অর্থতৃষ্ণা – ৩

তিন

গাড়ি যখন ঘণ্টাখানেক লেট করে দুলমিগড়ে এসে থামল তখন সকালের কুয়াশা কাটিয়ে সূর্যটা পুবের আকাশ বেয়ে অনেকখানি ওপরে উঠে গেছে। কিন্তু তবুও প্ল্যাটফর্মে পা রাখতেই কলকাতার সঙ্গে ঠাণ্ডার প্রভেদটা একেবারে হাড়ে হাড়ে টের পেলাম।

ট্রেন থেকে নেমে ধূর্জটির মুখের দিকে একবার তাকালাম। সে যে সেই সৌম্যেন্দ্রনারায়ণের সঙ্গে আমাদের মোলাকাতের পর থেকে মুখে কুলুপ এঁটেছে, তার মুখ দিয়ে আর একটা কথাও বার করাতে পারিনি। সে সেই সাতসকালে ‘ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরি যাচ্ছি’ বলে বেরত, রাত্রের আগে তার আর টিকিটি দেখা যেত না। আর দেখা হলে দু-একটা মামুলি হুঁ-হাঁ ছাড়া তার মুখ থেকে কিছুর শোনার সৌভাগ্য হয়নি।

‘কি হে? তার করে দিয়েছিলে তো? মোটর কোথায়?’

প্ল্যাটফর্মের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা একটা হুড খোলা শেভ্রোলে গাড়ির দিকে আঙুল তুলে দেখাল ধূর্জটি,

‘ওই তো! ওটাই হবে।’

গাড়ির কাছে এসে দাঁড়ালাম বটে, কিন্তু কাউকে দেখতে পেলাম না।

‘গাড়ি রয়েছে বটে। কিন্তু নিতে আসার লোক কই?’

‘হবে কোথাও আশেপাশে!’

বেডিং সুটকেস নামিয়ে রেখে এদিক ওদিক চাইছি, পাশ থেকে কেউ গলা খাঁকারি দিল।

‘বাবু শুনছেন?’

আগন্তুকের পরনে আধময়লা ধুতি আর কামিজ, উর্ধ্বাঙ্গে জড়ানো একটা রং জ্বলে যাওয়া জীর্ণ র‍্যাপার। পরিশ্রম ক্লিষ্ট মুখে উৎসুক চাহনি।

‘আপনারা কি সরকার বাড়ির অতিথি?’

‘হ্যাঁ! আপনি কি আমাদের নিতে এসেছেন।’

‘আরে না না। আপনাদের চিত্ত নিতে এসেছে। আপনাদের ট্রেন আসতে দেরি হচ্ছিল দেখে পোস্টাপিসে কি একটা কাজে গেল।’

এতক্ষণ খেয়াল করিনি, একটু দূরেই পোস্টাপিসের একতলা বাড়িটা নজরে পড়ল।

এক পা এগিয়ে এল ধূর্জটি।

‘তুমি?’

‘আজ্ঞে আমি গোপাল সমাদ্দার। ওই মণিহারী দোকানটা আমার।’

আঙুল তুলে দেখায় গোপাল। পোস্ট-অফিসের ঠিক বিপরীতে একটা হতশ্রী চেহারার বাড়ি। ইটের দেওয়াল, করগটের চাল।

‘কিছু যদি মনে না করেন, একটা নিবেদন ছিল। এই ঠাণ্ডায় কেন মিছিমিছি বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবেন? চিত্তর হয়তো আসতে সময় লাগবে, ততক্ষণ আপনারা আমার দোকানে এসে বসতে পারেন।’

আমি আপত্তি জানাতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু তার আগেই ধূর্জটি দেখি অমায়িক হেসে নিজেই দোকানের দিকে পা বাড়িয়ে দিল।

‘আরে হ্যাঁ হ্যাঁ। ভালোই হয় তাহলে।’

হতভম্ব হয়ে আমি ধূর্জটির পিছু নিলাম, সঙ্গে গোপাল সমাদ্দার।

দোকানটা ছোট বটে, কিন্তু মালে বোঝাই। প্রায় ছাদ অবধি বাক্স-প্যাঁটরায় ঠাসা, দেওয়ালে বসানো তাকেও থরে থরে নানান জিনিসপত্র।

সপ্রশংস দৃষ্টিতে চারদিকে একবার চোখ বোলায় ধূর্জটি।

‘বাঃ! তোমার দোকানে তো প্রচুর জিনিস মজুত দেখছি।’

সলজ্জ হাসি হাসে গোপাল।

‘হ্যাঁ। স্টেশন, পোস্টাপিসের কাছে তো, লোকের আনাগোনা লেগেই থাকে। খদ্দের ধরে রাখতে এটা ওটা সবই রাখতে হয়।’

‘তোমার দোকানে কিছু না পাওয়া গেলে? আর দোকান নেই এখানে?’

মাথা ঝাঁকায় গোপাল।

‘না বাবু, এখানে আর কোনও দোকান নেই। তবে আমার কাছে না থাকলেও, ফরমায়েশি জিনিস আমি কলকাতা থেকে আনিয়ে দিই। আমার কাছে থেকে খদ্দের খালি হাতে ফিরে যায় না।’

‘বাঃ! তা তোমার বাসা কোথায়?’

গোপালের মুখের হাসিটা কেমন ম্লান হয়ে এল।

‘একা মানুষ, আলাদা বাসা করে আর কি করব? তা ছাড়া দোকানের ঝাঁপ সেই সাতসকালে খোলে, আর রাতবিরেতে বন্ধ হয়। আমি এই দোকানের পেছনের ঘরখানাতেই থাকি। আসুন না।’

খেয়াল করলাম দোকানের পেছনের দেয়ালে একটা দরজা। দরজায় পাল্লা নেই, কেবল একটা তেলচিটে কাপড় পর্দার মতো করে টাঙানো।

গোপালের পেছনের ঘরে পা রাখলাম আমি আর ধূর্জটি। ঘরের একপাশে

একটা তক্তাপোষ, তাতে একটা ময়লা চাদর পাতা। এক কোনে জলের কুঁজো, কয়েকটা থালাবাসন আর একটা তোলা উনুন। দেওয়ালে টাঙানো দড়িতে কয়েকটা অপরিচ্ছন্ন জামাকাপড়। ঘরের সর্বত্র দারিদ্র আর অবহেলার ছাপ স্পষ্ট।

‘বসুন বাবু।’

তক্তপোষের নড়বড়ে চেহারাখানা দেখে আমি বসব কি বসব না ইতস্তত করলেও, ধূর্জটির সে বিষয়ে কোনও বিকার দেখা গেল না। সে পায়ের ওপর পা তুলে আয়েস করে বসে পড়ল।

‘তা গোপাল, তুমি অনেক রাত্তির অবধি দোকান খোলা রাখ?’

‘হ্যাঁ বাবু। কিন্তু কয়েকদিন ধরেই ভাবছি এবার থেকে তাড়াতাড়িই দোকান বন্ধ করে দেব। দিনকাল ভালো নয়, দু-দুটো খুন হয়ে গেছে। ক-টা পয়সার জন্যে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে লাভ কি?’

‘ঠিক বলেছ। তা খুনের ব্যাপারে জানো নাকি তুমি কিছু?’

‘ওই লোকের মুখে যেটুকু শোনা ততটুকুই। শুনেছি জঙ্গলে দুটো মানুষের লাশ পাওয়া গিয়েছিল। সারাদিন দোকান সামলাতেই কেটে যায়, অত খোঁজ রাখার সময় কোথায় বাবু!’

‘তা তোমার এ দোকান কদ্দিনের গোপাল?’

‘বেশিদিনের না। বছরখানেক হবে। আগে এলাহাবাদে একটা কারখানায় মিস্ত্রির কাজ করতাম। মাইনে মন্দ পেতাম না।’

‘তা ছাড়লে কেন সে কাজ?’

‘সে কী আর সাধ করে ছেড়েছি? একদিন চিৎ হয়ে একট মেশিনের পায়ার বল্টু ঠিক করছি, ওপর থেকে একটা ভারী শিক পড়ে পেটে গেঁথে গেল।’

‘সে কি!’

‘হ্যাঁ বাবু। অনেকদিন হাসপাতালে থাকার পর নিরাময় হলাম বটে, কিন্তু তখন আর কারখানায় কাজ করার মতো শরীরে বল নেই। হাতে যে কটা টাকা ছিল, তাই দিয়ে এই দোকানটা দিলাম।’

কথা বলতে বলতে হঠাৎই সামনের দেওয়ালে চোখ পড়ে ধূর্জটির।

‘তোমার কি বইয়েরও সখ আছে নাকি হে গোপাল?’

লক্ষ করি দেওয়ালে একটা তাকের ওপর সাজানো বইয়ের সারি।

ম্লান হাসে গোপাল,

‘না না বাবু। আমি বইয়ের আর কি বুঝি! এলাহাবাদে আমি এক মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে থাকতাম, বইগুলো তাঁর। তিনি কলকাতায় চাকরি নিয়ে চলে যাওয়ার সময় আমায় দিয়ে যান। আমায় খুব স্নেহ করতেন, তাই রেখে দিয়েছি।’

উঠে দাঁড়িয়ে দু-একটা বই উলটেপালটে দেখে ধূর্জটি।

‘বাঃ বেশ ভালো অবস্থাতেই আছে দেখছি। দেখ যতীন।’

ধূর্জটির হাত থেকে নিই বইটা। মরক্কো লেদারে বাঁধানো, সোনার জলে নাম লেখা। বেচারের ‘ফিজিকা সাবটেরানিয়া’।

‘হ্যাঁ সত্যিই, বেশ যত্ন করে রাখা বই। বেচবে নাকি গোপাল?’

‘না বাবু। ভালোবেসে দেওয়া জিনিস, অনেক অভাবেও বিক্রি করিনি।’

আমার হাত থেকে বইটা নিয়ে তাকে তুলে রাখে গোপাল।

‘কিছু যদি মনে না করেন বাবু, একটা কথা জিজ্ঞেস করি। আপনারা কি ওই খুনের ব্যাপারেই এখানে এসেছেন?’

দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে আসে ধূর্জটির,

‘হঠাৎ এ কথা কেন বলছ গোপাল?’

কেমন থতমত খায় গোপাল।

‘না আপনি একটু আগেই আমার কাছে খুনের কথা জানতে চাইছিলেন কিনা, তাই জিজ্ঞেস করছিলাম।’

ধূর্জটি ফের কি বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই বাইরে থেকে কার হাঁক শোনা গেল।

‘গোপালদা, ও গোপালদা।’

যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল গোপাল।

‘চিত্ত এসে গেছে। চলুন।’

গোপালের দোকান ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসি আমরা।

চিত্তর পরণে খাকি ট্রাউজার্স আর অলিভ গ্রীন পুলোভার। পুলোভারের নিম্নাংশ প্যান্টের মধ্যে গোঁজা। পায়ে ভারী বুট, কোমরে কালো রঙের চওড়া বেল্ট। বেল্টের একপাশে বাঁধা হোলস্টার থেকে উঁকি মারছে পিস্তলের বাট। বাটে বাঁধা কর্ডের দড়ির অন্যপ্রান্ত গলায় ঝোলানো। প্রায় মিলিটারি সাজপোষাক বললেই চলে।

‘কিছু মনে করবেন না স্যার। পোস্টাপিসে একটু দেরি হয়ে গেল।’

হাত নেড়ে গোপালকে বিদায় জানায় ধূর্জটি,

‘আরে না না। আমাদের কোনও অসুবিধে হয়নি। আমরা দিব্যি গোপালের সঙ্গে গল্প করছিলাম।’

গাড়িতে উঠে বসি

গাড়িতে উঠে বসি। জঙ্গল ঘেরা আলোছায়া মাখা পথ ধরে ছুটতে থাকে মোটর। কিছুক্ষণ চলার পর মোটর বড় রাস্তা ছেড়ে বাঁক নেয় একদিকে, জঙ্গলটাও ক্রমে পাতলা হয়ে আসে। আর তার একটু বাদেই মোটর এসে দাঁড়ায় একটা লোহার ফটকের সামনে।

মাথা তুলে দেখার চেষ্টা করি। ফটকের দু-পাশের প্রাচীর কমপক্ষে দু-মানুষ উঁচু, মাথায় তার কাঁটাতারের কুণ্ডলী। বাইরে থেকে কিছু দেখার উপায় নেই।

ধীরে ধীরে খুলে যায় ফটক, মোরাম বেছানো পথ ধরে আমাদের গাড়ি

ঢোকে ভেতরে।

পথের দুপাশে ফুলের বাগান আর ঘাসের লন। তাদের মাঝে উড়ে বেড়ায় রংবেরঙের প্রজাপতি। পথের মাঝে বসানো মার্বেলের ফোয়ারা। তার জলনিক্কণে সুর মিলিয়ে ডেকে চলে কোনও নাম না জানা পাখি।

আর এসবের সঙ্গে কুৎসিতভাবে বেমানান হয়ে পথের একপাশে একটা মাচার ওপর থেকে মাথা উঁচিয়ে থাকে একটা জাম্বুরকের কালো নল।

পথের শেষে দোতলা উঁচু বাড়ি। তার সামনের সিঁড়ি থেকে নেমে এলেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ। পরনে ফ্লানেলের ট্রাউজার্স আর ভারী কার্ডিগান।

‘আসুন আসুন। পৌঁছতে কষ্ট হয়নি তো?’

গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে যায় ধূর্জটি,

‘না না। ট্রেন ঘণ্টাখানেক লেট ছিল কেবল। এ ছাড়া আর কোনও কষ্ট হয়নি।’

বাড়ির ভেতরের দিকে হাত বাড়িয়ে দেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ,

‘আসুন।’

মূল দরজা পেরিয়ে বাড়ির ভেতরে পা রাখি। চারমহলা বাড়ি। মাঝের চকমিলান উঠোনকে প্রাচীরের মতো ঘিরে রেখেছে বাড়ির চারটে অংশ। একতলায় উঠোন ঘিরে দালান, দোতলায় টানা বারন্দা। মাথার ওপর শীতের নির্মেঘ নীল আকাশ।

উঠোনে দাঁড়িয়ে কিঞ্চিৎ ইতস্তত করেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।

‘এতটা পথ এসেছেন, আপনারা কি আগে খানিকটা বিশ্রাম করে নেবেন?’

মাথা ঘুরিয়ে চারপাশটা দেখে নেয় ধূর্জটি।

‘বিশ্রাম তো অবশ্যই নেব, কিন্তু তার আগে আপনাদের বাড়ির চতুর্দিকটা একটু দেখে নিতে চাই।’

হাত তুলে একে একে ইঙ্গিত করেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ। বাড়ির একটা মোটামুটি আন্দাজ পাই আমরা।

যেদিক দিয়ে আমরা ঢুকেছি একতলার সেই সামনের দিকটা এস্টেটের

সেরেস্তা আর মহাফেজখানা। দিনের বেলাটা সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ এখানেই কাটান। এর বিপরীতে পরপর কয়েকখানা ঘর, এস্টেটের কিছু কর্মচারীদের থাকার জায়গা। বাঁ দিকে অনুরূপ আরও কয়েকখানি ঘর। এস্টেটের কাজে এসে কাউকে রাত্রিবাস করতে হলে তাদের এই ঘর খুলে দেওয়া হয়। ডান দিকে ভাঁড়ার, রসুই আর এস্টেটের কর্মচারীদের আহারের ঘর।

‘বুঝতেই পারছেন, আমাদের বাস একেবারে জঙ্গলের মধ্যে। অতএব এই সুবিধাটুকু দিতেই হয়।’

ওপরের দিকে একবার তাকায় ধূর্জটি,

‘একতলাটা তাহলে আপনার কাজের এলাকা।’

‘তা একরকম বলতে পারেন। কাজের বাইরে আমার বাসস্থান দোতলায়। চলুন।’

সিঁড়িতে পা রাখে ধূর্জটি,

‘আপনার ড্রাইভার চিত্তর সাজপোষাক একেবারে মিলিটারির মতো।’

মৃদু হাসেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।

‘চিত্ত মিলিটারিই। কর্পোরাল চিত্ত দাস। মেসোপটেমিয়ায় ফৌজে ছিল, যুদ্ধের পর আমিই সঙ্গে করে নিয়ে আসি। তবে মাঝেমধ্যে গাড়ি চালালেও চিত্ত ড্রাইভার ঠিক নয়, এস্টেটের নজরদার। এস্টেটের সুরক্ষার দায়িত্বটা সব চিত্তর।’

দোতলায় অনেকগুলো ঘর। বেশ কয়েকটা শোবার ঘর আর একটা আলাদা খাবার ঘর ছাড়াও দোতলার অনেকখানি জুড়ে রয়েছে যে ঘরটা তাকে সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ লাইব্রেরি বলে ডাকলেও সেটাকে সংগ্রহশালা বললে অত্যুক্তি হয় না।

টানা লম্বা ঘরখানার একদিকে সারি সারি গরাদহীন উঁচু জানলা। জানলা দিয়ে আসা রোদের আলো লুটিয়ে পড়ছে মাটিতে বেছানো রঙিন গালিচার ওপর। জানালার পাশের দেওয়ালে পরের পর টাঙানো নানান বিচিত্র দর্শন পশু করোটি। ঘরের অন্যদিকে বই বোঝাই তাক উঠে গেছে মেঝে থেকে ছাদ অবধি। ঘরের মেঝেতে বসানো রয়েছে পেতলের জ্যোতিষযন্ত্র আর দু-একটা টেলিস্কোপ, একপাশে একটা কাঠামোয় টাঙানো একটা ইয়েতির কঙ্কাল।

বই বোঝাই তাক

মুগ্ধ দৃষ্টিতে ঘরের চারপাশে তাকিয়ে দেখে ধূর্জটি,

‘আপনার বিজ্ঞানচর্চায় বেশ আগ্রহ আছে দেখছি!’

সৌম্যেন্দ্রনারায়ণের হাসির শব্দটা ঘরময় ছড়িয়ে যায়।

‘ভুল ভাবছেন! বিজ্ঞানচর্চা কেন, কোনও পড়াশোনাতেই আমার তেমন কোনও আগ্রহ নেই।’

অবাক হয় ধূর্জটি।

‘তবে!’

জ্যোতিষযন্ত্র
জ্যোতিষযন্ত্র

‘যা দেখছেন সব আমার বাবা আর কাকার সংগ্রহ। কলকাতায় আপনাকে বলা হয়নি, এইবার আমাদের পারিবারিক ইতিহাস খানিকটা বলি। আমার ঠাকুর্দা কুমার নরেন্দ্রনারায়ণ সরকার ধনী ব্যবসায়ী ছিলেন, বহু মার্চেন্ট ফার্মের সঙ্গে তাঁর লেনদেন ছিল। নরেন্দ্রনারায়ণের দুই পুত্র। আমার বাবা নৃপেন্দ্রনারায়ণ আর কাকা নগেন্দ্রনারায়ণ। এঁরা দুজনেই অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন, বিজ্ঞানে দুজনেরই প্রগাঢ় আগ্রহ ছিল। দুজনেই ফাদার লাফঁর কাছে বহুকাল বিজ্ঞান শিক্ষা করেছিলেন।’

‘কিন্তু শহর ছেড়ে এত দূরে এমন সংগ্রহশালা আর লাইব্রেরি খুলতে গেলেন কেন দুজনে?’

‘উপায় ছিল না বলে। বিজ্ঞানচর্চা নিয়ে দু-ভাই এমন মশগুল ছিলেন যে ঠাকুর্দার ব্যবসায়ে তাঁদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। বহু চেষ্টা করেও দুজনকে ব্যবসায় ঢোকাতে না পেরে অবশেষে নরেন্দ্রনারায়ণ এই জমিদারীটা কিনে দুজনকে এর দায়িত্বে পাঠিয়ে দেন। তাঁর মনে হয়তো আশা ছিল যে কলকাতা থেকে দূরে থাকলে দুই ভাইয়ের ঘাড় থেকে বিজ্ঞানের ভূত নেমে যাবে।’

হেসে ফেলল ধূর্জটি,

‘সে আশা যে সফল হয়নি তা এই ঘরখানা দেখলেই বোঝা যায়।’

‘তা হয়তো হয়নি। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে পরিবারে কয়েকটি পরপর অঘটন ঘটল। প্রথমে ঠাকুর্দা দেহ রাখলেন। তারপর আমার ছোট ভাই উপেন্দ্রনারায়ণের জন্মের সময় মা মারা গেলেন। উপেন একটু বড় হতে বোঝা গেল সে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক নয়, তার বুদ্ধিবৃত্তি কিছুটা কম। এ সবের ধাক্কায় বাবা কেমন আনমনা হয়ে পড়লেন, সব ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি বিজ্ঞানচর্চায় মন দিলেন। কাকা কাকীমা নিঃসন্তান ছিলেন, তাঁরা উপেনকে নিজের মতো করে মানুষ করতে লাগলেন। উপেনের দায়িত্ব পেয়ে কাকা আরও বিষয়ী হয়ে পড়লেন, বিজ্ঞান ভুলে জমিদারী নিয়ে পড়লেন।

‘আর আপনি?’

‘আমি? আমি ছেলেবেলায় কিছুটা দুর্দান্ত প্রকৃতির ছিলাম, বইয়ের চাইতে বন্দুক বেশি প্রিয় ছিল। সুতরাং বয়স হতেই মিলিটারিতে নাম লেখালাম।’

ধূর্জটি ফের কী প্রশ্ন করতে যাচ্ছিল, তার আগেই সংগ্রহশালার অন্যদিক থেকে ভারী পায়ের আওয়াজ ভেসে এল। সঙ্গে একটা যান্ত্রিক ঘর্ঘর আওয়াজ।

আওয়াজের উৎস বুঝতে দেরি হল না। হ্যাঁচকা টানে পায়ের পর পা ফেলে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে এক কলগোলাম। তার দু-চোখের ঘোলাটে কাচের পেছনে বৈদ্যুতিক আলোর নীলাভ সাদা প্রভা, পেতলের শরীর থেকে ছিটকে যাচ্ছে জানলা দিয়ে আসা সূর্যের আলো, দুপাশে ছড়ানো হাতের ধাতব আঙুলগুলো সাঁড়াসির মতো বাঁকানো। মানবের তৈরি দানব।

মৃদু হাসেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ,

‘উপেন ভাব জমাতে এসেছে।’

কলগোলামের দিকে তাকায় ধূর্জটি।

‘এটা আপনি কি কোনও বিশেষ কাজের জন্যে কিনেছিলেন?’

‘না। জন্ম থেকেই উপেন খুব একটা স্বাভাবিক নয়। তার ওপর পিশাচের আক্রমণে কাকীমার মৃত্যু হওয়ার পর তার অবস্থার আরও অবনতি হয়, কথা বলাই বন্ধ করে দেয়। কিন্তু কথা না বললেও লক্ষ করতাম ও বাবার যন্ত্রপাতিগুলো নিয়ে খুটখাট করে। ওর মন ভোলানোর জন্যেই কলগোলামটা কিনেছিলাম। এখন ওটা ওর সর্বক্ষণের সঙ্গী।’

আমাদের কাছে এসে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে কলগোলাম, তার বুকের পোর্টহোলের পেছনে একটা হলদেটে আলো বারকয়েক জ্বলে নিবে ওঠে। তারপর একটা যান্ত্রিক শব্দ তুলে বুকের একটা চেরা ফোকর থেকে একফালি কাগজ বেরিয়ে আসে।

কলগোলামের বুক থেকে কাগজটা ছিঁড়ে নিয়ে আমাদের দিকে বাড়িয়ে ধরেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।

‘উপেনের দেওয়া নাম। ওর সঙ্গীকে কলগোলাম বলে ডাকাটা উপেনের মোটে পছন্দ নয়।’

কাগজটাতে চোখ রাখি। কালো কালিতে ইংরেজি অক্ষরে লেখা রয়েছে ‘রঘু’।

‘উপেন! উপেন!’

ডাক পাড়েন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।

খানিকটা দূরে একটা কাচের আলমারির পেছন থেকে একটা কিশোর মুখ উঁকি মারে। এক মাথা চুল। গভীর কালো দুটো চোখ।

‘উপেন। এঁদের সঙ্গে রঘুর আলাপ হয়ে গেছে, তুমি রঘুকে নিয়ে যেতে পার।’

কলগোলাম ‘রঘু’ / অলংকরণ: অদ্রীজা বর্ধন
কলগোলাম ‘রঘু’ / অলংকরণ: অদ্রীজা বর্ধন

সন্ত্রস্ত চাহনি নিয়ে আমাদের দিক ধীর পায়ে এগিয়ে আসে উপেন। তার বাঁ হাতে ধরা এক তাড়া খুদে খুদে ছক কাটা কার্ড।

আমার আর ধূর্জটির একবার ওপর চোখ বুলিয়ে নিয়ে তাড়া থেকে একটা কার্ড টেনে বের করে উপেন। লক্ষ করি কার্ডের ছকে ইতস্তত কিছু ফুটো করা করা রয়েছে। হাত উঁচু করে উপেন কার্ড ঢুকিয়ে দেয় কলগোলামের বুকের চেরা ফোকরটাতে।

হলেরিথ কার্ড
হলেরিথ কার্ড

একটা শব্দ তুলে সচল হয় কলগোলাম, একটা হাত বাড়িয়ে হাত ধরে উপেনের। তারপর পেছন ফিরে উপেনের সঙ্গে হাঁটা দেয় লাইব্রেরির অন্যদিকে।

এক অপরিণত কিশোরের নিশ্চিন্ত মনে এক যন্ত্রদানবের হাত ধরে হেঁটে যাওয়ার দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে থাকি বিস্ময়ে।

‘উপেনের হাতের কার্ডগুলো কি হলেরিথ কার্ড?’

খেয়াল করি সৌম্যেন্দ্রনারায়ণকে প্রশ্ন করছে ধূর্জটি।

‘হ্যাঁ, কলগোলামকে ওই দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।’

‘কলগোলামকে কি উপেন ছাড়া আর কেউ কখনও হলেরিথ কার্ড ব্যবহার করে চালায়?’

‘না ধূর্জটিবাবু। এ বাড়ির লোকজন কলগোলামের কাছে ভয়ে ঘেঁসতে চায় না, তাকে চালানো তো দূরের কথা। আমার ভয় নেই বটে, কিন্তু কলগোলাম চালানোর বিদ্যে আমার সাধ্যের বাইরে। এ বাড়িতে রঘুর উপেন ছাড়া আর কোনও দ্বিতীয় মালিক নেই।’

ঘরের বাইরে পা বাড়ায় ধূর্জটি, কপালে তার চিন্তার ভাঁজ।

‘বাড়ির ছাদটা একবার দেখতে চাই।’

‘চলুন। চিত্ত ছাড়াও মিলিটারি থেকে আর একজনকে নিয়ে এসেছিলাম। তার সঙ্গেও দেখা হয়ে যাবে।’

ছাদটা খালি, কোনও জিনিস নেই। কেবল পাঁচিলের ধারে পর পর বসানো গোটাকতক তোড়াদার জাজেল, তাদের বিশাল লম্বা নলগুলো বাইরের দিকে তাক করা।

ঘাড় বেঁকিয়ে একটা জাজেলের মাছি বরাবর চোখ রাখে ধূর্জটি।

‘দূরপাল্লার বন্দুক।’

জাজেলের বাটে আলতো চাপড় মারেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ,

‘হ্যাঁ। পুরানো অস্ত্র বটে কিন্তু খুব কাজের।’

পাঁচিল দিয়ে নিচে ঝুঁকে দেখে ধূর্জটি।

‘আসার সময় নিচে একটা জাম্বুরকও চোখে পড়ল।’

‘হ্যাঁ। পুরানো কায়দার হাত-কামান, পাল্লাও বেশি নয়, কিন্তু ছর্‌রা ভরে দাগলে একসঙ্গে দশ-বিশজনকে পেড়ে ফেলতে পারে।’

‘এ সব ব্যবস্থা নিশ্চই আপনার করা?’

‘হ্যাঁ। মেসোপটেমিয়া থেকে ফিরে এসে আমি এগুলো বসাই, বাড়ির পাঁচিলটাকে আরও উঁচু করে দিই। আর চিত্ত আর রামসহায়কে সঙ্গে করে নিয়ে এসে বাড়ি আর এস্টেটের পাহারার দায়িত্ব দিই।’

‘চিত্তকে তো দেখেছি। রামসহায়?’

‘আলাপ করিয়ে দিচ্ছি।’

ছাদের এক কোনে একটা ছোট ঘর। তার দিকে মুখ করে ডাক দেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।

‘রামসহায়! রামসহায়!’

ঘর থেকে ধীর পায়ে একজন গরুড় বেরিয়ে আসে। উচ্চতায় কমপক্ষে

সাত ফুট হবে, চওড়া কাঁধের থেকে বেরিয়ে আসা ডানা দুটো প্রায় মাটি ছুঁয়েছে। পরণে সাদা চাপকান আর পাজামা। হলুদ রঙের কোমরবন্ধের একপাশে তলোয়ার বাঁধা, অন্যদিকে একটা দুনলী হাওদা পিস্তল গোঁজা। পিস্তলের নলগুলোর দৈর্ঘ্য এক হাতের কম হবে না। মাথার কাঁচা পাকা চুল আর ডানার পালকের ইতস্তত কালো দাগে বয়সের ছাপ সুস্পষ্ট।

‘জী হুজুর!’

ধূর্জটির দিকে তাকান সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।

‘রামসহায় আমার সঙ্গে ফৌজে ছিল। গরুড় পল্টনে। রামসহায়, এঁরা কলকাতা থেকে এসেছেন।’

‘সেলাম হুজুর।’

আমাদের দিকে ফিরে কুর্ণিশ করে রামসহায়।

রামসহায়ের পেছনের ঘরটার দিকে তাকায় ধূর্জটি,

‘এই ঘরটাও বোধহয় আপনিই তুলিয়েছেন।’

গরুড় ‘রামসহায়’ / অলংকরণ: অদ্রীজা বর্ধন
গরুড় ‘রামসহায়’ / অলংকরণ: অদ্রীজা বর্ধন

‘হ্যাঁ, রামসহায় ঘরটাতে বসে। তা ছাড়া ওখানে কয়েকটা বন্দুক আর কিছু গুলি বারুদও মজুত করা আছে।’

হেলিওগ্রাফ
হেলিওগ্রাফ

ধূর্জটি আবার কী জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল, কিন্তু হঠাৎ আমার নজরে পড়ল দূরে একটা টিলার মাথায় একটা প্রখর আলো থেকে থেকে ঝলসে উঠছে।

বিস্ময় চেপে রাখতে পারলাম না।

‘কী ওটা?’

আলোর দিকে তাকালেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।

‘ও কিছু না। হেলিওগ্রাফ।’

ভ্রু কোঁচকাল ধূর্জটি।

‘হেলিওগ্রাফ! কোনও মাপজোকের কাজ চলছে নাকি?’

‘হ্যাঁ। সুকুমারবাবু বোধহয় কিছু জরিপের কাজ করছেন।’

‘সুকুমারবাবু কে?’

আলোর ঝলকানির দিকে তাকান সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।

‘সুকুমার ঘোষাল। ভূবিজ্ঞানী। আমার বাবার বিজ্ঞানচর্চার সময়কার বন্ধু। দুজনের মধ্যে এমন প্রগাঢ় বন্ধুত্ব ছিল যে একবার ঠিকই করেছিলেন চাকরিবাকরি ছেড়ে দিয়ে এই জঙ্গলে এসে বাড়ি বানিয়ে থাকবেন। বাবা কোনওমতে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ফেরত পাঠান।’

‘কোথায় চাকরি করতেন সুকুমারবাবু?’

‘উনি পশ্চিমে কোনও একটা কলেজে পড়াতেন। সেখানেই টুকটাক কিছু গবেষণার কাজও বোধহয় করতেন। মাঝে মধ্যে সময় সুযোগ পেলে ছুটি নিয়ে আমাদের এখানে আসতেন। কিন্তু একবার হঠাৎ ওঁর মাথায় কী ঝোঁক চাপল, বাবাকে এসে বললেন চাকরি ছেড়ে দিয়ে একেবারে পাকাপাকিভাবে এখানে এসে থাকবেন।’

‘এখানে মানে আপনাদের এই বাড়িতেই?’

‘না না। যেখান আলো ঝলসাচ্ছে, সেই টিলাটার নাম পিংলা পাহাড়। ওই পাহাড়ের জমিটা বাবার কাছে কিনতে চেয়েছিলেন ওখানে বাড়ি বানিয়ে থাকবেন বলে। বাবা চাকরি ছাড়তে মানা করে অনেক করে বুঝিয়ে ফেরত পাঠান।’

‘উনি দুলমিগড়ে ফের এলেন কবে?’

‘বাবার মৃত্যুতে সুকুমারবাবু মনে খুব আঘাত পান। কলেজের প্রফেসারি ছেড়ে দিয়ে গোলকুণ্ডায় একটা চাকরি নিয়ে একরকম অজ্ঞাতবাসেই চলে যান। আমার সঙ্গে তেমন কোনও যোগাযোগ ছিল না। কয়েক মাস হল জমিজঙ্গল জরীপ করার একটা সরকারি কাজ পেয়ে দুলমিগড়ে এসেছেন।’

‘এই বাড়িতেই থাকেন?’

‘না। উনি লোকজন নিয়ে জঙ্গলেই তাঁবু খাটিয়ে থাকেন। তবে বিকেলের

দিকে নিয়মিত আসেন। চা খান, খবরের কাগজ পড়েন, আমার সঙ্গে দু-একটা পুরানো দিনের গল্প করেন, তারপর ফেরত চলে যান।’

‘ওঁর সঙ্গে একটু আলাপ করা যাবে?’

‘অবশ্যই যাবে। আজ বিকেলে একসঙ্গে চা খেতে বসলেই হল। আপনার এখন ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নিন, দুপুরের খাবারটা আমি আপনাদের ঘরেই পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করছি। বিকেলে সুকুমারবাবু এলে আপনাদের ডেকে নেব।’

দোতলার একটা ঘরে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হল। ঘরের জানলা গিয়ে চোখে আসে দিগন্ত জোড়া বনানী, প্রকৃতির গভীর নিঃশ্বাসের মতো বাতাস তার মধ্যে দিয়ে ছুটে যায় মর্মর ধ্বনিতে, সঙ্গে বয়ে আনে নানান পাখির কুজন লহরী।

প্রকৃতির এই শ্যামল অঞ্চলছায়ে যে পরপর ঘটে গেছে নির্মম নৃশংস হত্যালীলা সেটা যেন বিশ্বাস করতে মন চায় না।

‘কী বুঝলে?’

জানলার বাইরের শোভা দেখতে দেখতেই প্রশ্ন করলাম ধূর্জটিকে।

‘বিশেষ কিছুই এখনও বুঝে উঠতে পারিনি, তবে এই কাহিনির কোনও কিছুই যে সোজা নয় সেটুকু বোধহয় বুঝতে পারছি।’

‘কেন?’

‘ভেবে দেখ! এই কাহিনিতে চোরে এয়ারশিপ চেপে চুরি করতে আসে, জঙ্গলে হেলিওগ্রাফের আলো ঝলসায়, কলগোলামকে হাত ধরে হাঁটিয়ে নিয়ে যায় অপরিণত বালক, কামান বসানো দুর্ভেদ্য দুর্গের মতো বাড়ি পাহারা দেয় গরুড়ে। কোনও কিছুই তোমার সহজ মনে হচ্ছে যতীন?’

এর পর থেকে ধূর্জটির মুখ থেকে আর একটা কথা বের করাতে পারলাম না। সে চিৎ হয়ে কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে রইল, তার হাতের আঙুল সিগ্রেটের টিনের ওপর টক্‌টক্‌ শব্দ তুলে চলল।

দুপুরের আহারের পর আরামকেদারায় বসে থাকতে থাকতে চোখটা কখন বুজে এসেছে বুঝতে পারিনি। ঘুম ভাঙল ধূর্জটির ডাকে।

‘আরে ওঠ ওঠ, রহস্য ভেদ করতে এসে এমন ঘুমোলে চলে?’

ধড়ফড় করে উঠে পড়লাম,

‘কী হয়েছে?’

ধূর্জটির মুখে মৃদু হাসি,

‘কী আর হবে। চায়ের ডাক এসেছে, চলো।’

সিঁড়ি দিয়ে একতলায় নেমে এলাম। চকমিলান উঠোনের একপাশে বেতের টেবিল চেয়ার পাতা রয়েছে, টেবিলের ওপর চায়ের সরঞ্জাম। সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ একটা চেয়ারে বসে ছিলেন, আমাদের দেখে উঠে দাঁড়ালেন।

‘আসুন, আসুন। সুকুমারবাবু বোধহয় সেরেস্তা থেকে আজকের খবরের কাগজটা আনতে গেছেন, এখনি এসে পড়বেন। ওই তো।’

দেখলাম সেরেস্তা থেকে বেরিয়ে উঠোন পেরিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছেন একজন প্রৌঢ় মানুষ। একরাশ কাঁচাপাকা চুল, আবক্ষ কাঁচাপাকা দাড়ি, চোখে কালো ফ্রেমের গোল চশমা, পরণে বুশ জ্যাকেট। শান্ত, সৌম্য চেহারা।

‘নমস্কার! আপনিই ধূর্জটিবাবু। সৌমেন বলছিল বটে আপনি আসবেন। বসুন বসুন।’

টেবিল ঘিরে বসি আমরা সবাই। টেবিলে একটা খবরের কাগজ আর একটা বই নামিয়ে রাখেন সুকুমারবাবু। বেয়ারা এসে পেয়ালায় চা ঢালে, কুকিজ্‌ ভরা প্লেট এগিয়ে দেয়।

চায়ে চুমুক দেন সুকুমারবাবু,

‘কী বিপদ দেখুন দিকি! নৃপেনের মতো এমন অজাতশত্রু মানুষ আমি আজন্ম দুটি দেখিনি। অত বড় বাড়ির ছেলে অথচ কাউকে কোনওদিন দুটো কড়া কথা বলতে শুনিনি। মুখে হাসিটি সর্বদা লেগে থাকত। তার ওপর এমন আক্রমণ কে করল, কেন করল আজও বুঝে উঠতে পারিনি। আর সৌমেন সেই পিতৃশোকের দুঃখ ভুলতে না ভুলতে আবার দু-দুটো খুন।

নিজের চায়ের কাপে আলগোছে চামচ নাড়ে ধূর্জটি।

‘শুনলাম নৃপেন্দ্রনারায়ণ আর আপনি খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন?’

‘সে আর বলতে। নৃপেন আমার ভাইয়ের মতো ছিল। একবার তো ঠিকই করেছিলাম কলেজের চাকরি ছেড়ে দিয়ে এইখানে পাকাপাকি এসে থাকব। কেবল গবেষণায় মন দেব।’

‘থাকলেন না কেন?’

হাসলেন সুকুমারবাবু,

‘নৃপেন ঠেলেঠুলে পাঠিয়ে দিল যে। বলল—শুধু গবেষণা করলেই হয় না। সঙ্গে মানুষকে শেখাতেও হয়। এই যে এতগুলো ছাত্রকে পড়াচ্ছ এতে বিজ্ঞানচর্চার প্রসার কি কম হচ্ছে? এটাও একটা দায়িত্ব।’

‘আপনি মেনে নিলেন?’

ফের হাসলেন সুকুমারবাবু,

‘নৃপেনের কথা কি ফেলতে পারি? কথাটা ভুল তো কিছু বলেনি সে। তা ছাড়া ঝোঁক নেমে গেলে ঠাণ্ডা মাথায় আর একটা কথা ভেবে দেখলাম। নৃপেনের জমিদারি আছে, তার চাকরির প্রয়োজন নেই, কিন্তু আমি চাকরি ছেড়ে দিলে খাব কি? খালি পেটে তো আর গবেষণা হয় না!’

চায়ের কাপ তুলে নেয় ধূর্জটি।

‘আপনাদের মতো এমন বন্ধুত্ব এ যুগে বিরল। আপনার আর নৃপেন্দ্রনারায়ণের গবেষণার বিষয়ও কি একইরকম ছিল।’

কৌতুকের ছোঁয়া লাগে সুকুমারবাবুর চোখে।

‘আমাদের সব বিষয়ে মিল থাকলেও এই একটা বিষয়ে বেজায় গরমিল ছিল ধূর্জটিবাবু। আমরা দুজনে একসঙ্গে ফাদার লাফঁর কাছে কাজ শিখলেও, ধীরে ধীরে আমাদের গবেষণার জগৎগুলো আলাদা হয়ে পড়ে। আমি আকৃষ্ট হয়ে পড়লাম ভূবিজ্ঞানের দিকে, আর নৃপেন ভালোবেসে ফেলল নক্ষত্রলোককে।’

‘নক্ষত্রলোক? মানে নৃপেন্দ্রনারায়ণের ঝোঁক ছিল জ্যোতির্বিজ্ঞানের দিকে?’

‘ঝোঁক ছিল বললে কম বলা হবে ধূর্জটিবাবু। এই পোড়া দেশে না

জন্মালে নৃপেনের নাম জগতের বিখ্যাত নক্ষত্রবিদদের সঙ্গে ঠাঁই পেত। বহুরূপ নক্ষত্র আর যুগল নক্ষত্রের ওপর তার অনেক গবেষণাপত্র বিলেতের জার্নালে ছাপা হয়েছে। করিমুণ্ড রাশিতে আকিলা নবনক্ষত্র সেই প্রথম দূরবীনে প্রত্যক্ষ করে।’

মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। নৃপেন্দ্রনারায়ণের মৃত্যুতে কেবল সৌম্যেন্দ্রনারায়ণের পিতৃবিয়োগই হয়নি, বঙ্গজননী হারিয়েছেন তাঁর একজন বৈজ্ঞানিক সুপুত্রকেও। এ ক্ষতি অপূরণীয়।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধূর্জটি।

‘আপনাকে দু-একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করছি সুকুমারবাবু। কিছু মনে করবেন না।’

‘না-না। বলুন।’

‘এ বাড়িতে যখন পিশাচ পড়ে, তখন আপনি কোথায়?’

‘এলাহাবাদে। হারকোর্ট বাটলার কলেজে শিক্ষকতা করছি তখন।’

‘নৃপেন্দ্রনারায়ণের মৃত্যুর খবর পেলেন কী করে?’

‘খবরের কাগজ থেকে। প্রথমটা বিশ্বাস করতে মন চায়নি। তারপর সৌমেনকে তার করলাম। সেও জানাল নৃপেন আর নেই।’

‘খবরটা জানার পর কী করলেন?’

‘দু-চারদিন কিছুই করিনি। করার ক্ষমতা ছিল না। দুঃখে শোকে পাথর হয়ে গিয়েছিলাম। তারপর মনে হল নৃপেনই যখন নেই আর গবেষণা, পড়ানো এসব করে আর কি হবে। একা মানুষ, দায়দায়িত্ব নেই, চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে কিছুদিন আপনমনে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ালাম। কিছুদিন বাদে মনের অবস্থা কিছুটা ঠিক হল। খবরের কাগজে গোলকুণ্ডার খনিতে ভূবৈজ্ঞানিকের পদের জন্যে একটা বিজ্ঞাপন বেরিয়েছিল। সেই চাকরিটা জুটিয়ে গোলকুণ্ডা চলে গেলাম।’

বেয়ারার বাড়ানো প্লেট থেকে একটা কুকি তুলে নেয় ধূর্জটি,

‘এখানে বোধহয় আপনি মাসখানেক আগে এসেছেন।’

‘হ্যাঁ। তবে ঠিক এই দুলমিগড় আসব বলে আসিনি। এই অঞ্চলটা জরিপ

করার জন্যে সরকার থেকে লোক খোঁজা হচ্ছিল। গোলকুণ্ডার চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে এই কাজে ভিড়ে গেলাম। উত্তরদিক থেকে জরিপ করতে করতে মাসকয়েক আগে দুলমিগড় এসে পৌঁছেছি। তবে এখানকার মেয়াদও ফুরিয়ে এল, আর দিনকয়েকের মধ্যে লোকজন নিয়ে দক্ষিণে সরে যাব।’

চুপ করে যান সুকুমারবাবু, কেমন অন্যমনস্কভাবে তুলে নেন খবরের কাগজটা। কেমন একটা অস্বস্তিকর নীরবতা নেমে আসে টেবিলে।

বোধহয় প্রসঙ্গ পালটাতেই হাতের কাপটা নামিয়ে রেখে বেয়ারাকে নিম্নস্বরে কিছু বলেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ। অতিথি কামরার দিকে হাঁটা দেয় বেয়ারা।

‘পুরানো কথা যখন উঠল, তখন আর একজন লোকের সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করিয়েই দিই।’

‘কে সৌমেন?’

খবরের কাগজের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে প্রশ্ন করেন সুকুমারবাবু।

‘গিরিজাপ্রসাদ। জেমস ট্রেডার। বাবা টেলিস্কোপের লেন্স বানানোর জন্যে মাঝে মধ্যে ওর থেকে হিমালিয়ান কোয়ার্টজ কিনতেন। সেই থেকে যাতায়াত।’

চশমার ফাঁক দিয়ে তাকান সুকুমারবাবু,

‘তোমাকেও কি টেলিস্কোপের নেশায় ধরেছে নাকি?’

হাসেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।

‘আমার যে ওইসব বিষয়ে কোনও আগ্রহ নেই তা আপনি ভালোই জানেন। না, গিরিজাপ্রসাদ আমার কাছে অন্য দু-একটা কাজে এসেছিল।’

উঠোন পার হয়ে বেয়ারা একজনকে নিয়ে আসে। স্থূল, বামনাকৃতি চেহারা, উচ্চতা চার ফিটের ওপর হবে না। মাথায় রেশমের পাগড়ি, হাতে রুপোর বালা। পায়ে জরীর কাজ করা নাগরা জুতো। গলার রুপোর হাঁসুলিতে বেজীর প্রতিকৃতি। কুবেরী যক্ষ।

‘প্রণাম হুজুর।’

‘বসো গিরিজাপ্রসাদ।’

খবরের কাগজটা নামিয়ে রাখেন সুকুমারবাবু।

‘বাড়ি কোথায় তোমার গিরিজাপ্রসাদ?’

‘কসৌল সে অউর থোড়া আগে হুজুর। দুটো পাহাড় ডিঙিয়ে যেতে হয়। লেকিন বাড়ি ওই নামেই। বছরে বারদুয়েক যাওয়া হয়। বাকি সময় তো সারা দেশ ঘুরে ঘুরে কেটে যায়।’

কসৌল! মনের মধ্যে নীলাকাশের পটভূমিতে আঁকা তুষার ধবল গিরিচূড়ার একটা ছবি ভেসে উঠল। উচ্ছ্বাস চেপে রাখতে পারলাম না।

‘কসৌল! খুব সুন্দর জায়গা তো গিরিজাপ্রসাদজী! চোখ তুললেই নীল আকাশ আর সাদা পাহাড় দেখা যায়।’

মৃদু হাসে গিরিজাপ্রসাদ।

‘আরে বাবুজী, আসমান মে উতনা দেখনে লায়েক হ্যায় হি কেয়া! বড়ে হুজুর ভী আঁখো মে দূরবীন লাগাকে আসমানকে তারে ঢুন্ডতে থে। উনসে ভী ম্যায়নে কহা থা, হুজুর, কভি আসমান ছোড়কে আপনে আসপাস কে জমীন কে নিচে ভি দেখিয়ে, কেয়া কেয়া নজারা দিখাই দেগা আপকো।’

সৌম্যেন্দ্রনারায়ণও হাসেন।

‘আমরা যদি যক্ষদের মতো খালি চোখেই মাটির তলাকার খবর জানতে পারতাম তাহলে আর তোমার আর পসার হত না গিরিজাপ্রসাদ!’

‘ওহ্‌ ভী সচ্‌ হ্যায় হুজুর। ইন্সান আপনি নজরিয়া সে দুনিয়া কো দেখতে হ্যায়, অউর যক্ষ উনকি। ভগবান আশুতোষ এক এক জনকে এক এক রকম দৃষ্টি দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন।’

টেবিল থেকে বইটা তুলে একবার পাতা উলটে রেখে দেয় ধূর্জটি।

‘গিরিজাপ্রসাদজী কি অনেকদিন হল সফরে বেরিয়েছেন?’

‘হ্যাঁ বাবুজী। সুরাটে কিছুদিন থাকতে হয়েছিল। তারপর সেখান থেকে জুনাগড়, পুনা। এবার এখান থেকে কলকাতা হয়ে মাদ্রাজ চলে যাব।’

‘এখানে কি কোনও বিশেষ কাজে এসেছিলেন?’

‘হাঁ। হুজুরাইন গয়না গড়াবেন, তাই তাঁর থেকে কয়েকটা জহরতের ফরমাস নেওয়ার ছিল।’

ধূর্জটির দেখাদেখি আমিও বইটা একবার হাতে নিয়ে দেখি। চামড়ায় বাঁধানো, বহু ব্যবহারে জীর্ণ। স্টাহ্‌লের ‘ফান্ডামেন্টা কিমিয়া’।’

উঠে দাঁড়ান সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।

‘ভালো কথা মনে করিয়েছ গিরিজাপ্রসাদ। চল, চিন্ময়ী হয়তো অপেক্ষা করছে। ধূর্জটিবাবু, কিছু মনে করবেন না, আমাকে উঠতে হল। আপনারা সুকুমারবাবুর সঙ্গে বসে গল্প চালিয়ে যান।’

দোতলার সিঁড়িতে সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ আর গিরিজাপ্রসাদ উঠে যেতে সুকুমারবাবুও টেবিল থেকে তাঁর বইটা হাতে করে উঠে দাঁড়ান।

‘আজ আমিও উঠি। বেশ খানিকটা পথ যেতে হবে। কাল তো আছেন, ফের দেখা হবে। আজ আসি। নমস্কার।’

বাইরের দরজার বাইরে সুকুমারবাবুর চেহারাটা আড়াল হয়ে যাবার অনেকক্ষণ পরেও ধূর্জটি নিজের জায়গায় বসে রইল চিন্তামগ্ন মুখে। শেষে আমায় তাগাদা দিতে হল।

‘কী হল? সারারাত এখানে বসে থাকবে নাকি?’

‘চলো!’

সুকুমারবাবুর ফেলে যাওয়া খবরের কাগজটা টেবিল থেকে তুলে নিয়ে দোতলার পথ ধরে ধূর্জটি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *