১০
শফিকের ধারণা ছিল নাদিয়া আর কখনো নিজ থেকে তার সাথে যোগাযোগ করবে না। নাদিয়ার সাথে যে তার আগেও কখনো খুব একটা যোগাযোগ ছিল, তাও নয়। বরং কালেভদ্রে পারিবারিক কোনো প্রোগ্রামে হয়তো মুহূর্তের জন্য তাদের দেখা হয়েছে। সেই দেখা হওয়ার আঁচটুকু কেবলই শফিকের একার। শফিক তা জানে। নাদিয়া হয়তো কখনো তাকে সেভাবে খেয়ালই করেনি। দেখলে চট করে শফিকের মুখটা যে সে চিনতে পারতো, ওটুকুতেই খুশি ছিল শফিক। কারণ সে জানে, তার চেহারা এমন আহামরি কিছু নয় যে আলাদা করে কেউ তাকে মনে রাখবে। কিংবা তার এমন কোনো গুণও নেই, যার জন্য তার সেই সাদামাটা চেহারাটা উপেক্ষা করেও তার সেই বিশেষ গুণের কারণে লোকে তাকে মনে রাখবে। তবে যতটুকু দেখাই হতো, শফিকের মনে হতো চারপাশের পৃথিবীটা হঠাৎ থমকে গেছে। সেই থমকে যাওয়া পৃথিবী থেকে তারপরের বেশ কিছুদিন সে আর বেরোতে পারত না। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত কী এক অবর্ণীয় অনুভব বয়ে বেড়াতো সে। নাদিয়া তার কিছুই জানত না। এখনো জানেনা। আর কখনো জানবেও না।
এবারই প্রথম নাদিয়ার সাথে দীর্ঘসময় কাটিয়েছে সে। কিন্তু তাতে তার জড়তা কিছুমাত্র কমেনি। বরং বেড়েছে। বাইরের পৃথিবীতে তাও সে যতটুকু সপ্রতিভ, কিন্তু নাদিয়ার সামনে সেই একইরকম এলোমেলো, অন্তর্মুখী, ভীত। শফিক ভেবেছিল অন্তত ঢাকায় পৌঁছে হলেও নাদিয়া তাকে একটা ফোন করবে। কিন্তু তার ধারণা ঠিক হয়নি। নাদিয়া তাকে ফোন করেনি। সেও করেনি। আচ্ছা, তার কি নাদিয়াকে ফোন করা উচিত ছিল? বহু চেষ্টা করেও এই প্রশ্নের উত্তর সে খুঁজে পায়নি। ফলে নাদিয়াকেও আর ফোন করা হয়ে ওঠেনি তার। শফিক যখন মোটামুটি ধরেই নিয়েছিল যে নাদিয়া তাকে আর কখনো ফোন করবে না। হয়তো তার কথা মনেই নেই নাদিয়ার। ঠিক এমনই এক দিনে তাকে ফোন করল নাদিয়া।
শফিক ফ্যাসফেঁসে গলায় বলল, ‘হ্যালো।’ তার গলা কাঁপছে।
নাদিয়া বলল, ‘আমি আপনার নাদিয়া আপা বলছি।’
‘জি আপা।’ বলেই শফিক বুঝতে পারল, সে বড়োসড়ো ভুল করে ফেলেছে। কিন্তু ভুল শোধরানোর জন্য কী করা উচিত, তা সে বুঝতে পারছে না। নাদিয়া বলল, ‘এইবার ঠিক আছে। আগেরবারতো আমার কথা শোনেননি, কিন্তু এবার থেকে আপনি আমাকে নিয়মিত আপা বলে ডাকবেন। ঠিক আছে?’
শফিক কথা বলল না। নাদিয়া বলল, ‘আপনাকে একটা কাজ করতে হবে শফিক ভাই।’
‘জি আচ্ছা।’
‘কী কাজ, না জেনেই জি আচ্ছা বলে দিলেন?’
‘জি।’ শফিক মৃদু কণ্ঠে বলল।
‘আপনাকে যদি এখন বলি, মঙ্গলগ্রহ থেকে মাটি এনে দিতে হবে, পারবেন?’
শফিক কথা বলল না। নাদিয়া বলল, ‘আপনার এসব অভ্যাস পাল্টান শফিক ভাই। খুবই বিচ্ছিরি লাগে। একটা মানুষের কোনোকিছুতেই নিজের কোনো মতামত থাকবে না? কথা বলার সাহস থাকবে না? এটা কেমন কথা?’
শফিক চুপ। নাদিয়া বিরক্ত গলায় বলল, ‘আপনি সন্ধ্যায় একটু আমাদের বাসায় আসতে পারবেন?’
শফিক অবশ্যই পারবে। কিন্তু এখন সে দ্বিধান্বিত হয়ে গেছে। সে যদি এখন বলে যে সে পারবে, আর তারপর যদি নাদিয়া আবার রেগে যায়? কিন্তু কী বলবে সে? এবার নিজের ওপরই নিজের বিরক্ত লাগতে লাগল শফিকের। দিন দিন এমন হয়ে যাচ্ছে কেন সে?
নাদিয়া বলল, ‘আপুর জন্য মা কিছু জিনিস পাঠাবে, আপনাকে একটু নিয়ে যেতে হবে এসে।’
‘আচ্ছা।’
নাদিয়া বিরক্ত গলায় বলল, ‘সন্ধ্যাবেলা এসে নিয়ে যাবেন।’
শফিক তার সবচেয়ে ভালো শার্টটা ধুয়ে দিল। এই জামা কতক্ষণে শুকাবে কে জানে! শুকানোর পরে মোড়ের দোকান থেকে ইস্ত্রি করাতে হবে। একটু ভেজা থাকলেও অবশ্য সমস্যা নেই। ইস্ত্রিতেই শুকিয়ে নেয়া যাবে। কিন্তু শফিকের ধারণা আজ মোড়ের ইস্ত্রির দোকানটা কোনো কারণ ছাড়াই বন্ধ থাকবে। এ ভয়ে সে শার্টটা গ্যাসের চুলার ওপর দড়ি বেঁধে শুকাতে দিল। তারপর বাইরে বের হলো ইস্ত্রির দোকান খোলা কিনা সেটা দেখতে। দোকান খোলা। কিন্তু প্রচণ্ড ভিড়। সে দোকানের ছোট ছেলেটাকে অবশ্য বলে এলো যাতে এক ফাঁকে চট করে তার জামাটা ইস্ত্রি করে দেয়। প্রয়োজনে পাঁচ টাকা বেশিই দেবে সে। বাসায় ফেরার পথে পাড়ার দোকান থেকে একটা সস্তা দামের বডি স্প্রেও কিনে ফেলল শফিক। সাথে এক জোড়া স্যান্ডেলও। সমস্যা হচ্ছে ঘরে ঢুকতেই তীব্র গন্ধে তার নাক বন্ধ হয়ে এলো। সে দৌড়ে চুলার কাছে চলে এলো। দড়িতে ঝোলানো শার্টটার অর্ধেকটা ততক্ষণে আগুনের আঁচে গলে চুলার মধ্যে পড়েছে। বাকি অর্ধেকটা কোনোমতে ঝুলে আছে দড়িতে। যেকোনো সময়ে সেটুকুও খুলে পড়ে যাবে। শফিক অবশ্য তাড়াহুড়া করল না। সে ধীরে সুস্থে চুলাটা বন্ধ করল। তারপর চুপচাপ বসে রইলো চুলার পাশে।
ঘরে তার আর একটাও ভালো জামা নেই। বোকার মতো বডি স্প্রে আর স্যান্ডেল না কিনে ফেললে ওই টাকা দিয়ে সে একটা নতুন শার্ট কিনে ফেলতে পারত। এখন কী করবে সে!
শফিক কাঁটায় কাঁটায় সন্ধ্যা সাতটায় নাদিয়াদের বাড়িতে গেল। তার গায়ে পুরনো কোঁচকানো একটা শার্ট। পায়ে পুরনো স্যান্ডেল। নতুন কেনা স্যান্ডেল সে পরেনি। কোঁচকানো শার্টটাও ইস্ত্রি করেনি। তার গায়ে কোনো সুগন্ধিও নেই। সে কি কারো ওপর অভিমান করেছে? কার ওপরে? শফিক নিজেও এই প্রশ্নের উত্তর জানে না।
হাফসা বললেন, ‘তুমি ভালো আছো বাবা?’
‘জি ভালো।’ শফিক স্পষ্ট গলায় উত্তর দিল।
‘বাড়িতে সবাই ভালো?’
‘গত দুদিনের খবর নেই। তার আগে ভালোই ছিল সব।’
‘সাজ্জাদ ফিরেছে?’
‘ফেরেনি, তবে ফোন করেছিল।’
‘কী বলল?’
‘তেমন কিছু না।’ শফিক ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে উঠেছে। সে আশপাশে কোথাও নাদিয়াকে দেখতে পাচ্ছে না। যদিও সে জানে, নাদিয়া তার সামনে এলেই তার এই স্বতঃস্ফূর্ততা আর থাকবে না।
হাফসা বললেন, ‘নাবিলা আমার খুব আদরের মেয়ে বুঝলে বাবা? কিন্তু নিজের ভুলে নিজের জীবনটাকে নষ্ট করেছে সে। এইজন্য যত কষ্টই হোক কিছুই বলতেও পারে না আমাকে। কিন্তু আমিতো মা, আমি সবই বুঝি। কিন্তু বুঝে কী করব বলো?’
শফিক জবাব দিল না। হাফসাও চুপ করে রইলেন। দীর্ঘ সময় পরে তিনি বললেন, ‘তার বড় ফুপু থাকে আমেরিকায়। সে তার জন্য অনেক কিছু পাঠিয়েছে। আদরের ভাইঝি ছিল সে। এ বাড়ির মেয়েদের মধ্যে সবার বড়। অথচ আজ তার…!’ হাফসার গলা ভিজে এলো যেন।
শফিক এদিক-সেদিক তাকিয়েও নাদিয়াকে কোথাও দেখতে পেল না। তাহলে কি সে বাড়িতে নেই? হাফসা কাজের মেয়েটাকে ডেকে একটা প্যাকেট দিলেন শফিকের হাতে। তারপর বললেন, ‘তুমি যখন বাড়িতে যাবে, এটা নিয়ে যেও বাবা।’
শফিক বলল, ‘আচ্ছা।’
হাফসা তাকে কিছু নাশতাও খেতে দিলেন। শফিক প্রয়োজনের চেয়েও দীর্ঘ সময় লাগিয়ে সেই খাবার খেল। খাবার শেষেও বসে রইলো সে। হাফসা বললেন, ‘কিছু বলবে বাবা?’
শফিক তটস্থ ভঙ্গিতে বলল, ‘না।’ তার বুকের ভেতর সেই পুরনো, চেনা, তীব্র চিনচিনে দম বন্ধ করা ব্যথাটা আবার টের পাচ্ছে সে। তার ভাগ্যটা সবসময়ই এমন কেন? যা চায়, তার কিছুই কেন কখনোই পায়না সে? খুব বেশি কিছুতো কখনোই চায়নি সে। তাহলে? একটু দেখাতো হতে পারত নাদিয়ার সাথে! এক অনির্দিষ্ট অভিমানের দলা পাকানো কষ্ট তার গলার কাছটাতে এসে আটকে রইলো যেন।
বাইরে আকাশ কি মেঘলা। এখুনি কি ঝমঝম করে বৃষ্টি নামবে? কী হয় নামলে? এমন কত বৃষ্টিইতো কত অসময়ে নেমে আসে। তাহলে আজ, এখন নামলে ক্ষতি কী? কিন্তু শফিক জানে, আজ কোনো বৃষ্টি হবে না। রাস্তায় কোনো দুর্ঘটনা ঘটবে না। তাকে এ বাড়ির কেউ সৌজন্যতাবশতও এই রাতটা থেকে যেতে বলবে না। নাদিয়াকে এক চোখ না দেখার তীব্র কষ্ট নিয়েই তাকে ফিরে যেতে হবে। তারপর আরো কিছু বিনিদ্র রাত্রি তার কেটে যেতে থাকবে যন্ত্রণার সুতোয় বুনে।
শফিক রাত নটার দিকে উঠল। সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতেও তার বারবার মনে হচ্ছিল, এই বুঝি পেছন থেকে তাকে কেউ ডাকল! এই বুঝি নাদিয়ার সাথে তার সিঁড়িতে মুখোমুখি দেখা হয়ে গেল। কিন্তু তেমন কিছুই ঘটলো না। সে নির্বিঘ্নেই নিচে নেমে এলো। গ্যারেজের ঘরটাতে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়েও রইলো। তারপর নিচু হয়ে গেটের ভেতর মাথা ঢোকাতে গিয়ে আচমকা বজ্রাহতের মতো চমকে গেল সে। নাদিয়া রিকশা থেকে নামছে। তার সাথে ঋদ্ধি। ঢং শব্দে গেটে মাথা ঠুকে গেল শফিকের। নাদিয়া আর ঋদ্ধি একসাথেই ফিরে তাকাল। নাদিয়া বলল, ‘আপনি এখনো আছেন!’
শফিক এক হাতে মাথা ডলতে ডলতে বলল, ‘হুম।’
‘ওহ, আচ্ছা। আমিতো ভেবেছি এতক্ষণে চলেই গেছেন আপনি।’
‘এইতো যাচ্ছি।’
নাদিয়া বলল, ‘আমার ধারণা এখুনি বৃষ্টি শুরু হবে। সারাদিন কী ভ্যাপসা গরম পড়েছে রিকশায় আসতে আসতে দেখলাম ঝিরিঝিরি বৃষ্টিও শুরু হয়েছে।’
শফিক আকাশের দিকে তাকাল। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বিকট শব্দে মেঘ ডাকল যেন। নাদিয়া বলল, ‘আপনি চাইলে একটু অপেক্ষা করেও যেতে পারেন।
নাদিয়ার কথা শেষ হতে না হতেই হুড়মুড় করে বৃষ্টি শুরু হলো। বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা যেন উন্মাতাল নৃত্য জুড়ে দিল ধুলোয় ধুসরিত রাস্তায়। এমন বৃষ্টির সাথে ঝোড়ো হাওয়া সচরাচর দেখা যায় না। কিন্তু এই মুহূর্তে দেখা যাচ্ছে। তীব্র হাওয়ায় তেরছা হয়ে পড়ছে বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটাগুলো। সেই বৃষ্টির ফোটার দিকে তাকিয়ে শফিক বুক ভরে নিঃশ্বাস নিল। তারপর নাবিলার জন্য হাফসার দেয়া প্লাস্টিকের প্যাকেটটা দু হাতে বুকের কাছে চেপে ধরে মাথা নিচু করে গেট পেরিয়ে বেরিয়ে এলো সে। নাদিয়া বড় বড় চোখে তাকিয়ে রইলো। শফিক বৃষ্টির ভেতর নেমে সামান্য থমকে দাঁড়াল। তবে পেছন ফিরে তাকাল না। নাদিয়া বিস্মিত গলায় বলল, ‘আপনি কী করছেন শফিক ভাই?’
শফিক জবাব দিল না। সে হাঁটতে শুরু করল। যেন এই জগতে আর কোনো কিছুর প্রতি তার কোনো আগ্রহ নেই। কোনো পিছুটান নেই। কোনো দ্বিধা নেই। সে বড় বড় পা ফেলে তুমুল বৃষ্টির সেই রাতে, বিষণ্ণ জলের সঙ্গীত কিংবা কান্নার ওপারে হারিয়ে যেতে থাকল। পেছন থেকে নাদিয়া তাকে ডাকতে থাকল। কিন্তু শফিক সেই ডাক শুনল কী না বোঝা গেল না। সে হেঁটে যেতে থাকল এক ঘোরগ্রস্ত মানুষের মতো। তার বুকের ভেতর যেন জমে আছে এক সাহারা তৃষ্ণার্ত মরুভূমি। সে যেন সেই মরুভূমিটাকে এই তীব্র বৃষ্টির জলে স্নান করিয়ে নিতে চায়। তেষ্টা মিটিয়ে দিতে চায়। নাদিয়া তখনো পেছন থেকে ডেকে চলেছে, ‘শফিক ভাই, এই শফিক ভাই…।’
শফিক ফিরেও তাকাল না। আপাতদৃষ্টিতে সে হেঁটে যাচ্ছে উদ্দেশ্যহীন ও একা। কিন্তু আর কেউ না জানলেও সে জানে, একবুক দুঃখী, বিষণ্ণ, ভেজা, অতল অন্ধকার সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে সে।