দুই
ধূর্জটির অনুমান মিথ্যে হল না। মাসখানেকের মধ্যেই উঠে গেল দ্বিতীয় অঙ্কের যবনিকা।
হেমন্ত বিদায় নিয়ে শীত এসেছে। সন্ধে ঘন হয়ে রাত নামলেই ঠাণ্ডার প্রকোপ বাড়ে, কুয়াশার চাদরের আড়ালে নিস্তেজ হয়ে আসে রাস্তার গ্যাসবাতি, পথিকের সংখ্যা কমে ক্রমে নিঝুম হয়ে আসে পথ। বন্ধ দরজা জানলার আড়ালে শহর নিজেকে গৃহবন্দী করে ফেলে তাড়াতাড়িই।
অন্যদিনের মতো আজকেও এই সময়টাও আমরা বৈঠকখানার আশ্রয় ছেড়ে শোবার ঘরের বিছানায় আস্তানা নিয়েছি। ধূর্জটি থ্যাকার্স ডিরেক্টরি থেকে তার নোটবইতে কী সব টুকছে, আর আমি একটা গল্পের কয়েকটা লাইন লিখে চিন্তার খেই হারিয়ে কলম হাতে হাঁ করে কড়িকাঠ গুনছি। রাত বেশি হয়নি, কিন্তু তাও সব নিস্তব্ধ হয়ে পড়েছে, নিচের রাস্তায় মানুষজনের সাড়াশব্দ বিশেষ পাওয়া যায় না। রান্নাঘর থেকে বাসনের টুংটাং শব্দের সঙ্গে ভেসে আসছে কুঞ্জর রান্নার সুঘ্রাণ।
গল্পের পরের লাইনটা মাথার মধ্যে খুঁজে না পেয়ে এক কাপ চা চাইব কিনা ভাবছি, বাইরের দরজায় কে সজোরে কড়া নাড়ল।
ধূর্জটির দিকে তাকালাম।
‘এই শীতের রাতে আবার কে এল? হেম নাকি?’
মাথা নাড়ল ধূর্জটি,
‘হেম নয়। রাস্তায় মোটরের আওয়াজ পাইনি।’
না হেম নয়। কুঞ্জ এসে একটা চিরকুট দিল। ডাক্তার মেজর প্রভাতরঞ্জন আমাদের ডেকে পাঠিয়েছেন। তক্ষুনি যেতে হবে।
আমি আর ধূর্জটি মুখ চাওয়াচায়ি করলাম। মেজর প্রভাতরঞ্জনকে আমরা চিনি। মিলিটারি থেকে অবসর নিয়ে ইদানীং প্রাইভেট প্রাক্টিস করেন, নেবুতলার মাঠের অপর পারেই তাঁর চেম্বার। ডাক্তার হিসেবে পাড়ায় সুনাম আর দুর্নাম দুই-ই আছে। হাতযশের জন্যে সুনাম, আর মেজাজের জন্যে দুর্নাম। লোকে ঠাট্টা করে বলে, ডাক্তার প্রভাতরঞ্জনকে দেখালে ওষুধ খাওয়ার আর প্রয়োজন হয় না, তাঁর ধমকের চোটেই রোগ শরীর থেকে পালিয়ে যায়। একই পাড়ায় থাকি, সুতরাং মৌখিক আলাপ নেই, তা নয়। কিন্তু রাতের বেলায় হঠাৎ এই জরুরি তলবের মানে বুঝতে পারলাম না।
আর কিছু না হোক অন্তত কৌতূহল নিরসনের জন্যেই পুলওভার, র্যাপার আর পশমের টুপিতে আপাদমস্তক ঢেকে আমরা পা বাড়ালাম মেজর প্রভাতরঞ্জনের চেম্বারের দিকে।
নির্জন রাস্তায় মানুষের সাড়াশব্দ বিশেষ নেই। কেবল বাড়িঘরের বন্ধ দোর-কপাটের ফাঁক থেকে চুঁইয়ে পড়ছে আলো। নেবুতলার মাঠ টপকে আমরা এসে দাঁড়ালাম প্রভাতরঞ্জনের ডাক্তারখানার সামনে।
আমার দিকে চোখ তুলে ইঙ্গিত করল ধূর্জটি,
‘দেখেছ?’
রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে দু-দুখানা মোটর। তাদের একটার চেহারা আমাদের পরিচিত। মাসখানেক আগেই এটাতে চাপিয়েই হেম আমাদের ইন্ডো-ব্রিটিশ ক্লকওয়ার্কসে নিয়ে গিয়েছিল।
‘পুলিসের মোটর না?’
প্রশ্ন করলাম বিস্মিত স্বরে।
ভ্রু কুঁচকে গেল ধূর্জটির।
‘হ্যাঁ। চলো।’
ডাক্তারখানার ভিজিটর্স রুম ফাঁকা। টুলে বসে থাকা আর্দালী আঙুল তুলে ভেতরের চেম্বারের দিকে দেখাল,
‘ডাক্তারসাব অন্দর হ্যায়।’
চেম্বারে স্পিরিটের ঝাঁঝালো গন্ধে মিশেছে তামাকের কটু বাস। ছোট ঘরটাতে টেবিলের পেছনে দাঁতে পাইপ কামড়ে যিনি বসে আছেন তাঁকে আমরা চিনি। প্রশস্ত কাঁধ, মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা, এই শীতেও পরনের টুইডের কোটের সব ক-টা বোতাম খোলা। ইনি আমাদের পাড়ার সর্বজনশ্রদ্ধেয় ডাক্তারসাহেব মেজর প্রভাতরঞ্জন।
ডাক্তারের টেবিল আর কলাই করা সাদা বেসিনের মাঝখানের স্বল্প পরিসরে জড়সড় হয়ে বসে থাকা হেমও আমাদের পরিচিত। অপরিচিত কেবল ঘরে উপস্থিত তৃতীয় ব্যক্তিটি। টিকালো নাক, পাতলা ঠোঁটের ওপরে সরু গোঁফের রেখা, মুখের গৌরবর্ণ পুড়ে তামাটে হয়ে গেছে। পরণে ফার বসানো অলস্টার আর ধূসর ট্রাউজার্স।
মুখ থেকে পাইপ নামালেন ডাক্তার প্রভাতরঞ্জন,
‘বসো।’
‘ডাক্তারসাহেব, এত রাতে?’
চেয়ার টেনে নিয়ে বসতে বসতেই প্রশ্ন করে ধূর্জটি।
ঘরে উপস্থিত তৃতীয় ব্যক্তির দিকে চোখ তুলে ইঙ্গিত করেন ডাক্তার প্রভাতরঞ্জন, ‘দরকারটা ঠিক আমার নয়। দুলমিগড় এস্টেটের কুমারবাহাদুর সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ সরকার আমার বিশেষ পরিচিত, তোমার সঙ্গে ওঁর কিছু কথা আছে।’
অপরাধ অনুসন্ধানী হিসেবে ধূর্জটির নামডাক কম নেই, তার কাছে কোনও বড়মানুষের প্রয়োজন থাকতেই পারে, কিন্তু সরাসরি আমাদের
বাসায় না এসে এখানে কেন?
আমার মুখের বিস্ময়ের ছাপটা বোধহয় সৌম্যেন্দ্রনারায়ণের নজর এড়ায়নি, হেমের দিকে তাকালেন তিনি,
‘দেখুন, পুলিশের তরফ থেকে হেমবাবুরা যা তদন্ত করার তা করছেন। কিন্তু হেমবাবুর কাছে আপনার কথা জানতে পেরে মনে হল এই ব্যাপারে আপনাকেও সঙ্গে রাখাটাও প্রয়োজন। তবে আমি যে আপনার কাছে এসেছি এটা পাঁচকান হোক আমি চাই না। মেজর প্রভাতরঞ্জন আমার অনেকদিনের পরিচিত, তাই মনে হল গোপনীয়তার খাতিরে ওঁর ডাক্তারখানাটাই আপনার সঙ্গে দেখা করার উপযুক্ত জায়গা।
ধূর্জটির মুখের মৃদু হাসিটা নজর এড়াল না।
‘হেম, কিছু না জেনেও অনুমান করতে পারছি, খুব সম্ভব বলাই হালদারের আবির্ভাব ঘটেছে।’
গম্ভীর মুখে ঘাড় নাড়ল হেম,
‘তা একরকম বলতে পারো। তবে আবির্ভাব না বলে তিরোধান বলাটাই ভালো।’
‘মানে?’
‘মানে বলাই হালদার খুন হয়েছে।’
‘খুন! কবে?’
‘মাসদেড়েক আগে।’
‘কোথায় খুন হল?’
‘আমার এস্টেটে। দুলমিগড়ে।’
হেম নয়, উত্তর এল সৌম্যেন্দ্রনারায়ণের কাছ থেকে।
‘দুলমিগড় এখান থেকে প্রায় চারশো মাইল উত্তর-পশ্চিমে। বেশিরভাগটাই জঙ্গল আর পাহাড়, তবে কয়েকটা ছোট গ্রামও আছে। মাসদেড়েক আগে একজন গ্রামবাসীর গোরু পালিয়ে যায়। জঙ্গলে গোরু খুঁজতে গিয়ে তার চোখে পড়ে ঝোপের মধ্যে একটা মৃতদেহ পড়ে আছে। এরপর আমার কাছে খবর যায়। আমি পুলিসে খবর দিই।
‘দেহটা যে বলাই হালদারের বোঝা গেল কী করে?’
পকেট থেকে একটা ফোটোগ্রাফ বের করল হেম।
‘ছবি দেখে। বলাই হালদার ফেরার হয়ে যাওয়ার পর তার এই ফোটোগ্রাফখানা সব থানাতে পাঠানো হয়েছিল। দুলমিগড়ের পুলিশ তাই দেখেই সনাক্ত করে।’
‘মৃত্যুর কারণ?’
‘ভারী কোনও কিছু দিয়ে মাথাটা থেঁতলে দেওয়া ছিল। এ ছাড়া শরীরে কোনও আঘাতের চিহ্ন ছিল না।’
‘কিন্তু কিছু মনে করবেন না কুমারবাহাদুর, এটা ছাড়াও আরও কিছু অঘটন নিশ্চয়ই ঘটেছে। তা না হলে শুধু একটা ফেরারী চোরের মৃত্যুর রহস্যভেদ করতে রাতবিরেতে আপনি এই অধমকে স্মরণ করতেন না।’
দু-আঙুলে মাথার রগদুটো একবার টিপে ধরলেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ,
‘ঠিকই বলেছেন। আমার এস্টেটে এটা একমাত্র অপরাধ নয়। গত মাসে আরও একটা খুন হয়। তার কোনও কিনারা এখনও পুলিশ করে উঠতে পারেনি। আর যে মারা গেছে তার মৃত্যুর দায় বোধহয় খানিকটা আমার ওপরেও বর্তায়।’
‘আপনার ওপর? কেন?’
একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।
‘কারণ যে খুন হয়েছে, তাকে আমিই দুলমিগড়ে ডেকে এনেছিলাম। আমার কাজে দুলমিগড় না এলে মানুষটা হয়তো প্রাণ হারাত না।’
‘কাকে ডেকে এনেছিলেন?’
‘বলছি। আমার একটা কলগোলাম আছে। ইন্ডো-ব্রিটিশ ক্লকওয়ার্কস থেকে বছরখানেক আগে কেনা। এতদিন ভালোই চলছিল। হঠাৎ গতমাসে বিগড়ে গিয়ে উলটোপালটা আচরণ করতে শুরু করল। কখনও আচমকা হাত-পা ছোঁড়ে, কখনও জিনিসপত্র আছড়ে ভাঙে। বাধ্য হয়ে গোলাম বন্ধ করে দিয়ে কলকাতায় ইন্ডো-ব্রিটিশ ক্লকওয়ার্কসে তার করলাম। দিনকয়েকের মধ্যেই ইন্ডো-ব্রিটিশ ক্লকওয়ার্কস থেকে পীতাম্বর গোমেজ নামে এক মেকানিক তার যন্ত্রপাতিসমেত এসে হাজির হল। বেশি বয়েস নয়, কিন্তু কাজের হাতটি পাকা। দিন-দুয়েকের মধ্যেই গোলাম ঠিক করে ফেলল।
‘গোলামের কী সমস্যা হয়েছিল আপনাকে জানিয়েছিল?’
‘সেটাই তো রহস্য। এমনিতে ছোকরা বেশ হাসিখুশি, কিন্তু গোলামের কী হয়েছিল আমি প্রশ্ন করতেই গম্ভীর হয়ে গেল। বলল আর-একবার দেখে তবে বলবে।’
ভ্রু কুঁচকাল ধূর্জটি।
‘পরে জিজ্ঞেস করেছিলেন?’
মাথা নাড়লেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ,
‘না। তার আর সুযোগ পেলাম কোথায়? পরের দিন সকাল বেলায় পীতাম্বর এসে বলল তাকে কলকাতার অফিসে একটা তার করতে হবে, সে একবার পোস্ট-অফিসে যাচ্ছে। আমাদের পোস্টাপিস বেশ খানিকটা দূরে, স্টেশনের কাছাকাছি। আমি সঙ্গে লোক দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পীতাম্বর রাজি হল না। বলল সে স্টেশনের রাস্তা চেনে, নিজে নিজেই চলে যাবে। বেলা গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল, কিন্তু পীতাম্বর ফিরল না। পোস্টাপিসে লোক পাঠালাম। পোস্ট মাস্টার বললেন সকাল থেকে তার করার জন্য কেউ আসেনি। লোক লাগিয়ে খোঁজাখুঁজি শুরু করলাম, সন্ধে নাগাদ রাস্তার থেকে বেশ খানিকটা দূরে জঙ্গলের ভেতরে পীতাম্বরের খোঁজ পাওয়া গেল। দেহে প্রাণ নেই, মাথাটা থেঁতলানো।’
পকেট থেকে সিগ্রেটের টিন বের করে সিগ্রেটে অগ্নিসংযোগ করে ধূর্জটি। লক্ষ করি তার মুখ গম্ভীর হয়ে উঠেছে।
‘বলাই হালদারের হদিস পাওয়া গেলেও রহস্যটা যে আরও জটিল হয়ে উঠল হেম!’
সায় দিল হেম।
‘হ্যাঁ তা তো হলই। বোঝাই যাচ্ছে যে বলাই আর নিতাই কেবল ক্যাশ চুরি করার জন্যে ইন্ডো-ব্রিটিশ ক্লকওয়ার্কসে হানা দেয়নি। ইন্ডো-ব্রিটিশ ক্লকওয়ার্কসে খরিদ্দাররা সব বড়মানুষ। পরে তাদের ঘরে চুরি করাটাও বোধহয় দুই ভাইয়ের মতলব ছিল। খুব সম্ভব শোরুম থেকে খরিদ্দারদের নাম-ঠিকানার তালিকাও তারা যাবার আগে হাতিয়ে নিয়ে যায়। আর সেই সূত্র ধরেই বলাই দুলমিগড় হাজির হয়। কিন্তু বলাইকে খুন কে করল? তাহলে বলাই আর নিতাই ছাড়া কি এই চোরের দলে আরও কেউ আছে?
ফের মাথার রগদুটো একবার টিপে ধরলেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।
‘ধূর্জটিবাবু, মাত্র কয়েক বছর আগে আমাদের বাড়িতে পিশাচের পালের আচমকা হানায় আমার পরিবারের অর্ধেক সদস্য প্রাণ হারায়। সুতরাং আমার জমিদারীতে পরপর দুটো খুন হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে ঝড়ের পূর্বাভাসের মতোই ঠেকছে।’
বিস্ময় চেপে রাখতে পারলাম না।
‘পিশাচ হানা! কিন্তু পিশাচেরা তো দল বেঁধে মানুষকে আক্রমণ করে না। যদি না—’
হঠাৎ মাথায় একটা চিন্তা ভেসে উঠতেই থেমে গেলাম মাঝপথে।
আমার অসম্পূর্ণ কথায় সায় দিল ধূর্জটি,
‘যদি না কোনও পিশাচসিদ্ধ তাদের প্ররোচিত করে থাকে। কুমারবাহাদুর, কে এই কাজ করেছিল বুঝতে পেরেছিলেন?’
মাথা নাড়লেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।
‘না ধূর্জটিবাবু। বুঝতে পারিনি। মহাযুদ্ধের সময় আমি মিলিটারিতে যোগ দিয়েছিলাম। যখন বাড়িতে পিশাচ পড়ে তখন আমি মেসোপটেমিয়ায়। জেনারেল টাউনসেন্ডের ফৌজে সামিল হয়ে নাসিরিয়ার যুদ্ধে লড়াই করছি। সন্ধের সময় পিশাচের দল পাঁচিল ডিঙিয়ে ঢুকে পড়ে সবাইকে নির্বিচারে টুঁটি কামড়ে হত্যা করতে শুরু করে। চিন্ময়ী না থাকলে হয়তো কেউই প্রাণে বাঁচত না।
‘চিন্ময়ী কে?’
এই প্রথম সামান্য এক চিলতে হাসি ফুটল সৌম্যেন্দ্রনারায়ণের ঠোঁটে,
‘আমার স্ত্রী। বিয়ের পর আমি চিন্ময়ীকে সখ করে বন্দুক চালানো
শিখিয়েছিলাম। সেই বিদ্যাটা এই বিপদের মুখে কাজে লেগে যায়। আমার সংগ্রহে একটা আমেরিকান উইঞ্চেস্টার রিপিটার রাইফেল আছে। পিশাচ পড়ার পর শাড়ির আঁচলে এক আঁজলা টোটা বেঁধে চিন্ময়ী সেই রাইফেল হাতে বাড়ির কিছু কাজের লোকজন আর আমার ছোটভাই উপেন্দ্রকে নিয়ে ছাদে আশ্রয় নেয়। সঙ্গে আমাদের এস্টেটের পেয়াদা মাহিন্দার সিং। ছাদে ওঠার সিঁড়িটা অপ্রশস্ত, দু-একজনের বেশি ওঠার জায়গা নেই। মাহিন্দারের তলোয়ার আর চিন্ময়ীর বন্দুকের দাপটে পিশাচেরা অনেকক্ষণ সিঁড়িতেই আটকে থাকে, ছাদে পা রাখতে পারে না।’
তামাকের ধোঁয়ায় ঘরের আলো ঝাপসা হয়ে এসেছে। শীতের নিঝুম রাত্রে দেওয়াল-ঘড়ির টিকটিক ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। সৌম্যেন্দ্রনারায়ণের বর্ণনা শুনতে শুনতে আমি অন্য কোনও এক জগতে হারিয়ে গেলাম, আমার মানসপটে যেন একখানা ছবি ফুটে উঠল। কোনও এক আরণ্যক প্রদেশে এক গৃহলক্ষ্মী তাঁর পরিজনের প্রাণ রক্ষার্থে মরণপন লড়াই করছেন। শ্বদন্ত মেলে হুহুঙ্কারে ছুটে আসছে উন্মত্ত পিশাচের দল। নীলাভ ধূসর তাদের বর্ণ, জ্বলন্ত অঙ্গারের মতো রক্তলাল চোখ, অঙ্গে হাড়ের ভূষণ। বরনারীর আঁচলটি কোমরে জড়িয়ে বাঁধা, মুহুর্মুহু অগ্নিবর্ষণ করছে তাঁর হাতের বন্দুক, মাটিতে ঝরে পড়ছে খালি কার্তুজের খোল, আছড়ে পড়ছে পিশাচের প্রাণহীন দেহ।
ধূর্জটির অবশ্য কল্পনার জগতের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই, সে ভ্রু কোঁচকায়।
‘কিছু মনে করবেন না কুমারবাহাদুর। কিন্তু পিশাচের প্রাণশক্তি মানুষের চাইতে অনেক বেশি। একদম মর্মস্থলে বারংবার আঘাত না পেলে তাদের সহজে মৃত্যু হয় না। একটা বন্দুকের ভরসায় তাদের বেশিক্ষণ ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব না।’
মাথা নেড়ে সায় দিলেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ,
‘ঠিক বলেছেন। পিশাচদের হয়তো আটকানো যেত না। কিন্তু গুলি চালাতে চালাতে চিন্ময়ীর হঠাৎ নজরে পড়ল আমাদের বাড়ির ফটকের কাছে কেউ একজন মাথার ওপর দু-হাত তুলে দুর্বোধ্য স্বরে কীসব মন্ত্রপাঠ করছে। মন্ত্রোচ্চারণ করা ব্যক্তি যে কোনও পিশাচসিদ্ধ, মন্ত্রবলে পিশাচদের আক্রমণ করতে প্ররোচনা দিচ্ছে, চিন্ময়ীর বুঝতে অসুবিধে হয়নি। মুহূর্তমাত্র কালক্ষেপ না করে সে রিপিটার রাইফেল থেকে ঘনঘন কয়েকটা ফায়ার করে। সবগুলো না হলেও একটা বা দুটো গুলি লক্ষভ্রষ্ট হয় না, চিৎকার করে পিশাচসিদ্ধ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। পিশাচেরাও যেন হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে পেয়ে দুদ্দাড় করে ছুটে পালায়।’
‘পিশাচসিদ্ধকে সনাক্ত করা গিয়েছিল?’
দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।
‘না। পিশাচরা পালিয়ে যাবার পর চিন্ময়ী যখন নিচে নেমে আসে তখন বাড়িময় রক্তগঙ্গা বইছে। বেশিরভাগ লোকই মৃত্যুবরণ করেছে। এস্টেটের কর্মচারীরা ছাড়াও মারা গেছেন আমার বাবা, কাকা আর কাকীমা। যারা মারা যায়নি, তারাও সাঙ্ঘাতিক আহত, প্রায় মৃত্যুর দোড়গোড়ায়। রাতটুকু কাটে কিনা সন্দেহ। সে দিন আর কারোর পক্ষে অনুসন্ধান করা সম্ভব হয়নি। পরের দিন সকালে ফটকের কাছে খানিকটা রক্তের ছিটে নজরে এলেও কোনও মৃতদেহ পাওয়া যায়নি। হয় পিশাচসিদ্ধের দেহ তার সঙ্গীরা সরিয়ে নিয়ে গেছিল, অথবা সে মরেনি, জখম হয়েছিল কেবল, সে অবস্থাতেই পালিয়েছে। সে কে ছিল, কেন আমার পরিবারকে আক্রমণ করেছিল, আজও তার রহস্য ভেদ হয়নি।’
মুখ থেকে পাইপ নামালেন মেজর প্রভাতরঞ্জন।
‘ধূর্জটি, সৌমেন তোমার কাছে কেন ছুটে এসেছে বুঝতে পেরেছ? ওর পরিবারের ওপর দিয়ে একবার ভয়ঙ্কর ঝড় বয়ে গেছে। দ্বিতীয়বার ও আর কোনও ঝুঁকি নিতে চায় না।’
পায়ের কাছে থেকে একটা খবরের কাগজের মোড়ক তুলে এনে টেবিলের ওপর রাখেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।
‘আপনার মনে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে আপনার কাছে না গিয়ে কেন গোপনে প্রভাতের চেম্বারে ডাকিয়ে আনলাম। আমার জন্যে আপনি যাতে
কোনও বিপদে না পড়েন তাই এই সতর্কতা।’
‘আপনার এই রকমটা ভাবার কারণ?’
‘ধূর্জটিবাবু, আমি ব্রিস্টল হোটেলে উঠেছি। গতকাল সারাদিন আমি কাজের প্রয়োজনে বাইরেই ছিলাম। সেই ফাঁকে এটাকে কেউ আমার বিছানায় ছেড়ে যায়।’
কাগজের মোড়কটা খোলেন সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ। ভেতরে একটা কাচের বয়েম। আর বয়েমের মধ্যে কুণ্ডলী পাকিয়ে পড়ে হাতদুয়েক লম্বা কেঁচোর আকারের একটা কীট। গায়ের বর্ণ তার আগুনের মতো লাল।
বয়েমটা হাতে তুলে নিয়ে দেখে ধূর্জটি। একটা বিস্ময়ের আওয়াজ বেরিয়ে আসে তার মুখ থেকে।
‘এটা তো দেখছি অল্ঘই খর্খই। গোবি মরুভূমির মৃত্যুকীট। ভয়ঙ্কর বিষাক্ত। মুখ থেকে বিষ ছোঁড়ে। বিষের একফোঁটা শরীরের কোথাও লাগলে তৎক্ষণাৎ মৃত্যু। আপনি খুব জোর বেঁচে গেছেন।’
‘আমি ফ্রণ্টে লড়াই করেছি ধূর্জটিবাবু, বিপদের মুখে আমার স্নায়ুগুলো সাধারণ মানুষের থেকে দ্রুত কাজ করে। লেপ উলটে এটাকে দেখতে পেয়েই আমি লাফ দিয়ে একপাশে সরে যাই। এটা মুখ দিয়ে বিষ ছোঁড়ে বটে, কিন্তু তার পুরোটাই লক্ষভ্রষ্ট হয়। দ্বিতীয়বার আক্রমণ করার আগেই টেবিলে একটা ফলকাটা ছুরি ছিল সেটা দিয়ে এটাকে বিছানায় গেঁথে ফেলি।’
উঠে দাঁড়ান সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ।
‘ধূর্জটিবাবু, আমি জানি আপনার আরও প্রশ্ন আছে। কিন্তু আজ নয়। আপনার বাকি প্রশ্নের উত্তর আমি দুলমিগড়ে দেব। আজ উঠি।’
উঠে দাঁড়ায় ধূর্জটিও।
‘আমাকে দু-তিনদিন সময় দিতে হবে। হাতে কয়েকটা কাজ আছে।’
‘কোনও অসুবিধে নেই। আপনি আপনার কাজ শেষ করেই আসুন। কেবল আসার একটা তার করে দেবেন, আপনার জন্যে স্টেশনে মোটর রাখা থাকবে। আজ আসি। নমস্কার।’