১৪
শুক্রবার সকালে দেরি করে ঘুম ভাঙল মুনিয়ার। শেষ রাতের দিকে ভালো ঘুম হয়েছে তার। দীর্ঘ আড়মোড়া ভেঙে চোখ মেলে তাকাল সে। জাফর ঘরে নেই। হয়তো বাইরে কোথাও গিয়েছে। হাত-মুখ ধুয়ে এসে ধীরে সুস্থে সকালের খাবার খেল মুনিয়া। তারপর ফোনটা খুলল। অনেকগুলো মেসেজ এসেছে ফোনে। অবশ্য বেশির ভাগই বিভিন্ন কোম্পানির প্রোমোশনাল মেসেজ। আকাশটা খানিক মেঘলা আজ। আবহাওয়াও ঠাণ্ডা। একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বারান্দায় এলো সে। বাইরে শান্ত, স্নিগ্ধ এক আবহ। ছুটির দিন বলেই হয়তো রাস্তায় একদম লোক নেই। মুনিয়া রেলিংয়ের কাছে এসে দাঁড়াল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে একটা লোক যেন চট করে দেয়ালের আড়ালে সরে গেল। ঠিক রাস্তার ওপাশে ফুটপাতে দাঁড়িয়েছিল লোকটা। পাশেই ভাঙা দেয়াল। মুনিয়ার চোখ কিংবা মনের ভুলও হতে পারে। কিন্তু তার কেন যেন মনে হলো, তাকে দেখেই লোকটা আড়ালে সরে গেল। আবার নাও হতে পারে। হয়তো এমনি এমনিই সে সরে গেছে। তারপরও মনের ভেতর কেমন একটা খচখচ করতে লাগল তার। দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এলোমেলো নানা ভাবনা ভাবল সে। তারপর চেষ্টা করল বিষয়টা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলার। আজকাল শুধু শুধু উটকো চিন্তা মাথায় নিচ্ছে সে। এটাও বয়স বাড়ার লক্ষণ।
আয়েশ করে চেয়ারে বসল মুনিয়া। এমনিতে সংবাদপত্র পড়ে না সে। কিন্তু আজ কী মনে করে খবরের কাগজটা হাতে নিয়ে বসল। অনেকদিন পর আলস্যে ভরপুর এক সকাল। প্রায় প্রতিদিনই খবরের কাগজে রফিকুল আলমের ঘটনার ফলোআপ সংবাদ আসছে। কিন্তু এখনো তদন্তে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি।
ফোনটা আবার হাতে নিল মুনিয়া। হাবিজাবি সব মেসেজের মধ্যে জাফরের একটা মেসেজও দেখা যাচ্ছে। সে লিখেছে, ‘রাতে তোমাকে জানাতে ভুলে গেছি। সকালে আমার চট্টগ্রামের ফ্লাইট ছিল। অফিসের জরুরি কাজ। কালই ফিরব।’
মুনিয়া ধোঁয়া ওঠা চায়ের উষ্ণ কাপে আলতো করে ঠোঁট ছোয়ালো। তারপর ফোনে দুটো অক্ষর লিখে পাঠিয়ে দিল জাফরকে, ‘ওকে।’
তারপর ফোন করল রাফিকে, ‘আজ ফ্রি আছো?’
রাফি ঘুম জড়ানো গলায় বলল, ‘কখন?’
‘বিকেলে।’
‘কেন?’
‘জাফর ঢাকার বাইরে।’
রাফি বলল, ‘আচ্ছা।’
.
মুনিয়ার অবশ্য বের হওয়া হলো না। বিকেলের দিকে হাফসা খুব অসুস্থ হয়ে পড়ল। আশফাককে অনেকবার ফোন করা হলেও তাকে পাওয়া গেল না। নাদিয়া এসে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘মা কেমন করছে চাচি। বাবাও ফোন ধরছে না।’
মুনিয়া তখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সাজছিল। যত্ন করে কাজল পরছিল চোখে। সে নাদিয়ার দিকে না তাকিয়েই বলল, ‘কী হয়েছে?’
‘মা শ্বাস নিতে পারছে না। বুকের ভেতর কেমন ঘড়ঘড় শব্দ হচ্ছে।’
‘ইনজেকশন দিয়েছো?’
‘হ্যাঁ, কিন্তু কাজ হচ্ছে না।’
মুনিয়া তখনো গুরুতর কিছু ভাবেনি। হাফসার মাঝেমধ্যেই এমন একটু আধটু হয়। সে ধীরে সুস্থে চোখে কাজল পরা শেষ করল। তারপর ওপর তলায় গেল। কিন্তু হাফসার অবস্থা দেখে ঘাবড়ে গেল মুনিয়া। হাফসাকে দেখে মনে হচ্ছে যেকোনো মুহূর্তে বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। হাপড়ের মতো ওঠানামা করছে হাফসার বুক। চোখজোড়া যেন উল্টে বেরিয়ে আসতে চাইছে। মুনিয়া বার দুয়েক হাফসার সাথে কথা বলার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। তাকে হাসপাতালে নেয়া হলো তার কিছুক্ষণ পরই। ডাক্তার অবশ্য চিন্তিত হবার মতো কিছু বললেন না। তবে দুটো দিন হাসপাতালেই রাখতে চাইলেন। মায়ের সাথে হাসপাতালে রয়ে গেল নাদিয়াও। সবকিছু গোছগাছ করে মুনিয়া বাড়ি ফিরল রাত দশটায়। তার ঘরের আলো নেভানো। দরজা বন্ধ। কিন্তু ভেজানো দরজা খুলে ঘরে ঢুকতেই অন্ধকার ঘরে কারো উপস্থিতি টের পেল মুনিয়া। বাইরের আবছা আলোয় বিছানায় উবু হয়ে শুয়ে থাকা অবয়বটা ঋদ্ধির তা বোঝা যাচ্ছে। এসময় এভাবে তার ঘরে কেন ঋদ্ধি?
মুনিয়া বাতি জ্বালাল। ঋদ্ধি অবশ্য নড়ল না। যেভাবে শুয়ে ছিল, সেভাবেই শুয়ে রইলো। মুনিয়া বিছানায় এসে বসল। তারপর আলতো হাতে ঋদ্ধির মাথায় হাত বোলোতে বোলাতে বলল, ‘কী হয়েছে মা?’
ঋদ্ধি কথা বলল না। পড়ে রইলো অনড়, অসাড়। মুনিয়া ঋদ্ধির এলোমেলো চুলগুলো গালের কাছ থেকে সরিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘শরীর খারাপ করেছে?’
ঋদ্ধি এবার ডানে বাঁয়ে মাথা নাড়লো, তার শরীর খারাপ করেনি।
‘তাহলে?’
ঋদ্ধি কথা বলল না। মুনিয়া ঋদ্ধির পাশে কাত হয়ে শুয়ে পড়ল। তারপর এক হাত বাড়িয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘মন খারাপ?’
‘হুম।’ মৃদু মাথা নাড়ল ঋদ্ধি।
‘কী হয়েছে? মন খারাপ কেন?’
‘তোমার জন্য।’ ঋদ্ধির গলা ভাড়ী।
আমার জন্য? আমার জন্য মন খারাপ কেন মা?’
ঋদ্ধি আবার চুপ করে রইলো। মুনিয়া খানিকটা জোর করেই ঋদ্ধিকে তার দিকে ফেরাল। হঠাৎ চোখে আলো লাগায় ঋদ্ধি বার কয়েক কপাল কোঁচকাল তবে চোখ খুলল না। তার চোখের কোলে শুকিয়ে যাওয়া জলের দাগ। মুনিয়া আঁতকে ওঠা গলায় বলল, ‘কী হয়েছে মা?’
ঋদ্ধি সাড়া দিল না। মুনিয়া এবার ঋদ্ধির গালে হাত রেখে ঝাঁকালো, ‘এই ঋদ্ধি। ঋদ্ধি? কী হয়েছে বলতো!’
ঋদ্ধি চোখ মেলে মায়ের দিকে তাকাল। তারপর হাসতে চেষ্টা করল, ‘কিছু না মা।’
‘কিছু না মানে কী! বল।’
সামান্য চুপ করে থেকে ঋদ্ধি বলল, ‘তুমি কেমন অন্যরকম হয়ে গেছো মা। ‘অন্যরকম মানে কী?’
‘আমাকে আর আগের মতো ভালোবাসো না।’
‘তোকে আর আগের মতো ভালোবাসি না?’
‘উহু।’
‘তাহলে কাকে ভালোবাসি?’
‘তাতো জানি না! তবে আমাকে বাসো না।’
‘কী করে বুঝলি?’
‘বোঝা যায়।’ ঋদ্ধি সামান্য থামল। তারপর মায়ের চোখে চোখ রেখে দৃঢ় কণ্ঠে বলল, ‘ভালোবাসলে যতটা বোঝা না যায়। ভালো না বাসলে তারচেয়েও বেশি বোঝা যায় মা।’
ঋদ্ধির কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেল মুনিয়া। এভাবে কথা বলা কোথায় শিখেছে ঋদ্ধি? সে কথা বলছে পরিণত বয়সী মানুষের মতো। কতদিন তাকে ঠিকঠাক খেয়াল করে না মুনিয়া? মাত্র কদিনেই কী অনেকখানি বদলে গেছে সে! ঋদ্ধিকে অবশ্য তার এসব ভাবনা বুঝতে দিলনা মুনিয়া। বরং সে আদুরে গলায় বলল, ‘ওরে আমার পাকনা বুড়ি, আর কী কী বোঝা যায় শুনি?’
মুনিয়া দু হাতে ঋদ্ধির মুখটা তার বুকের কাছে টেনে নিল। তারপর বলল, ‘এইসব কথা কোথায় শিখেছিস হ্যাঁ? বাসায় কী আজকাল খুব হিন্দি সিরিয়াল দেখিস? না বন্ধুদের কাছে শিখেছিস?’
ঋদ্ধি হাসল, ‘কোথাও শিখিনি মা। আই ক্যান ফিল, না?’ সে গম্ভীর, স্থির। ‘আচ্ছা, কী কী করলে মনে হয় মা তোকে ভালোবাসে না?’
‘তাতো জানি না। কিন্তু বুঝতে পারি।’
‘উহু। তুই কিছুই বুঝছে পারিস না। মা তোকে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। সবচেয়ে বেশি।’
ঋদ্ধিকে শক্ত করে বুকের সাথে চেপে ধরে তার কপালে চুমু খেল মুনিয়া। তারপর চুলে বিলি কেটে দিতে লাগল। ঋদ্ধি বলল, ‘মা।’
‘হুম।
‘তুমি আর আগের মতো আমার সাথে কথা বলো না কেন? সময় দাও না কেন?’
মুনিয়া খানিক চুপ করে থেকে বলল, ‘কে বলেছে সময় দিই না?’
‘দাও?’
উত্তরটা দিতে গিয়েও থমকালো মুনিয়া। একটু সময় নিল যেন। তারপর বলল, ‘তুইতো জানিসই কীসব ঝামেলা যাচ্ছে আমার ওপর দিয়ে। স্কুলে অতবড় একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল। নানা প্রেসার। একটু বুঝতে হবে না মা?’
‘আমিতো বুঝি মা। এজন্যইতো তোমাকে কখনো জ্বালাই না। কিন্তু আজ কেন যেন খুব মন খারাপ হয়ে গেল। মনে হলো, কতকাল তুমি আমার সাথে আর মায়ের মতো কথা বলো না। অন্য মানুষের মতো কথা বলো।’
ঋদ্ধির এই কথাটুকুতে কী ছিল কে জানে! মুনিয়া আবারো ঋদ্ধির মাথাটা তার বুকের সাথে চেপে ধরল। ঋদ্ধি কাঁপা গলায় বলল, ‘আজতো বাবা নেই। আমি আজ রাতে তোমার সাথে ঘুমাই মা?’
মুনিয়া কী বলবে ভেবে পেল না। আজ বিকেলে রাফির সাথে তার বের হবার কথা ছিল, কিন্তু পারল না। অথচ রাফি তার আর সব কাজ ফেলে মুনিয়ার অপেক্ষায় বসেছিল। মুনিয়ার সাথে তার জরুরি কিছু কথা আছে। যে কথাগুলো সে ফোনে বলতে চায় না। আবার অনেকদিন মুখোমুখি কথার সুযোগও হচ্ছে না তাদের।
মুনিয়া অবশ্য হাফসার অবস্থা দেখে রাফিকে আর কিছু জানাতেও পারেনি। রাফি অপেক্ষা করতে করতে অধৈর্য হয়ে বারবার ফোন করেছে। কিন্তু ওই পরিস্থিতিতে সবার সামনে তার ফোনও ধরতে পারেনি মুনিয়া। বিরক্ত রাফি মেসেজের পর মেসেজও করেছে। মুনিয়া ভেবেছিল বাসায় ফিরে একবারে ফোন করবে। কত কাল সারারাত জেগে কথা হয়না রাফির সাথে। জাফর না থাকায় আজ সেই সুযোগটা হয়েছে। ফলে ছোট্ট করে মেসেজ লিখে রাফিকে তা জানিয়েও দিয়েছিল মুনিয়া। সে লিখেছিল, ‘ইন অ্যান ইমারজেন্সি সিচ্যুয়েশন। উইল টক টু ইউ এট নাইট ইন ডিটেলস।’
বহুদিন পরে রাতভর নিশ্চিন্তে কথা বলতে পারবে ভেবে ভেতরে ভেতরে এক ধরনের উত্তেজনাও অনুভব করছিল মুনিয়া। কিন্তু এখন? এখন কী করবে সে?
মুনিয়া যেন জোর করেই সামান্য হাসল। তারপর বলল, ‘অবশ্যই ঘুমাবি। কিন্তু রাতে যদি আমাকে বারবার হাসপাতাল থেকে ফোন করে, তখন বিরক্ত লাগবে না তোর?’
তুমি আজ রাতে আর কারো ফোন ধরবে না। তাহলেইতো হলো মা। ‘কিন্তু তোর বড় চাচি যে হাসপাতালে। সেখানে তোর নাদিয়া আপু একা। যখন তখন আমাকে দরকার হতে পারে না?’
ঋদ্ধি অবশ্য মায়ের কথা শুনল না। মুনিয়ারও আর জোর করতে ইচ্ছে করছে না। ঋদ্ধি এমন করে আগে কখনো বলেনি। বরং সে একা একা থাকতেই বেশি পছন্দ করে। মেয়েটার জন্য ভেতরে ভেতরে কেমন একটা অস্থিরতাও অনুভব করছে মুনিয়া। কিন্তু রাফিকে কী করে বোঝাবে সে? এখন ফোন করলেও রাফি বুঝতে চাইবে না। বরং চিৎকার-চেঁচামেচি করবে। একগুঁয়েমি দেখাবে। তারচেয়ে ভালো তাকে মেসেজ করে পরিস্থিতি জানিয়ে দেয়া। মুনিয়া দিলও। আজ রাতেও আর কথা বলা যাবে না। কাল ভোরে সে চেষ্টা করবে ফোন করতে। কিন্তু সে যা ভেবেছিল, তাই ঘটল। মেসেজ পাওয়ার সাথে সাথেই একনাগাড়ে ফোন করতে থাকল রাফি। মুনিয়া যতবার ফোন কেটে দিচ্ছে, ঠিক ততবারই আবার ফোন করছে রাফি। বিরক্ত মুনিয়া শেষ অবধি ফোন অফ করে রাখল।
বিষয়টা অবশ্য চোখ এড়ায়নি ঋদ্ধির। সে বলল, ‘এতোবার কে ফোন করছিল মা? হাসপাতাল থেকে?’
‘উহু।’
‘হাসপাতাল থেকে হলে ধরো। আমার সমস্যা হবে না।’
‘নাহ, হাসপাতাল থেকে না। অপরিচিত উটকো নাম্বার। সমস্যা নেই, আমি ফোন অফ করে রেখেছি।’
ঋদ্ধি চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, ‘অফ করলে কেন? যদি হাসপাতাল থেকে নাদিয়াপু ফোন করে?
মুনিয়া সামান্য থমকে গিয়ে বলল, ‘সমস্যা নেই। দিপু বা সেলিনার ফোনে ফোন করলেই হবে।
ঋদ্ধি কিছুই বুঝল না। কিছুক্ষণ আগেই না মা নাদিয়াপুর ফোন নিয়ে এত দুশ্চিন্তা করছিল! অথচ এখন কীনা নিজ থেকেই বলছে অন্যদের ফোনে ফোন করবে। মাকে খুব চিন্তিতও দেখাচ্ছে। এই ব্যাপারগুলোই বেশ কিছুদিন থেকে খেয়াল করছে ঋদ্ধি। মা যেন কেমন অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে। এই যে অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে, তা হয়তো মা নিজেও বুঝতে পারছে না। কিন্তু ঋদ্ধির ধারণা সে ঠিক ঠিক বুঝতে পারছে।
.
সেই রাতটা বুকের ভেতর অদ্ভুত এক শান্তি এবং তীব্র এক অস্থিরতা নিয়ে কাটল মুনিয়ার। ঋদ্ধিকে বুকের ভেতর জড়িয়ে রেখে কতকাল পর যে তার মনে হলো, সেই এতটুকু ইঁদুর ছানার মতো বাচ্চাটা তার চোখের সামনেই যে এত বড় হয়ে গেল, তা সে টেরই পায়নি! ঋদ্ধিকে এভাবে জড়িয়ে রাখতে কী যে ভালো লাগছে মুনিয়ার। মনে হচ্ছে, সারাক্ষণ বুকের ভেতর যে অথৈ শূন্যতা সে বয়ে বেড়ায়, সেই শূন্যতার সবটুকু যেন কানায় কানায় পরিপূর্ণ লাগছে আজ। কিন্তু রাফির বিষয়টাও মাথা থেকে তাড়াতে পারছে না মুনিয়া। নিশ্চয়ই সারাটা রাত একা একা জেগে থাকবে ছেলেটা। ছটফট করতে থাকবে। কে জানে, এত রাতে চলেও আসতে পারে সে। আপাদমস্তক পাগল এক ছেলে রাফি। কিন্তু আজ এই এত রাতে রাফিকে নিয়ে ভীষণ ভয়ও কাজ করছে তার। এখন যদি সে চলে আসে তবে ভয়াবহ বিপদ ঘটে যাবে। আপাতত বেশ কিছুদিন রাফিকে বাড়ির আশপাশে আসতে না করে দিয়েছে মুনিয়া। কারণ সে জানে, তার ঠিক নিচতলার বারান্দা কিংবা জানালার ফাঁকফোকড় দিয়ে একজোড়া চোখ নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে রাস্তায়। সেই চোখ জোড়া সেলিনার। কিংবা তার শাশুড়ি মছিদা বেগমের। এই এতরাতে রাফি চলে এলে যে ভয়ানক বিপদ
রাফি অবশ্য সেই রাতে এলো না। সে এলো পরদিন সকালে। শনিবারও সরকারি কী এক ছুটির কারণে স্কুল বন্ধ। ফলে ভোরে ঘুম থেকে ওঠার তাড়া ছিল না মুনিয়ার। শেষ রাতের দিকে ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছিল তার। সে ঘুম থেকে উঠল বেলা করে। ঋদ্ধি ততক্ষণে তার ঘরে গিয়ে পড়তে বসেছে। মুনিয়া হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিচে নাশতার টেবিলে গিয়ে বসল। সেখানে দিপু নাশতা করছে। তবে দিপুকে দেখার মতো অবস্থা আর রইলো না মুনিয়ার। সে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। দিপুর পাশের চেয়ারটাতে বজ্রাহতের মতো তাকিয়ে রইলো মুনিয়া। সেখানে নির্বিকার ভঙ্গিতে নাশতা করছে রাফি। মুনিয়াকে দেখে সে উঠে দাঁড়াল। তারপর বিনীত ভঙ্গিতে বলল, ‘স্লামালিকুম ভাবি, কেমন আছেন?’
মুনিয়া কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। এখানে এই অবস্থায় রাফিকে দেখবে, এটা সে ভাবেনি। খারাপ কোনো কিছু ঘটেনিতো! না হলে অন্তত এই পরিস্থিতিতে এতটা বেপরোয়া হওয়ার কথা না রাফির। মুনিয়া জানে রাফি আর দিপু বিশ্ববিদ্যালয়ে একই ব্যাচের ছাত্র। কিন্তু বিভাগ আলাদা হওয়ায় খুব একটা যোগাযোগ নেই তাদের। ঋদ্ধি আর রথির বন্ধুত্বের সূত্রেই মূলত যতটুকু জানাশোনা, ঘনিষ্ঠতা দুজনের। কিন্তু এর আগে কখনো এ বাড়িতে আসেনি রাফি। গতকাল সন্ধ্যা থেকে সেই অর্থে যোগাযোগ হয়নি রাফির সাথে তার। কিন্তু তাই বলে এভাবে বাড়ি চলে আসবে সে? অজানা আশঙ্কায় বুক কাঁপতে লাগল মুনিয়ার। সে যতটা সম্ভব নিজেকে সামলে নিয়ে সালামের জবাব দিল। তারপর অপ্রস্তুত হাসি হেসে বলল, ‘তুমি কেমন আছো?’
‘জি ভালো।’
চেয়ারে বসতে বসতে মুনিয়া বলল, ‘এত সকালে, কী খবর?’
‘দিপুর কাছে হঠাৎ জরুরি একটা দরকার পড়ে গিয়েছিল ভাবি।’
‘আচ্ছা। রথির কী খবর? ওর পড়াশোনা কেমন চলছে?’ যতটা সম্ভব স্বাভাবিক
থাকার চেষ্টা করছে মুনিয়া।
রাফি মৃদু হাসল, ‘ওর পড়াশোনার খবরতো ভাবি আপনার কাছে।’
মুনিয়াও হাসার চেষ্টা করল, ‘আসল পড়াশোনাটা কিন্তু স্কুলে নয় রাফি, ওটা বাড়িতেই। বাড়িতে পড়াশোনাটা ঠিকঠাক না হলে সমস্যা।’
‘জি ভাবি।’
‘তুমি আজ সব কথায় এত ভাবি ভাবি করছো কেন?’
রাফি যেন একটু সপ্রতিভ হলো, ‘ম্যাডাম বলব তাহলে? রথিও অবশ্য আপনাকে তা-ই বলে।’
মুনিয়া আর এ কথার জবাব দিল না। তার প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে। এ কেমন কান্ডজ্ঞানহীনের মতো কাজ করল রাফি! এই পরিস্থিতিতে কেউ সরাসরি বাড়ি চলে আসে? এত করে সবকিছু বুঝিয়ে বলার পরও? কোনো সমস্যা নয়তো?
মুনিয়া খাওয়া শেষ করে দোতলায় উঠে গেল। তার খুবই বিরক্ত লাগছে। একবার ভাবল ঘরে এসে রাফিকে ফোন করে। কিন্তু পরক্ষণেই সেই চিন্তা বাদ দিল সে। রাফির আশপাশে নিশ্চয়ই দিপুও আছে। সে থম মেরে বসে রইলো অনেকক্ষণ। আর সেই মুহূর্তে ঘরে ঢুকল ঋদ্ধি। ঋদ্ধিকে দেখে আরেক দফা চমকে গেল মুনিয়া। নিজে নিজে চোখে কাজল পরার চেষ্টা করেছে ঋদ্ধি। কিন্তু আগে কখনো একা একা পরেনি বলে অনভ্যস্ত হাতের কাজটা ঠিকঠাক হয়নি। চোখ ছাড়িয়ে নেমে যাওয়া কাজলটুকু কিছু দিয়ে মুছে ঠিক করতে গিয়ে আরো লেপ্টে ফেলেছে সে। মুখে কি সামান্য প্রসাধনীও মেখেছে?
ঋদ্ধির চোখ মুখ ঝলমল করছে চাপা আনন্দে। তার হাতে একখানা নোটবুক আর কলম। সে সেই নোটবুক খানা টেবিলের ওপর রাখতে রাখতে উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, ‘মা, শুনেছো? রাফি ভাইয়া আমাদের বাসায় এসেছে?’
মুনিয়া নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে মেয়ের দিকে তাকাল, ‘হ্যাঁ, শুনেছি।’
‘এই প্রথম আমাদের বাসায় এলো, না?’
‘কী জানি!’
‘দেখা করবে না তুমি?’
‘দেখা করার কী আছে? ও তো প্রায়ই রথিকে নিতে স্কুলে আসে।’
‘কিন্তু বাসায়তো আর আসে না। চলো না মা।’
‘উহু।’
‘কেন?’
‘আমার মাথাটা খুব ধরেছে।’
‘ওহ!’ এতক্ষণে যেন মায়ের প্রতি খেয়াল হলো ঋদ্ধির। সে মুনিয়ার পাশে এসে বসল। তারপর কপালে হাত রেখে বলল, ‘তোমার গা-টাও কিন্তু একটু গরম মা। জ্বর আসবেনাতো?’
মুনিয়া এই প্রশ্নের উত্তর দিল না। সে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘তুই এমন সেজেগুজে কই যাচ্ছিস?’
ঋদ্ধি ভারি লজ্জা পেল। সে কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বলল, ‘নিচে।‘
‘কেন?’
‘রাফি ভাইয়া এলো যে!’
‘তাতে কী?’
ঋদ্ধি খানিক চুপ করে থেকে বলল, ‘একটা কবিতা লিখে দিতে বলব।’
‘একবার না দিল?’
‘হুম।’
‘তাহলে আবার কী?’
ঋদ্ধি এবার আর সাথে সাথে জবাব দিল না। চুপ করে রইলো দীর্ঘ সময়। তারপর আচমকাই বলল, ‘স্কুল ফাংশানে সেবার তোমাকে যেমন কবিতা লিখে দিয়েছিল, আমাকে অমন একটা কবিতা লিখে দিতে বলবে?’
মুনিয়া জবাব দিল না। ঋদ্ধি করুণ গলায় বলল, ‘প্লিজ মা, প্লিজ।’
মুনিয়া কী বলবে ভেবে পেল না। সে জানালা দিয়ে তাকিয়ে রইলো বাইরে। বাইরে ঝলমলে রোদ উঠেছে। সেই রোদে তার চোখ জ্বালা করছে।