কাটার ভঙ্গিতে বলল, ‘ঘটনা কী খুলে বলো। সুমির সাথে ঝগড়া হয়েছে?’
‘আর ঝগড়া!’ দিপু হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়াল। তারপর বলল, ‘কোথায় যেন পড়েছিলাম, নারী আর মেশিনারি একই। সময়ে অসময়ে বিগড়ে যায়। তো সে আর আলাদা হবে কেন?’
মুনিয়া এবার যেন গম্ভীর হলো, ‘আলাদাই। তবে সেই আলাদা জায়গাটুকু যত্ন করে বুঝতে হয়। না হলে একটা জীবন কেটে গেলেও অচেনাই রয়ে যায়।’
‘ভাইয়া তোমাকে চেনে?’
মুনিয়া কী বলবে ভেবে পেল না। একটু সময় নিল। তারপর বলল, ‘না চিনলে এই যে এতদিন একসাথে থাকছি। তা থাকছি কী করে?’
‘থাকেতো সবাই।’
‘কই? সবাইতো থাকে না। সেলিনাতো থাকল না। এই যে চলে এলো।’ সবাইতো আর সেলিনার মতো একগুঁয়ে, স্ট্যাবোর্ন নয়। তাই না? অনেকেতো মানিয়েও নেয়।’
হুম, এ জন্যই লোকে বলে, মেনে নেয়া আর মনে নেয়া এক নয়। আমরা সবাই-ই সম্ভবত কেবল মানিয়েই নিই, মনে আর নেই না।’ মুনিয়া শেষটায় এসে যেন দীর্ঘশ্বাস লুকাল। বিষয়টা চোখ এড়াল না দিপুর। সে বলল, ‘এই যে তুমি এক হাতে এতকিছু সামলে নাও, তোমাকে কম্প্রোমাইজ করতে হয় না? নিশ্চয়ই হয়। কিন্তু তোমাকে দেখে তা বোঝা যায়?’
‘যায় না?’
‘একদম না। কিন্তু এই কম্প্রোমাইজটুকু যদি তুমি না করতে, তাহলে কিন্তু সবার কাছে তুমি অন্য একটা মানুষ হয়ে যেতে। ছোট আপার মধ্যে এই মানিয়ে নেয়ার প্রবণতাটাই নেই। আর সবাই মানিয়ে নিতে পারলে সে কেন পারবে না?’
‘কেউ মানিয়ে নিয়ে ভালো থাকে। কেউ মানিয়ে না নিয়ে ভালো থাকে। দিন শেষে ভালো থাকাটাই আসল।’
‘সে কি মানিয়ে না নিয়ে ভালো আছে?’
তোমার কী মনে হয়, কে ভালো আছে?’
প্রশ্নটার উত্তর চট করে দিতে পারল না দিপু। হয়তো ঠিকঠাক বুঝলই না। তবে সামান্য চুপ করে থেকে বলল, ‘তুমি। তুমি ভালো আছো।’
‘তাই মনে হয়?’
‘হুম। এই যে সবসময় হাসি খুশি থাকো। নির্ভার থাকো। মনে হয় অযথা কোন সমস্যা নেই তোমার। উটকো কোনো ঝামেলা নেই। চারপাশের সবাইকে কেমন কেমন করে যেনো আপন করে ফেলো। আর সবাই খুব পছন্দও করে তোমাকে।’
‘সবাই পছন্দ করে?’
‘হুম।’
মুনিয়া ছাতা আর ব্যাগ হাতবদল করতে করতে বলল, ‘তাহলে তো সমস্যা। ‘সমস্যা কেন?’
‘যাকে সবাই পছন্দ করে বলে মনে হয়, তাকে আসলে কেউই পছন্দ করে না। কিংবা বেশিরভাগই পছন্দ করার ভান করে। ভেতরে ভেতরে আসলে অপছন্দ করে।’
‘মানে কী?’
‘মানে, মানুষ সবসময় চায় তাকে সবাই পছন্দ করুক। কিন্তু সে যখন দেখে অন্য একজনকে সবাই পছন্দ করছে, তখন সে আপনা আপনি ঈর্ষাকাতর হতে থাকে। পরশ্রীকাতরতা যাকে বলে। সে তখন অবচেতনেই সে মানুষটাকে অপছন্দ করতে শুরু করে। কিন্তু সেটি সে সহজে প্রকাশ করতে পারে না। কারণ সে ভাবে, অন্য সবাই যেহেতু মানুষটাকে পছন্দ করছে, সেহেতু তাকে অপছন্দ করলে বিষয়টা অন্যরা ঠিকঠাকভাবে নেবে না। আসলে কিন্তু অন্যরা বেশির ভাগই তার মতো করে একই ডিলেমায় ভুগতে থাকে।’
‘এভাবেতো কখনো ভাবিনি!’
মুনিয়া হাসল, ‘দেখবে খুব জনপ্রিয় কারো বিরুদ্ধে হঠাৎ যখন কেউ অভিযোগ করে বসে, তখন আরো অসংখ্য মানুষ নানা অভিযোগ করতে থাকে। অথচ এর আগে তারা কেউ কখনো কিছু বলেনি। কিন্তু একজন যখন বলল, তখন সবাই বলতে শুরু করে।
‘ইন্টারেস্টিং অবজার্ভেশন।’
‘হ্যাঁ। ইন্টারেস্টিং বাট টু।’
মুনিয়ারা বাড়ির কাছে পৌছে গেল। দিপু গেটের তালা খুলে মাথা নিচু করে ভেতরে ঢুকল। তারপর ঢুকল ঋদ্ধি। ঋদ্ধির পরে মুনিয়া। মুনিয়া ভেতরে ঢুকে গেটের পাল্লাটা বন্ধ করতে গিয়ে হঠাৎ থমকে গেল। তার হঠাৎ মনে হলো, পাশের গলির মুখটাতে অন্ধকারে কেউ একজন দাঁড়িয়ে ছিল। মুনিয়ার চোখে চোখ পড়তেই মুহূর্তের মধ্যে মানুষটা অন্ধকারে আড়াল হয়ে গেল।
মানুষটাকে কি আগে কখনো কোথাও দেখেছে মুনিয়া?