অর্থতৃষ্ণা – ৪

চার

সেদিন রাতটুকু ধূর্জটিকে বিরক্ত করিনি, কিন্তু সকালেই প্রাতরাশের পরেই চেপে ধরলাম।

‘কিছু বুঝতে পারছ?’

গম্ভীর মুখে একটা সিগারেট ধরায় ধূর্জটি।

‘দেখ ষড়যন্ত্রের জাল যে অনেকদিন ধরে বেছানো হয়েছে, সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত। পিশাচ পড়া, ইন্ডো-ব্রিটিশ ক্লকওয়ার্কসের দোকানে চুরি, পীতাম্বর আর বলাইয়ের খুন, এ সবই এক সুতোয় বাঁধা। কিন্তু এ সবের উদ্দেশ্য কী, কোন লক্ষ্যে নেপথ্যের হোতা একের পর এক এইসব অপরাধ করে চলেছে তা এখনও বুঝে উঠতে পারিনি।’

‘খানিকটা তো বোঝাই যাচ্ছে। নিতাই আর বলাই দুজনে মিলে এয়ারশিপে চেপে ইন্ডো-ব্রিটিশ ক্লকওয়ার্কসে হানা দিয়ে সিন্দুকের টাকা আর বড়মানুষ খদ্দেরদের একটা লিস্ট চুরি করে। ফেরার সময় এয়ারশিপ ভেঙে পড়ে নিতাই মারা পড়ে, বলাইও ভয় পেয়ে পালায়। কিন্তু লিস্টটা তার কাছে থেকে গিয়েছিল, সেইটা থেকে দুলমিগড় এস্টেটের নাম পেয়ে এখানে চুরি করতে আসে।’

সিগ্রেটের টিনে টক্‌টক্‌ আওয়াজ তোলে ধূর্জটির আঙুল। তামাকের নীলচে ধোঁয়া পাক খেয়ে উড়ে যায় জানলা দিয়ে।

‘হতে পারে। অসম্ভব নয়। কিন্তু তাহলেও অনেকগুলো প্রশ্ন থেকে যায়। পীতাম্বর গোমেজ খুন হল কেন? বলাইকেই বা কে মারল?’

‘হয়তো পীতাম্বরও চুরির সঙ্গে জড়িতে ছিল, ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে কোনওরকম অশান্তির জেরে বলাইয়ের দলের লোকজন তাকে আর বলাইকে, দুজনকেই খুন করে।’

‘উঁহু! তোমার যুক্তিতে গলদ আছে। পীতাম্বরের সঙ্গে যদি বলাই কি নিতাইয়ের যোগসাজস থাকত, তাহলে অত পরিশ্রম করে তাদের তালা ভাঙতে হত না, পীতাম্বরই তাদের ভেতরে ঢোকার ব্যবস্থা করে দিত। তা ছাড়া পীতাম্বরের দুলমিগড় আসাটাও কাকতালীয়। কলগোলাম না বিগড়োলে পীতাম্বরের ডাক পড়ত না। আর মেরামত করতে ইন্ডো-ব্রিটিশ ক্লকওয়ার্কস থেকে অন্য কোনও মিস্ত্রিকেও পাঠাতে পারত। পীতাম্বরই যে আসবে তার কি নিশ্চয়তা ছিল? আমার মনে হয়, বলাইয়ের সঙ্গে যোগসাজস নয়, পীতাম্বরের নজরে এমন কিছু পড়েছিল, বা সে এমন কিছু জেনে ফেলেছিল যে তাকে সরিয়ে দেওয়াটা জরুরি হয়ে পড়েছিল।

‘কিন্তু কী দেখে ফেলেছিল পীতাম্বর?’

‘সেটাই তো রহস্য।’

‘আর বলাইকেই বা খুন করল কে?’

‘খুব সম্ভব এই নাটকের নেপথ্যের গোপন নায়কটি। কিন্তু সে যে কে এখনও সেটা আমার কাছে স্পষ্ট নয়।’

একটা ছোট রঙিন পাখি জানলায় এসে বসে সুরেলা আওয়াজ তুলে ফের উড়ে যায়। তার পাখনার হাওয়াতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায় তামাকের ধোঁয়া। সিগারেটের শেষ অংশটুকু ছাইদানে গুঁজে দেয় ধূর্জটি।

‘চলো। একটু বেরনো যাক। পীতাম্বর আর বলাই যেখানে খুন হয়েছিল

সে জায়গা দুটো একবার দেখে আসি। যদি মাথার জট কিছুটা খোলে।’

সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ আমাদের একা ছাড়তে রাজি হলেন না।

‘পীতাম্বরের বেলায় যে ভুল করেছি, সে ভুল আমি আর দ্বিতীয়বার করছি না। চিত্ত আপনাদের সঙ্গে যাবে। তা ছাড়া চিত্ত জায়গাটা চিনিয়ে দিলে আপনাদের সুবিধে হবে।’

মোটরে উঠতে যাচ্ছি, পেছন থেকে একটা পরিচিত গলার আওয়াজ পেলাম।

‘নমস্কার বাবু!’

মাথা ঘুরিয়ে দেখে আশ্চর্য হলাম। স্টেশনের দোকানী গোপাল সমাদ্দার। মলিন পোষাক, হাতে একটা চামড়ার সুটকেস।

‘তুমি? এখানে? কোনও কাজে নাকি?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ বাবু। আমি এই সেরেস্তায় কাগজ কালি জোগান দিই, সেই কাজেই এসেছিলাম। আপনারা কি বেরোচ্ছেন কোথাও?’

‘হ্যাঁ, আমরা—’

‘একটু বেড়াতে বেরচ্ছি।’

আমাকে মাঝপথেই থামিয়ে দেয় ধুর্জটি।

‘ঘুরে আসুন বাবু। জঙ্গলে খুব সুন্দর পাখি আছে।’

মোটর ছেড়ে দেয়। ঝুঁকে প্রণাম করে গোপাল।

‘আগে কোথায় যাবেন স্যার?’

গাড়ি চালাতে চালাতেই প্রশ্ন করে চিত্ত।

একটু চিন্তা করে নেয় ধূর্জটি।

‘পীতাম্বর যেখানে খুন হয়েছিল সেখান চলো আগে।’

‘ওটা স্টেশনের দিকে।’

‘চলো।’

স্টেশনের দিকের রাস্তায় মোটর ছোটে।

কিছুদূর যাবার পর এক জায়গায় মোটর দাঁড় করায় চিত্ত।

‘স্যার এইখান থেকে খানিকটা ভেতরে পীতাম্বরের দেহ পাওয়া গিয়েছিল।’

‘দেখে আসি, চলো।’

ঝোপঝাড় ঠেলে জঙ্গলের খানিকটা ভেতরে নিয়ে যায় চিত্ত।

‘এই যে স্যার, এইখানটা। এই গাছটার নিচে পড়ে ছিল পীতাম্বর।’

চারপাশটা একবার চোখ বুলোয় ধূর্জটি। এখানে ঝোপঝাড় কিছুটা পাতলা। গোটাতিনেক বড় গাছ হাতকয়েক ফাঁক রেখে দাঁড়িয়ে আছে। নাকে আসে কোনও বুনো ফুলের ঝাঁঝালো গন্ধ।

‘পুলিশ জায়গাটার তল্লাসী নিয়েছিল?’

‘হ্যাঁ স্যার, পুলিশ শুধু নয়, আমাদের লোকজনও চারিদিকে খোঁজাখুঁজি করেছিল, কোনও কিছু পায়নি।’

‘তুমি পীতাম্বরের দেহটা দেখেছিলে?’

‘হ্যাঁ স্যার। ঠিক অন্য খুনটার মতোই। সারা শরীরে কোনও চোট নেই, কেবল মাথাটা থ্যাঁতলানো।’

‘হুঁ।’

গম্ভীর হয়ে যায় ধূর্জটি।

‘চলো। বলাই যেখানটা খুন হয়েছিল, সে জায়গাটা একবার দেখে আসি।’

মোটর ছুটিয়ে বেশ খানিকটা দূর যাবার পর, বাঁধানো বড় রাস্তা ছেড়ে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে মেঠো পথ ধরে চিত্ত। সে পথও কিছুটা যাবার পর একটা ঢিবির কাছে এসে ফুরিয়ে যায়।

মোটরের ইঞ্জিন বন্ধ করে চিত্ত।

‘বাকি পথটুকু হেঁটেই যেতে হবে স্যার।’

‘চলো।’

মোটর থেকে নামে ধূর্জটি।

পায়ে হেঁটে ঢিবিটা পেরোই। এখানে বড় গাছের সংখ্যা কম। উঁচু ঝোপগুলো প্রায় একমানুষ সমান উঁচু হয়ে উঠে আছে। তাতে কোথাও থোকা থোকা সাদা-হলুদ ফুল ফুটেছে। আমাদের শরীরের ধাক্কায় ফুলগুলো টুপটাপ করে ঝরে পড়ে, দু-একটা পাখি তীক্ষ্ণ শিষে আপত্তি জানিয়ে ডানার

ঝটপট শব্দে উড়ে যায় ঝোপ ছেড়ে।

ঝোপগুলোর ফাঁকে অল্প একটু ফাঁকা জায়গা। সেখানে এসে দাঁড়ায় চিত্ত।

‘স্যার, লাশটা এখানেই পাওয়া গেছিল।’

চারদিকে একেবার তাকায় ধূর্জটি।

‘হুঁ। যে এখানে খুন করে লাশটা ফেলে গিয়েছিল, সে এই জঙ্গলের খুঁটিনাটি সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল। লাশ এখানে পড়ে থাকলে বাইরে থেকে টের পাওয়ার উপায় নেই।’

‘হ্যাঁ স্যার। গ্রামের একটা লোক গোরু খুঁজতে এসে দৈবাৎ লাশটা দেখতে না পেলে, কয়েকদিন বাদে আর চিহ্ন পাওয়া যেত না, শেয়াল কুকুরে কোথায় টেনে নিয়ে যেত।’

‘মৃত্যু কীভাবে হয়েছিল জানো?’

‘পীতাম্বরের মতোই স্যার। মাথার একপাশটা ভারী কিছু দিয়ে থ্যাঁতলানো।’

‘এখানেও বোধহয় লাশের আশেপাশে কিছু খুঁজে পাওয়া যায়নি?’

‘না স্যার! আমরা তো কিছু দেখতে পাইনি। তা ছাড়া—’

খানিকটা ইতস্তত করে চিত্ত।

ভ্রু কোঁচকায় ধূর্জটি,

‘তা ছাড়া কী চিত্ত?’

‘স্যার পীতাম্বরের দেহে আশপাশে কিছু না পেলেও তার পকেটে ব্যক্তিগত দু-একটা জিনিস ছিল। কিন্তু বলাইয়ের লাশের পকেটে কিচ্ছু পাওয়া যায়নি।’

‘হুঁ। মানে সব রকম তথ্যপ্রমাণ খুনি লোপাট—’

‘স্‌স্‌স্‌—’

হঠাৎ ঠোঁটে আঙুল দিয়ে সামনের দিকে ইশারা করে চিত্ত। লক্ষ করি সেখানে একমানুষ উঁচু ঝোপটা অল্প অল্প নড়ছে।

বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ডটা লাফিয়ে ওঠে। কেউ কি লুকিয়ে রয়েছে ঝোপের ভেতরে? কী তার উদ্দেশ্য? আড়ি পেতে আমাদের কথা শোনা? নাকি আমাদের

আক্রমণ করা?

খাপ থেকে পিস্তল বের করে উঁচিয়ে ধরে চিত্ত। নিম্নস্বরে বলে,

‘আমার পেছনে চলে আসুন।’

জড়সড় হয়ে দুজনে চিত্তর শরীরের আড়ালে এসে দাঁড়াই।

বন্ধ হয়ে যায় ঝোপের পেছনের নড়াচড়া। লুকিয়ে থাকা ব্যক্তি কি বুঝতে পেরেছে আমরা তার উপস্থিতি টের পেয়েছি?

পিস্তলধরা ডান হাত সামনের দিকে বাড়িয়ে ধরে চিত্ত।

‘কে আছ বেরিয়ে এস। নইলে কিন্তু গুলি চালাব!’

কোনও সাড়াশব্দ নেই।

মাটি থেকে কয়েকটা পাথর কুড়িয়ে নিয়ে ঝোপের মধ্যে ছুঁড়তে থাকে চিত্ত। একবার। দুবার। তিনবার। একটা জান্তব আওয়াজ ভেসে আসে ঝোপের ভেতর থেকে, জোরে জোরে দুলে ওঠে ঝোপটা। আর আচমকাই ক্রুদ্ধ গর্জন করে শিং বাগিয়ে ঝোপঝাড় ভেঙে আমাদের দিকে ছুটে আসে একটা বুনো মোষ।

‘পালান!’

সেই ধেয়ে আসা কৃষ্ণকালো পেশীর পাহাড়ের সামনে থেকে লাফ দিয়ে সরে যেতে যেতে চেঁচিয়ে ওঠে চিত্ত।

মুহূর্তমাত্র মাত্র দেরি না করে ঝোপের মধ্যে দিয়ে দৌড় লাগাই। হাতে-পায়ে কাঁটার খোঁচা লাগে, শরীরের ওপর বেতের মতো আছড়ে পড়ে গাছের ডাল, তবুও প্রাণের ভয়ে দৌড়তে থাকি না থেমে।

দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে খানিকটা দৌড়োনোর পর বুঝতে পারি আমার পেছনে কোনও পশু তাড়া করে আসছে না, গাছের পাতার শব্দ আর দু-একটা পাখির ডাক ছাড়া আর কোনও আওয়াজ নেই। একটা উঁচু গাছের নিচে হাঁটুতে দু-হাত রেখে নীচু হয়ে হাঁপাতে থাকি।

‘স্যার! স্যার!’

কোথাও দূর থেকে চিত্তর কণ্ঠস্বর ভেসে আসে।

হাঁপাতে হাঁপাতেই উত্তর দিই।

‘এই যে, এখানে!’

ঝোপ ঠেলে উদয় হয় চিত্তর

‘যাক! আপনার কিছু হয়নি!’

সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে শ্বাস নিই,

‘ধূর্জটি? ধূর্জটি কোথায়?’

চিত্ত ধূর্জটিকে দেখেনি। মোষের তাড়া থেয়ে পালিয়ে আসার পর আমাকেই প্রথম খুঁজে পেয়েছে সে।

গলা তুলে চিৎকার করতে থাকি,

‘ধূর্জটি! ধূর্জটি!’

বেশ কিছুক্ষণ ডাকাডাকির পর একটা ক্ষীণ আওয়াজ আসে,

‘এখানে!’

আওয়াজ লক্ষ করে ঝোপঝাড় ঠেলে এগোই আমি আর চিত্ত।

একটু বাদে নজরে পড়ে একটা ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে আছে ধূর্জটির জুতো পরা পা দুখানা।

উদ্বিগ্ন হয়ে ছুটে যাই। ধূর্জটির চোট লাগেনি তো?

দেখি মাটিতে পা ছড়িয়ে বসে ধূর্জটি। গায়ে মাথায় লেগে রয়েছে ছেঁড়া পাতা, গালের দু-একটা জায়গায় ছড়ে গেছে, কিন্তু মুখে একটা অদ্ভুত হাসি। হাত ধরে টেনে তুলি।

‘কি, লেগেছে কোথাও?’

মাথা নাড়ে ধূর্জটি,

‘না, লাগেনি তেমন। পা পিছলে ঝোপের মধ্যে বসে পড়েছিলাম কেবল।’

একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলি,

‘একটা অভিজ্ঞতা হল, যা হোক।’

‘যা বলেছ। চলো যাওয়া যাক।’

মুখের সেই অদ্ভুত হাসিটা নিয়েই মোটরে চড়ে বসে ধূর্জটি।

হাসির রহস্যটা বুঝতে পারি আমাদের ঘরে ফিরে। ঘরের দরজটা বন্ধ করে কামিজের পকেট থেকে দুটো দলাপাকানো কাগজের টুকরো টেবিলের

ওপর নামিয়ে রাখে।

‘মোষের তাড়া খাওয়াটা শাপে বর হয়েছে। না হলে এটা পেতাম না।’

‘কী এটা।’

‘খবরের কাগজের কাটিং। খুব সম্ভব বলাইয়ের পকেটে ছিল। খুনি প্রমাণ লোপাট করার জন্যে বোধহয় দূরে ছুঁড়ে ফেলেছিল। একটা ঝোপের পাতার ফাঁকে আটকে পড়েছিল। পালাতে গিয়ে ঝোপের ভেতরে আছড়ে না পড়লে এটা চোখে পড়ত না।’

একটা কাগজ তুলে নিয়ে চোখ বোলাই। মাসছয়েক আগেকার খবর। হায়দ্রাবাদে নিজামের খাস অ্যালকেমিস্টের কিমিয়াখানায় চুরির বিবরণ। কী চুরি গেছে তার কথা বিশদে না থাকলেও, নিজামত থেকে চোর ধরার জন্যে নগদ পুরষ্কার ঘোষণার কথা রয়েছে।

কাগজটা নামিয়ে রাখি।

‘ইন্ডো-ব্রিটিশ ক্লকওয়ার্কসের চুরিতে ক্যালরিক ব্যবহারের রহস্যটা এবার বোঝা গেল তাহলে। খুব সম্ভব বলাইয়েরই কাজ।’

‘হুঁ! ঠিক ধরেছ। তবে—’

ধূর্জটির মুখে আবার সেই রহস্যময় হাসিটা ফুটে ওঠে।

‘তবে অন্য কাগজটাও দেখ একবার।’

দ্বিতীয় কাগজটা তুলে নিই।

এবং চোখ বুলিয়ে খানিকটা আশ্চর্য হই।

‘এ তো দেখছি ইন্ডো-ব্রিটিশ ক্লকওয়ার্কসের চুরির খবর। এয়ারশিপ ভেঙে পড়া, নিতাইয়ের মৃত্যু, চুরির টাকা উদ্ধার, সব খবরই রয়েছে দেখছি।’

‘কিন্তু যতীন, প্রশ্ন হল এই খবরটা বলাই পকেটে করে বয়ে বেড়াচ্ছিল কেন?’

‘দুটো খবরই একই কারণে পকেটে রেখেছিল। খুব সম্ভব বলাই নিজের চুরি ডাকাতির খতিয়ান রাখতে পছন্দ করে। একরকম আত্মম্ভরিতা বলতে পারো।’

মুখের হাসিটা আরও দুর্জ্ঞেয় হয়ে ওঠে ধূর্জটির।

‘তা হতে পারে। আবার নাও হতে পারে।’

‘কিচ্ছু বুঝলাম না।’

একটা সিগ্রেট ধরিয়ে চিৎ হয়ে শোয় ধূর্জটি।

‘পুরোটা কি আমিই বুঝেছি যতীন! শুধু এটুকু বুঝতে পারছি যে, এই সরকারবাড়ি ঘিরে বহু যত্নে যে ষড়যন্ত্রের ফাঁদ পাতা হয়েছে, বলাই তারই বলি হয়েছে। এই নাটকে বলাই মূল কুশীলবদের কেউ নয়, পার্শ্বচরিত্র মাত্র। নিজের মাত্রা না বুঝে পা ফেলতে গিয়েই খুব সম্ভব তার প্রাণহানি হয়েছে।’

সিগ্রেটের টিনে টক্‌টক্‌ আওয়াজ তোলে ধূর্জটির আঙুল।

‘এর বেশি আর কিছু আমার কাছে এই মুহূর্তে পরিষ্কার নয়। আপাতত আমাকে মস্তিষ্কের গোড়ায় ধোঁয়া দিয়ে চিন্তার জট ছাড়াতে হবে। সুতরাং বৎস, তিষ্ঠ ক্ষণকাল এবং আমাকে ভাবতে দাও।’

কিন্তু বেশিক্ষণ ভাবার অবকাশ পেল না ধূর্জটি। দুপুরের আহারাদি খানিকটা অন্যমনস্কভাবে সেরে নিয়ে সে আবার সিগ্রেটের টিন হাতে শোওয়ার তোড়জোড় করছে, দরজায় কে টোকা দিল।

দরজা খুলে দেখলাম একজন ভৃত্যগোছের লোক।

‘বাবু, হুজুর আপনাদের নিচে ডাকছেন।’

নিচের উঠোনে গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়েছিলেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।

‘আপনাদের বিশ্রামে ব্যাঘাত ঘটানোর জন্যে দুঃখিত ধূর্জটিবাবু। কিন্তু একটা সমস্যা হয়েছে।’

‘কী হয়েছে?’

‘গিরিজাপ্রসাদকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না!’

‘সে কি?’

‘হ্যাঁ। দুপুরের আহারের পর একটা কাজের জন্যে ডেকে পাঠিয়েছিলাম। আমার লোক ডাকতে গিয়ে দেখে ঘরে নেই। একে তাকে জিজ্ঞেস করে জানলাম দুপুরে নাকি সে খেতেও আসেনি। সকালবেলা তাকে একবার বাড়ির কম্পাউন্ডে ফোয়ারার কাছে দেখা গিয়েছিল, তারপর থেকে তাকে আর কেউ দেখেনি।’

একট ইতস্তত করে ধূর্জটি,

‘কিছু মনে করবেন না কুমারবাহাদুর। গিরিজাপ্রসাদ ব্যবসায়ী মানুষ। হয়তো আপনার সঙ্গে লেনদেনের কোনও শর্ত তার পছন্দ হয়নি। আপনাকে সরাসরি না বলতে সংকোচ হচ্ছিল বলে সে চুপিসাড়ে আপনার অজান্তে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে।’

গম্ভীর হয়ে যান সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।

‘প্রথমটা আমিও তাই ভেবেছিলাম। কিন্তু না ধূর্জটিবাবু, গিরিজাপ্রসাদ বাড়ি ছেড়ে চলে যায়নি। খুব সম্ভব সে কোনও বিপদে পড়েছে। নিজের চোখেই দেখবেন আসুন।’

লম্বা পায়ে উঠোন পার হয়ে একটা অতিথি কামরার দিকে এগিয়ে যান সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ। ঠেলে খুলে ধরেন ঘরের দরজা।

‘গিরিজাপ্রসাদকে খুঁজে না পেয়ে আমি ওর ঘরখানা দেখতে এসেছিলাম। দেখলাম ওর সমস্ত জিনিসপত্রই পড়ে রয়েছে। দেখুন।’

নিরাভরণ ঘর। একপাশে একটা তক্তপোষ পাতা, তার মাথার কাছে একটা টুলের ওপর গেলাসে ঢাকা দেওয়া জলের কুঁজো। অন্যদিকে মেঝের ওপর জড়ো করে রাখা কয়েকটা ট্রাঙ্ক আর একটা বেডিং।

ঘরের ভেতরে দু-পা এগিয়ে গিয়ে অঙ্গুলিনির্দেশ করেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।

‘অন্য জিনিস তবুও না নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু এই বাক্সটাতে গিরিজাপ্রসাদের সমস্ত দামী জহরৎ থাকে। এটা না নিয়ে সে যায় কোথায়?’

দেখলাম একটা ট্রাঙ্কের পাশে মাটিতে বসানো রয়েছে একটা অদ্ভুত চেহারার ছোট বাক্স। গায়ে পেতলের বেড়, ডালায় সিংহের মুখের আকারের তালা, দুপাশে পেতলের হাতল।

ভালো করে দেখব বলে বাক্সটা তুলতে গেলাম, কিন্তু পারলাম না। বাক্সটা দৈর্ঘ্য প্রস্থে হাতখানেকের বেশি হবে না, কিন্তু অসম্ভব ভারী। সর্বশক্তি

প্রয়োগ করেও সেটাকে বিন্দুমাত্র নড়াতে পারলাম না।

পেছন থেকে আপত্তি জানায় ধূর্জটি।

‘উঁহু! ছেড়ে দাও যতীন। যক্ষরা তাদের দৌলতপেটি গরিমা সিদ্ধাই দিয়ে অসম্ভব ভারী করে রাখে। সঠিক মন্ত্রপাঠ না করলে ওটাকে নড়ানো সম্ভব নয়।’

সৌম্যেন্দ্রনারায়ণের দিকে ফেরে ধূর্জটি।

‘আপনি ঠিকই বলেছেন কুমারবাহাদুর। গিরিজাপ্রসাদ একেবারে বাড়ি ছেড়ে চলে গেলে তার জিনিসপত্র এভাবে ফেলে যেত না।’

‘আর এটাও দেখুন ধূর্জটি বাবু।’

ঘরের একটা কোনের দিকে নির্দেশ করেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।

মেঝেতে তক্তপোষের একটা পায়ার কাছে খানিকটা ছাই পড়ে রয়েছে। ঝুঁকে পড়ে আতস কাচ দিয়ে ছাইটা পরীক্ষা করে ধূর্জটি।

‘কাগজ। খানিকটা কাগজ পোড়ান হয়েছে।’

‘কিন্তু কেন?’

বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।

উত্তর না দিয়ে ঝুঁকে পড়ে তক্তপোষের তলাটা একবার দেখে ধূর্জটি, তারপর হাত বাড়িয়ে কী একটা বের করে আনে।

‘খুব সম্ভব কেউ চিঠি লিখে গিরিজাপ্রসাদকে ডেকে পাঠায়। চিঠিতে গোপনীয় এমন কিছু ছিল, যার জন্যে গিরিজাপ্রসাদ চিঠিটা নিজেই পুড়িয়ে ফেলে।’

তক্তপোষের তলা থেকে বের করে আনা জিনিসটা আতস কাচ দিয়ে খুঁটিয়ে দেখে ধূর্জটি, তারপর বাড়িয়ে ধরে আমার দিকে।

একটা আধপোড়া কাগজের টুকরো। তার চারপাশ পুড়ে গেছে, বাকি অংশটুকুতে কেবল অতিকষ্টে ‘গম’ শব্দটুকু পড়া যায়।

‘গম’!

এবার আমার বিস্মিত হবার পালা।

মুখে বিরক্তির আওয়াজ তোলে ধূর্জটি।

‘ওটা অন্য কোনও শব্দের অংশ।’

‘কী শব্দ? দুর্গম? সুগম?’

বাইরে কোথাও থেকে কয়েকটা উচ্চকণ্ঠ কানে আসে। উত্তেজিত স্বরে কারা যেন কিছু আলোচনা করছে।

মাথা ঝাঁকায় ধূর্জটি।

‘শব্দটা কী সেটা পরে ভাবলেও চলবে। এই মুহূর্তে আমাদের কাজ গিরিজাপ্রসাদকে খুঁজে বের করা। কুমারবাহাদুর, আপনি কি লোক লাগিয়েছেন গিরিজাপ্রসাদকে খুঁজতে?’

‘অবশ্যই, গিরিজাপ্রসাদকে পাওয়া যাচ্ছে না জানতে পারার সঙ্গে সঙ্গে তিলমাত্র দেরি না করে চারপাশে লোক পাঠিয়ে দিয়েছি।’

ভারী জুতো পায়ে ছুটে আসার একটা শব্দ কানে আসে। উঠোন দিয়ে কেউ দৌড়ে আসছে।

একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে ধূর্জটি।

‘গিরিজাপ্রসাদকে সুস্থ শরীরে পাওয়া গেলেই ভালো। কিন্তু যে ভাবে তাকে চিঠি লিখে গোপনে ডেকে পাঠানো হয়েছে, সে কোনও ঘোর বিপদে না পড়ে থাকে।’

জুতোর শব্দ আরও কাছে আসে। দরজার দু-দিকে দু-হাত রেখে ঘরের মধ্যে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে চিত্ত।

‘স্যার! গিরিজাপ্রসাদ খুন হয়েছে।’

অকুস্থল বেশি দূরে নয়। সরকার বাড়ির ফটক থেকে মাইলখানেক হবে। জঙ্গলের মধ্যে একটা গাছের তলায় ঠেস দিয়ে বসে গিরিজাপ্রসাদের দেহ। চোখ দুটো খোলা, মুখে একটা অদ্ভুত বিস্ময়ের ছাপ। নাগরা জুতো পরা পা দুটো সামনের দিকে ছড়ানো, গলার রুপোর হাঁসুলি ডুবে গেছে গাঢ় কালচে রক্তে। মাথার একপাশ তোবড়ানো। ডিমের খোলায় ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করলে যেমন তুবড়ে ভেতরে ঢুকে যায়, গিরিজাপ্রসাদের মাথার ডানদিকটাও তেমনি কোনও ভয়ঙ্কর আঘাতে ভেঙে ভেতর দিকে ঢুকে গেছে।

‘মাথায় কি পাথর দিয়ে আঘাত করা হয়েছিল?’

প্রশ্ন করি বিস্মিত কন্ঠে।

গিরিজাপ্রসাদের মাথার ক্ষতটা পরীক্ষা করে ধূর্জটি।

‘হতে পারে। কিন্তু যে শক্তিতে আঘাত করা হয়েছে, তাতে হয় পাথরটা প্রকাণ্ড ভারী অথবা আঘাতকারীর শরীরে অসুরের মতো বল আছে।’

গিরিজাপ্রসাদের দেহটা পরীক্ষা করতে থাকে ধূর্জটি। কয়েক পা এগিয়ে আতস কাচে চোখ রেখে পরীক্ষা করে গাছের গুড়িটা।

‘পুলিসে খবর দেওয়া হয়েছে?’

মাথার ওপরে কর্কশ আওয়াজ করে চক্কর কাটে কয়েকটা কাক। সে দিকে একবার তাকান সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।

‘হ্যাঁ, কোতয়ালীতে লোক পাঠিয়েছি।’

দূরে কোথাও গর্জন করে একটা মোটর এসে থামে। তারপর জঙ্গল ঠেলে কয়েকজন কনস্টেবল সঙ্গে করে এগিয়ে আসেন একজন পুলিস ইন্সপেক্টর।

ইন্সপেক্টরের নাম শিউলাল দ্বিবেদী। মৃতদেহটা একবার পরীক্ষা করে ধূর্জটির সঙ্গে করমর্দন করেন।

‘লালবাজার থেকে আপনার আসার কথা আমাকে তার করে জানানো হয়েছিল। কিন্তু নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল আপনি না ডাকলে না যেতে।’

গিরিজাপ্রসাদের প্রাণহীন দেহের দিকে একবার তাকায় ধূর্জটি।

‘হ্যাঁ, আপনাকে এবার বোধহয় দু-একটা কাজের জন্য প্রয়োজন হতে পারে। যদি কালকে একবার সময় করে আসতে পারেন তো ভালো হয়।’

‘অবশ্যই যাব। এমনিতেও আমাকে নিয়মমাফিক কয়েকটা জবানবন্দী নিতে হবে।’

গিরিজাপ্রসাদের দেহ তুলে নিয়ে যায় কনস্টেবলরা। কসৌলের কুবেরী যক্ষের শেষ চিহ্ন হয়ে পড়ে থাকে কেবল ঘাসে লেগে থাকা রক্তের দাগটুকু।

বিমর্ষ মনে ফিরে আসি। দূরদেশের বণিক গিরিজাপ্রসাদকে কেন অনর্থক প্রাণ হারাতে হল কিছুতেই বুঝে উঠতে পারি না।

বেলা পড়ে এসেছে। দিনের শেষ সোনালী রোদটুকু আঁচলের মতো ছড়িয়ে রয়েছে বাড়ির উঠোনে। রোদে শরীর রেখে মাথার ওপরের আকাশটা একবার তাকিয়ে দেখে ধূর্জটি।

‘যতীন, গিরিজাপ্রসাদ প্রাণ দিয়ে আমার কাজটা খানিকটা সহজ করে দিয়ে গেল। এই ষড়যন্ত্রের জালের কেন্দ্রবিন্দুতে যে ঊর্ণনাভটি বসে আছেন, তিনি যে কে, সেটা বোধহয় বুঝতে পেরেছি।’

‘কে ধূর্জটি?’

আকাশের দিকে মাথা তুলে লম্বা শ্বাস নেয় ধূর্জটি।

‘না যতীন! সে কে এখনই তা প্রকাশ করতে পারব না। সন্দেহ যত দৃঢ় হোক, প্রমাণ না থাকলে গোপন আততায়ীটির টিকিও ছুঁতে পারব না।’

ঘরে ঢুকতে যাচ্ছি পেছন থেকে ডাক পড়ল।

‘বাবু।’

দুপুরবেলায় যে কাজের লোকটি ডাকতে এসেছিল সে।

‘বাবু, হুজুর হুকুম করেছেন এখন থেকে তাঁকে না জানিয়ে কেউ যেন বাড়ির বাইরে পা না দেয়। আপনাদের কোথাও যাওয়ার থাকলে আপনারা হুজুরকে জানাবেন।’

খবর দিয়ে লোকটি চলে যাচ্ছিল, ধূর্জটি তাকে পেছন থেকে ডাকল।

‘শোনো!’

‘বলুন বাবু।’

‘তোমাদের উপেন দাদাবাবু কোথায়।’

‘আজ্ঞে তিনি আর কোথায় থাকবেন। সকাল থেকে লাইব্রেরি ঘরেই আছেন।’

‘আর তার কলগোলামটা? রঘু?’

‘ওই পেতলের দানোটা? ও ওই উপেন দাদাবাবুর সঙ্গেই আছে। দাদাবাবু তো ওটাকে এক মুহূর্ত চোখের আড়াল করে না।’

‘আচ্ছা! তাহলে সারাদিনই দুজনেই লাইব্রেরিতে ছিল!’

কেমন আশ্বস্ত মনে হল ধূর্জটিকে।

‘আজ্ঞে হ্যাঁ বাবু!’

দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে অভ্যেস মতো বিছানায় চিৎ হয় ধূর্জটি। তার ঠোঁটের কোনে একটা অদ্ভুত হাসি।

‘বার বার ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান। এইবারে ঘুঘু তব বধিব পরান।’

একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলি।

‘কিচ্ছু বুঝলাম না।’

সিগ্রেট ধরিয়ে কড়িকাঠের দিকে ধোঁয়া ছাড়ে ধূর্জটি। হাতের আঙুল তার টক্‌টক্‌ শব্দ তোলে সিগ্রেটের টিনে।

‘ক্রমশ প্রকাশ্য বৎস, ক্রমশ প্রকাশ্য। কিন্তু আপাতত আমি স্পিকটি নট।’

পরের দিন সকালে একটু বেলা বাড়তেই খবর আসে, ইন্সপেক্টর শিউলাল দ্বিবেদী এসেছেন, দেখা করতে চান।

‘চলো।’

টেবিল থেকে একটা খাম তুলে নিয়ে পা বাড়ায় ধূর্জটি।

পেছনে দু-হাত রেখে উঠোনে দাঁড়িয়েছিলেন শিউলাল দ্বিবেদী।

‘নমস্কার ধূর্জটিবাবু।’

‘নমস্কার শিউলালজী। একেবারে সকালবেলাই!’

‘হ্যাঁ। জবানবন্দী নেওয়ার ছিল কয়েকজনের। তা ছাড়া মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া অবধি গিরিজাপ্রসাদের ঘরটাও সীল করে দিলাম।’

চারপাশে একবার তাকিয়ে নিয়ে হাতের খামটা ইন্সপেক্টর শিউলালের দিকে বাড়িয়ে ধরে ধূর্জটি।

‘শিউলালজী, আমার কয়েকটা খবর দরকার। কী দরকার আমি লিখে দিয়েছি। আপনি যদি এই খবরগুলো আমাকে জোগাড় করে দিতে পারেন, আমার তদন্তের সুবিধে হয়।’

খাম খুলে কাগজটাতে একবার চোখ বোলান ইন্সপেক্টর শিউলাল।

‘এগুলো জোগাড় করতে কিন্তু দিনকয়েক সময় লাগবে। বুঝতেই পারছেন শহর থেকে আমরা অনেক দূরে।’

‘বুঝতে পারছি। তবে যতটা তাড়াতাড়ি পারেন করুন। কারণ এই কাহিনির মূল চরিত্রটিকে পাকড়াও করতে যত দেরি হবে, তত হয়তো প্রাণহানি হবে।’

নমস্কার করে বিদায় নেন ইন্সপেক্টর শিউলাল।

এর পরের দুটো দিন কাটে মন্থর গতিতে। বাড়ির ফটক বন্ধ। স্বয়ং সৌম্যেন্দ্রনারায়ণের হুকুম ছাড়া কারোর বাইরে বেরোনোর বা ভেতরে ঢোকার অনুমতি নেই, গোটা বাড়িটা যেন একটা দুর্গের চেহারা নিয়েছে। কোনও আসন্ন বিপদের আশঙ্কায় সবাই উদ্বিগ্ন, তাদের সবার ভীতি আর দুশ্চিন্তা যেন জমাট বেঁধে ভারী করে তুলেছে বাতাসকে।

এই গৃহবন্দী জীবন যখন প্রায় অসহ্য হয়ে এসেছে, তখন তৃতীয় দিনের সকালবেলা একজন পুলিস কনস্টেবল এসে ধূর্জটিকে সেলাম করল। তার হাতে একটা বড় খাম।

‘শিউলালজী নে ভেজা হ্যায়।’

খামটা হাতে করে সটান ঘরে ঢুকে পড়ে ধূর্জটি।

‘যতীন, দরজাটা বন্ধ করে দাও।’

আমি দরজা বন্ধ করে দিলে সন্তর্পণে খামটা খোলে ধূর্জটি, ভেতরে থেকে টেনে বের করে আনে এক গোছা টাইপ করা কাগজ।

একটার পর একটা পাতায় চোখ বুলোতে থাকে ধূর্জটি আর তার মুখে ধীরে ধীরে পরিস্ফুট হতে থাকে সেই অদ্ভুত হাসিটা।

শেষ পাতাটায় চোখ বুলিয়ে কাগজের তাড়াটা আবার খামে পুরে ফেলে ধূর্জটি। তার মুখের সেই অদ্ভুত হাসিটা তখনও অটুট।

‘কিছু বুঝতে পারলে?’

প্রশ্ন করি উদ্বিগ্ন কণ্ঠে।

‘বুঝেছি বই কি! পাক্কা বুঝেছি! সব একেবারে যাকে বলে জলবৎ তরলং।’

‘তবে—’

খামটার দিকে হাত বাড়াই আমি।

‘উঁহুঃ! আরও কয়েকটা জিনিস মিলিয়ে নিতে হবে আগে।’

খামটা সুটকেসে ভরে তালা বন্ধ করে ফেলে ধূর্জটি।

‘কিন্তু তার আগে বলো তুমি ‘গম’ কথাটার কিছু মানে খুঁজে পেলে?’

সত্যি কথা বলতে কি কয়েকদিন ভেবে সুগম, দুর্গম পার করে বেগম, নিগম, পয়গম অবধি দু-একটা শব্দ মাথায় এলেও সাম্প্রতিক ঘটনাক্রমের সঙ্গে তাদের কোনও তাৎপর্য্য খুঁজে পাইনি। কিন্তু ধূর্জটির সামনে এই মুহূর্তে হেরে যেতেও মন চাইছিল না, সুতরাং বললাম,

‘অর্থাগম! শব্দটা অর্থাগম হবে। খুব সম্ভব বণিক গিরিজাপ্রসাদকে অর্থাগমের টোপ দিয়ে ডেকে পাঠানো হয়।’

ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে ধূর্জটি।

‘কী আশ্চর্য! কল্পনাও যে অনেক সময়ে যুক্তির কাছাকাছি আসতে পারে এটা তোমার সাহচর্য্য না করলে জানতেই পারতাম না।’

‘তাহলে শব্দটা অর্থাগমই?’

‘ঠিক তা নয়, তবে কাছাকাছি গেছো! যাক চলো!’

‘কোথায়?’

‘লাইব্রেরিতে। উপেনের সঙ্গে একটু গল্প করে আসি।’

‘উপেন? উপেন কেন?’

‘দরকার আছে। আরে চলোই না!’

লাইব্রেরিতে ঢোকার মুখে একজন ঝাড়পোঁছ করছিল, তাকে উপেন কোথায় জিজ্ঞেস করতে সে হেসে লাইব্রেরির শেষ প্রান্তের দিকে দেখাল।

‘ওই যে ওইখানে। রঘুকে বল খেলা শেখাচ্ছেন।’

কলগোলামকে বল খেলা শেখানো! মনের ভেতরে খানিকটা কৌতূহল নিয়ে লাইব্রেরিতে পা রাখলাম।

লাইব্রেরির শেষ প্রান্তে একটা উঁচু গরাদবিহীন জানলা। তার পেছনে সবুজ বনানীর ওপর ঝকঝক করে নীল আকাশ। জানলার একপাশে দাঁড়িয়ে কলগোলাম রঘু, অন্যপাশে দাঁড়িয়ে উপেন, তার হাতে একটা বল।

আমি উপেনের দিকে এগোতে যাচ্ছিলাম, ঠোঁটে আঙুল রেখে আমাকে

বাধা দিল ধূর্জটি।

‘কথা বলো না। দেখে যাও।’

দেখলাম উপেন বলটা কলগোলামের দিকে ছুঁড়ল। কলগোলাম বলটা ধরার চেষ্টা করেও ধরতে পারল না, ফস্কে গেল।

আগে লক্ষ করিনি, এখন খেয়াল করলাম, এক পাশে একটা টুলের ওপর একগোছা হলেরিথ কার্ড রাখা। একটা হলেরিথ কার্ড তুলে নিল উপেন, কামিজের পকেট থেকে বের করল একটা মোটা ছুঁচ। দ্রুত হাতে হলেরিথ কার্ডে কয়েকটা পরপর ফুটো করে ভরে দিল কলগোলামের বুকের চেরা ফুটোয়। তারপর বলটা কুড়িয়ে নিয়ে চলে গেল নিজের জায়গায়।

ফের বল ছুঁড়ল উপেন, এবার কোনওরকমে বলটা ধরতে সক্ষম হল কলগোলাম। আবার নতুন একটা হলেরিথ কার্ড ফুটো করে কলগোলামের বুকে পুরে দিল উপেন। এবং আবার ছুঁড়ল বল।

এবার কলগোলাম বলটা ধরে ফেলল অনেকটা অনায়াসেই।

চলতে থাকে উপেনের কলগোলামকে বল ধরা শেখানোর পালা। আমরা দাঁড়িয়ে দেখতে থাকি মন্ত্রমুগ্ধের মতো।

মিনিট পনেরো পর মুখ দিয়ে একটা আনন্দের আওয়াজ করে উপেন। কলগোলাম প্রত্যেকবারই লুফে নিচ্ছে বল, একবারও ফস্কাচ্ছে না।

হাততালি দেয় ধূর্জটি। আমাদের দিকে তাকিয়ে লাজুক হাসি হাসে উপেন।

উপেনের দিকে এগিয়ে যায় ধূর্জটি

‘উপেন, রঘু তোমার খুব বন্ধু?’

ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায় উপেন।

‘উপেন, যখন রঘু বিগড়ে যায় তখন পীতাম্বর বলে যে রঘুকে সারাতে এসেছিল তাকে তুমি চিনতে?’

আবার মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় উপেন।

‘তোমাকে পীতাম্বর বলেছিল রঘুর কী হয়েছিল?’

ফের মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় উপেন। তারপর একটা হলেরিথ কার্ডে

দ্রুতগতিতে কয়েকটা ছিদ্র করে পুরে দেয় কলগোলামের বুকের ফোকরে। শরীরের অভ্যন্তরে যান্ত্রিক আওয়াজ তুলে কলগোলাম বুকের ফোকর থেকে উগরে দেয় একটুকরো ছাপানো কাগজ।

হাতে তুলে নিই কাগজটা। দেখি ইংরেজি অক্ষরে লেখা রয়েছে ‘লাইট’।

‘লাইট! মানে আলো? আলোর সঙ্গে কলগোলাম বিগড়োনোর সম্পর্ক কি?’

ধূর্জটির মুখে ফুটে ওঠে আবার সেই অদ্ভুত হাসিটা।

‘সম্পর্ক? সম্পর্ক আছে বৈকি! বুঝ জন যে জান সন্ধান!’

আমি ফের ধূর্জটিকে বলতে যাচ্ছিলাম হেঁয়ালি ছেড়ে সোজা কথায় আমাকে বোঝাতে, কিন্তু তার আর সুযোগ পেলাম না। সাইরেনের তীক্ষ্ণ আওয়াজ তুলে কলগোলাম হঠাৎ একপাশে সরে এসে তার বিশাল শরীরটা দিয়ে আড়াল করে দাঁড়াল ধূর্জটিকে, তার মাথার আলো দুটো তখন দানবিক চোখের মতো দপদপ করে জ্বলছে। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জানলা দিয়ে বর্শার আকারের কোনও একটা অস্ত্র একটা ধাতব আওয়াজ তুলে আঘাত করল তার বুকে।

সেই ভয়ঙ্কর আঘাতের ধাক্কায় কলগোলাম এক পা হটে গেল, কিন্তু পড়ল না। টাল সামলেই দুহাতে আঁকড়ে বুকের ওপর থেকে তুলে ফেলল বর্শাটাকে। হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে খেয়াল করলাম কলগোলামের চোখের আলোর দপদপানির সঙ্গে তাল রেখে ওঠা পড়া করছে সাইরেনের আওয়াজ আর দুই হাত মুঠো করে তাকিয়ে রয়েছে উপেন, তার চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝরে পড়ছে।

আর তার মধ্যেই বর্শাটা ধীরে ধীরে পালটে যাচ্ছে একটা কুণ্ডলী পাকানো সাপে। তবে সাপ হলেও তার পিঠে বসানো একজোড়া বাদুড়ের মতো ডানা।

হাত থেকে সাপের কুণ্ডলীগুলোকে ছাড়িয়ে সাপটাকে মাটিতে আছড়ে ফেলে কলগোলাম। তার একটা ধাতব পা হাতুড়ির মতো নেমে আসে সাপের মাথায়।

ছিটকে আসে সামান্য রক্ত, একবার দুবার ছটফট করে নিথর হয়ে পড়ে সাপের প্রাণহীন দেহ।

অগ্নিঝরা দৃষ্টি নিয়ে তখনও সাপটার তাকিয়ে উপেন।

থামে সাইরেনের আওয়াজ। নিবে যায় কলগোলামের চোখের আলো।

প্রায় ছুটতে ছুটতেই এসে পৌঁছন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।

‘কী হয়েছে? সাইরেনের আওয়াজ পেয়ে দৌড়ে এলাম। কেউ চোট পাননি তো?’

মেঝেয় পড়ে থাকা সাপটার দিকে ইঙ্গিত করে ধূর্জটি।

‘আপনার ভাইয়ের কলগোলামের জন্য আজ প্রাণে বেঁচে গেছি। আন্দাজ করতে পারি, এটা আমার উদ্দেশেই ছোঁড়া হয়েছিল।

জুতো দিয়ে ডানাওয়ালা সাপটাকে উলটে দেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।

‘কী এটা?’

খুঁটিয়ে দেখে সাপটাকে ধূর্জটি।

‘জ্যাকুলাস! জ্যাভেলিনের মতো একে ছোঁড়া যায় বলে ওই নাম হয়েছে। পুরাকালের গ্রীক আর রোমান মন্ত্রঘাতকদের প্রিয় অস্ত্র। মন্ত্রপাঠ করে শিকারের উদ্দেশে ছুঁড়ে দিলে, নিজেই তার মর্মস্থলে খুঁজে নিয়ে আঘাত করে। লুকানের ফার্সালিয়া কেতাবে এর প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়।

‘কি ভয়ঙ্কর! এ জিনিস দুলমিগড়ে এল কোথা থেকে?’

‘আপনার গোপন শত্রুটির তূণীরে ছিল। তার হাত যে অনেক লম্বা বোঝাই যাচ্ছে।’

উপেনের দিকে ফেরে ধূর্জটি।

‘উপেন, রঘু অমন লাফিয়ে পড়ে আমাকে বাঁচাতে গেল কেন? তুমি কি রঘুকে ট্রেনিং দিয়েছিলে?’

মৃদু হেসে মাথা নাড়ে উপেন। তারপর এগিয়ে গিয়ে কলগোলামের বুকে পুরে দেয় একটা হলেরিথ কার্ড। ঘড়ঘড় আওয়াজ তুলে কলগোলামের বুকের ফোকর থেকে বেরিয়ে আসে একটা ছাপা কাগজ। কাগজে ইংরেজি অক্ষরে লেখা ‘প্রোটেক্ট’।

সপ্রশংস দৃষ্টিতে ভাইয়ের দিকে তাকান সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।

‘হ্যাঁ, আমাদের উপেন বীরপুরুষ। উপেন আমাদের সবাইকে রক্ষা করবে।’

একজন কর্মচারী এসে উপেনের হাত ধরে।

‘চলো দাদাবাবু। মা ঠাকরুণ ডাকছেন।’

আমাদের দিকে হাত নেড়ে কলগোলাম সঙ্গে করে বিদায় নেয় উপেন।

সৌম্যেন্দ্রনারায়ণের দিকে ফেরে ধূর্জটি।

‘কুমারবাহাদুর, আপনার শত্রুর দুঃসাহস দিনের পর দিন বেড়ে চলছে। আর অপেক্ষা করা ঠিক হবে না। এই ষড়যন্ত্রের মূল পাণ্ডাটিকে যদি খুব তাড়াতাড়ি তার চারপাশের গোপন অন্ধকার থেকে আলোয় টেনে আনতে না পারি তাহলে আবার হয়তো প্রাণহানি হবে। আমার একটা অনুরোধ আপনাকে রাখতে হবে।’

‘বলুন।’

‘আমি চিত্তকে দু-একদিনের জন্যে কলকাতা পাঠাতে চাই। আমার হয়ে কয়েকটা খবর জোগাড় করে আনবে। এই মুহূর্তে আমি অন্য কারোর ওপরে ভরসা করতে পারছি না।’

‘অবশ্যই। আমি চিত্তকে আপনার কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি, আপনি যা বোঝাবার ওকে বুঝিয়ে দিন।’

‘আর একটা অনুরোধ ছিল। আপনার উইঞ্চেস্টার রিপিটার রাইফেলটা কয়েকদিনের জন্যে ধার নিতে চাই। আর একটা টোটা সমেত কার্তুজের বেল্ট।’

কপাল কোঁচকান সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।

‘আপনি কি টিপ প্র্যাক্টিস করবেন? তাহলে—’

মৃদু হাসে ধূর্জটি।

‘আপনার চিন্তা নেই। আমি বাড়ির মধ্যে বন্দুক দাগব না। কয়েকটা জিনিস পরীক্ষা করতে চাই কেবল।’

‘বেশ। আমি বন্দুক চিত্তর হাত দিয়েই পাঠিয়ে দিচ্ছি।’

অস্ত্র পরিচয়
অস্ত্র পরিচয়

দুপুরের খাওয়ার পর চিত্ত আমাদের ঘরে এসে হাজির হল।

‘এই নিন রাইফেল আর কার্তুজ। আর কলকাতায় কখন যেতে হবে যদি বলেন।’

‘কাজটা খুব জরুরি চিত্ত। আজ রাতেই তোমায় রওনা দিতে হবে। পারবে তো?’

‘নিশ্চয়ই। কলকাতায় আমায় কী করতে হবে?’

‘বলছি। চলো।’

ঘাড়ে বন্দুক আর আর কার্তুজের বেল্ট ফেলে চিত্তর সঙ্গে সেই যে ধূর্জটি বেরিয়ে গেল, তারপর থেকে তার টিকিটি আর দেখতে পেলাম না।

বিকেলের দিকে ধূর্জটির খোঁজে নিচে নেমেছি, দেখি সুকুমারবাবু খবরের কাগজ হাতে করে কোথায় যাচ্ছেন। আমাকে দেখে ব্যস্ত হয়ে এগিয়ে এলেন।

‘দেখুন দিকি কি অবস্থা! কার নজর লেগেছে এ বাড়িতে। আপনারা অতিথি মানুষ দু-দিনের জন্যে এসেছেন, আপনাদের ওপরেও হামলা! তা আপনাকে দেখছি, ধূর্জটিবাবু কই?’

প্রায় বলতেই যাচ্ছিলাম যে তাকে আমিও খুঁজছি, কিন্তু তার আগেই দরজার কাছ থেকে তার গলার আওয়াজ এল।

‘এই যে এখানে। একটু বাগানে বেড়াচ্ছিলাম।’

বেড়ানোর সখ ধূর্জটির কস্মিনকালেও আছে বলে জানতাম না। কিন্তু তবু চুপ করে রইলাম।

আমাদের কাছে এগিয়ে আসে ধূর্জটি।

‘নমস্কার সুকুমারবাবু। ভালো তো?’

‘আমি তো ভালোই। কিন্তু আপনার ওপর যে শুনলাম হামলা হয়েছে?’

তাচ্ছিল্যের ভঙ্গীতে হাত নাড়ে ধূর্জট।

‘ও ছেড়ে দিন। এই পেশায় থাকলে মাঝে মধ্যে এইরকম ঝামেলা একটু-আধটু সইতে হয়।’

‘তা হলেও। আপনারা অতিথি। আপনাদের ওপর এই রকম আক্রমণ

কাম্য নয়।’

উঠোনের অন্যপ্রান্ত থেকে জুতোর আওয়াজ আসে। ভারী পায়ে এগিয়ে আসেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ। মুখে চিন্তার ছাপ।

‘আবার কিছু হল নাকি সৌমেন?’

সৌম্যেন্দ্রনারায়ণের মুখের চেহারা দেখে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে প্রশ্ন করেন সুকুমারবাবু।

‘আর বলবেন না। এইসব গণ্ডগোল, তার মধ্যে আবার রামসহায় চলে গেছে।’

‘কে রামসহায়? তোমার ফৌজী গরুড়?’

‘হ্যাঁ। পরিবারের কে মারা গেছে সেই মর্মে তার পেয়ে প্রায় এক কাপড়েই বেরিয়ে গেছে। যাওয়ার সময়ে আমার সঙ্গেও দেখা করে যায়নি।’

‘সে কি। ভারী মুস্কিল তো।’

‘হ্যাঁ, আজ তো আর হবে না, কাল আবার ছাদে পাহারা দেওয়ার জন্যে অন্য কাউকে লাগাতে হবে।’

ধূর্জটির দিকে ফেরেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।

‘চিত্ত চলে গেছে আপনার কাজ নিয়ে? বুঝিয়ে দিয়েছেন সব।’

‘হ্যাঁ। দু-একদিনের মধ্যে চিত্ত খবর নিয়ে ফিরলেই আশা করছি এই রহস্যের একটা নিষ্পত্তি করতে পারব।’

‘এই হত্যালীলার পেছনে কে আছে আপনি বুঝতে পেরেছেন নাকি?’

বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।

‘ঠিক জানতে পেরেছি বলব না। তবে একটা আঁচ করতে পেরেছি। চিত্ত বাকি খবরটুকু জোগাড় করে আনলেই বোধহয় একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারব।’

‘কী আঁচ করতে পেরেছেন জানতে পারি কি? অবশ্য যদি বলতে বাধা না থাকে!’

সুকুমারবাবুর কণ্ঠে উৎসুকতার ছোঁয়া।

মৃদু হাসে ধূর্জটি,

‘আরে না না। আপনাদের বলতে আর বাধা কি? তবে এখনও কয়েকটা যুক্তি সাজানো বাকি আছে, কাল অবধি আমায় সময় দিন। কালকে বিকেলে আশা করছি আপনাদের সব পরিষ্কার করে বলতে পারব। কুমারবাহাদুর, আগের দিনের মতো একটা চায়ের বৈঠক বসানো যায় কি? তাহলে খানিক গল্পগাছা করা যায়।’

‘অবশ্যই। চায়ের বৈঠক আর এমন কি বড় ব্যাপার। কালকের বৈঠকেই না হয় সব শুনব আপনার থেকে।’

ফিরে যাওয়ার জন্যে পা বাড়িয়েছেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ, আর একবার ডাক দিল ধূর্জটি।

‘কুমারবাহাদুর, আপনাদের সেরেস্তায় কাগজ কালি জোগান দেয় যে গোপাল, তাকে কাল বিকেলে একবার ডেকে পাঠাতে পারবেন? আমারও কিছু লেখার কাগজ আর কলমের দরকার ছিল।’

‘নিশ্চই। আমি খবর পাঠিয়ে দেব।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *