1 of 2

অর্ধবৃত্ত – ১৫

১৫

আফসানা তার নামের সাথে হঠাৎ করেই আহমেদ যোগ করতে শুরু করেছে। সে নুরুন্নবী চৌধুরী ডিগ্রি কলেজের বিজ্ঞানের শিক্ষক। তবে সাহিত্য চর্চায়ও তার বিশেষ সুনাম রয়েছে। অনেকগুলো মৌলিক গল্প ও কবিতার বইও প্রকাশিত হয়েছে তার। এতদিন সে আফসানা চৌধুরী নামে লেখালেখি করলেও সম্প্রতি তার নামের সাথে চৌধুরীর পরিবর্তে আহমেদ যুক্ত হয়েছে। তার ধারণা একজন লেখিকার নাম হিসেবে আফসানা চৌধুরীর পরিবর্তে আফসানা আহমেদ অনেক বেশি আকর্ষণীয়। তবে তার নামের শেষে এই আহমেদ যুক্ত করা নিয়ে চারদিকে এক ধরনের ফিসফিসানিও শুরু হয়েছে। অনেকেরই ধারণা ‘নুরুন্নবী চৌধুরী ডিগ্রি কলেজে’র বাংলা শিক্ষক আশফাক আহমেদের সাথে মিলিয়ে সে তার নাম রেখেছে আফসানা আহমেদ। যদিও একথা প্রকাশ্যে বলার সাহস কারোরই নেই। কারণ এই কলেজের প্রতিষ্ঠাতা তার বাবা।

.

আফসানার বাবা নুরুন্নবী চৌধুরী নিজের নামেই এই কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি ধনাঢ্য ব্যক্তি। ঢাকা শহরে তার নানান ব্যবসা বাণিজ্য রয়েছে। সেই সাথে রয়েছে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে যুক্ততাও। আর এ কারণেই নিজের এলাকায় এই কলেজটি স্থাপন করেছেন তিনি। কিন্তু কখনোই কলেজটি সরকারি করার চেষ্টা করেননি নুরুন্নবী চৌধুরী। তার ধারণা, কলেজটি সরকারি হয়ে গেলে কলেজের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ কমে যাবে। সেটি তিনি চাননি। আর চাননি বলেই তিনি তার বড় মেয়ে আফসানাকে কলেজের দায়িত্ব দিয়ে এখানে পাঠিয়েছেন। কাগজে-কলমে আফসানা একজন সাধারণ শিক্ষক হলেও এই কলেজ মূলত চলে তার নির্দেশেই। আফসানার বয়স প্রায় ছত্রিশ-সাইত্রিশ। গত দশ বছর ধরে সে এই কলেজেই শিক্ষকতা করছে। তার বাবা তাকে অধ্যক্ষের দায়িত্ব দিয়েই পাঠাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আফসানার বয়সের কারণে সেটা সম্ভব হয়নি।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার মাঝামাঝি সময়ে আফসানা তার এক সহপাঠিকে বিয়ে করেছিল। কিন্তু সেই বিয়ে বছর তিনেকের বেশি টেকেনি। না টেকার কারণও অবশ্য সে কাউকে বলেনি। তবে মানসিক দিক থেকে ভয়াবহ রকম বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল আফসানা। আর ঠিক সেই সময়ে তার সাথে পরিচয় ঘটে আশফাক আহমেদের।

আশফাক তখন কাজ করতেন একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সাহিত্য পাতায়। মানসিক বিপর্যস্ত অবস্থা কাটাতেই কী না কে জানে, আফসানা নিয়মিত সেই পত্রিকায় লেখা পাঠাত। কিন্তু সেসব লেখা কখনোই ছাপা হয়নি। বাংলা সাহিত্যের ছাত্র আশফাক আহমেদের সম্পাদনার অতি সূক্ষ্ম আতশি কাঁচ পেরিয়ে সেই লেখা কখনোই ছাপার ছাড়পত্র পায়নি।

কিন্তু টানা বছর খানেক প্রায় প্রতি সপ্তাহে যখন বিরামহীন লেখা পাঠিয়ে গেল আফসানা, তখন কৌতূহলী হয়েই আফসানার সাথে যোগাযোগ করেছিলেন আশফাক। সেই যোগাযোগ ক্রমশই বাড়তে থাকল। নিজের জীবনের নানা দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা সে বলতে থাকল আশফাককে। পরস্পরের গল্প আর ভাবনা বিনিময় করতে করতেই নিজের চেয়ে বছর দশেকেরও বেশি বড়, দুই সন্তানের জনক আশফাক আহমেদের সাথে কখন যে তার আড়ালহীন, অকপট এক বন্ধুত্ব হয়ে গেল, আফসানা তা টেরই পায়নি। আশফাক আহমেদ প্রবল আগ্রহ নিয়েই আফসানাকে লেখালেখির কৌশল শেখাতে থাকলেন। তার মন খারাপের, হতাশার, বিষাদের আশ্রয় হতে থাকলেন। আর ক্রমশই শর্তহীন, লক্ষ্যহীন এক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তে থাকলেন তারা। যেই সম্পর্কের কোনো নাম নেই, পরিচয় নেই। কিন্তু সম্পর্কটা আছে।

তবে এই সম্পর্কে আফসানা যে শুধু নিয়েছেই, তা নয়। বরং দিয়েছেও অনেক। আশফাকের হঠাৎ চাকরি চলে গেল। ঘরে তার অসুস্থ স্ত্রী হাফসা, দুই মেয়ে নাদিয়া আর নাবিলা। রীতিমতো অথৈ পাথারে পড়ে গেলেন আশফাক। তাকে এই অবস্থা থেকে উদ্ধার করল আফসানা। তার বাবার এই কলেজটা বানানোর কথা তখন চলছিল। আফসানা আশফাককে সরাসরি প্রস্তাব দিল কলেজে বাংলার শিক্ষক হিসেবে যোগ দেয়ার। আশফাক রাজি হলে সে নিজেও চলে আসবে এখানে। আশফাকের সামনে তখন এর চেয়ে ভালো কোনো সুযোগ আর ছিল না। সে সাথে সাথেই রাজি হয়ে গেল। তা ছাড়া তার সারাজীবনের স্বপ্নও ছিল শিক্ষকতা করা। হঠাৎ সেই সুবর্ণ সুযোগটাই যেন মিলে গেল তার। কিন্তু গত দশটা বছরে আশফাক নতুন করে অনেক কিছুই আবিষ্কার করেছেন। সেখানে সম্পর্কের রসায়ন যেমন আছে। আছে দেয়া-নেয়া, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, স্বার্থ ও সুযোগের নানান হিসেব- নিকেশও।

আশফাক আহমেদ এই মুহূর্তে বসে আছেন আফসানার রুমে। আফসানা তার বিশাল চেয়ারটাতে হেলান দিয়ে আয়েশ করে বসল। তারপর বলল, ‘সমস্যা কী?’

‘তুমি বুঝতে পারছো না সমস্যা কী!’

‘উহু। পারছি না।’

‘তোমাকে কেন তোমার নাম পাল্টাতে হবে?’

‘নামতো আমি পাল্টাইনি।’

‘তাহলে এটা কী করেছো?’

আশফাক আহমেদের হাতে একখানা বইয়ের মলাট। আফসানার নতুন কবিতার বই। সেখানে তার নাম লেখা আফসানা আহমেদ। বইটা এখনো প্রেসে যায়নি। তবে আগেভাগেই বইয়ের মলাট চলে এসেছে। আশফাক কয়েকদিনের জন্য ঢাকায় গিয়েছিলেন। আজ কলেজে ফিরে দেখেন এই কাণ্ড! আফসানা বলল, ‘বাবার পদবি বাদ দিয়ে স্বামীর পদবি যোগ করেছি। আগে সব মেয়েরাই এমন করত। তুমিতো জানোই আমি আবার একটু ওল্ড ফ্যাশানড!’

আশফাক ঝট করে পেছন ফিরে তাকালেন। আশেপাশে কেউ নেই। তারপর প্রায় ফিসফিস করে বললেন, ‘এটা নিয়ে সবাই কথা বলাবলি করছে আফসানা।’

বলুক। তাতে কী?’

‘তাতে কিচ্ছু না?’

‘নাহ।’

‘আফসানা, কী চাও তুমি?’

আফসানা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে চেয়ারে খানিক দোল খেল। তারপর মৃদু হেসে বলল, ‘বাংলা সিনেমার নায়িকাদের মতো করে বলব?’

‘মানে?’

মানে, এভাবে বলব? আমি আমার স্ত্রীর অধিকার চাই। স্ত্রীর অধিকার। তুমি আমার স্ত্রীর অধিকার ফিরিয়ে দাও… ফিরিয়ে দাও।’ সিনেমার সংলাপের মতো টেনে টেনে কথা কটি বলল আফসানা। তারপর উচ্চস্বরে হাসতে থাকল।

আশফাক স্তম্ভিত ভঙ্গিতে আফসানার দিকে তাকিয়ে রইলেন। মাঝে মাঝে আফসানাকে তার মানসিকভাবে অসুস্থ মনে হয়। তিনি অসহায় ভঙ্গিতে বললেন, ‘তুমি যখন যা বলছো, তা-ই কিন্তু করছি আমি। তারপরও কেন এমন করছো?’

‘কেমন করছি আমি?’

‘তুমি বুঝতে পারছো না?’

‘নাহ। বুঝতে পারছি না।’

আশফাক টেবিলের ওপর খানিক ঝুঁকে নিচু গলায় বললেন, ‘এই ঘটনা যদি এখন সবাই জেনে যায়, তাহলে কি হবে তুমি বুঝতে পারছো?’

কী হবে? আমরা বিয়ে করেছি। দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ। এটা কেউ জানলে কী হবে?’

‘উফ!’ প্রচণ্ড রাগে, হতাশায় পাগল পাগল লাগছে আশফাকের। তিনি দুহাতে শক্ত করে তার মাথার দু পাশ চেপে ধরলেন। তারপর বললেন, ‘এটা কিন্তু কথা ছিল না আফসানা। এই বিয়েতে আমি কী শর্তে রাজি হয়েছিলাম তোমার ভুলে

যাওয়ার কথা না।’

আফসানা হাসলেন, ‘কিন্তু তুমি সেই শর্ত রাখছো না।’

‘আমি রাখছি না?’

‘হুম, তুমি রাখছো না।’

‘কীভাবে রাখছি না? নাদিয়ার এখনো বিয়ে হয়েছে? কথা ছিল নাবিলা- নাদিয়ার বিয়ের পর আমরা ঘটনাটা পাবলিশড করব, তাই না?’

‘হ্যাঁ।’

‘তাহলে? নাদিয়ার কি এখনো বিয়ে হয়েছে? তুমি কি বুঝতে পারছো ওর বিয়ের আগেই যদি সবাই জেনে যায় যে আমি এমন একটা কাজ করেছি, তাহলে সেটা ওর জন্য কত বড় একটা ক্ষতি হবে?’

‘জানি।’

‘তাহলে?’

‘তাহলে নাদিয়ার বিয়ে দিচ্ছো না কেন?’

