ছয়
লাইব্রেরি ঘরে জড়ো হয়েছি আমরা আর সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ। বই আর বৈজ্ঞানিক সংগ্রহের মাঝে বসে গত কয়েকদিনের স্মৃতিকে দুঃস্বপ্নের মতোই লাগাছে। একদিকে আপন মনে কলগোলামের সঙ্গে বল খেলে চলেছে উপেন। তার একটু দূরেই গোটাকতক বন্দুক নিয়ে পরিষ্কার করতে বসেছে চিত্ত আর রামসহায়। খোলা জানলা দিয়ে বাইরের নীল আকাশের দিকে একবার তাকায় ধূর্জটি।
‘নৃপেন্দ্রনারায়ণের সঙ্গে সুকুমারবাবু সখ্য বোধহয় বহুকাল আগেই ঈর্ষায় পরিণত হয়েছিল। কিন্তু ধূর্ত সুকুমারবাবু সেটা বন্ধুকে কখনও বুঝতে দেননি। তা-ও একরকমভাবে চলছিল। কিন্তু সুকুমারবাবু যেদিন জানতে পারলেন পিংলা পাহাড়ের নিচে অ্যাডামান্টাইন আছে সেদিন আগুনে ঘৃতাহুতি পড়ল। প্রথমে ভালোমানুষ সেজে সুকুমারবাবু বাড়ি বানানোর অছিলায় জায়গাটা চাইলেন। কিন্তু নৃপেন্দ্রনারায়ণ যখন রাজি হলেন না, তখন গোপালের সাহায্যে সুকুমারবাবু আপনার বাড়িতে পিশাচের আক্রমণ করালেন। আপনি তখন যুদ্ধে। তাঁর হয়তো পরিকল্পনা ছিল সবাই খুন হয়ে গেলে আপনি ফেরার আগেই পাহাড়ের তলা থেকে তিনি সবটুকু অ্যাডামান্টাইন তুলে নেবেন।’
উপেনের ছোঁড়া বলটা সৌম্যেন্দ্রনারায়ণের পায়ের কাছে এসে পড়ে। বলটা তুলে নিয়ে উপেনের দিকে বাড়িয়ে ধরেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।
‘কিন্তু চিন্ময়ীর গুলিতে সুকুমারবাবুর প্ল্যান ভেস্তে গেল।’
‘হ্যাঁ। খুব সম্ভব গোপালের চিকিৎসার ব্যবস্থা করে, সুকুমারবাবু গোলকুণ্ডায় আস্তানা গাড়লেন। গোলকুণ্ডার খনি নিজামের এক্তিয়ারে। ইংরেজের শাসনের বাইরে। জল কোনদিকে গড়ায় সেটা দেখার জন্যে নিজামের রাজত্ব থেকে তিনি আপনার গতিবিধির ওপর নজর রাখতে শুরু করলেন। ততদিনে তিনি অপরাধের জগতে অনেকদূর পা রেখে ফেলেছেন, সুতরাং তাঁকে এ কাজে সাহায্য করবার লোকের অভাব হয়নি।’
‘ততদিনে আমিও ফিরে এসেছি।’
‘হ্যাঁ, আপনি ফিরে এসেছেন। এবং ফিরে কেবল আসেননি, ফৌজ থেকে লোক নিয়ে এসেছেন, এবং তাদের সাহায্যে বাড়িটিকে একটি দুর্ভেদ্য দুর্গ বানিয়ে তুলেছেন। আপনাকে সরাসরি আক্রমণ করা অসম্ভব দেখে সুকুমারবাবু অন্য মতলব আঁটলেন।’
উপেনের সঙ্গে বল খেলতে থাকা কলগোলামের দিকে তাকালেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।
‘কলগোলামকে কাজে লাগানো!’
‘হ্যাঁ। কলগোলামকে হলেরিথ কার্ড দিয়েই নির্দেশ দেওয়া হয়ে থাকে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে কলগোলামের একদম কাছে কাউকে যেতে হয়। যুদ্ধের প্রায় শেষের দিকে একটা পরীক্ষা শুরু হয়েছিল। ধরুন কলগোলামকে কোনও বিপজ্জনক জায়গায় নিয়োগ করা হয়েছে। এবার তাকে দূর থেকে নির্দেশ দিতে হবে, কাছে যাওয়া যাবে না। এখানে হলেরিথ কার্ডের ব্যবহার অচল। তখন চেষ্টা শুরু হল যদি আলোর ঝলকানি দিয়ে সঙ্কেতে কলগোলামকে নির্দেশ দেওয়া যায়।
চমকে উঠলেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ
‘আলোর ঝলকানি! মানে সুকুমারবাবুর হেলিওগ্রাফ! সুকুমারবাবুর হেলিওগ্রাফ তাহলে ওই কাজের জন্যে ব্যবহার হত।’
হাসল ধূর্জটি।
‘ঠিকই ধরেছেন। তবে হেলিওগ্রাফের মূল উদ্দেশ্য ছিল নিজের দলের লোকেদের সঙ্গে সংবাদ আদানপ্রদান করা। কারণ ততদিনে সুকুমারবাবু আর গোপালের ত্রাসপশুর চোরাকারবারের ব্যবসা বেশ ফুলে ফেঁপে উঠেছে। কলগোলামকে নির্দেশ দেওয়ার চিন্তাটা হয়তো তাঁর মাথায় পরে আসে।’
দুজন কাজের লোক এসে টেবিলের ওপর চায়ের পট আর পেয়ালা রেখে যায়।
কাপে চা ঢালেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ। এগিয়ে দেন ধূর্জটির দিকে,
‘কিন্তু কলগোলামকে আলোর সঙ্কেতের সাহায্যে নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে তো সেই সাঙ্কেতিক নিয়মাবলীগুলো জানা প্রয়োজন।’
‘অবশ্যই এবং এই সঙ্কেতের নির্দেশ-পঞ্জিকা জোগাড় করতেই সুকুমারবাবুর দরকার হয়ে পড়ল ইন্ডো-ব্রিটিশ ক্লকওয়ার্কসে চুরি করার। বলাই হালদার তখন হায়দ্রাবাদে গা ঢাকা দিয়ে আছে। সুকুমারবাবুর অপরাধ জগতে যোগাযোগ কম নয়। তিনি পয়সার লোভ দেখিয়ে বলাইকে দিয়ে নিজামের কিমিয়াখানা থেকে ক্যালরিক চুরি করালেন, এবং তারই মাধ্যমে নিতাই হালদারের সঙ্গে জোট বাঁধলেন। নিতাই তখন সবে জেল থেকে বেরিয়েছে, তারও পয়সার দরকার। এয়ারশিপে করে সুকুমারবাবু নিতাইকে নিয়ে ইন্ডো-ব্রিটিশ ক্লকওয়ার্কসে চুরি করতে ঢুকলেন। দোতলায় যখন নিতাই সিন্দুক থেকে নগদ টাকা চুরি করছে, সুকুমারবাবু তখন একতলা থেকে সাঙ্কেতিক নির্দেশ-পঞ্জিকা সরালেন। কিন্তু ওই সামান্য টাকাতে সুকুমারবাবুর কোনও আগ্রহ ছিল না। তিনি তখন কুবেরের সম্পদের লোভে পাগল। চুরির শেষে সুকুমারবাবু নিতাইকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিলেন, আর এয়ারশিপের কাপড়টা দিলেন ফাঁসিয়ে, যাতে লোকে মনে করে এয়ারশিপ দুর্ঘটনায় নিতাইয়ের মৃত্যু হয়েছে, এবং বলাই ফের
পালিয়েছে।
স্ট্র্যাণ্ড রোডের মালগুদামে পড়ে থাকা এয়ারশিপের ছবিটা ফের ভেসে উঠল মনের মধ্যে।
‘সুকুমারবাবু ভেবেছিলেন টাকাটা ফেরত পাওয়া গেলে মামলাটা চাপা পড়ে যাবে। তাঁর চুরির আসল উদ্দেশ্যটাও লোকে ধরতে পারবে না।’
‘ঠিক বলেছ যতীন। কিন্তু বলাই এদিকে হায়দ্রাবাদে বসে খবরের কাগজ থেকে জানতে পারল তার ভাই মারা গেছে, আর পুলিস চুরির মামলায় তাকেই খুঁজছে। সে নিজামের কিমিয়াখানায় চুরির খবর আর ইন্ডো-ব্রিটিশ ক্লকওয়ার্কসে চুরির খবর দুটোর কাটিং পকেটে করে সুকুমারবাবুর খোঁজে দুলমিগড় হাজির হল।’
‘কিন্তু কেন? তোমাকে আগেও জিজ্ঞেস করেছিলাম। বলাই পকেটে করে কাটিং দুটো নিয়ে এসেছিল কেন?’
‘খুব সম্ভব সুকুমারবাবুকে ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করবে বলে।’
‘কিন্তু সুকুমারবাবু বোধহয় ভয় পাননি।’
হাসল ধূর্জটি।
‘সুকুমারবাবুর মতো রাঘববোয়ালের সঙ্গে টক্কর নিতে যাওয়াটা বলাইয়ের মতো চুনোপুঁটির উচিত হয়নি। সুকুমারবাবু তাকে খুন করে জঙ্গলের একদম ভেতরে ফেলে দিলেন। মনে করলেন শেয়াল-কুকুরে তার লাশ খেয়ে যাবে। কেউ টের পাবে না।’
একটা লম্বা নিশ্বাস ফেললেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ,
‘কিন্তু ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। বলাইয়ের লাশ একজন গ্রামবাসীর চোখে পড়ে গেল।’
‘হ্যাঁ। পুলিস বলাইকে সনাক্ত করে ফেলল। সুকুমারবাবুর মনে হল হয়তো দেরি করাটা আর সমীচীন হবে না, পুলিসের তদন্ত কোনদিকে এগোয় তার ঠিক নেই, শেষে হয়তো তাঁর কাজই ভেস্তে গেল। তিনি হেলিওগ্রাফ দিয়ে কলগোলামকে সাঙ্কেতিক নির্দেশ পাঠালেন।’
মাথার রগদুটো চেপে ধরলেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।
‘আন্দাজ করতে পারছি সুকুমারবাবু কলগোলামকে দিয়ে কী করাতে চেয়েছিলেন। তবু আপনার মুখ থেকেই শুনি।’
ফের হাসে ধূর্জটি।
‘সুকুমারবাবু যে কলগোলামকে দিয়ে আপনার বাড়িশুদ্ধ সবাইকে হত্যা করাতে চেয়েছিলেন এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু এ ব্যাপারে তাঁর সফল হওয়ার কোনও সম্ভাবনাই ছিল না।’
‘কেন? এ কথা বলছেন কেন?’
বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।
‘আমি এখান আসার আগে ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরিতে সাম্প্রতিককালের খবর ঘেঁটে যা পেয়েছি তাতে মনে হয়েছে এই আলোর মাধ্যমে কলগোলামকে নির্দেশ দেওয়ার প্রতিটি পরীক্ষাই ব্যর্থ হয়েছে। প্রত্যেকবারই কলগোলাম বিগড়ে গেছে।’
উপেনের বলখেলার সঙ্গী একজন বেড়ে গেছে। কলগোলামের সঙ্গে এবার চিত্তও যোগ দিয়েছে। কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে খেলা দেখেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।
‘এরপর কলগোলাম মেরামত করতে কলকাতা থেকে পীতাম্বর এসে হাজির হল।’
‘হ্যাঁ, পীতাম্বর কেবল কলগোলাম সারিয়েই তুলল না। কলগোলাম কেন বিগড়েছিল তাও চট করে আন্দাজ করে ফেলল।’
‘আমাকে জানালো না কেন?’
‘হয়তো আপনি বিশ্বাস করতে চাইবেন না মনে করে। কিংবা হয়তো তার মনে হয়েছিল অফিসে আগে জানানো দরকার।’
কলগোলামের বুক থেকে আগের দিন ইংরেজিতে ‘লাইট’ শব্দটা বেরোনোর কথা মনে পড়ে গেল আমার।
‘কিন্তু উপেনকে জানিয়েছিল।’
‘হ্যাঁ, উপেনকে পীতাম্বর জানিয়েছিল যে আলোর ঝলকানিতে তার কলগোলাম বিগড়ে গেছে।’
মৃদু হাসেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ,
‘ওটা হয়তো পীতাম্বরের দোষ না। মাঝে মধ্যে উপেন এমন নাছোড়বান্দার মতো করে যে তাকে না বলাটা মুস্কিল হয়ে পড়ে।’
‘সুকুমারবাবু বোধহয় পীতাম্বরের ওপর নজর রাখছিলেন। তাকে পোস্ট-অফিসের পথে একলা পেয়ে স্রেফ সন্দেহের বশেই হোক, কিংবা ভুলিয়ে-ভালিয়ে তার পেট থেকে কথা বের করে নিয়েই হোক, তাকে খুন করলেন।’
সৌম্যেন্দ্রনারায়ণের দিকে বল ছোঁড়ে উপেন। বলটা লুফে নিয়ে ফের ছুঁড়ে দেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ, মাঝপথে লুফে নেয় কলগোলাম। আনন্দে চিৎকার করে ওঠে উপেন।
‘পীতাম্বর মারা যেতে আমি কলকাতায় গেলাম।’
‘হ্যাঁ। এবার সুকুমারবাবু সোজা আপনার ওপর আক্রমণ করালেন। ঘরে বিষাক্ত কীট ছেড়ে দিলেন। আপনার মনে ধারণা পোক্ত হল যে আপনার পরিবারকে ঘিরে ফের কোনও ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। আপনি হেমের সঙ্গে আমার কাছে পৌঁছলেন। এর পরের ঘটনাগুলো আপনি জানেন।’
উপেনের আনন্দের চিৎকারে গমগম করছে লাইব্রেরি ঘরখানা। দু-হাতে হাঁটু জড়িয়ে ধরে রামসহায়ও উপভোগ করছে উপেন, চিত্ত আর কলগোলামের বলখেলা।
‘কিন্তু সুকুমারবাবুর ওপর তোমার সন্দেহ হল কী করে?’
প্রশ্ন করি ধূর্জটিকে।
‘দেখ, প্রথমটায় সুকুমারবাবুই যে আসল হোতা সে কথা মনে হয়নি। কিন্তু ঝোপের ভেতর থেকে যখন কাটিং দুটো কুড়িয়ে পেলাম, বুঝলাম যে বলাই বোড়ে মাত্র। এই দাবার রাজা-মন্ত্রী দুলমিগড়েই কোথাও লুকিয়ে আছে।’
‘কেন?’
‘ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরিতে গিয়ে নিয়মিত সংবাদপত্র হাঁটকানো যে আমার অভ্যেস তুমি জানো। এইটা করতে করতে আলাদা আলাদা সংবাদপত্রের ছাপা আর কাগজের মান সম্বন্ধে আমার একটা মোটামুটি ধারণা হয়ে গেছে। ঝোপে পাওয়া কাটিং এর চেহারা দেখে মনে হল সে দুটো হায়দ্রাবাদের কোনও একটা বিশেষ সংবাদপত্র থেকে নেওয়া। তুমি জানো দ্বিতীয় কাটিংটা ছিল ইন্ডো-ব্রিটিশ ক্লকওয়ার্কসে চুরির খবর। কিন্তু বলাই যদি এ খবর হায়দ্রাবাদে বসে পেয়ে থাকে তাহলে আমাদের থিয়োরিটাই পালটে যায়। সেক্ষেত্রে ধরে নেওয়া যায় বলাই এই চুরিতে অংশ নেয়নি, চুরির খবর পেয়ে দুলমিগড়ে কারোর সঙ্গে মোলাকাত করতে এসেছিল।
‘সুকুমারবাবুর ওপর তোমার সন্দেহ হল কেন?’
‘প্রথমদিন যখন সুকুমারবাবুর সঙ্গে আলাপ হয় তখন উনি যখন খবরের কাগজের পাতা ওল্টাচ্ছিলেন, কোন পাতায় উনি মনোযোগ দিয়ে নজর রাখছিলেন সেটা খেয়াল রাখছিলাম। উনি চলে যেতে সেই পাতাটা দেখতে চোখে পড়ল সেখানে অ্যাডামান্টাইন কিনতে চাওয়ার বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে। তখনই মনে খটকা লেগেছিল। সুকুমারবাবু কাছে অ্যাডামান্টাইন কোথায়, যে তিনি সে বস্তুটি কিনতে চাওয়ার বিজ্ঞাপন দেখছেন?’
‘তার পরের দিন গিরিজাপ্রসাদ খুন হল।’
‘হ্যাঁ। বুঝতে পারলাম তাকে কিছুর টোপ দিয়ে ডেকে নিয়ে গিয়ে খুন করা হয়েছে।’
চিঠির পোড়া অংশের কথা মনে পড়ে গেল।
‘কিসের টোপ? ‘অর্থাগম’ হবার?’
হেসে ফেলল ধূর্জটি।
‘হয়তো অনেকটা তাই। তবে ‘গম’ শব্দটা সম্ভবতঃ নাগমণি শব্দের অংশ। জহুরী গিরিজাপ্রসাদকে নাগমণি বিক্রির লোভ দিয়ে খুন করা হয়।’
‘কিন্তু কেন?’
‘ওই ‘কেন’র মানে খুঁজতে গিয়েই সুকুমারবাবুর ওপর সব সন্দেহটুকু গিয়ে পড়ল। দেখ, এই রহস্যের সবচাইতে জটিল গ্রন্থিটুকু ছিল মোটিভ। কীসের স্বার্থে এই নাটকের হোতা মেতেছে এই হত্যালীলায়? কী তার উদ্দেশ্য? এটা কিছুতেই আমার কাছে পরিষ্কার হচ্ছিল না। তোমার হয়তো মনে আছে সেদিন কথাচ্ছলে গিরিজাপ্রসাদ বলেছিল যে যক্ষরা মাটির নিচে অনেক কিছু দেখতে পায়। সে সত্যি কিছু জানত, না কি এমনিই কথার কথা বলেছিল জানা নেই, কিন্তু একথার পরপরই যখন সে খুন হল তখন বুঝলাম এই রহস্যের মোটিভ লুকিয়ে আছে মাটির তলায়। তার এই কথাটুকু বলার সময়ে সেখানে আমরা আর কুমারবাহাদুর ছাড়া উপস্থিত ছিলেন কেবল সুকুমারবাবু। এ ছাড়া সেদিন তাঁর অ্যাডামান্টাইনের বিজ্ঞাপনের প্রতি আকর্ষণটাও চোখ এড়ায়নি। অতএব দুইয়ে দুইয়ে চার করতে সময় লাগল না। তবু খুনের ধরনটা দেখে মনের মধ্যে একটু খুঁতখুঁতানি ছিল—’
‘খুঁতখুঁতানি? কেন?’ প্রশ্ন করি বিস্ময়ের সঙ্গে।
‘ওই যে বললাম খুনের ধরনটা দেখে। মনে হল অত জোর আঘাত তো কেবল কলগোলামের শক্তিতেই সম্ভব। কিন্তু তারপর খোঁজ নিয়ে জানলাম সারাদিন উপেন আর কলগোলাম লাইব্রেরি ছেড়ে নড়েনি। সমস্ত সন্দেহটা তখন সুকুমারবাবুর ওপরে গিয়ে পড়ল।’
জানলার বাইরের নীল আকশের বুকে সাদা রেখা টেনে উড়ে যায় কয়েকটা হাঁস। সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ বললেন,
‘এই জন্যেই কি আপনি শিউলালকে কিছু তদন্ত করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন?’
‘হ্যাঁ। আর তার জন্যে খানিকটা সুকুমারবাবু নিজেই দায়ী। নিজেকে অতিচালাক ভেবে আমার চোখের সামনে স্টাহ্লের বইখানা না ফেললেই পারতেন। তার আগেই গোপালের দোকানে বেচারের বই দেখে এসেছি। এইটুকু জায়গায় দু-দুটো লোকের কাছে ফ্লজিস্টন থিয়োরির বই! কাকতালীয়? না এরা দুজন পরস্পরকে চেনে? শিউলালকে তাই খোঁজ নিতে বললাম।’
‘আপনি শিউলালকে দিয়ে তদন্ত শুরু করাতেই আপনার ওপর আক্রমণ হল।’
‘হ্যাঁ। আমরা আসার সময়ে দোকানে বসানোর অছিলায় গোপাল খুব সম্ভব আমার ঘ্রাণ তার জ্যাকুলিসকে শুঁকিয়ে রেখেছিল। প্রয়োজনে সেটাই
কাজে লাগায়।’
‘কিন্তু আপনার এগুলো সবই অনুমান। কঠিন প্রমাণ কিছু নেই।’
মাথা নাড়ে ধূর্জটি।
‘জানি। সেইজন্যেই চিত্ত আর রামসহায়কে সরিয়ে দিয়ে সুকুমারবাবুকে একটা আক্রমণের সু্যোগ করে দিলাম। আর উপেনকেও বলে এলাম আমরা বিপদে পড়লে রঘুকে পাঠিয়ে দিতে। প্রমাণের অপেক্ষায় থেকে আবার কারো প্রাণ যাক সে ঝুঁকি আমি আর নিতে চাইনি।’
‘আমার বাবার এতদিনের বন্ধু। তাঁর এইরকম আচরণ—’
মাঝপথে থেমে যান সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ। খেয়াল করি তাঁর চোখের কোন চিকচিক করছে।
নীল আকাশের বুকে ফের উড়ে যায় একসারি হাঁস। সেদিকে তাকিয়ে থাকে ধূর্জটি।
‘অর্থতৃষ্ণা। অর্থতৃষ্ণায় সুকুমারবাবু সব ভুলেছিলেন। মানুষ থেকে নির্দয় নরপশু হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন।
.
পরিভাষাকোষ
অলস্টার: Ulster; ওভারকোট জাতীয় শীতপোষাক
আইকর: Ichor; দানব রক্ত
অ্যাডামান্টাইন: কল্পিত বিরল ধাতু
এল্ড্রিচ: Eldritch; অতিপ্রাকৃত
কলগোলাম: Clockwork Robot
কমিশনার রেজিনাল্ড ক্লার্ক: Sir Reginald Clarke, ১৯১৬-১৯২৩ সময়কালে কলকাতার পুলিস কমিশনার
করিমুণ্ড রাশি: Coma Berenices
ক্যালরিক: The substance of heat, as proposed by Lavosier
কিমিয়া: Alchemistry
কিমিয়াখানা: Alchemistry Laboratory
জাম্বুরক: ঘোড়া বা উটের পিঠে বইবার উপযুক্ত ক্ষুদ্রাকার তোপ
জাজেল: দুর্গপ্রাকারে ব্যবহৃত সুদীর্ঘ নলের বন্দুক
জ্যোতিষ যন্ত্র: Orrery
জেনারেল টাউন্সহেন্ড: Major General Sir Charles Townshend (১৮৬১-১৯২৪); প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মেসোপটেমিয়ার লড়াইয়ে ব্রিটিশ ফৌজের অধিনায়ক
তোড়া: Flintlock / Matchlock
তোড়াদার জাজেল: জাজেল ও তোড়া দ্রষ্টব্য
ত্রাসপশু: Monster; অতিপ্রাকৃত পশু
থ্যাকার্স ডিরেক্টরি: থ্যাকার্স ইণ্ডিয়ান ডিরেক্টরি কলকাতা থেকে প্রকাশিত ভারতে ব্রিটিশ রাজত্বের তথ্য সমন্বিত ডিরেক্টরি
নব নক্ষত্র: Nova
ফ্লজিস্টন: Phlogiston; A substance supposed by 18th-century chemists to exist in all combustible bodies, and to be released in combustion
ফাদার লাফঁ: Father Eugene Lafont; সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের অধ্যক্ষ; ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশান অব কাল্টিভেশন অব সায়েন্সের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা।
বজ্রবহ্নি: বজ্রের প্রাকৃতিক বিদ্যুৎ; (ঋণ: রবীন্দ্রনাথ)
বহুরূপ নক্ষত্র: Variable Star
বেচার: Johan Joachim Becher
মাছি: Bead, Sight; বন্দুকের নিশানা কল
যুগল নক্ষত্র: Binary Star
লুকানের ফারসালিয়া কেতাব: রোমান কবি মার্কাস অ্যানিয়াস লুকানাস (৩৯-৬৫ খ্রীষ্টাব্দ) রচিত কাব্য Pharsalia
স্টাহ্ল: Georg Ernst Stahl
হাওদা পিস্তল: হাতির হাওদার পাশে বেঁধে রাখার উপযুক্ত অতিকায় গাদা পিস্তল
হেলিওগ্রাফ: Heliograph; সূর্যকিরণের সাহায্যে সঙ্কেত পাঠানোর যন্ত্র
ৎসুচিনোকো: Tsuchinoko; জাপানের কল্পিত সর্পশ্রেণীর বিষাক্ত জীব