এক
য়ুরোপের যুদ্ধের সময় নানা টানাপোড়েনের দরুন কলকাতায় দ্রব্যমূল্য অত্যধিক বৃদ্ধি পায়। তার উপর আবার চাকরির বাজারেও মন্দার ভাঁটা লেগে অনেক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ে। এই দুয়ের ধাক্কায় বহু লোকে তাদের কলকাতার পাট চুকিয়ে দেশের বাড়িতে পাড়ি দিলে, কলকাতার অনেক ভাড়াবাড়ি খালি হয়ে পড়ে। আমি আর ধূর্জটি সেই সময়ে আমাদের আমহার্স্ট স্ট্রিটের পুরানো মেসবাড়িটা ছেড়ে, বড় রাস্তা থেকে একটু ভেতরে নেবুতলার মাঠের কাছে একটা নতুন বাড়িতে উঠে আসি।
ভাড়ার খুব একটা সাশ্রয় হয়নি বটে, কিন্তু তিনতলায় বড় বড় দুখানা ঘর, টানা বারন্দা, আর উপরি পাওনা চারতলার চওড়া ছাত, আর তার সংলগ্ন চিলেকোঠার ঘরখানা আমাদের কাছে একটা পুরো রাজত্ব হাতে পাওয়ার থেকে কম হয়নি। তিনতলা ঘরের একটিতে আমরা শুই, অন্যটি বৈঠকখানা হিসেবে ব্যবহার হয়, ধূর্জটির মক্কেল এলে ওই ঘরেই বসে। তবে আমাদের বেশিরভাগ সময় কাটে চারতলার চিলেকোঠার ঘরটাতেই। এটাই ধূর্জটির লাইব্রেরি তথা ল্যাবরেটরি এবং সারা কলকাতা ঘুরে খুঁজে আনা যতরকম অদ্ভুত জিনিসের তোষাখানা। ইয়ালির নখ, গেণ্ডাবেরুণ্ডার পালক, সাইক্লপ্সের আইকর, কুকুল্কানের বিষ, সে সংগ্রহে বাদ নেই কিছুই।
আজ রবিবার, কাজের তাড়া নেই। হেমন্তের রোদটা পর্যন্ত যেন ছাদের ওপর আয়েস করে লুটিয়ে রয়েছে। নেবুতলার মাঠে ছেলেদের ফুটবল খেলার হইচই এর সঙ্গে মিশছে ছাদের পাঁচিলে রোদ মেখে বসা কাকের অলস ডাক। প্রাতরাশের টোস্ট আর অমলেটের পালা শেষ করে পেয়ালাটা দুহাতে ধরে সুগন্ধি দার্জিলিং চায়ের স্বাদ উপভোগ করছি তারিয়ে তারিয়ে।
ধূর্জটির অবশ্য চায়ের সৌখীনতার বড় একটা বালাই নেই, সে দুধ-চিনি বিহীন মসীবর্ণ চায়ের গেলাস হাতের মুঠোয় ধরে নাক ডুবিয়েছে খবরের কাগজে।
প্রাতরাশের প্রসাদ প্রত্যাশী একটা কাক পাঁচিল থেকে চৌকাঠের বাইরে লাফিয়ে নেমে এসে ডেকে উঠল কা-কা শব্দে। তার দিকে পাঁউরুটির একটা টুকরো ছুঁড়ে দিয়ে তাকালাম ধূর্জটির দিকে।
‘কি? তেমন কাজের খবর কিছু পেলে?’
‘হুঁঃ! আর কাজের খবর!’
একটা বিরক্তির আওয়াজ করে কাগজটা আমার দিকে বাড়িয়ে ধরল ধূর্জটি।
‘এই যে নিজেই দেখ না। একদম ওপরের দিকেই রয়েছে খবরটা।’
চোখ রাখলাম কাগজে। গতকাল রাতে ডালহৌসী স্কোয়ারে ইন্ডো-ব্রিটিশ ক্লকওয়ার্কসের শোরুমে চুরি হয়ে গেছে। চোর অফিসের সিন্দুক ভেঙে আগের দিনের বিক্রির সমস্ত টাকা হাতিয়ে নিয়ে চম্পট দিয়েছে।
‘ইন্ডো-ব্রিটিশ ক্লকওয়ার্কসের নামটা আগে শুনেছি। এরা ঘড়িকলের যন্ত্র বানায় না?’
‘হ্যাঁ! যন্ত্রবাদ্য, কলগোলাম, ডিফারেন্স এন্জিন্। বেঙ্গল আর মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে এদের একেবারে একচেটিয়া ব্যবসা। রাজা মহারাজা, সরকারি এজেন্সি, বড় বড় মার্চেন্ট ফার্ম; সব এদের কাস্টমার।’
‘বাপরে! এখানে চুরি করা তো সরাসরি বাঘের গুহায় সিঁধ কাটতে যাওয়া
দেখছি! তা এটাও কাজের খবর নয় বলছ? একটা বড় মক্কেল পেয়ে যেতে হাতে। দেখবে নাকি একবার গিয়ে?’
ফের একটা বিরক্তির আওয়াজ করল ধূর্জটি,
‘ধুত্তোর বড় মক্কেল! এই ছিঁচকে চুরি ধরার জন্যে ধূর্জটি শীলের প্রয়োজন নেই, বিটের পাহারাওলাই যথেষ্ট।’
সিঁড়িতে ভারী বুটের আওয়াজে ছেদ পড়ল ধূর্জটির কথায়। খুব নিকটজন ছাড়া অন্য কারোর এই চারতলার ছাদের ঘরে আসার এক্তিয়ার নেই, সুতরাং বুটের আওয়াজে অনুমান করে নিতে অসুবিধে হল না যে হেমের আগমন ঘটেছে।
হেম অর্থাৎ হেমচন্দ্র বসু ধূর্জটির বাল্যকালের সহপাঠী, তবে ইদানীং তার পরিচিতি ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের একজন জাঁদরেল ইন্সপেক্টর হিসেবে।
মুচকি হেসে বললাম, ‘হেম এসে পড়েছে! তুমি যাব না বললেই হবে?’
ধূর্জটি ব্যাজার মুখে কিছু বলতে যাবে, তার আগেই চৌকাঠ পেরিয়ে ঘরে পা রাখলো হেম। আমার হাতে ধরে থাকা কাগজটা তার পুলিসের সন্ধানী চোখ এড়াল না।
‘যাক, খবরটা তোমাদের চোখে পড়েছে দেখছি। চলো তৈরি হয়ে নাও, নিচে মোটর দাঁড় করিয়ে রেখে এসেছি।’
ধূর্জটি আমতা-আমতা করতে লাগল, ‘দেখ এটা তো মামুলি চুরি বলে মনে হচ্ছে, আমি খামোখা গিয়ে কি করব?’
‘চুরিটা মামুলি হতে পারে, তা বলে তো ফরিয়াদি তো আর মামুলি নয়। ইন্ডো-ব্রিটিশ ক্লকওয়ার্কসের দোকানে চুরি হওয়াটা, তা সে যাই চুরি হোক, মোটেই কোনও ছোটখাটো ব্যাপার নয়। খোদ কমিশনার রেজিনাল্ড ক্লার্ক সাহেব নিজে খোঁজখবর রাখছেন। চলো, চলো।’
ধূর্জটির কোনও ওজর আপত্তি ধোপে টিকল না। পুলিসের মোটরে আমাদের যেতে হল ইন্ডো-ব্রিটিশ ক্লকওয়ার্কসের শো-রুম অবধি।
উঁচু পাঁচিলঘেরা ইন্ডো-ব্রিটিশ ক্লকওয়ার্কসের বিশাল দোতলা বাড়ির সামনের রাস্তা পুলিসে ছয়লাপ। লালপাগড়ি পাহারাদারেরা তো রয়েছেই,
মোটরবাইক সওয়ার দু-একজন গোরা সার্জেন্টও নজরে পড়ল।
‘একটা সামান্য চুরির পর এমন বিশাল বন্দোবস্ত।’
গাড়ি ততক্ষণে থেমেছে বাড়ির মূল ফটকের সামনে। হাতে ধরা টুপিটা মাথায় বসাতে বসাতে মুচকি হাসল হেম।
‘ইন্ডো-ব্রিটিশ ক্লকওয়ার্কসের সর্বপ্রথম খদ্দের হলেন সরকার বাহাদুর। বড়লাটের কাউন্সিল, পোস্ট-মাস্টার জেনারেল, মিলিটারি, বাদ নেই কেউ। অতএব বুঝতেই পারছো! চলো।’
ফটক থেকে কয়েক কদম ভেতরে হেঁটে পেতলের ফ্রেমে আঁটা কাচের বিশাল দরজা ঠেলে খুলল হেম।
শোরুমের ভেতরে পা রাখতেই মনে হল যেন হঠাৎ পথ ভুলে স্বয়ং বিশ্বকর্মার যন্ত্রশালায় ঢুকে পড়েছি। মাথার ওপরের বেলজিয়ান গ্লাসের ঝাড়লণ্ঠনের আলো ছড়িয়ে পড়েছে শোরুম জুড়ে। সে আলোয় ঝলসে উঠছে পেতল, তামা, ব্রোঞ্জ আর ইস্পাতে গড়া নানান অদ্ভুতদর্শন যন্ত্রের পালিশ করা চেহারা। ঘড়িকলের প্যাঁচানো স্প্রীং, দাঁতকাটা চাকা আর তক্লি চলার টিকটক, খুটখুট, কড়কড়, নানান আওয়াজ তুলে তারা কাজ করে চলেছে বিরামহীনভাবে। কোথাও জ্যোতিষযন্ত্রের পেতলে গড়া সৌরমণ্ডল জটিল আবর্ত্তে কষে চলেছে জ্যোতির্বিজ্ঞানের অঙ্ক, কোথাও দম দেওয়া যন্ত্রবাদ্য সুরেলা আওয়াজ তুলছে আপনা-আপনিই, আবার কোথাও ডিফারেন্স এন্জিন অসংখ্য দাঁত কাঁটা পেতলের চাকায় দুরূহ হিসেবের সমাধান কষে উগরে দিচ্ছে লম্বা কাগজের ফালিতে ছেপে।
আর শোরুমের এক কোনে হুকুমের অপেক্ষায় নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে পেতল আর ব্রোঞ্জের ধাতুর চাদরে মোড়া কলগোলামের সারি।
আমার তো চোখ আটকে গেলই, খেয়াল করলাম ধূর্জটিও একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে তাদের মানুষের আদলে গড়া ধাতব চেহারাগুলোর দিকে।
তারও দোষ নেই, এর আগে দু-একটা বিলিতি ম্যাগাজিনে ছবি দেখে থাকলেও চাক্ষুষ কলগোলাম দর্শন আমাদের এই প্রথম।
তাদের আগাপাস্তলা পেতলে তৈরি শরীরে ব্রোঞ্জের বিচিত্র জ্যামিতিক
নক্সা, হাঁটু, কনুই আর আঙুলের গ্রন্থিতে আঁটা ইস্পাতের কব্জা, মুখের কাছে তামার জালের জাফরি, চোখের জায়গায় ঘোলাটে কাচের আবরণ। বুকে শিকের গরাদ বসানো মোটা কাচের পোর্টহোল। তার পেছনের আধো-অন্ধকারে আবছা নজরে আসে ঘড়িকলের ছোটবড় গিয়ার, পিস্টন, শাফট আর অন্যান্য বলযন্ত্রের ব্যস্ততা।
পকেট থেকে নোটবই পেন্সিল বের করে দু-একটা কী লিখে নিয়ে আমার দিকে ফেরে ধূর্জটি, ‘যুদ্ধের অনেক কিছুই খারাপ, বুঝলে যতীন, কিন্তু দু-একটা ভালো দিকও বোধহয় থাকে। যুদ্ধের সময়ে বিজ্ঞানের যতটা অগ্রগতি হয় অন্য সময়ে ততটা হয় না।’
‘কেন বলছ একথা?’
চোখ তুলে কলগোলামের সারির দিকে ইঙ্গিত করে ধূর্জটি।
‘এদের কথাই চিন্তা কর। মহাযুদ্ধের সময় য়ুরোপের দেশে দেশে কর্মঠ লোকের আকাল। ছেলে, বুড়ো, জোয়ান সব ফ্রন্টে লড়তে চলে গেছে। দেশের বাকি কাজ চলে কী করে? অতএব এইসব যন্ত্রচালিত দাসেদের উদ্ভাবন। যুদ্ধ না হলে এদের প্রয়োজনই হত না।’
‘স্যার! নমস্কার!’
শোরুমের ভেতরের দিক থেকে যে কখন একজন অল্পবয়সী ছোকরা এগিয়ে এসেছে খেয়াল করিনি। পরণে সুতির হাতকাটা কামিজ আর কালো প্যান্ট। মাথার চুলে টেরি কাটা।
‘স্যার আমি গৌরচাঁদ। শোরুমের ফ্লোর ইনচার্জ। ভেতরে আসুন স্যার। জেনারেল ম্যানেজার ফিনলে সাহেব অপেক্ষা করছেন।’
গৌরচাঁদের পেছনে হাঁটতে হাঁটতে হাতটা সামনের দিকে ছড়িয়ে দিয়ে ধূর্জটি প্রশ্ন করল, ‘সব যন্ত্রপাতি চলছে যে? আপনাদের রবিবারেও শোরুম খোলা?’
‘হ্যাঁ। আমাদের সপ্তাহে সাতদিনই খোলা। এসব যন্ত্র খুব গুরুত্বপূর্ণ, কোন কাস্টমারের কখন কী প্রয়োজন হবে তো জানা নেই।’
‘দোকান বন্ধ হয় ক’টার সময়ে?’
‘সাধারণত রাত আটটায় বন্ধ হয়, তবে কখনও কখনও জরুরি মেরামতির কাজ থাকলে, কি আচমকা কোনও বরাত পেলে, তার পরেও দোকান খোলা থাকে।’
‘কালকেও কি দোকান দেরিতে বন্ধ হয়েছিল?’
‘না, কালকে আটটাতেই দোকান বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।’
‘চুরি টের পেলেন কখন?’
‘রাত তিনটে নাগাদ আমাদের দরোয়ান শোরুমের ভেতরে আওয়াজ পেয়ে ফিনলে সাহেবকে খবর দেয়। সাহেব সঙ্গে সঙ্গে এসে দরজা খুলে সব তল্লাসি করেন, কিন্তু ততক্ষণে চোর তার কাজ শেষ করে ভেগে পড়েছে। চলুন স্যার, বাকিটা ফিনলে সাহেবের থেকে শুনে নেবেন।’
খেয়াল করলাম কথা বলতে বলতে এসে দাঁড়িয়েছি নেমপ্লেট বসানো দরজার সামনে।
ভেতরে টেবিলের পেছনে একজন মাঝবয়েসী ইংরেজ বসেছিলেন, আমাদের দেখে উঠে দাঁড়ালেন। পরণে টুইলের কোট আর কালো নেকটাই। মাথায় ছোট ছোট করে ছাঁটা বাদামী রঙের চুল। ধূসর চোখে উদ্বিগ্নতার ছাপ সুস্পষ্ট।
হেম পরিচয় করিয়ে দিলে ধূর্জটির সঙ্গে করমর্দন করলেন।
‘স্প্লেন্ডিড ওয়ার্ক ইউ ডিড দেয়ার ইন দ্যাট ফ্রেজার হাউস মার্ডার কেস ধূর্জাটি। আমি সেইজন্যে পুলিসকে বিশেষভাবে অনুরোধ করেছিলাম যাতে তদন্তে তোমাকে সঙ্গে নেয়। প্লীজ টেক আ সিট জেন্টেলমেন।’
চেয়ার টেনে নিয়ে বসলাম আমরা।
ফিনলে সায়েব বিচক্ষণ পেশাদার মানুষ। তাঁর মুখ থেকে আগের রাতের ঘটনার সারসংক্ষেপ শুনতে বেশিক্ষণ সময় লাগল না।
শোরুমের প্রবেশপথ দুটো। সামনেরটা দিয়ে আমরা ঢুকেছি। কাস্টমাররা এই পথেই যাওয়া আসা করে থাকে। এর ঠিক বিপরীতে, অর্থাৎ বাড়ির একদম পেছন দিকে আর একটা দরজা আছে। এই দরজা দিয়ে মাল দেওয়া নেওয়া করা হয়। এ বাদে আর একটা দরজা আছে ছাদে ওঠার, সেটা সাধারণত বন্ধই থাকে। রাত্রে দোকান বন্ধের সময়ে পেছনের দরজটা ভেতর থেকে বন্ধ করে তারপরে সামনের দরজটা তালা দেওয়া হয়। তালার একটা চাবি থাকে ফিনলে সাহেবের কাছে আর অন্যটা গৌরচাঁদের কাছে, যাতে প্রয়োজন মতো দুজনের যে কেউ একজন অফিস খুলতে পারেন। সবাই বেরিয়ে গেলে কম্পাউন্ডের লোহার ফটক ভেতর থেকে বন্ধ হয়ে যায়। দুজন পাহারদার আছে, সারা রাত তারা পালা করে একজন ফটকে পাহারা দেয়, আর একজন কম্পাউন্ডের চারপাশে টহল দেয়।
গতকাল রাতে পাহারার দায়িত্বে ছিল জানকীনাথ সিং আর মণিলাল রাই। দুজনেই বিশ্বস্ত কর্মচারী, ইন্ডো-ব্রিটিশ ক্লকওয়ার্কসে বহু বছর ধরে কাজ করছে। রাত তিনটে আন্দাজ পেছনদিকে টহল দেবার সময় মণিলাল বাড়ির ভেতরে কিছু পড়ার আওয়াজ পায়। জানলা সব বন্ধ, তবু তারই মধ্যে একটার খড়খড়ি তুলে তার ফাঁকে চোখ রাখতে দেখে ঘরের মধ্যে একটা আবছা আলো জ্বলছে। মণিলাল হাঁক পাড়তে আলোটা নিবে যায়। এরপর আরও দু-একবার হাঁকাহাঁকি করে সাড়াশব্দ না পেয়ে মণিলাল জানকীনাথকে পাহারায় রেখে বাইসাইকেলে করে সদর স্ট্রিটে ফিনলে সাহেবের বাসায় খবর দেয়। ফিনলে সাহেব মোটরে মণিলালকে বসিয়ে নিজে ড্রাইভ করে এসে শোরুমের তালা খোলেন। এরপর জানকীনাথ আর মণিলালকে সঙ্গে নিয়ে শোরুমের পেছনের দরজার দিকে যান। দেখতে পান একটা টেবিল উলটে যন্ত্রপাতি ছড়িয়ে পড়ে আছে মাটিতে। পেছনের দরজার তালা টেনে দেখেন, তালা অক্ষতই আছে, দরজাও বন্ধ।
শোরুমের একতলাটা তন্নতন্ন করে খুঁজে কাউকে না পেয়ে ফিনলে এবার দোতলায় ওঠেন। এইখানে তাঁর চোখে পড়ে টাকা রাখার ঘরের দরজা খোলা। ঘরের ভেতরে পা রাখতেই দেখতে পান আয়রন চেস্টের ডালা খোলা, ভেতরে রাখা নোটের তাড়াও উধাও।
একতলার দুটো দরজাই বন্ধ, বাড়িতে ঢোকার আর একটিমাত্র প্রবেশপথ, তিনতলার ছাদের দরজা। অতএব কালক্ষেপ না করে তিনি তিনতলার সিঁড়ি ধরে ওপরের দিকে দৌড়লেন। সিঁড়ির শেষে পৌঁছে দেখলেন তাঁর আশঙ্কা অমূলক নয়, ছাদের দরজাও খোলা। দরজা পার হয়ে ফিনলে ছাদে গেলেন। বৈদ্যুতিক টর্চের আলো ফেলে চারিদিকে খুঁজলেন, কিন্তু কাউকে দেখতে পেলেন না। চোর যেন হাওয়ায় কর্পূরের মতো উবে গেছে।
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল ধূর্জটি।
‘আমি একটু ঘুরে দেখতে চাই। আর আপনার কর্মচারীদের কাছ থেকেও কয়েকটা কথা জানতে চাই।’
গৌরচাঁদের দিকে তাকালেন ফিনলে।
‘অফ কোর্স! গৌর উইল শো ইউ এরাউন্ড।’
ফিনলে সাহেবের ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম আমরা সবাই।
‘আগে কোথায় যেতে চান?’
ধূর্জটির দিকে তাকিয়ে গৌরচাঁদের প্রশ্ন।
‘পেছনে যেখান থেকে আওয়াজ এসেছিল আগে সেই জায়গাটা দেখতে চাই।’
‘এইদিকে। আসুন।’
শোরুমের প্রবেশপথের উলটোদিকে হাঁটা দিলাম আমরা।
আলোয় ঝলসে ওঠা যন্ত্রের সারি যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানে দেওয়ালের গায়ে একটা দু-পাল্লার চওড়া দরজা।
‘এটা আমাদের যন্ত্র সারাইয়ের জায়গা। বাড়তি মালও এইখানে জমা করে রাখা হয়।’
দরজা ঠেলে পেছনের ঘরটায় পা রাখতেই এক ঝটকায় যেন অনেকটাই নেমে এল শোরুমের দীপ্তি। বাহারি ঝাড়লণ্ঠন নয়, এখানে ছাদ থেকে ঝোলানো আটপৌরে বৈদ্যুতিক বাল্ব। অবশ্য উলটোদিকে বড় বড় কয়েকটা জানলা থাকায় ঘরে আলোর অভাব নেই।
একখানাই লম্বা ঘর। পরপর সাজানো তাক আর টেবিল। সব টেবিলের পেছনেই একহাত উঁচু খোপকাটা কাঠের তাক বসানো, খোপের মধ্যে নানা
টুকিটাকি যন্ত্রাংশ। তাকেও জড় করে রাখা নানা যন্ত্রপাতি।
যেখান দিয়ে ঢুকেছি তার উলটোদিকে আর একটা দরজা। সেটার ওপর একবার দৃষ্টি রেখে গৌরচাঁদের দিকে ফেরে ধূর্জটি।
‘এটা কি বাইরে যাবার রাস্তা?’
‘হ্যাঁ, এটার পেছনেই কম্পাউন্ড। লরিতে করে মাল এলে এর পেছনেই দাঁড়ায়।’
‘আর মণিলাল আওয়াজ কোথা থেকে পেয়েছিল?’
‘এই যে, এইদিকে।’
ঘরের একদম ডানপ্রান্তে আমাদের নিয়ে গেল গৌরচাঁদ। একদিকে একটা যন্ত্রপাতি ছড়ানো টেবিল, অন্যদিকে বই আর পাকানো কাগজ বোঝাই একটা সেল্ফ। টেবিল থেকে কিছু যন্ত্রাংশ ছড়িয়ে পড়েছে মাটিতে। অনুমান করতে অসুবিধে হয় না, এর আওয়াজই মণিলাল গতরাতে শুনে থাকবে। টেবিলের উলটোদিকে একটা খোলা জানলার দিকে ইঙ্গিত করল ধূর্জটি।
‘এই জানলার খড়খড়ি দিয়েই?’
ঘাড় নাড়ল গৌরচাঁদ,
‘হ্যাঁ, কাল রাতে এটা বন্ধ ছিল, মণিলাল এটারই খড়খড়ি তুলে ভেতরে আলো দেখতে পায়।’
টেবিলটা খুঁটিয়ে দেখে ধূর্জটি, নিচু হয়ে একবার দেখে নেয় মাটিতে পড়ে থাকা যন্ত্রের টুকরোগুলোকেও।
‘এ সব কে ব্যবহার করে?’
তাচ্ছিল্যের ভঙ্গীতে ঘাড় নাড়ে গৌরচাঁদ।
‘কেউ না। এগুলো সব বাতিল। নানান যন্ত্রের বিগড়ে যাওয়া টুকরো-টাকরা। যন্ত্র সারাইয়ের পরে রয়ে গেছে, যদি কখনও কোনও কাজে লাগে।’
‘আর এই সেলফের সব কাগজপত্র?’
‘ওগুলো সব নির্দেশ-পঞ্জিকা। যন্ত্র সারানোর সময়ে অনেক সময়ে মিস্ত্রিদের কাজে লাগে।’
জানলা দিয়ে বাইরের দিকে একবার তাকায় ধূর্জটি।
‘চলুন বাইরেটা দেখে আসি।’
দরজার বাইরে কম্পাউন্ডটা অনেকটা চওড়া। একপাশে উঁচু করে রাখা প্যাকিং বাক্সের স্তূপ। অন্যদিকে তেলের ড্রাম, জল দেবার হোসপাইপ, দড়িদড়া আর চটের খালি বস্তা। বোঝাই যায় জায়গাটা মাল খালাস করার কাজে ব্যবহার হয়।
বাড়ির বাইরে বেরিয়ে মাথা উঁচু করে ছাদের দিকটা দেখে ধূর্জটি।
‘ছাদে ওঠার জন্যে বাইরের দিকে কোনও সিঁড়ি আছে?’
মাথা নাড়ে গৌরচাঁদ।
‘না, একটাই সিঁড়ি। বাড়ির ভেতরে।’
কম্পাউন্ড ধরে হেঁটে আমরা ফেরত আসি শোরুমের সামনে। আর একবার ওপর দিকে তাকিয়ে দেখে ধূর্জটি।
‘বাড়ির গায়ে কোনও পাইপ দেখছি না।’
সায় দেয় গৌরচাঁদ।
‘হ্যাঁ, আমাদের দোতলায় কোনওরকম জলের ব্যবস্থা নেই। একতলায় দামী যন্ত্রপাতি থাকে, কয়েক ফোঁটা জল পড়লেও মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।’
‘অফিসের শৌচালয়?’
‘সব একতলায়।’
ওপরের দিকে তাকিয়ে খানিকক্ষণ কী চিন্তা করে ধূর্জটি।
‘চলুন, ওপরে চুরির জায়গাটা দেখি।’
ফের শোরুমের ভেতরে পা রাখি আমরা। বিচিত্র দর্শন যন্ত্রের সারি পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসি দোতলায়।
দোতলা জুড়ে একটা বিশাল হলঘর। ঘর জুড়ে পরের পর টেবিল চেয়ার সাজানো। টেবিলের ওপর কাগজ, ফাইল আর লেখার সরঞ্জাম দেখে বোঝা যায় এটা কর্মচারীদের দৈনন্দিন কাজের এলাকা। দু-একটা টেবিলে টাইপ রাইটারও চোখে পড়ল।
হলঘরের দুপাশে দরজার সারি। প্রত্যেকটাতে ইয়েল-লক বসানো।
‘এই ঘরগুলো?’
গৌরচাঁদের দিকে ফিরে প্রশ্ন করল ধূর্জটি।
‘কয়েকটা কাস্টমারদের আপ্যায়নের ঘর। বাকিগুলোর কোনওটা রেকর্ড রুম, কোনওটা সাহেবদের কমন রুম। আর এ ছাড়া শেষের ঘরটা ক্যাশরুম।’
‘চুরিটা তো ওই ঘরেই হয়েছে?’
‘হ্যাঁ।’
‘চলুন দেখি।’
বাঁদিকের সারির একদম শেষ ঘরটা ক্যাশরুম। দরজা হাট করে খোলা রয়েছে।
দরজার ইয়েল লকটা ঝুঁকে দেখে ধূর্জটি। পকেট থেকে একটা আতস কাচ বের করে পরখ করে খুঁটিয়ে।
ঘরের ভেতরটা অনাড়ম্বর, সাজসজ্জাবিহীন। ফাইল আর হিসেবের খাতাপত্র রাখার সেল্ফ, টেবিল চেয়ার আর একটা আয়রন সেফ। সেফের ডালা খোলা, তার অভ্যন্তরটা এই দরজা থেকেই পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।
টেবিলের পেছনে একজন বয়স্ক মানুষ দাঁড়িয়ে। পরনে মিলের ধুতি আর লংক্লথের কামিজ। মাথার চুল উস্কোখুস্কো। চোখে মুখে একটা উদ্ভ্রান্তের মতো ছাপ।
আলাপ করিয়ে দিল গৌরচাঁদ।
‘আমাদের ক্যাশিয়ার নবকুমার বাবু।’
ডালা খোলা আয়রন সেফটার দিকে তাকায় ধূর্জটি,
‘এই সেফটা থেকে চুরি হয়েছে?’
‘হ্যাঁ স্যার!’
কাঁপা কাঁপা গলায় উত্তর নবকুমারবাবুর।
‘কী কী খোয়া গেছে?’
‘বিশ হাজার টাকা নগদ ছিল। তার পুরোটাই চুরি গেছে।’
‘আর কিছু?’
‘না। দু-একটা মূল্যবান দলিল আর কিছু কোম্পানির শেয়ারের কাগজও ছিল। সেগুলোতে হাত পড়েনি।’
নিচু হয়ে সিন্দুকটা আতস কাচ দিয়ে পরীক্ষা করে ধূর্জটি।
‘হেম একবার দেখ। পাকা হাতের কাজ। সিন্দুক এমনভাবে খুলেছে যে বোঝাই যাচ্ছে না চাবি ছাড়া খোলা হয়েছে।’
ঝুঁকে সিন্দুক পরীক্ষা করে হেমও। চিন্তার ভাঁজ পড়ে তার কপালে।
উঠে দাঁড়ায় ধূর্জটি,
‘ছাদটা দেখি চলুন।’
ক্যাশরুমের একটু পরেই অপ্রশস্ত সিঁড়ি উঠে গেছে ছাদ অবধি। সিঁড়ির মাথায় দরজার দুটো পাল্লাই খোলা। খোলা দরজা দিয়ে নজরে আসে ঝকঝকে নীল আকাশ আর রোদ মাখা ছাদ।
দু-পাল্লার দরজা। মাঝখানে আড়াআড়ি হুড়কো, তাতে তালা পরানো।
কিন্তু সে তালা খোলার কোনও চেষ্টাই করা হয়নি।
অবাক হয়ে লক্ষ করলাম তালাটা অক্ষত অবস্থায় যেমন লাগানো ছিল, তেমনই লাগানো রয়েছে। কেবল কোনও রহস্যময় কারণে হুড়কোর আড়াআড়ি দণ্ডটা মোমের মতো গলে দু-ফাঁক হয়ে গেছে। হুড়কোর ঠিক ওপরে দরজার গায়ে একটা চাকতির আকারে ফুটো। ফুটোর চারপাশ পুড়ে কালো হয়ে আছে। যেন কোনও গনগনে আগুন দিয়ে দরজার কাঠটা পুড়িয়ে ছ্যাঁদা করা হয়েছে।
আতস কাচ দিয়ে দরজার ফুটো আর দু-টুকরো হয়ে যাওয়া হুড়কোটাকে ভালো করে পরখ করে ছাদে উঠে গেল ধূর্জটি। খেয়াল করলাম তার কপালে জমে উঠেছে চিন্তার রেখা।
পরিষ্কার ছাদে হেমন্তের রোদটুকু ছাড়া আর দেখার বিশেষ কিছু নেই। সাধারণ গৃহস্থ বাড়ির ছাদে যেমন দেখা যায় কাপড় মেলার দড়ি কিংবা ফুলগাছ। এখানে সে সব কিছুই নেই।
‘গৌর, ছাদে কে ওঠে?’
‘কেউ না স্যার। কেবল সপ্তাহে একবার ঝাড়ুদার এসে ঝাঁটপাট দিয়ে
চলে যায়।’
‘ঝাড়ুদার একাই আসে ছাদে?’
‘না, আমাদের স্টোরকিপার মুকুন্দবাবুর কাছে চাবি থাকে, তিনি এসে দরজা খুলে দেন, আবার কাজ হয়ে গেলে তালা লাগিয়ে দেন।’
‘পাঁচিলে ওগুলো কী?’
আগে খেয়াল করিনি, এবার ধূর্জটির কথায় লক্ষ করলাম, ছাদের পাঁচিলে কয়েক হাত অন্তর অন্তর লোহার আংটা বসানো আছে।
‘নিউ ইয়ারে ছাদে সাহেবেদের পার্টি হয়। সামিয়ানা টাঙাতে সুবিধে হবে বলে আংটাগুলো পোঁতা হয়েছে।’
ফের আতস কাচ বের করল ধূর্জটি।
‘আমাদের যা দেখার দেখা হয়ে গেছে। কেবল তোমাদের রাতের পাহারাদারদের কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করার আছে। তুমি গিয়ে আগে মণিলালকে পাঠিয়ে দাও।’
আতস কাচ দিয়ে এক-একটা আংটা খুঁটিয়ে দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে ধূর্জটি।
একটু পরেই সিঁড়িতে শোনা যায় ভারী জুতোর শব্দ। ছাতে যে এসে দাঁড়ায় তার বয়স বেশি না হলেও একজোড়া পাকানো গোঁফ তার চেহারাটা ভারিক্কি করে তুলেছে। পরনে তকমা আঁটা উর্দি, মাথায় পাগড়ি।
‘সাব!’
পাঁচিলের আংটা ছেড়ে এগিয়ে আসে ধূর্জটি।
‘তুমি মণিলাল?’
‘জী সাব।’
‘কাল রাত্রে কী হয়েছিল?’
মণিলালের বয়ানের সঙ্গে আমরা আগে ফিনলে সাহেবের থেকে যা শুনেছি তার বিশেষ তারতম্য হল না। রাতে টহল দেওয়ার সময় মণিলাল বাড়ির ভেতর থেকে কিছু পড়ার আওয়াজ পায়। তারপর খড়খড়ি ঈষৎ তুলে উঁকি দিয়ে দেখে ভেতরে কোনও ম্লান আলো জ্বলছে। বারদুয়েক হাঁকাহাঁকি করে কোনও সাড়া না পেয়ে সে তখন জানকীনাথকে পাহারায়
রেখে বাইসাইকেলে করে ফিনলে সাহেবেকে খবর দিতে যায়।
মণিলালের কথা শেষ হতে ঘাড় নাড়ে ধূর্জটি।
‘হুঁ! আচ্ছা মণিলাল, আওয়াজ পাবার পর তুমি একবারও ওপরের দিকে তাকিয়েছিলে কি?’
‘ওপরের দিকে? না সাব! আওয়াজ নিচে হচ্ছে, আমি ওপরের দিকে তাকিয়ে কি করব? আর দুটো দরজাই বন্ধ আছে কিনা দেখে নিয়ে আমি আর বেশিক্ষণ দাঁড়াইনি, সাহেবকে খবর দিতে ছুটেছিলাম।’
‘হুঁ, আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি গিয়ে জানকীনাথকে পাঠিয়ে দাও।’
জানকীনাথের পরণেও একই রকমের উর্দি, তবে বয়স হয়েছে। মুখের গোঁফদাড়ি পরিষ্কার করে কামানো। তার থেকেও বিশেষ কিছু জানা গেল না। মণিলাল বেরিয়ে যাবার পর সে ছুটে ছুটে বাড়িটা বেড় দিয়ে পাহারা দিয়েছে, পাছে দুটো দরজার কোনও একটা দিয়ে চোর পালানোর চেষ্টা করে।
কিছুক্ষণ কী চিন্তা করে ধূর্জটি।
‘পেছনের দরজাটা কেউ খোলার চেষ্টা করেছিল?’
‘না সাব। মণিলাল বেরিয়ে যাবার পর আর পেছনের দিকে থেকে কোনও আওয়াজ পাইনি।’
‘ওপর দিকে দেখেছিলে, কিছু দেখতে পাও কিনা?’
‘জী সাব। যেদিকটা টাকা রাখার ঘর সেদিকের জানলার খড়খড়িতে দু-একবার আলো ফেলেছিলাম। কিন্তু কিছু দেখতে পাইনি।’
‘আর ছাদে? ছাদে কিছু দেখতে পেয়েছিলে?’
‘না সাব। ছাদ অবধি টর্চের আলো পৌঁছয় না। ফির কাল অমাবস কা রাত ভি থা। বিলকুল অন্ধেরা। ছাদে কিছু দেখতে পাইনি।’
‘একদম কিচ্ছু না? দেখে না থাক, কোনও আওয়াজ শুনেছিলে? ঠিক করে ভেবে দেখে।’
‘নেহি সাব! কুছ ভি নেহি দেখা, শুনা ভি নেহি। সির্ফ্—’
কী একটা বলতে গিয়েও কেমন থতমত খায় জানকীনাথ।
‘কী? কী জানকীনাথ?’
সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে উৎসুক কণ্ঠে প্রশ্ন করে ধূর্জটি।
‘সাব, আমার মনের ভুলও হতে পারে। কিন্তু—’
‘কিন্তু?’
‘কিন্তু, মণিলাল সাহেবকে নিয়ে ফেরত আসার একটু আগে, আমি যখন ওপরের দিকে একাবার টর্চের আলো ফেলছিলাম, মনে হল একটা কালো মেঘ নিচু দিয়ে উড়ে গেল।’
একটা খুশির ঝলক খেলে যায় ধূর্জটির মুখে। যেন সে কোনও একটা জটিল অঙ্ক সমাধান করে ফেলেছে।
‘ঠিক আছে জানকীনাথ। তুমি যেতে পার। দরকার হলে আবার তোমায় ডেকে পাঠাব।’
‘জী সাব!’
সেলাম করে চলে যায় জানকীনাথ।
উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
‘কিছু বুঝলে?’
মৃদু হাসে ধূর্জটি,
‘তা কিছুটা বুঝেছি বৈকি যতীন! হেম, সিন্দুকের আর দরজার চাবি যে খুলেছে সে তো দেখছি ওস্তাদ কারিগর। একটা আঁচড় পর্যন্ত ফেলেনি। কেউ আছে নাকি এ্ররকম পুলিশের সন্ধানে।’
মাথা নাড়ে হেম।
‘হ্যাঁ আছে। তবে একজন নয়। এইরকম দুজনের নাম আছে পুলিসের খাতায়।’
‘এমন পাকা হাতের কারিগর একজন নয়, একেবারে দু-দুজন! বলো কি!’
‘হ্যাঁ, বলাই আর নিতাই হালদার! দুই ভাই। পুলিস সেরেস্তায় দুজনের নামেই চুরির অনেক রেকর্ড আছে।’
চোখ কপালে তোলে ধূর্জটি।
‘বাপরে! মাসতুতো ভাই কোন ছার। এতো দেখছি চোরে চোরে সহোদর ভাই!’
‘যা বলেছ। বছর ছয়েক আগে দুই ভাই মিলে রাত্রে একটা গয়নার দোকানে চুরি করতে ঢোকে। দোকানের দরোয়ান কোনওভাবে টের পেয়ে চেঁচামিচি জুড়ে দিতে দুজনেই দোকানের পেছনের পাঁচিলে টপকে পালানোর চেষ্টা করে। তবে বলাই পালিয়ে যেতে পারলেও নিতাইয়ের পাঁচিল থেকে পড়ে গিয়ে পা ভাঙে, তাকে পুলিসের পাহারাওলারা ধরে ফেলে।’
‘ওঃ! আর বলাই?’
‘বলাইকে ধরা যায়নি। খুব সম্ভব সে কলকাতা ছেড়ে হায়দ্রাবাদ পালায়।’
মাথা নাড়ে ধূর্জটি।
‘স্বাভাবিক। নিজামের রাজ্যে গা-ঢাকা দিয়ে থাকলে ইংরেজের পুলিসের নজর এড়ানোটা সহজ। আর নিতাই?’
‘নিতাই ভাঙা পা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। কিন্তু তার জখম এমন ছিল যে, তার পা পুরোপুরি সারেনি, সে একরকম খোঁড়াই হয়ে যায়। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবার পর তার চুরির দায়ে জেল হয়।’
কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে ধূর্জটির।
‘তা এই দুই মহাত্মা ইদানীং কোথায়?’
‘বলাই এখনও ফেরার। নিতাইয়ের জেলের সাজা শেষ হয়ে সে কয়েকদিন আগে ছাড়া পেয়েছে।’
ছাদে ওঠার দরজাটার দিকে চোখ তুলে ইঙ্গিত করে ধূর্জটি।
‘দরজার ফুটো আর গলে যাওয়া হুড়কোর রহস্য আশা করি তোমাকে বোঝাতে হবে না।’
মুখ গম্ভীর হয়ে গেল হেমের।
‘ক্যালরিক!’
কিছু বুঝতে না পেরে আমি হেমের মুখের দিকে তাকালাম।
‘ক্যালরিক! সেটা কী জিনিস?’
‘সোজা কথায় বলতে গেলে উত্তাপের নির্য্যাস! যার ওপর পড়বে পুড়িয়ে
গলিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেবে।’
ঘাড় নাড়ল ধূর্জটি।
‘বিশুদ্ধ দাহক, কোনও কিছুকে রেয়াত করে না। একসঙ্গে দু-এক ফোঁটার বেশি মজুতও করা যায় না।’
সায় দিল হেম।
‘বিপজ্জনক বস্তু। পাকা অ্যালকেমিস্ট ছাড়া অন্য কারোর পক্ষে বানানো কঠিন। সরকারি লাইসেন্স ছাড়া এ জিনিস বানানো বা কেনাবেচার নিয়ম নেই।’
অবাক হলাম।
‘কিন্তু এমন জিনিস চোরেদের হাতে পড়ল কী করে?’
মুখ কালো হয়ে গেল হেমের।
‘মহাযুদ্ধের পর অনেক নিষিদ্ধ বস্তুই অবাঞ্ছিত লোকজনের হাতে গিয়ে পড়েছে। তার ফল তো দেখতেই পাচ্ছো। কিন্তু সে সব পরে ভাবলেও চলবে, আপাতত আমাদের কাজ এই চুরির কিনারা করা।’
সূর্য মাথার ওপরে উঠে গেছে। কপালে হাত ঠেকিয়ে রোদের তাত আড়াল করে পশ্চিম দিগন্তে কী দেখার চেষ্টা করে ধূর্জটি।
‘কী দেখছ ধূর্জটি?’
আমার কথার উত্তর না দিয়ে হেমের দিকে তাকায় ধূর্জটি।
‘হেম, স্ট্র্যান্ড রোডে গঙ্গার পূর্বপাড়ে যে মালগুদামগুলো আছে সেগুলো একবার খানাতল্লাসী করে দেখ। চোরকে হয়তো পাওয়া যাবে না, কিন্তু কিছু সূত্র মিললেও মিলতে পারে।’
‘স্ট্র্যান্ড রোডের মালগুদাম!’
অবাক প্রশ্ন হেমের,
‘কিন্তু কেন? ওখানে কী এমন আছে?’
হাত তুলে বাধা দেয় ধূর্জটি।
‘এখন নয় হেম। আমার সবটুকুই অনুমান মাত্র। যদি কিছু পাওয়া যায় তখন সব খুলে বলব। আমরা বাড়িতেই অপেক্ষা করব, যদি কিছু পাও খবর
দিও।’
নিচে নেমে আসি আমরা। মোটরে চড়ে বসে হেম, পুলিস লরিতে লাফিয়ে ওঠে লালপাগড়ি কন্সটেবলরা। ফট্ফট্ শব্দ তুলে ছুটতে থাকে গোরা সার্জেন্টদের মোটরবাইক, তাদের অনুসরণ করে পুরো পুলিস বন্দোবস্তটাই।’
কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ফাঁকা হয়ে যায় ইন্ডো-ব্রিটিশ ক্লকওয়ার্কসের সামনের রাস্তা।
আমার কাঁধে হাত রাখে ধূর্জটি।
‘চলো যতীন, বাড়ি যাই। আপাতত আমাদের কাজ কেবল অপেক্ষা করা।’
একটা ট্যাক্সি ধরে বাড়ি ফিরে আসি আমরা।
দুপুরের রোদটা অনেকটাই ঢলে এসেছে। খাওয়াদাওয়া সেরে আমি বৈঠকখানার একটা আরামকেদারায় গড়াচ্ছি। ধূর্জটি ফরাসের ওপর আধশোয়া অবস্থায় বসে আছে। দৃষ্টি তার শূন্যে নিবদ্ধ, মুখে কথা নেই। কেবল মাঝে মধ্যে তার তর্জনীটা হাতে ধরা সিগ্রেটের টিনের ওপর টক্টক্ করে আওয়াজ তুলছে।
চোখটাকে ধীরে ধীরে কব্জা করে ফেলা ভাতঘুমটাকে তাড়ানোর জন্যে ধূর্জটির কাছে থেকে একটা সিগ্রেট চাইব কিনা ভাবছি, সিঁড়িতে ভারী বুটের আওয়াজ পাওয়া গেল।
এক লহমায় কেটে গেল ধূর্জটির চিন্তার ঘোর, সে লাফ মেরে উঠে এক টানে খুলে ফেলল দরজা।
দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে এক লালপাগড়ি কন্সটেবল।
‘সাব নে এত্তেলা ভেজা হ্যায়। নিচে মোটর খাড়া হ্যায়।’
অফিস পাড়া ছাড়িয়ে পুলিসের মোটর ছুটল স্ট্র্যান্ড রোডের দিকে।
গঙ্গার পাড়ে সার দেওয়া গুদামঘর। তারই একটার সামনে এসে দাঁড়াল আমাদের মোটর। গুদামের দরজার সামনে পুলিসের জমায়েত। তাদের একজন আমাদের দেখে এগিয়ে এল সামনে।
‘সাব অন্দর হ্যায়।’
ভেতর থেকে হেমের গলা ভেসে এল,
‘ধূর্জটি, যতীন, ভেতরে চলে এস।’
দরজার ভেতরে পা রেখেই থতমত খেলাম। ভেবেছিলাম ভেতরে ঢুকে দেখব আধো অন্ধকার একটা ঘর, বিনা জানলার মালগুদাম সাধারণত যেমন হয়ে থাকে। কিন্তু চৌকাঠ পেরিয়ে খেয়াল করলাম ঘরের আলোর কোনও খামতি নেই, পশ্চিমের পড়ন্ত রোদ তেরচা হয়ে লুটিয়ে পড়ছে গুদামঘরের মেঝেতে।
কারণটা আবিষ্কার করতে সময় লাগল না। বিশাল আকারের ঘরটার অর্দ্ধেকটা ছাদ নেই, মাথার ওপরে ঝকঝক করছে নীল আকাশ। অনুপস্থিত ছাদের কড়ি, বরগা, টালি, সুরকি সব স্তূপীকৃত হয়ে পড়ে রয়েছে ঘরের মাঝখানে। সে স্তূপের এখানে ওখানে সবুজ পাতা মেলেছে দু-একটা ছোট গাছ।
স্তূপের এক পাশে দাঁড়িয়ে নিচের দিকে কী লক্ষ করছিল হেম, আমাদের দিকে নজর পড়তে ইশারা করে কাছে ডাকল।
শ্যাওলা পড়া উঁচুনিচু মেঝে পেরিয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম হেমের পাশে।
‘এই দেখ!’
ইমারতি আবর্জনার স্তূপের পেছনে থাকার জন্যে আগে চোখে পড়েনি, এখন দেখতে পেলাম মেঝেতে ভেঙে পড়ে রয়েছে একটা খুদে এয়ারশিপ। তার ছাতার মতো শিক বসানো কালো ডানাদুটো মুচড়ে বেঁকে গেছে, বেতের সওয়ারী টুকরিতে ফাটল ধরেছে, পেতলের পাইপ আর যন্ত্রপাতি জায়গায় জায়গায় তুবড়ে গেছে। আর বেলুনটা গ্যাস মুক্ত হয়ে একটা বিশাল কালো চাদরের মতো ছড়িয়ে আছে মেঝের অনেকখানি জায়গা জুড়ে।
টুকরির কাছে বেলুনের কাপড়ের একটা অংশ হাতে ধরে উঁচু করে দেখাল হেম।
‘দেখেছ?’
দেখলাম কাপড়ের অনেকখানি ছেঁড়া।
‘দেখি।’
আতস কাচ বের করে কাপড়ের ছেঁড়াটা খুঁটিয়ে দেখল ধূর্জটি। লক্ষ করলাম, তার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে, কিন্তু মুখে সে কিছু বলল না। মাথার ওপরে আঙুল তুলে ইঙ্গিত করল হেম,
‘ওই ছাদের ফাঁক দিয়ে নামার সময়ে কিছুর খোঁচা লেগে ফেঁসে গিয়ে থাকবে। তারপর সটান মাটিতে আছড়ে পড়ে। এদিকটা এস।’
হেমের পেছন পেছন মাটিতে লুটিয়ে থাকা বেলুনের কাপড়টার পাশ কাটিয়ে অন্যদিকে গেলাম। ভাঙা সওয়ারী টুকরি থেকে কয়েক হাত দূরেই মাটিতে চিত হয়ে পড়ে আছে একটা মানুষের নিষ্পন্দ দেহ। পরণে তেলচিটে জিনের প্যান্টুলুন আর রঙচটা কামিজ। মাথার চুল রক্তে ভিজে জবজব করছে, খানিকটা রক্ত চুঁইয়ে পড়েছে মাটিতেও।
চোখ তুলে ইঙ্গিত করল হেম,
‘সনাক্ত করা হয়ে গেছে। নিতাই হালদার।’
নিচু হয়ে আতস কাচ দিয়ে নিতাই হালদারের শরীরটা খানিকক্ষণ ধরে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে ধূর্জটি।
‘চুরির টাকাটার কিছু হদিস পেলে?’
মাথা নাড়ল হেম।
‘হ্যাঁ। পুরো টাকাটাই পাওয়া গেছে। টুকরির ভেতর একটা থলেতে রাখা ছিল।’
উঠে দাঁড়ায় ধূর্জটি। ইমারতি আবর্জনার স্তূপটার কাছে গিয়ে কী দেখতে থাকে মন দিয়ে।
‘বাঃ! চোর বামাল দুটোই পাওয়া গেছে।’
মৃদু হাসে হেম,
‘তা যা বলেছ। মামলাটার এত তাড়াতাড়ি নিষ্পত্তি হয়ে যাবে ভাবতেই পারিনি।’
অন্যমনস্কভাবে কী চিন্তা করে ধূর্জটি,
‘নিষ্পত্তি! পুরোটা নিষ্পত্তি হল কি? এখনও কয়েকটা প্রশ্ন রয়ে গেল যে!’
হেসে ধূর্জটির পিঠ চাপড়ে দিল হেম।
‘আরে অত খুঁতখুঁত কোরো না। জানি তোমার মাথায় কী ঘুরছে। নিতাইয়ের খোঁজ পাওয়া গেল, কিন্তু বলাই কোথায়? কিন্তু ও সমস্যার উত্তর ধীরে সুস্থে খুঁজলেও চলবে। চলো, মোটর তোমাদের বাড়ি ছেড়ে দিয়ে আসবে। আজ আর হবে না, আমি কাল আসব। এত তাড়াতাড়ি রহস্যের কিনারা কী করে করলে, রিপোর্ট লেখার আগে সে সবের খুঁটিনাটি তোমার থেকে শুনে নিতে।’
পরের দিন বিকেলে হেমের আবির্ভাব হল। হাতে দুটো খাম। একটাতে স্বয়ং পুলিশ কমিশনার রেজিনাল্ড ক্লার্ক সাহেবের সই করা সুপারিশ পত্র, আর অন্যটাতে ইন্ডো-ব্রিটিশ ক্লকওয়ার্কসের তরফ থেকে পারিশ্রমিকের একটা চেক। সে চেকের অংকটা এমনি বড়, যে ধূর্জটির মাসছয়েক কোনও মক্কেল না পেলেও চলে যাবে।
কুঞ্জ টিপাইয়ের ওপর খাবারের প্লেট সাজিয়ে দিয়ে গেছে। আলুর ফ্রেঞ্চ বল আর গুল-কাবাব। সঙ্গে একটা বিরাট থার্মোফ্লাস্কে চা।
ধোঁয়া ওঠা ফ্রেঞ্চ বলে কামড় দিয়ে গরম থেকে জিব বাঁচিয়ে হেম প্রশ্ন করল,
‘এবার খুলে বলো তো, কী করে বুঝলে যে চোরকে গঙ্গার পাড়ে কোনও গুদামে পাওয়া যাবে?’
চায়ে চুমুক দিল ধূর্জটি।
‘ঠিক বুঝে ফেলেছিলাম বললে সত্যের অপলাপ হবে। বরং বলতে পার অনুমান করেছিলাম।’
‘আহা, তাই নয় হল। কিন্তু সেই অনুমানেই বা পৌঁছলে কী করে?’
‘দেখ, ইন্ডো-ব্রিটিশ ক্লকওয়ার্কসের বাড়িটা তো দেখেছ? বাড়ির গায়ে জলের পাইপ বা ধরে ওপরে ওঠার মতো কোনও অবলম্বন নেই। তা ছাড়া পাহারাওলারা রাতে বাড়ি ঘিরে টহল দেয়। কেউ দেওয়াল বেয়ে উঠতে গেলে তাদের নজরে পড়ে যাবে। সুতরাং যে বা যারা চুরি করতে এসেছিল, তারা আকাশ পথেই এসেছিল। এখন মানুষ যেহেতু উড়তে পারে না—’
‘গরুড় পারে!’
আমি মাঝখানে তাড়াহুড়ো করে বলে উঠলাম।
আমার দিকে অবাক চোখে তাকাল ধূর্জটি।
‘যতীন, তোমার ছেলেমানুষিগুলো আর গেল না। গরুড়রা যোদ্ধার জাত। কোনও গরুড় কোথাও চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে কখনও শুনেছ? ইন্ডো-ব্রিটিশ ক্লকওয়ার্কসের শোরুমে কোনও গরুড় হানা দিলে, লুকিয়ে চুরিয়ে তালা কেটে ঢুকত না। দরওয়ানদের কচুকাটা করে দরজা ভেঙে যা নেবার লুটে নিয়ে যেত।’
নিজের বোকামিতে লজ্জা পেয়ে চুপ করে রইলাম।
‘আর তা ছাড়া—’
চায়ের কাপে ফের চুমুক দিল ধূর্জটি।
‘আর তা ছাড়া কোনও গরুড় হলে তার ডানার শব্দ পাওয়া যেত। তোমাদের মনে থাকবে জানকীনাথ আর মণিলাল দুজনেই বলেছে সে রাতে তারা ওই জিনিস পড়ার শব্দের পর আর কোনও আওয়াজ শোনেনি।’
ফ্রেঞ্চ-বলের পালা সাঙ্গ করে গুল-কাবাবে মন দিল হেম।
‘বেশ! বলে যাও!’
‘চুরির ধরণ দেখে তোমাকে জিজ্ঞেস করে নিতাই হালদারের কথা জানতে পারলাম। সেই সঙ্গে এও জানলাম যে তার একটা পা জখম। অর্থাৎ দেওয়াল বেয়ে চুরি করতে ওঠা তার সাধ্যের বাইরে। আমার ধারণা আরও দৃঢ় হল। চোর নিচে থেকে ওপরে ওঠেনি। সে আকাশপথেই এসেছিল, এবং এসেছিল কোনও নিঃশব্দ যানে, যার আওয়াজ নিচের পাহারাদাররা পায়নি। কিন্তু কোন যান? এরোপ্লেন নিশ্চয়ই নয়, তার আওয়াজও পাহারাদারদের কানে যেত।’
হঠাৎ করে মনে পড়ে গেল, ‘জানকীনাথ বলছিল সে একটা মেঘের মতো কি দেখেছে!’
মৃদু হাসল ধূর্জটি,
‘তোমার মনে আছে তাহলে! হ্যাঁ জানকীনাথের কথাতেই আমার সংশয় অনেকটা কেটে গেলে। চোর এসেছিল কোনও খুদে এয়ারশিপে চড়ে। তার আওয়াজ তো নেই, তার ওপর গায়ে কালো রং লাগানো ছিল যাতে পাহারাদারদের চোখে না পড়ে। এ ছাড়া ছাদের পাঁচিলে বসানো আংটাগুলো খুঁটিয়ে দেখে আর একটা জিনিস আমার নজরে পড়ে।’
গুল-কাবাব শেষ করে ফ্লাস্ক থেকে কাপে চা ঢালে হেম।
‘কি দেখেছিলে?’
‘দেখেছিলাম সব ক-টা আংটাতেই একটা হালকা ধুলোর প্রলেপ রয়েছে, কেবল একটা ছাড়া। খুব সম্ভব হাওয়া ভেসে থাকা এয়ারশিপকে দড়ি দিয়ে ওই আংটার সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছিল।’
নিজের ঠোঁটে একটা সিগ্রেট লাগিয়ে নিয়ে আমার দিকে টিনটা বাড়িয়ে ধরে ধূর্জটি। টিন থেকে সিগ্রেট টেনে নিতে নিতেই প্রশ্ন করি,
‘কিন্তু এয়ারশিপ গঙ্গার ধারে মালগুদামেই পাওয়া যাবে তুমি জানলে কী করে?’
‘এয়ারশিপই পাওয়া যাবে জানতাম বললে সেটা বাড়িয়ে বলা হবে। এয়ারশিপ বা চোরাই টাকা পেয়ে যাওয়াটা আমাদের কপালের জোর। কিন্তু অনুমান করেছিলাম যে গঙ্গার পাড়ে চোরেরা কিছু একটা সূত্র ফেলে যাবে।’
‘কেন?’
মাথাটা পেছন দিকে হেলিয়ে সশব্দে ধোঁয়া ছাড়ে ধূর্জটি। নীলচে ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠে যায় কড়িকাঠের দিকে।
‘দেখো, কলকাতার আকাশে বিনা অনুমতিতে এয়ারশিপ ওড়ানোটা সহজ নয়। মহাযুদ্ধের সময় যে সব নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছিল সেগুলো সব এখনও বহাল আছে। এয়ারশিপ কারোর চোখে পড়লে হুলুস্থূল বেঁধে যাবে। লালবাজার থেকে একেবারে কাতারে কাতারে বেরিয়ে আসবে পুলিস। সুতরাং এয়ারশিপ যেখান থেকেই এসে থাকুক, জায়গাটা ইন্ডো-ব্রিটিশ ক্লকওয়ার্কসের অফিস থেকে বেশি দূরে নয়।
‘সে রকম জায়গা তো অনেকই আছে?’
‘হ্যাঁ, তা হয়তো আছে, কিন্তু এয়ারশিপ যেখান থেকে এসেছে, সেখানে এয়ারশিপটাকে লুকোনোরও একটা ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন।’
সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকায় হেম,
‘কী আশ্চর্য! এ কথাটা আমার মাথায় আসেনি কেন! ওল্ড কোর্ট হাউস স্ট্রিট থেকে স্ট্র্যান্ড রোড বেশি দূরে নয়, আর স্ট্র্যান্ড রোডের মালগুদামে একটা ছোট এয়ারশিপ লুকিয়ে রাখাটাও সহজ।’
মাথা নেড়ে সায় দেয় ধূর্জটি,
‘হ্যাঁ। এ ছাড়া আরও কয়েকটা সুবিধে আছে। গঙ্গা দিয়ে বজরায় মাল বওয়ার রেওয়াজ কমে যাওয়ার পর থেকে ওই রাস্তায় অনেকগুলো গুদাম পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। তা ছাড়া মাল ওঠা নামানোর সুবিধের জন্য গুদামগুলোতে গঙ্গার দিকে চওড়া দরজা বসানো থাকে—সেখান দিয়ে এয়ারশিপ ঢোকানো বা বার করাটাও সোজা।’
মুচকি হাসে হেম,
‘হ্যাঁ, কেবল দরজা দিয়ে না ঢুকিয়ে ভাঙা ছাদ দিয়ে নামতে যাওয়াটাই নিতাই হালদারের কাল হল। খোঁচা লেগে এয়ারশিপ ফুটো হয় গিয়ে প্রাণটা হারাতে হল। যাক, মামলাটা তাড়াতাড়ি মিটিয়ে দেওয়ার জন্যে তোমাকে আর এক প্রস্থ ধন্যবাদ। আজ উঠি। গিয়ে রিপোর্ট লিখতে বসতে হবে।’
বাধা দিল ধূর্জটি।
‘বলাই হালদার…’
‘বলাইয়ের কোনও খোঁজ পেলেই তোমাকে জানাব। এখন আসি।’
সিঁড়িতে হেমের জুতোর শব্দ মিলিয়ে যাবার পর খেয়াল করলাম, ধূর্জটি কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে মগ্ন হয়ে রয়েছে চিন্তায়। স্বভাবসিদ্ধ ভাবে তার তর্জনীটা টক্টক্ আওয়াজ তুলছে সিগ্রেটের টিনে।
হেসে ফেললাম।
‘এতো দেখছি জয় করে তবু ভয় কেন তোর যায় না। কেস তো মিটে গেল। আবার চিন্তা কীসের?’
ঘাড় নাড়ল ধূর্জটি।
‘না হে যতীন। অনেক প্রশ্নের উত্তর বাকি রয়ে গেছে। নিতাইয়ের মতো একজন সদ্য জেলছুট চোর কী করে একটা আস্ত এয়ারশিপ জুটিয়ে ফেলল, সে ক্যালরিকই বা কোথা থেকে পেল, বলাই হালদারের ভূমিকাই বা কী, এসবের উত্তর না পেলে কেসটা মিটে গেছে মন থেকে মেনে নিই কি করে। আর তা ছাড়া আরও একটা ব্যাপারে খটকা লাগছে।’
‘কোনটা?’
‘এয়ারশিপের ছেঁড়া জায়গাটা দেখে আমার মনে হয়েছিল ওটা কিছুর খোঁচা লেগে ছেঁড়েনি। ধারালো কিছু দিয়ে কাটা হয়েছে। না যতীন, আমার কেমন মনে হচ্ছে এ নাটক এখনও শেষ হয়নি। এর পরের অঙ্ক এখনও বাকি আছে।’