আশফাক হাল ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গিতে বললেন, ‘ও বাচ্চা একটা মেয়ে। কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলো। একটু সময়তো লাগবে।’

আফসানা সাথে সাথেই জবাব দিল না। চুপ করে রইলো। বাইরে শুভ্র মেঘের আকাশ। সূর্যটা খানিক পরপর সেই মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। কেমন একটা আলো-ছায়ার খেলা। সেই আলো ছায়ার খেলা দেখতে দেখতেই আফসানা বলল, ‘আজ পাঁচ বছর! প্রায় অর্ধ যুগ। এই দীর্ঘ সময় আমি অপেক্ষা করেছি না আশফাক? আর কত?

আশফাক কী বলবেন ভেবে পেলেন না। তার খুব অসহায় লাগছে। ক্লান্ত লাগছে। আফসানা বললেন, ‘তুমি কি ইচ্ছে করেই মেয়ের বিয়ে দিচ্ছো না? যাতে আমাদের বিয়ের খবরটা আরো দীর্ঘ সময় আটকে রাখা যায়?’

‘তুমি বুঝতে পারছো না আফসানা…।’ বেপরোয়া ভঙ্গিতে বলার চেষ্টা করলেন আশফাক। কিন্তু তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে আফসানা বলল, ‘তুমি কি আদৌ নাদিয়ার বিয়ে দেয়ার কোনো চেষ্টা করছো?’

আশফাক চুপ করে রইলেন। আফসানা হঠাৎ শব্দ করে হেসে উঠলেন তারপর বললেন, ‘তুমি নিজেকে খুব বুদ্ধিমান ভাবো, তাই না? তুমি আসলে অত বুদ্ধিমান কেউ না আশফাক। বরং বোকা। শোনো, আমি ইচ্ছে করেই নতুন বইটাতে আমার নামের ওই অংশটা বদলে দিয়েছি। এটা তোমার জন্য একটা সতর্কবার্তা। যাতে এবার অন্তত তুমি বিষয়টা সিরিয়াসলি নাও। তুমি ভেবো না, আগের মতোই সামনেও তুমি বছরের পর বছর আমাকে ভুলভাল বুঝিয়ে আটকে রাখতে পারবে। এটা তার সামান্য নমুনা।’

আফসানা সামান্য থামল। আশফাক অবশ্য কোনো কথা বললেন না। তিনি মাথা নিচু করে বসে আছেন। আফসানা বলল, ‘এটুকুতেই চারপাশের মানুষ এত ফিসফাস শুরু করেছে। কারণ তারা আগে থেকেই সন্দেহ করছে যে উই হ্যাভ সামথিং ভেরি স্পেশাল বিটুইন আস। তাই না? এখন তুমি যদি অতি দ্রুত নাদিয়ার বিয়ের ব্যবস্থা না করো, তাহলে এটা আর কতদিন গোপন করে রাখব আমি? অনেক হয়ে গেছে না? আমার একটা বাচ্চা চাই। আই রিয়েলি নিড আ বেবি অ্যান্ড ইটস অলরেডি টু লেট আশফাক। আই এম থার্টি সেভেন নাউ। ইউ হ্যাভ টু আন্ডারস্ট্যান্ড দ্য সিচ্যুয়েশন। আমি ডাক্তারের সাথেও কথা বলেছি।’

আশফাক জানেন, এখানে তার বলার আর কিছু নেই। আফসানা যা বলছে তা হয়তো একদিক থেকে ঠিকই। আশফাকের সাথে তার বিয়ে হয়েছে। বয়সও হয়ে যাচ্ছে। আর কতদিন এই বিয়েটাকে সে লুকিয়ে রাখবে! কিন্তু বিয়েটা আশফাকের ইচ্ছেয় হয়নি, হয়েছে আফসানার ইচ্ছেয় কিংবা জোর জবরদস্তিতে। এটাও সত্য! এই বিয়েটা করতে চাননি তিনি।

.

গভীর রাতে আফসানার বাড়িতে এলেন আশফাক। চমৎকার পুরনো আমলের বাড়ি। একপাশে বিল আর অন্যপাশে ঘন শালবন। এই অঞ্চলে প্রচুর শালবন। সংরক্ষিত বিশাল বনাঞ্চলও রয়েছে। সেই বনাঞ্চলের মাঝখান দিয়ে চলে গেছে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক। বাড়ির মূল গেট থেকে লাল ইটের লম্বা পায়ে হাঁটা পথ। পথের দুই ধারে দেবদারু গাছের দীর্ঘ সারি। কলেজের শিক্ষকদের জন্য আলাদা কোয়ার্টার থাকলেও সেখানে থাকেনা আফসানা। সে থাকে কলেজ থেকে খানিক দূরে তাদের পুরনো আমলের এই বাড়িটাতে। এখানে কাজের মানুষ ছাড়া তার সাথে আর বিশেষ কেউ থাকে না। মাঝেমধ্যে তার বাবা ঢাকা থেকে এলে কয়েকদিনের জন্য একটা হৈ-হল্লা লাগে বটে। কিন্তু তারপরই আবার সুনসান। ফলে বাকি সময়টাতে যখন তখন চলে আসতে পারেন আশফাক।

.

আজ অবশ্য বাড়ির পরিবেশ আরো গম্ভীর। সুনসান, থমথমে। খুব মন খারাপ হলে প্রায়ই ইলিক্ট্রিকের লাইট বন্ধ করে বড় বড় দুখানা মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখে আফসানা। আজও তাই। আশফাক নিঃশব্দে ঘরে ঢুকলেন। আফসানা জানালার কাছে চেয়ারে বসে আছে। তার পরনে ধবধবে সাদা গাউন। এই মোমের অদ্ভুত নরম আলোয় তাকে কেমন অশরীরী লাগছে। আশফাকের পায়ের শব্দ শুনেও সে ফিরে তাকাল না। আশফাক নিজেই তার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালেন। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন দীর্ঘ সময়। তারপর আলতো করে কাঁধ ছুঁয়ে দিলেন আফসানার। আফসানা পাথরের মূর্তির মতো শীতল, স্থির।

আশফাক বললেন, ‘দুপুরের ঘটনার জন্য আমি সরি।’

আফসানা জবাব দিল না। আশফাক বললেন, ‘তুমি নিশ্চয়ই আমার মানসিক অবস্থাটা বুঝতে পারছো।’

আফসানা এবারও জবাব দিল না। আশফাক বললেন, ‘আমি কী করব তুমিই বলো আফসানা। আমার খুব অসহায় আর এলোমেলো লাগছে। মনে হচ্ছে, আই কান্ট ব্রেথ প্রোপারলি।’

আশফাক ভেবেছিলেন আফসানা কিছুটা নরম হবে। কিছুটা আর্দ্র ভঙ্গিতে কথা বলবে। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। সে বরং দৃঢ় ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল। তারপর হাত উঁচু করে ইলেক্ট্রিকের বাতিটা জ্বালিয়ে মোমবাতি দুটো নিভিয়ে দিল। তারপর স্পষ্ট কণ্ঠে বলল, ‘তুমি কবিতার বইয়ের পাণ্ডুলিপিটা রেডি করেছো?

আশফাক অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বললেন, ‘প্রায় রেডি।’

‘প্রায় রেডি হলেতো হবে না। একটু দ্রুত করো। দেখলেতো সবকিছু রেডি। বইয়ের কভার পর্যন্ত ছাপা হয়ে গেছে।’

আশফাক সামান্য নীরব থেকে বললেন, ‘চার ফর্মার বইয়ের জন্য যতগুলো কবিতা দরকার ততগুলো এখনো লেখা হয়নি।’

‘লেখা না হলে তাড়াতাড়ি লিখে ফেলো। সময়তো বেশি নেই।’

‘আমি কবিতা লিখতে পারছি না আফসানা।’

‘না লিখতে পারলে বই বেরুবে কীভাবে? সবাই জানে এ মাসেই বইটা বেরুচ্ছে।’

আশফাক কথা বললেন না। আফসানা বলল, ‘লিখতে পারছো না কেন?’

‘কেন লিখতে পারছি না, তাতো জানি না।’

‘আমি জানি।’

‘তুমি কীভাবে জানো?’

‘আমি অনেক কিছু বুঝতে পারি আশফাক। অনুভব করতে পারি। তোমার চেয়েও বেশি। কিন্তু সমস্যা হলো আমি লিখতে পারি না। যেটা অনুভব করি, সেটা লিখতে গেলেই সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। জুতসই কোনো শব্দ, বাক্য খুঁজে পাই না। যেটা বলতে চাই সেটা বোঝাতে পারি না। প্রকাশ করতে পারি না।’

আফসানা থামলেও আশফাক কথা বললেন না। আফসানাই আবার বলল, ‘তুমি লিখতে পারছো না কারণ তোমার সাবকনসাস মাইন্ড তোমাকে লিখতে দিচ্ছে না। দিনের পর দিন তুমি লিখছো, আর তোমার সেই লেখা ছাপা হচ্ছে আমার নামে। তোমার অবচেতন মন এটা মেনে নিতে পারছে না। তার কষ্ট হচ্ছে। সে চায়, সৃষ্টিগুলো তার আসল স্রষ্টার নামে হোক। যার লেখা, পাঠক তাকেই প্রশংসা করুক। ভালোবাসুক। অন্য কাউকে না। আমি কি সত্যি বলেছি?’

আশফাক এবারও কথা বললেন না। চুপ করে রইলেন। একটা মৃদু ফুরফুরে হাওয়া ভেসে আসছে জানালা দিয়ে। সেই হাওয়ায় আশফাকের বুকের ভেতর কোথায় যেন তিরতির করে একটা কম্পন তৈরি হচ্ছে। আফসানা বলল, ‘এই ইউনিভার্সটাই একটা জটিল ধাঁধা আশফাক। এর সৃষ্টি, স্রষ্টা বিশাল এক রহস্য। সব কি আমরা জানি? জানি না। তাহলে পাঠকের কী দরকার এই লেখার স্রষ্টা কে সেটা জানার? সে জানবে সৃষ্টি। স্রষ্টাকে ছাড়িয়ে সৃষ্টি বড় হলেইতো স্রষ্টার সবচেয়ে বেশি আনন্দ। তাই না?’

আফসানা মাঝেমধ্যে এমন অদ্ভুত সব কথা বলে যে আশফাকের অবাক লাগে। অচেনা লাগে। মনে হয়, এই আফসানাকে সে চেনে না। কখনো দেখেওনি। এই মুহূর্তে আফসানাকে তার তেমন মনে হচ্ছে।

আফসানা আশফাকের গা ঘেঁষে এসে দাঁড়াল। তারপর খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, ‘তুমি আবার ভেবো না যে দুপুরে আমি যে কথাগুলো বলেছি, তা এমনি এমনি বলেছি। আমি এবার খুব সিরিয়াস আশফাক। আমি মা হতে চাই। আর এ জন্য আমাকে আমাদের বিয়ের কথাটা সবাইকে জানতে হবে। তুমি যত দ্রুত সম্ভব নাদিয়ার বিয়ের ব্যবস্থা করো। খুব দ্রুত। তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো, আমার হাতেও খুব একটা সময় নেই। প্রথমবার কনসিভ করার জন্য অলরেডি আমার যথেষ্ট বয়স হয়ে গেছে আশফাক।’

আশফাক চুপ করে রইলো। বাইরে তখন তীব্র শব্দে ঝিঁঝি পোকা ডাকতে শুরু করেছে। কিন্তু আশফাকের মনে হচ্ছে ঝিঁঝি পোকাগুলো বাইরে নয়, ডেকে যাচ্ছে তার মাথার ভেতর। একটানা, অবিরাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *