অর্থনৈতিক ক্ষমতা
অর্থনৈতিক ক্ষমতা সামরিক ক্ষমতার মতো মৌলিক নয়, সিদ্ধান্তমূলক। তা একটি রাষ্ট্রের ভেতরে আইনের উপর নির্ভর করে। আন্তর্জাতিক পরিসরে তা শুধু ছোটখানো ব্যাপারেই আইনের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে তা যুদ্ধ বা যুদ্ধের আশংকার উপর নির্ভরশীল। কোনোরূপ বিশ্লেষণ ছাড়াই অর্থনৈতিক ক্ষমতা গ্রহণ করে নেয়া প্রচলিত হয়ে পড়েছে। এর ফলে ঐতিহাসিক কারণগত ব্যাখ্যায় অযৌক্তিক গুরুত্ব আরোপিত হচ্ছে যুদ্ধ ও প্রচারণার বিপরীতে অর্থনীতির উপর।
শ্রম-অর্থনৈতিক ক্ষমতা ছাড়া অন্যসব অর্থনৈতিক ক্ষমতার সর্বশেষ বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, একখন্ড জমির উপর দাঁড়িয়ে থাকা এবং এর উপর কিছু রাখা বা তা থেকে কিছু নিয়ে যাওয়া কার পক্ষে সম্ভব প্রয়োজনে তা সেনাশক্তি ব্যবহারের সামর্থ্যের উপর নির্ভর করছে। কিছু ক্ষেত্রে তা অপরিহার্য। এংলো পারসিক কোম্পানির মালিকানাধীন দক্ষিণ পারস্যের তেল সম্পদগুলো। কারণ ব্রিটিশ সরকার এ রকম আইন পাস করেছে যে তাতে অন্য কারোর অধিকার থাকবে না এবং অদ্যাবধি এই আইন বলবৎ করার জন্য তা যথেষ্ট শক্তিশালী। কিন্তু ব্রিটেন কোনো মরাত্মক যুদ্ধে পরাজিত হলে সম্ভবত মালিকানা পরিবর্তিত হতে পারে। কিছু ধনী মানুষের মালিকানাধীন রোডেশীয় স্বর্ণক্ষেত্রগুলো। কারণ ব্রিটিশরা মনে করত যে লবেনগুলার সঙ্গে যুদ্ধের মাধ্যমে লোকগুলোকে ধনী করে দেয়াই লাভজনক। যুক্তরাষ্ট্রের তেল সম্পদ কতগুলো কোম্পানির মালিকানাধীন, কারণ তাদের আইনগত অধিকার রয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সেনাশক্তি এই আইন বলবৎ করতে প্রস্তুত। তেল এলাকাগুলোর মালিকানা যেসব ইন্ডিয়ানদের ছিল তাতে তাদের কোনো আইনগত অধিকার নেই। কারণ, তারা যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিল। অতি সম্প্রতি সংঘটিত যুদ্ধে বিজয় অনুসারে ফ্রান্স অথবা জার্মানির মালিকানাধীন লরেনের লৌহখনি।
কিন্তু অপেক্ষাকৃত অস্পষ্ট ক্ষেত্রে এই বিশ্লেষণ প্রযোজ্য। কেন একজন প্রজা কৃষক জমির খাজনা দেন এবং কেন তিনি জমির শস্য বিক্রি করতে পারেন? তাকে খাজনা দিতে হয় কারণ জমি জমিদারের মালিকানাধীন। জমিদার জমির মালিক কারণ তিনি তা অর্জন করেছেন ক্রয় করে অথবা তা পেয়েছেন উত্তরাধিকার সূত্রে। আমরা মালিকানা সূত্রের উল্টো দিক অনুসরণ করলে পরিশেষে এমন এক ব্যক্তির কাছে পৌঁছব, যিনি শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে তা অর্জন করেছিলেন–এটা হতে পারে কোনো সভাসদের অনুকূলে ব্যবহৃত রাজার স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতা অথবা সেক্সন বা নরমেনদের মতো বড় ধরনের বিজয়। এসব উগ্র কার্যকলাপের মধ্যবর্তী সময়ে রাষ্ট্রশক্তি ব্যবহৃত হয় আইন অনুসারে মালিকানা পরিবর্তনের নিশ্চয়তা বিধানের জন্য। জমির মালিকানা সিদ্ধান্তকারী ক্ষমতা, কে জমির উপর থাকবে এর মাধ্যমে তা নির্ধারিত হয়। এই অনুমতির জন্য কৃষক জমির খাজনা প্রদান করেন এবং সে সুবাদে শস্য বিক্রি করেন তিনি।
একই ধরনের সর্বশেষ বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, লক আউট শিল্পপতির ক্ষমতার ভিত্তি হচ্ছে। অর্থাৎ ফ্যাক্টরি মালিক রাষ্ট্রশক্তি ব্যবহার করতে পারেন অগ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের ফ্যাক্টরির ভেতরে প্রবেশকরা থেকে বিরত রাখতে। গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে এ ব্যাপারে কোথাও রাষ্ট্রীয় অনীহা থাকতে পারে, পরিণামে ধর্মঘটের সম্ভাবনা দেখা দেয়। রাষ্ট্র কর্তৃক এগুলো সহনীয় হয়ে ওঠামাত্রই নিয়োগকারীদের নিরঙ্কুশ মালিকানা রদ হয়ে যায় এবং কর্মচারীদের অংশগ্রহণ শুরু হয় মালিকানায়।
অন্যান্য আর্থিক ক্ষমতার চেয়ে ঋণ অধিক বিমূর্ত, কিন্তু পৃথক নয়। এই ক্ষমতা নির্ভরশীল উৎপাদক থেকে অব্যবহিত উৎপাদনশীল নয় এমন কাজে নিয়োজিত লোকের হাতে উদ্বৃত্ত ভোগ্যপণ্য হস্তান্তর করার আইনগত অধিকারের উপর। আর্থিক ঋণ গ্রহণকারী কর্পোরেশন বা সাধারণ মানুষ শুধু আইনের বলেই ঋণ পরিশোধে বাধ্য। কিন্তু এ উপায় ব্যর্থ হতে পারে ঋণ গ্রহণকারী সরকারের বেলা চূড়ান্ত উপায় হিসেবে বিপ্লবোত্তর রাশিয়ার মতো পরিবেশ যে দেশে বিরাজ করে সে দেশে। ব্যর্থ হলে ঋণগ্রহীতা সোজা ঋণদাতার সম্পত্তি দখল করে নেয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ উল্লেখ করা যায় লিনা স্বর্ণ ক্ষেত্রে কে প্রবেশাধিকার পাবে। এই সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার সোভিয়েত সরকারের, যুদ্ধপূর্ব শেয়ার মালিকদের নয়।
সাধারণত মানুষের অর্থনৈতিক ক্ষমতা এভাবে সরকারের সেনাশক্তি নিয়োগের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করে। প্রয়োজনে এগুলো বিধিবদ্ধ কিছু নিয়মানুসারে ঠিক করে দেয় যে, এই জমিতে যাওয়ার মোক্ষম অধিকার কে পেতে পারে। কিন্তু সরকারের অর্থনৈতিক ক্ষমতা নির্ভর করে আংশিকভাবে সেনাশক্তির উপর এবং আংশিকভাবে অন্যান্য সরকারের সঙ্গে সম্পাদিত শান্তিচুক্তি বা আন্তর্জাতিক আইনের বিভিন্ন পদক্ষেপের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের উপর।
অর্থনৈতিক ক্ষমতার সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক অনেকটা উভয়মুখী। অর্থাৎ একদল মানুষ অর্থনৈতিক ক্ষমতা অর্জন করতে পারে একত্রিত হয়ে অর্জিত সেনাশক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে। প্রকৃতপক্ষে চরম অর্থনৈতিক ক্ষমতা অর্জনই তাদের একত্রিত হওয়ার মূল লক্ষ্য। দৃষ্টান্তস্বরূপ ধরা যাক ১৮৪৯ সালে ক্যালিফোর্নিয়ায় অথবা এর কয়েক বছর পর ভিক্টোরিয়ায় অকস্মাৎ ত্বরাপূর্ণ স্বর্নমুখী আগমনজনিত আধানৈরাজ্যিক অবস্থার কথা। যিনি আইনসঙ্গতভাবে স্বর্ণের অধিকার পেয়েছেন তিনি তা ব্যাংকে জমা রাখার আগে অর্থনৈতিক ক্ষমতা অর্জন করেছেন বলা যায় না। তার লুণ্ঠিত হওয়ার অথবা খুন হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে সে সময় পর্যন্ত। নৈরাজ্যপূর্ণ দেশে যখন সবাই একে-অন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধেরত তখন যিনি রিভলবার দিয়ে খুব তাড়াতাড়ি এবং নিশ্চিতভাবে আক্রমণকারীকে প্রতিহত করতে পারে তিনি ছাড়া অন্য সবার কাছে স্বর্ণ অর্থহীন হয়ে পড়ে। তার কাছে এমন চিন্তা করা আনন্দদায়ক যে, কোনোরূপ অর্থ প্রদান ছাড়াই তিনি খুন করার ভয় দেখিয়ে চাহিদা পূরণ করতে পেরেছেন। বিক্ষিপ্তভাবে অবস্থানরত খাদ্যান্বেষী জনসমষ্টি ছাড়া অন্য কোথাও এ ধরনের অবস্থা স্থিতিশীল হবে না। কৃষিকাজ অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায় অনধিকার প্রবেশ ও চুরি বন্ধ করতে না পারলে। এটা স্পষ্ট যে স্বর্ণসন্ধানীদের মতো কমবেশি সভ্যলোকের সমন্বয়ে গঠিত নৈরাজ্যিক সমাজে ভিজিল্যান্ট কমিটির অনুরূপ এক প্রকার সরকার দেখা দেয়। একত্রিত হয়ে লুণ্ঠনকারীদের প্রতিহত করবে শক্তিমান ব্যক্তিরা। হস্তক্ষেপের জন্য বাহ্যিক কর্তৃপক্ষ না থাকলে তারা অন্যদেরও লুণ্ঠন করবে, কিন্তু তারা এ ক্ষেত্রে সংযম চর্চা করে থাকে স্বর্ণ ডিমদানে সক্ষম হাঁসের হত্যার ভয়ে। তারা সমাজে নিরাপত্তা বিধান করে মানুষের আয়ের এক অংশের বিনিময়ে। একেই বলে আয়কর। নিরাপত্তা বিধানের লক্ষ্যে আইন গঠিত হওয়া মাত্রই সামরিক শাসন আইনের ছদ্মাবরণে সজ্জিত হয়। ফলে নৈরাজ্য রহিত হয়ে পড়ে। আজও ভিজিলেন্টদের সামরিক ক্ষমতা হলো আইন এবং অর্থনৈতিক সম্পর্কের চরম ভিত্তি।
আইনগত ভিত্তি জটিল। চার্চের সম্পত্তি হলো ঐতিহ্যর্নিভর। শ্রমজীবীরা লাভবান হয়েছে ট্রেড ইউনিয়নের বদৌলতে। স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের অধিকারের ভিত্তি সম্প্রদায়গত নৈতিকতা। সামরিক ক্ষমতা রাষ্ট্রের সর্বপ্রকার অর্থনৈতিক বিধিবিধান বলবৎ করার পেছনে অপরিহার্য।
আইনের প্রাসঙ্গিক অধ্যায় হচ্ছে সাধারণ মানুষের জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক প্রণীত নীতি। আইনের এই অধ্যায় জনমত সমর্থিত হলেই শুধু অন্যান্য অধ্যায়ের মতো কার্যকরী হয়। অষ্টম আদেশ অনুসারে জনমত দ্বারা চুরি নিন্দিত এবং আইনের চোখে নিন্দিত উপায়ে সম্পদ অর্জন চুরি বলে অভিহিত হয়েছে। সুতরা সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক ক্ষমতা আসলে নির্ভরশীল মতামতের উপর। যেমন বলা যায়, আইন দ্বারা চুরির সংজ্ঞা প্রদানের মনোভাব সমেত চুরির নৈতিক নিন্দাবাদ। সম্পদ সেখানে বিপন্ন যেখানে মনোভাব দুর্বল অথবা অস্তিত্বহীন। যেমন বলা যায়, সাম্যবাদের স্বার্থে বৃত্তি চর্চার জন্য ধার্মিক সমাজচ্যুত ব্যক্তি হিসেবে জীবন শুরু করেন স্ট্যালিন। আমরা দেখেছি ত্রয়োদশ শতাব্দীতে অষ্টম অধ্যাদেশ বাধ্যবাধকতা থেকে মানুষকে মুক্ত করতে পোপের ক্ষমতা ইতালির ব্যাংকারদের নিয়ন্ত্রিত করতে তাকে সামর্থ্য যোগায়।
অর্থনৈতিক ক্ষমতা একটি রাষ্ট্রের ভেতর আইন এবং জনমত লব্ধ হলেও তা সহজেই কিছু বিশেষ স্বাধীনতা ভোগ করে। এটি দুর্নীতির মাধ্যমে আইন প্রভাবিত করে এবং প্রচারণার মাধ্যমে জনমত প্রভাবিত করে। এটি রাজনীতিকদের উপর বাধ্যবাধকতা আরোপ করে তাদের স্বাধীনতা হ্রাস করতে পারে এবং ভয় দেখাতে পারে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের। কিন্তু অত্যন্ত সীমিত অর্থনৈতিক ক্ষমতার সাফল্যের দিক। ঋণদাতা সিজারের ক্ষমতা অর্জনে সহায়তা দান করে তার সাফল্য ছাড়া ঋণ পরিশোধের সম্ভাবনা দেখেনি। কিন্তু সাফল্য অর্জনের পর তাদের উপেক্ষা করার উপযোগী ক্ষমতা অর্জন করেন সিজার। সম্রাটের অবস্থান দখল করে নেয়ার জন্য ফুজারের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করেন পঞ্চম চার্লস। কিন্তু সম্রাট হওয়ার পর তিনি তাদের দিকে অঙ্গুলী নির্দেশ করেন। ফলে সব ঋণই হারায় তারা। আমাদের সময়ে জার্মান পুনরুদ্ধারের জন্য সাহায্যদানে লন্ডন শহরে অনুরূপ অভিজ্ঞান রয়েছে। টাইসনের অভিজ্ঞতাও হিটলারের ক্ষমতা লাভে একই জাতীয়।
এ মুহূর্তে গণতান্ত্রিক দেশে কিছু লোকের শাসন ক্ষমতার (Plutocracy) কথা ধরা যাক। আগেকার দিনগুলোর কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া তা ব্যর্থ হয় ক্যালিফোর্নিয়ায় ও অস্ট্রেলিয়ায় এশীয় শ্রমের প্রবর্তন করতে। এটি ধ্বংস করতে পারেনি ট্রেড ইউনিয়ন। ব্রিটেনে এটি ধনীদের উপর ব্যাপক করারোপ এড়াতে এবং সমাজতান্ত্রিক প্রচারণারোধে ব্যর্থ হয়। এটি সমাজতন্ত্রীদের সমন্বয়ে গঠিত সরকারকে সমাজতন্ত্র প্রবর্তনে বাধা প্রদান করতে পারে। তারা অনমনীয় হলে সংকট সৃষ্টি ও প্রচারণার মাধ্যমে তাদের পতন ঘটাতে পারে। এসব উপায় ব্যর্থ হলে গৃহযুদ্ধের সূচনা করতে পারে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বাধা প্রদানের জন্য। যেখানে এই বিষয়টি সহজ এবং জনমত খুবই সুনির্দিষ্ট সেখানে প্রটোক্র্যাসি ক্ষমতাহীন। কিন্তু যেখানে জনমত সুনির্দিষ্ট নয় অথবা বিষয়ের জটিলতার জন্য জনমত বিভ্রান্ত, সেখানে অভীষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ প্লুটোক্র্যাসি।
ট্রেড ইউনিয়নের ক্ষমতা রয়েছে ধনীদের বিপরীতে। বর্ণ শ্রমিকদের অন্তর্ভুক্তি ঠেকিয়ে রাখতে পারে ট্রেড ইউনিয়নগুলো। নিজেদের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে পারে, ব্যাপক মৃত্যুকর ও আয়কর লাভ করতে পারে। কিন্তু এ পর্যন্ত সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছে ট্রেড ইউনিয়ন। তাছাড়াও ব্যর্থ হয়েছে তাদের পছন্দসই অথচ অধিকাংশ লোকের বিরাগভাজন সরকারকে টিকিয়ে রাখতে।
এভাবে জনমত দ্বারা সীমিত হয়ে পড়ে গণতন্ত্রে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের উপর অর্থনৈতিক সংস্থাগুলোর প্রভাব। অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে যেখানে তীব্র প্রচারণা ও জনমত প্রভাবিত করতে পারে না। এর বাস্তবতা গণতান্ত্রিক দেশে পুঁজিবাদ বিরোধীদের স্বীকৃত মানের চেয়েও বেশি।
আধুনিক সমাজে আইনের নিয়ন্ত্রণাধীনে অর্থনৈতিক ক্ষমতা চূড়ান্তভাবে জমির মালিকানার উপর নির্ভরশীল হলেও এর সবচেয়ে বড় দাবিদারদের অন্তর্ভুক্ত নয় নামমাত্র জমির মালিকরা। সামন্তযুগে জমির মালিকদেরই অর্থনৈতিক ক্ষমতা ছিল। মজুরি নির্ধারণে শ্রম আইনের ভূমিকার মতোই তারা নির্ধারণ করতে পারত শ্রমিকদের মজুরি। তাছাড়া সংগঠিত আন্দোলনের মাধ্যমে সদ্যজাত ঋণদানেও তাদের ভুমিকা রাখতে পারে। কিন্তু শিল্পোন্নত দেশে জমির মালিকানার চেয়ে ঋণ অধিকতর শক্তিশালী। অবিবেচনার সাথে ঋণ গ্রহণ করে জমির মালিকরা, নির্ভরশীল হয়ে পড়ে ব্যাংকের উপর। উৎপাদন কৌশলের পরিবর্তনের পরিণামস্বরূপ তা ঘটে বলেই মনে করা হয়। ভারতের মতো যেসব দেশে কৃষি ব্যবস্থা আধুনিক যন্ত্রনির্ভর নয় সেখানে তা হচ্ছে আইন কার্যকরি করার ক্ষেত্রে সরকারি ইচ্ছা ও ক্ষমতার ফসল। যে দেশে আইন সবার ঊর্ধ্বে নয় সেখানে দেখা গিয়েছে যে সময় সময় ঋণদাতারা তাদের ঋণগ্রহীতাদের হাতে খুন হয় এবং ঋণগ্রহীতারা ঋণের কাগজপত্র পুড়িয়ে দেয়। রাজপুরুষ থেকে কৃষক পর্যন্ত জমির সঙ্গে যাদেরই সম্পর্ক রয়েছে তারা সবাই ঋণ গ্রহণে অভ্যস্ত। কিন্তু যেখানে আইনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হয় এবং তা কার্যকরি করা হয় সেখানে ঋণগ্রহীতাকে ধ্বংস হওয়ার আগ পর্যন্ত ঋণের সুদ দিয়ে যেতে হয়। যেখানে তা ঘটে থাকে সেখানে ভূ-সম্পত্তির উপর নির্ভরশীল ক্ষমতা ঋণগ্রহীতার হাত থেকে ঋণদাতার হাতে চলে যায়। কিন্তু ব্যাংক হচ্ছে আধুনিককালে ঋণদাতা।
আধুনিক বৃহৎ কর্পোরেশনের মালিকানা ও ক্ষমতা কোনোক্রমেই একত্রিত নয়। বার্লে ও মিনস The Modern Corporation and Private Property নামে বইতে দেখিয়েছেন তা কিভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রভাবিত করে। তারা যুক্তি দেন যে মালিকানা অপকেন্দ্রিক হলেও অর্থনৈতিক ক্ষমতা কেন্দ্রমুখী। দুহাজার ব্যক্তি যুক্তরাষ্ট্রের অর্ধেক শিল্পকারখানা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে (পৃঃ ৩৩)-সযত্ন ও শ্রমবাধ্য অনুসন্ধানের মাধ্যমে তারা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। তাঁরা মনে করেন যে, আগেকার দিনের রাজা ও পোপের অনুরূপ বর্তমান নির্বাহীরা; তাদের মতে এডাম স্মিথের লেখায় আবির্ভূত ব্যবসায়ীদের উত্তরাধিকারী হিসেবে নয় এবং মহান আলেকজান্ডারের জীবনী আলোচনায় ওই নির্বাহীদের উদ্দেশ্য ও প্রেরণা সম্বন্ধে অধিক জানা যায়। তারা যুক্তি দেখান যে এসব বিশাল অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে ক্ষমতার কেন্দ্রায়ন মধ্যযুগীয় চার্চ বা জাতীয় রাষ্ট্রর ক্ষমতার কেন্দ্রায়নের অনুরূপ এবং এভাবে কর্পোরেশনগুলো রাষ্ট্রের গড়ে ওঠে সমকক্ষ প্রতিযোগী হিসেবে।
সহজেই এই কেন্দ্রায়ন বোঝা সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সাধারণ শেয়ার মালিকদের মতামত রাখার কোনো সুযোগ নেই রেল কোম্পানির ব্যবস্থাপনায়। তত্ত্বগতভাবে পার্লামেন্ট নির্বাচনের মাধ্যমে সাধারণ ভোটাররা ব্যবস্থাপনায় যেটুকু ক্ষমতা রাখে, কোম্পানি ব্যবস্থাপনায় তাদের ততটুকু ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তারা তার চেয়েও কম ক্ষমতা ভোগ করে থাকেন। রেল কোম্পানি অর্থনৈতিক ক্ষমতা কিছু সংখ্যক ব্যক্তির হাতে কুক্ষিগত; আমেরিকাতে তা এক ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত। প্রতিটি উন্নত দেশে অর্থনৈতিক ক্ষমতা মুষ্টিমেয় ব্যক্তিদের একচেটিয়া অধিকার। কখনও কখনও এরা আমেরিকা, গ্রেট ব্রিটেন ও ফ্রান্সে পুঁজিপতি। এরা জার্মানি, ইতালি ও রাশিয়ায় রাজনীতিবিদ। যেখানে রাজনৈতিকও অর্থনেতিক ক্ষমতা একীভূত হয়ে গেছে সেখানে উদ্ভব ঘটেছে শেষোক্ত পদ্ধতির। অর্থনৈতিক ক্ষমতা মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে কুক্ষিগত হওয়া সাধারণ ব্যাপার। কিন্তু এ ধরনের প্রবণতা ক্ষমতার ক্ষেত্রে সাধারণতভাবে প্রযোজ্য-শুধু অর্থনৈতিক ক্ষমতার ক্ষেত্রে নয়। একটি স্টিল ট্রাস্ট কিছু সংখ্যক প্রতিযোগিতাশীল ছোট ছোট স্টিল উৎপাদকের পরবর্তী স্তরের অন্তর্ভুক্ত। তেমনি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার একাঙ্গীভূত অবস্থা ও এগুলোর পৃথক সত্তা রয়েছে পরবর্তী স্তরে। কিন্তু এখনও আমি যেতে চাই না সর্বগ্রাসী রাষ্ট্রের আলোচনায়।
অর্থনেতিক ক্ষমতা পর্যবসিত হতে পারে সামরিক বা প্রচারণা ক্ষমতায়। বিপরীত প্রতিক্রিয়াটিও ঘটে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিভিন্ন দেশের আন্তঃসম্পর্কে অন্তর্ভুক্ত হলে প্রাচীন অবস্থাধীন সামরিক ক্ষমতাই অন্যান্য ক্ষমতার উৎস। আলেকজান্ডার পারসিকদের মতো এবং রোমানরা কার্তেজদের মতো ধনী ছিলেন না; কিন্তু যুদ্ধে বিজয়ের ফলে বিজয়ীরা তাদের শত্রুদের চেয়ে ধনী হয়ে ওঠে। বিজয়ের সূচনালগ্নে মোহাম্মদ (সাঃ)-এর অনুসারীরা বাইজেনটাইনদের চেয়ে অনেক গরিব ছিলেন এবং টিউটনিক আক্রমণকারীরা ছিলেন পশ্চিমা সাম্রাজ্যের চেয়ে গরিব। এসব ক্ষেত্রে সামরিক ক্ষমতা অর্থনৈতিক ক্ষমতার উৎস। কিন্তু আরব জাতির অভ্যন্তরে সামরিক ক্ষমতা নবী (সাঃ) ও তার পরিবারের প্রচারণার মাধ্যমে সৃষ্টি হয়। অনুরূপভাবে সৃষ্টি হয়েছিল পশ্চিমা চার্চের ক্ষমতা ও সম্পদ।
অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ক্ষমতাশালী হওয়ার পর সামরিক ক্ষমতা অর্জন করেছে–এমন অনেক রাষ্ট্রের দৃষ্টান্ত রয়েছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রাচীনকালে উপকূলবর্তী গ্রিক শহর ও কার্তেজ। মধ্যযুগে ইতালীয় প্রজাতন্ত্র এবং বর্তমান যুগে প্রথমে হল্যান্ড ও পরে ইংল্যান্ড। শিল্প বিপ্লবের পর ইংল্যান্ডের আংশিক ব্যতিক্রম ছাড়া এর সব ক্ষেত্রেই অর্থনৈতিক ক্ষমতার ভিত্তি ছিল বাণিজ্য কাঁচামালের মালিকানা নয়। ভৌগোলিক সুবিধার সঙ্গে দক্ষতার সমন্বয়ে কোনো শহর বা রাষ্ট্র আংশিকভাবে একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার লাভ করে। (সতেরো শতকে স্পেনের পতনে দৃষ্ট শুধু পরিবর্তীগুলোই যথেষ্ট ছিল না) সামরিক ক্ষমতা অর্জনের উপায় বের করা হয় বাণিজ্যলব্ধ সম্পদ আংশিকভাবে ভাড়াটে সৈন্যদের পেছনে ব্যয় করে। যা হোক এ ব্যবস্থায় ত্রুটি ছিল যে তা সব সময় সিপাহি বিদ্রোহ এবং ব্যাপকভাবে বিশ্বাসঘাতকতার জন্ম দিত। ম্যাকিয়াভেলি এ কারণেই তা অনুমোদন করেননি এবং পরামর্শ দেন যে সেনাবাহিনী নাগরিকদের সমন্বয়ে গঠিত হবে। বাণিজ্য সমৃদ্ধ বিরাট দেশে এ পরামর্শ খুবই ফলপ্রসূ, কিন্তু গ্রিক নগর রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে অথবা ছোট ইতালীয় প্রজাতন্ত্রের বেলায় তা অর্থহীন। শুধু বিশাল সম্প্রদায় অথবা প্রতিবেশিদের তুলনায় অধিকতর সভ্য সমাজের ক্ষেত্রেই স্থিতিশীল হয়ে থাকে বাণিজ্য নির্ভর অর্থনৈতিক ক্ষমতা।
যা হোক এর গুরুত্ব হারিয়েছে বাণিজ্য। আগের তুলনায় পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে ভৌগোলিক অবস্থানের গুরুত্ব কমে গেছে। সাম্রাজ্যবাদের প্রসারের ফলে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রগুলোর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রয়োজন আগের তুলনায় অনেক কম। কাঁচামাল ও খাদ্যের মালিকানা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ক্ষমতার গুরুত্বপূর্ণ অংশ; যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষমতা খুব কমই সম্ভব। দৃষ্টান্তস্বরূপ তেলের ব্যাপারটি ধরা যাক: তেল ছাড়া কোনো দেশই যুদ্ধ করতে পারে না এবং যুদ্ধ করতে সমর্থ না হলে সে তেলের মালিক হতে পারে না। ব্যর্থ হতে পারে উভয় শর্তই: পারস্যের তেল পারসিকদের উপকার আসেনি, কারণ তাদের যথেষ্ট সেনাশক্তির অভাব ছিল। তেল অর্জন করতে না পারলে জার্মান সেনাশক্তি তাদের কোনো উপকারে আসবে না। অনুরূপ অবস্থা বিরাজমান খাদ্যের বেলা। একটি শক্তিশালী যুদ্ধযন্ত্রের জন্য খাদ্যোপার্জন থেকে প্রভূত জাতীয় শক্তি অর্জন করা প্রয়োজন হয়ে পড়ে, তাই তা নির্ভর করে বিশাল উর্বর এলাকার সামরিক নিয়ন্ত্রণের উপর।
বর্তমানের মতো অতীতে কখনও এত অঙ্গাঙ্গীভঅবে সম্পর্কযুক্ত ছিল না অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষমতা। শিল্পে উন্নতি বিধান, খাদ্য এবং কাঁচামালের অধিকার ছাড়া কোনো জাতিই ক্ষমতা অর্জন করতে পারে না। সামরিক ক্ষমতাবলে জাতিগুলো নিজ দেশে অনুৎপাদনযোগ্য কাঁচামালের অধিকার লাভ করে। যুদ্ধের সময় জার্মানরা বিজয়ের মাধ্যমে রোমানিয়ার তেল ও ইউক্রেনের ফসলের অধিকার লাভ করে। গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চল থেকে যেসব দেশ তাদের কাঁচামাল পেয়ে থাকে তারা নিজেদের অথবা তাদের মিত্রদের সামরিক শক্তির মাধ্যমে তাদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে ওইসব দেশের উপর।
এর ভূমিকা বৃদ্ধি পেয়েছে শিক্ষার প্রসারের সাথে সাথে জাতীয় ক্ষমতার প্রচারণায়। অধিকাংশ মানুষ দুঃখ-কষ্ট ভোগ করতে এবং কিছুসংখ্যক মানুষ মৃত্যুবরণ করতে প্রস্তুত না থাকলে কোনো জাতিই আধুনিক যুদ্ধে জয় লাভ করতে পারে না। শাসকরা এ ধরনের অভিপ্রায়ে উদ্বুদ্ধ করার জন্য প্রজাদের মনে এমন প্রত্যয় সৃষ্টি করেন যে যুদ্ধে মৃত্যুবরণকারী শহীদের সমমর্যাদাসম্পন্ন। যুদ্ধে মিত্রশক্তির জয়ের প্রধান কারণ প্রচারণা এবং ১৯১৮-২০ সময়কালের ভেতর সোভিয়েতেদের বিজয়ের একমাত্র কারণ তা-ই। এটা স্পষ্ট যে, যেসব কারণে অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষমতা একীভূত হয়, ওই একই কারণে এ উভয় প্রচারণা একীভূত হয়। প্রকৃতপক্ষে একটি সংগঠনে সর্বপ্রকার ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়ার একটি প্রবণতা রয়েছে–এ সংগঠনটি হলো রাষ্ট্র। বিভিন্ন প্রকার ক্ষমতার ভেতর পার্থক্য শিগগিরই শুধু ঐতিহাসিক আগ্রহের কারণ হয়ে দাঁড়াবে প্রতিবাদী শক্তিগুলো কার্যকর না হলে।
অবশ্য এই প্রেক্ষাপটে মার্কসবাদের সমর্থনপুষ্ট দৃষ্টিভঙ্গির আলোচনা প্রয়োজনীয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে পুঁজিবাদী শ্রেণি সংগ্রামের জন্ম দেয়, যা পরিণামে অন্যান্য সংগ্রামকে প্রভাবিত করে। মার্কসবাদের ব্যাখ্যা সহজ ব্যাপার নয়। কিন্তু মার্কস মনে হয় ভেবেছিলেন যে শান্তির সময়ে অর্থনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষিগত থাকে জমিদার ও পুঁজিপতিদের হাতে। এরা চরমতম বিশ্লেষণ চালায়। ফলে বিদ্রোহ দানা বেঁধে ওঠে প্রলেতারীয়দের ভেতর। প্রলেতারীয়রা বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ বিধায় একত্রিত হলেই জয় লাভ করবে এবং এমন একটি পদ্ধতি প্রবর্তন করবে যে জমি ও পুঁজি থেকে প্রাপ্ত অর্থনৈতিক ক্ষমতা সম্পূর্ণভাবে সমাজের হাতে ন্যস্ত থাকবে। সঠিকভাবে তত্ত্বটি মার্কসের হোক বা না হোক, ব্যাপকভাবে তা আজকাল সাম্যবাদীদের এবং তাই এটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার দাবিদার।
জমিদার ও পুঁজিপতিদের হাতে সব অর্থনৈতিক ক্ষমতা-এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি যদিও মোটামুটিভাবে সত্য এবং এ পর্যন্ত আমি তা-ই ধরে নিয়েছি, তারপরও এর গুরুত্বপূর্ণ সীমাবদ্ধতা রয়েছে। জমিদার ও পুঁজিপতিরা শ্রম ছাড়া বড় অসহায়। তাই ধর্মঘটে দৃঢ় সংকল্প ও ব্যাপকতা থাকলে অর্থনৈতিক ক্ষমতায় শ্রমিকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়। কিন্তু ধর্মঘটের সম্ভাবনা এতই পরিচিত যে আমি আর কিছুই বলব না এ সম্পর্কে।
দ্বিতীয় যে প্রশ্ন উঠে তা হচ্ছে : প্রকৃতপক্ষে পুঁজিপতিরা তাদের চরমতম নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে কি? যেখানে তারা অপরিণামদর্শী নয় সেখানে মার্কসের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী পরিণতির ভয়ে তারা এমন করে না। শ্রমিকদের উন্নতি লাভে সুযোগ দেয়া হলে তারা বিপ্লব থেকে বিরত থাকে। আমেরিকা এর উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত। দক্ষ শ্রমিকরা সেখানে রক্ষণশীল।
এমন ধারণা খুবই প্রশ্ন সাপেক্ষ যে প্রলেতারীয়রা সংখ্যাগরিষ্ঠ। কৃষিপ্রধান যে দেশের জমির উপর কৃষকদের মালিকানা রয়েছে সেখানে মোটেই এর সত্যতা নেই। যেসব দেশে স্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ অনেক বেশি সেখানে অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ অনুযায়ী যারা প্রলেতারীয় তারা রাজনীতির ক্ষেত্রে ধনীদের পক্ষে থাকে, কারণ তাদের চাকরি নির্ভরশীল বিলাস সামগ্রীর চাহিদার উপর। এক্ষেত্রে প্রলেতারীয়ের বিজয় কোনোক্রমেই নিশ্চিত নয় শ্রেণি সংগ্রাম সংগঠিত হলে।
অধিকাংশ মানুষই চরম সংকট মুহূর্তে তার শ্রেণির চেয়ে জাতির প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে। এর রকম সবসময় নাও হতে পারে। কিন্তু ১৯১৪ সালের পর আজ অবধি পরিবর্তনের কোনো লক্ষণ নেই, যখন প্রায় সব আন্তর্জাতিকবাদীই যুদ্ধবাজ ও দেশপ্রেমিক হয়ে গিয়েছিল। সুতরাং শ্রেণি সগ্রাম যদিও সুদূর ভবিষ্যতের একটি সম্ভাবনা তারপরও খুব কমই তা আশা করা যায় না। বর্তমানের মতোই থেকে যাবে জাতীয়তাবাদী যুদ্ধের আশঙ্কা।
স্পেনের বর্তমান গৃহযুদ্ধ এবং অন্যান্য দেশে এর প্রতিক্রিয়া এ কথা প্রমাণ করে যে, জাতীয়তাবাদী ধারণাগুলো শ্রেণি সংগ্রামের প্রভাবাধীন। আমি মনে করি না যে, এই দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দিয়েছে ঘটনা প্রবাহই। জার্মানি ও ইতালি জাতীয়তাবাদী পটভূমির জন্যেই জেনারেল ফ্রাঙ্কোর পক্ষ অবলম্বন করে। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স একই জাতীয় কারণে ফ্রাঙ্কোর বিরোধিতা করে। এটা সত্য যে সরকারের নীতি ব্রিটিশ স্বার্থ অনুযায়ী স্থির করা হলে ব্রিটিশরা যতটুকু ফ্রাঙ্কোর বিরোধিতা করত বাস্তবে তার চেয়ে অনেক কম বিরোধিতাই করেছে। কারণ রক্ষণশীলরা। স্বভাবতই তার প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। তা সত্ত্বেও যখন মরক্কোর খনি অথবা ভূমধ্যসাগরে নৌ নিয়ন্ত্রণের প্রশ্ন দেখা দিয়েছে তখনই ব্রিটিশ স্বার্থ রাজনৈতিক সহানুভূতি অগ্রাহ্য করেছে। রুশ বিপ্লব সত্ত্বেও ১৯১৪ সালের আগে বৃহৎ শক্তিগুলোর বিভিন্ন শিবিরে বিভক্তিই আবার কার্যকর হয়েছে। উদারপন্থিরা জারকে অপছন্দ করেছে এবং রক্ষণশীলরা স্ট্যালিনকে; কিন্তু স্যার E-কে অথবা বর্তমান সরকারের কেউই এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে পারতেন না ব্রিটিশ স্বার্থের প্রতি হস্তক্ষেপ।
যা এ অধ্যায়ে বলা হয়েছে তার সারসংক্ষেপ হচ্ছে : সামরিক ইউনিটের (যা কয়েকটি স্বাধীন দেশের সমন্বয়ে গঠিত হতে পারে) অর্থনৈতিক ক্ষমতা নির্ভর করে (ক) নিজ ভূখন্ডের নিরাপত্তা বিধানে এর সামর্থ্যের উপর, (খ) অন্য রাষ্ট্রকে ভীতি প্রদানে এর ক্ষমতার উপর, (গ) কাঁচামাল, খাদ্য, শিল্প ক্ষেত্রে দক্ষতার উপর, (ঘ) অন্যান্য সামরিক ইউনিটের প্রয়োজনীয় দ্রব্য ও সেবা সরবরাহে এর সামর্থ্যের উপর। এর সব ক্ষেত্রে সামরিক ও অর্থনৈতিক উৎপাদনগুলো একটি অন্যটির সাথে মিশে আছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, জাপান শুধু মিলিটারি শক্তির দ্বারাই চীনা ভূ-খন্ডে তার সামরিক শক্তির জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল অর্জন করে এবং একইভাবে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স অর্জন করে নিকট প্রাচ্যে তেল। কিন্তু শিল্পে পূর্ব অগ্রগতি ছাড়া উভয়টিই অসম্ভব। যুদ্ধ যতই বিজ্ঞানভিত্তিক ও যন্ত্রর্নিভর হচ্ছে সামরিক ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক গুরুত্ব ততই বাড়ছে। কিন্তু এ কথা মনে করা নিরাপদ নয় যে, অর্থনৈতিক সম্পদে শ্রেষ্ঠ পক্ষই জয়লাভ করে। প্রচারণার গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে অর্থনৈতিক উৎপাদকের মতোই জাতীয়তাবোধ সৃষ্টিতে।
আইন সম্পদ সীমাবদ্ধতা আরোপ করে একটি দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শোষণের উপর। ব্যক্তি বিশেষ বা দল বিশেষ অবশ্যই একচেটিয়া অধিকার রাখে অন্যান্য লোকের আকাঙ্ক্ষিত কিছুর উপর আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে। একচেটিয়া অধিকার আইন দ্বারা সৃষ্টি হতে পারে, যেমন– ঔষধপত্রের উৎপাদন, ছাপানো ইত্যাদি অধিকার ও জমির মালিকানা। এগুলো সৃষ্টি হতে পারে ট্রেড ইউনিয়ন ও ট্রাস্টের মতো সংঘের মাধ্যমে। দরকষাকষির মাধ্যমে ব্যক্তিগতভাবে বা সমষ্টিগতভাবে যা কিছু লাভ করা যায় রাষ্ট্র ঐগুলো ছাড়া প্রয়োজনীয় অন্য সব কিছুই বল প্রয়োগ করে অর্জন করার অধিকার রাখে। প্রভাবশালী মহল রাষ্ট্রকে অধিকার আদায়ে এবং যুদ্ধে এমনভাবে উদ্বুদ্ধ করে যা সঠিকভাবে জাতির জন্য নয় বরং নিজেদের পক্ষে সুবিধাজনক তাদের সুবিধামত আইন কাজে লাগাতে পারে, যেমন শ্রমিকদের নয়, নিয়োগকারীদের সংঘবদ্ধ হওয়ার সুযোগদানে। প্রকৃত অর্থে ব্যক্তি বিশেষ বা গোষ্ঠী বিশেষের অর্থনৈতিক ক্ষমতা সামরিক শক্তির উপর নির্ভরশীল এবং অর্থনীতির সাধারণ বিবেচ্য উৎপাদকগুলোকে প্রচারণার মাধ্যমে প্রভাবিত করে থাকে। পথপ্রদর্শকের ভূমিকায় প্রায়োগিক ক্ষেত্রে অর্থনীতি পৃথক বিজ্ঞান হিসেবে আবির্ভূত হলে তা হবে অবাস্তব ও ত্রুটিপূর্ণ। ক্ষমতা বিজ্ঞানের বিশদ অধ্যয়নের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, এ কথা সত্য।