অর্থতৃষ্ণা – ৫

পাঁচ

পরের দিন নিচে যখন নামলাম তখন টেবিলে চায়ের সরঞ্জাম সাজানো। চেয়ারে বসে একটা ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাচ্ছেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।

সুকুমারবাবু এসে পৌঁছন একটু বাদে। হাতে খবরের কাগজ, কাঁধে একটা ঝোলা ব্যাগ।

ব্যাগটার দিকে ইঙ্গিত করে ধূর্জটি,

‘সব তল্পিতল্পা গোটানোর পালা না কি?’

রুমাল বের করে মুখ মোছেন সুকুমারবাবু।

‘হ্যাঁ! আর বলবেন না। যন্ত্রপাতি সব এদিক সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, যাবার আগে সব এক জায়গায় জড়ো করছি।’

ম্যাগাজিনটা নামিয়ে রাখেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ,

‘এইবার বলুন এই রহস্যের আপনি কী সমাধান সূত্র পেলেন।’

কাপে চা ঢালে ধূর্জটি।

‘বলছি। তবে তার আগে একটা কাজ সেরে নিই। যতীন, কুমারবাহাদুরের বন্দুক আর কার্তুজের বেল্টটা আমি সিঁড়ির পাশে রেখে এসেছি। ওটা নিয়ে এস তো।’

হুকুম তামিল করি।

বন্দুক আর বেল্ট সৌম্যেন্দ্রনারায়ণের হাতে তুলে দেয় ধূর্জটি।

‘এই নিন কুমারবাহাদুর, আপনার বন্দুক। এইবার শুরু করি।’

কিন্তু ধূর্জটির শুরু করা হয় না। তার আগেই সুটকেশ হাতে গোপাল এসে নমস্কার করে দাঁড়ায়।

‘বাবু, আপনার কী কাগজ কলমের দরকার ছিল?’

অপ্রসন্ন দৃষ্টিতে গোপালের দিকে তাকান সুকুমারবাবু।

‘তুমি বাপু বড্ড অসময়ে এসে পড়েছ। আমাদের দরকারী কথাবার্তা সেরে নিই, ততক্ষণ তুমি ঘুরে এস না হয়।’

‘আরে না-না থাক থাক।’

বাধা দেয় ধূর্জটি।

‘আমাদের কতক্ষণই বা লাগবে। এইখানেই অপেক্ষা করুক না।’

চুপ করে যান সুকুমারবাবু, কিন্তু তাঁর মুখ দেখে মনে হয় না যে ব্যাপারটা তাঁর খুব একটা মনঃপূত হয়েছে।

চায়ে চুমুক দেয় ধূর্জটি।

‘আসলে ব্যাপারটা বেশ জটিল। আর এর শিকড় রয়েছে আমাদের দেশের বিজ্ঞানচর্চার ইতিহাসে।’

ভুরু কোঁচকান সুকুমারবাবু।

‘বিজ্ঞানচর্চার সঙ্গে এই সব খুনের কী সম্পর্ক?’

‘সম্পর্ক আছে।’

চায়ের কাপ নামিয়ে রাখে ধূর্জটি।

‘আমাদের দেশে বিজ্ঞানচর্চার প্রধান অন্তরায় হল অর্থ। সরকার বাহাদুর কলেজ ইউনিভার্সিটি বসিয়েছেন বটে, কিন্তু সেখান বিজ্ঞান সাধনার জন্যে উপযুক্ত যন্ত্রপাতি বা গবেষণাগার কিছুই নেই। এইবার ধরুন একজন বিত্তবান মানুষ, বিজ্ঞানের উপাসক, মেধাবী, নিজের খরচে যন্ত্রপাতি কিনে গবেষণা চালিয়ে ফেললেন, এবং বিজ্ঞানী মহলে যথেষ্ট প্রতিষ্ঠা পেলেন। আর একজন, তিনিও যথেষ্ট মেধাবী, বিজ্ঞানে তিনিও সমান রকমের উৎসাহী, কিন্তু তাঁর কাছে পর্যাপ্ত অর্থ নেই। অতএব তাঁর উচ্চ গবেষণার পথ রুদ্ধ হয়ে রইল। প্রশ্ন হল এই অবস্থায় দ্বিতীয় ব্যক্তি কী করবেন?’

‘আপনি কি আমার আর নৃপেনের তুলনা টানছেন?’

রাগত স্বরে প্রশ্ন করেন সুকুমারবাবু।

মৃদু হাসে ধূর্জটি,

‘আমি কারোরই তুলনা টানছি না সুকুমারবাবু। আমি একটা থিয়োরি খাড়া করছি কেবল। সমস্তটা শুনেই নিন না।’

প্লেট থেকে একটা পেস্ট্রি তুলে নেয় ধূর্জটি।

‘এবার আমাদের এই কল্পিত দ্বিতীয় ব্যক্তি হঠাৎ আবিষ্কার করলেন, প্রাকৃত বিজ্ঞান সাধনায় অর্থ অন্তরায় হলেও, অতিপ্রাকৃত বিজ্ঞানের সাধকদের কিন্তু অর্থোপার্জনের প্রভূত সুযোগ রয়েছে। জ্ঞানকে আমরা আলোর সঙ্গে তুলনা করি বটে, কিন্তু এই অতিপ্রাকৃত জ্ঞানের ফলিত ব্যবহারের কয়েকটা অন্ধকারাচ্ছন্ন দিকও আছে। সরকার বাহাদুর সে সব ব্যবহারকে খুব একটা সুনজরেও না দেখলেও এক শ্রেণীর লোক কিন্তু সেই সব কাজের জন্যে দু-হাতে পয়সা খরচ করতে সর্বদাই প্রস্তুত থাকে।’

পড়ন্ত বেলার রোদ এসে পড়েছে চকমিলান উঠোনে। মাথার ওপরের আকাশের নীল রংটুকু খানিকটা গাঢ় হয়ে এসেছে। ওপরের বারন্দায় একটা পাখি দু-একবার ডাকাডাকি করে উড়ে যায় আকাশে।

একটা সিগ্রেট ধরায় ধূর্জটি। উড়ে যাওয়া পাখির সন্ধানে বাতাসে ভেসে যায় ধোঁয়া।

‘আমাদের এই দ্বিতীয় বৈজ্ঞানিক তাঁর অধ্যয়নের অভিমুখই পালটে ফেললেন। ল্যাভোসিয়ার আর ক্যাভেন্ডিশকে ছেড়ে পড়লেন বেচার আর স্টাহ্‌লকে নিয়ে। ফ্লজিস্টন থিয়োরি এতদিন হাতুড়েদের পাল্লায় আটকে অর্ধমৃত হয়ে ছিল, তিনি তাকে পুনর্জীবন দিলেন। নামকরা পত্রিকায় হয়তো তাঁর গবেষণা ছাপা হল না, কিন্তু সমাজের প্রদীপের নিচে যে অন্ধকার জগৎ সেখানে তিনি দৈত্যাচার্য্য শুক্রের মতোই প্রসিদ্ধ হয়ে উঠলেন।

জোরে টেবিলে একটা চাপড় মারেন সুকুমারবাবু। লাফিয়ে ওঠে কাপ প্লেটগুলো।

‘খুনের কিনারা না করে আপনি কী সব আষাঢ়ে গল্প ফাঁদছেন বলুন তো ধূর্জটিবাবু? আর আমার নামে যে অভিযোগগুলো তুলছেন সেটার একটাও প্রমাণ করতে পারবেন?’

সামনে ঝুঁকে পড়ে বাধা দেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।

‘আহা। ওঁকে বলতেই দিন না। আপনাকে তো সরাসরি কিছু বলেননি।’

হাতের সিগ্রেটটা ছাইদানে গুঁজে দেয় ধূর্জটি।

‘যোগ্য গুরু হলে উপযুক্ত শিষ্যও জুটে যায়। আমাদের এই বৈজ্ঞানিকও তাঁর উপযুক্ত একটি ছাত্র পেয়ে গেলেন। ছাত্রটি মেধাবী, কিন্তু অতিপ্রাকৃত জ্ঞানের সন্ধান করতে গিয়ে সে ভিক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের থিয়োরির প্রতি একটু বেশি মাত্রায় আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। একবার কলেজের গবেষণাগারে সবার অজান্তে মৃতদেহের ওপর বজ্রবহ্নি প্রয়োগ করতে গেলে বিধ্বংসী আগুনে গবেষণাগার পুড়ে যায়। নিষিদ্ধ গবেষণার দায়ে কলেজ কর্তৃপক্ষ তাকে বিতাড়ন করেন। কিন্তু রতনে রতনে চেনে। আমাদের বিজ্ঞানীটি পিতৃস্নেহে তাকে নিজের কাছে স্থান দেন। কি গোপাল ঠিক বলছি কি না?

কয়েকজোড়া চোখের বিস্মিত দৃষ্টি গিয়ে পড়ে গোপালের ওপর। হকচকিয়ে সে সবার মুখের দিকে তাকায় হতভম্ব ভঙ্গীতে।

‘বাবু! কী বলছেন আমি কিছুই বুঝতে পারছি না!’

হেসে ঘাড় নাড়ে ধূর্জটি।

‘অত ভণিতা না করলেও চলবে। হারকোর্ট বাটলার কলেজ থেকে যে ছাত্রটি বিতাড়িত হয়, তার নাম নবগোপাল শিকদার। নিজের ছদ্মনামটা গোপাল সমাদ্দার না রেখে অন্য কিছু রাখলে পারতেন। কলেজের পাঠানো ছাত্রদের লিস্টটা পড়ার পর আমার কাজটা সহজ হয়ে গেল যে!’

গোপালের মুখে ফুটে উঠল একটা হালকা ক্রূর হাসি। ঝুঁকে পড়া কাঁধ-

দুটো সোজা হয়ে এল। মাথাটা যেন আরও খানিকটা উঁচু হয়ে উঠল। মনে হতে লাগল যেন পূর্বপরিচিত সেই দীনহীন দোকানী নয়, আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে অন্য কেউ।

পাশ থেকে ভেসে এল সুকুমারবাবু শীতল কণ্ঠস্বর।

‘যদি ধরেও নিই আপনার এইসব কথা সত্যি, তাহলেও একটা প্রশ্ন থেকে যায়। এইসব খুনজখমের পেছনে আমার স্বার্থ কোথায়?’

‘স্বার্থ! হ্যাঁ, স্বার্থ। স্বার্থ ছাড়া এ পৃথিবীতে কি-ই বা ঘটে?’

সিগ্রেটের টিনে টক্‌টক্‌ আওয়াজ তোলে ধূর্জটির আঙুল।

‘স্বার্থ লুকিয়ে আছে পিংলা পাহাড়ের নিচে, যেখানে আপনি বাড়ি বানাতে চেয়েছিলেন।’

‘পিংলা পাহাড়। পিংলা পাহাড়ের নিচে কী আছে ধূর্জটিবাবু?’

বিস্মিত প্রশ্ন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণের।

সুকুমারবাবুর চোখে চোখ রাখে ধূর্জটি,

‘পিংলা পাহাড়ের নিচে অ্যাডামান্টাইন আছে কুমার বাহাদুর। ইস্পাতের চাইতে মজবুত, অত্যন্ত হালকা, যুদ্ধাস্ত্র বানানোর আদর্শ ধাতু। য়ুরোপে একটা যুদ্ধে ক্ষমতার ফয়সালা হয়নি। তলে তলে সব দেশ ফের যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। অ্যাডামান্টাইনের চাহিদা এখন আকাশ ছোঁয়া। সোনার চাইতেও তার দাম বেশি।’

লক্ষ করি দু-চোখ জ্বলছে সৌম্যেন্দ্রনারায়ণের। দু-হাতে আঁকড়ে ধরেছেন বন্দুকটাকে।

‘এ সব কি সত্যি সুকুমারবাবু?’

গোপালের দিকে চোখ রাখে ধূর্জটি।

‘সত্যিটা নবগোপাল শিকদারের জামাটা তুললেই জানা যাবে। রাণীসাহেবার ছোঁড়া গুলির ক্ষতচিহ্নটা ওঁর পেটের ওপর আছে কিনা দেখে নিলেই হল।’

‘আমার পেটে কারখানায় শিক পড়ে গিয়েছিল। তার একটা দাগ আছে।’

জোরে হেসে ওঠে ধূর্জটি,

‘নবগোপালবাবু, ওই গল্প দিয়ে আমাকে হলেও কুমারবাহাদুরকে ফাঁকি

দিতে পারবেন না। উনি ফ্রন্টে লড়াই করেছেন, শিকের আঘাত আর গুলির ক্ষতচিহ্নের ফারাক উনি ভালোই ধরতে পারবেন।’

সুকুমারবাবু কী বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু বাধা দেয় গোপাল।

‘স্যার! কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। এটার এখনই ফয়সালা হয়ে যাক।’

গোপালের দিকে ফেরে ধূর্জটি।

‘ফয়সালা করবেন নবগোপালবাবু। তা করুন। কিন্তু আগাম জানিয়ে রাখি, কিছু ফয়সালা আপনাদের হাত থেকে বেরিয়ে গেছে। এতক্ষণে আপনার দোকান আর সুকুমারবাবুর ক্যাম্পে পুলিস পৌঁছে গেছে। আপনারা জঙ্গলে লুকিয়ে ত্রাসপশুর চোরাকারবারের যে ব্যবসা ফেঁদেছিলেন, তার সবটাই এখন পুলিসের কব্জায়।’

আচমকাই উঠে দাঁড়ান সুকুমারবাবু। তাঁর পেছনে সশব্দে আছড়ে পড়ে চেয়ারটা।

বন্দুক আঁকড়ে উঠে দাঁড়ান সৌম্যেন্দ্রনারায়ণও। টেবিল ছেড়ে পিছিয়ে আসেন কয়েক পা।

আমিও দেরি করি না। ধূর্জটির কাঁধটা ধরে টেনে আনি পেছনে।

টেবিলের দুপাশ থেকে সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ আর সুকুমার ঘোষাল জ্বলন্ত চোখে দেখতে থাকেন পরস্পরকে।

ধূর্জটির চোখে চোখ রাখেন সুকুমারবাবু।

‘এর মধ্যে তুমি মাথা না গলালেই ভালো করতে ধূর্জটিবাবু। সুকুমার ঘোষালকে অমান্য করে কেউ ইহলোকে বেশিদিন থাকে না। নৃপেন যেদিন আমায় পিংলা পাহাড়টা দিতে অস্বীকার করে, পরিবারসমেত তার মৃত্যু পরোয়ানা সেইদিনই লেখা হয়ে গিয়েছিল। অপেক্ষা ছিল কেবল সময় আর সুযোগের। কিন্তু তার মধ্যে ঢুকে তুমি খামোখা নিজের প্রাণটা হারাতে বসেছ।’

কাঁধে বন্দুক তোলেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ। ট্রিগারে আঙুল রেখে বন্দুকের নল তাক করেন সুকুমারবাবুর দিকে।

‘প্রাণ কার যাবে আর থাকবে, তার হিসেব এক্ষুণি হয়ে যাবে।’

নাক দিয়ে একটা তাচ্ছিল্যের আওয়াজ তোলেন সুকুমার বাবু।

‘হুঃ! গোপাল—‘

কয়েক পা এগিয়ে এসে সুটকেসটা খুলে উপুড় করে দেয় গোপাল।

সুটকেস থেকে কিলবিল করে মাটিতে ছড়িয়ে পড়ে একরাশ অদ্ভুতদর্শন প্রাণী। লম্বায় তারা বিঘৎখানেক হবে, চেহারায় মোটা জোঁকের মতো হলেও মাথাটা সাপের মতো। তেলতেলে গায়ে সাপের মতো নক্সা কাটা।

‘এগুলো কি জানো ধূর্জটিবাবু?’

সুকুমারবাবুর মুখে ব্যঙ্গের হাসি।

‘ৎসুচিনোকো।’

উত্তর দেয় ধূর্জটি।

‘হ্যাঁ, ৎসুচিনোকো। খাস জাপান থেকে আমদানি করা। একটা কামড়ে সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু।’

সুকুমারবাবুর কথা শেষ হতে না হতেই একটা প্রাণী লাফ দেয় আমাদের লক্ষ্য করে।

গর্জে ওঠে সৌম্যেন্দ্রনারায়ণের বন্দুক, রক্তের ফিনকি ছড়িয়ে প্রাণীটা আছড়ে পড়ে মাটিতে।

ব্যঙ্গের হাসি হাসেন সুকুমারবাবু।

ৎসুচিনোকো
ৎসুচিনোকো

‘কটাকে মারবে কু-মা-র বাহাদুর? কত গুলি আছে তোমার বন্দুকে। সুটকেশ বোঝাই করে ৎসুচিনোকো নিয়ে এসেছি। মেরে শেষ করতে পারবে না। এই বাড়িশুদ্ধ লোকের ভবিতব্য আজ এদের কামড়েই মৃত্যুবরণ করা।’

আবার লাফ দেয় গোটাদুয়েক ৎসুচিনোকো, আবার গর্জে ওঠে সৌম্যেন্দ্রনারায়ণের বন্দুক। ফের সুকুমারবাবুর অট্টহাস্য ছড়িয়ে যায় সরকার বাড়ির চকমিলান উঠোনে।

দু-পা পিছিয়ে আসেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ। সঙ্গে আমরাও। লক্ষ করি এবারে ঝাঁপ দেবার জন্যে তৈরি হচ্ছে একসঙ্গে অন্তত গোটাদশেক ৎসুচিনোকো। বুঝতে পারি লড়াইটা অসম। একসঙ্গে অতগুলো ৎসুচিনোকো ঝাঁপ দিলে, সৌম্যেন্দ্রনারায়ণের পক্ষে তাদের পেড়ে ফেলা সম্ভব হবে না।

হঠাৎ পেছন থেকে কানে আসে আগ্নেয়াস্ত্রের গর্জন। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাই।

দুহাট হয়ে খুলে গেছে একটা অতিথি কামরার দরজা, আর সেই ঘরের ভেতরে থেকে লম্বা পায়ে দৌড়ে আসছে চিত্ত, তার দু-হাতের মুঠোয় ধরা দু-দুটো ওয়েব্লি রিভলভার অগ্নিবর্ষণ করে চলেছে অনবরত।

লাফ দেওয়ার আগেই ভবলীলা সাঙ্গ হয় দশ-বারোটা ৎসুচিনোকোর।

আঙুল দিয়ে টেবিলে টক্‌টক্‌ আওয়াজ তোলেন সুকুমারবাবু।

‘চিত্ত দেখছি। এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলে কলকাতা থেকে?’

‘কলকাতা যায়নি তো ফিরবে কোথা থেকে? কলকাতা যাওয়ার গল্প তো টোপ, না হলে কি আপনি আমাদের দুর্বল ভেবে ফাঁদে পা দিতেন?’

উত্তর দেয় ধূর্জটি।

‘তা বেশ! এক যাত্রায় পৃথক ফল হয় কেন? চিত্তও না হয় ৎসুচিনোকোর বিষের একবার আস্বাদ নিক। গোপাল—!’

সামনের দিকে দু-হাত তুলে দুর্বোধ্য উচ্চারণে কি মন্ত্রপাঠ করে গোপাল। ৎসুচিনোকোর কিলবিলে তৈলাক্ত স্তূপটা ধীরে ধীরে মাটি ছেড়ে উঠে ভাসতে থাকে হাওয়ায়।

ফের মন্ত্রোচ্চারণ করে গোপাল। বৃত্তাকারে পাক খেতে থাকে ৎসুচিনোকোর

ঝাঁক।

ভয়ে হাড় হিম যায় আমার। বুঝতে পারি গোপাল সব ক-টা ৎসুচিনোকোকে একসঙ্গে আমাদের দিকে ছুঁড়ে দেওয়ার ছক কষছে। অতসংখ্যক ৎসুচিনোকো সৌম্যেন্দ্রনারায়ণের বন্দুক আর চিত্তর দুটো পিস্তল মিলেও ঠেকাতে পারবে না।

হঠাৎ ভারী ধাতব কিছু পড়ার শব্দে কেঁপে ওঠে চকমিলান উঠোন। চমকে তাকিয়ে দেখি দোতলার বারন্দা থেকে লাফিয়ে নেমেছে কলগোলাম। তার মুখের জাফরি থেকে শব্দ উঠছে সাইরেনের। দু-চোখের আলো জ্বলছে দপদপ করে।

দু-হাত দুপাশে ছড়িয়ে আমাদের আড়াল করে দাঁড়ায় কলগোলাম।

তাচ্ছিল্যের হাসি ফোটে সুকুমারবাবুর ঠোঁটে।

‘ওই পেতলের পিপেটাকে দিয়ে আমাদের আটকাতে পারবে ভেবেছ?’

সুকুমারবাবুর কথা শেষ হতে না হতেই কানে আসে একটা ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ। অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখি দু-হাতে একটা জাম্বুরক ধরে পাখায় ভর করে উঠোনে নেমে আসছে গরুড় রামসহায়।

জম্বুরকটা মাটিতে নামিয়ে রেখে আমাদের আড়াল করে দুপাশে তার পাখা দুটো ছড়িয়ে দেয় রামসহায়।

‘মেরে পিছে আ যাইয়ে হুজুর।’

উচ্চ উচ্চ গ্রামে উঠতে থাকে গোপালের মন্ত্রপাঠ।

চকমকি ঠুকে জাম্বুরকের সলতেয় আগুন দেয় রামসহায়।

চিৎকার করে সামনের দিকে দু-হাত ছুঁড়ে দেয় গোপাল।

তৈলাক্ত মেঘের মতো আমাদের দিকে ছিটকে আসে একরাশ ৎসুচিনোকো।

কান ফাটানো আওয়াজে গর্জন করে ওঠে জাম্বুরক।

ছররার আঘাতে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে ছিটকে পড়ে বেশিরভাগ ৎসুচিনোকো। বাকিগুলো আটকে যায় কলগোলাম আর গরুড়ের দূর্ভেদ্য প্রাচীরে।

কলগোলামের গায়ে পড়া ৎসুচিনোকোগুলো নিষ্ফল আক্রোশে বিষ ঢালে,

সবুজ বিষ গড়িয়ে পরে তার পেতলের গাত্রবর্মে। নির্বিকারভাবে শরীর থেকে তুলে কলগোলাম সেগুলো হাতের মুঠোয় আর পায়ের নিচে পিষে মারতে থাকে সেগুলোকে।

রামসহায়ের শরীরে যে ক-টা ৎসুচিনোকো পড়ে, তাদের কামড় বৃথাই যায়। বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে রামসহায় তাদের কোপাতে থাকে একটা বিশাল ছোরা দিয়ে।

আর এদের দুজনের পেছন থেকে গর্জন করতে থাকে সৌম্যেন্দ্র- নারায়ণের বন্দুক আর চিত্তর পিস্তল।

কতক্ষণ সময় কেটে যায় জানি না। কিন্তু এক সময় খেয়াল করি থেমে গেছে বন্দুকের গর্জন। রক্ত আর ৎসুচিনোকোর দেহাবশেষ মাখামাখি ক্লেদাক্ত উঠোনে আমাদের দিকে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন সুকুমারবাবু।

কলগোলাম আর রামসহায়ের আড়াল থেকে সামনে এগিয়ে যায় ধূর্জটি।

‘আপনার আমদানি করা ৎসুচিনোকোর ভাঁড়ার তো শেষ। আর কিছু আছে নাকি আপনার সংগ্রহে?’

মুচকি হাসেন সুকুমারবাবু।

‘ভাঁড়ার তো তোমাদের গুলিরও শেষ। কি বলো সৌমেন। কি বলো চিত্ত!’

সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ আর চিত্তর দিকে তাকাই। উত্তর আসে না দুজনের কাছ থেকেই। বুঝতে পারি বানিয়ে বলছেন না সুকুমারবাবু। ৎসুচিনোকোর সঙ্গে শেষ হয়েছে আমাদের পক্ষের গুলিও।

ফের হাসেন সুকুমারবাবু।

‘আমার সংগ্রহে তোমার ক্ষুদ্র বুদ্ধি দিয়ে বোঝা যায় না এমন অনেক জিনিসই আছে ধূর্জটিবাবু। যেমন ধরো এইটা—’

ঝোলা থেকে দস্তানার মতো একটা ধাতব বস্তু বের করেন সুকুমার বাবু। তবে দস্তানার মতো দেখতে হলেও আকারে সেটা মানুষের হাতের পাঞ্জার চাইতে চার পাঁচগুণ বড়।

দস্তানার মধ্যে হাত ঢোকান সুকুমারবাবু। দস্তানার প্রতিটি গ্রন্থি উজ্জ্বল

হয়ে ওঠে নীলাভ দ্যুতিতে।

‘এটা আমার আবিষ্কার। নাম দিয়েছি বজ্রমুষ্টি। চলে এল্ড্রিচ শক্তিতে। খনিতে পাথর ভাঙতে কাজে লাগে। তবে অন্য ব্যবহারও আছে।’

দস্তানাটা মুঠো করে সজোরে চায়ের টেবিলের ওপর নামিয়ে আনেন সুকুমারবাবু। সশব্দে চুরমার হয়ে যায় টেবিলটা। তার কাঠের টুকরোগুলো ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। মাটিতে আছড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যায় চিনেমাটির তৈরি চায়ের বাসন।

মাথা নাড়ে ধূর্জটি।

‘এটা দিয়েই বোধহয় আপনি বলাই, পীতাম্বর আর গিরিজাপ্রসাদের মাথাটা থেঁতলে দিয়েছিলেন?’

গর্বের হাসি হাসেন সুকুমারবাবু।

‘বললাম না, পাথর ভাঙা ছাড়া এর আরও ব্যবহার আছে! তবে এটা ছাড়াও তোমাদের জন্যে আর একটা উপহার আছে। পাশের জঙ্গলে অপেক্ষা করছে। গোপাল—!’

মাথার ওপর দু-হাত তুলে মন্ত্রপাঠ শুরু করে গোপাল।

মাথার ওপরে বজ্রমুষ্টি তুলে ধূর্জটির দিকে এগিয়ে আসেন সুকুমারবাবু,

‘এস ধূর্জটিবাবু। তোমাকেও গিরিজাপ্রসাদের কাছে পাঠিয়ে দিই।’

সুকুমারবাবুর পথ আটকে এসে দাঁড়ায় কলগোলাম।

তাচ্ছিল্যের হাসি হাসেন সুকুমারবাবু।

‘ওফ! ফের এই পেতলের পিপেটা।’

হাত চালান সুকুমারবাবু। বজ্রমুষ্টি আছড়ে পড়ে কলগোলামের বুকে। আঘাতের তীব্রতায় দু-পা পিছিয়ে যায় কলগোলাম।

একটা ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ ওঠে। মাথা তুলে দেখি পাক খেতে খেতে আকাশ থেকে নিচে নেমে আসছে একটা সরীসৃপের আকারের প্রাণী। পিঠে তার বাদুড়ের মতো ডানা, চাবুকের মতো ল্যাজের শেষ প্রান্তটুকু তীরের ফলার মতো।

‘ওয়াইভার্ন! খুব সাবধান। এটা নাক থেকে বিষাক্ত বাষ্প ছোঁড়ে।’

ওপরের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে ধূর্জটি।

‘রামসহায়! রামসহায়!’

খোলা অতিথি কামরার দিকে আঙুল তুলে চিৎকার করে চিত্ত।

চিত্তর দিকে একবার তাকিয়েই খোলা ঘরের দিকে দৌড়য় রামসহায়।

মাথা নিচু করে তীরের বেগে উঠোনের দিকে পড়তে থাকে ওয়াইভার্ন। যে যেদিকে পারি ছিটকে যাই আমরা।

ধাতব আওয়াজ তুলে আর একবার কলগোলামের বুকে আছড়ে পড়ে সুকুমারবাবুর বজ্রমুষ্টি। টলমল করে হটে যায় কলগোলাম।

উঠোনের কাছাকাছি এসে নাক থেকে একরাশ সবুজ বাষ্প ছড়িয়ে ফের আকাশে উঠে যায় ওয়াইভার্ন। সে বাষ্প লাগামাত্র জ্বলে বিবর্ণ হয়ে যায় উঠোনের চকমিলান নক্সা। তার নিচের পাথর গলে চারপাশে ছড়িয়ে যায় বুদবুদ হয়ে।

ঘর থেকে দৌড়ে বেরোয় রামসহায়। তার দু-হাতে ধরা একটা জাজেল।

মাথা নিচু করে আবার নিচের দিকে পড়তে থাকে ওয়াইভার্ন! আকাশের দিকে উঁচু করে তুলে ধরে রামসহায় জাজেলের সুদীর্ঘ নলটা।

আবার ধাতব আওয়াজ ওঠে। বজ্রমুষ্টির আঘাতে আবার পিছু হটে কলগোলাম।

গর্জন করে ওঠে রামসহায়ের জাজেল। দু-বার ডিগবাজী খেয়ে আকাশে ছিটকে যায় ওয়াইভার্ন!

হাত থেকে জাজেল মাটিতে ফেলে দেয় রামসহায়। দুপাশে তার বিশাল ডানা ছড়িয়ে উঠে যায় আকাশে। কোমরবন্ধ থেকে টেনে বের করে হাওদা পিস্তল।

নিজেকে সামলে নিয়ে রামসহায়ের দিকে তেড়ে আসে ওয়াইভার্ন!

পরের পর বজ্রমুষ্টি আছড়ে পড়ে কলগোলামের বুকে। পিছু হটতে থাকে কলগোলাম।

অদ্ভুত কায়দায় শরীরটাকে বাঁকিয়ে ওয়াইভার্নের পথ থেকে সরে যায় রামসহায়। বাঁ হাতে চেপে ধরে তার লম্বা গলাটাকে। তারপর তার পিঠের

মধ্যে হাওদা পিস্তল ঠেকিয়ে পরপর দেগে দেয় দুটো নলই।

একটা মরণ চিৎকার করে আকাশ থেকে পড়তে শুরু করে ওয়াইভার্ন! মন্ত্রপাঠ ভুলে বিস্মিত দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকে গোপাল।

হাওদা পিস্তল কোমরে গোঁজে রামসহায়। খাপ থেকে বিশাল তলোয়ারটা টেনে বের করে একপাশে বাড়িয়ে দেয় হাতটা।

আবার একটা ধাতব আওয়াজ ওঠে। কিন্তু এবারে সুকুমারবাবুর বজ্রমুষ্টি কলগোলামের বুকে পড়েনি। হাত দিয়ে আঘাত আটকে দিয়েছে সে।

মাথা নিচু করে আকাশ থেকে নেমে আসে রামসহায়। তার বাড়ানো হাতের তলোয়ারের ধার নির্মম বিদ্যুতের মতো নেমে আসে গোপালের ঘাড়ের ওপর।

কোনও আওয়াজ হয় না। গোপালের মুণ্ডটা শরীর থেকে আলাদা হয়ে গড়িয়ে পড়ে উঠোনে।

রক্তের ফোয়ারা ছড়িয়ে তার কবন্ধ লাশটাও ঢলে পড়ে একপাশে।

আর তার পরপরই ওয়াইভার্নের দেহটা সশব্দে আছড়ে পড়ে মাটিতে।

‘গোপাল!!’

একটা হাহাকার ভেসে আসে সুকুমারবাবুর গলা থেকে।

এক পা এগিয়ে যায় কলগোলাম। সুকুমারবাবুর বজ্রমুষ্টিকে এড়িয়ে দু-হাতের মুঠোয় ধরে ফেলে তাঁর কনুই দুটোকে। চোখের আলো দুটো দপদপ করে জ্বলে ওঠে তার। তারপর মড়মড় শব্দে তার হাতের নিষ্পেষণে গুঁড়িয়ে যায় সুকুমারবাবুর কনুই দুটো।

উঠোনের রণক্ষেত্রের ক্লেদরক্ত ছাড়িয়ে আকাশের দিকে উঠে যায় সুকুমারবাবুর আর্ত চিৎকার।

এগিয়ে এসে বন্দুকের নলটা সুকুমারবাবুর মাথায় ঠেকান সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।

‘ওপর থেকে কার্তুজ আনিয়ে তোমাকে এখনই গুলি করে মেরে ফেলতে পারতাম। কিন্তু গুলিতে মৃত্যু সে সাহসী সৈনিকের জন্যে। তোমার মতো বিশ্বাসঘাতক হত্যাকারীর শাস্তি পঙ্গু হয়ে বন্দীজীবন ভোগ করা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *