অর্থনীতির দর্শনের সন্ধানে

অর্থনীতির দর্শনের সন্ধানে 

প্রখ্যাত দার্শনিক লুডভিগ ভিটগেনস্টাইন (Ludwig Wittgenstein) মনে করতেন যে, দর্শন একটি অতি সহজ বিষয়। তাই তিনি লিখেছেন: “A serious and good philosophical work could be written consisting entirely of jokes.” (একটি চিন্তাশীল ও উত্তম দার্শনিক গ্রন্থ শুধুমাত্র ঠাট্টা-তামাশার সমাহারে লেখা সম্ভব।) যাঁরা দর্শন শাস্ত্রের পাণ্ডিত্যপূর্ণ গ্রন্থ পাঠ করে জ্ঞান অর্জনের চেষ্টা করেছেন তাঁরা অনেকেই ভিটগেনস্টাইনের সাথে একমত হবেন না। কিন্তু আমার মত যারা অর্বাচীন তাদের পক্ষে অবশ্য দর্শন পুরোপুরি না বুঝলেও ঠাট্টা-তামাশাটাই বোঝা সম্ভব হয়। প্রকৃতপক্ষে অর্থনীতির দর্শন সম্পর্কে আমার নিজের আগ্রহ জন্মে একটি মজার ঘটনা থেকে। ষাটের দশকে আমাদের এক বন্ধু, যিনি ছিলেন গড়পড়তা মানের ছাত্র, ক্লাসের পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে হুলস্থুল কাণ্ড বাধিয়েছিলেন। ক্লাসের তাবৎ তুখোড় তুখোড় ছাত্ররা পরীক্ষায় ফেল করে যায়। কাজেই সবাই আগ্রহের সাথে সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়া বন্ধুটির খাতা দেখতে যাই। পরীক্ষায় প্রশ্ন ছিল : “একচেটিয়া উৎপাদকের সরবরাহ রেখা আছে কি?” এ প্রশ্নের সঠিক জবাব হল, নেই (কেননা সরবরাহ রেখাতে বিভিন্ন বাজার দরে সরবরাহের পরিমাণ প্রতিফলিত হয়, একচেটিয়া ব্যবসায়ে পণ্যের দাম বাজার নিয়ন্ত্রণ করে না-একচেটিয়া উৎপাদক নিজেই নির্ধারণ করে)। ক্লাসের সবাই জবাব দেয়, একচেটিয়া ব্যবসায়ীর সরবরাহ রেখা আছে। আমার বন্ধুটি প্রশ্নটির জবাব জানতেন না। তিনি দীর্ঘ জবাব দিয়ে যা বলেন তার সারমর্ম হল: কেউ কেউ বলেন একচেটিয়া ব্যবসায়ীর সরবরাহ রেখা আছে, আবার কেউ কেউ বলেন নেই; আমার মনে হয় এটি থাকতেও পারে, আবার নাও থাকতে পারে। ক্লাসে সবাই ভুল উত্তর দেওয়াতে শিক্ষক মহোদয় এই অস্পষ্ট জবাবকেই সর্বোচ্চ নম্বর দেন। আমার বন্ধুর উত্তরটি অবশ্য আমারও পছন্দ হয়েছিল। তাঁর উত্তরের মধ্যে বিনয় ছিল, সবজান্তার ভাব ছিল না। পরবর্তীকালে জানতে পারি যে, আমার বন্ধুর সংশয়বাদ তাঁর মৌলিক অবদান নয়। দর্শনের জগতে সংশয়বাদ একটি অতি পুরানো মতবাদ। দু’হাজার বছর আগে গ্রীক দার্শনিক আরসেসিলস ( Arcesilaus ) লিখেছেন: “Nothing is certain, not even that.” (কোন কিছুই নিশ্চিত নয়, এমনকি যা বললুম তাও নয়)। এই সংশয়বাদই দার্শনিক নীটসের হাতে “মিথ্যুকের আপাত-স্ববিরোধী সত্য”-এর (liar paradox) রূপ লাভ করে।° নীটস বলতেন, সত্য বলে কিছু নেই, শুধু সত্য নামধারী কতগুলি ব্যাখ্যা রয়েছে। নীটসের বক্তব্য যদি সঠিক হয়, সত্য সম্পর্কে নীটসের ব্যাখ্যাও সঠিক হতে পারে না, এ ব্যাখ্যাও মিথ্যা। 

বিজ্ঞান অবশ্য জন্মলগ্ন হতেই নিজেকে সংশয় হতে মুক্ত করার চেষ্টা করেছে। বার্ট্রান্ড রাসেল সুন্দরভাবে বিজ্ঞান ও দর্শনের মধ্যে তফাৎ করেছেন’: “Science is what you know, philosophy is what you do not know” (বিজ্ঞান হচ্ছে আমরা যা জানি, দর্শন হচ্ছে আমরা যা জানি না)। বিজ্ঞানীরা অপরিবর্তনীয় সত্য জানতে চান। দার্শনিকদের আনন্দ “সত্যের আপাত-স্ববিরোধিতায়।” দার্শনিক কীর্কেগার্ড (Kierkegaard) লিখেছেন: “The thinker without a paradox is like a lover without feeling, a paltry mediocrity.” (আপাত-স্ববিরোধী সত্য ছাড়া একজন চিন্তাবিদ্ হচ্ছেন অনুভূতিহীন প্রেমিকের মত, তুচ্ছ সাধারণ ব্যক্তিত্ব)। বিজ্ঞানীরা সংশয়ের দোদুল দোলায় দুলতে রাজি নন। তাই তাঁরা সংশয়-মুক্ত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। 

জন্মলগ্ন থেকেই বিজ্ঞানের টোপর মাথায় নিয়ে অর্থনীতির আত্মপ্রকাশ। লাগসই দর্শনের সন্ধানে বিজ্ঞানীদের মধ্যে যে টানাপড়েন ও আত্মজিজ্ঞাসা দেখা দেয় তা অর্থনীতিবিদদের মধ্যে ছিল অনেকাংশে অনুপস্থিত। বিজ্ঞানের দর্শন নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষাতে অর্থনীতিবিদ্রা আগ্রহী ছিলেন না। তাঁদের লক্ষ্য ছিল বিজ্ঞান হিসাবে অর্থনীতির স্বীকৃতি। তাই তাঁরা বারবার সমকালে সর্বাধিক জনপ্রিয় বৈজ্ঞানিক দর্শনের ভিত্তিতে তাঁদের বক্তব্যের সত্যতা প্রতিপাদনের চেষ্টা করেছেন। অর্থনীতির দর্শনের ও বিজ্ঞানের দর্শনের ইতিহাস বহুলাংশে অভিন্ন এবং সকল ক্ষেত্রেই সমান্তরাল। 

অর্থনীতির জন্ম আঠারো শতকে। ততদিনে বিজ্ঞানের দর্শন অনেক চড়াই উৎরাই পার হয়ে এসেছে। খৃষ্টের জন্মের দু’শ থেকে চার শ বছর আগে – অর্থাৎ অর্থনীতির জন্মের প্রায় দু’হাজার থেকে বাইশ শ বছর আগে গ্রীসে ইউক্লিড তাঁর জ্যামিতিতে বৈজ্ঞানিক প্রমাণের একটি নতুন মান প্রতিষ্ঠা করেন। ইউক্লিডের জ্যামিতিতে স্বয়ংসিদ্ধ সত্য (axioms) থেকে তর্ক ও যুক্তির ভিত্তিতে নতুন নতুন উপপাদ্য প্রমাণ করা সম্ভব। এ ধরনের উপপাদ্য তর্কশাস্ত্র অনুসারে অবিসংবাদিত সত্য। নতুন প্রকরণের সাথে আঠারো শতকে নতুন দর্শন সংযুক্ত হয়। আঠারো শতকের সমাজবিজ্ঞানী আগস্ট কোঁতের (August Comte) মতে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তির তিনটি পর্যায়ে বিকাশ ঘটেছে। প্রথম পর্যায়ে জ্ঞানের উৎস ছিল ধর্মতত্ত্ব (theology)। এ পর্যায়ে বিশ্বাস করা হত যে, নির্ভুল জ্ঞান একমাত্র ঈশ্বরের পক্ষেই সম্ভব – মানুষের পক্ষে নয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে জ্ঞানের উৎস হল পরাবিদ্যা (metaphysics)। পরাবিদ্যা হল চূড়ান্ত বাস্তবতা সম্পর্কে দার্শনিক মতবাদ, পরাবিদ্যার সূত্রসমূহ প্রত্যক্ষভাবে প্রমাণ সম্ভব নয়। সবশেষ পর্যায়ে জ্ঞানের উৎস হল দৃষ্টবাদ বা প্রত্যক্ষবাদ (positivism)। প্রত্যক্ষবাদই হল বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের উৎস। প্রত্যক্ষবাদ শুধুমাত্র সে জ্ঞানকেই বিজ্ঞান হিসাবে স্বীকার করে যা বক্তা-নিরপেক্ষ (objective) ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সাক্ষ্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। প্রত্যক্ষবাদ আর ইউক্লিডের জ্যামিতির প্রকরণের ভিত্তিতে বৈজ্ঞানিক প্রমাণের যে নতুন দর্শন গড়ে ওঠে তার নাম হল প্রতিপাদনবাদ (verificationism )। অবশ্য এ দর্শনের চূড়ান্ত রূপ পরিগ্রহ করে বিংশ শতাব্দীতে ভিয়েনার দার্শনিকদের হাতে। এ মতবাদের মূল প্রতিজ্ঞা অথবা তর্কের ভিত্তি (premise) হল দুটি। প্রথমত বৈজ্ঞানিক বক্তব্য এমন হবে যা প্রমাণ করা সম্ভব। কেউ যদি ভবিষ্যদ্বাণী করে যে এক হাজার বছর পর কেয়ামত হবে তা প্রমাণ করা সম্ভব নয়। এ ধরনের ভবিষ্যদ্বাণীকে বৈজ্ঞানিক বক্তব্য রূপে গণ্য করা যাবে না। দ্বিতীয়ত, বৈজ্ঞানিক বক্তব্য দু’ভাবে প্রমাণ করা সম্ভব : পূর্বনির্ধারিত তত্ত্বের ভিত্তিতে অবরোহ (deductive) পদ্ধতি অনুসরণ করে অথবা অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আরোহ (inductive) পদ্ধতি প্রয়োগ করে। 

মূলত ধ্রুপদী অর্থনীতিবিদ্রা বিশ্বাস করতেন যে, অর্থনীতি হল প্রতিপাদনভিত্তিক বিজ্ঞান। রিকার্ডো দাবি করতেন যে তাঁর সকল ভবিষ্যদ্বাণীরই প্রমাণ সম্ভব। ধ্রুপদী ঘরানার অর্থনীতিবিদ্রা ঐতিহাসিক ঘরানা বা প্রতিষ্ঠানিক ঘরানার অর্থনীতিবিদদের সাথে কখনও একমত হননি যে, স্থান-কাল-পাত্র ভেদে অর্থনীতির মূল সূত্রসমূহ পরিবর্তিত হয়। তাঁরা বিশ্বাস করতেন যে, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে প্রমাণিত অর্থনৈতিক সূত্রসমূহ বিশ্বজনীন সত্য। 

আপাতদৃষ্টিতে বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের জন্য প্রতিপাদনবাদকে যতই নিখুঁত প্রকরণ মনে হোক না কেন, বিজ্ঞানের সকল ক্ষেত্রে সত্যতা প্রতিপাদন করা সম্ভব নয়। বৈজ্ঞানিক দর্শন হিসাবে প্রতিপাদনবাদের দুটো দুর্বলতা রয়েছে। প্রথমত কোন বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণেই সকল বক্তব্যের সত্যতা পরীক্ষা করা সম্ভব হয় না। কাজেই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির অন্যতম লক্ষ্য হল জানা সত্য হতে অজানা সত্যে উপনীত হওয়া। অবরোহ পদ্ধতিতে সাধারণত দুটি প্রতিজ্ঞা থেকে একটি নতুন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। উদাহরণস্বরূপ নিম্নরূপ তার্কিক প্রক্রিয়াটি দেখা যেতে পারে: 

মানুষ মরণশীল, 
সক্রেটিস মানুষ, 
সুতরাং সক্রেটিস মরণশীল। 

এই তার্কিক প্রক্রিয়াতে দুটো প্রতিজ্ঞাই সত্য, তাই সিদ্ধান্তও এ ক্ষেত্রে সঠিক। এ ক্ষেত্রে দুটি জানা সত্য হতে একটি অজানা সত্যতে উপনীত হওয়া সম্ভব হয়েছে। কিন্তু সিদ্ধান্ত সঠিক হলেই প্রতিজ্ঞাসমূহ সত্য হবে এ ধরনের নিশ্চয়তা নেই। উদাহরণ স্বরূপ নীচের উদাহরণটি লক্ষ্য করা যেতে পারে: 

সকল অর্থনীতিবিদ্ পুরুষ
আইনস্টাইন একজন অর্থনীতিবিদ্ 
সুতরাং আইনস্টাইন একজন পুরুষ 

এ ক্ষেত্রে দুটো প্রতিজ্ঞাই ভুল। সকল অর্থনীতিবিদ্ পুরুষ নন এবং আইনস্টাইন একজন অর্থনীতিবিদ্ ছিলেন না। তবু আইনস্টাইন একজন পুরুষ সিদ্ধান্তটি সঠিক। তর্কের প্রতিজ্ঞা ও সিদ্ধান্ত সম্পর্কে তর্কশাস্ত্রে দুটো সূত্র রয়েছে। একটি সূত্র “modus ponens” নামে পরিচিত। এ সূত্র অনুসারে দুটো সত্য প্রতিজ্ঞা বা বক্তব্য হতে একটি নতুন সত্য সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব। কিন্তু সিদ্ধান্ত সঠিক হলে প্রতিজ্ঞাসমূহ সঠিক হবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। দ্বিতীয় সূত্রটি “modus tollens” নামে অভিহিত। এ সূত্র অনুসারে সিদ্ধান্ত অসত্য হলে, প্রতিজ্ঞা দুটি বা কমপক্ষে একটি প্রতিজ্ঞা অসত্য হবে। কিন্তু সিদ্ধান্ত সত্য হলেই প্রতিজ্ঞাসমূহের সত্যতা সম্পর্কে কোন অনুমান সম্ভব নয়। কাজেই তর্কের ভিত্তিতে সব সময়ে অজানা সত্যে উপনীত হওয়া সম্ভব নয়। অনেক ক্ষেত্রে প্রতিপাদনবাদ তাই অচল। 

দ্বিতীয়ত, ইন্দ্ৰিয়গ্রাহ্য অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সকল ক্ষেত্রে সত্যতা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। এর জন্য অনেক ক্ষেত্রে প্রয়োজন সংখ্যাতাত্ত্বিক অনুমান (statistical inference)। দুর্ভাগ্যবশত সংখ্যাতাত্ত্বিক পদ্ধতিতে কোন একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের সত্যতা প্রতিপাদন সম্ভব নয়। সংখ্যাতাত্ত্বিক পদ্ধতি ব্যবহার করে শুধু এতটুকু বলা সম্ভব যে কোন প্রতিজ্ঞা বা সিদ্ধান্ত গ্রহণযোগ্য বা অগ্রহণযোগ্য। কিন্তু কোন প্রতিজ্ঞা বা সিদ্ধান্ত সংখ্যাতাত্ত্বিক পদ্ধতিতে গ্রহণযোগ্য হলেই তা সত্য নয়। এর কারণ হল সংখ্যাতাত্ত্বিক অনুমানের দু’ধরনের ত্রুটি রয়েছে। সংখ্যাতাত্ত্বিকরা এ সব ত্রুটির নাম দিয়েছেন : পয়লা কিসিমের ত্রুটি (type I error) এবং দোসরা কিসিমের ত্রুটি (type II error)। সংখ্যাতাত্ত্বিক অনুমানসমূহ সকল সম্ভাব্য সংখ্যার ভিত্তিতে গ্রহণ করা হয় না, কেননা সকল সম্ভাব্য উপাত্ত সংগ্রহের জন্য প্রচুর সময় ও সম্পদের প্রয়োজন। তাই সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ নির্ভর করে সংখ্যার দৈব চয়নের উপর। দৈব চয়নের (random sampling) ভিত্তিতে যে সব সংখ্যা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা হয় না সে সব সংখ্যা সম্পর্কেও অনুমান করা হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে একশ ভাগ নিশ্চয়তা নিয়ে কোন সিদ্ধান্ত সম্ভব নয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শতকরা ৯৫ ভাগ থেকে ৯৯ ভাগ নিশ্চয়তার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়ে থাকে। নিশ্চয়তার পর্যায় যত উঁচু হবে প্রাপ্ত গড় তথ্যের সাথে সম্ভাব্য তথ্যের আস্থার ব্যবধান (confidence interval) তত বড় হবে। পক্ষান্তরে নিশ্চয়তার পর্যায় যত কম হবে আস্থার ব্যবধান তত কম হবে। অর্থাৎ নিশ্চয়তার পর্যায় কম হলে প্রতিপাদনীয় বক্তব্য সহজে গ্রহণযোগ্য হবে। কিন্তু এ পর্যায়ে প্রতিপাদনযোগ্য বক্তব্য গ্রহণীয় মনে হলেও, প্রতিপাদনটি ভুল হওয়ার মত যথেষ্ট পাল্টা তথ্য থাকতে পারে। যদি প্রতিপাদনীয় বক্তব্যটি গ্রহণযোগ্য বলে প্রতীয়মান হয় অথচ আসলে তা মিথ্যা প্রমাণিত হয় তবে তাকে type I error অথবা পয়লা কিসিমের ত্রুটি বলা হয়ে থাকে। এ ধরনের ভ্রান্তি হ্রাসের উপায় হল নিশ্চয়তার পর্যায় বৃদ্ধি। নিশ্চয়তার পর্যায় বাড়লে প্রাপ্ত উপাত্তের গড়ের সাথে আস্থার ব্যবধান বাড়বে। তার ফলে অনেক প্রতিপাদনীয় বক্তব্য সঠিক হলেও সে সব বক্তব্য গ্রহণযোগ্য প্রতীয়মান হবে না। এ ধরনের ভ্রান্তিকে type II error বা দোসরা কিসিমের ত্রুটি বলা হয়ে থাকে। বাস্তব পরিস্থিতি হল প্রথম ধরনের ভ্রান্তির সম্ভাবনা হ্রাস করতে গেলে দ্বিতীয় ধরনের ভ্রান্তির সম্ভাবনা বেড়ে যায়। দ্বিতীয় ধরনের ভ্রান্তি কমাতে গেলে প্রথম ধরনের ভ্রান্তি বেড়ে যায়। কাজেই সংখ্যাতত্ত্বের ভিত্তিতে কোন বক্তব্যই নিশ্চয়তার সাথে প্রমাণ বা প্রত্যাখ্যান করা যায় না।’ 

ঊনবিংশ শতাব্দীতে প্রখ্যাত দার্শনিক ও অর্থনীতিবিদ্ জন স্টুয়ার্ট মিল অর্থনীতির সাথে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের একটি বড় তফাৎ তুলে ধরেন। অর্থনৈতিক সূত্রসমূহ প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের নিয়মের মত অমোঘ নয়। অর্থনৈতিক সূত্রসমূহ হচ্ছে প্রবণতা। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের নিয়ম সকল ক্ষেত্রেই সত্য। কিন্তু অর্থনৈতিক সূত্রসমূহ প্রায় সকল ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও প্রতিটি ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ সত্য নাও হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, একটি সাধারণ অর্থনৈতিক সূত্র হল এই যে, কোন পণ্যের দাম কমলে ক্রেতারা তা বেশি পরিমাণে কিনবে। কিন্তু সকল ক্রেতা একই ধরনের ব্যবহার নাও করতে পারে। অতি অল্প সংখ্যক ক্রেতা থাকতে পারে যারা কোন পণ্যের দাম কমলেও তা কম কেনে। অতি অল্প সংখ্যক ক্রেতার এই আচরণের জন্য মূল্য ও চাহিদার সম্পর্ক সংক্রান্ত অর্থনৈতিক সূত্র অচল বলে গণ্য করা সঠিক হবে না। এই ক্ষেত্রে স্বল্প সংখ্যক ক্রেতার আচরণ হল ব্যাতিক্রমধর্মী —যাকে জন স্টুয়ার্ট মিল বিশৃঙ্খল শক্তি (disturbing force) হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। অবশ্য পরবর্তীকালে বিশৃঙ্খল শক্তির বদলে ceteris paribus শর্তাবলীর উপর জোর দেওয়া হচ্ছে। ceteris paribus-এর অর্থ হল অন্যসব পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকবে। অর্থনৈতিক সূত্রের ক্ষেত্রে অনুক্ত অনুমান হল যে, অন্যসব কিছু অপরিবর্তিত থাকলে অর্থনীতিবিদদের বর্ণিত প্রবণতা দেখা যাবে। অনেকে মনে করে থাকেন যে, অন্যসব কিছু অপরিবর্তিত থাকার শর্ত শুধু অর্থনীতিতেই ব্যবহার করা হয়ে থাকে, অন্যান্য প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এ ধরনের শর্ত প্রয়োগ করা হয় না। এ অনুমান কিন্তু মোটেও সঠিক নয়। অতি অল্পসংখ্যক প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের নিয়মের ক্ষেত্রে এ শর্ত ব্যবহৃত হয় না। কিন্তু বেশিরভাগ প্রাকৃতিক বিজ্ঞানেই অনুমান করতে হয় যে, অন্য কিছু পরিবর্তিত হয়নি। অন্যসব কিছু অপরিবর্তিত থাকার শর্ত যোগ করার সাথে সাথে অর্থনীতির সূত্রসমূহ বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে সকল ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না হলেও প্রত্যাখ্যান করার উপায় নেই। যদি বাস্তবতা সূত্রের সাথে না মেলে, তাহলে সূত্র অবশ্যই ত্রুটিপূর্ণ প্রমাণিত হবে না। বরং পরীক্ষা করে দেখতে হবে–যে উপাত্ত ব্যবহার করা হয়েছে তাতে সূত্রের ব্যতিক্রম হওয়ার কারণ রয়েছে কি না। তাই প্রতিপাদনবাদের ভিত্তিতে অর্থনীতির কোন সূত্র বাতিল করা সম্ভব নয়। 

সমাজবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যান্ত্রিকভাবে প্রতিপাদনবাদ প্রয়োগ আদৌ ফলপ্রসূ কি না সে সম্পর্কে সন্দেহ রয়েছে। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে অনুসন্ধেয় বিষয়ের সাথে বিজ্ঞানী ব্যক্তিগতভাবে সম্পৃক্ত নয়। পর্যবেক্ষণ ও গণনার মাধ্যমে বিষয়বস্তুর সম্পূর্ণ বাইরে থেকে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে জ্ঞান অর্জন সম্ভব। কিন্তু সমাজবিজ্ঞানে তা সম্ভব নয়। সমাজবিজ্ঞানীরা ব্যক্তিগতভাবে সামাজিক প্রক্রিয়ার অংশীদার। এর অসুবিধে আছে, আবার সুবিধেও আছে। অসুবিধা হল, সমাজবিজ্ঞানীদের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ তাঁদের গবেষণাকে পক্ষপাত-দুষ্ট করে তুলতে পারে। সুবিধা হল, সমাজবিজ্ঞানীগণ প্রত্যক্ষ অংশীদার হওয়ার ফলে অন্তজ্ঞান (intuition) এবং অন্যের আবেগ-অনুভূতির সঙ্গে একাত্ম হওয়ার ক্ষমতা (empathy) প্রয়োগ করে গভীর ও অর্থবহ বিশ্লেষণ সম্ভব। এ ধরনের পদ্ধতিকে জার্মান সমাজবিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন “verstehen”, যার আক্ষরিক অনুবাদ হল “উপলব্ধি”। সমাজবিজ্ঞানে প্রতিপাদনবাদ সমাজ সম্পর্কে অনেক তথ্য দিতে পারে, কিন্তু “উপলব্ধি” দিতে পারবে না। 

প্রতিপাদনবাদের অপূর্ণতা ও সীমাবদ্ধতা হতে এ কথা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, বৈজ্ঞানিক বক্তব্যসমূহের সত্যতা প্রমাণ করা সম্ভব নয়। বৈজ্ঞানিক বক্তব্য হল ফৌজদারী মামলার আসামীর মত। ফৌজদারী মামলায় কেউ নির্দোষ কি না প্রমাণ করা সম্ভব নয়। প্রমাণিত হয় কেউ নিঃসন্দেহে অপরাধী কি না, কোন সন্দেহ থাকলে আসামী “অপরাধী নয়” বলে বিবেচিত হবে। বৈজ্ঞানিক বিবৃতিও মিথ্যা হলে তা প্রমাণ করা সম্ভব। যে সব বিবৃতি এখন পর্যন্ত মিথ্যা নয় সে সব বিবৃতি সত্য প্রমাণিত হতে পারে, নাও হতে পারে। এই প্রেক্ষিতে বিজ্ঞানের নতুন দর্শন নিয়ে আসেন কার্ল পপার। পপারের বক্তব্য হল বৈজ্ঞানিক বক্তব্যের সত্যতা প্রমাণ সম্ভব নয়; শুধুমাত্র অসারতা প্রতিপাদন সম্ভব। পপারের এই নতুন মতবাদের নামকরণ করা হয় অসারতা-প্রতিপাদনবাদ (falsificationism)। পপারের বিশ্লেষণ অনুসারে, কোন বৈজ্ঞানিক সূত্রই সত্য নয়, সব বৈজ্ঞানিক সূত্রই হল সাময়িক অনুমান, যতক্ষণ পর্যন্ত কোন অনুমান মিথ্যা প্রমাণিত হবে না, তা ব্যবহৃত হতে থাকবে। এইভাবে মিথ্যা সূত্রসমূহ বাদ দিতে দিতে বিজ্ঞান সত্যের দিকে এগিয়ে যাবে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে একটি বক্তব্যের সমর্থনে অজস্র সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া গেলেও একে সত্য বলে গণ্য করার উপায় নেই। ভবিষ্যতে যদি একটিও উল্টো প্রমাণ উপস্থাপিত হয় তবে তা প্রত্যাখ্যান করতে হবে। এ প্রসঙ্গে পপারের একটি প্রিয় উদাহরণ উল্লেখ করা যেতে পারে। পপার বলতেন যে, আমরা যত শাদা বকই দেখি না কেন বৈজ্ঞানিকভাবে এ কথা প্রমাণ করা সম্ভব নয় যে সকল বকই শাদা কেননা একটিও যদি ভিন্ন বর্ণের বক দেখা যায় তবে এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করতে হবে। হার্বাট স্পেন্সার বলতেন, পৃথিবীর সবচেয়ে বিয়োগান্ত নাটক হল একটি সুন্দর তত্ত্বের শুধু একটি মাত্র বিসদৃশ তথ্য দ্বারা ধ্বংস হয়ে যাওয়া। পপারের বক্তব্য বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি করে। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানীদের অনেকেই পপারের “অসারতা-প্রতিপাদনবাদ” গ্রহণ করে। অর্থনীতিতে এ তত্ত্ব প্রথম প্রয়োগ করেন টি ডাবলু হাচিনসন (T. W. Hutchinson)। পরবর্তীকালে স্যামুয়েলসনসহ অধিকাংশ অর্থনীতিবিদ্‌ই এ মতবাদ গ্রহণ করেন। 

দার্শনিকরা “প্রতিপাদনবাদের” দুর্বলতাসমূহ স্বীকার করেন, কিন্তু “অসারতা—প্রতিপাদনবাদ” পূর্ববর্তী দর্শনের চেয়ে উন্নত এ বক্তব্য তারা মোটেও মানেন না। পপারের দর্শনের তিনটি উল্লেখযোগ্য দুর্বলতা রয়েছে। প্রথমত, শুধুমাত্র দু’একটি অসঙ্গতিপূর্ণ তথ্য পেলেই কোন তত্ত্বকে মিথ্যা বলে বাতিল করা যুক্তিযুক্ত হবে না। সবসময়েই সন্দেহ থেকে যায় যে, প্রাপ্ত উপাত্তসমূহ যথেষ্ট নয়। উপরন্তু তত্ত্ব প্রতিপাদনের জন্য যে আদর্শ অবস্থা অনুমান করা হয়েছিল সে অবস্থা বাস্তবে নাও থাকতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা হল, একটি তত্ত্ব বাতিল করাই যথেষ্ট নয়, এর বিকল্প তত্ত্বও সাথে সাথে দাঁড় করাতে হবে। দ্বিতীয়ত, উপাত্ত শূন্য থেকে আসে না। যে কোন উপাত্ত সংগ্রহ করার আগে একটি পূর্ব-ধারণা (hypothesis) থেকে শুরু করতে হয়। আর এ সব পূর্ব-ধারণা নিয়ন্ত্রিত হয় প্রচলিত তত্ত্ব দ্বারা। কাজেই বক্তা-নিরপেক্ষ (objective) কোন উপাত্ত নেই। সমাজবিজ্ঞান সম্পর্কে মার্ক ব্লাউ (Mark Blaug) যথার্থই বলেছেন, সকল উপাত্তই হল তত্ত্ব-ভারাক্রান্ত আর সকল তত্ত্বই হল মূল্যবোধে ভারাক্রান্ত। কাজেই নিরপেক্ষ ও বস্তুনিরপেক্ষ উপাত্তের কষ্টিপাথরে যারা তত্ত্বের যাচাই করার বড়াই করে তারা মিথ্যার মোহে আচ্ছন্ন রয়েছে। এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ্ আলফ্রেড মার্শাল যথার্থই লিখেছেন : “The most reckless and dangerous theorist is the man who claims to let the facts speak for themselves.” (সবচেয়ে বেপরোয়া ও বিপজ্জনক হচ্ছে সেই তত্ত্ববিদ যিনি দাবি করেন যে উপাত্ত নিজে নিজে কিছু প্রমাণ করবে)। তৃতীয়ত, যেখানে কোন ইন্দ্রিয়-গ্রাহ্য বস্তু বা বিষয়ের শুধু একটি কারণ থাকে পপারের পদ্ধতি সেখানে সহজভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব। কিন্তু যেখানে অনেক কারণ থাকে সেখানে কোটি সত্য আর কোটি মিথ্যা তা প্রমাণ করা অত্যন্ত কঠিন। প্রতিপাদনবাদের মত অসারতা—প্রতিপাদনবাদও আদর্শ প্রকরণ হিসাবে দার্শনিকদের সমর্থন লাভ করতে পারেনি। 

দার্শনিকদের নির্দেশিত পদ্ধতি অনুসারে সকলক্ষেত্রে সত্যতা বা অসত্যতা কোনটিই প্রতিপাদন করা সম্ভব নয়। টমাস কুন (Kuhn) তাই মনে করেন যে, বিজ্ঞানীদের কি করা উচিত সে সম্পর্কে আলোচনা করে বিজ্ঞানের দর্শন নির্ধারণ করা যাবে না, বরং বিজ্ঞানীরা কিভাবে বিজ্ঞান চর্চা করছে তা বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানের দর্শন প্রণয়ন করা সম্ভব। তাঁর মতে বিজ্ঞানের ইতিহাস, বিজ্ঞানের দর্শন এবং বিজ্ঞানের সমাজতত্ত্বের সংমিশ্রণের মাধ্যমে বিজ্ঞানের বিকাশ সম্পর্কে তত্ত্ব গড়ে তুলতে হবে। টমাস কুনের মতে বিজ্ঞানে বিশেষ সূত্রের সত্যতা বা অসত্যতা বড় কথা নয়। বিজ্ঞানের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল পূর্ণাঙ্গ তাত্ত্বিক আদল বা paradigm। এই তাত্ত্বিক আদল সম্পর্কে সমকালীন বিজ্ঞানীরা একমত পোষণ করে। এই আদল দীর্ঘদিন ধরে অপরিবর্তিত থাকে। তবে মাঝে মাঝে আদলের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন দেখা দেয়। এই বৈপ্লবিক প্রক্রিয়াতে একটি আদলের স্থলে ভিন্ন আদল প্রতিষ্ঠিত হয় এবং দীর্ঘদিন ধরে তা অপরিবর্তিত থাকে। কুনের আদল তত্ত্ব (paradigm theory) সমাজবিজ্ঞানীদের বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে। কিন্তু দার্শনিকগণ কুনের সাথে একমত নন। কুনের বক্তব্য মেনে নিলে বৈজ্ঞানিকদের সকল পরীক্ষা নিরীক্ষা অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়, তাত্ত্বিক আদল পরিবর্তিত না হওয়া পর্যন্ত এ সব পরীক্ষা নিরীক্ষা তত্ত্বকে প্রভাবিত করবে না। আসলে তাত্ত্বিক আদলে আকস্মিক বিপ্লব আসে না। ছোট ছোট পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই তাত্ত্বিক আদল পরিবর্তিত হয়। উপরন্তু একটি আদল অন্য আদলের চেয়ে শ্রেয় তা প্রমাণ করা সহজ নয়। কাজেই আদল পরিবর্তনের ফলে বৈজ্ঞানিক উন্নয়ন ঘটেছে তা প্রমাণ করা সম্ভব নয়। তত্ত্ব হিসাবে নানা দুর্বলতা সত্ত্বেও কুনের তত্ত্বের দুটো গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। প্রথমত, কুন প্রতিষ্ঠা করেছেন যে, কোন কোন বিজ্ঞানে বিশেষ করে সমাজবিজ্ঞানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রসমূহে (core areas) শুধু বাস্তব অভিজ্ঞতার (empirical evidence) ভিত্তিতে তত্ত্বে পরিবর্তন ঘটে না। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানসমূহের আচরণ সম্পর্কে নানা ধরনের প্রতিকূল উপাত্ত থাকা সত্ত্বেও অর্থনীতিবিদ্‌গণ এখন পর্যন্ত লাভ—সর্বোচ্চায়নের (profit-maximization) পূর্বানুমান বাতিল করে নি। দ্বিতীয়ত, কুন আমাদের সবাইকে মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, বিজ্ঞান সামাজিক পরিবেশের মধ্যে গড়ে ওঠে। তাই বিজ্ঞানের সমাজতত্ত্বকে উপেক্ষা করার জো নেই।  

আদল তত্ত্বের (paradigm theory) পরবর্তী পর্যায়ে ভবিষ্যদ্বাণীমূলক নিমিত্তবাদ (predictive instrumentalism) উপস্থাপিত হয়। এ তত্ত্বের মূল বক্তব্য হল, সকল বৈজ্ঞানিক তত্ত্বই হচ্ছে ভবিষ্যদ্বাণীর নিমিত্ত মাত্র। এ সব তত্ত্বের কার্যকারিতা নির্ভর করে সঠিক ভবিষ্যদ্বাণীর সাফল্যের উপর। অর্থনীতিতে এই দর্শনের প্রধান প্রবক্তা হলেন মিল্টন ফ্রিডম্যান। তাঁর মতে অর্থনৈতিক তত্ত্বের গ্রহণযোগ্যতার কষ্টিপাথর হল, এই তত্ত্ব সঠিকভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে কি না। যদি তত্ত্ব সঠিকভাবে ভবিষ্যদ্বাণী না করতে পারে তবে তত্ত্বের পূর্বানুমান সঠিক হলেও কিছু লাভ নেই। আর যদি সঠিকভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করা যায় তবে যে সব পূর্বানুমান ব্যবহৃত হয় সেগুলো সঠিক না হলেও কিছু যায় আসে না। মিল্টন ফ্রিডম্যানের লেখা পড়লে এক পাদ্রী সম্পর্কে একটি গল্প মনে পড়ে যায়। একজন অত্যন্ত ধার্মিক পাদ্রী সারা জীবন সৎ পথে থেকে ধৰ্ম সাধনা করেন। মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে সেই পাদ্রী সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত একজন বেপরোয়া ট্যাক্সি-চালকের শেষকৃত্য সম্পাদন করেন। এর কয়দিন পর পাদ্রী নিজে মারা যান। স্বর্গে যাওয়ার পর পাদ্রী দেখতে পান যে, ট্যাক্সি চালকেরও স্বর্গে স্থান হয়েছে। কিন্তু স্বর্গে ট্যাক্সি চালকের মর্যাদা পাদ্রী সাহেবের অনেক ঊর্ধ্বে। পাদ্রী মনঃক্ষুণ্ন হয়ে সেন্ট পিটারকে বললেন, ট্যাক্সি চালকটি মাতাল হয়ে বেপরোয়া গাড়ি চালাত এবং নানা কুকর্মে লিপ্ত থাকত। তিনি সারা জীবন ধর্মকর্ম করেছেন, অথচ স্বর্গে তাঁর মর্যাদা ট্যাক্সি চালকের নীচে। স্বর্গে এ ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণ করা ন্যায় বিচার নয়। সেন্ট পিটার জবাব দিলেন, “দেখ হে বাপু, স্বর্গে স্থান নির্ভর করে কার্যকারিতার উপর। তুমি অবশ্যই নিজে ধর্মকর্ম করেছ। কিন্তু তুমি খুব বেশি লোককে দিয়ে প্রার্থনা করাতে পারনি। গির্জায় তোমার বক্তৃতা শুনে বেশির ভাগ শ্রোতা ঘুমিয়ে পড়ত। কিন্তু বেপরোয়া ট্যাক্সি চালক যখনই গাড়ি চালাত, গাড়ির আরোহীরা ভয়ে জোরে জোরে (প্রাণ বাঁচানোর জন্য ) ভগবানের কাছে প্রার্থনা করত। ভগবানের দৃষ্টিকোণ থেকে তোমার চেয়ে ট্যাক্সি চালক অনেক কার্যকর। তাই স্বর্গে তার স্থান উপরে। 

বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে সঠিক ভবিষ্যদ্বাণী করাই যথেষ্ট নয়, সঠিক পদ্ধতিতে সঠিক ভবিষ্যদ্বাণী করতে হবে। কাকতালীয়ভাবে ভবিষ্যদ্বাণী সঠিক হলে চলবে না। পূর্বানুমান ভুল হলেও সিদ্ধান্ত সঠিক হবে এ ধরনের ধারণা অর্থনীতিবিদদের সম্পর্কে একটি বহুল-প্রচলিত গল্প মনে করিয়ে দেয়। একবার একটি নির্জন দ্বীপে একজন প্রকৌশলী, একজন পাদ্রী ও একজন অর্থনীতিবিদ্ আটকা পড়েন। তাঁদের সাথে একটি টিনের বাক্স ভর্তি খাবার ছিল। টিনের বাক্সটি খোলার জন্য কোন যন্ত্র ছিল না। প্ৰথমে প্রকৌশলীকে টিনের বাক্সটি খোলার জন্য অনুরোধ করা হয়। প্রকৌশলী দ্বীপে যে সব পাথর, ডালপালা পাওয়া যায় তা ব্যবহার করে টিনের বাক্সটি খোলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এবার প্রকৌশলীটি পাদ্রীকে এ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতে অনুরোধ করেন। পাদ্রী তাঁর অনুরোধ শুনে হাঁটু গেড়ে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেন, যাতে তিনি এ বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার মত ব্যবস্থা করেন। দীর্ঘক্ষণ প্রার্থনা করার পরও ভগবানের কাছ থেকে কোন সাড়া পাওয়া যায়নি। তখন দু’জনে অর্থনীতিবিদের পরামর্শ চাইলেন। অর্থনীতিবিদ্ সঙ্গে সঙ্গে বললেন, “অনুমান করুন টিনের বাক্স খোলার যন্ত্র আমাদের কাছে রয়েছে।” কিন্তু অনুমান করা ছাড়া অর্থনীতিবিদ্ আর কোন পরামর্শ দিতে পারেনি। 

দীর্ঘদিন ধরে বিজ্ঞানের দর্শন সম্পর্কে বিভিন্ন তত্ত্বের অপ্রতুলতার ফলে সম্প্রতি এক নতুন দর্শনের জন্ম হয়েছে। এ দর্শনের নাম হল দার্শনিক নৈরাজ্য (philosophical anarchism)। এ মতবাদের প্রধান প্রবক্তা হলেন ফেয়েরাবেন্ড (Feyerabend) । S তাঁর লেখা পড়লে ১৯৭১ সালে আমার এক তরুণ সহকর্মী আমাকে যে উপদেশ দিয়েছিলেন সেটা মনে পড়ে যায়। তিনি বলেছিলেন, “ঠেইলা খেলেন, ফাউল নাই।” আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে যে, ফেয়েরাবেন্ডের জগতেও ফাউল নেই। ফেয়েরাবেন্ডের শ্লোগান ছিল –”Anything goes” অর্থাৎ সব কিছুই চলবে। ফেয়েরাবেন্ডের যুক্তি হল যে, কোন বিজ্ঞানীই বিজ্ঞানের দর্শনের আদর্শ প্রকরণ অনুসরণ করে বিজ্ঞান চর্চা করেনি। যদি বিজ্ঞানীরা বিশেষ প্রকরণে বন্দী হয়ে যেত তবে বিজ্ঞানের বিকাশই সম্ভব হত না। অবশ্য ফেয়েরাবেন্ড এ কথাও বলেছেন যে, সব কিছু চলবে মানে এই নয় যে বিজ্ঞান চর্চার কোন পদ্ধতি নেই। এর অর্থ হল, যে কোন পদ্ধতি দিয়েই বিজ্ঞান চর্চা সম্ভব। ফেয়েরাবেন্ডের বক্তব্য হল সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য একটি মাত্র পদ্ধতি নেই, বিভিন্ন সমস্যার ক্ষেত্রে বিভিন্ন পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হবে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে, দার্শনিক নৈরাজ্য বিজ্ঞানের জগতে নৈরাজ্য সৃষ্টি করেনি, বরং বিজ্ঞানের জটিলতা ও বহুমাত্রিকতা এবং বিজ্ঞানীদের স্বাধীনতার গুরুত্ব তুলে ধরেছে। 

দার্শনিক নৈরাজ্যের পাশাপাশি বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে “বিশৃঙ্খলা তত্ত্ব বা chaos theory”র উদ্ভব হয়েছে।১২ এতদিন বিজ্ঞানের জগত ছিল সমস্থিতির (equilibrium); এ জগত ছিল বিন্যস্ত (orderly)। এ জগতে বিশৃঙ্খলা ও অনিয়মের স্থান ছিল না। বিশৃঙ্খলা-তত্ত্বের প্রবক্তারা এ জটিল জগতের সমাধান খুঁজছেন। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, গঠনকারী এককসমূহের ব্যবহার সমগ্র ব্যবস্থা থেকে ভিন্ন। প্রচলিত বৈজ্ঞানিক সূত্রে এ সব বৈসাদৃশ্যের কোন ব্যাখ্যা ছিল না। অত্যন্ত জটিল ও বিস্তারিত অঙ্কের ভিত্তিতে “বিশৃঙ্খলা তত্ত্ব” বিজ্ঞানের জগতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। “বিশৃঙ্খলা তত্ত্ব” ইতোমধ্যে অর্থনীতিবিদদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। শেয়ারবাজারের ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা তত্ত্ব প্রয়োগ করা হচ্ছে। পল ক্রুগম্যান বিশৃঙ্খলা তত্ত্বের ভিত্তিতে আঞ্চলিক অর্থনীতির বিশ্লেষণ করেছেন।১৩ 

বিজ্ঞানের দর্শনের ক্ষেত্রে নতুন নতুন বিতর্কের সাথে সাথে বার বার প্রশ্ন উঠছে অর্থনীতি আদৌ বিজ্ঞান কি না। অর্থনীতিবিদ্ ম্যাকলস্কির (McCloskey) মতে অর্থনীতির পদ্ধতি আসলে বৈজ্ঞানিক নয়। তাঁর মতে অর্থনীতি হচ্ছে বাগ্মিতার মাধ্যমে বক্তব্য বোঝানোর প্রয়াস (rhetorical persuasion)। ম্যাকলস্কির বক্তব্যের পক্ষে যুক্তিসমূহ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে একজন বিশেষজ্ঞ লিখেছেন”: 

Economic theories and models do not speak for themselves and against their rivals. Data do not speak for or against theories. Logic does not speak for or against theories. Economists speak for or against theories by appealing to data, logic and a number of other things. Economists attempt to justify theories by trying to persuade their audiences. 

(অর্থনৈতিক তত্ত্ব ও আদলসমূহ নিজেরা নিজেদের সপক্ষে এবং প্রতিদ্বন্দ্বী তত্ত্বের বিপক্ষে কথা বলে না। উপাত্ত কোন তত্ত্বের পক্ষে বা বিপক্ষে কথা বলে না। তর্কশাস্ত্র কোন তত্ত্বের পক্ষে বা বিপক্ষে কথা বলে না। অর্থনীতিবিদ্‌গণ উপাত্ত, তর্ক ও অনেক কিছু ব্যবহার করে কোন তত্ত্বের পক্ষে বা বিপক্ষে বক্তব্য রাখেন। অর্থনীতিবিদ্রা তাঁদের শ্রোতাদের মধ্যে প্রত্যয় সৃষ্টি করে তাঁদের তত্ত্বের গ্রহণযোগ্যতা প্রতিপাদন করেন।) 

ম্যাকলস্কির বাগ্মিতা চাপাবাজি নয়। এ বাগ্মিতা হচ্ছে একটি সামাজিক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে বক্তাদের বক্তব্য শ্রোতাদের কাছে গ্রহণযোগ্য করা হয়। ম্যাকলাস্কির মতে অর্থনীতিতে চূড়ান্ত সত্য কিছু নেই। অর্থনীতিতে সত্য অর্থ নিশ্চয়তা নয়। অর্থনীতিতে সত্য অর্থ হল আপাতদৃষ্টিতে যথার্থ বা যুক্তিসঙ্গত (plausible)। এ ধরনের যথার্থতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে যুক্তিতর্কের মাধ্যমে। এ ধরনের যুক্তিতর্কে নিয়ম মেনে চলতে হবে। এ প্রক্রিয়াতে জানার আগ্রহ থাকতে হবে এবং অন্যের মতের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকতে হবে। যাঁরা অভিজ্ঞ অর্থনীতিবিদ্ একমাত্র এঁদের পক্ষেই এ ধরনের যুক্তিতর্ক ব্যবহার করা সম্ভব। 

সকল ধরনের বিজ্ঞানে ও বিশেষ করে অর্থনীতিতে বাগ্মিতার বিশেষ ভূমিকা অবশ্যই রয়েছে। কিন্তু অর্থনীতির সবটুকুই বাগ্মিতা এ ধরনের দাবি অতিরঞ্জিত। অর্থনীতিবিদ্‌গণ এত যত্নের সাথে যে বিপুল পরিমাণ তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করছেন তার সবটুকুই ছলনা নয়। অবশ্য ম্যাকলস্কি দাবি করছেন যে American Economic Reviewতে যে সব প্রবন্ধ ছাপা হয় তার শতকরা ৭৫ ভাগ সংখ্যাতত্ত্বের অপপ্রয়োগ করে। কোন কোন অর্থনীতিবিদ্ বস্তুনিরপেক্ষ না থাকতে পারেন, কিন্তু অধিকাংশ অর্থনীতিবিদ্‌ই প্রতারণা করছেন এ দাবি গ্রহণ করা শক্ত। এঁদের অনেকেই লব্ধ উপাত্তের বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ করে তাঁদের মতামত পরিবর্তন করে থাকেন। অর্থনীতিতে বাগ্মিতা ব্যবহৃত হয়, কিন্তু অর্থনীতি শুধু বাগ্মিতাতে সীমাবদ্ধ নয়। 

বিজ্ঞানের দর্শন সম্পর্কে দীর্ঘ ও অমীমাংসিত বিতর্ক হতে বিজ্ঞান ও দর্শনের দুর্বলতা ও সবলতা দুটো দিকই বের হয়ে আসছে। বিজ্ঞানের দীর্ঘ পথ পরিক্রমাতে আজ আমরা বুঝতে পারছি বিজ্ঞান হচ্ছে জ্ঞানের সন্ধান, জ্ঞানের প্রাপ্তি নয়; বিজ্ঞান জ্ঞানের সংকলন নয়, বিজ্ঞান হল জ্ঞান অর্জনের কার্যকলাপ। এই নতুন মতবাদ অবধারণমূলক নিমিত্তবাদ (cognitive instrumentalism) হিসাবে পরিচিত। এ মতবাদ অনুসারে তর্ক ও উপাত্তসমূহ অবধারণের বা উপলব্ধির নিমিত্ত মাত্র। বিজ্ঞানের সাধনার ফলে বিশ্ব সম্পর্কে যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য জ্ঞান পাওয়া যাবে, কিন্তু এই জ্ঞানকে নিশ্চিত গণ্য করা ঠিক হবে না। বিজ্ঞানের যত বিকাশ হবে ততই আমাদের জ্ঞানের অপূর্ণতা কমে আসবে। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, আমাদের জ্ঞান কখনও সম্পূর্ণ ও নিখুঁত হবে। প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ও অর্থনীতিতে আমাদের জ্ঞান অনেক ক্ষেত্রেই থাকবে অনিশ্চিত (contingent)। বস্তুনিরপেক্ষ নিশ্চিত জ্ঞান অর্থনীতির আদর্শ হিসাবে থাকবে –কিন্তু অর্থনীতি সংক্রান্ত জ্ঞানের বিশেষত্ব হবে না। এতে আমাদের অবশ্য হতাশ হওয়ার কারণ নেই। অধ্যাপক স্কট গর্ডন (Scott Gordon) সুন্দরভাবে বলেছেন: 

Perfect cleanliness is also impossible but that does not serve as a warrant for not washing, much less for rolling in a manure pile. (নিখুঁত পরিচ্ছন্নতাও অসম্ভব, কিন্তু এতে পরিষ্কার না করার ন্যায্যতা প্রতিপন্ন হয় না আর এ জন্য ময়লার স্তূপে গড়াগড়ি খাওয়ার প্রশ্নও ওঠে না।) 

পরিপূর্ণ ও নিখুঁত জ্ঞান লাভ সম্ভব না হলেও অর্থনীতিতে ও সামাজিক বিজ্ঞানে আমাদের সাধনা অবশ্যই অব্যাহত রাখতে হবে। 

.

তথ্যসূত্র 

১. Bullivant, Alison, The Little Book of Humorous Quotations (Bristol : Parragon, 1994, p. 147 

২. Durant, Will, The Life of Greece (New York: Simon and Schuster, 1966), p. 643 

৩. Scruton, Roger, Modern Philosophy (Hammondsworth : Penguin Books, 1994), p. 402 

8. Peter, Laurence J., Peter’s Quotations (New York: Quill, 1977), p. 383 

৫. Scruton, Roger, 2, 

৬. Gordon, Scott, The History and Philosophy of Social Science (London: Routledge, 1991), p. 40 

৭. Kelejian, Harry H. & Oates, Wallace E., Introduction to Econometrics (New York: Harper and Row, 1974), pp 83-84 

৮. Blaug, Mark, The Methodology of Economics (Cambridge: Cambridge University Press, 1980), p. 124 

৯. Krugman, Paul, Peddling Prosperity (New York : W. W. Norton & Company, 1994), p. 112 

১০. Kuhn, J. S., The Structure of Scientific Revolution (Chicago: University of Chicago Press, 1970) 

১১. Feyerabend, P. K., Against Method, Outline of An Anarchist Theory of Knowledge (London : NLB, 1975) 

১২. Gleick, James, Chaos (New York: Penguin Books, 1987) 

১৩. Krugman, Paul, The Self-Organizing Economy (Cambridge : Blackwell Publishers, 1996) 

১৪. Maki, Uskali, “Diagnosing McCloskey”, Journal of Economic Literature, September 1995, vol XXXIV, p. 1303 

১৫. Gordon, Scott, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৬৬৭ 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *